× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

আন্তর্জাতিক
Australia could give arms to Taiwan to fight China
google_news print-icon

চীনের সঙ্গে লড়তে তাইওয়ানকে অস্ত্র দিতে পারে অস্ট্রেলিয়া

চীনের-সঙ্গে-লড়তে-তাইওয়ানকে-অস্ত্র-দিতে-পারে-অস্ট্রেলিয়া
চীন বিপুল শক্তি সঞ্চয় করছে বলে সতর্কবার্তা দেয় অস্ট্রেলিয়া। চীনের বিরুদ্ধে লড়তে তাইওয়ানকে সহযোগিতা করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি অস্ট্রেলিয়া। ছবি: এএফপি
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিটার ডাটন দাবি করেন, চীন পরমাণু অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে। ওই সময় তিনি তাইওয়ানকে দখল করার জন্য চীনের হুমকিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্রের জোগান দিয়েছে, একইভাবে চীনের বিরুদ্ধে লড়তে তাইওয়ানকে সহযোগিতা করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিটার ডাটন।

তিনি বলেছেন, চীনকে সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে বিরত রাখতে অস্ট্রেলিয়া যা করার দরকার, তা-ই করবে।

এবিসির ইনসাইডার্স অনুষ্ঠানে রোববার সকালে এক সাক্ষাত্কারে ডাটন দাবি করেন, চীন পরমাণু অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে।

ওই সময় তিনি তাইওয়ানকে দখল করার জন্য চীনের হুমকিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেন।
পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র সাহায্য করেছে, একইভাবে অস্ট্রেলিয়া তাইওয়ানকে সহায়তা করবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে চীনের আগ্রাসন থামাতে আমাদের যা করার দরকার, সেটা আমরা করব।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে ইউক্রেনে এখন যা হচ্ছে, তাইওয়ানে তেমনটা হলে কী এরপর আর কোথাও হবে না? কিসিঞ্জার ও অন্যরা ইন্দো-প্যাসিফিকের ইতিহাস নিয়ে কথা বলার সময় যে, শাখা রাজ্যের কথা বলেছেন, চীন কি সে মডেলটি রাখতে চায়? মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য এর অর্থ কী দাঁড়াবে?’

ডাটনের মতে, কোনো পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট মূল্য দিতে হয়, আবার নিষ্ক্রিয়তার জন্যও মূল্য দিতে হয়।

তিনি বলেন, ‘তাই শান্তির জয় দেখার প্রচেষ্টা আমাদের। একই সঙ্গে প্রচেষ্টা চীন হোক বা রাশিয়া বা অন্য যে কারও আগ্রাসনকে প্রতিহত করা।’

এ বিষয়ে পরিষ্কার উত্তর দেয়ার আহ্বান জানানো হলে ডাটন কোনো কিছু বাতিলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় স্বার্থ আছে এমন যেকোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের প্রতি আগ্রহ আছে দেশের।’

অস্ট্রেলিয়ার এ মন্ত্রী আরও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে ‘খুব শক্তিশালী প্রতিরোধ বার্তা’ পাঠাবে। চীন এ অঞ্চলে বিপুল শক্তি সঞ্চয় করছে বলেও তিনি সতর্কবার্তা দেন।

তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীন ব্যবস্থা নিলে যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ট্রেলিয়া সাহায্য করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডাটন বলেন, ‘আমাদের দেশ ও আমাদের মিত্রদের রক্ষা করা যদি আমাদের জাতীয় স্বার্থে হয়, তবে আমরা সেই সময়ে সিদ্ধান্ত নেব যে, দেশের জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো হবে। অন্যথায় এখানে ভান করার কোনো অর্থ নেই।’

সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব অনিশ্চিত এক সময়ে বাস করছি। এটা শুধু পরের কয়েক বছর নয়, পরবর্তী কয়েক দশক। আমাদের অঞ্চলে আমরা শান্তি চাই। আপনি যদি দুর্বলতার অবস্থান থেকে তর্ক করেন, তবে আপনার সেই শান্তি থাকবে না।

‘অস্ট্রেলিয়াকে শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে হবে। আমরা যদি ন্যাটো জোটের মতো শক্তিশালী মিত্রদের সঙ্গে থাকি, তাহলে আমরা সবচেয়ে দৃঢ় অবস্থানেই আছি।’

সাক্ষাত্কারে ডাটন আরও বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সরকার শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তার পারমাণবিক সাবমেরিন চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত ঘোষণা করবে।

তার দাবি অনুযায়ী, ২০৪০ সালের লক্ষ্যমাত্রার আগেই অস্ট্রেলিয়া অনেক তাড়াতাড়ি এ সক্ষমতা অর্জন করতে চলেছে।
এর আগে নভেম্বরে ডাটন দাবি করেন, বেইজিং জোর করে তাইওয়ানকে দখলের চেষ্টা করলে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার যোগদান না করা ‘অচিন্তনীয়’। তার এ মন্তব্য বেইজিংয়ে ক্ষোভের জন্ম দেয়।

গ্লোবাল টাইমস সম্পাদক হু শিকিং ডাটনকে সতর্ক করেন, অস্ট্রেলিয়া যদি এমন পদক্ষেপ নেয় তাহলে তাদের তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটোকেই ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন:
ইউক্রেন হামলার মধ্যেই তাইওয়ানের আকাশে চীনের যুদ্ধবিমান
সাবমেরিন নৌঘাঁটিতে চীনা শ্রমিকের মৃত্যু
চীন-ভারত সম্পর্ক খুব কঠিন পর্যায়ে: জয়শঙ্কর
গালওয়ানে নিহত হন ৩৮ চীনা সেনা, দাবি অস্ট্রেলীয় পত্রিকার

মন্তব্য

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক
Messi is part of the Saudi billion dollar project
দীর্ঘ পাঠ

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি সৌদি আরবের পর্যটন শিল্পের প্রচারের দায়িত্ব পেয়েছেন মেসি। গ্রাফিক্স: দ্য অ্যাথলেটিক
বিশ্বকাপে গ্রুপ সির প্রথম ম্যাচের আগে সোমবার সন্ধ্যায় দোহায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেসি। মাঠে যে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। আর প্রতিপক্ষ দেশটি ছিল তারা, যারা তাদের প্রচারে ব্যবহার করছে মেসির ছবি। কাতারের টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছে মেসির সৌদি আরব সফর নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপন।

কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিস্ময়কর জয় পেয়েছে সৌদি আরব। এটি ছিল গ্রুপ সি-এর প্রথম ম্যাচ। একই সঙ্গে এটি ছিল মাঠের বাইরে একটি যুদ্ধের পটভূমি, যা আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে চলবে।

সৌদি আরবের ভাবমূর্তি উন্নয়নের মিশনে আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি যোগ দেন চলতি বছর। আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তির লক্ষ্য সৌদি পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন।

তবে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানির মালিকানাধীন স্পোর্টস ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিকের নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, রিয়াদের সঙ্গে মেসির গাঁটছড়া ২০৩০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে সৌদি আরবের প্রচেষ্টাকে শক্তি জোগাবে। আর সে ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারে তার নিজের দেশ আর্জেন্টিনা। প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।

০২৬ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। এরপর ২০৩০ সালের আয়োজক দেশ ঠিক করতে চলতি বছরের জুনেই বিডিং উন্মুক্ত হয়েছে। আয়োজক দেশের নাম চূড়ান্ত হবে ২০২৪ সালে ফিফার ৭৪তম কংগ্রেসে।

এখন পর্যন্ত স্পেন, পর্তুগাল ও ইউক্রেনের যৌথ উদ্যোগের বিডিং নিশ্চিত হয়েছে। এ বছরের শুরুতেই দেশ তিনটি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়। তবে আরও দুটি প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে জমা পড়ার কথা।

এর একটি হলো দক্ষিণ আমেরিকান দেশ আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও চিলির যৌথ উদ্যোগ। অন্যটি সৌদি আরব, মিশর ও গ্রিসের। একাধিক দেশের যৌথ আয়োজক হিসেবে বিডে অংশগ্রহণের ফলে ২০২৬ সাল থেকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্ব ৪৮ দলের প্রতিযোগিতায় পরিণত হচ্ছে।

২০৩০ সালের জন্য দক্ষিণ আমেরিকান বিড খুব শক্ত প্রতিপক্ষ হবে বলে মনে করছেন এর কো-অর্ডিনেটর ফার্নান্দো মারিন। দ্য অ্যাথলেটিককে তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলটি অজস্র প্রতিভার জন্ম দিয়েছে, যারা সারা বিশ্বে সুপরিচিত। এ ছাড়া ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। এর ১০০তম বার্ষিকীতে ২০৩০ সালে দক্ষিণ আমেরিকাই হবে বিশ্বকাপের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।’

১৯৩০ সালে স্বাগতিক উরুগুয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট জিতেছিল।

দক্ষিণ আমেরিকার যৌথ বিডের বিষয়টি ২০১৭ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসে, যখন বার্সেলোনার সতীর্থ উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ এবং আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি তাদের দেশের পক্ষে প্রচারে যুক্ত হন। দুই দেশের মধ্যে একটি ম্যাচের আগে সুয়ারেজ যে জার্সি পরেন তার সামনে ২০ এবং মেসির জার্সিতে ৩০ সংখ্যাটি লেখা ছিল।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
দক্ষিণ আমেরিকায় যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রচারে সুয়ারেজ ও মেসি

পরের বছর ফার্নান্দো মারিন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টার সঙ্গে মেসি যোগ দেবেন এবং সুয়ারেজ তো অবশ্যই। আমরা তাকে (মেসি) আমাদের লক্ষ্য সম্পর্কে জানিয়েছি এবং তিনি মনে করেন এটা সম্ভব। তিনি আমাদের সাহায্য করতে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য বিশ্বকাপের পতাকাবাহী হবেন।’

তবে গত মে মাসে ঘটনার নতুন বাঁক তৈরি হয়। বর্তমানে এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবলার সৌদি আরবের প্রচারের দায়িত্ব নিতে একটি আকর্ষণীয় চুক্তিতে সই করেন।

প্রথম কথাটি হলো, চুক্তিটি হয়েছে সৌদির পর্যটন-সংক্রান্ত প্রচারের জন্য, ২০৩০ সালের বিশ্বকাপের বিডের প্রসঙ্গ সেখানে নেই।

তবে সৌদি আরবের জাতীয় লক্ষ্যগুলো দেশটির ‘ভিশন ২০৩০’-এর সঙ্গে যুক্ত। সরকারি ভাষ্যগুলোতে একে ‘সৌদি আরবকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার একটি অনন্য রূপান্তরমূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের নীলনকশা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই ২০৩০ সালের বিশ্বকাপের বিড সৌদি আরবের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত বলে মনে হয় এবং পর্যটনের প্রচার সেই লক্ষ্যটি অর্জনে অনেকভাবে সাহায্য করবে।

অন্য উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল- পিআইএফের মাধ্যমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব নিউকাসল ইউনাইটেডকে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত, সেই সঙ্গে এলআইভি গলফ ব্রেকওয়ে ট্যুরকে সহায়তাদান। এ ছাড়া ১০ বছরের জন্য ফর্মুলা ওয়ান রেসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ২০১৯ সালে অ্যান্টনি জশুয়া এবং অ্যান্ডি রুইজের হেভিওয়েট বক্সিং আয়োজনের জন্য ৬৫ কোটি ডলারের চুক্তি।

সৌদিতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কানাডার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন ডেনিস হোরাক। তিনি বলেন, ‘বিনোদন ও ক্রীড়ায় এই বিপুল অংশগ্রহণ সৌদির ভিশন ২০৩০-এর একটি বড় অংশ। এলআইভি গলফ (সৌদি আরবের অর্থায়নে) এবং এখন এগুলোর সঙ্গে মেসির মতো তারকাদের উচ্চমূল্যে যুক্ত করার মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার এবং আরও বৈশ্বিক করার চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাপী সৌদির সুনাম বাড়াতে হবে এবং এসবের মাধ্যমে দেশটি নিজেদের নতুন ব্র্যান্ড তৈরির চেষ্টা করছে।’

মেসির চুক্তির মেয়াদ এবং শর্ত কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি।

যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফ আগে এক প্রতিবেদনে জানায়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালডো সৌদি পর্যটনের প্রচারে কাজ করার জন্য প্রতিবছর ৫০ লাখ পাউন্ডের বেশি অর্থের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই আলোচনায় যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘনিষ্ঠ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

উপসাগরীয় অঞ্চলে রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র দ্য অ্যাথলেটিককে বলেছে, মেসির সঙ্গে সৌদির চুক্তিটির আর্থিক মূল্য রোনালদোকে দেয়া প্রস্তাবের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হতে পারে।

সৌদি এজেন্সিগুলোর তৎপরতার বিভিন্ন উদাহরণ পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। যেমন এলআইভি গলফ ট্যুরে টাইগার উডসকে ভেড়াতে ৭০-৮০ কোটি ডলারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, তবে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন৷

মেসির প্রতিনিধিরা বলেছেন, গোপনীয়তার শর্তের কারণে তারা চুক্তির পরিসংখ্যানগত দিকগুলো প্রকাশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে এ-সংক্রান্ত ই-মেইলের কোনো জবাব দেয়নি সৌদি সরকার।

মেসি গত মে মাসে লোহিত সাগরের তীরের রিসোর্ট শহর জেদ্দায় ভ্রমণের সময় প্রথমবার তাকে সৌদির পর্যটনদূত হিসেবে প্রচার করে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মেসিকে স্বাগত জানিয়ে সৌদি পর্যটনমন্ত্রী আহমেদ আল-খতিব এক টুইটে লেখেন, ‘সৌদি আরবে এটি তার প্রথম সফর নয় এবং এটি শেষও হবে না।’

পরে ইয়টে সূর্যাস্ত দেখার সময়কার নিজের একটি ছবি প্রকাশ করেন মেসি।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করা ছবিতে লোহিত সাগরের বুকে ইয়টে মেসি

ইনস্টাগ্রামে ছবির শিরোনামে তিনি লেখেন, ‘লোহিত সাগরের বুকে #ভিজিটসৌদি’। ইনস্টাগ্রামে মেসির ফলোয়ারের সংখ্যা ৩৭ কোটি। পোস্টটিতে সৌদি পর্যটন কর্তৃপক্ষের সহায়ক সংস্থা ভিজিট সৌদির ‘পেইড পার্টনারশিপ’ লেবেল যুক্ত ছিল।

মেসি পরে সৌদির সহকারী পর্যটনমন্ত্রীর প্রিন্সেস হাইফা আল-সৌদের সঙ্গে পুরোনো জেদ্দা সফরে যোগ দেন।

প্রিন্সেস হাইফা পরে টুইটারে লেখেন, ‘এই শহরের অন্তর্নিহিত রূপ, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের প্রতি তার (মেসি) মুগ্ধতা দেখে আমি আনন্দিত।’

ভিজিট সৌদির ওয়েবসাইটে এখন মেসির একটি ল্যান্ডিং পেজ রয়েছে। এর শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘লিওনেল মেসি চান আপনি নিজের ভেতরের রোমাঞ্চ-সন্ধানী সত্তাকে উন্মোচন করুন এবং অকল্পনীয় দিকগুলো উদ্ঘাটন করুন।

‘আপনি নতুন বা পুরোনো কিছু আবিষ্কার করতে অথবা শুধু নিজের ভেতরে নতুন কিছু জাগানো- যে উদ্দেশ্যেই ভ্রমণ করুন না কেন, সৌদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাকে সন্তুষ্টি জোগাবে। তাহলে আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? এখনই আপনার অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলুন।’

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
ভিজিট সৌদির ওয়েবসাইটে মেসির পেজ

সৌদি আরবের প্রচারে মেসির এই অবস্থান ২০৩০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনে তার নিজের দেশের প্রচেষ্টার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে মেসির সাপোর্ট টিম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। একইভাবে পর্যটন প্রচারের চুক্তির অংশ হিসেবে তিনি কতবার সৌদি সফরে যাবেন, সে বিষয়ে তথ্য দিতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তারা এমন একটি দেশের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের চেক নেয়ার বিষয়ে মেসির প্রস্তুতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি, যে দেশটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগের মধ্যে আছে ভিন্নমতাবলম্বী ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যা, নারী অধিকারকর্মী ও এলজিবিটি গোষ্ঠী এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারীদের ওপর ক্র্যাকডাউন।

মানবাধিকার সংস্থা ইউনিসেফ গত বছর জানায়, প্রতিবেশী ইয়েমেনে সংঘাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট জড়িয়ে পড়ার পর থেকে ১০ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। মেসি ২০১০ সাল থেকে ইউনিসেফের একজন ‘শুভেচ্ছাদূত’।

