আলি খাদজালি থাকেন রাশিয়া-ইউক্রেনের সীমানা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের একটি শহর খারকিভে। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি ছয়টি স্বেচ্ছাসেবক দলের একটির সঙ্গে মানবিক সহায়তা এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিতে কাজ করছেন।
৩০ বছরের টগবগে যুবক খাদজালি। পরনে টুপি, হুডি এবং কার্গো প্যান্ট। মে মাসের মাঝামাঝি এক বিকেলে কাজের বিরতিতে আছেন। রুশ বাহিনীকে শহর থেকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে তীব্র গোলাবর্ষণে উত্তর শহরতলির অনেক জায়গা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
কামানের গর্জন এখনও এই নির্জন মহল্লায় প্রতিধ্বনিত হয়। মাঠের মধ্যে রঙিন দোলনাটি কীভাবে যেন এখনও অক্ষত।
খাদজালির জন্ম ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এই খারকিভে। মা ইউক্রেনীয়, বাবা সিরীয়। ২০১১ সালে সেখানে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় আগ পর্যন্ত নিয়মিত সিরিয়ায় আসা-যাওয়া ছিল তার। ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পরে রাশিয়া। দেশটির নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই মস্কোর হাতে।
খাদজালি বলেন, ‘আমার মাতৃভূমি ইউক্রেন এবং সিরিয়া। দুই দেশই রুশ আগ্রাসনের শিকার হয়েছে।’
যুদ্ধে যোগদান
২০১৫ সালের দিকে খাদজালি ইমাম হয়ে ওঠেন, যিনি যুদ্ধের মধ্যে আধ্যাত্মিক সেবা প্রদান দিয়ে থাকেন।
আগের বছর ময়দান রেভ্যুলেশন দেখেছিল ইউক্রেনীয়রা। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের রাশিয়াপন্থি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছিল দেশটির জনগণ।
বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নেয় প্রশাসন। নৃশংস এক ক্র্যাকডাউনে প্রাণ হারায় শতাধিক বিক্ষোভকারী, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়।
শেষ পর্যন্ত গদি ধরে রাখতে পারেননি ইয়ানুকোভিচ, তাকে উৎখাত করা হয়। এর পরই, রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদিরা দোনেস্ক এবং লুহানস্কের ডনবাস অঞ্চলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল।
ইসা আকায়েভ ক্রিমিয়া নামক একটি ব্যাটালিয়নের প্রধান এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইকে ক্রিমিয়াতে ফিরে যাওয়ার লড়াই হিসাবে দেখেন। ছবি: আল জাজিরা
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরু করলে খাদজালি তার দেশকে (ইউক্রেন) সাহায্য করার উপায় খুঁজছিল। এক সময় তার মনে হয়, ডনবাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অল্প সংখ্যক মুসলিম সেনারা হয়ত তাকে সমর্থন দেবে।
খাদজালি বলেন, ‘যুদ্ধরত একটি দেশে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী একটি ভূমিকা পালন করার চেয়ে ভাল উপায় কী হতে পারে?’
ইমাম হিসেবে নামাজে নেতৃত্ব দিতেন খাদজালি। হালাল খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেন। সেনাদের ধর্মীয় নির্দেশ, মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা এবং মানবাধিকার সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন।
তিনি বলেন, ‘সরল সেনাদের সঙ্গে কথা বলা আমার দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হতে পারে।’
খাদজালি এখনও এই দায়িত্বগুলো পালন করেন। তবে এখন তার দায়িত্ব আরও বেশি। প্রায়শই তাকে বিপজ্জনক ফ্রন্ট-লাইনে লোকেদের সাহায্য করতে হয়।
খাদজালি বলেন, ‘আমাদের কাছে সাহায্যের প্রয়োজন এমন লোকদের একটি তালিকা রয়েছে। আমরা তাদের প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা করি। যেমন, আমরা বয়স্ক ব্যক্তিদের ওষুধ দিই, যাদের এটি প্রয়োজন। পরিবারগুলোয় নিত্যপণের সরবরাহ দিয়ে থাকি।’
খারকিভের কয়েক সপ্তাহের বোমা হামলার বিধ্বস্ত কয়েকটি ভবন।ছবি: আল জাজিরা
৪ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার ইউক্রেনে খ্রিস্টানরাই সংখ্যাগুরু। ১ শতাংশ মুসলমানের বাস সেখানে। রাশিয়ার আক্রমণের পর এদের অনেকে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। অনেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবিচারের ইতিহাস তুলে ধরছে।
ইউক্রেনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠই ক্রিমিয়ান তাতার। তারা তুর্কি বংশোদ্ভূত সুন্নি মুসলিম। নিজ অঞ্চল ক্রিমিয়ায় ফিরে যেতে এরা লড়াই করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০১৪ সালে কৃষ্ণ সাগরের এই জায়গাটির দখল নেয় রাশিয়া।
ক্রিমিয়ান তাতার: অত্যাচারিত সাম্প্রতিক অতীত
ইউক্রেনে ইসলামের একটি দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে। কেবল ভ্রমণকারী ব্যবসায়ী বা ধর্মপ্রচারকদের হাতে এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়নি। এখানকার মানুষের হৃদয়ে আছে ইসলাম। ক্রিমিয়ার খানাতে ১৫ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ইসলাম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ছাপ রেখে গেছে।
ক্রিমিয়ান তাতারদের সাম্প্রতিক অতীতে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিন তাদের নির্বাসিত করেন। যাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল চেচনিয়া এবং ইঙ্গুতেটিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠী। বর্তমানে উত্তর ককেশাসের অঞ্চল দুটি রুশ প্রজাতন্ত্র। ১৯৪৪ সালে তাদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করা হয়।
খাদজালি খারকিভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেখেছেন তার মাতৃভূমি সিরিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। ছবি: আল জাজিরা
এখন চেচেন সেনারা রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে দুই পক্ষেই লড়ছে। এটা অনেকটা একটি যুদ্ধের মধ্যে ছোট আরেক প্রক্সি যুদ্ধের মতো। চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ পুতিনের অনুগত। তার সেনারা চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিয়েছে।
আবার ওদিকে ইউক্রেনের পক্ষেও যুদ্ধ করছে চেচেনদের একটি অংশ। তাদের বেশিরভাগই বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক। স্বাধীনতার জন্য দুটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিশোধ নেয়ার একটি সুযোগ এখন তাদের সামনে। লড়াইটা আসলে শুরু হয় ১৯৯৪ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলে এ লড়াই। যুদ্ধে রুশ বাহিনী চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল।
