ভূমিকম্পের মতোই তালেবানের আফগানিস্তান দখলের প্রভাব আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অনেক বছর থেকে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আর্থ-সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তালেবানশাসিত আফগানিস্তান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, কট্টরপন্থি তালেবান সাংগঠনিক আধুনিকায়নের কথা বললেও কার্যত তারা আগের মতোই আছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা নেয়ার প্রথম মাসের তালেবান সরকার আর ২০ বছর আগে প্রথম ক্ষমতায় থাকা তালেবান সরকারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না।
ওই কর্মকর্তার মতে, আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়ো করে বিশৃঙ্খলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী ২০ বছরে নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের মতো আমাদের ওপর ভেঙে পড়েছে আফগানিস্তান। এই সংকট অনেক, অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে…পরের ২০ বছর কি আমরা আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার ছায়ার ওপর নির্ভর করতে পারব? আমার মনে হয় যে, পরিস্থিতি এখন সত্যিই জটিল, ভীষণ জটিল।’
তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পারস্য উপসাগরবিষয়ক নীতিমালা কার্টার ডকট্রিনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক ছিল আফগানিস্তান অধ্যায়।
১৯৮০ সালে এ নীতিটি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল নীতিটিতে। মূলত বিদেশি তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা মনে করেন, আফগানিস্তানে দুই দশকের ‘যুদ্ধটি ছিল মূলত তাদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল।’ অথচ বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণ গেলেও শেষ পর্যন্ত লড়াই শেষ হয়েছে কার্যকর কোনো সমাধান ছাড়াই।
তার অনুমান, তালেবানের হঠাৎ আফগানিস্তান দখল পশ্চিম আফ্রিকা ও সাহেল অঞ্চলের নেতাদের মধ্যেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, তালেবানের শাসন অঞ্চলটিতে ইসলামপন্থি উগ্রবাদীদের নতুন করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে।
নব্বইয়ের দশকের তুলনায় একবিংশ শতাব্দীর তালেবানের আচরণে ভিন্নতার আশা রাখাও বোকামি বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আগের তুলনায় আরও বেশি সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে গোষ্ঠীটি। কিন্তু তাদের মূলে কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
তার মতে, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্ভবত পাকিস্তানের জন্য জয় আর চীনের জন্য নতুন সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ন্যূনতম।
তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক লড়াই হলে একদিকে থাকবে পাকিস্তান ও চীন, অন্যদিকে থাকবে ভারত, ইরান আর রাশিয়া। এখানে যুক্তরাষ্ট্র আর কখনো কেন্দ্রীয় শক্তিতে উঠে আসতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।’
পারস্য উপসাগরীয় অনেক দেশ এরই মধ্যে নিজেদের পররাষ্ট্র নীতিমালা ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে। সম্ভাব্য নতুন নীতিমালায় তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার মতো বিষয়গুলোকে বাদ দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ওই কর্মকর্তার মতে, ভবিষ্যতে ইরানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে দেখা যেতে পারে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও।
সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর কার্বন পরবর্তী যুগের লক্ষণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্বের ফলে নিরাপত্তায় যেন হুমকি তৈরি না হয়, তা নিশ্চিতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির আমলেই সৌদি আরবের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে সে উদ্যোগ কেবল গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতার মধ্যেই সীমিত ছিল। ভবিষ্যতে তেহরান-রিয়াদের আলোচনার পরিসর আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
পারস্য অঞ্চলে নতুন মিত্রের খোঁজে গত এক বছরে তৎপর হয়েছে বিভিন্ন দেশ। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে বাহরাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ। সিরিয়ার সঙ্গে আরব আমিরাতও কূটনৈতিক সম্পর্কে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দীর্ঘ যুদ্ধের চাপে ‘প্রেশার কুকারে’ থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে শান্ত করতে এসব পদক্ষেপ কাজে আসবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুন:আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবানের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর হাজারো আফগাানের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন নসরত আহমাদ ইয়ার। দোভাষী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করায় বিশেষ ভিসায় দেশটিতে গিয়েছিলেন তিনি।
আমেরিকায় স্ত্রী এবং ১৩, ১১, ৮ বছর ও ১৫ মাস বয়সী চার সন্তানকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন ৩১ বছর বয়সী নসরত। আশা ছিল নিরাপদে বাঁচার, কিন্তু সেটি সম্ভব হলো না।
