দুই দশকের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করা তালেবানের মধ্যে পরিবর্তন খুব সামান্যই দেখছে বিশ্ব। সেই সামান্য পরিবর্তনের একটি হলো আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
এবিসি নিউজের একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিকে দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আশ্রয় নিচ্ছে তালেবান, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি পেতেও সামাজিক মাধ্যমকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক দল।
ক্ষমতা দখলের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনার দাবি করেছে তালেবান। নারী অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ নানা আশ্বাস দিয়েছে গোষ্ঠীটি, কিন্তু এসব আশ্বাস সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে বহির্বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রনেতা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শঙ্কা, তালেবানের শাসনামলে আবারও আল-কায়েদার মতো নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চারণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান।
মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ গোষ্ঠীটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা উদ্বেগজনক ও ভীতিকর।
কারণ এবার ক্ষমতায় এসে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নিজেদের প্রতি ঢালাও সমর্থন দেখছে গোষ্ঠীটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় অংশ অনিয়ন্ত্রিত বলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উগ্রবাদীদের আকৃষ্ট করা ও নিজেদের উগ্রবাদী আদর্শ আরও ছড়িয়ে দেয়া সহজ হবে তালেবানের জন্য।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণেই এবার বহির্বিশ্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম হয়ে উঠেছে তালেবান, যা আগে কঠিন ছিল। এভাবে দেশ ও দেশের বাইরে অনেক ঘটনাবলিও এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমবিষয়ক জ্ঞানের অভাব আর অপপ্রচারকে পুঁজি করে জনসমর্থন নিজেদের দিকে টানতে তালেবান দীর্ঘদিন ধরেই বেশ কৌশলী। এভাবেই আফগান সরকারকেও অবস্থানগতভাবে দুর্বল করে তুলেছে গোষ্ঠীটি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ছবি, ভিডিও আর বিবরণীতে কাবুলে চলমান নৈরাজ্যের চিত্র অস্পষ্ট। অথচ তালেবানশাসিত অঞ্চলগুলোতে গোষ্ঠীটি প্রচার করছে শহরের পরিস্থিতি ‘সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল, যা আগে ছিল না।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মমতা আর নিপীড়ক নীতির জন্য সমালোচিত তালেবান সম্প্রতি ভাবমূর্তি তৈরির জন্য বিপরীতমুখী বার্তা দিচ্ছে অনলাইনে। তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়। তাই আফগানিস্তানের বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পশ্চিমাদের ধোঁকা দেয়ার এ কৌশল নিয়েছে গোষ্ঠীটি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক থিংকট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র ফেলো টম জোসেলিন বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কৌশলী তালেবান…নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গোষ্ঠীটি। বিভিন্ন ঘটনায় আফগান সরকার প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই তালেবানের বক্তব্য জানতে পারতাম আমরা।’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে তালেবান, এটাই মুখ্য বিষয়। তারা জানে কীভাবে সাংবাদিকদের নাচাতে হয়। তারা জানে কীভাবে কী বললে সে বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর কানে তা শ্রুতিমধুর শোনাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয় গোষ্ঠীটি।’
বার্তার বন্যা তালেবানের
২০১৭ সালে সবশেষ প্রকাশিত তথ্যে বিশ্বব্যাংক জানায়, আফগানিস্তানে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১১ দশমিক চার শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। নব্বইয়ের দশকে তালেবানের আগের শাসনামলে এ হার ছিল শূন্য।
১৭ বছরের ব্যবধানে দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী তৈরি হলেও আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক থেকে ৪৯ শতাংশ পিছিয়ে ছিল আফগানরা।
অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রোতা হিসেবে আফগানরা নয়, তালেবানের লক্ষ্য বহির্বিশ্ব।
অন্যদিকে তালেবানের স্থানীয় শ্রোতা, অর্থাৎ আফগান সমর্থকরাও দেশটির সংবাদমাধ্যম অবকাঠামোর ভগ্নদশার বলি। ক্ষমতাসীনদের মিথ্যা বিবৃতির ফাঁকফোকর ধরতে সেসব সংবাদমাধ্যম ব্যর্থ। সাধারণ আফগানদের জন্যও ঘটনার সত্যতা যাচাই করা কঠিন।
তার ওপর বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মতো আফগানিস্তানেও ইন্টারনেটবিষয়ক শিক্ষার হার সামান্য বলে মনে করেন গবেষকরা। ফলে সত্যের চেয়ে অপপ্রচারের বিস্তারই সেখানে বেশি।