মেসির প্রতিনিধিরা ইয়েমেন বিরোধের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি, একই সঙ্গে ইউনিসেফও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

মেসির অগণিত অংশীদারত্বের মধ্যে একটি হলো ফরাসি চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেন্ট-জার্মেইনের হয়ে খেলা, যেখানে তিনি ৩ কোটি ইউরোর বেশি আয় করেন। এটি কাতারের সঙ্গে যুক্ত একটি তহবিলের মালিকানাধীন ক্লাব, যে দেশটির বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

মেসি সম্প্রতি ক্রিপ্টো ফ্যান টোকেন ফার্ম সোসিওস-এর প্রচারের জন্য ২ লাখ ডলারের চুক্তি করেছেন, পাশাপাশি তিনি এনএফটিভিত্তিক গেম সোরারেও একজন বিজ্ঞাপনী মুখ। এ ছাড়া তিনি আডিডাস, পেপসি, বাডওয়াইজার, ওরেডু, প্রো অ্যাভ্যুলিউশন সকার, লুই ভ্যুইতন, ইসরায়েলি কোম্পানি ওরক্যাম, দ্য দুবাই এক্সপো-২০২০, তার নিজস্ব শো সার্ক দ্যু সোলেইল এবং চীনা দুগ্ধ কোম্পানি মেংনিউ-এর সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি করেছেন।

ফোর্বস ম্যাগাজিন গত মে মাসে যে অনুমান প্রকাশ করে সে অনুযায়ী, গত বছর মেসি ১২ কোটি ডলারের বেশি আয় করেছেন।

সৌদি নাগরিক খালিদ আল-জাবরির বোন সারা এবং ভাই ওমর বর্তমানে দেশটির একটি কারাগারে বন্দি। খালিদ আল-জাবরির বাবা সৌদি আরবের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

দ্য অ্যাথলেটিক-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে খালিদ অভিযোগ করেন, তার বাবা ড. সাদ আলজাবরির ওপর চাপ দেয়ার জন্য কারাবন্দি দুই ভাইবোনকে ‘দর-কষাকষির হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে সৌদি সরকার।

খালিদ বলছেন, ‘সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান দেশকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছেন এবং মেসির দূতের ভূমিকা এতে অবদান রাখছে।

‘মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার সময় তাকে (মেসি) দেখতে আমরা একসঙ্গে জড়ো হতাম। তিনি বিশ্বে সুপরিচিত এটাই একমাত্র কারণ নয়, দেশের ভেতরেও সবাই তাকে ভালোবাসে। ফুটবলের ক্ষেত্রে তার অবস্থান ঈশ্বরের ঠিক পরেই। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা (সৌদি সরকার) সেই কেন্দ্রবিন্দুটিতে আঘাত করেছে।’

...

মেসি ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরব সফর করেন।

তার ফ্লাইট অবতরণের পর ভক্তদের হুড়োহুড়ি লেগে যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর। ভিড়ের চাপ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত সশস্ত্র রক্ষীদের একজনের বন্দুকের নল ঘটনাক্রমে মেসির মুখের দিকে ঘুরে গিয়েছিল।

তারপর থেকে সম্পর্কটি ক্রমশ উষ্ণ হয়েছে। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তুর্কি আল-শেখ নামের এক ব্যক্তি। তিনি সৌদি জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
২০১২ সালে প্রথম সৌদি সফরে যান মেসি

বিশিষ্ট সৌদি রাজনীতিক ও স্প্যানিশ লা লিগা ফুটবল ক্লাব আলমেরিয়ার মালিক আল-শেখকে ২০২০ সালের মে মাসে অনলাইনে একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান মেসি।

উপলক্ষটি ছিল সৌদি ফুটবল ক্লাব আল-নাসর এফসির সাবেক সভাপতি সৌদ আল-সুওয়াইলেমের বিপক্ষে একটি চ্যারিটি প্লেস্টেশন ফুটবল ম্যাচে আল-শেখের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

সৌদি আরবের অভাবী মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ম্যাচটি আয়োজন করা হয়। সেখানে মেসি ছাড়াও ডিয়েগো ম্যারাডোনা, সাবেক ব্রাজিল তারকা কাফু, রবার্তো কার্লোস এবং রোনালদিনহো, ইতালীয় ডিফেন্ডার লিওনার্দো বোনুচ্চিও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। চার্লি শিনের মতো বিখ্যাত অভিনেতা এবং র‌্যাপার স্নুপ ডগও বার্তা দিয়েছিলেন।

ওপরের ভিডিওতে টেলিভিশন উল্টে ফেলার দৃশ্য দেখলে আল-শেখ একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুর মতো আচরণ করছেন বলে ভ্রম হতে পারে। তবে সৌদি আরবের অনেক পর্যবেক্ষকের মতে তিনি দেশটির অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুমোদনে খাশোগজি হত্যার অভিযোগ রয়েছে

সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী খাশোগজিকে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে ওই হত্যায় ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুমোদন ছিল।

খাশোগজির মৃত্যুর আগে রেকর্ড করা একটি সাক্ষাৎকার পরে নিউজউইকে প্রকাশ হয়। সেখানে খাশোগজি বলেন, ‘তুর্কি আল-শেখ এবং সৌদ আল-কাহতানি ছাড়া মোহাম্মদ বিন সালমানের আর কোনো রাজনৈতিক উপদেষ্টা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরা গুণ্ডা প্রকৃতির। মানুষ তাদের ভয় পায়। তুর্কি আল-শেখ খেলাধুলার দায়িত্বে আছেন। গুজব রয়েছে খেলাধুলার পেছনে ব্যয় এবং তরুণদের এতে ব্যস্ত রাখতে তার হাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার রয়েছে।’

মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য মিডিয়া অপারেশন এবং প্রচারের দায়িত্ব সামলাতেন সৌদ আল-কাহতানি। আমেরিকান গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাকে খাশোগজি হত্যার চক্রান্তে যুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। তবে সৌদি আদালত ২০১৯ সালে তাকে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
লিওনেল মেসি

আল-শেখ ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমানের সাবেক নিরাপত্তাকর্মী। ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার প্রচণ্ড বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার হাতে তুলে দেয়া হয় সৌদি স্পোর্টস কমিশন চালানোর দায়িত্ব।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহাম্মদ বিন সালমান তার ক্ষমতা সংহত করতে সৌদি আরবের শত শত ধনী ব্যবসায়ীকে রিটজ-কার্লটন হোটেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছিলেন। ওই সময়ে আল-শেখ অত্যন্ত তৎপর ভূমিকা পালন করেন। পরে ঘটনাটিকে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানো হয়।

সৌদি স্পোর্টস কমিশন পরিচালনার সময় আল-শেখ ক্রীড়ায় অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহীদের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। তিনি ২০১৯ সালে সৌদিতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার একটি ম্যাচ আয়োজন করেন।

ওই ম্যাচের আগে তার ফুটবল ক্লাব আলমেরিয়া ভেন্যুর টানেলে মেসি ও আল-শেখের আলিঙ্গনের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘দুই সিংহ’।

মেসিও প্রকাশ্যে ৪০তম জন্মদিনে আল-শেখকে শুভেচ্ছা জানান। এর আগে তিনি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের নিয়ে রিয়াদে তার বাড়িতে ঘুরতে যান।

জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আল-শেখ ২০২২ সালের রিয়াদ সিজনের (একটি বিনোদন উৎসব) বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে মেসির ছবি ব্যবহার করেন। এসব বিলবোর্ড লন্ডন, দুবাই ও নিউকাসলে স্থাপন করা হয়।

পিএসজির জার্সি পরে রিয়াদ সিজনের প্রচার চালানোর একটি ভিডিওতেও দেখা যায় মেসিকে।

সৌদি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের অংশ মেসি
মোহাম্মদ বিন সালমান

এটি বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পিএসজির সঙ্গে যুক্ত দেশ কাতারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আল-শেখ কাতারের উপর সৌদি অবরোধের কেন্দ্রীয় শক্তির অংশ ছিলেন। এমনকি টুইটারে তিনি বলেছিলেন, কাতার নৈতিকতা লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজন ইংল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেয়া উচিত।

অবশ্য পিএসজির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মেসির অন্য কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি করায় বাধা নেই। পাশাপাশি গত বছর থেকে সৌদি ও কাতারের সম্পর্কের শীতলতা কাটতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের দিন রোববার ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর দুই পাশে বিন সালমান ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে বসতে দেখা গেছে।

মানবাধিকার কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে অটোয়ার বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ২০১৮ সালে কানাডার রাষ্ট্রদূত হোরাক সৌদি আরব থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি তার মূল্যায়নে সৌদির নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন।

হোরাক বলেন, বিন সালমান সৌদির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিকদের মনে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। তবে খাশোগজির হত্যা, নারী অধিকার কর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে তার শাসনের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়।

আল-শেখ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তার প্রভাবের কথা শুনেছি। তাকে নিশ্চিতভাবে রাজকীয় ব্যবস্থায় মোহাম্মদ বিন সালমানের অতি ঘনিষ্ঠদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

‘তিনি (আল-শেখ) অবশ্যই ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত এবং মেসিকে যুক্ত করার বিষয়টি বিন সালমান অবশ্যই পছন্দ করবেন। তার (মোহাম্মদ বিন সালমান) চোখে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান উপলব্ধির আরেকটি সুযোগ ঘটাবে এই বিষয়টি। তিনি বুঝবেন সৌদি বিচ্ছিন্ন কোনো মরুরাজ্য নয়।

‘আন্তর্জাতিকভাবে মেসির যে প্রোফাইল রয়েছে, সেটি সৌদিকে স্বাভাবিকতার একটি বৃহত্তর অনুভূতি দেবে। তাই আমি মনে করি এ বিষয়টি ২০৩০ সালে তাদের বিশ্বকাপ বিডের ক্ষেত্রেও সহায়তা করবে।’

হোরাক বলেন, ‘খাশোগজি হত্যার কারণে মোহাম্মদ বিন সালমান ব্র্যান্ডটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একইসঙ্গে সৌদি আরবের ব্র্যান্ডও কলঙ্কিত হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বের সেলিব্রিটিদের কাছে যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ তৈরি করা যাবে এবং সে অনুযায়ী সৌদি আরবের ব্র্যান্ডটিকে আবারও ঝকঝকে করে তোলা সম্ভব হবে।’

সৌদি কারাগারে বন্দি দুই স্বজনের ভাই খালিদ আল-জাবরি বলেন, ‘মেসির মতো খেলোয়াড়দের একটি দলের অংশ হিসেবে সৌদিতে খেলতে যাওয়া নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কারণ দেশের শাসকদের নৃশংসতার কারণ দেখিয়ে সৌদি ভক্তদের তাদের প্রিয় দলের খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। আমার সমস্যা হলো মেসি নিজেকে সৌদি স্পোর্টস ওয়াশিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন।

‘তিনি নিজেকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।’

...

বারের বিশ্বকাপে গ্রুপ সি ম্যাচের আগে সোমবার সন্ধ্যায় দোহায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেসি। মাঠে যে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। আর প্রতিপক্ষ দেশটি ছিল তারা, যারা তাদের প্রচারে ব্যবহার করছে মেসির ছবি।

কাতারের টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছে সৌদি আরবে মেসির সফর নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপন।

সেই সংবাদ সম্মেলনে মেসির আগমনকে ওহ, আহা ধ্বনি এবং ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলে স্বাগত জানানো হয়। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে কয়েকজন করতালি দিচ্ছিলেন।

ব্যস্ত ওই মিডিয়া সেশনে দ্য অ্যাথলেটিক কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। মেসি এক ডজনেরও বেশি প্রশ্ন নিয়েছিলেন, তবে তার একটিও সৌদি আরবকে নিয়ে প্রচার চালানো বিষয়ক চুক্তি সংক্রান্ত ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকান বা আরব মিডিয়া থেকে এসব প্রশ্ন করা হয়েছিল।

চলমান বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রোববার সন্ধ্যায় ইনফান্তিনোর পাশে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বসার দৃশ্য সৌদির সামনে আরও একবার আশা জাগিয়ে তুলেছে। এই জুটিকে গত সপ্তাহে জি টোয়েন্টি সম্মেলনে বালিতেও একসঙ্গে দেখা গেছে। এর আগেও তারা একসঙ্গে বক্সিং ম্যাচ দেখেছেন।

সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, ২০৩০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য মিশর ও গ্রিসের সঙ্গে যৌথভাবে সৌদি আরবের বিডকে ফিফা গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করবে বলে রিয়াদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। সৌদিরা ২০৩০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপোর আয়োজক দেশ হতেও একটি বিড জমা দিয়েছে, এটিও ভিশন ২০৩০ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ।

বিশিষ্ট আর্জেন্টাইন ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথোপকথনে মেসিকে ঘিরে সমালোচনায় অস্বস্তি মৃদু আকারে হলেও বোঝা যায়।

বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে আর্জেন্টিনার আগ্রহের বিপরীতে প্রতিপক্ষের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে মেসি সাহায্য করছেন, এটি অদ্ভুত লাগছে কিনা- এমন প্রশ্নে তার সাবেক আন্তর্জাতিক সতীর্থ ম্যাক্সি রদ্রিগেজ বলেন, ‘সত্যি বলতে কি এটা ঠিক, তবে… আপনি জানেন না শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে।

‘আপনি নিজ দেশে বিশ্বকাপ দেখতে চান, তবে এ জন্য অনেক কিছু করতে হবে। কারণ, বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া সহজ নয়। টুর্নামেন্টের আয়োজক নির্বাচনের সময় কী ঘটছে আমরা দেখতে পাব। আর্জেন্টাইন হিসেবে আমরা আবারও আমাদের দেশে এই আয়োজন দেখতে চাই।’

দক্ষিণ আমেরিকার যৌথ বিডের কো-অর্ডিনেটর ফার্নান্দো মারিন বলেন, ‘মাঠে এবং মাঠের বাইরে মেসির এক অনন্য ক্ষমতা রয়েছে। তিনি একটি সুউচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছেন। মেসি নিজেই একটি ব্র্যান্ড এবং এটি খুব শক্তিশালী।

‘তিনি সমস্ত ফুটবলের জন্য একটি ব্র্যান্ড, কোনো দেশের নয়। তিনি ২০৩০ সালের জন্য দক্ষিণ আমেরিকান বিডের একটি মৌলিক অংশ হিসেবে থাকবেন।’

তবে একই সঙ্গে মেসিকে দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি মৌলিক অংশ হতেও দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন:
বড় জয়ের দিনেও দুঃসংবাদ পেল ফ্রান্স
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয়, সিজদায় সৌদি যুবরাজ
‘আর্জেন্টিনার গোল খাওয়া দেখে নয়, কাকনের মৃত্যু পুরোনো অসুস্থতায়’
আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করা রিস্ক: মাশরাফি
ওচোয়ার দক্ষতায় পোল্যান্ডের বিপক্ষে হার এড়াল মেক্সিকো

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Why do Americas homeless keep going to jail?
দীর্ঘ পাঠ

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান ওয়াশিংটনের স্পোকেন শহরের ক্রিস কারভান রাস্তার জীবনের চেয়ে জেলখানাকে শান্তিদায়ক মনে করেন। ছবি: ইনভেস্টিগেটওয়েস্ট
ক্রিস কারভারের মতো ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে জেল ভয়ের কোনো জায়গা নয়। গৃহহীনতা নিয়ে সামাজিক টানাপড়েনে ভোগা মানুষ যেকোনো আশ্রয় বেছে নিতে পিছ পা হন না। তারা সেতুর নীচে পড়ে থাকেন, ফুটপাতে তাঁবু খাটান এবং এখন যা বাড়ছে সেই কারাগারে বন্দি হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন অনেকে দিন-রাত পার করেন রাস্তায়। তীব্র শীতে প্রতিবছর অনেকে মারাও যান। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এসব মানুষের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রের জীবনকে ঘৃণা করেন। তাদের সামনে থাকে শুধু দুটি নির্দয় পছন্দ- তীব্র ঠান্ডার মাঝে রুক্ষ জীবনযাপন, নয়ত কারাগারে দিন কাটানো।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টিগেটওয়েস্ট বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উইলসন ক্রিসিওনের প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হলো নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।

ডাক পড়ার আগে ক্রিস কারভার দুই ঘণ্টা আদালত কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন। স্পোকেন মিউনিসিপ্যাল ​​জজ মেরি লোগান অবশেষে তাকে দাঁড়াতে বলেন- ‘আমরা এখন আপনার মামলা নিয়ে কাজ করছি।’

পায়ের সঙ্গে কসরৎ করে উঠে দাঁড়ান কারভার। তার দাড়ি নোংরা। চোখের চারপাশে শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তৃত ট্যাটু। ক্লান্ত চোখে শিশুসুলভ হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন।

বিচারক লোগান সরাসরি কারভারের দিকে তাকান, তার পিছনে একটি আমেরিকান পতাকা টাঙানো।

‘তাহলে বলুন, মিস্টার কারভার, আপনি কি নিজের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব একজন অ্যাটর্নির ওপর ছাড়তে রাজি নন?’