বন্ধু রহিম আমিনি আল জাজিরাকে জানান, গত ৩ জুলাই রাত ১২টার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির উত্তর-পূর্বে লিফট রাইডশেয়ার নামের কোম্পানির গাড়ির ভেতর গুলিতে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায় নসরতকে।
যুক্তরাষ্ট্রে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করা দোভাষী বন্ধুর স্মৃতিচারণ করে রহিম আমিনি বলেন, ‘সে আমার রক্তের ভাই না হলেও এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল। তার ঘুমের সময়ই কেবল আমরা পরস্পর থেকে আলাদা হতাম। আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম, একসঙ্গে হাসতাম, একসঙ্গে খেতাম।’
রহিম জানান, নসরত আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর দোভাষী হিসেবে ১০ বছর ধরে কাজ করার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়।
নসরতের মতো রহিমও পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।
আরও পড়ুন:আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের এক বছরেরও বেশি সময় পর তালেবান আফগানিস্তান জুড়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তালেবান সরকারের স্বীকৃতি না মেলায় বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা ও বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভ স্থগিত হয়ে আছে। এ অবস্থায় দেশটির অর্থনীতি ভয়াবহ আর্থিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে এড়িয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। এরপর ২০টি বছর তাদের সমর্থিত সরকার বসিয়ে সে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায় এই পরাশক্তি। তাতে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে সেই যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই বিভিন্ন দেশের সরকার আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে রাখে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে কোটি কোটি ডলারের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। একইসঙ্গে আফগানদের সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ রেখেছে তারা।
আফগানিস্তানে অবস্থানকালে বিগত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা মিলে সন্ত্রাসবিরোধী যেসব আইনকানুন করেছিল, সেসবের দোহাই দিয়ে এসব ব্যবস্থা আফগানিস্তানের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে অর্থ সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনই তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে দেশটিতে।
সম্প্রতি ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ‘দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক সতর্কতামূলক হট স্পট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
আফগানিস্তানভিত্তিক খামা প্রেস বলছে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থা খুবই নাজুক। দেশ দুটিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে আগামী মাসগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা আরও তীব্রতর হবে, যা দেশ দুটিকে আরও বাজে পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।
খরা, সংঘাত এবং অর্থনৈতিক দৈন্য- এসব কিছুর মিলিত প্রভাব আফগান জনগণের জীবিকা ও খাদ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আফগানিস্তানে প্রতি তিনজনে একজন মানুষ খাদ্যাভাবে ভুগছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। এ অবস্থায় সেখানে বড় ধরনের মানবিক সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘গত দুই বছরে আফগানিস্তানে বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য মানবিক সংকটের পাশাপাশি এই বেকারত্ব আফগানিস্তানে লক্ষাধিক মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আইসিআরসি আফগানিস্তানে বিনিয়োগ শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কাবুলভিত্তিক টোলো নিউজের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থনীতিবিদ দরিয়া খান বাহির বলেছেন, এই সাহায্যের একটি বড় অংশ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের পরিবেশকে অনুকূল করতে এবং তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা কমানোর জন্য বৃহৎ অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করা প্রয়োজন।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার পাকিস্তান। স্বভাবতই পাকিস্তানের রাজনৈতিক টালমাটাল ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাবুলেও পড়ছে। ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম বড় একটা বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
বিশ্বব্যংকের প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে না পারায় আফগানিস্তান দুর্ভিক্ষের মতো গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেশটির লক্ষাধিক পরিবারের কাছে আরেকটি কঠোর শীত মোকাবেলা করার কোনো উপায় নেই।
তীব্রভাবে খাদ্য-অনিরাপদ আফগানদের মাঝে মাসিক খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা চালিয়ে যেতে ডব্লিউএফপি’র জরুরিভাবে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এই সহায়তার জন্য আইসিআরসি’র পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।
ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ১৪ লাখই কোনোমতে খেয়ে বা না খেয়ে দিন পার করছে। অপুষ্টিতে ভুগছে ২০ লাখের বেশি শিশু। দেশটিতে বর্তমানে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৭০ হাজারের বেশি, যার প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাটি আরও বলছে, এ বছরের শেষ নাগাদ দেশটিতে আরও অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন:গা হিম করা শীতে আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ফ্লোর ম্যাট্রেস তোশকে পা রেখে গুটিসুটি হয়ে বসে ছিল শাহ ইব্রাহিম শাহিনের কম বয়সী সন্তানেরা। তাদের পাশে ছিলেন প্রাপ্তবয়স্করা, যাদের গায়ে ছিল উলের জামা।
ছোট্ট ঘরে এমন চিত্র দেখা যায় উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাগলানে।
এবারের মৌসুমে বাগলানের মতো অনেক প্রদেশেই অস্বাভাবিক শীত অনুভব করছেন বাসিন্দারা। রাজধানী কাবুলে তাপমাত্রা কমে হিমাঙ্কের ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শৈত্যপ্রবাহে দেশজুড়ে ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বাগলানে গত কয়েক দিনের মধ্যে শুক্রবার তাপমাত্রা একটু বেড়েছিল। তাও সেটি ছিল হিমাঙ্কের ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। এমন পরিস্থিতিতে ১০ সন্তানসহ ১৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে ঘর গরম রাখার সামগ্রী কেনার অবস্থায় নেই শাহিন। এ পরিবারে উষ্ণতা ছড়ানোর একমাত্র উপায় পরস্পরের গা ঘেঁষে থাকা।
পেশায় ট্যাক্সিচালক শাহিন প্রায় এক বছর ধরে বেকার। শীতে জমে যাওয়া ঘরে বসে ৫৪ বছর বয়সী এ ব্যক্তি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের একটি মাত্র বুখারি (ঐতিহ্যবাহী কয়লাচালিত হিটার)। শীতের শুরুতে আমরা কিছু কয়লা কিনেছিলাম, কিন্তু এমন আবহাওয়ায় আমাদের জোগান প্রায় শেষ এবং নতুন করে কেনার সামর্থ্যও নেই।’
আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার ১৮ মাসের বেশি সময়েও অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে। এখনও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এ সরকার ব্যাপক দারিদ্র্য ও মানবিক সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতা দেখাতে পারেনি।
১০ সন্তানের জনক শাহিন যখন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, ঠিক সে সময়ে পরিবারের সদস্যের অসুস্থতা তাকে মারাত্মক ঋণে ফেলে দিয়েছে। এমন বাস্তবতায় ট্যাক্সি চালাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি জোগানো সম্ভব হবে না তার পক্ষে।
সংসার কেমন চলছে, তার বিবরণ দিয়ে শাহিন বলেন, ‘আমার দুই ছেলে দিনমজুরের কাজ করে, তবে তারা দৈনিক দেড় শ আফগানির বেশি রোজগার করতে পারে না, যা দিনের খাবার কেনার জন্যও যথেষ্ট নয়। কয়েক মাস ধরে আমরা ফল বা মাংস ছুঁয়ে দেখিনি।’
হিন্দুকুশ পর্বতমালার পাদদেশে বাগলানে তীব্র শীত নতুন নয়, যেখানে তুষারপাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়ে, যা হতে পারে চাষাবাদের সহায়ক।
এ নিয়ে শাহিন বলেন, ‘আমরা খুশি যে তুষার পড়ছে। এটা আল্লাহর দান, যা কুয়ায় কাজে লাগবে এবং কৃষকদের উপকারে আসবে, তবে তাপমাত্রা কমতে থাকার মধ্যে কীভাবে নিজেদের গা গরম রাখব, তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আমরা।’
বাগলানের পার্শ্ববর্তী সামানগান প্রদেশেও তীব্র শীত দেখছেন বাসিন্দারা। সেখানে দুই সন্তানের জননী ২৫ বছর বয়সী এক নারী আছেন উভয় সংকটে। তাকে কয়লা বা খাবারের যেকোনো একটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মারিয়াম (ছদ্মনাম) নামের ওই নারী আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা কাঠ ও কয়লা কিনলে খাবার কিনতে পারব না। আমার স্বামী যে অর্থ পাঠায়, তা মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যও যথেষ্ট নয়।’
তার স্বামী যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আফগান সরকারের সাবেক সেনা। তিনি পালিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে গিয়ে কাজ নিয়েছেন।
তালেবানের প্রতিশোধের ভয়ে আসল নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করা নারী বলেন, ‘কাবুলের পতনের পর তালেবান আমার স্বামীকে খুঁজেছে, যার ফলে তাকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে যেতে হয়েছে। সে সময় কিছুদিন আমরা তার সঞ্চয়ের ওপর চলেছি। এরপর চলেছি দানের ওপর। কাজ থাকলে তিনি টাকা পাঠান, কিন্তু এ শীতে আমরা একটি বুখারি কিনতে পারছি না।’
মারিয়াম আরও বলেন, ‘আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি শীত দেখেছি এবারের শীত মৌসুমে। খাবার কিংবা হিটার ছাড়া কীভাবে এটি পার করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
আরও পড়ুন:নারীর ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা তালেবানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বলে জানিয়েছেন গোষ্ঠীটির মুখমাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম খামা প্রেসের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএনআইর প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ শনিবার একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসলামিক আইনের ওপরে নির্ভর করেই ইসলামিক শাসন জারি থাকবে। নারীদের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করাটা কখনোই সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাবে না।’
গত ২০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে তালেবান। এরপর দেশটিতে এনজিওতে নারীদের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। এ নিয়ে দেশটিতে বিক্ষোভও করেন নারীরা।