১৯৪৪ সালের ১৮ মে সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মি ক্রিমিয়া থেকে অক্ষ বাহিনীকে বিতাড়িত করার মাত্র কয়েকদিন পর ক্রিমিয়ান তাতারদের পুলিশ আটক করে। নাৎসিদের সহযোগিতার অভিযোগে তাদের তখন নির্বাসিত করা হয়। রেহাই পায়নি রেড আর্মিতে ক্রিমিয়ান তাতার এবং ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের নায়ক’ মর্যাদাপ্রাপ্তরাও।
ইসা আকায়েভ উজবেকিস্তানে একটি নির্বাসিত ক্রিমিয়ান তাতার পরিবারে বেড়ে ওঠেন। ছবি: আল জাজিরা
পরিবারগুলোকে একপ্রকার অবরুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বাধ্য হয়ে গরুর গাড়িতে চেপে তারা পাড়ি জমিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে; বেশিরভাগকে নির্বাসিত করা হয়েছিল উজবেকিস্তানে।
প্রায় দুই লাখ ক্রিমিয়ান তাতারকে সে সময় সরিয়ে নেয়া হয়। হাজার হাজার তাতার তখন নিহত হয়, অপুষ্টিতে ভুগেছিল অনেক মানুষ। খামার এবং কারাগারের মতো শ্রম শিবিরে তারা ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রম করত।
সোভিয়েত কালার
উজবেকিস্তানের সমরকন্দ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি যৌথ খামারে ক্রিমিয়ার তাতারদের অনেককে পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে এখন আছে ইউক্রেনে সেবারত একটি স্বেচ্ছাসেবক ইউনিটের কমান্ডার ইসা আকায়েভের পরিবার।
আকায়েভের বয়স ৫৭। লম্বা দাড়িওয়ালা ধার্মিক আকায়েভ ১৩ সন্তানের পিতা। রাজধানী কিয়েভে তিনি স্মরণ করেন ১৯৭০ এর দশকে উজবেকিস্তানে নির্বাসনের দিনগুলোর কথা, যেখানে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তখন আকায়েভের বয়স ছিল ১০। তরুণ উদ্যমী আকায়েভ সেময়ে স্কাউট আন্দোলনের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করেছিলেন।
আকায়েভ একটি সেনাশিবিরে যোগদানের জন্য তার জন্মভূমি ক্রিমিয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি সাংস্কৃতিক শোতে তার শিক্ষককে বলেছিলেন, তিনি তার ক্রিমিয়ান তাতার ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কিছু করবেন।
আকায়েভ যখন বিভ্রান্ত হয়ে উজবেকিস্তানে ফেরেন, সেখানে তিনি তার মায়ের কাছে যান। বিরক্ত হলেও মা তাকে ঘটনাটি উপেক্ষা করতে বলেছিলেন। তাদের কাছে সাম্প্রদায়িক নির্বাসন ছিল একটি দীর্ঘ চাপা অসন্তোষ।
তবে আকায়েভের দাদি অতীতের ঘটনা চেপে রাখতে পারেননি। তিনি তাকে পুরনো দিনের ঘটনা বলেছেন।
দাবি একবার লাল নিশানের স্কার্ফের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, যা তিনি গর্ব করে গলায় পরতেন। এটিকে ‘সোভিয়েত কলার’ বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। এরপর তিনি আর কখনও আকায়েভের সামনে এটি পরেননি।
আকায়েভ বলেন, ‘তিনি (দাদি) প্রায়শই ক্রিমিয়ার কথা বলতেন। সেখানকার সৌন্দর্য, প্রকৃতি এবং সমুদ্র উপকূল নিয়ে কথা বলতেন। বলতেন কীভাবে রুশ অভিজাতরা তাদের সঙ্গে অন্যায় করেছে।
ইউক্রেন এ নির্বাসনকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রাশিয়া ক্রিমিয়ান তাতারদের এ ইতিহাস মনে রাখতে দিতে নারাজ। ২০১৪ সালের ১৮ মে ক্রিমিয়ায় হাজার হাজার মানুষ নির্বাসনের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশে যোগ দিয়েছিল রুশ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে।
দেশে ফেরার লড়াই
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আকায়েভ ব্যবসা করতেন। সে সময়ে তিনি রাশিয়ান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন।
অপ্রস্তুত ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী সে সময় কোনো যুদ্ধ ছাড়াই উপদ্বীপ ছেড়ে দেয়। ইউক্রেনীয় নৌবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডের মতো অনেক কমান্ডার এমন আত্মসমর্পণ মেনে নিতে পারেননি।
আকিয়াভ বলেন, ‘সশস্ত্র প্রতিরোধে সমর্থন দেয়ার জন্য স্থানীয় ক্রিমিয়ান নেতাদের কাছে আবেদন করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এক সময় বুঝতে পারি, রুশ এজেন্টরা আমাকে অনুসরণ করছে।
‘এমন পরিস্থিতে মূল ভূখণ্ড ইউক্রেনে পালানোর সিদ্ধান্ত নিই। ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফেরোপল থেকে অনেকটা নাটকীয়ভাবে পালিয়ে যাই।
‘আমি সিমফেরোপল থেকে পরের স্টপেজের উদ্দেশে ট্রেনে চড়েছিলাম। তার আগে কাছের একটি দোকানের ফিটিং রুমে জামাকাপড় বদলে নেই। আমার সহকর্মী আমার পোশাক পরেছিলেন, কারণ যারা আমাকে অনুসরণ করছিল, তারা আমাকে পোশাকে চিনত। সে ওই পোশাকে আমার গাড়িতে উঠেছিল। আর আমি তার পোশাক পরে ফিটিং রুম থেকে বেরিয়ে আসি।’
আকায়েভ ও তার পরিবারের পাশপাশি ২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়া থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ৩০ হাজার ক্রিমিয়ান তাতারের জন্য এটি সেই নির্বাসনেরই পুনরাবৃত্তি।
আকায়েভ বলেন, ‘ঈশ্বর বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, যারা তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার জন্য এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা। আমাদের অবশ্যই ক্রিমিয়ায় ফিরে যেতে হবে। আমরা ফিরে যাবই।’
ক্রিমিয়া ছাড়ার কিছু পর আকায়েভ ডনবাসে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে লড়াই করার জন্য মুসলিম যোদ্ধাদের নিয়ে একটি ছোট দল গঠনে সাহায্য করেন।
ক্রিমিয়া স্কোয়াড
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার শুরুতে আকায়েভ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন যাতে তাকে দেখা যায় মুখোশ পরা অবস্থায় সশস্ত্র কমরেডদের মাঝে দাঁড়িয়ে। এ যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ না করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান আকায়েভ। যারা রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে অনেক জমি আছে, সবাইকে কবর দেয়ার জন্য যা যথেষ্ট।’
রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের শুরুতে আকায়েভের বিচ্ছিন্ন দলে প্রায় ১৫ জন যোদ্ধা ছিল। এখন প্রায় ৫০ জন মুসলিম ক্রিমিয়ান তাতার যোদ্ধা রয়েছে তার দলে।
আকায়েভ বলেন, ‘আমরা মূলত পুনর্জাগরণের কাজ করি। সদ্য মুক্ত অঞ্চলগুলোতে স্কাউট এবং চেকপয়েন্ট পরিচালনা করি।’
মার্চের শেষ দিকে রাশিয়ান বাহিনী কিয়েভের চারপাশ থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তার দলের সদস্যরা মোটিজিন গ্রামে প্রবেশ করে। সেখানে তারা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছে। গণকবর আবিষ্কার করেছে তারা।