জোসেলিন জানান, তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইটারে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভীষণ সক্রিয়। গত সপ্তাহের আলোচিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছিলেন মুজাহিদ।
ইংরেজি, আরবি, পশতু ও উর্দুসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় তালেবান নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বার্তা প্রচার করে থাকে।
জোসেলিন বলেন, ‘তালেবান প্রতিদিন যত ভাষায় বার্তা প্রকাশ করে, তত সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও করে না।’
অনলাইনে উগ্রবাদের প্রচার ঠেকাতে পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও দেশ। এতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থকদের ইন্টারনেটভিত্তিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে এলেও তালেবান এখনও বাধাহীনভাবেই সামাজিক যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তালেবান ইস্যুতে কোনো নির্দেশনাও পায়নি। তাদের তালেবানবিরোধী কোনো নীতিমালাও নেই।
এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোষ্ঠীটিকে নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন।
অথচ বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফেসবুক-টুইটারসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ। এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দ্বিমুখী নীতি নিয়ে সরব ট্রাম্পবিরোধীরা।
ফেসবুকের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির ‘বিপজ্জনক সংগঠনবিষয়ক নীতি’র আওতায় কয়েক বছর ধরেই নিষিদ্ধ তালেবান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাদা কালো তালিকায় তালেবানের নাম না থাকলেও সরকারের কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে গোষ্ঠীটির ওপর। সে হিসেবেই ফেসবুকেও তারা নিষিদ্ধ।
তালেবান বা তালেবানের পক্ষে পরিচালিত অ্যাকাউন্টগুলো মুছে দেয়া হয়েছে বলে দাবি ফেসবুকের।
এ ধরনের অ্যাকাউন্ট শনাক্তে আরবি, পশতুসহ বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ দলও গঠন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিবৃতিতে ফেসবুক বলেছে, ‘কোনো দেশে স্বীকৃত সরকারের বিষয়ে ফেসবুক সিদ্ধান্ত নেয় না; বরং সে ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের গৃহীত পদক্ষেপে শ্রদ্ধাশীল থাকাকেই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে। ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, সে হিসেবে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও আমাদের নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
এ বিষয়ে টুইটার এখনও কোনো অবস্থান ঘোষণা করেনি। আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে টুইটারে যাবতীয় তৎপরতা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক আগেই ফেসবুক-টুইটারে তালেবানকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল।
জোসেলিন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালেবানকে নিজস্ব একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আত্মঘাতী হামলা থেকে শুরু করে নারীদের ওপর নিপীড়ন, কঠোর শরিয়াহ আইন প্রয়োগের বিষয়গুলোতে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে তারা।’
যোগাযোগের সস্তা ও কার্যকর মাধ্যম
জার্মান থিংকট্যাংক মার্শাল ডিজিটাল ফান্ডের সহকারী গবেষক অ্যাড্রিয়েন গোল্ডস্টেইন জানান, টুইটারে সক্রিয় কমপক্ষে ছয়জন তালেবান কর্মকর্তা। তাদের অনুসারী সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ।
এ নেতাদের সাম্প্রতিক সব টুইটেই তালেবানকে দেখানো হয়েছে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসেবে। গোষ্ঠীটির সংবাদ সম্মেলনেও এমন ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
তালেবানের টুইট অপপ্রচার আর মিথ্যায় ভরপুর বলে অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মিডিয়া এশিয়া জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এ ধারণাতেই সমর্থন দেয়া হয়।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও পরামর্শক সংস্থাগুলোর প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে ভিন্ন কিছুই প্রকাশ করে তালেবান; হোক তা সামাজিক বা অন্য কোনো মাধ্যমে।
২০১৮ সালে গবেষণাটি করার সময় কেউ ধারণাও করেনি যে তিন বছরের মাথায় আবারও আফগানিস্তান দখল করবে তালেবান। কিন্তু গোষ্ঠীটি সে সময় ঠিকই আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চেয়েও বেশি ও বিভিন্ন ভাষায় টুইটারে বার্তা প্রকাশ করত নিয়মিত।