থ্যাঙ্কসগিভিং ডেতে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের স্কিডরোর ভিড়েঠাসা ফুটপাতে একজন গৃহহীনের তাঁবু দেখা যাচ্ছিল। রেকর্ড বলছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে গত বছর তীব্র শীতে অন্তত ১৪ জন গৃহহীনের মৃত্যু হয়েছে।

‘হ্যাঁ ম্যাম’- কারভারের জবাব।

বিচারক বলেন, ‘এটা (আইনজীবী নিয়োগ) আপনার অধিকার মিস্টার কারভার। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি কেন এবং কী কারণে আপনি... আইনজীবী নিয়োগে আপনার তো কোনো অর্থ খরচ হবে না...!‘

তাকে থামিয়ে দেন কারভার; ‘কারণ আমার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল এবং এটা আমার কাছে কিছুই নয়।’

অবাক কণ্ঠে বিচারক বলেন, ‘দুঃখিত, আপনি কী বলতে চাইছেন?’

কারভার কথা চালিয়ে যান, ‘আমি গৃহহীন, রাস্তায় পড়ে থাকি। তাই জেলে একটি বছর আমার কাছে কিছুই নয়… তাছাড়া আমি জানি না এ অবস্থায় আমি আর কী করতে পারি।’

বিচারক গলায় জোর এনে বলেন, ‘আমি মোটেই আপনার চিন্তাকে গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ বাড়ি হারিয়ে জেলখানাকেই আপনি বাড়ি হিসেবে ভাবতে চাইছেন।’

কাঁধ ঝাঁকান কারভার- ‘জেলখানার বাইরেও আমি গৃহহীন, তাই হয়ত...।’

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

টি ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকেনে শীত মৌসুমের এক ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকের ঘটনা। ক্রিস কারভার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পরবর্তী কয়েক মাস রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে জেলে কাটানোই ভালো।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো যথেষ্ট গুরুতর। অপরাধমূলক অনুপ্রবেশ, একটি গির্জার সিঁড়িতে মলত্যাগ এবং যে গলিতে ঘুমিয়েছিলেন সেখান দিয়ে যাওয়া একটি গাড়িতে স্কেটবোর্ড ছুড়ে মারা। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে একজন সরকারি আইনজীবী কারভারের জেলের মেয়াদ কমাতে সাহায্য করতে পারতেন, তবে তিনি এই সাহায্য নেননি।

নিয়মিতভাবে গৃহহীনদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা কারভারের এমন অবস্থানে বিস্মিত নন। তারা বলছেন, এমন ঘটনা অনেকবার দেখা গেছে। এর সামান্য অংশ মাঝেমধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়।

ইন্ডিয়ানায় ২০২১ সালে পুলিশ মামলা না করা পর্যন্ত এক ব্যক্তি হাসপাতাল ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। মিসিসিপিতে ২০১৯ সালে ক্রিসমাসের ঠিক আগে একজন গৃহহীন একটি ভবনের জানালা ভেঙে দেন, যাতে শাস্তি হিসেবে তিনি জেলে রাত কাটাতে পারেন। ওয়াশিংটনে ২০১৮ সালে দীর্ঘ কারাদণ্ড পেতে এক ব্যক্তি চতুর্থবারের মতো ব্যাংক ডাকাতিতে অংশ নেন।

এসব ঘটনাকে গৃহহীনতা নিয়ে চলমান সংকটের বাইরের দিক হিসেবে ধরে নিলেও, কারভারের মতো ব্যক্তিরা সারা দেশে জরুরি নীতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া ক্রমবর্ধমান একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এই নীতি হলো শহরগুলো কীভাবে নিরাশ্রয় ও ভবঘুরে মানুষদের বিষয়টি মোকাবিলা করছে। রাজনীতিকরা প্রায়ই এসব ব্যক্তিদের অমানুষ হিসেবে দেখান। আমেরিকার শহরগুলো যে মারা যাচ্ছে এই মানুষেরা কি তার জীবন্ত প্রমাণ?

কারাগারকে অস্থায়ী আবাস হিসেবে ব্যবহার করাকে কেউ স্মার্ট বা মানবিক বলে বিশ্বাস করেন না। এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভালো কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ এটি অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় বেশি ব্যয়বহুল। সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতের পক্ষের ব্যক্তিরা বলছেন, এসব ঘটনার অর্থ হলো কোথাও ভয়ঙ্কর কোনো ভুল হচ্ছে।

সিয়াটলের কিং কাউন্টি রিজিওনাল হোমলেস অথরিটির প্রধান মার্ক ডনস বলছেন, ‘এটি একটি জাতীয় পরিস্থিতি, যা অনেককে আবাসন বঞ্চিত করেছে। এর ফলে নানা ধরনের অস্থিরতার মুখোমুখি ব্যক্তিরা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুর পছন্দ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।’

এ ঘটনা কেবল সিয়াটল এবং সান ফ্রান্সিসকোর মতো জায়গায় দেখা যাচ্ছে না। স্পোকেনের (জনসংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার) মতো ছোট ও মাঝারি আয়তনের শহরগুলোও এমন সমস্যায় আক্রান্ত। পরিবার গড়ে তোলার জন্য এসব শহর দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই।

গত দুই বছরে আবাসনের দাম ৬০ শতাংশ বেড়েছে। স্পোকেনের ডাউনটাউনের কোণ দখল করা গৃহহীনদের আকস্মিক উপস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তা নিয়ে শহরের লোকজন দ্বিধাবিভক্ত।

শহরের বামপন্থি মনোভাবের সিটি কাউন্সিল আরও আশ্রয়ের জায়গা ও আবাসনের স্থাপনা তৈরির জন্য চাপ দিচ্ছে, যেগুলোতে নিয়ম মানার খুব বেশি বাধ্যবাধকতা নেই।

অন্যদিকে শহরের মেয়র নাডিন উডওয়ার্ড একজন সাবেক টিভি উপস্থাপক এবং রক্ষণশীল ব্যক্তিত্ব। ২০১৯ সালের নির্বাচনে খুব সামান্য ব্যবধানে জয় পাওয়া উডওয়ার্ড নির্বাচনি প্রচারের সময় কোনো জবাবদিহি ছাড়াই গৃহহীনদের ঘর দেয়ার নীতির সমালোচনা করেছিলেন। তিনি এখনও গৃহহীনদের নিছক ‘গুদামজাত করা এবং স্যান্ডউইচের মতো আবাসন’ দেয়ার বিরোধিতা করছেন।

কারভার রাস্তা থেকে জেলের চক্রে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। গর্ব করে তিনি জানান, স্পোকেনে দীর্ঘতম সময়ের গৃহহীন ব্যক্তিদের তালিকায় তার অবস্থান দ্বিতীয়। রাস্তায় ২৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন।

তাকে ক্রমাগত টিকিট দেয়া হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জেলে পাঠানো হয়েছে। তার অনেক দাবি যাচাই করা অসম্ভব। তবে নথিপত্র বলছে, শুধু স্পোকেনেই তিনি ১৬ বার শাস্তি পেয়েছেন। কারভারের ১৮তম জন্মদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে এই শহর ছাড়াও অন্যত্র ৪৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে৷

বেশির ভাগ অভিযোগ ছিল অহিংস অপরাধ; যেমন গাঁজা রাখা, চুরি বা ভিক্ষাবৃত্তি। কয়েকটি অভিযোগ ছিল হিংসাত্মক, যেমন ধাক্কাধাক্কি ও চতুর্থ-ডিগ্রি হামলা সংক্রান্ত।

১৯৯৯ সালে আইডাহোতে আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের ওপর আক্রমণের অভিযোগে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গার অভিযোগে ২০০৭ সালে এক বছর জেল খাটেন তিনি।

স্পষ্টতই তার ক্ষেত্রে জেল ভয়ের কোনো জায়গা নয়। গৃহহীনতা নিয়ে সামাজিক টানাপড়েনে ভোগা কারভারের মতো মানুষ যেকোনো আশ্রয় বেছে নিতে পিছ পা হন না। তারা সেতুর নীচে পড়ে থাকেন, ফুটপাতে তাঁবু খাটান এবং এখন যা বাড়ছে সেই কারাগারে বন্দি হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

লোগানের কোর্টরুমের ঘটনার প্রায় এক মাস পর গত মার্চে আমি কারভারের সঙ্গে প্রথম দেখা করি।

তিনি একটি পেট্রল পাম্পের সামনে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন। পরনে রোদে পোড়া ইনসুলেটেড বিব ওভারঅল এবং কম্বল মোড়ানো একটি কোট। পায়ে আঘাতের কারণে একদিকে ঝুঁকে হাঁটেন। আমি কাছে যেতেই তিনি বসে পড়েন এবং ফের উঠে দাঁড়াতে সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল।

আমি নিজের পরিচয় দিয়ে জানাই তার সম্পর্কে বিচারক লোগানের কাছ থেকে জেনেছি। কারভারের সঙ্গে কথা বলতে একটি উষ্ণ জায়গায় যাই। সেটি ছিল স্থানীয় এক সহায়তাকেন্দ্র, যেখানে তিনি বিনামূল্যে খাবার পান।

কারভার প্লাস্টিকের চামচ দিয়ে একটি জার থেকে পিনাট বাটার বের করে আনেন। উষ্ণ পরিবেশ আর খাবার বাকপটু করে তোলে তাকে। ফেব্রুয়ারিতে আদালতের কক্ষে ওই দিনের পর তিনি এক মাস কারাগারে ছিলেন। এই প্রথম তিনি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কমদিন কারাভোগ করেছেন।

কারভার বলেন, শীতের ঠান্ডা মাসগুলোতে একটি যৌক্তিক পছন্দ হতে পারে কারাগার। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, বহু মানুষের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা তিনি ঘৃণা করেন, সেখানে নিরাপদও বোধ করেন না।

সমাজসেবা কর্মীরা বলছেন, গৃহহীনদের মধ্যে এটি একটি সাধারণ অভিযোগ।

কারভার স্বাভাবিক ভঙ্গীতে তার অপরাধমূলক রেকর্ড সম্পর্কে জানাচ্ছিলেন। গর্বিত গলায় বলেন, বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য তাকে প্রথম নামেই চেনেন। তার অভিযোগ, রাস্তার জীবন নির্বিবাদে কাটাতে চান, কিন্তু পুলিশ তাতে বাধা দেয়।

তিনি বলেন, ‘আমি একদিকে, আর ওরা অন্য দিকে।’

তবে তিনি স্বীকার করেন, রাস্তায় জীবন একাকিত্বের।

পরিবার?

তিনি বলেন, ‘গত ৩০ বছরে তাদের কাউকে দেখিনি। এখন আমি তাদের চিনতেও পারব না।’

তারপর তিনি একাকী জীবনের একটি কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। এটি এমন একটি মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা যা মেজাজের চরম পরিবর্তন ঘটায়।

কারভার বলছিলেন, এতটাই খারাপ অবস্থা তৈরি হয় যে তিনি অনেক সময় হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। তখন মনে হয় কাউকে হত্যা করে রক্তের পুকুরে শুইয়ে রেখেছেন।

তিনি দাবি করেন, এভাবে তিনি মানুষ হত্যাও করেছেন এবং আইডাহো রাজ্যে এ অপরাধে তাকে অমৃত্যু কারাগারে রাখার উপক্রম হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত রায়ের আগে আত্মরক্ষার বিষয়টি প্রমাণ হওয়ায় তিনি ছাড় পান।

জেলখানা বেশ উপকারী জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে নিজের জন্য ভালো খাবার এবং একটি কক্ষ পাওয়া যায়। সেখানে অন্য কাউকে আঘাত করার ঝুঁকি নেই।

আমি জানতে চাই, ‘একটা নির্দিষ্ট আবাসন ও চাকরি সম্পর্কে তাহলে কী বলবেন?’

জবাবে কারভার বলেন, একটা সময় ছিল যখন সবকিছু একসঙ্গে মিলেছিল।

পাঁচ বছর আগে স্পোকেন থেকে ৪০ মিনিট দূরের আইডাহোর কোর ডে’লাইন শহরের একজন যাজক কারভারকে একটি স্টিল বিম কারখানায় চাকরি এবং একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকার সুযোগ পেতে সাহায্য করেন৷

তারপর একদিন পুলিশের ধাওয়া খাওয়া এক কিশোরের গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। কারভার কয়েক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এরপর আবার চাকরি ও ঘর হারান।

তিনি এমন গল্পই আমাকে বলেছিলেন। তবে পরে আমি আবিষ্কার করি মানুষ হত্যা, পরিবারকে কখনোই দেখা যায়নি, পুলিশের তাড়া খাওয়া গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা- এসব গল্পের প্রায় সবটাই অসত্য।

এগুলো তিনি বিচারক এবং পরিষেবাদানকারীদের কাছে নিজের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সাজিয়েছেন, যারা ভাবছেন কেন তিনি রাস্তায় আছেন এবং কেন একটি উষ্ণ বিছানার জন্য স্বেচ্ছায় নিজের অধিকার ছেড়ে দিচ্ছেন।

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

সিয়াটলের কিং কাউন্টি রিজিওনাল হোমলেসনেস অথরিটির প্রধান ডনসের কাছে একজন ব্যক্তির স্বেচ্ছায় নিজের অধিকার সমর্পণের গল্পটি নতুন কিছু নয়। তার মতে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল, রাস্তার কঠিন জীবনের মধ্যে থাকা মানুষকে সাহায্য করতে এই দেশটি কীভাবে ব্যর্থ এটি তার আরেকটি দৃষ্টান্ত।

ডনস বলেন, ‘আমি গল্পটি অনেক, অনেক, বহুবার শুনেছি। এ বিষয়ে কোনো অ্যাকাডেমিক পেপার সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে আমরা যারা আবাসন, গৃহহীনতা এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি তারা এটি জানি।’

বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা রয়েছে। শেফিল্ড হ্যালাম ইউনিভার্সিটি ২০১০ সালে রাস্তায় বসবাসকারী ৪০০ জনের ওপর জরিপে চালিয়ে দেখেছে, তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষ রাতের বেলায় জেলহাজতে থাকার উদ্দেশ্যে ছোটখাটো অপরাধ করেন।

যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে চলা একটি ওয়াচডগ ২০২০ সালে আরেক গবেষণায় দেখতে পায়, স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়া গৃহহীনদের অনেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার জেলে ফিরে গেছেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে একজন ব্যক্তি বলেছেন, ‘থাকার জায়গা না পেয়ে আমি আবার জেলে যেতে চেয়েছি।’

শুধু জেলে যাওয়ার জন্য মানুষ অপরাধ করেছে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মোটেই কঠিন নয়।

আগের বছরের হ্যালোইনের সময় ওয়াশিংটনের লংভিউয়ে একজন গৃহহীন কারাগারে জায়গা পেতে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়েছিলেন। তবে জেলের পরিবর্তে পুলিশ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গেলে তিনি সেখান থেকে চলে যান। এরপর একটি গাড়ি থেকে বন্দুক চুরির মতো আরও গুরুতর অপরাধ করেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করার সময় আনন্দ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি উষ্ণতার মধ্যে থাকার জন্য জেলে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’

বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও আগ্নেয়াস্ত্র চুরির অপরাধে সেই থেকে তিনি জেলে আছেন।

লংভিউয়ের পুলিশ ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ডেন ম্যাকনিউ বলছেন, ‘লোকজন যতটা না স্বীকার করে, তার চেয়েও এটা বেশি ঘটছে। পুলিশ হিসেবে আমরা এসব ঘটনার সঙ্গে পরিচিত।’

রাস্তায় যার যত বেশি সময় কাটে তার তত বেশি জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেটা তিনি পছন্দ করুন বা না-ই করুন।

সিয়াটলে করোনা মহামারির আগে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা শহরের মোট জনসংখ্যার আনুমানিক ১ শতাংশ ছিল। তবে সেখানকার কারাগারে বন্দিদের প্রায় ২০ শতাংশ ছিল গৃহহীন, যাদের বেশিরভাগই ছোট অপরাধে জেলে গিয়েছিলেন।

প্রিজন পলিসি ইনিশিয়েটিভের গবেষণা দেখা গেছে, সাধারণ নাগরিকের তুলনায় গৃহহীন ব্যক্তিদের অপরাধমূলক ইতিহাস ১০ গুণ বেশি। আশ্রয়হীনতার কারণে পুলিশের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হওয়া ও জেলে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