আকায়েভ বলেন, ‘জঙ্গলে হাঁটতে গিয়ে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা এটি উদঘাটন করে। একজন যোদ্ধার তখন লক্ষ্য করে একটি হাত মাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। পা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার পর মরদেহ দেখতে পেয়েছিল আরেকজন। পরে আরও অনেক মরদেহের সন্ধান পাই।’
ইসমাগিলভের বয়স ৪৩। রাজধানী কিয়েভ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বুচারের বাসিন্দা তিনি। শহরটির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে রুশ সেনাদের বর্বরতার চিহ্ন। ২০১৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ডনবাস থেকে সেখানে চলে আসেন ইসমাগিলভ। ওই বছর তার শহর দখলে নেয় দোনেস্ক রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদিরা।
কিয়েভ অঞ্চল থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের পরের দিন ইসমাগিলভ তার অ্যাপার্টমেন্টে ফেরেন। দখলদার সেনারা ভবনটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে গিয়েছিল।
দীর্ঘ ১৩ বছর ইসমাগিলভ ছিলেন ইউক্রেনের অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম নেতা; দেশের সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের ইউক্রেনীয় ‘উম্মার’ মুফতি। মার্চে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি ইউক্রেনের টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দেন।
ট্রাকে করে সংঘাতময় ডনবাসে চিকিৎসকদের আনা-নেয়া এবং আহতদের সরিয়ে নেয়ায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন ইসমাগিলভ।
তিনি বলেন, ‘সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে দূরে কোথাও প্রার্থনায় চোখ বন্ধ করে থাকার চেয়ে অসহায়দের সেবা করাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে।’
অনলাইন ভিডিওতে পুতিনের ‘অন্যায় আগ্রাসনের’ নিন্দা জানানোর জন্য বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আবেদন করেছেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনকে সমর্থন করুন, তহবিল দিয়ে সমর্থন করুন, তথ্য দিয়ে সমর্থন করুন, সামরিকভাবে সমর্থন করুন।’
নিপীড়ন সব ক্রিমিয়ান তাতার পরিবারকে স্পর্শ করেছে
আকায়েভের মতো ইসমাইল রামাজানভের ক্ষেত্রেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধটি শুরু হয়ে গিয়েছিল রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর।
৩৬ বছরের ইসমাইল বলেন, ‘বড় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য আমরা ছোট মাতৃভূমি ছেড়েছি। আমি জানি একটি মুক্ত ইউক্রেন ছাড়া মুক্ত ক্রিমিয়া থাকবে না।’
রামাজানভ কিয়েভের কেন্দ্রে একটি ক্যাফেতে তার বন্ধু আনা ইসমন্তের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ক্রিমিয়ান তাতার পেস্ট্রি এবং চা খাচ্ছিলেন।
তিনি জানান, কীভাবে একজন কর্মী এবং সাংবাদিক হিসেবে তিনি ক্রিমিয়ার রাজনৈতিক বন্দিদের দুর্দশার বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গোপনে রাশিয়ান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারদের জামিনের অর্থ সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ফ্ল্যাশ মব আয়োজন করে থাকেন তিনি।
বেশিদিন নিজেকে আড়ালে রাখতে পারেননি রামাজানভ। ২০১৮ সালের জানুয়ারির এক ভোরে রুশ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) এজেন্টরা রামাজানভকে তার বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে একটি সাদা ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন তাকে ভীষণ পেটানো হয়। বিচারের অপেক্ষায় তাকে ছয় মাস জেলে কাটাতে হয়েছে।
রামাজানভ বলেন, ‘এফএসবি এজেন্টরা আমার বাড়িতে পিস্তলের কার্তুজ এবং চরমপন্থি বই রেখে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল। স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করার জন্য আমার বিচার করতে চেয়ছিল।’
আনা ইসমন্ট ইউক্রেনীয় সৈন্যদের জন্য পণ্য সংগ্রহ এবং তহবিল সংগ্রহ করছেন। ছবি: আল জাজিরা
খারকিভ হিউম্যান রাইটস প্রোটেকশন গ্রুপের মতে, এ ধরনের কৌশলগুলো রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের সমালোচনার একটি সাধারণ প্রতিক্রিয়া। দখলের পর অপহরণের ঘটনা নিয়মিত হয়ে ওঠে। কাউকে চুপ করানোর জন্য পুরো পরিবারকে হয়রানি করা হয়েছে, ভয় দেখানো হয়েছে। ২০২২ সালের মে পর্যন্ত ১২৩ জন নথিভুক্ত ক্রিমিয়ান রাজনৈতিক বন্দি ছিল। এদের ৯৮ জনই ক্রিমিয়ান তাতার।
রামাজানভ বলেন, ‘এমন কোনো ক্রিমিয়ান তাতার পরিবার নেই, যাকে রুশ দমন-পীড়ন স্পর্শ করেনি।’
আইনে সামান্য পরিবর্তনের ফলে রামাজানভের আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত তার গ্রেপ্তারের এক বছর পর তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে পারেন। এরপর তিনি ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে চলে যান।
সেনাদের জন্য ড্রোন সোর্সিং
ইসমন্তও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। ২৬ বছর বয়সী লাজুক প্রকৃতির ইসমন্ত হিজাব পরে পণ্য সরবরাহ এবং তহবিল সংগ্রহ করেন। ১৮ বছর বয়সে ময়দান রেভ্যুলেশনের সময় থেকেই তিনি একজন কর্মী।
ইউক্রেনভিত্তিক সাহায্য সংস্থা অ্যানোমালির মাধ্যমে কাজ করেন তিনি। সক্রিয়ভাবে চিকিৎসা সরবরাহ, যানবাহন, খাদ্য, ড্রোন, থার্মাল ইমেজিং ডিভাইস এবং সেনাদের জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে থাকেন এ তরুণী।
ইসমন্ত বলেন, ‘চেরনিহিভের সেনাদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার কিট পাঠিয়েছিলাম। যখন আমি কিটের সঙ্গে তাদের ছবি দেখেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল আমিও তাদের অংশ।’
ময়দান রেভ্যুলেশনের সময় সহকর্মীদের মতো ইসমন্তও ইউক্রেনের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনে আগ্রহী ছিলেন। সে সময় তার এক ঘনিষ্ঠ মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যিনি পরে ডনবাসে যুদ্ধে মারা যান। গত বছর ইসলামে ধর্মান্তরিত হন ইসমন্ত।
ময়দানে সহিংসতা যখন চরম পর্যায়ে, তখন তার বন্ধু তাকে ‘কিছু’ সংগ্রহ করতে স্কোয়ার থেকে অনেক দূরে পাঠিয়েছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন, বন্ধু তাকে বিপদ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন।
শৈশবের বেশিরভাগ সময় ক্রিমিয়াতে কাটলেও এটি দখল হয়ে যাওয়ার পর ক্রিমিয়ান তাতার পরিবারগুলোকে সমর্থন করার জন্য ক্রিমিয়ান তাতার সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়েছিলেন ইসমন্ত।
তিনি বলেন, ‘আমি ক্রিমিয়ার বেশ কয়েকটি পরিবারকে কিয়েভের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছি।’