একটি ঘটনা নিয়ে তালেবান ও সংবাদমাধ্যম আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের অসংগতি ছাড়াও গবেষণায় বেরিয়ে আসে সামাজিক মাধ্যমের ওপর তালেবানের নির্ভরশীলতার তথ্যও।
কারণ বিস্তৃত পরিসরে বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য এর চেয়ে সস্তা ও সহজ আর কোনো মাধ্যম নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য কোনো আধুনিক অবকাঠামো বা বিশেষজ্ঞেরও প্রয়োজন হয় না।
বিষয়টির সুযোগ নিয়ে ন্যূনতম অর্থ ও সময় ব্যয় করে আফগান সরকারের চেয়েও অনলাইনে বেশি প্রচার চালিয়েছে তালেবান।
অথচ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় যেকোনোভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছিল এ তালেবানই। নিষেধাজ্ঞা অমান্যে পেতে হতো কঠোর শাস্তি।
বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমেই পরিবর্তনীয়। টুইটার ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ আফগানদের অনেকেই এখন দেশটির অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবহিত করে ও সাহায্য চায়।
আরও পড়ুন:মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। মে দিবসে এই দিনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে অংশ নিতে দেশটির বিভিন্ন শহরে জড়ো হন হাজারও মানুষ। সে সময় তারা ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিমালা ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করার প্রতিবাদ জানান। এদিকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ফ্রান্স থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত মে দিবসের র্যালিতে ট্রাম্পবিরোধী বার্তা দেখা গেছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের প্রধান আয়োজক ছিল ‘৫০৫০১’ নামের একটি সংগঠন। ‘বামপন্থি’ কিছু গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠনের নামের ব্যাখ্যা হলো ৫০ অঙ্গরাজ্যে ৫০টি বিক্ষোভ ও একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এরা আগেও বেশ কয়েকবার বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল। সংগঠনটি জানায়, মে দিবসের এই বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের এক হাজারের বেশি জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিউইয়র্ক, শিকাগো ও লস অ্যাঞ্জেলেসসহ দেশের বড় বড় শহরে হাজারও মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। ছোট শহরগুলোর রাস্তাতেও বিক্ষোভকারীরা সমবেত হন।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী শেন রিডল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, আমরা মনে করি, অতিধনীরা দেশকে দখল করে নিচ্ছে এবং শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে দমন করছে। ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি শিক্ষা ইউনিয়নে কর্মরত রিডল আরও বলেন, আমাদের নাগরিকরা যদি এই প্রেসিডেন্ট ও তার ধনকুবের মিত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হতে পারে।
ওয়াশিংটনের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত বিক্ষোভে কয়েকশ মানুষ অংশ নেন। নিউইয়র্কেও একই চিত্র দেখা গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেসে কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন বলে ঘটনাস্থলে থাকা এএফপির আলোকচিত্রীরা জানিয়েছেন। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বার্নার্ড স্যাম্পসন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির সমালোচনা করে বলেন, এই অভিবাসীরাই তোমার রেস্তোরাঁয় কাজ করে, তোমার ঘরবাড়ি নির্মাণ করে।
এ বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর থেকে ট্রাম্প ও তার বিলিয়নিয়ার মিত্র ইলন মাস্ক দুই লাখের বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করেছেন। তা ছাড়া প্রশাসন অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীকে আটক করেছে এবং জলবায়ু উদ্যোগ ও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফেডারেল তহবিল বন্ধের হুমকি দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব নীতির নিন্দা জানিয়েছে।
মাইক ওয়াল্টজকে অব্যাহতি দিলেন ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে মাইক ওয়াল্টজকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ট্রাম্প বলেছেন, ‘মাইক ওয়াল্টজকে জাতিসংঘে তার দেশের পরবর্তী দূত হিসেবে মনোনীত করা হবে। আমাদের জাতির স্বার্থকে সবার ওপরে রাখতে তিনি (ওয়াল্টজ) কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আমি জানি তিনি তার নতুন ভূমিকায়ও (জাতিসংঘে মার্কিন দূত হিসেবে) এভাবেই কাজ করে যাবেন।’