শহরের নীতিগুলোতে ফুটপাতে শুয়ে থাকা, অযথা ঘোরাঘুরি করা বা ভিক্ষাবৃত্তিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। শহরগুলো আশ্রয়ের স্থান নির্ধারণ করে গৃহহীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আইনকে ন্যায্যতা দেয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হলো, যে কেউ চাইলেই রাস্তার বাইরে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বেছে নিতে পারেন।

তবে আশ্রয়কেন্দ্রের শয্যাগুলো প্রয়োজনের সঙ্গে খুব কমই তাল মিলিয়ে চলে। এবং কারভারের মতো কিছু মানুষ এসব আশ্রয়কেন্দ্র ফাঁকা থাকার পরেও এড়িয়ে যান।

তারা বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে তারা অনিরাপদ ও অস্বস্তি বোধ করেন। অথবা সেখানে এমন নিয়ম আরোপ করা হয় যা অনুসরণ অযোগ্য। করোনা মহামারি চলার সময় অন্যদের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নেয়ার বিষয়টি পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।

গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, একজন ব্যক্তি কত ঘন ঘন কারাগার বেছে নিচ্ছেন তার চেয়ে বোঝা জরুরি কেন তিনি এটা করছেন। মৌলিক জায়গা থেকে, এটি উত্তর না পাওয়ার মতো কোনো কঠিন প্রশ্ন নয়।

কিং কাউন্টি রিজিওনাল হোমলেসনেস অথরিটির প্রধান ডনস বলেন, ‘আপনি কি কখনও কোনো সুরক্ষা ছাড়াই বাইরে ঘুমানোর চেষ্টা করে দেখেছেন? শীতের রাতের কথা ছেড়ে দিন, বসন্তের রাতেও এমন অবস্থায় আপনার হাত-পা খোয়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।’

কেউ কেন কারাগার বেছে নেন তা সত্যিকার অর্থে বোঝার অর্থ হল তারা কীভাবে সেই পছন্দের দিকে ধাবিত হলেন সেটি অনুধাবনের চেষ্টা করা।

ডনস বলছেন, ‘সেই আলোচনার শুরুতে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে, দেশ একটি আবাসন সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই সংকট মানুষদের স্থিতিশীল ঠিকানার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।

‘গৃহহীনতা একটি আবাসন সংকটজনিত সমস্যা। এটি অপরাধমূলক বা ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার বা আচরণগত সমস্যা নয়।’

কারও জেলে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণের বিষয়ে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে লংভিউ পুলিশ ক্যাপ্টেন ম্যাকনিউয়ের।

তিনি বলেন, ‘গৃহহীন ইস্যুতে গ্রেপ্তার আপনি বন্ধ করতে পারবেন না। তবে ঘরহীনদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দরিদ্রদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে এটি তাদের আচরণকে স্থায়ীত্ব দেয়।’

অবশ্য কখনও কখনও গৃহহীন ব্যক্তি এত গুরুতর অপরাধ করেন যে তা উপেক্ষা করা যায় না।

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

চার বছর আগে ম্যাকনিউ একজন গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতেন। সে সময় পুলিশের রেডিওতে একটি কল আসে। দক্ষিণ-পশ্চিম ওয়াশিংটনের কলম্বিয়া নদীর ধারে ৩৭ হাজার জনসংখ্যার শহর লংভিউতে পুলিশ স্টেশন থেকে মাত্র আধা ব্লক দূরে একটি ব্যাংকে ডাকাতি চলছে।

জিম্মি, গুলি, ধাওয়া এমন সব খারাপ পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিয়ে ম্যাকনিউ ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তবে এসবের পরিবর্তে তিনি ৬৮ বছর বয়সী একজনকে দেখতে পান, যার মাথাভর্তি টাক। মোটা চশমা পরা রিচার্ড গর্টন নামের ওই ব্যক্তি ব্যাংকের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

ম্যাকনিউ বলেন, ‘তাৎক্ষণিক স্পষ্ট হয়ে যায় অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে।’

গর্টন গ্রেপ্তার হতেই চেয়েছিলেন। ম্যাকনিউ শিগগিরই জানতে পারেন কয়েক বছর আগেও তিনি (গর্টন) জেলে যাওয়ার আশায় উত্তরে প্রায় ২০০ মাইল দূরে বেলিংহাম, ওয়াশিংটনে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি করেন। প্রতিবার গর্টন ছিলেন শান্ত, পুলিশ আসার পর স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন।

লংভিউতে ২০১৮ সালে ব্যাংক ডাকাতির জন্য সাত বছরের সাজা পান গর্টন। তিনি এখন অ্যাবারডিনের স্টাফোর্ড ক্রিক সংশোধন কেন্দ্রে আছেন।

তিনি আমাকে বলেছেন, বেলিংহামে প্রথম ব্যাংক ডাকাতি করেন ২০১৪ সালে। কারণ তখন তিনি ভেবেছিলেন একটি পাবলিক হাউজিং কমপ্লেক্সে নিজের অ্যাপার্টমেন্টটি হারাতে বসেছেন।

ডাকাতির প্রথম ঘটনায় তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর একজন দণ্ডিত অপরাধী হিসেবে স্থায়ী আবাসন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তিনি আরেকটি ব্যাংক ডাকাতি করেন, তারপরে আরেকটি, যতক্ষণ না তিনি তিন বছরের জেল পান।

তৃতীয় ডাকাতির পর তিনি রাস্তায় জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। তিনি স্পোকেনে ইউনিয়ন গসপেল মিশনে সাহায্য চেয়েছিলেন, তবে ধর্মের প্রয়োজনীয় বিধান মেনে চলতে পারেননি। একই ঘটনা ঘটে পোর্টল্যান্ডেও।

আর তাই কারামুক্তির মাত্র ১০ দিন পর তিনি আবার একটি ব্যাংকে ডাকাতির জন্য লংভিউ গিয়েছিলেন। এ দফায় দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়ার বাসনা পূর্ণ হয়।

গর্টন জানান, তার এখন খারাপ লাগছে। তবে খারাপ লাগার কারণ এটা নয় যে, তিনি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার উপর কোনো বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন। কারণটি হলো, তাকে বলা হয়েছে শেষবার ডাকাতির সময় পরিস্থিতির ধাক্কায় ব্যাংক টেলার (ক্যাশ ব্যবস্থাপনাকর্মী) খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।

গর্টন বলেন, ‘আমি সচেতন হয়েই এ পথে এসেছি। আমি জানি আঘাতপ্রাপ্ত লোকজন প্রায়ই ঘুরে দাঁড়ান এবং অন্যদের আঘাত করেন। কে জানে এখন এই ব্যাংক টেলার কোন পথে যাবেন?’

কলোরাডোর একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত এলাকা গোল্ডেনে পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে গর্টন বেড়ে ওঠেন। তিনি একটি স্টেট কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বছরের পর বছর কম বেতনে কেরানি ধরনের চাকরি করেন। এরপরেও লোকজনের সঙ্গে মিশতে তার সমস্যা হতো।

গর্টন বলেন, ২০০০ সালে তার অটিজম ধরা পড়ে এবং এই প্রতিবন্ধকতার সুবিধা পেতে শুরু করেন। প্রতি মাসে ৭০০ ডলার ভাতার পাশাপাশি তাকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাবলিক হাউজিংয়ে থাকার সুযোগ দেয়া হয়।

একপর্যায়ে তিনি বাসস্থান হারানোর ভয় পেতে শুরু করেন। অবশ্য তিনি কখনোই কোনো সমাজসেবা সংস্থার সাহায্য চাওয়ার কথা বিবেচনা করেননি। নির্ভর করার মতো পরিবারের কোনো সদস্যও ছিল না। প্রথম ব্যাংক ডাকাতি করার পর বন্ধুরাও তাকে অস্বীকার করতে শুরু করেন।

গর্টন বলেন, ‘তারা (বন্ধুরা) আমাকে বুঝতে পারেনি। আমার সঙ্গে ওরা কিছু করতে চায় না।’

গর্টন জানেন না কারাগার থেকে বের হয়ে কীভাবে বাঁচবেন। তিনি বলেন, ফের অপরাধে জড়াতে চান না অথবা আরও কোনো লোককে আঘাত করতে চান না। তাই অপরাধ এড়িয়ে যেভাবে চলা যায় সে বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

গর্টন বলেন, ‘আমি মনে করি গৃহহীনতার যন্ত্রণা সহ্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

প্রিলের এক শীতল রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। স্পোকেনের উচ্চতম ভবনগুলোর ছায়ায় ডেভেনপোর্ট হোটেল টাওয়ারের পিছনে একটি গলিতে কারভার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। শহরের ফ্ল্যাগশিপ বিলাসবহুল হোটেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ এলাকায়।

একটি আচ্ছাদিত সিঁড়ির নীচে গড়ে তোলা নিজের ক্যাম্পের দেয়াল ঘেঁষে বসেন কারভার। পেছনেই দেখা যাচ্ছে ‘অনুপ্রবেশ নয়’ চিহ্ন। দুই ব্লক দূরে ট্র্যাক ধরে ছুটে চলছে ট্রেন। কারভারের সারা দেহ নিজের মলে মাখামাখি। তার কোনো তাঁবু নেই।

তিনি বলেন, ‘তাঁবু মানেই পুলিশের লক্ষ্যবস্তু।’

শহরের রাস্তার পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগিয়ে আসতেই তিনি কম্বল গুটিয়ে নিয়ে একটি ছেঁড়া ব্যাগে প্যাক করেন। ব্যাগ থেকে বাতাস বের করে দিতে হাত দিয়ে চাপ দেন। এবার তিনি কম্বলটি গায়ের কোটের নীচে ভরে রাখতে পারবেন।

তার হাত ফাটা ও শুকনো, ঠান্ডা বাতাসে রক্তপাত শুরু হয়েছে, ব্যথায় শক্ত। কম্বলগুলো সুরক্ষিত হয়ে গেলে তিনি হিঁসহিঁস শব্দ তুলে গলিতে পা বাড়ান।

কারভার দক্ষিণে কয়েকটি ব্লক পরের শালম মিনিস্ট্রিজের দিকে যাচ্ছেন। সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাকে প্যানকেক এবং ওটমিলের তিনটি টু-গো বক্স দেবে।

অন্য গৃহহীনদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নতুন প্রজন্মের রুক্ষ জীবনযাপনকারীদের নিয়ে তার কণ্ঠে খেদ ঝরে। কারভার বুঝতে পারেন না এরা একসঙ্গে নেশা করার পরেও কীভাবে একে অপরকে ঠকাচ্ছে, মারধর করছে, এমনকি হত্যাও করছে।

কারভার একাকী শুধু গাঁজার নেশা করেন, সূঁচকে ভয় পান বলে কালেভদ্রে মেথ গ্রহণ করেন।

তিনি জানান, রাস্তায় লোকজনের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পান, কারণ তারা তাকে আক্রমণ বা ছিনতাই করতে পারেন।

তিনি বলেন, বহু বছর হয়ে গেছে কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছে। বয়ফ্রেন্ডরা মারধর করলে তারা এসে কান্নাকাটি করত, তবে এরপর আবার বয়ফ্রেন্ডদের কাছেই ফিরে যেত।

এটি কারভারের জন্য একটি সাধারণ সকাল। দুঃসহ অবস্থায় তার ঘুম ভেঙেছে। তিনি খাবার, বাথরুম ও শান্তিতে বিশ্রাম নেয়ার জায়গা খুঁজছেন। তিনি যেখানেই যান, ‘কোনো অনুপ্রবেশ নয়’ চিহ্নগুলো মনে করিয়ে দেয় তিনি অনাহূত।

কিছু দিন আগের মতো আজও তিনি স্থানীয় একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে থামেন। রোগী না হওয়ার পরেও কর্তৃপক্ষ তাকে ভিতরে যেতে দেয়।

সামনের দিকে একজন নারী লাইটার খুঁজছিলেন, তিনি কারভারকে দেখতে পান।

তিনি বলেন, ‘ওহ, কারভার, আমি জানি তোমার লাইটার আছে।’

‘এই নিন’, কারভার এগিয়ে যান।

এই সাহায্যের বিনিময়ে ওই নারী কারভারকেও একটি সিগারেট ধরিয়ে দেন। কারভারের আচরণ অত্যন্ত ভদ্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ, তবে নারীটি চলে যাওয়ার পরই তিনি ভেঙচি কাটেন।

‘উফ, মেন্থল।’

নিরাময় কেন্দ্রের ভিতরে তিনি গ্রুপ থেরাপির জন্য ব্যবহৃত ডাইনিং টেবিলে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে খাবারের বাক্স খোলেন।

ওটমিল এতই আঠালো যে প্লাস্টিকের কাঁটাচামচ প্রায় ভেঙে যায়। প্যানকেকগুলো পুড়ে গেছে। খাবারের সঙ্গে পাওয়া কিশমিশের ছোট বাক্সগুলো তিনি ফেলে দেন।

কিছু কুকিজ ও কফি আনতে কারভার উঠে যান। ফিরে এসে দেখেন রেবেকা নামে এক নারী চেয়ার দখল করে আছেন।

কারভার বলেন, ‘মাফ করবেন রেবেকা, আপনি আমার চেয়ারে বসেছেন।’

রেবেকা চেয়ার ছেড়ে দেন। তবে ফের অন্য কুকি এনে বসেতে গিয়ে দেখেন, টেবিলের প্রতিটি চেয়ার খালি থাকার পরেও রেবেকা আবার তার চেয়ারেই বসেছেন।

এরপরেও কারভার ভদ্র স্বরে বলেন, ‘রেবেকা, আপনি আমার চেয়ারে বসেছেন। আপনি কি এটা ছেড়ে দেবেন?’

রেবেকা আবার সরে যান। অবশেষে ঝামেলার মিমাংসা হয়। কারভার তার প্যানকেকের ওপর সিরাপ ছড়িয়ে দেন, মাথা নিচু করে নিবিষ্টভাবে দেখেন কীভাবে সিরাপ কেকের উপর দিয়ে ঝরে পড়ছে।

তিনি একটি চিনির কুকি নিয়ে কফিতে ডুবিয়ে রাখেন। চারপাশে লোকজনের উপস্থিতিকে তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না। এভাবে খাবার শেষ করতে ৩০ মিনিট লেগে যায়। সবশেষে নিজের জোগাড় করা সিগারেটের বিনিময়ে তিনি আরেক গৃহহীনের কাছ থেকে আধা কাটন দুধ নিয়ে গলায় চালান করেন।

একটি গ্রুপ সেশন শুরুর প্রস্তুতির মধ্যেই কারভার নিরাময় কেন্দ্র ছেড়ে বাইরের শীতার্ত পরিবেশে চলে আসেন।

তিনি বলেন, এরকম ঠান্ডা দিন কাঙ্ক্ষিত বিকল্প হিসেবে জেলখানাকে সামনে নিয়ে আসে। সেখানে অন্তত শান্তিতে খাওয়ার জন্য শহরজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।

আমি জিজ্ঞাসা করি, শীতকালে তিনি কোনটি পছন্দ করেন: জেল, নাকি রাস্তার জীবন?

একটু চিন্তা করে তার জবাব, ‘জেলখানা।’

তারপর একটি শর্ত যোগ করেন, ‘যদি সেখানে আমি গাঁজা খেতে পারতাম!’