এই ধরনের একটি কোর্সের মাধ্যমেই তার দেখা হয়েছিল রামাজানভের সঙ্গে। সক্রিয়তা এবং স্বেচ্ছাসেবক কাজের মাধ্যমে দুজনের একটি দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়।
ইসমন্ত এবং রামাজানভ তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্টগুলোতে অনুদানের জন্য ঘন ঘন আবেদন করে থাকেন। ইদানিং তাদের ঝোঁক ড্রোন সরবরাহের দিকে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এখন অবধি আনা খেরসন, মাইকোলাইভ, জাপোরিজিয়া, ইজিয়াম এবং এর আগে মারিউপোলের আশেপাশের ব্যাটালিয়নে ড্রোন পাঠিয়েছেন তারা।
যারা ফিরে এসেছে
ক্রিমিয়ায় রুশ শাসন এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত শাসনে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের ফলে এ উপদ্বীপের রূশ রূপান্তর ঘটে। নির্বাসনে পাঠিয়ে ক্রিমিয়ান তাতারদের বাড়িগুলোকে খালি করিয়েছিল রুশ অভিবাসীরা। জাতিগত রুশরা এখনও সেখানে সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। তারপর যথাক্রমে ইউক্রেনীয় এবং ক্রিমিয়ান তাতাররা, যারা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কিছু বেশি।
সোভিয়েত নিপীড়নের স্মৃতি এখনও অনেক ক্রিমিয়ান তাতারকে তাড়া করে। স্তালিনের যৌথ শাস্তির পর পুতিনের অধীনে নিপীড়নের ইতিহাস একটি নতুন অধ্যায় মাত্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর জন্মগ্রহণকারী অল্পবয়সী ক্রিমিয়ান তাতারদের কাছে সেই ক্ষত এখনও কাঁচা। নির্বাসিত চেচেন সম্প্রদায়গুলোকে চেচনিয়া ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলেও ক্রিমিয়ান তাতারদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি ৪৫ বছরেও।
ইসমাইল কার্ট-উমের ১৯৯১ সালে ক্রিমিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি বেড়ে ওঠেন প্রাচীন খানাতের রাজধানী বাখচিসারাইতে।
অনেকের মতো কার্ট-উমের কাছে জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন শক্ত চ্যালেঞ্জের। তাদের জন্মভূমিতে বিদেশিরা আবাস গেড়েছে। এসব বিদেশিদের কাছে তারা এখন বিশ্বাসঘাতক।
কার্ট-উমার বলেন, ‘অন্যান্য ক্রিমিয়ান আমাদের প্রত্যাবর্তনকারীদের প্রতি খুব বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করতে পারে। অনেকেই আমাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখে।’
ইসমাইল কার্ট-উমেরের সামরিক জোটে গায়ক হিসেবে ভূমিকা সেনাদের মনোবল চাঙা রাখতে সাহায্য করছে। ছবি: আল জাজিরা
কার্ট-উমের এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন, যখন সমাজ থেকে কুসংস্কার ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। প্রবাসের কষ্টের গল্প শুনে বড় হয়েছেন তিনি।
কার্ট-উমের দাদা সোভিয়েত রেড আর্মির সদস্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে কেটেছে তার। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পর ক্রিমিয়া ছাড়ার জন্য তাকে মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছিল সোভিয়েত সরকার। কার্ট-উমেরের বাবাকে আফগানিস্তান যুদ্ধে পাঠিয়েছিল সোভিয়েত শাসকরা।
২০১৪ সালে কার্ট-উমর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের প্রশিক্ষিত গায়ক হিসেবে।
কার্ট-উমার বলেন, ‘প্রত্যেকেরই এখন কর্তব্য আছে। আমার বন্দুক নাও থাকতে পারে। তবে আমি অন্যভাবে অবদান রাখি।’
ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের জন্য গান
ইসমন্তের মতো কার্ট-উমেরও জন্ম ময়দান রেভ্যুলেশনের সময়ে। বেশ কয়েক বছর তিনি ওই বিদ্রোহের স্মরণে অনুষ্ঠানগুলোতে গান গেয়েছেন।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে কার্ট-উমের বিভিন্ন জায়গায় তার ব্যান্ডের সঙ্গে ভ্রমণ এবং পারফর্ম করছেন। তিনি তার ভূমিকাকে মনোবল গড়ে তোলা এবং মানুষের হৃদয়ে ইউক্রেনীয় জাতিয়তার বোধ জাগানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখেন।
গানের আসরে কার্ট-উমেরকে একজন ক্রিমিয়ান তাতার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এতে তিনি ও তার দল যে অভ্যর্থনা পান, তাতে তারা অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হন।
স্বাধীনতার যুদ্ধ
ইউক্রেনের ধর্মীয় সহনশীলতা ও উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের আকৃষ্ট করেছে। দেশপ্রেমবোধ তাদের মধ্যে অনেক তীব্র।
আকায়েভ বলেন, ‘ইউক্রেন এমন একটি দেশ, যেটি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে।’
ক্রিমিয়ান তাতার এবং অন্যান্য যারা রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছে, তারা এই যুদ্ধের ঝুঁকি জানে।
ইসমাগিলভ বলেন, ‘মুসলিমরা ভাল করেই জানে রাশিয়া তাদের ভূখণ্ড (ইউক্রেন) দখলে নিলে কী ঘটবে। এটি রাশিয়া-অধিকৃত ক্রিমিয়ার মতোই হবে, যেখানে মুসলমানদের গুম করা হয়, জেলে পুরে রাখা হয়।’
খাদজালির জ্যাকেটের চিহ্ন তাকে একজন স্বেচ্ছাসেবক ইমাম হিসেবে চিহ্নিত করে। ওপরের লেখাটি ‘ইমাম চ্যাপলিন’, নীচে ‘ইউক্রেন’ লেখা। ছবি: আল জাজিরা
খাদজালি এবং অন্যদের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ সমাজের প্রতীক। ইসমন্ত বলেন, ‘একসঙ্গে থাকলেই আপনি জিততে পারবেন, বেঁচে থাকতে পারবেন। আমাদের ইউক্রেনীয়দের এই অভাব ছিল। একটি জাতি হিসেবে আমরা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সূচনার মাধ্যমে তা উপলব্ধি করেছি। আমরা এখন ঐক্যবদ্ধ।’
আরও পড়ুন:গত বছরের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আনিকা মেহেরুন্নেসা শাহি। তার ইচ্ছা ছিল এলাকায় বিচারক হয়ে ফেরার; ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার। সে ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে সোমবার লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এ ছাত্রী।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি ছাত্রীনিবাস থেকে রবিবার রাতে ঝুলন্ত অবস্থায় আনিকাকে উদ্ধার করে নিউ মার্কেট থানা পুলিশ। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান।
আনিকার বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামে। সেখানে সোমবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, তার শতবর্ষী দাদা আলহাজ সোলাইমান আলী মণ্ডল হতভম্ব হয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন। কান্না থামছিল না ফুফু আক্তার বানুর।
আনিকার এমন মৃত্যুতে বিস্মিত পরিবারের সদস্য ছাড়াও প্রতিবেশীরা চেয়েছেন ঘটনার রহস্য উদঘাটন।
পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ হোসেনের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন আনিকা মেহেরুন্নেসা শাহি। ২৪ বছরের এ তরুণী ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ২০২০-২১ সেশনে ভর্তি হন ঢাবির দুর্যোগ বিজ্ঞান ও স্থিতিস্থাপকতা বিভাগে।