প্রেসিডেন্ট এদিন সকালেই ওয়াল্টজকে এই পরিবর্তন বিষয়ে অবহিত করেন, পরে সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে এমনটি জানান হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা। গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনান্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার প্রশাসনে মাইক ওয়াল্টজের এই অপসারণ সবচেয়ে বড়সড়ো রদবদলের ঘটনা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর নতুন পদে আসীন হওয়ার খবর জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তরেও তিনি (রুবিও) তার শক্তিশালী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন।’
মার্কো রুবিওর আগে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি রিপাবলিকান সরকারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
এদিকে অব্যাহতি পাওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওয়াল্টজ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও আমাদের মহান জাতির জন্য আমার কাজ অব্যাহত রাখতে পারব, এ কারণে আমি গভীরভাবে সম্মানিত।’
গত মার্চে সামরিক হামলা সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য তৈরি একটি মেসেজিং গ্রুপে অসাবধানতাবশত একটি মার্কিন ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদককে যুক্ত করার পর থেকে ওয়াল্টজের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করে। তথ্য ফাঁস নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনে প্রভাব হারাতে থাকেন তিনি। যে গ্রুপটিতে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন।
মার্কিন গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ‘উদ্বেগজনক অবনতি’
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে মার্কিন গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ‘উদ্বেগজনক অবনতি’ ঘটেছে বলে সতর্ক করেছে গণমাধ্যম অধিকার সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ)। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সাংবাদিকদের জন্য পরিস্থিতিকে ‘অভূতপূর্বরকম’ কঠিন বলে আখ্যা দিয়েছে সংস্থাটি।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, প্যারিসভিত্তিক সংগঠনটি গত ২৩ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, সূচকটি এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে। বছরব্যাপী বৈশ্বিক গণমাধ্যম পরিস্থিতির এই পর্যালোচনায় বলা হয়, ‘‘সূচকের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্বের অর্ধেক দেশে সাংবাদিকতা চর্চার পরিস্থিতি ‘খারাপ’ এবং প্রতি চারটির মধ্যে মাত্র একটিতে তা ‘সন্তোষজনক’।’’
আরএসএফের সম্পাদকীয় পরিচালক অ্যান বোকান্দে বলেন, সাংবাদিকতা-নির্ভর সত্যভিত্তিক প্রতিবেদন অর্থনৈতিক চাপে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থাভাবে অনেক স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে অনলাইন বিজ্ঞাপনে ব্যয় বেড়ে ২৪৭.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছালেও এর বড় অংশই চলে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল ও অ্যামাজনের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের পকেটে- গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়।
ভারত-পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করায় এর চাপ পড়বে দুই দেশের ওপরই। আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমন সিদ্ধান্তে উভয় দেশের ফ্লাইট পরিচালনায় জ্বালানি ব্যয়, ট্রানজিট খরচ ও অপারেটিং খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে।
ওয়াশিংটন থেকে সিনহুয়া আজ এই খবর জানায়।
গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোরেন চলছে। ওই হামলায় পাকিস্তানের মদদের অভিযোগ আনে ভারত। আর তা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যেও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে।
পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যেই ভারতের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। এই পদক্ষেপের এক সপ্তাহের মাথায় পাকিস্তানের জন্যও একই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত।
সম্প্রতি ভারত সরকারের এক নোটিশে বলা হয়েছে, ৩০ এপ্রিল থেকে ২৩ মে পর্যন্ত পাকিস্তানি বিমানের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান-ভারতের পাল্টাপাল্টি আকাশসীমা বন্ধে কার কী ক্ষতি হবে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়ার কারণে শত শত ভারতীয় ফ্লাইট চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে ভারতীয় এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পরিচালনায় জ্বালানি এবং ট্রানজিট খরচ উভয়ই বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে লম্বা পথের ফ্লাইটগুলোকে জ্বালানি নিতে মাঝপথে থামতে হবে, যা ফ্লাইট পরিচালনার খরচ আরো বাড়িয়ে দেবে।
