যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গণতন্ত্র সূচকে এক বছরে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ৫.৯৯ স্কোর অর্জন করে ৭৬তম অবস্থানে রয়েছে। আঞ্চলিকভাবে দেশের অবস্থান ১৬তম।
আগের বছর ২০১৯ সালে ৫.৮৮ স্কোর নিয়ে ৮০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এর আগের বছর ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ছিল তালিকার ৮৮তম অবস্থানে।
‘ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০২০: ইন সিকনেস অ্যান্ড ইন হেলথ?’ শিরোনামে বুধবার গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইআইইউ।
সূচকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদে বাংলাদেশ পেয়েছে ৭.৪২ পয়েন্ট। এ ছাড়া সরকারের কার্যকারিতায় ৬.০৭, রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ৬.১১, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ৫.৬৩ ও নাগরিক স্বাধীনতায় স্কোর ৪.৭১।
গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হলেও ইআইইউ-এর বিবেচনায় দেশটি এখনও মিশ্র শাসনের (হাইব্রিড রেজিম) ক্যাটাগরিতে রয়েছে।
নির্বাচনি ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক স্বাধীনতার পরিবেশ বিবেচনা করে ১০ পয়েন্টের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সূচক তৈরি করে ইআইইউ।
কোনো দেশের গড় স্কোর আট এর বেশি হলে সেখানে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’; স্কোর ছয় থেকে আট এর মধ্যে হলে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’; চার থেকে ছয় এর মধ্যে হলে ‘মিশ্র শাসন’ এবং পয়েন্ট চার এর নিচে হলে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরা হয়।
ইআইইউর করা তালিকায় এবার ১৬৭ দেশের মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে ২৩টি দেশে, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে ৫২টি দেশে, মিশ্র শাসন ৩৫টি ও স্বৈরশাসন রয়েছে ৫৭টি দেশে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশ দেশ ভারত সূচকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ ক্যাটাগরিতে থাকলেও স্কোর আগের চেয়ে কমেছে। ২০২০ সালে গণতন্ত্র সূচকে দেশটি ৬.৬১ স্কোর পেয়ে আছে ৫৩তম অবস্থানে। ২০১৯ সালে ৬.৯ স্কোর নিয়ে ৫১তম অবস্থানে ছিল দেশটি।
‘মিশ্র শাসন’ ক্যাটাগরিতে থাকা পাকিস্তান ৪.৩১ স্কোর নিয়ে আছে তালিকার ১০৫ নম্বরে। ৪.৪৮ স্কোর নিয়ে ১০৪তম অবস্থানে তুরস্ক।
ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬৮তম। এই দেশটিও আছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের ক্যাটাগরিতে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান ৫.৭১ পয়েন্ট পেয়ে ৮৪তম অবস্থানে এবং নেপাল ৫.২২ স্কোর নিয়ে আছে ৯২তম অবস্থানে। এই দেশগুলোর অবস্থান মিশ্রশাসন ক্যাটাগরিতে।
সূচকে স্বৈরশাসন ক্যাটাগরিতে মিয়ানমারের অবস্থান ১৩৫তম, আর আফগানিস্তান আছে ১৩৯তম অবস্থানে।
ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ আছে স্বৈরশাসন ক্যাটাগরিতে।
মধ্যপ্রাচ্যের সম্মৃদ্ধ দেশ কাতার ৩.২৪ স্কোর নিয়ে অতীতের মতোই স্বৈরশাসন ক্যাটাগরিতে জায়গা পেয়েছে। গণতন্ত্র সূচকে ১৬৭ দেশের মধ্যে কাতারের অবস্থান ১২৬তম। দেশটির সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়মিত সংবাদ প্রচার করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের একটি প্রতিবেদন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে মধ্যাপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের অবস্থানও তলানির দিকে। মাত্র ২.০৮ স্কোর নিয়ে সৌদি আরবের অবস্থান ১৫৬তম।
সৌদি আরব ছাড়াও স্বৈরশাসন ক্যাটাগরিতে আছে ফিলিস্তিন (১১৩তম), রাশিয়া (১২৪তম), কিউবা (১৪০তম), চিনসহ (১৫১তম) ৫৭ দেশের নাম।
২০১৪ সালের পর এই প্রথম পূর্ণ গণতন্ত্র ফেরত এসেছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। তাইওয়ান প্রথমবারের মতো ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে পূর্ণ গণতন্ত্রের মর্যাদা পেয়েছে। আফ্রিকান দেশ উগান্ডায় চলছে মিশ্রশাসন, সূচকে দেশটির অবস্থান ৯৮তম।
২০২০ সালে ৯.৮১ স্কোর নিয়ে ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে শীর্ষ অবস্থানে আছে নরওয়ে। এর পরের চারটি দেশ হলো আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা।
আরও পড়ুন:
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনী অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করেছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৬২ জন। এর মধ্যে গতকাল রোববার ভোর থেকে চালানো হামলাতেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ ফিলিস্তিনি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে মিডল ইস্ট আই।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে ফের হামলা শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ শিশু নিহত হচ্ছে।