এ বিভাগের পড়াশোনা শেষ করে আইনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিচারক হতে চেয়েছিলেন আনিকা।
গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নওগাঁয় সম্মুখসারিতে ছিলেন আনিকা। পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলায় মাইক হাতে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে সড়কে দাঁড়ান তিনি।
সুষ্ঠু তদন্ত দাবি
পরিবারসহ এলাকাবাসীর দাবি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আনিকার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হোক।
বকুল নামের একজন মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখি আনিকার মরদেহ ফ্যানের সাথে ঝুলছিল, কিন্তু অর্ধেক মেঝেতে লেগে ছিল। আমার জানা মতে একটা ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল।
‘আমরা ঢাকায় আছি। তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। তবে আমরা যখন যাই, তখন দেখি লক ভাঙা ছিল। মনে হয় তাকে কেউ নামানোর চেষ্টা করেছিল।’
বুটেক্স ছাত্র আটক
আনিকার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) এক ছাত্রকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
বাহিনীর ধারণা, প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন ঢাবির এ ছাত্রী। তবে এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:নওগাঁয় অনিয়ম করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিইসি) বীজ ও সারের ডিলারশিপ নিয়েছেন সরকারি কলেজের প্রভাষক ও কৃষি কর্মকর্তা। তাদের স্বজনদেরও একই সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন তারা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ অনুসারে, একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে অন্য কোথাও থেকে কোনো ধরনের সুযোগ- সুবিধা নেওয়ার বিধান নেই। একই সঙ্গে একজন ব্যক্তি একের অধিক ডিলারশিপ নিতে পারবেন না।
অন্যদিকে আচরণ বিধিমালার ১৭ (১) নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘এই আইনের অন্য বিধান অনুসারে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না অথবা দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো কাজ কিংবা চাকরি নিতে পারবেন না।’
অনিয়মে যুক্তদের ভাষ্য
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ী নওগাঁতে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ফজলে রাব্বি। তিনি তার স্ত্রী সম্পা বেগমের নামে বিএডিসির বীজের লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে কৌশলে ডিলারশিপ বিক্রি করে খাচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নওগাঁ শহরে বসবাস করলেও তারা পোরশা উপজেলায় ‘সাইফ ট্রেডার্স’ নামের ঠিকানা ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়ে রেখেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্পা বেগম তার নামে লাইসেন্স স্বীকার করে বলেন, ‘আমি নওগাঁ বসবাস করলেও পোরশায় আমার দোকান রয়েছে। ওখানে একটি ছেলে আছে। সে দোকান চালায়।’
দোকানের ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী রাব্বি নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে চাকরি করেন। তিনি সব বলতে পারবেন।’
সাইফ ট্রেডার্স নামের কোনো দোকান পোরশা বাজারে পাওয়া যায়নি। দোকানের সঠিক ঠিকানা কোথায় জানতে চাইলে সম্পা কোনো সদুত্তর না দিয়ে কথা না শোনার ভান করে ফোনের সংযোগ কেটে দেন। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফজলে রাব্বির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই লাইসেন্সটা আমার স্ত্রী সম্পার নামে করা আছে।’
নিয়মিত বীজ তোলেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাই অফিসে আসেন, চা খেয়ে যান। আপনাদের অনেক সাংবাদিক আসে; চা খেয়ে যায়।
‘সবার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আপনি অফিসে আসেন, চা খেয়ে যান।’
ওই বক্তব্যের পর সংযোগটি কেটে দেন তিনি।
এদিকে জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার মেসার্স জিমান ট্রডার্স নামে নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ফারুক হোসেন নিয়ে রেখেছেন বিএডিসির সার লাইসেন্সের ডিলারশিপ। প্রোপাইটারে জায়গায় রয়েছে তার নিজের নাম।
তার ছেলে জিমানের নামে নিয়ামতপুর বাজারে রয়েছে দোকান। নিয়মিত বিএডিসির সার ও বীজ তুলে বিক্রি করেন তিনি।
এ বিষয়ে নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘লাইসেন্সটা অনেক আগে করা ছিল। তখন আমার কলেজ সরকারি হয়নি। ২০১৮ সালে আমার কলেজ সরকারি হয়েছে।’
‘তাহলে দীর্ঘ সাত বছর ধরে সরকারি ডাবল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। এটার সুযোগ রয়েছে কী?’
উল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই একাধিক জায়গা হতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা আমার অন্যায় হয়েছে। আমি তিন মাস আগে ডিসি অফিসে লাইসেন্স বাতিলের আবেদন জানিয়েছি।’
এদিকে ধারাবাহিকভাবে গত মাসেও সরকারি গুদাম থেকে সার তুলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সটা আমার ছেলের নামে হস্তান্তর করা হবে। তার প্রক্রিয়া চলছে।’
অপরদিকে ধামইরহাট উপজেলার ধামইরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক তৌহিদুল ইসলাম তার নিজ নামে নিয়ে রেখেছেন বিসিআইসির সার ডিলারশিপ। সরকারি গুদাম থেকে নিয়মিত সার তুলে উপজেলার আমাইতাড়া বাজারে বিক্রি করছেন তিনি।
এ বিষষে জানতে ধামইরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক তৌহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আসলে ওটা অনেক আগে করা হয়েছিল। পরে আমার কলেজ সরকারীকরণ হয়।
‘সরকারি একাধিক জায়গা হতে সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি বেআইনি হয়েছে। আমি লাইসেন্সটা ট্রান্সফার করে দেব।’
‘আপনি তো এখনও নিয়মিত সার তোলেন।’ এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘আসলে এখন ইরি-বোরো মৌসুম চলছে তো। তাই একটু তুলতেছি।’
যা বলছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা
ডিলারশিপের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে বিএডিসি কিংবা বিসিআইসির ডিলারশিপ লাইসেন্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা এটা করতে পারে না।’
‘আপনার অধিদপ্তরে এমন অনেকে রয়েছে। তাহলে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?’