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

ডিসিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আরবান ইনস্টিটিউটের সহযোগী ভাইস প্রেসিডেন্ট সারাহ গিলেস্পি গৃহহীনদের ক্ষেত্রে ‘পছন্দ (চয়েস)’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেন।

ইস্যুটির একজন গবেষক হিসেবে গিলেস্পি রাস্তার জীবন বা জেলে যাওয়াকে মানুষের পছন্দ ভাবার বিষয়টিকে ‘মিথ’ বলে অভিহিত করতে চান। তার গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষকে যদি আবাসন থাকা বা না থাকার সুবিধা বাছাইয়ের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে বেশিরভাগ মানুষ আবাসনকেই বেছে নেবে।

গিলেস্পি বলেন, ‘আমরা জানি সমাধানগুলো কী। এই জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে প্রয়োজনীয় সমাধানের জন্য আমাদের কী করতে হবে।’

তিনি বলেন, গৃহহীনতা থেকে কারাগারে যাওয়ার চক্রের অবসান ঘটানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়টি খুব পরিষ্কার। আর সেটি হলো সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা।

হিউস্টনে গবেষণাপ্রসূত উচ্চাভিলাষী ‘হাউজিং ফার্স্ট’ পদ্ধতি মানুষকে বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন দেয়ার মাধ্যমে দুর্দান্তভাবে গৃহহীনতা সমস্যার মোকাবিলা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেয়া হলে আশ্রয়কেন্দ্র, পুলিশ পরিষেবা এবং কারাগারে ব্যয়ের তুলনায় অর্থের সাশ্রয় ঘটবে।

যুক্তরাষ্ট্রে যাদের সহায়তা প্রয়োজন তাদের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করতে কত খরচ হবে সে বিষয়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কোনো অনুমান নেই।

তবে বাড়িভাড়া নিয়ে হিমশিম খাওয়া পরিবারকে সহায়তা দেয়া ফেডারেল হাউজিং ভাউচার প্রোগ্রামের একটি আরবান ইনস্টিটিউট বিশ্লেষণ বলছে, সহায়তার জন্য যোগ্য প্রতি পাঁচজন ভাড়াটের মধ্যে মাত্র একজন এটি গ্রহণ করেন। যোগ্য সবাইকে এ সহায়তার আওতায় আনা হলে অতিরিক্ত ১ কোটি ৯৭ লাখ মানুষ যোগ হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে আনুমানিক ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচ হবে।

গিলেস্পি ডেনভারভিত্তিক একটি কর্মসূচির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যারা ক্রিস কারভারদের মতো দীর্ঘদিন ধরে গৃহহীন ও ঘনঘন পুলিশের মুখোমুখি হচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের বিনামূল্যে বা বড় ভর্তুকিতে আবাসন সুবিধা দিচ্ছে। এসব ভাড়াটে এখনও মাদক গ্রহণ বা অ্যালকোহল সেবন করতে পারেন এবং বাড়িতে রাখতে পারেন। তবে তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তি নিরাময়ের সেবা বিদ্যমান।

তিন বছর কাটার পর ডেনভার কর্মসূচির আওতায় আসা ব্যক্তিদের প্রায় ৮০ শতাংশের থিতু হওয়ার মতো আবাসন বহাল রয়েছে। গিলেস্পির যুক্তি, এটাই বড় প্রমাণ যে দীর্ঘদিন ধরে ঘরছাড়ারাও বাড়ি পেলে তা গ্রহণ করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, একটি নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের তুলনায় এই কর্মসূচির আওতায় আবাসন পাওয়া ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা ৪০ শতাংশ কমে গেছে।

খরচের দিক থেকে হিসাব করলে এ ধরনের সরাসরি আবাসন প্রকৃতভাবে অর্থ বাঁচাতে পারে। কর্মসূচির আওতায় জনপ্রতি আবাসন খরচ বছরে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার ডলার। আরবান ইনস্টিটিউটের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অন্যান্য পরিষেবা যেমন রাস্তার ঝাড়ু দেয়া, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা, পুলিশি কর্মকাণ্ড এবং জরুরি তৎপরতাসহ অন্যান্য ব্যয়ের তুলনায় এই খরচ অর্ধেক।

গিলেস্পির যুক্তি, জেল ব্যবস্থাপনা, গৃহহীনতা এবং জরুরি পরিষেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বড় অংকের অর্থ ব্যয় হয়। এই পরিষেবাগুলোর পেছনে ব্যয়ের হিসাব করলে আবাসনে বিনিয়োগ করা অনেক বেশি যৌক্তিক।

কিং কাউন্টির হোমলেসনেস অথরিটির ডনসও মনে করছেন, কারভারের মতো ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা সর্বোত্তম উপায়। পর্যাপ্তসংখ্যক জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র থাকাও জরুরি, তবে অনেকেই এটি ব্যবহার করতে চাইবেন না। আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে ব্যয় করা কিছু ডলার আবাসনে বিনিয়োগ করে আরও ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

এমনকি তথাকথিত তাঁবুর শহরে পরিষেবা দেয়াও বেশ ব্যয়বহুল। সান ফ্রান্সিসকো শহর কর্তৃপক্ষ পরিচালিত গৃহহীনদের একটি ক্যাম্পে প্রতি তাঁবুর পেছনে বছরে আনুমানিক ৬০ হাজার ডলার খরচ হয়।

আগে হোটেল ছিল এমন ভবনগুলো সরকারিভাবে কেনার পক্ষে ডনস। কারণ এগুলো দ্রুত সাশ্রয়ী দামের আবাসনে রূপান্তর করা সম্ভব।

একটি আবাসন ব্যয়ের চেয়ে একজন গৃহহীকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থাপনার খরচ অনেক বেশি। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ভেরা ইনস্টিটিউট অফ জাস্টিসের তথ্য অনুসারে, একজন ব্যক্তিকে এক বছরের জন্য জেলে পাঠাতে গড়ে ৪৭ হাজার ৫৭ ডলার খরচ হয়, আর তাকে এক বছরের জন্য কারাগারে রাখতে ব্যয় হয় ৩৩ হাজার ২৭৪ ডলার।

এ কারণেই কলোরাডো কোয়ালিশন ফর দ্য হোমলেস-এর পাবলিক পলিসি অফিসার ক্যাথি অল্ডারম্যানের মতো বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন, ডেনভারের মতো কর্মসূচিগুলোকে প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি যত বার কারাগার বেছে নেন, ততবার একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার চিত্র প্রতিফলিত হয়।

অল্ডারম্যান বলেন, ‘এটি নীতিগত, রাজনৈতিক এবং তহবিলগত একটি ব্যর্থতা।’

এসব নীতি বিতর্কগুলোর বাস্তব কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় কারভারের মতো ব্যক্তিরা দুর্ভাগ্যের চক্রেই ঘুরপাক খেতে থাকেন।

ইডাহোর পোস্ট ফলসে বেটি আরফোর্ডের বাড়িটি সাদা রঙের, সামনের লন উজ্জ্বল সবুজে ঝকঝক করছে। পরিপাটি বাড়িটি আশেপাশের বাচ্চাদের বাস্কেটবল খেলার শব্দ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, ঘাস কাটার যন্ত্রের গুঞ্জনে মুখরিত।

এই দৃশ্য ঠিক ২৫ মাইল দূরে স্পোকেনের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আরফোর্ডের মেজ সন্তান ক্রিস কারভারের জীবনের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত।

৭০ বছর বয়সী আরফোর্ড বলেন, পাঁচ বছর আগে ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছে। কারভার তখন ভাঙা ডান নিতম্ব ও ফিমার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তার জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়েছিল।

তিনি (কারভার) পুলিশের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করা কোনো কিশোরের গাড়ির আঘাতে আহত হননি, যেমনটি তিনি এখন লোকজনদের বলছেন। প্রকৃতপক্ষে একটি ঝোপের চারপাশে ঘোরাঘুরি করার সময় তিনি সাইকেল থেকে পড়ে যান এবং তার পা ভেঙে যায়।

অস্ত্রোপচারের পরপরই চিকিৎসকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কারভার একটি হুইল চেয়ার নিয়ে ব্যান্ডেজসহ হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

এর কারণ হিসেবে মা আরফোর্ডকে তিনি কী বলেছিলেন? তিনি সেখানে নাকি গাঁজা খেতে পারছিলেন না!

কারভার ৩০ বছর ধরে পরিবারের কাউকে দেখতে না পাওয়ার যে দাবি করেছেন বাস্তবতা তার বিপরীত।

প্রকৃতপক্ষে আরফোর্ড- যিনি সাত বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে একটি মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক চালিয়েছেন তিনি বলেন, ছেলেকে সাহায্য করার চেষ্টা বছরের পর বছর ধরে করেছেন। এখনও তিনি স্থানীয় কারাগারের লগ চেক করে দেখেন, ছেলে কোথায় আছে।

আরফোর্ড বলেন, ‘আমরা জানি না ওর জন্য কী করতে হবে। আমার ভয় হয়, একদিন হয়ত শুনতে পাব ওকে কেউ খুন করেছে।’

কেলগ শহরের কাছেই দুই একর জমির ওপর বড় একটি বাড়ি কারভারদের। খ্রিস্টান পরিবারে বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তিনি বেড়ে ওঠেন। কেলগ ছোট একটি শহর, যেখানে জনপ্রিয় স্কি রিসোর্ট রয়েছে৷ তার বাবা গ্যারি কারভার পাশের বাঙ্কার হিল খনির ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। সপ্তাহান্তে পুরো পরিবার ক্যাম্পিং করতে যেত।

আরফোর্ড বলছিলেন, ‘গুরুতর এডিএইচডির (অ্যাটেনশন-ডেফিসিট/হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার) সম্ভাব্য ফল হিসেবে স্কুলে সবসময় ওর সমস্যা ছিল। ও অন্য বাচ্চাদের বিরক্ত করত, যে কারণে ওরা পাল্টা ধমক দিত। ও প্রায়ই স্কুল থেকে পালিয়ে যেত, রাতের খাবার পর্যন্ত বাড়ি ফিরত না।’

মিডল স্কুলে ভর্তির আগে তিনি (আরফোর্ড) কারভারকে কয়েক বছর হোম-স্কুল করিয়েছিলেন। তবে ছেলে সেই পরিবেশকে ‘কাজে লাগাতে পারেনি’ এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ শিক্ষা সহায়তার ব্যবস্থাও আরফোর্ড করতে পারেননি।

তিনি ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেডেন্টের কাছে যান। এলাকার আমেরিকান সিনেটরকে চিঠি লেখেন। তিনি একটি বিকল্প স্কুলের চেষ্টা করেছিলেন। একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলে ভর্তির আগে প্রায় ছয় মাস কারভারের জন্য একজন পূর্ণকালীন শিক্ষক ছিলেন। তবে এর কোনোটি কাজ করেনি।

কিশোর বয়সে কারভার প্রায়ই সমস্যা করতেন। বাসায় ভাংচুর চালাতেন, চুরি করতেন, মিথ্যা বলতেন। অন্য শিশুদের কাছ থেকেও পালটা গালি আরও বাড়ছিল। আরফোর্ড বলেন, ১৪ বছর বয়সে আশেপাশের কিছু শিশু ওকে শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ওর পায়ে দাহ্য তরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওর পায়ে সেই পোড়া দাগ এখনও আছে।

কারভারের দাবি অনুযায়ী তিনি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কিনা আরফোর্ডের জানা নেই। তবে আক্রান্ত হয়ে থাকলেও তিনি অবাক হবেন না। আরফোর্ড নিশ্চিত, তার ছেলে হিংস্র ব্যক্তি নন। তার সঙ্ঘাত শুধু সত্যের সঙ্গে।

আরফোর্ড বলেন, ‘সত্য যখন অধিকতর ভালো, তখনও সে মিথ্যা বলবে। সে একটি মিথ্যা বলা শুরু করে এবং তারপর এতবার বলতে থাকে যাতে সেটি বাস্তব মনে হয়।’

মা বলছিলেন, কারভার শুধু প্ররোচিত হয়েছেন, কখনও এর পরিণতি বিবেচনা করেননি। হাতে টাকা এলেই সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেন।

একটি বিষয় আরফোর্ড মনে করতে পারেন- তার ছেলে মাছ ধরা খুব পছন্দ করত। কখনও একাকী মাছ ধরত। তবে বাড়িতে সে কী করবে সে বিষয়ে কখনোই নিশ্চিত হতে পারতেন না আরফোর্ড।

১৮ বছরে পৌঁছানোর পর চুরি, লোকজনের ওপর চড়াও হওয়ার মতো অপকর্মের অভিযোগে কারভার গ্রেপ্তার হতে শুরু করেন। আরফোর্ড বলেন, কারভার ভয়ঙ্কর কোনো মাদক গ্রহণ না করলেও গাঁজা রাখার দায়ে প্রায়ই গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কারভারের নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়ার বন্দোবস্তের জন্য এডিএইচডি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা পেতে সাহায্য করেন আরফোর্ড। তবে এই তহবিল ব্যবস্থাপনার সময় মায়ের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তোলেন কারভার। পরে পুরো ব্যবস্থাপনা নিজের কাছে নিয়ে সহায়তার অর্থ অন্য কাজে ব্যয় শুরু করেন।

আরফোর্ড বলেন, ‘অর্থের বিষয়ে ওর কোনো ধারণা নেই। সহায়তা পাওয়ামাত্র সে বাইরে গিয়ে সব খরচ করে ফেলত, এভাবে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই কপর্দকশূন্য হয়ে যেত। অনেকেই তাকে আবাসন বা চিকিৎসাসেবা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা সে হয় গ্রহণ করে না, নয়ত গ্রহণ করার পর একটি ঝামেলা পাকায়।’

আরফোর্ড জানেন না কীভাবে ছেলেকে সাহায্য করবেন। তিনি এখনও ভাবেন, স্কুলে পড়ার সময় কারভারের মতো শিশুকে আরও বোঝার সুযোগ ঘটলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। এখন কারভারের বয়স প্রায় ৫০ বছর, জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি রাস্তায় বা জেলে কাটিয়েছেন।

আরফোর্ড মনে করেন, তার ছেলের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা প্রয়োজন।

তবে আইনত যতক্ষণ না তাকে নিজের বা অন্যদের জন্য হুমকি বলে মনে করা হবে ততক্ষণ তাকে প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রে পাঠানো যাবে না। আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই আইনটি বিদ্যমান। এতে মনে করা হয়, কারও জন্য হুমকি নন এমন কাউকে প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রে আটকে রাখা নির্দয়তা।

এরপরেও আরফোর্ড বিশ্বাস করেন, তার ছেলে মানসিক হাসপাতাল বা কারাগারে থাকার সময়ে সবচেয়ে শান্তিতে ছিল। সে আবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ভালো থাকে।

আরফোর্ড বলেন, তার ছেলেও হয়ত নিজের সম্পর্কে একই কথা ভাবে।

আমেরিকার গৃহহীনরা কেন বারবার জেলে যেতে চান

স্পোকেন শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি গির্জার সামনে সিঁড়িতে বসে আমি কারভারের কাছে জানতে চাই, তিনি নিজের জন্য কী চান। যদি তিনি নিজের জীবনের পরবর্তী কয়েক বছরকে একটি সুগঠিত রূপ দিতে সক্ষম হন, তাহলে সেটি কেমন হবে?

তিনি উত্তর দেন, ‘এ রকমই, নতুন কিছু না আসা পর্যন্ত।’

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী আসা পর্যন্ত?’

এর জবাব তার জানা নেই।

কারভার উল্লেখ করেন, তার এক বন্ধু একটি আবাসনে আছেন, যেখানে তিনি গাঁজা খেতে পারেন এবং কেউ তাকে বিরক্ত করে না।

আমরা ক্যাথলিক চ্যারিটিজ ইস্টার্ন ওয়াশিংটন পরিচালিত একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে আসা রাস্তার ধারে বসে আছি। এটি স্পোকেনে প্রতিষ্ঠানটির ‘হাউজিং ফার্স্ট’ নীতি কৌশলের আওতায় বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প। কোনো জবাবদিহি ছাড়াই আবাসন দেয়ার এই ধারণা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিতর্ক রয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি থাকার ঘর চান?’

তার জবাব, ‘ঘরটি কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করছে।’

হঠাৎ তিনি বিষয় পরিবর্তন করেন; ‘আমি গাঁজা সেবন করলে আপনি কি আপত্তি করবেন?’

নিরাময়কেন্দ্রের চত্বরে ধূমপানের অনুমতি নেই, তাই তিনি ব্লক পেরিয়ে একটি গির্জার সিঁড়িতে বসেন। ‘অনুমতিহীন প্রবেশ নিষিদ্ধ’ লেখাটিকে তিনি উপেক্ষা করেন। গাঁজার স্টিকে তিনবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। তার পৃথিবী যেন নিশ্চল ও ঘোলাটে হয়ে আসে। তার কথামালা- যেগুলো সাধারণত অস্পষ্ট বিড়বিড় ধরনের, তা অনেক পরিষ্কার হয়ে আসে।

১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই নিজের ১৩তম জন্মদিনে কীভাবে তুষারপাত হয়েছিল সে গল্প শোনান। একটি নির্দয় পৃথিবীতে তার অবস্থানের আরেকটি প্রতিফলন ঘটায় এই গল্প।

কারভারের জন্মদিনটি উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল হওয়ার কথা থাকলেও তিনি তুষারপাতের কথা শোনান। আবহাওয়ার রেকর্ড অনুসারে এ বক্তব্যও অসত্য।

গল্পটি চলতে থাকে। কারভার তুষার দেখে মায়ের ঘরে গিয়ে তাকে বলেন।

‘মা দেখো, জুলাই মাসে তুষার ঝরছে।’

মা বিশ্বাস করেন না।

তিনি অনুনয় করেন, ‘দেখো না, সত্যি তুষার পড়ছে।’

তারপর কারভারের গল্প অনুযায়ী, মা বাইরে ফিরে তাকান। তিনি দেখেন ছেলে সত্যি বলছে। মা তখন তার মতোই হতবাক। ছেলের জন্মদিনে সমস্ত দিন ধরে ঝরছে তুষার।

মা বলেন, ‘সত্যিই তো! জুলাই মাসে তুষারপাত হচ্ছে!’