গাজার ১০ লাখেরও বেশি শিশু এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা পাচ্ছে না বলেও সতর্ক করেছে ইউনিসেফ। গাজায় আগ্রাসনের সময় চলতি বছরের ২৩ মার্চ ১৫ জন জরুরি চিকিৎসা কর্মীকে হত্যার ঘটনায় ভুল স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে রাফাতে এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল আইডিএফ।
হত্যার শিকার রেফাত রাদওয়ানের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওটি প্রকাশের পর বিষয়টি সামনে আসে। ত্রাণবাহী একটি দল নিহত চিকিৎসা কর্মীদের মরদেহগুলো খুঁজে পায়। এ সময় তারা রিফাত রাদওয়ানের মোবাইল ফোনও উদ্ধার করেছিল।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসাকর্মী ও ত্রাণকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে, যা নতুন প্রকাশিত একটি ভিডিওতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এটি আন্তর্জাতিক আইনে একটি ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
গাজায় ১৫ জন চিকিৎসা ও ত্রাণকর্মীর হত্যাকাণ্ডকে ‘নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধাপরাধ’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক সাবেক প্রধান এবং মেডিয়েশন গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মার্টিন গ্রিফিথস। ওই ঘটনায় আটজন রেড ক্রিসেন্ট কর্মী, ছয়জন দমকল কর্মী ও একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। রেড ক্রিসেন্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন। এ সময় ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। এরপর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে বেশির ভাগ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়টির দেওয়া হিসাবে বেসামরিক নাগরিক ও যোদ্ধার আলাদা হিসাব দেওয়া হয়নি। তথ্যমতে নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। ইসরায়েল প্রায় ২০ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করার দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।
চলমান এই যুদ্ধ গাজাকে ধ্বংস করেছে। বেশির ভাগ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলার মাত্রা এত বেশি যে, ভূখণ্ডটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
রাফাকে গাজা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় ইসরায়েল
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে একটি নতুন সামরিক করিডোর স্থাপনের কাজ শুরু করেছে ইসরায়েল। তারা এর নাম দিয়েছে ‘মোরাগ করিডোর’। ২০০৫ সালে উচ্ছেদ করা একটি অবৈধ ইসরায়েলি বসতির নামানুসারে করিডোরটির নামকরণ করা হয়েছে। এই করিডোর রাফাহ শহরকে গাজার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।
গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকা থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি জানিয়েছেন, রাফাহ ও খান ইউনিসের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থান নেওয়া ইসরায়েলি সেনারা যে কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। তিনি ওই এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করছেন।
খোদারি বলেন, এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের জন্য একমাত্র খোলা পথ হলো উপকূলীয় রাস্তার আল-রাশিদ করিডোর। এর মানে হলো, আরও বেশি ফিলিস্তিনিকে খান ইউনিস ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং ইসরায়েল আরও বেশি ভূমি দখলের চেষ্টা করছে।
রাফা শহর কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যকার প্রধান বাণিজ্য পথ ‘কারেম আবু সালেম’ ক্রসিংয়ের প্রধান পথ এই শহরটির ভেতর দিয়েই গেছে। পাশাপাশি এটি রাফাহ সীমান্ত দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের অন্যতম প্রধান সংযোগস্থলও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই করিডোর নির্মাণ গাজার ভূখণ্ড ভাগ করে ফেলার একটি পরিকল্পিত কৌশল, যা মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
১৫ স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে হত্যা
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ১৫ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। গত ২৩ মার্চ দক্ষিণ গাজায় জরুরি বিভাগের ওই কর্মীদের হত্যা করা হয়। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে যে তাদের সৈন্যরা ভুল করে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