এমন প্রশ্নে প্রোগ্রামের ব্যস্ততার কথা বলে ফোন লাইন কেটে দেন এ কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ইউএনও, কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে জেলা কমিটিকে প্রস্তাব পাঠাই। তারপর অনুমোদন দেওয়া হয়।
‘সরকারি চাকরি করে বিএডিসি কিংবা বিসিআইসির ডিলারশিপ লাইসেন্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পূর্ব অনুমতিও নিতে পারত এ ক্ষেত্রে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িতে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অজ্ঞাত মুখোশধারীরা গত রবিবার রাতের বেলায় জমিদার বাড়ির পুরোহিতকে ধরে নিয়ে জঙ্গলে বেঁধে রাখে। টাকা-পয়সা এবং জমিদারেরও খোঁজ করে তারা।
এমন পরিস্থিতিতে ডাকাত আতঙ্কে রয়েছেন বাড়ির লোকজন।
মুখোশধারীরা ঘণ্টা তিনেক ধরে বাড়িটির বিভিন্ন কক্ষ ও আশপাশে তল্লাশি চালানোর কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
এতে দেখা যায়, রবিবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে জমিদার বাড়ির পুরোহিত বাদল ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী নেলী চক্রবর্তী ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে দুজন মুখোশধারী ধরে জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে পুরোহিতকে বেঁধে ফেলে।
জমিদার বাড়ির পুরোহিত বাদল ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাতে ঘুমানোর আগে স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়েছিলাম। এর মধ্যেই দুজন মুখোশধারী আমাদেরকে ধরে বাড়ির পাশে জঙ্গলে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। এ সময় মুখোশধারীরা জমিদার কোন ঘরে জানতে চায়। সিন্দুকের খোঁজও চায় তারা।
‘বাড়ির তিন তলায় ওঠার চেষ্টাও করে। ঘণ্টা তিনেক ধরে বাড়িটির বিভিন্ন কক্ষ ও আশেপাশে তল্লাশি চালায়।’
বাড়ির কেয়ারটেকার স্বপন সাহা বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবত জমিদার বাড়িতে চাকরি করছি। দেশের বিভিন্ন জায়গার লোকজন এখানে ঘুরতে আসেন। পুরো বাড়ি তাদের ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করি।
‘কিন্তু অতীতে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। এই ঘটনার পর থেকে বাড়ির লোকজন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।’
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িটিতে জমিদারের একমাত্র শেষ বংশধর মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী বসবাস করছেন। নিঃসন্তান ব্যক্তিটির স্ত্রী কিছুদিন আগে লোকান্তরিত হন। বাড়িটিতে বর্তমানে তিনি ছাড়া কয়েকজন কর্মচারী ও পুরোহিত অবস্থান করছেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে বাড়িটিতে অজ্ঞাত কয়েকজন মুখোশধারী হানা দেয়। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে চারজনকে দেখা যায়।
বাড়ির মালিক মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী বলেন, ‘মুখোশধারীরা হয়তো ধনদৌলত নিতে কিংবা আটকে রেখে টাকা-পয়সা দাবি করতে চেয়েছিল। তবে বাড়ির লোকজন সজাগ হয়ে যাওয়ার মুখোশধারীরা সেটা করতে পারেনি।’
জানতে চাইলে হোসেনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মারুফ হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন:বিনা নোটিশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, বগুড়ার আকস্মিক উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছে।
এ ধর্মঘটে বুধবার সকাল ৮টা থেকে নওগাঁর সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রয়েছে, যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন চালকরা।
কী বলছেন ভুক্তভোগীরা
যানবাহন না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী লোকজনও। তাদের একজন বেসরকারি সিম কোম্পানির কর্মী আল-আমিন।
তিনি বলেন, ‘বাসা থেকে সকাল সাড়ে আটটায় মোটরসাইকেল নিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে তেল শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আধা কিলোমিটার ঠেলে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় পেট্রল পাম্পে নিয়ে আসি।
‘পাম্প বন্ধ থাকায় আবার ঠেলে নিয়ে চলে যেতে হয়। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
আবদুল মান্নান নামের এক বাইকচালক বলেন, ‘আমি জানতাম না পেট্রল পাম্প মালিকদের ধর্মঘট চলছে। পেট্রল পাম্পে এসে দেখি পাম্প বন্ধ। তেল দেওয়া হচ্ছে না।
‘এখন তেল ছাড়া আমরা কীভাবে চলি? আগে জানানো হলে তাও সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ে অবস্থিত মেসার্স সাকিব ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকেই অফিসগামী মোটরসাইকেল আরোহী ও জ্বালানিচালিত বিভিন্ন যানবাহনগুলো পাম্পে এসে বন্ধ থাকায় ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যানবাহন চালকদের। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান চান যানবাহন চালকরাও।
‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সকল পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই আমাদেরও বন্ধ রাখতে হয়েছে।’
প্রেক্ষাপট
পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহীর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়কে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সওজ বগুড়া। ওই সময় সান্তাহারের হামিম ফিলিং স্টেশন ও আনিকা ফিলিং স্টেশনে তেলের মিটার উচ্ছেদ করা হয়।
তারা জানান, পূর্বঘোষণা, নোটিশ বা আনুষ্ঠানিক চিঠি না দিয়ে এ উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ ট্রেন ব্যবহার করেন। হঠাৎ করে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার সুযোগে বাসের ওপর বাড়তি যাত্রীর চাপ বেড়েছে। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বাসের টিকিটের মূল্য বেড়ে গেছে।
খুলনা থেকে নওগাঁ যাওয়ার জন্য সকালে রেলওয়ে স্টেশনে এসেছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।
তারা জানান, খুলনা থেকে নওগাঁ যেতে তারা সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে কোনো টিকিট পাননি। বাসে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তাতে ভাড়া গুনতে হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এ পথে নিয়মিত ভাড়া ৫০০ টাকার বেশি নয়।
শ্রমিকদের একজন সান্তনু বলেন, ‘সকাল থেকে আমরা কয়েকজন এখানে এসে বসে আছি। কয়েকজন গিয়ে বাসের খোঁজ নিয়েছে; কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
‘অতিরিক্ত ভাড়ায় আমরা যেতে পারছি না। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি ট্রেন চালু হয় কি না। না হলে সন্ধ্যার দিকে বাসে করে রওনা দেব।’
সান্তনুর মতো অনেক দূরপাল্লার যাত্রীকে খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা বাসে করে গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন।
খুলনা থেকে উত্তরবঙ্গে দৈনিক একাধিক ট্রেন যাতায়াত করে। এর মধ্যে কপোতাক্ষ ও সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস খুলনা থেকে রাজশাহী, রূপসা ও সীমান্ত এক্সপ্রেস খুলনা থেকে চিলাহাটি, মহানন্দা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রকেট এক্সপ্রেস খুলনা থেকে পার্বতীপুর, নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট, বেনাপোল ও মোংলা কমিউটার খুলনা থেকে বেনাপোল যাতায়াত করে।
এ ছাড়া সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে ঢাকাতে যাতায়াত করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে এর মধ্যে কোনো ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়নি। ফলে হাজার হাজার হাজার যাত্রী স্টেশনে এসে ফিরেছেন।
রেলওয়ের রানিং স্টাফরা মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে এ সুবিধা সীমিত করা হয়।
ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত বুধবার রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ২৭ জানুয়ারির মধ্যে দাবি পূরণের আলটিমেটাম দেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন তারা।
খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সোমবার রাত ১২টা থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ। আজ কোনো ট্রেন চলেনি। টিকিট বুকিং দেওয়া যাত্রীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
এ সমস্যার সমাধান কবে হবে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন:দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে নব্বইয়ের দশকে নির্মিত ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি।
এমন পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালতে কর্মরতদের।
সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থদের অবহিত করে গণপূর্ত বিভাগের ঝালকাঠি অফিস ২০১৯ সালে চিঠি চালাচালি করলেও বিষয়টি এখনও ফাইলবন্দি।
ভবনটি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই সংস্কার অথবা পুনর্নির্মাণের দাবি আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর জরাজীর্ণ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ৫ নভেম্বর বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবর পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠান।
ভবন পরিদর্শনকালে তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলী, গণপূর্তের ঝালকাঠির নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ উপস্থিত ছিলেন। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা।
কী ছিল পরিদর্শন কপিতে
ঝালকাঠি গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী অনিরুদ্ধ মন্ডল, মো. বদরুজ্জামান, মো. ইমরান বিন কালাম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল-মাসুম স্বাক্ষরিত ওই পরিদর্শন কপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ভবনটির দুই তলায় করিডোরের বেশ কিছু স্থানে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়ছে। এ ছাড়াও নলছিটি কোর্ট রুমের পরিদর্শনকারীদের বসার ওপরের ছাদের অংশ খসে পড়েছে। এ সমস্ত স্থানে মরিচা পড়ে রড উন্মুক্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় তলা এবং নিচ তলার করিডোরের বেশ কিছু বিম ও কলামে ফাটল লক্ষ করা গেছে।
‘ভবনটির নিচ তলায় হাজতখানার ছাদের বেশ কিছু অংশসহ করিডোরের বিভিন্ন অংশে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়েছে। এসব স্থানেও মরিচা পড়ে রড বের হয়ে আছে। নিচ তলার বিভিন্ন কলাম এবং বিমের ফাটল লক্ষ করা গেছে। কিছু স্থানে কলাম ফেটে রড বের হয়ে গেছে।’
পরিদর্শন প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ‘ভবনটির দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ১৯৮৯-৯০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ২০০৪-০৫ সালে তৃতীয় তলার উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে বিম কলামে ফাটল থাকায় এবং ছাদের কনক্রিট খসে পড়ায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
‘এমতাবস্থায়, উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত ডিজাইন বিভাগের মতামতসহ পরবর্তী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রয়োজন।’
প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ
সম্প্রতি জজ আদালত ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনের ছাদের ওপর থেকে খসে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে অনেক পিলারেও। ভারি বৃষ্টি এলেই ছাদ ও দেয়াল চুষে পানি পড়ে মেঝেতে। নষ্ট হয়ে যায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র।
দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় তিন তলা ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিচারকের এজলাস, খাসকামরা, পেশকার, সেরেস্তাদারের কক্ষ, নকল কক্ষ, হাজতখানাসহ প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই চলছে আদালতের কার্যক্রম। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
যা বলছেন আদালত সংশ্লিষ্টরা
আদালতের জরাজীর্ণ অবস্থার বিষয়ে কথা হয় আবদুর রহমান, তৈয়ব আলী, কামরুল ইসলাম, মুরাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে।
তাদের একজন বলেন, ‘আদালত ভবনের ভিতরে প্রবেশের পর কার্যসম্পাদন করে বের হওয়া পর্যন্ত আমরা থাকি আতঙ্কে। প্রায় সময়ই ছাদের পলেস্তারা খসে নিচে পড়ে।
‘বর্ষায় তো বারান্দায় পানি জমে যায়। দেয়ালে পানি চুষে অনেক ফাইল নষ্ট হয়ে যায়।’
আইনজীবী মানিক আচার্য্য বলেন, ‘ভবনটি ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তার সংস্কার করছে না কর্তৃপক্ষ। বিচারকরা যদি ভালো পরিবেশে বিচারকার্য পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে বিচারকার্যে মনোনিবেশও করতে পারেন না।
‘ঝালকাঠির বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীসহ সকলেই আমরা এ ভোগান্তিতে রয়েছি। বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থদের বিষয়টি অবগত করলেও এখনও কোনো ভূমিকা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’
আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট ফয়সাল বলেন, ‘ড্যামেজড ভবনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা এবং নতুন ভবন নির্মাণ অথবা টেকসই সংস্কারের জন্য গণপূর্তের চিঠি চালাচালি হলেও দীর্ঘদিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাইনি। জনস্বার্থে দ্রুত নতুন আদালত ভবন নির্মাণ জরুরি।’
আইনজীবী আক্কাস সিকদার বলেন, ‘বর্তমানে এ আদালতে ১৬ হাজার দেওয়ানি মামলা এবং দেড় হাজার ফৌজদারি মামলা চলমান। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আদালত ভবনের নিচ তলায় হাজতখানার পশ্চিম দিকে মসজিদের সামনে একাধিকবার ধসে পড়েছে ছাদের অংশ। এখন এই ভবন অস্থায়ী সংস্কার না করে এটি ভেঙে এখানে নতুন ভবন করা উচিত।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘নব্বই দশকে দোতলা জজ আদালত ভবনটি নির্মাণের পর ২০০৬ সালে এর ওপর আরও এক তলা বর্ধিত করে তৃতীয় তলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে নিচ তলার অনেক পিলারে ফাটল ধরেছে। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আদালতের স্টাফ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা রয়েছেন আতঙ্কে।
‘হাজতখানা সরিয়ে পার্শ্ববর্তী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনে নেওয়া হয়েছে। ভবনে আগতদের নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দ্রুত এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।’
জরাজীর্ণ ভবনের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ ঝালকাঠির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়সাল আলম ও বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আমানুল্লাহ সরকার একই ধরনের বক্তব্য দেন।
তাদের একজন বলেন, ‘ভবন পরিদর্শনের রিপোর্ট ২০১৯ সালে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন ভবনের জন্য সম্ভাব্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে আছে।
‘সেখান থেকে অর্ডার হলেই গণপূর্ত বিভাগ টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যসম্পাদন করবে।’
ক্যাপশন: ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের ভেতরের জরাজীর্ণ অংশ। ছবি: নিউজবাংলা
আরও পড়ুন:ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আওয়ামী লীগের পলাতক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানকে কৌশলে পুনর্বাসনের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীসহ স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক ও কিছু ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট এ ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