এই অবস্থা চলতে থাকলে, ভারতীয় এয়ারলাইন্সগুলোর প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭৭ কোটি রুপি বাড়তি খরচ করতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতি মাসে তা ছাড়াতে পারে ৩০৭ কোটি রুপি। আর ফ্লাইট প্রতি অতিরিক্ত খরচ হতে পারে ১ হাজার ৩৫০ থেকে ৩ হাজার ডলার। অবশ্য এমন সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের নিজের হাতছাড়া হচ্ছে ওভারফ্লাইট ফি।
একইভাবে ফ্লাইট পরিচালনায় বাড়তি সময় ও অপারেটিং খরচ বাড়ায় ভুগবে পাকিস্তানও। কারণ, একটি এয়ারলাইন্সের মোট খরচের প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় করতে হয় বিমানের জ্বালানিতে। তবে বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের বিমান শিল্পে কম পড়বে। কারণ, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স, পিআইএ শুধুমাত্র কুয়ালালামপুর রুটে ভারতীয় আকাশসীমা ব্যবহার করে। যেখানে প্রতিদিন ২শ’ থেকে ৩শ’ ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে।
চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে শুল্কসংক্রান্ত আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্ক নীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাজার এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তা প্রশমনে ওয়াশিংটন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় বলে জানা গেছে।
বেইজিং থেকে এএফপি জানায়, চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা সিসিটিভির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ইউয়ুয়ান তানতিয়ান’ বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র "বহুমুখী চ্যানেলের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে" চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রই এখন বেশি উদ্বিগ্ন পক্ষ। ট্রাম্প প্রশাসন বহুমুখী চাপের মুখে রয়েছে।'
চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়ায় বেইজিংও বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, চীন আলোচনার জন্য তার কাছে পৌঁছেছে—চীন এই দাবি জোরালোভাবে অস্বীকার করে আসছে।
তবে এবার চীনা সূত্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমে বলা হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই উদ্যোগ নিচ্ছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহুবার যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ন্যায়সঙ্গত, সম্মানজনক ও পারস্পরিক সুবিধাজনক’ আলোচনার আহ্বান জানালেও, এক ভিডিও বার্তায় সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ‘লড়াই দরকার হলে শেষ পর্যন্ত লড়বে, কখনো নতি স্বীকার করব না।’
চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এই খবর এমন এক সময় এলো, যখন মার্কিন অর্থনীতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে এবং ওয়াশিংটন থেকে বেইজিং পর্যন্ত উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে জয় পেয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি। কানাডার ব্রডকাস্টিং করপোরেশন এমনটিই জানিয়েছে। দেশটির অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকির কারণে সোমবারের নির্বাচনের ফলাফলে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।
গতকাল মঙ্গলবার জয় ঘোষণার পরই কার্নি বলেছেন, তার দেশ ‘কখনো’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করবে না।
বিজয়ী ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন কার্নি। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প আমাদের (কানাডা) ‘ভাঙার’ চেষ্টা করছেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দখলে নিয়ে নিতে পারে। তবে এমনটি কখনোই হবে না। আমি কয়েক মাস ধরেই এ বিষয়ে সতর্ক করে আসছি যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ভূমি, সম্পদ, আমাদের পানি, আমাদের দেশ নিয়ে নিতে চায়। এগুলো কেবল নিষ্ক্রিয় কোনো হুমকি নয়।’
‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার সংহতিসাধনের যে পুরোনো সম্পর্ক ছিল তাও এখন শেষ’, উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ভাষণে বলেন তিনি। একে তিনি এক ট্র্যাজেডি বলে বর্ণনা করেন।
বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দিয়ে কার্নি বলেন, যেসব মানুষ কানাডাকে নিজেদের বাড়ি মনে করেন, তাদের সবার নেতা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতায় কানাডা বিস্মিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন একে অপরের যত্ন নিতে হবে।’
এদিকে নির্বাচনের দিন কানাডার নাগরিকদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে উপহাস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, তিনি নিজেই ব্যালটে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হওয়া উচিৎ কানাডাকে। যুক্তরাষ্ট্র ভুলবশত কানাডাকে ভর্তুকি দেয় বলেও দাবি করেন তিনি। পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘কানাডা রাজ্য না হওয়াটার কোনো মানে নেই।’