রাফার কাছে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘের একটি গাড়ি এবং গাজার সিভিল ডিফেন্সের একটি অগ্নিনির্বাপক ট্রাকে গুলি চালানো হয়।
ইসরায়েল প্রথমে দাবি করেছিল, হেডলাইট বা কোনো ধরনের আলো ছাড়াই অন্ধকারে ‘সন্দেহজনকভাবে’ গাড়ি বহর এগিয়ে আসার কারণে সৈন্যরা গুলি চালিয়েছিল। যানবাহনের চলাচলের আগে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি বা তাদের সম্মতি নেওয়া হয়নি।
কিন্তু নিহত হওয়া প্যারামেডিকদের একজনের মোবাইলের ফুটেজ খুঁজে দেখা গেছে যে, আহতদের সহায়তা দেওয়ার সময় যানবাহনগুলোতে আলো জ্বলছিল। অর্থাৎ ইসরায়েলি বাহিনীর ওই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এদিকে ইসরায়েলি বাহিনী জোর দিয়ে বলছে, কমপক্ষে ছয়জন চিকিৎসক হামাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা এটাও স্বীকার করেছে যে, সৈন্যরা যখন গুলি চালায় তখন জরুরি বিভাগের ওই কর্মীরা নিরস্ত্র ছিল।
আরও পড়ুন:ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
এ হামলায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার এক নেতাসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
হাসপাতালটিতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও গার্ডিয়ান এমন তথ্য দিয়েছে।
খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালের অস্ত্রোপচার ভবনে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
এমন এক সময়ে হামলা চালানো হয়েছে, যখন হতাহতে পরিপূর্ণ ছিল ভবনটি।
হামলার ঘটনাটি নিশ্চিত করে ইসরায়েল বলছে, একজন হামাস সদস্য সেখান থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন বলে তারা এ অভিযান চালিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের খবর বলছে, হামলায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা ও চিকিৎসকসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হন।
গেল মঙ্গলবার থেকে নতুন করে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ১৭ মাসের যুদ্ধে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনটিতে চার শতাধিক মানুষ নিহত হন।
এ সময়ে বেশ কয়েকজন হামাস নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে।
গাজায় হামলা শুরুর পর থেকে এ কয়েক দিনে নিহত হন ৬০০ জনের বেশি মানুষ, যার মধ্যে দুই শতাধিক শিশু রয়েছে।
১৫ মাস যুদ্ধের পর গাজা উপত্যকায় কিছুটা শান্তির দেখা মিলেছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফের সর্বাত্মক হামলা চালায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
এর আগে শনিবার খান ইউনিসে ইসরায়েলের আরেক হামলায় হামাসের আরেক নেতা সালাহ বারদাইল নিহত হন।
ইসমাইল ও সালাহ দুজনই হামাসের ১৯ সদস্যের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ইউনিটের সদস্য। ২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ ইউনিটের আরও ১১ সদস্য নিহত হন।
উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় রবিবার সকাল থেকেই বিস্ফোরণের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এসব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
দক্ষিণ ইসরায়েলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ঢুকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধাদের হামলাকে কেন্দ্র করে গাজায় ১৮ মাসব্যাপী এ যুদ্ধের সূচনা হয়। এ বছরের ১৯ জানুয়ারিতে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। তারপরও এ যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ১৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।
আরও পড়ুন:পরিবার নিয়ে ভোর রাতে সেহরি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গাজার বাসিন্দারা, তখনই মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণে কেঁপে ওঠে উপত্যকা। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) হামলা থেকে আবাসিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শরণার্থী শিবির—কিছুই রেহাই পায়নি।
অন্তত চার শতাধিক ফিলিস্তিনি মঙ্গলবারের এই বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। এছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েছে আরও অনেকে। ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের।
ইউনিসেফের মুখপাত্র রোসালিয়া বোলেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলি হামলায় ১০ লাখের বেশি (ফিলিস্তিনি)শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। তাদের যুদ্ধের ধকল সহ্য করতে হচ্ছে। শিশুদের জীবন এভাবে হুমকিতে পড়ায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