নারীদের ওপর এসব বিধিনিষেধ আরোপ করায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ। গত বছরের আগস্টে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষার সীমিত প্রবেশাধিকারের কারণে ১২ মাসে দেশটির আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) অবিলম্বে আফগানিস্তানে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
আফগানিস্তানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন।
বুধবারের এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
তালেবান সরকারের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
কাবুলের পুলিশ জানিয়েছে, হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। বাহিনীটি এ হামলাকে ‘কাপুরোষচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
কাবুলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে চালানো এ হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় বিকেল ৪টার দিকে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সে ব্যর্থ হয়।
মন্ত্রণালয়ের বাইরে থাকা গাড়িচালক জামশেদ কারিমি বলেন, ‘ আমি হামলাকারীকে দেখেছি, যিনি নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছেন।’
ইতালিভিত্তিক সংস্থা ইমার্জেন্সি এনজিওর প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের কাছে ৪০ জনের বেশি আহত মানুষকে আনা হয়েছে।
একটি টেলিগ্রাম পোস্টে আইএসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিহতদের মধ্যে কূটনৈতিক কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় চীনা একটি প্রতিনিধি দল মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ছিল, তবে আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অফিস এএফপিকে জানিয়েছে, হামলার সময় সেখানে কোনো বিদেশি ছিলেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট দেশটির ক্ষমতায় আসে তালেবান। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও দৃশ্যত অস্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি।
আফগানিস্তানজুড়ে একের পর এক হামলা চলছেই। এসব হামলার বেশিরভাগেরই দায় স্বীকার করে নিয়েছে আইএস।
আরও পড়ুন:আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি কে হয়েছেন তা এখনও অস্পষ্ট বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি এমনটি জানান বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল যে, গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানে তাদের হামলায় নিহত হন জাওয়াহিরি। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে আল-কায়েদার প্রধান নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর সংগঠনটির প্রধান হন তিনি। এর পর থেকে জাওয়াহিরি পলাতক ছিলেন।
জাওয়াহিরির মৃত্যুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টারটেরোরিজম সেন্টারের পরিচালক ক্রিস্টিন আবিজাইদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সংগঠনটি নিজেদের সুবিধার জন্যই পরবর্তী উত্তরসূরির নাম প্রকাশ করছে না।’
যুক্তরাষ্ট্র জাওয়াহিরিকে হত্যার দাবি করলেও আল-কায়েদার পক্ষ থেকে এখনও নতুন নেতার নাম ঘোষণা করা হয়নি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক সদস্য ও আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতা সাইফ আল-আদেল গোষ্ঠীটির পরবর্তী প্রধান হতে পারেন।
সাইফ আল-আদেলকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাকে ধরিয়ে দিতে কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন।
সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করার সময় আফগানিস্তানে ২৫ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের তোপে পড়েছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স হ্যারি।
এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আফগান সরকার বলেছে, তালেবান নয়, বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছিলেন হ্যারি।
আত্মজীবনীমূলক ‘স্পেয়ার’ নামের বইতে হ্যারি আফগানিস্তানে ২৫ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। আগামী ১০ জানুয়ারি প্রকাশ হতে যাচ্ছে বইটি।
প্রিন্স হ্যারি জানিয়েছেন, ওই ২৫ জনকে তার কাছে মানুষ মনে হয়নি; ‘দাবার ঘুঁটি ’ মনে হয়েছে। তাদের তিনি দাবার বোর্ড থেকে কেবল সরিয়ে দিয়েছেন।
এ নিয়ে তালেবান নেতা আনাস হাক্কানি শুক্রবার আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওই সময় হেলমান্দে কোনো তালেবান সদস্য নিহত হননি। এটা স্পষ্ট যে, তিনি সাধারণ বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছেন।
‘আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের অনেক যুদ্ধাপরাধের একটি মাত্র গল্প বলেছেন হ্যারি। এটি পশ্চিমাদের অপরাধের পুরো চিত্র নয়।’
এর আগে টুইটে আনাস হাক্কানি লেখেন, ‘হ্যারি যাদের হত্যা করেছেন তারা দাবার ঘুঁটি নয়; তারা মানুষ। আপনি সত্য বলেছেন, সাধারণ আফগান মানুষজন আপনাদের সেনা, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দাবার ঘুঁটি ছিল, কিন্তু আপনারা সেই খেলায় হেরেছেন।’
প্রিন্স হ্যারির সমালোচনা করে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি বলেন, ‘আমাদের দেশে পশ্চিমা দখলদারিত্ব সত্যিই মানব ইতিহাসে একটি বিশ্রী মুহূর্ত।’
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট দেশটির ক্ষমতায় আসে তালেবান। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার আফগানি।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য