জনসেবা অব্যাহত রাখতে নিয়ম অনুসারে ইউপি সদস্য সুমন রানাকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ করে বাকি প্যানেল গঠন করা হয়।
বর্তমানে ইউপিতে নাগরিক সেবা অব্যাহত থাকলেও প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কৌশলে অনাস্থা এনে এরশাদ আলীসহ অন্যরা পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় আছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি কৌশল জানাজানি হলে ইউনিয়নবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতায় যেকোনো সময় ওই ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের ‘কৌশল’
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রথমে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক বরাবর শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব এনে একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ৯ জন ইউপি সদস্য।
পরে সেই আবেদনের জের ধরে ১৩ জানুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডের পাতায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ মো. এরশাদ আলী স্বাক্ষরিত এক পাতার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের রেজুলেশন ও অপর একটি পাতায় আটজন ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত পাতা সংযুক্ত করা হয়। এ পাতায় সভার স্থান দেখানো হয় ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে।
ওই রেজুলেশনে বলা হয়, ‘অদ্যকার অত্র আলোচনায় শুকানপুকুরী ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে ইউপির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সভায় বিস্তর আলোচনা করা হয়। এরপর সভার সভাপতি প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীর উপস্থিতিতে সদস্যদের জানান, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্বেচ্ছাচারিতা করে আসছেন, যা জেলা প্রশাসকের বরাবরে অনাস্থার প্রস্তাব আনয়ন করি।
‘তাই ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখা একান্ত জরুরি মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
রেজুলুশনে উল্লেখ করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে পলাতক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পরিষদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা নিয়ে দুই ইউপি সদস্যের ভাষ্য
কারণ জানতে এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করা দুজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে। তারা হলেন মো. আমজাদ ও ধর্ম নারায়ণ রায়।
ইউপি সদস্য আমজাদ বলেন, ‘৪ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে আমার বাড়ির সামনে স্থানীয় সাবেক দুজন সদস্য মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। তারা আমাকে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি অন্যান্য ইউপি সদস্যরাসহ বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত। রাতের খাবারের বিশাল আয়োজনও করা হয়েছে। আমি কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
‘পরে জানানো হলো, আমাকে বর্তমান প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে স্বাক্ষর করতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। তিনি খুব ভালোভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এসবই আলোচনা হচ্ছে। এরপর এক প্রকার জোর করেই আমাকে রাতের খাবার খাওয়ানো হলো এবং পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করতে হলো। কিন্তু আমি সিলমোহর দিইনি।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘একই তারিখে স্থানীয় বাসিন্দা তোষর এবং রফিকুল আমাকে একটা জায়গায় সমস্যার কথা বলে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিএনপির অন্যান্য রাজনীতিক নেতাসহ অন্যান্য ইউপি সদস্যরা রয়েছেন। আমাকে রাতের খাবারের জন্য বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারণে এত আদর-আপ্যায়ন, বুঝতে পারছিনা। জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর পাই না।
‘সমাজ রক্ষার্থে সকলের সাথে রাতের খাবার খেলাম। এরপর আমাকে এক প্রকার চাপ দেওয়া হয় প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু আমি তার সমর্থক। তিনি ভালো মানুষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাক্ষর দিতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাক্ষর করেছে। আমি কেন করব না, এ কথা তোলে। অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর সই করে সেখান থেকে আসতে হয়েছে। পরে আমি লিখিত চিঠি দিয়ে বিষয়টি প্যানেল চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।’
ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ভবেষ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে অনাস্থা আনা হয়েছে, তা আমার কাছে ভিত্তিহীন মনে হয়েছে।’
সচিব আরও বলেন, ‘পরিষদে তিনি (সুমন রানা) সবার সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন এবং নাগরিক সেবা অব্যাহত রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে আমাকেও কেউ কোনো দিন কোনো মৌখিক অভিযোগ দেননি।’
সভার বিষয়ে যা বললেন ইউপি সচিব ও সদস্য
ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বলেন, ‘৪ জানুয়ারি, ৭ জানুয়ারি ও ১৩ জানুয়ারি কোনো সভা ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমসহ পরিষদের কোনো স্থানে অনুষ্ঠিত হয়নি। যেসব সভার কথা বলা হচ্ছে, তা গোপনে বা প্রকাশ্যে অন্য কোথাও হয়ে থাকতে পারে। তা আমার জানা নাই।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘১৩ তারিখ সকাল ১১টায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ সভা ডেকেছিল। আমি সময়মতো পরিষদে আসলেও সভা হয়নি।
‘আমি জানতে চাইলে তিনি গোপনে স্থানীয় দুলাল নামের এক লোকের বাসায় মিটিং হবে বলে জানান। কিন্তু আমি সেখানে যাইনি। পরিষদের কাজ শেষে বাড়ি চলে আসি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যানের ভাষ্য
স্থানীয় বাসিন্দা জিলানি হোসেন বলেন, ‘যে চেয়ারম্যান জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি, তিনি জনগণের কথা ভাববেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি আমাদের দুর্ভোগে ফেলে আজও পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন। আমরা নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা তার পুনর্বাসন চাই না।
‘পরিষদ তাকে ছাড়া বেশ ভালো চলছে। আমরা সুন্দর সেবা পাচ্ছি। শুনছি অনেকে পলাতক চেয়ারম্যানের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে। আমরা নতুন কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেব না।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলী ইউনিয়ন পরিষদে সভা না করা এবং কোনো ব্যক্তির বাসায় বসে সভা করার বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিষদে সভা করতে পারেননি।
তিনি কেন পলাতক ও বিতর্কিত চেয়ারম্যানকেই পুনর্বাসন করতে চান, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বর্তমান দায়িত্বরত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলেন।
অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পরিষদে নাগরিক সেবা অব্যাহত আছে কি না, তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার আহ্বান জানান।
ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়িতে পরিষদের কোনো বৈঠক হয়নি; সিদ্ধান্তও হয়নি। আমার হাত ভেঙে যাওয়ায় আমি অসুস্থ। তাই রাজনীতিক নেতা ও পরিষদের সদস্যরা দেখতে এসেছিল। এর বেশি কিছু না।’
তবে চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, ‘আবেদনসহ অন্যান্য কাগজ আমি পেয়েছি। উভয় পক্ষকে ডেকে শুনানি করা হবে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
‘কোনো কৌশলগত বিষয় আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে। তবে নিয়ম-বহির্ভূত কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য