সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কেবল ওই অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য খাদ্যভান্ডারে পরিণত হয় ইউক্রেন। পাশাপাশি দেশটি কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে কৃষিপণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটে পরিণত হয়েছে।
চলমান যুদ্ধ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে শস্য এবং অন্যান্য খাদ্য রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্য ও ভোজ্যতেলের জোগানে হুমকি তৈরি করেছে।
মাত্র কয়েক দিনের সংঘাতেই পণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। সূর্যমুখী তেল এফওবি ব্ল্যাক সি ইউক্রেনের দাম টনপ্রতি ১৪৮০ ডলার থেকে ৪৭০.৫০ ডলার বেড়ে পৌঁছেছে ১৯৫০.৫০ ডলারে। ২০১৮ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ দাম। একইভাবে শিকাগো বোর্ড অফ ট্রেডে গমজাত পণ্যের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
আগের মৌসুমের বেশির ভাগ ভোজ্যতেল, ভুট্টা ও গম রপ্তানি হয়ে গেলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ সামনে আরও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ রাশিয়া ইউক্রেনের প্রধান বন্দর, শস্যগুদাম এবং কৃষিজমিতে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আসন্ন ফসল কাটার মৌসুমকে প্রভাবিত করতে যাচ্ছে।
রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং আজভ ও কৃষ্ণসাগরের বাণিজ্য রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল এবং গম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রুশ অভিযানের কারণে বসন্তে সয়াবিন ও সূর্যমুখীর রোপণ বিলম্বিত হবে এবং হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন কমবে।
ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে নিত্যপণ্যের জোগানে যে বিপুল ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলায় অবশ্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো। তবে এরপরেও আগামীতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
সূর্যমুখী তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ধস
রাশিয়ান অভিযানে বহুমুখী সংকটে পড়েছেন ইউক্রেনের কৃষকরা। ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক, খারকভ, নিকোলিয়েভ, লুহানস্ক, ওডেসা ও পোলতাভা ইউক্রেনের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। দেশের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের উল্লেখযোগ্য অংশের আবাদ হয় এসব অঞ্চলে।
ইউক্রেনের প্রধান শহরগুলো দখলের চেষ্টা হিসেবে রুশ বাহিনী ওই অঞ্চলগুলোকে ভারী আক্রমণের আওতায় নিয়ে এসেছে। বোমাবর্ষণের তীব্রতায় সেখানে সূর্যমুখী বীজের বহু সংরক্ষণাগার বিধ্বস্ত হয়েছে, ফলে হুমকিতে পড়েছে তেল রপ্তানি। এ ছাড়া যুদ্ধের কারণে সারের জোগান থমকে যাওয়ায় নতুন মৌসুমের আবাদ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
ইউক্রেনে এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যমুখী বীজ বপন করা হয়, আর ফসল তোলা শুরু হয় সাধারণত সেপ্টেম্বরে। চলমান অস্থিরতা এবং সামরিক অভিযানে কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় পরবর্তী আবাদ ও ফসল তোলা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে বিপুল ঘাটতির ঝুঁকি। বাণিজ্য রুট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষকরা বীজ বপনের সুযোগ না পাওয়ায় আগামী মৌসুমে সূর্যমুখী বীজের প্রতি হেক্টর গড় ফলনে বড় ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেনের ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ইউক্রেনে সব ধরনের তেলবীজ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টন, এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ টন ছিল সূর্যমুখী বীজ।
রপ্তানির ওপর গুরুত্ব দেয়ায় ইউক্রেনে তেলবীজ ভাঙানোর বেশির ভাগ কারখানা কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী বন্দরগুলোর কাছে গড়ে উঠেছে। এগুলোর সঙ্গে দেশের মধ্য ও পূর্ব অংশের বীজ উৎপাদনকারী এলাকার দূরত্ব অনেক।
রুশ আক্রমণে ইউক্রেনের এসব কারখানা অচল হয়ে গেছে। লেনদেন স্থগিত এবং সূর্যমুখী বীজের সরবরাহ ঘাটতিতে বেশির ভাগ তেল উৎপাদন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে বন্দরগুলো বন্ধ থাকায় সূর্যমুখী তেল আমদানিকারকরা চিন্তিত।
ইউক্রেন থেকে আনুমানিক তিন লাখ টন সূর্যমুখী তেল ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চে রপ্তানির কথা ছিল, তবে চলমান সংকটের কারণে আমদানিকারকদের এখন অন্য কোনো উৎস থেকে এই তেলের জোগান পেতে হবে।
সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও শিপিং সুবিধা বন্ধের বিষয়টি ইউক্রেনের ভোজ্যতেল প্যাকেজিং শিল্পকেও প্রভাবিত করেছে। ফিউচার মার্কেট ইনসাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিং ড্রাম বিক্রি ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। তবে, যে পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে তাতে আগামী মাসগুলোতে এই বিক্রি ব্যাপকভাবে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গম সরবরাহ ব্যাহত
করোনা মহামারির কারণে সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটায় এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অনেক নিম্ন আয়ের খাদ্য আমদানিকারক দেশে বাড়ছে অপুষ্টির হার। এর মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও বাড়িয়েছে অস্থিরতা।
রপ্তানি সুবিধা বন্ধ হওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে সারের অভাব, যা সরাসরি বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদনকে হুমকিতে ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরবরাহব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা না গেলে ইউক্রেন থেকে বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির প্রায় ১২ শতাংশ কমতে পারে।
রুশ অভিযানে বিশ্বব্যাপী গম ও গমজাত খাদ্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতির প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলো সমস্যাগ্রস্ত দেশে খাদ্যের জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিপর্যয়কর ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব।
পৃথিবীর অনেক দেশই খাদ্যনিরাপত্তার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল। তাই চলমান সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছে।
সামনের দিনে কী ঘটতে যাচ্ছে
বিশ্বব্যাপী গম ও সূর্যমুখী তেলের বাজারে স্বাভাবিকতা কবে ফিরবে এখনই তা বলা খুব কঠিন। এখন পর্যন্ত বিষয়টি নির্ভর করছে যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইনের ক্ষতির পরিমাণ এবং লড়াই কত দিন চলে তার ওপর। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক শস্য ও ভোজ্যতেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। একই সঙ্গে পরিষ্কারভাবে বিশ্ব খাদ্য বাজার একটি মন্দায় প্রবেশ করছে এবং বিশ্বের দুর্বল অর্থনীতিগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।
উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার গম, ভোজ্যতেলের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো রাশিয়া অঞ্চলের বাইরের শস্য এবং তেল উত্পাদনকারী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এটি ভারত ও চীনের মতো উদীয়মান জোগানদাতাদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।
চলমান সংকটে খাদ্যনিরাপত্তার ইস্যুটি এখন সবার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ জন্য শস্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগের পাশাপাশি খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত করার সম্ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ন্যাটো এবং এর মিত্রদের অবশ্যই সরবরাহব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে হবে। এর সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে খাদ্যনিরাপত্তা দিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগামী মাসগুলোতে সংঘাত আরও খারাপ অবস্থায় গেলে বিভিন্ন দেশকে আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য