চলতি বছরের শুরুতে দেশটিতে আবাসন খরচ বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান অভিবাসনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগের পর লিবারেলদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অর্থনীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নাগরিকরা। এর ফলে তাদের মাঝে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। এর ফলেই লিবারেলদের পতনমুখী অবস্থার অবসান হয়—যা দলটিকে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে।
নির্বাচনের আগে ভ্যাঙ্কুবারে প্রাণঘাতী গাড়ির ধাক্কায় হতাহতের পর নির্বাচনী প্রচারণা কয়েক ঘণ্টা স্থগিত রাখা হয়েছিল। এই ঘটনার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের সম্পৃক্ততাকে উড়িয়ে দিয়ে জড়িত স্থানীয় এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। আটক ব্যক্তি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন বলে জানায় পুলিশ।
বেশ কিছুদিন ধরে কানাডা জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ট্রাম্পের ব্যাপক শুল্কারোপের হুমকি ও উত্তর আমেরিকার গাড়ি নির্মাতাদের কারখানা কানাডা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা দেশটির অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এতে অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে।
কার্নির দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন কিনা, নাকি তাকে জোট সরকার গঠনের পথে হাঁটতে হবে সেটি এখনও দেখার বাকি।
কানাডায় হাউস অব কমন্সের মোট আসনসংখ্যা ৩৪৩। দেশটির নির্বাচনে কোনও দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ১৭২ আসনে জিততে হয়। লিবারেল পার্টি ১৬০টির বেশি আসনে এগিয়ে রয়েছে। তবে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ কনজারভেটিভ পার্টি পাচ্ছে অন্তত ১৪৭ টি আসন। ইতোমধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েল পয়েলিভার। তিনি বলেন, ‘কার্নি একটি সূক্ষ্ম ব্যবধানের সংখ্যালঘু সরকার গড়ার জন্য যথেষ্ট আসন পেয়েছেন।’
কানাডায় ভোটাররা সরাসরি তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন না। ভোটাররা ৩৪৩টি নির্বাচনী জেলায় কেবল হাউস অ কমন্সে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
হাউস অব কমন্সে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, সেই দলের নেতা সরকর গঠন করবে এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে যদি কোনো দলই প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে জয়লাভ করতে না পারেন, তাহলে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দল বিরোধী অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবে। তবে বিরল ঘটনা হলো— দুই বা ততোধিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি করে জোট সরকার গঠন করতে পারে।
লিবারেল দলের কার্নি ও কনজারভেটি দলের পোইলিভর উভয়ই বলেছেন, নির্বাচিত হলে তারা কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয় পুনর্বিবেচনা করবেন—যাতে উভয় দেশের অর্থনীতির অনিশ্চয়তা কেটে যায়।
যুক্তরাজ্যের নাগরিক নন এমন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কার্নির ব্যাংক অব ইংল্যান্ড পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর আগে তিনি কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা করেছেন।
নির্বাচনের দিন কানাডার রেকর্ড ৭৩ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছেন।
কাশ্মীর ইস্যুতে চলমান উত্তেজনার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা(এলওসি) বরাবর আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় ভারতীয় একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভিম্বর জেলার মানাওয়ারে মনুষ্যবিহীন যানটি ভূপাতিত করা হয়। মূলত, ড্রোনটি ভারতীয় বাহিনীর গোয়েন্দা নজরদারির কাজে নিয়োজিত ছিল।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়ে মনুষ্যবিহীন ড্রোনটিকে ভূপাতিত করে।
এতে পাকিস্তানের কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরীক্ষার জন্য যানটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্প্রতি পারমানবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনা চরমে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর বার বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘণের ঘটনা ঘটে ও আকাশপথে নজরদারি বাড়িয়েছে দুই দেশ।
কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ হামলার ঘটনার পর পাকিস্তানে ভারতের ‘সামরিক অনুপ্রবেশ’ আসন্ন বলে গতকাল সোমবার মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ।