গল্পটি শেষ করে কারভার হাসেন।

পুলিশের একটি দল এলাকায় টহলে বেরিয়েছে। কারভার তার কোট গুছিয়ে নিয়ে একটি গলিতে সেঁধিয়ে যান।

আরও পড়ুন:
রাশিয়ার কৃষি ও চিকিৎসাপণ্যে নিষেধাজ্ঞা নেই: যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান
খাসজমি দখলমুক্ত করে উপহারের ঘর
পশ্চিমে ইসলামফোবিয়ার পর এবার ‘রুশোফোবিয়া’
আমেরিকা-রাশিয়ার সর্বনাশে চীনের পৌষমাস

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Irans political circles are worried about youth protests

তরুণদের বিক্ষোভে চিন্তিত ইরানের রাজনৈতিক মহল

তরুণদের বিক্ষোভে চিন্তিত ইরানের রাজনৈতিক মহল ইরানের তেহরানে জাতীয় পতাকার ম্যুরালের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারী। ছবি: এএফপি
চলমান বিক্ষোভ ঘিরে অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো ইরান সরকার বিশ্বাস করে, নেতৃত্বহীন এসব বিক্ষোভ মিইয়ে যাবে। সরকারের দাবি, মাত্র ৮০ হাজার লোক রাস্তায় নেমেছে এবং প্রতিবাদকারীদের বিপ্লব সংঘটন বা নেতা তৈরির সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।

পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যু কেন্দ্র করে ইরানে ব্যাপক জনবিক্ষোভ চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দেশটির অভিজাত রাজনীতিকদের কপালে দেশকাঁপানো এই বিক্ষোভ বিদেশি গোয়েন্দা ষড়যন্ত্রের ফসল, নাকি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটের প্রভাব তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্লেষকদের মধ্যে তরুণ প্রজন্ম ইসলামি বিপ্লবের মূল্যবোধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কি না, তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকের জন্য

নানা বিতর্কে ঘেরা এই আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে নির্ধারিত হবে ইরানের রাজনৈতিক ওপরমহল এখন কী করবে। তারা বিক্ষোভকারী ও বাইরের শক্তির ওপর ক্র্যাকডাউন চালিয়ে প্রতিশোধের পথ বেছে নেবে, নাকি নেতৃত্বহীন তরুণদের সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপে বসবে।

প্রথম পদক্ষেপটি নিলে এবং তারপরও বিক্ষোভ বাড়তে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার পশ্চিমা দাবি আরও সংকুচিত হয়ে আসবে। ইরানের চলতি সরকার সংস্কারে সক্ষম কি না, সেটিরও পরীক্ষা হবে।

ইরান সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন এমন কয়েকজন পর্যবেক্ষক বর্তমানে দেশটির নৃশংসতার মাত্রায় নমনীয়তা দেখছেন। তারা বলেছেন, চলমান বিক্ষোভে ২০০ জনের বেশি প্রাণ হারালেও এই সংখ্যা ২০০৯ সালের বিক্ষোভে কয়েক দিনের মধ্যে ৪০০ জন নিহত হওয়ার তুলনায় কম। তারা এটাও মনে করাচ্ছেন, ২০০৯ সালের বিক্ষোভের পর শত শত মানুষকে কাহরিজাক কারাগারে নির্যাতন করা হয়।

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পস যে অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতাবাদীপ্রবণ বলে মনে করে সেই কুর্দিস্তান মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কাজে লাগাচ্ছে। গত মাসে নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাহসা মারা যান। এরপর ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।

চলমান বিক্ষোভ ঘিরে অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো ইরান সরকার বিশ্বাস করে, নেতৃত্বহীন এসব বিক্ষোভ মিইয়ে যাবে। সরকারের দাবি, মাত্র ৮০ হাজার লোক রাস্তায় নেমেছে এবং প্রতিবাদকারীদের বিপ্লব সংঘটন বা নেতা তৈরির সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।

এই দাবির সঙ্গে বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ একমত। তবে পশ্চিমাদের অধিকাংশই নারীর বৃহত্তর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। একজন পশ্চিমা পর্যবেক্ষক এমন মন্তব্যও করেছেন, তাদের (বিক্ষোভকারী) ‘কোনো ম্যান্ডেলা নেই, অং সান সু চি নেই’।

রেভল্যুশনারি গার্ডরা এ বিক্ষোভকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখতে চাইছেন না। তাদের মতে, এটি পশ্চিমা ও সৌদি মদতে চলা ইরান ইন্টারন্যাশনাল চ্যানেলের ষড়যন্ত্র।

রেভল্যুশনারি গার্ডকে সমর্থনকারী সংবাদপত্র জাভান বলছে, এ ষড়যন্ত্রের হোতা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের সাবেক প্রধান স্টেফানি আল-কাক।

পত্রিকাটির দাবি, আল-কাক দাঙ্গা শুরুর কয়েক দিন আগে ইরানে আসেন ও পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। রয়টার্স ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন কর্মী হিসেবে তার অতীতের রেকর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে পত্রিকাটি বলেছে, আল-কাক ‘একজন সংযোগকারী ও দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সাম্প্রতিক গোলমালের নির্দেশনা দিয়েছেন ও মিডিয়ার ফিল্ড অপারেশন নির্ধারণে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।’

তেহরানে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সাইমন শেরক্লিফ অবশ্য এ দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার হোসেন সালামিও দাবি করছেন, বিক্ষোভের পেছনে উসকানিদাতাদের ভূমিকা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের রাস্তা থেকে সাম্প্রতিক অস্থিরতার শিকড় ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, লন্ডন, তেল আবিব ও রিয়াদের কেন্দ্রে নিয়ে যাব।’

তার যুক্তি হলো, এই সংঘাতকে একটি সফল ইসলামি বিপ্লব ও ঈর্ষান্বিত পতনশীল পশ্চিমের মধ্যে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, বিক্ষোভকারীদের প্রতিটি মোলোটভ ককটেলের জন্য ৫০ হাজার তোমান (দেড় ডলার বা প্রায় ১৬০ টাকা) দেয়া হয়েছে।

৮৩ বছর বয়সী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, আলি খামেনি সংলাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং বিক্ষোভকে ‘ছোট ঘটনা’ ও ‘বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

তিন দশক ধরে খামেনির বৈধতা ও উত্তরাধিকারকে চ্যালেঞ্জ করা যাচ্ছে না। তারা মাহসার মৃত্যুকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সরকারি তদন্তে দাবি করা হয়েছে মাহসার মৃত্যু স্বাভাবিক। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ইরান ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার রাস্তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। প্রায় ৩০ লাখ ইরানি বার্ষিক আরবাইন তীর্থযাত্রায় ইরাকে গেছেন। এর আনুষ্ঠানিকতা ইমাম হুসেইনের হত্যাকে স্মরণ করে ৪০ দিনের শোকের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। এই ধর্মানুরাগ দেখে ইরানের আলেমরা আনন্দিত।

চলমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স প্রায় ২০-এর আশপাশে। এ নিয়ে আলেমদের বক্তব্য হলো, কীভাবে তারা দেশের তরুণদের একটি অংশকে হারিয়েছেন সে সম্বন্ধে আত্ম-অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

ইরানে ইন্টারনেট নিয়ে বিবাদ অনেক দিনের। পশ্চিমা ইন্টারনেটের অনুপ্রবেশকে ঐতিহ্যগত ইসলামি মূল্যবোধে আঘাত ও ব্যবহারকারীদের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তনের জন্য দায়ী করছেন দেশটির অনেক রক্ষণশীল। এই সপ্তাহে একজন আলেম দাবি করেছেন, ইন্টারনেট ক্রমশ ন্যাটো সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

জাভান দাবি করেছে, কোভিড লকডাউনের সময় ‘কিছুসংখ্যক হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবসায় যুক্ত হন। তাদের পেজগুলো জনপ্রিয় হওয়ার কারণে প্রচুর বিজ্ঞাপন পান এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করেন। তারা তাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তারা আরও কর্তৃত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন এবং আরও স্বাধীন হয়ে উঠেছেন।’

রক্ষণশীলদের মতে, পশ্চিমা ইন্টারনেট ইরানের যুবাদের নৈতিকতাকে বিপথে চালিত করছে। ইরানওয়্যারের কাছে ইমাম সাদিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাদেগ কুশাকি দাবি করেন, ‘বিক্ষোভকারীদের একমাত্র দাবি ছিল সুইমিং পুল, হিজাব অপসারণ ও ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে পার্টির স্বাধীনতা।’

পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য হামিদ রাসাই সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, “গুটিকয়েক ব্যক্তি রাস্তায় মাথার স্কার্ফ নেড়েছে তাদের চাওয়া কী বলে আপনাদের মনে হয়? তারা একমাত্র যে ‘স্বাধীনতা’ চায় তা হলো প্রতি রাতে ভিন্ন কারও সঙ্গে কাটানো ও পশুর মতো আচরণ করা।”

শাসকদের কট্টর বিরোধী পক্ষ ও আবেগপ্রবণ আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেশটির বিচার বিভাগ একটি ভ্রান্তিকর পার্থক্য তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষামন্ত্রী ইউসেফ নুরি নিশ্চিত করেছেন, কিছু স্কুলছাত্রকে সত্যিই আটক করা হয়েছে এবং তাদের ‘মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানে’ রাখা হয়েছে।

নুরি বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের ‘অসামাজিক’ আচরণ প্রতিরোধ করে তাদের মন সংস্কার ও পুনর্শিক্ষিত করা।”

এ সমাধান আদতে নৈতিকতা পুলিশের পুনর্শিক্ষা কর্যক্রম থেকে আলাদা কিছু নয়।

গ্রেপ্তার শিশুদের বাবা-মাকেও আটক করা হচ্ছে। অনেককে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ‘যথাযথ’ আচরণের শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেয়া হচ্ছে।

ইরানে নির্বাচনে টানা হার ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরমাণু চুক্তি-সংক্রান্ত বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দেশটির সংস্কারপন্থিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তাদের অভিযোগ, রক্ষণশীলরা এখন তাদের বোনা তিক্ততার ফসল কাটছে।

পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, মিডিয়াকে শৃঙ্খলিত করা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করার পর তরুণ ইরানিদের নিজেদের মুক্তির জন্য অন্য পথ খুঁজতে হয়েছে।

সংস্কারপন্থি পত্রিকা ইতেমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস হজরাতি ১৩ অক্টোবর এক খোলা চিঠিতে লিখেছেন, ‘বিবিসি ও ইরান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রতিটি ইরানি ... ইরানের রাষ্ট্রীয় সেন্সরের কারণে যুক্ত হয়েছেন।’

ইন্টারনেট যেভাবে ইরানি যুবাদের পালটে ফেলছে ও একটি অপূরণীয় জেনারেশন গ্যাপ তৈরি করছে তা উল্লেখ করে পত্রিকাটি একটি সতর্কতা বার্তা আবার ছাপিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের মা-বাবার ভূমিকা খুবই দুর্বল। শিক্ষক ও মা-বাবার মতো ঐতিহ্যগত শিক্ষাব্যবস্থা, হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাদের আনুগত্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।’

প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে ঘিরে রয়েছে মশাদ শহরের রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে আছেন তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আহমদ আলামলহোদা।

তারাই মূলত নৈতিকতা পুলিশকে হিজাব পরানোর জন্য চাপ বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ইরানের রাজনৈতিক শ্রেণি যে আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে তাতে সাড়া দেয়ার দক্ষতা তাদের আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। তবে এ মুহূর্তের জন্য, প্রমাণ ও অতীতের ঘটনাবলির বিবেচনায় বলা যায়, যারা বহিরাগতদের দোষারোপ ও দমন-পীড়নের পক্ষে তারাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

আরও পড়ুন:
‘চুল না ঢাকলে নারীদের ৭৪টি বেত্রাঘাত করা উচিত’
‘খোমেনির বাণী সত্য, আমেরিকা বড় শয়তান’
ইরানের লড়াকুদের পাশে বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকরা

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Why are you laughing knowing you are laughing?

কেন হাসছেন, জেনে হাসছেন তো?

কেন হাসছেন, জেনে হাসছেন তো? হাসিকে মানুষের সাধারণ অভিব্যক্তি মনে করা হলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে জটিল অনেক কারণ: ছবি: নিউজবাংলা
আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমাগত অনুমান করতে থাকে পরে কী হবে ও অন্যদের উদ্দেশ্য কী। সার্বক্ষণিক এ প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই হাস্যরস বিকশিত হয়েছে। মানুষ তার প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে নিরীহ অসংগতিগুলো খুঁজে বের করে আনন্দ পায়। হাসি আমাদের অসংগতিগুলো শনাক্ত করার ক্ষমতার একটি সর্বজনীন লক্ষণ।

অট্টহাসি, মুচকি হাসি, ফিচকে হাসি- কত ধরনের হাসিই না আমাদের মুখে অহরহ খেলে যায়। আমরা কেন হাসি, সেটাও অনেকের কাছে মনে হতে পারে ‘হাস্যকর’ প্রশ্ন।

ঠিক আছে, এই প্রশ্ন শুনে মন খুলে হেসে নিন, কিন্তু তারপর একটু ভেবে বলুন তো- কেন আমরা হাসি?

সাধারণভাবে হাসির কারণ অতি সাধারণ মনে হলেও বাস্তবে এর তল পাওয়া খুবই কঠিন। সাধারণ হাসি মোটেই কিন্তু সাধারণ নয়; উল্টো এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুগভীর মনোবিজ্ঞান, জটিল স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ, এমনকি বেশখানিকটা দার্শনিকতাও।

আমরা সব সময় খুশির কারণে হাসি- তেমনটি মোটেই সত্যি নয়। গভীর দুঃখের মাঝেও আমরা ফিক করে হেসে ফেলতে পারি, অন্যের দুর্দশাও আমাদের মুখে হাসি ছড়িয়ে দিতে পারে, নিজের বিব্রতকর পরিস্থিতি আড়াল করতেও হাসির আশ্রয় নিতে পারি আমরা।

হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিস্তর জটিলতা নিয়ে সায়েন্টিফিকআমেরিকানে প্রকাশিত নিবন্ধের কিছুটা সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।

‘হাউ মেনি সাইকোলজিস্টস ডাজ ইট টেক… টু এক্সপ্লেইন আ জোক?’- এমন শিরোনামের বাংলা করা যেতে পারে একটি কৌতুকের ব্যাখ্যার জন্য কতজন মনোবিজ্ঞানীর দরকার?

মনোবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান জ্যারেট ২০১৩ সালে এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। এতে তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি জানেন না মানুষ কেন হাসে।

এককথায় বলা চলে হাস্যরসের ধারণাটিই রহস্যময়। সবাই জানেন ও বোঝেন হাস্যরস কী, তবে একে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা বা এর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা কঠিন। হাস্যরস থেকে অট্টহাসি বা চাপা হাসির উদ্রেগ হতে পারে। নাটক, সিনেমা, কোনো ঘটনা, ছবি কিংবা শব্দ থেকে আমরা হাস্যরসের উপাদান পেতে পারি। নিরীহ কৌতুক থেকে শুরু করে, কড়া বিদ্রূপ, শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও আমাদের মস্তিষ্ককে নাড়া দিয়ে যায়।

হাস্যরসের উৎস অনুসন্ধানে কিছু গবেষণা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব উৎস আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেন্দ্রিক।


শ্রেষ্ঠত্ব ও পরিত্রাণ

দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পণ্ডিতরা ভেবেছেন, সব ধরনের হাস্যরসের একটি সাধারণ উপাদান রয়েছে। এই উপাদানের খোঁজ প্রথম করেছেন দার্শনিকেরা, পরে যোগ দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানীরা। মনোবিজ্ঞানীরা দার্শনিক ধারণাগুলোকে পরীক্ষামূলক ধারণায় রূপান্তর ঘটিয়েছেন।

হাস্যরস নিয়ে প্রাচীনতম তত্ত্বটি হলো, শ্রেয়তর বোধ থেকে কোনো মানুষ অন্যের দুর্ভাগ্যের মাঝে হাস্যরস খুঁজে পায় ও হাসে। প্লেটো থেকে শুরু করে অন্য গ্রিক দার্শনিকেরাও এ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন।

এরপর আঠারো শতকে আসে পরিত্রাণের তত্ত্ব। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দেয়া এ তত্ত্ব অনুসারে, হাসি মানুষকে নার্ভাস এনার্জি থেকে মুক্ত করে বা চাপ কমাতে সাহায্য করে।

ফ্রয়েড ব্যাখ্যা করেছেন, নিষিদ্ধ অশ্লীলতা, যৌনতাবিষয়ক বিদ্রূপগুলো কেন আমাদের কাছে মজাদার মনে হয়। এসব কৌতুকের চূড়ান্ত মুহূর্তে দৃশ্যত অনুপযুক্ত আবেগ দমনের চেষ্টা মানুষের থাকে না, উল্টো তা হাসির রূপ ধরে প্রকাশিত হয়।

হাস্যরসের তৃতীয় ব্যাখ্যা হলো, অসংগতি তত্ত্ব। মানুষ প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অসংগতিতে হাসে। অসংগতি তত্ত্বের মতোই আরেকটি তত্ত্ব হলো, কোনো ব্যক্তি একটি আপাত অসংগতির অপ্রত্যাশিত সমাধান বের করে ফেললেও হাসতে পারেন। যেমন, একজন ব্যক্তি কোনো বক্তব্যের দ্বৈত অর্থ ধরে ফেললে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সেটি আবিষ্কার করেন, এ সময় তার হাসি পায়।

মৃদু লঙ্ঘন

ওপরের ব্যাখ্যাগুলো থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার, তবে এগুলো থেকে সব জবাব মেলে না। এসব তত্ত্ব সব ধরনের হাস্যরসের ব্যাখ্যা দেয় না।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওপরের ব্যাখ্যা স্ল্যাপস্টিকের আবেদনকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে পারে না। স্ল্যাপস্টিক হলো ইচ্ছাকৃতভাবে করা কিছু আনাড়ি কমর্কাণ্ড অথবা বিব্রতকর ঘটনার ওপর ভিত্তি করে হাস্যকর কমেডি।

সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স জার্নালে ২০১০ সালে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারের এ. পিটার ম্যাকগ্রা ও কেইলেব ওয়ারেন আগের তত্ত্বগুলোর সীমাবদ্ধতা দূর করতে ‘মৃদু লঙ্ঘন’ নামে নতুন একটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেন।

ম্যাকগ্রা ও ওয়ারেনের প্রস্তাবিত তত্ত্ব অসংগতি তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত, তবে এর আওতা আরও বিস্তৃত।

তাদের মতে, একজন ব্যক্তি যখন স্বীকার করেন যে একটি নৈতিক, সামাজিক বা শারীরিক নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে, তবে এই লঙ্ঘনটি খুব আপত্তিকর, নিন্দনীয় বা বিরক্তিকর নয়; তেমন পরিস্থিতিও হাস্যরসের জন্ম দিতে পারে। অবশ্য নিয়ম লঙ্ঘনকে সব সময়েই ‘বড় সমস্যা’ হিসেবে দেখা লোকজন এ ধরনের রসিকতায় উল্টো বিরক্ত হতে পারেন।

উদাহরণ হিসেবে গির্জার একটি গল্প বিবেচনা করা যেতে পারে। সদস্য সংগ্রহের জন্য তারা বিশেষ অফার দিয়েছিল। প্রথম ছয় মাসে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে র‍্যাফেল ড্র করে বিজয়ীকে একটি এসইউভি গাড়ি পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সবাই পরিস্থিতিটিকে অসংগতিপূর্ণ বলে ধরে নিয়েছে, শুধু অবিশ্বাসীরা এটি নিয়ে সহজেই হাসতে পেরেছেন।

বহুল প্রচলিত একটি বিষয় হচ্ছে, হাস্যরস হলো ট্র্যাজেডি প্লাস টাইম। ম্যাকগ্রা, ওয়ারেন ও তাদের সহকর্মীরা ২০১২ সালে সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স জার্নালে এ ধারণাটিকে সমর্থন করেন। গুরুতর দুর্ভাগ্যের স্মৃতি (যেমন একটি গাড়ি দুর্ঘটনা) যত বেশি সময় যায়, ততই মজাদার মনে হতে পারে।

ভৌগোলিক বা মানসিক দূরত্বও এমন পরিস্থিতি তৈরি করে। একটি পরীক্ষায়, স্বেচ্ছাসেবকরা অদ্ভুতুড়ে ছবি দেখে বিমোহিত হয়েছেন (যেমন এক ব্যক্তি তার নাকে আঙুল দিয়ে চোখ দিয়ে বের করেছে)। ছবিগুলো ফটোশপে তৈরি করা জানার পর তারা বিমোহিত হন।

বিপরীতে, সাধারণ বিপত্তিকে (একজন ব্যক্তির দাড়ি বরফে জমে যাওয়ার ছবি) সত্যি বলে বিশ্বাস করার পর তারা বেশি হেসেছেন। ম্যাকগ্রার যুক্তি হলো, কোন জিনিস কতটা খারাপ এবং এটি কতটা দূরত্বে আছে তার মধ্যে ভারসাম্য ঠিক থাকলে একটা সর্বোত্তম কমিক পয়েন্ট পাওয়া যায়।


বিবর্তন তত্ত্ব

মৃদু লঙ্ঘনের ধারণাতেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি হাসির কারণ বর্ণনা করে, কিন্তু ব্যাখ্যা করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের বিবর্তনীয় সাফল্যের পেছনে হাস্যরসের ভূমিকা রয়েছে। নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী গিল গ্রিনগ্রস বলেন, হাস্যরস ও হাসি প্রতিটি সমাজে, একই সঙ্গে বনমানুষ (এইপ) ও এমনকি ইঁদুরের মাঝেও রয়েছে। এই সর্বজনীনতা একটি বিবর্তনীয় ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।

কোয়ার্টারলি রিভিউ অফ বায়োলজির ২০০৫ সালের ইস্যুতে নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির বিবর্তনবিদ ডেভিড স্লোয়েন উইলসন ও তার সহকর্মী ম্যাথিউ জার্ভেইস হাস্যরসের বিবর্তনমূলক সুবিধা ব্যাখ্যা করেছেন।

উইলসন ‘গ্রুপ সিলেকশন’ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা। এই তত্ত্বে মনে করা হয়, আমাদের মতো সামাজিক প্রাণী প্রাকৃতিক নির্বাচনের সময় এমন বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করে যা শুধু ব্যক্তিদের নয়, পুরো গোষ্ঠীর টিকে থাকাকে সাহায্য করে।

উইলসন ও জারভেইস দুটি ভিন্ন ধরনের হাসির ক্ষেত্রে মানুষের গ্রুপ সিলেকশনের ধারণাটি প্রয়োগ করেন। স্বতঃস্ফূর্ত, সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ ও অনিচ্ছাকৃত হাসি হলো আমোদ ও আনন্দের একটি প্রকৃত অভিব্যক্তি। একই সঙ্গে এগুলো মজা করার প্রতিক্রিয়া; এটি শিশুর হাসিতে বা সুড়সুড়ি দেয়ার সময় দেখা যায়।

আনন্দের এ প্রদর্শনকে ডুসেন হাসি বলা হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুইলেম বেঞ্জামিন আমান্দ ডুসেন দ্য বুলোন প্রথম এমন হাসির বর্ণনা দেন। বিপরীতে, নন-ডুসেন হাসি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত হাসির আবেগপূর্ণ অনুকরণ নয়। মানুষ একে একটি ঐচ্ছিক সামাজিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, কথোপকথন মজার না হলেও মানুষ হাসির ব্যবহার করে।

উইলসন ও জারভেইস বলেন, মুখের অভিব্যক্তি ও তাদের নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুপথ দুই ধরনের হাসির পার্থক্য গড়ে দেয়। ডুসেন হাসির উদ্ভব হয় মস্তিষ্কের স্টেম ও লিম্বিক সিস্টেমে (যেটি আবেগের জন্য দায়ী)। নন-ডুসেন হাসি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের প্রি-মোটোর এলাকা (পরিকল্পনা অংশগ্রহণ করে যে অংশ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

উইলসন ও জারভেইসের মতে, দুই ধরনের হাসি ও এর পেছনের স্নায়বিক প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে বিবর্তিত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত হাসির শিকড় প্রাথমিক পর্যায়ের প্রাইমেটদের খেলার মধ্যেও রয়েছে এবং এর সঙ্গে প্রাণীর কণ্ঠস্বরের মিল লক্ষ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিদিনকার কথোপকথন, অবজ্ঞা ও উপহাসের উদ্ভবের সঙ্গে ধীরে ধীরে ‘নিয়ন্ত্রিত হাসিও’ বিকশিত হয়ে থাকতে পারে।

গবেষকরা মনে করছেন, প্রাইমেটদের হাসি ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায়ে জৈবিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে। ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষদের মধ্যে মানসিক ও সামাজিক সংযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে ‘ডুসেন হাসি’।

সামাজিক নিয়মের অযৌক্তিক লঙ্ঘনকে ‘প্রোটোহিউমার’ বলছেন উইলসন ও জারভেইস। এ ধরনের হিউমার গ্রুপের কোনো সদস্যের হাসিকে অন্যদের জন্য স্বস্তিদায়ক, নিরাপদ ও হালকা আবেগের পথ প্রশস্ত করে দেয়।

পরবর্তীকালে মানব পূর্বপুরুষ আরও পরিশীলিত জ্ঞানীয় ও সামাজিক দক্ষতা অর্জনের পর ডুসেন হাসি ও প্রোটোহিউমার সব জটিল পরিস্থিতিতে হাস্যরসের ভিত্তি হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে কৌশলগত, হিসেবি, এমনকি উপহাসমূলক ও আক্রমণাত্মক নন-ডুসেন হাসিরও উদ্ভব ঘটে।

হাস্যরস ও হাসি যৌনসঙ্গী নির্বাচন এবং আগ্রাসী মনোভাব অবদমনে ভূমিকা রাখে বলেও মনে করেন অনেক গবেষক।


ভুল বের করা

ইনসাইড জোকস: ইউজিং হিউমার টু রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার দ্য মাইন্ড শিরোনামের বইটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এর রচয়িতা আমেরিকার ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি অফ ব্লুমিংটনের ম্যাথিউ এম হার্লি, টাফটস ইউনিভার্সিটির ড্যানিয়েল ডেনেট ও পেনসিলভিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রেজিনাল অ্যাডামস জুনিয়র।

হার্লি তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘হাস্যরস কোনো না কোনো ভুলের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিটি শ্লেষ, কৌতুক ও হাস্যরসাত্মক ঘটনার মধ্যে বোকাসোকা কারও ভুল থাকে বলে মনে হয়।’
সবাই ওই ভুলটি উপভোগ করেন। তবে এখানে প্রশ্ন হলো, ভুলটি কোনো অপছন্দের ব্যক্তি বা প্রতিদ্বন্দ্বী করে থাকলে মজা করা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রিয়জনের ভুলও কেন আমরা উপভোগ করি?

হার্লির মতে, ভুল করাকে আমরা উপভোগ করি না, বরং ভুলটিকে চিহ্নিত করার বিষয়টি উপভোগ করি।

হার্লির পর্যবেক্ষণ, আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমাগত অনুমান করতে থাকে পরে কী হবে ও অন্যদের উদ্দেশ্য কী। সার্বক্ষণিক এ প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই হাস্যরস বিকশিত হয়েছে। মানুষ তার প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে নিরীহ অসংগতিগুলো খুঁজে বের করে আনন্দ পায়। হাসি আমাদের অসংগতিগুলো শনাক্ত করার ক্ষমতার একটি সর্বজনীন লক্ষণ। এটি একটি চিহ্ন, যা আমাদের সামাজিক মর্যাদা উন্নত করে এবং আমাদের প্রজনন অংশীদারদের আকৃষ্ট করে।

কৌতুক (জোক) এটি একটি ‘অতি স্বাভাবিক’ উদ্দীপনা, যা যৌন আনন্দেরও বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ক্ষেত্রে ভুল ধরার ফলে এ আনন্দ অনুভূত হয়। ২০১৩ সালে হার্লি মনোবিজ্ঞানী জ্যারেটকে বলেছিলেন, মানুষ কী কারণে হাসে সে তত্ত্বটি আসলে অনুমানেরও বাইরের। এটি হাস্যরসের জ্ঞানীয় মূল্য ও টিকে থাকার ভূমিকাকেও ব্যাখ্যা করে।

তার পরও গ্রিনগ্রস ইনসাইড জোকসের একটি পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছেন, এই তত্ত্বটিও অসম্পূর্ণ। এটি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেও আরও কিছু বিষয় অমীমাংসিত রাখে। যেমন, ‘কেন আমাদের মেজাজ বা অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে হাস্যরস ও উপভোগের উপলব্ধি পরিবর্তিত হয়?’

ইতালিয়ান মনোবিজ্ঞানী ও হাস্যরস নিয়ে গবেষণায় যুক্ত জার্নাল আরআইএসইউর (রিভিসতা ইতালিয়ানা দি স্তুদি সুলুমোরিসমো) সম্পাদক জোভান্নাতোনিও ফোরাবস্কোও বিষয়টিতে একমত।

তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি।’


যে প্রশ্নের উত্তর নেই

অনেক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের রবার্ট প্রোভাইন তার ‘কারেন্ট ডিরেকশনস ইন সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’ বইয়ে দেখিয়েছেন, মানুষ একা যতটা হাসে, অন্যেদের সঙ্গে তার ৩০ গুণ বেশি হাসে। প্রোভাইন ও তার ছাত্ররা একটি গবেষণায় গোপনে মানুষকে তাদের দৈনন্দিন কাজের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে দেখেছেন।

ফোরবস্কো দেখেছেন, হাস্যরস ও হাসির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

তিনি বলেন, ‘হাসি একটা সামাজিক ঘটনা। হাস্যরস ছাড়াও হাসির উদ্রেগ হতে পারে। হাস্যরস যে সব সময় হাসি উৎপাদন করবে, তেমনটা নয়।’

তিনি এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে একজন ব্যক্তির অবমাননা করা হয় বা যেখানে একটি পর্যবেক্ষণ মজার মনে হলেও তা থেকে হাসি পায় না।

আরেকটি আলোচনার বিষয় হলো, যৌন আকর্ষণ ও প্রজনন সাফল্যে হাস্যরসের ভূমিকা। গবেষকরা দেখেছেন, পুরুষের হাস্যকর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং নারীদের ক্ষেত্রে হাস্যরসের প্রশংসা করার সম্ভাবনা বেশি। এর অর্থ হলো, পুরুষ মনোযোগ পেতে এ জন্য বেশি প্রতিযোগিতা করে এবং নারীরা বেছে নেয়।

ফোরাবস্কো বলেন, ‘কোনো একক তত্ত্ব দিয়ে হাস্যরসের রহস্য বের করার কথা ভাবাটা বাড়াবাড়ি। আমরা এর অনেকগুলো দিক অনুভব করতে পারি। এখন নিউরোসায়েন্স গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করছে। এতে তা দিয়ে কোনো একক সারমর্ম বের করা সম্ভব নয়। যেমন করে ভালোবাসার একক কোনো সংজ্ঞা দেয়া যায় না। আমরা প্রেমিকের হৃদস্পন্দনের ওপর প্রেয়সীর দৃষ্টির প্রভাব পরিমাপ করতে পারি। তবে এর মাধ্যমে ভালোবাসার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। হাস্যরসের বিষয়টিও একই রকম।’

তবু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এখন বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত। ফোরাবস্কোর মতে, এর একটি হলো অসংগতির উপলব্ধি।

তিনি বলেন, ‘এটা জরুরি কিন্তু পর্যাপ্ত নয়, কারণ কিছু অসংগতি রয়েছে যেগুলো হাস্যকর নয়। যে কারণে অন্য কী উপাদান আছে সেগুলো আমাদের খুঁজে দেখতে হয়। আমার মনে হয়েছে, অসংগতি সম্পূর্ণরূপে সমাধান না করে উপশম করা প্রয়োজন।’

অন্যান্য জ্ঞানীয় ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদান থেকে কৌতুকের অনুসন্ধান করা যেতে পারে। ফোরাবস্কোর মতে, এগুলোর মধ্যে আগ্রাসন, যৌনতা, বিকৃতমনা ও ছিদ্রান্বেষী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো কৌতুকে থাকতেই হবে তেমনটা নয়, তবে সবচেয়ে মজার কৌতুকগুলো এসব প্রসঙ্গ নিয়েই হয়। একইভাবে, মানুষ ওইসব রসিকতায় সবচেয়ে হাস্যরস পায়, যেগুলো ‘খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও দুষ্টপ্রকৃতির।’

ফোরাবস্কো বলেন, ‘হাস্যরস কী? এটা হয়তো ৪০ বছর পর আমরা জানতে পারব।

আরও পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে রাখি পাঠালেন মমতা
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন খুদে বিজ্ঞানী নাবিহা
মৃতদেহে প্রাণ ফেরানোর গবেষণায় বিরাট অগ্রগতি
খুনিচক্র আমাকেও সরাতে চায়: প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা: জামিন হয়নি ৪ আসামির

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Penalty of lakh rupees for urinating in girlfriends bag

গার্লফ্রেন্ডের ব্যাগে প্রস্রাব করায় লাখ টাকা জরিমানা

গার্লফ্রেন্ডের ব্যাগে প্রস্রাব করায় লাখ টাকা জরিমানা প্রতিকী ছবি
আদালত ব্যাগটিকে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠালে ব্যাগের মধ্যে প্রসাবের নমুনা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, প্রসাবের ডিএনএ অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএর সঙ্গেও মিলে যায়। এ পর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার করে নেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সিভিল আদালত সম্পতি ৩১ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে ১৫ লাখ উয়ন জরিমানা করেছে। ঝগড়ার একপর্যায়ে তিনি তার প্রাক্তন বান্ধবীর লুই ভিটন ব্যাগে প্রসাব করেছিলেন বলে এই জরিমানা করা হয়।

অডিটি সেন্ট্রালের প্রতিবেদনে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি (গোপনীয়তার স্বার্থে যার নাম প্রকাশ করা হয়নি) গত বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার গাংনাম-গু শহরে বান্ধবীর বাড়িতে ছিলেন। বান্ধবীর বাড়তি খরচের প্রবণতা নিয়ে হঠাৎ তারা তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তর্কের একপর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি ভিতরের রুমে গিয়ে লুই ভিটন ব্যাগটি নিয়ে আসেন এবং বান্ধবীর সামনেই সেটার মধ্যে প্রস্রাব করে দেন।

ভদ্রমহিলা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেননি। তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন।

দক্ষিণ কোরিয়ার অনলাইন পত্রিকা গ্যাগ ডট কে-আইডোলার প্রতিবেদনে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। আদালতকে জানান, তিনি প্রস্রাব করার ভান করেছিলেন শুধু।

আদালত ব্যাগটিকে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠালে ব্যাগের মধ্যে প্রস্রাবের নমুনা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, প্রস্রাবের ডিএনএ অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএর সঙ্গেও মিলে যায়। এ পর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার করে নেন।

দামি ব্যাগটি নষ্ট করার কারণে সিউল সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক পার্ক হাই-রিম অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১৫ লাখ উয়ন বা ১ লাখ ৮ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বিচারক বলেন, তাকে কম শাস্তি দেয়া হলো কারণ এটা তার প্রথম অপরাধ।

আরও পড়ুন:
পাকিস্তানের দুই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে টুপি-চকলেট চুরির অভিযোগ
দক্ষিণ কোরিয়ার ভিসা পাবেন না বাংলাদেশিরা
শরতের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি চায় দক্ষিণ কোরিয়া
নতুন ধরনের করোনা দক্ষিণ কোরিয়াতেও
ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটার যাবে হাইপারলুপ

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Why was India divided 75 years ago?

৭৫ বছর আগে ভারত কেন ভাগ হলো

৭৫ বছর আগে ভারত কেন ভাগ হলো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মোহনদাস গান্ধী ভারত বিভাজন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছিলেন। ছবি: টুইটার
ড. গ্যারেথ প্রাইস বলেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা ঘনিয়ে আসার সময় অনেক ভারতীয় মুসলিম ভাবতে শুরু করেন, তারা কীভাবে একটি হিন্দুশাসিত দেশে থাকবেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাই আলাদা একটি মুসলিম দেশের জন্য তারা আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন জোগানো শুরু করেন।’

এখন থেকে ৭৫ বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশ তবে যাওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে দুটি ভাগে করে দিয়ে যায় ভারত পাকিস্তান

দেশভাগের পরই শুরু হয় দাঙ্গা দেড় কোটি মানুষ বাস্তুহারা হন, সহিংসতায় প্রাণ হারান ১০ লাখ ওই বিভাজনের পর থেকে ভারত পাকিস্তান চিরশত্রুতে পরিণত হয়

১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আর ১৫ আগস্ট ভারতের উপমহাদেশে বিভাজনের ৭৫ বছর উপলক্ষে এক নিবন্ধে বিবিসি বিশ্লেষণ করেছে পেছনের কারণগুলো সেটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য

বিভাজনের মূল কারণ কী

১৯৪৬ সালে ব্রিটেন ভারতকে স্বাধীনতা দেয়ার ঘোষণা দেয়। দেশটির শাসনকাজ চালানোর সক্ষমতা হারানোর পর তারা যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছিল।

ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত স্বাধীনের তারিখ ঠিক করেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।

এ অঞ্চলের ২৫ শতাংশ নাগরিক ছিল মুসলমান, বাকিদের অধিকাংশ হিন্দু। এরপর ছিল শিখ, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।

ভারতের দ্য আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিস রিসার্চ কাউন্সিলের অধ্যাপক নাভতেজ পুরেওয়াল বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতের মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজনের জন্য ব্রিটিশরা ধর্মকে বেছে নেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা স্থানীয় নির্বাচনে মুসলিম ও হিন্দু ভোটারদের জন্য আলাদা তালিকা তৈরি করেছিল।

‘মুসলমান রাজনীতিকদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল। একই রকম সংরক্ষিত আসন ছিল হিন্দুদের জন্যও। রাজনীতিতে ধর্ম বড় একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যাটাম হাউস ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের সদস্য ড. গ্যারেথ প্রাইস বলেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা ঘনিয়ে আসার সময় অনেক ভারতীয় মুসলিম ভাবতে শুরু করেন, তারা কীভাবে একটি হিন্দুশাসিত দেশে থাকবেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাই আলাদা একটি মুসলিম দেশের জন্য তারা আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন জোগানো শুরু করেন।’

কংগ্রেস পার্টির স্বাধীনতা-আন্দোলনের নেতা মোহনদাস গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু এমন এক অখণ্ড ভারত চাচ্ছিলেন, যা সমস্ত ধর্মকে বরণ করে নেয়। তবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীনতার অংশ হিসেবে দেশভাগের দাবি তোলেন।

ড. প্রাইস বলেন, ‘অখণ্ড ভারত কীভাবে কাজ করবে সেটা ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যেত। দেশভাগ ছিল দ্রুত ও চটজলদি একটা সমাধান।’

দেশভাগে ক্ষতির পরিমাণ কতটা?

ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করেন।

উপমহাদেশকে তিনি মূলত দুটো বৈশিষ্ট্যে ভাগ করেন:

. হিন্দু অধ্যুষিত মধ্য দক্ষিণাঞ্চল

. উত্তর-পশ্চিম উত্তর-পূর্বের দুটি অঞ্চল যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ

তবে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলিমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করত। প্রায় দেড় কোটি লোককে বহু পথ পাড়ি দিয়ে সীমানা অতিক্রম করতে হয়।

১৯৪৬ সালে কলকাতা রায়টের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ কারণেও বহু লোককে ঘরছাড়া হতে হয়। কলকাতার দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ মানুষ মারা পড়েন।

এসওএএস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের অধ্যাপক এলানর নিউবিগিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডানপন্থি হিন্দু গ্রুপ ও মুসলিম লীগ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছিল। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো মানুষদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত।’

কমপক্ষে ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ লোক এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রোগশোকে ভুগে মারা যান। হিন্দু ও মুসলিম হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ, অপহরণ বা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।

৭৫ বছর আগে ভারত কেন ভাগ হলো
প্রস্তাবিত পাকিস্তান ও ভারতের মানচিত্র (বাঁয়ে), চূড়ান্ত কার্যকর হওয়া মানচিত্র । ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা



বিভাজনের চূড়ান্ত ফল কী

দেশভাগের পর থেকে কাশ্মীর প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৫ সালে দুই দেশ যুদ্ধে জড়ায়। ১৯৯৯ সালে কারগিলেও লড়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বর্তমানে দেশ দুটি কাশ্মীরের দুটি ভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করে।

বর্তমানে পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম হিন্দু। ড. প্রাইস বলেন, ‘পাকিস্তান দিনে দিনে আরও বেশি ইসলামপন্থি হয়ে উঠছে। এর মূল কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার বড় একটা অংশ মুসলমান এবং খুব বেশি হিন্দু দেশটিতে বাস করেন না। একইভাবে ভারত এখন হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে।’

ড. নিউবিগিন বলেন, ‘ভারত ভাগের পরবর্তী আখ্যানটি দুঃখজনক। দুই দেশেই শক্তিশালী ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমে এসেছে এবং তারা আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে আছে।’

অধ্যাপক পুরেওয়াল যোগ করেন, ‘১৯৪৭ সালে হয়তো অবিভক্ত ভারত রাখা সম্ভব ছিল। হয়তো কয়েকটি রাজ্যের ফেডারেশন হিসেবে একে গঠন করা যেত, যেখানে কয়েকটি রাজ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকতেন। তবে গান্ধী ও নেহরু দুজনেই কেন্দ্রশাসিত অবিভক্ত একটি রাষ্ট্রের ধারণায় অটল ছিলেন। তারা ভাবেননি যে সংখ্যালঘু মুসলিমরা কীভাবে সে দেশে থাকবেন।’

আরও পড়ুন:
কাশ্মীরে বন্দুকধারীর হামলায় ৩ ভারতীয় সেনা নিহত
বিকিনি পরায় চাকরি খোয়ালেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা
কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ৭ সেপ্টেম্বর থেকে

মন্তব্য

আন্তর্জাতিক
Learn from Sheikh Hasina Pakistani bureaucrats

শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখুন: পাকিস্তানি আমলা

শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখুন: পাকিস্তানি আমলা
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৭৫ শতাংশ দরিদ্র ছিল, কিন্তু এখন পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ ধনী। পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ অংশে এক কোটি বেশি জনসংখ্যা ছিল। আর এখন পাকিস্তানের ২৩ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। ‘টেকঅ্যাওয়ে ফ্রম বাংলাদেশ’স লিডারশিপ’ শিরোনামে মঙ্গলবার প্রকাশিত নিবন্ধটির লেখক সাহেবজাদা রিয়াজ নূর। কেমব্রিজ থেকে স্নাতকোত্তর সাহেবজাদা রিয়াজ নূর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মুখ্য সচিব ছিলেন। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যার কৃতিত্ব দেশটির নেতৃত্বকে দেয়া যেতে পারে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন, এই সেতুকে দেশের ‘গর্ব ও সামর্থ্যের প্রতীক’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

শেখ হাসিনা ১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। তিনি রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতির ভারসাম্যের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা তার বাবার সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা থেকে বাজারভিত্তিক পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলো থেকে শিখেছেন, যাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের ভিত্তি চারটি। এই ভিত্তিগুলো হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন, রপ্তানিকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাণিজ্য উদারীকরণ এবং আর্থিক সংযম।

একটি সম্মেলনে এক অর্থনীতিবিদ যখন তাকে বাণিজ্য উদারীকরণের সুবিধা সম্পর্কে বলছিলেন, শেখ হাসিনা থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বাণিজ্য উদারীকরণের বিষয়ে আমাকে বোঝাতে হবে না। আমি যখন যুগোস্লাভিয়া সীমান্তবর্তী ইতালির শহর ত্রিয়েস্তে আমার পদার্থবিদ স্বামীর সঙ্গে থাকতাম, তখন দেখেছি, সীমান্ত সপ্তাহে তিন বার খোলা থাকছে এবং দুই পাশ থেকে মানুষ যাতায়াত করছে, পণ্য কিনছে এবং আবার ফিরে যাচ্ছে।’

এতে এটিই প্রমাণ হয়, রাজনীতিবিদরা সাধারণত যেসব বিষয়ে আকৃষ্ট হন, তার পরিবর্তে শেখ হাসিনা অর্থনীতির দিকে আন্তরিকভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন।

১৯৭১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জবাবদিহির অভাব এবং সামরিক শাসনের প্রভাব থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী অন্তরালে রয়েছে। বেসামরিক সরকারগুলোর ঘন ঘন পা পিছলে পড়া এবং সরকারগুলোর সামান্য বৈধতা বা অবৈধতার অভিজ্ঞতা পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির গণতান্ত্রিক ইতিহাস মোটেই নিষ্কলঙ্ক নয় এবং এখানকার সরকার দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে জনসাধারণের সমালোচনা বারবার এড়িয়ে গেছে।

দেশ শাসনে অল্প অভিজ্ঞতা থাকার পরেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দূরদর্শী এবং দৃঢ় প্রত্যয় ধারণ করেছেন। তিনি মনে করেছেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায়।

বিরোধীদেরকে বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকলেও ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৭০ সালে দেশটি ৭৫ শতাংশ দরিদ্র ছিল, কিন্তু এখন পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ ধনী।

পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ অংশে জনসংখ্যা ১ কোটি বেশি ছিল। আর এখন পাকিস্তানের ২৩ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ৪৭ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ২৮ বিলিয়ন ডলার।

পাকিস্তানের ১ হাজার ৫৪৩ ডলারের তুলনায় বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার। বাংলাদেশে ২০২২ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪১১ বিলিয়ন, পাকিস্তানে তা ৩৪৭ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ, পাকিস্তানে আগে যা ছিল ১২-১৫ শতাংশ। পাকিস্তানে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ২১ শতাংশ হয়েছে, সমনে এই হার আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া, পাকিস্তানি রুপির তুলনায় বাংলাদেশি টাকা অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর উচ্চ অংশগ্রহণের পাশাপাশি সাক্ষরতার হার অনেক বেশি।

পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও নিজস্ব স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বারবার কারসাজির ফলে শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক এবং পরিবারতন্ত্রবহির্ভূত রাস্তায় রাজনৈতিক দলগুলোর পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

এটা অনস্বীকার্য যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, শক্তিশালী বেসামরিক প্রতিষ্ঠান এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে একটি রাষ্ট্র পেয়েছে, যেখানে শক্ত রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে একটি দুর্বল বুর্জোয়া জনগোষ্ঠী গ্রহিতা-দাতার সম্পর্কে বিন্যস্ত।

শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখুন: পাকিস্তানি আমলা
সাহেবজাদা রিয়াজ নূর

দেশটি অনিবার্যভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ও কর্তৃত্বমূলক গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কৃষি এবং ব্যবসায়িক আয়কে করের আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। প্রচুর শিল্প-কারখানা যেকোনো ধরনের শুল্ক থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত। আমাদের পার্লামেন্টে আধিপত্য ভূস্বামীদের, ফলে কৃষি আয়করের বিষয়টিকে নাকচ করে দেয়ার বিষয়টি আশ্চর্যজনক নয়। তবে এর ফলে কৃষি ও শিল্প খাতে কম করের কারণে সামগ্রিক কর জালটি ছোট থেকে গেছে।

পাকিস্তানে ১৯৫৮ সাল থেকে সরকারের সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা জনগণের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে সামন্ত শক্তিকে বাড়িয়েছে। পাকিস্তান যে উন্নয়নের পথ অনুসরণ করেছে, তা কেবল সুবিধাভোগী, ধনী এবং অভিজাতদের পক্ষে গেছে। এসব গোষ্ঠীর এখন রাষ্ট্রের প্রতি ন্যায্য ভূমিকা পালন করা উচিত।

বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করে পাকিস্তানি নেতৃত্বকে অবশ্যই জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ অনুসরণ করতে হবে এবং আঞ্চলিক শান্তির পাশাপাশি সাংবিধানিক শাসনকে এগিয়ে নিতে হবে।

কার্যকর প্রতিরক্ষার সঙ্গে আপস না করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ভারত, ইরান, চীন, আফগানিস্তান এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানি বৃদ্ধির মডেল তৈরির ক্ষেত্রে উচ্চ-মূল্য-সংযোজিত পণ্যের উপর ফের জোর দেয়া উচিত।

পাকিস্তান তুলনামূলক সস্তা শ্রমের যে সুবিধা ভোগ করছে সেটিকে উন্নত দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে নারীদের জন্য শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি নিরাপদ এবং অনুকূল আইনি পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষি আয়ের উপর একটি ন্যায্য কর আরোপের শক্তিশালী প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। ধনী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ অবদান রাখতে হবে। বড় করপোরেট ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোকে করের আওতায় আনতে হবে।

পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। তবে প্রধান পদক্ষেপটি হওয়া উচিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারের বিষয়টি অনুসরণ করা, যা প্রতিরক্ষা এবং গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন:
আরও দুই মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত
রেমিট্যান্সের পর অর্থনীতির চাপ কমাচ্ছে রপ্তানির উল্লম্ফন
ইমরান খানের পিটিআই নিয়েছিল নিষিদ্ধ বিদেশি অনুদান
পাকিস্তানে বন্যায় ১৩৬ মৃত্যু, ইরানে ৬৯
অনিবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা আমানতে সুদ বাড়ল

মন্তব্য

p
উপরে