কাশ্মীরের পহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হন এবং এতে ভারতজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও ওঠে।
ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান ২২ এপ্রিল বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই হামলায় মদদ দিচ্ছে। যদিও কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ইসলামাবাদে তার কার্যালয়ে ‘জিও নিউজ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা আমাদের বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছি। কারণ, ভারতের আক্রমণ এখন আসন্ন। এমন পরিস্থিতিতে কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হতো, তাই সেই সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে।
আসিফ বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতীয় আক্রমণের আশঙ্কা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করেছে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বা বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
পাকিস্তান সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি’ থাকলেই কেবল পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার ব্যবহার করবে।
ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের সাথে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিসা নিয়ে পাকিস্তান ভ্রমণকারী কমপক্ষে ৩৩৫ জন ভারতীয় নাগরিককে বহিষ্কার করেছে ইসলামাবাদ সরকার।
ভারত সরকার এই ঘোষণা দিয়েছে। ‘ইরানা জানায়’ মঙ্গলবার রাতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পেহেলগামের পর্যটন এলাকায় বন্দুকধারীরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালায়। ওই হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়। ভারতীয় কর্মকর্তারা ঘটনাটিকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভারত ওই হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার অভিযোগ করলেও ইসলামাবাদ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ হামলার বিস্তারিত তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা, সীমান্ত বন্ধ করাসহ আরো অনেক কিছু।
অপরদিকে, ভারতের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও একটি কড়া বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন দুই দেশের মধ্যে অভূতপূর্ব উত্তেজনার পরিণতিতে নতুন করে আঞ্চলিক সংঘাতের সূচনা হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী টানা তৃতীয় রাতে গুলি বিনিময় করেছে। পেহেলগাম সন্ত্রাসী ঘটনার কারণে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এদিকে,শনিবার ভারত থেকে কমপক্ষে ৭৫ জন পাকিস্তানি নাগরিক তাদের দেশে ফিরেছেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে শনিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে তার প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেছেন।
ফোনালাপে তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাবলি মোকাবেলায় বিশেষ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আর্থিক ও অস্ত্র অবকাঠামো ধ্বংস করার জন্য বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
টেলিফোন সংলাপে শাহবাজ শরীফ যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসবাদের শিকার এবং এই অশুভ ঘটনার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা ভালোভাবেই জানে। আমরা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি এবং পাকিস্তানি জাতির কল্যাণকে উন্নত করতে চাই। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মতো আমরা এ অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং স্থায়ী নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছি।
শনিবার সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে টেলিফোনে আলাপকালে ইরানের প্রেসিডেন্ট ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসী ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি ওই ঘটনার জন্য দুঃখ ও সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং এই অভিন্ন হুমকির বিরুদ্ধে সংহতির প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন।
নরেন্দ্র মোদীও পেহেলগাম সন্ত্রাসী ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে এবং সন্ত্রাসবাদের সাথে ইরানি জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বলেন, তার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ভারতীয় জনগণের অনুভূতি ও কষ্ট ভালোভাবে বুঝতে পারে। মোদি বলেন আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক ঐক্য এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।
মন্তব্য