গাজা সিটির কেন্দ্রস্থলে আত-তলিবিন নামের একটি স্কুলে বাস্তুহারা নারী ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিল। ইসরায়েলি বিমান হামলায় মাটিতে মিশে গেছে স্কুলটি। এ সময় ঘটনাস্থলেই নারী-শিশুসহ অন্তত ২৫ জন প্রাণ হারান বলে মিডল ইস্ট আইয়ের খবর থেকে জানা গেছে।
গাজায় ইসরায়েল নতুন করে হামলা শুরু করায় দুমাসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভেঙে গেছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খবর বলছে, হামাসের কাছ থেকে জিম্মিদের মুক্ত করতে আরও বলপ্রয়োগের হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর আকস্মিক হামলা চালিয়ে ২৫০ ইসরায়েলিকে জিম্মি করে হামাস, তাদের মধ্যে ৫৯ জন এখনও সশস্ত্র গোষ্ঠীটির কাছে রয়েছে। হামাস অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করার পর এই ঘটনা ঘটল।
এই হামলার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্রবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে হামাস। এর মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি চুক্তির জন্য মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টা আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাদের।
এদিকে, হামাসের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই হামলাকে ‘নিবৃত্তিমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে আইডিএফ।
হামাসের ‘মাঝারি সারির’ সামরিক কমান্ডার, শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও বিভিন্ন অবকাঠামো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।
পুরোনো শত্রু হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন নেতানিয়াহু। স্থল হামলার পাশাপাশি আকাশ থেকে অবিরত বোমা ফেলা হচ্ছে।
গাজা সিটি ছাড়াও উপত্যকার উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত বেসামরিক নাগরিকদের বাড়ি ও শরণার্থী শিবিরেও নতুন করে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গাজা সিটির বাসিন্দা রাবিহা জামাল (৬৫) বলেন, ‘এটা যেন রাতের গভীরতা ভেদ করে নরকের আগুন জ্বলে উঠেছে। যুদ্ধের প্রথম দিনের মতোই হামলা করা হয়েছে।’
পাঁচ সন্তানের মা এই নারী বলেন, ‘সেহরি খাওয়ার জন্য আমরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন বিস্ফোরণ শুরু হয় এবং ভবনগুলো কেঁপে উঠতে শুরু করে। ভেবেছিলাম যুদ্ধ শেষ, কিন্তু তা আবার ফিরে এলো!’
নতুন দফায় এই হামলায় নিহতদের মধ্যে হামাসের রাজনৈতিক শাখার দীর্ঘদিনের সদস্য ইসাম আল-দালিসও রয়েছেন। গাজার সরকারের প্রশাসনিক কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। এছাড়া উপ-বিচারমন্ত্রী আহমেদ আল-হাত্তা, উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আবু ওয়াতফাও নিহত হয়েছেন।
ব্যাপক পরিসরে এই হামলায় রমজান মাসেও নতুন করে প্রাণ সংকটে পড়ে গেল গাজাবাসী।
আরও পড়ুন:হামাসের সঙ্গে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় মঙ্গলবার ইসরায়েলের হামলায় কমপক্ষে ৩২৬ জন নিহত হয়েছেন।
আল জাজিরা জানায়, উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস ও রাফাহ, উত্তরাঞ্চলীয় গাজা সিটি এবং মধ্যাঞ্চলীয় দেইর এল-বালাহসহ বিভিন্ন স্থানে এসব হামলা হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অনেক শিশু রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে এখন পর্যন্ত ৩২৬ শহিদকে নেওয়া হয়েছে। এখনও অনেক ভুক্তভোগী ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে।
গাজার শাসক দল হামাস মনে করছে, ইসরায়েলের এ হামলা গত ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে একতরফা সরে আসার শামিল।
অন্যদিকে গাজার আরেক সংগঠন প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) অভিযোগ, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির সব ধরনের প্রচেষ্টা ইচ্ছাকৃতভাবে নস্যাৎ করছে ইসরায়েল।
আরও পড়ুন:সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ও দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগতদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
স্থানীয় সময় শনিবার যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী একটি গোষ্ঠী এমন তথ্য দিয়েছে।
বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) খবর অনুসারে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির ১৪ বছরে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনা এটি।
ব্রিটিশভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানায়, ৭৪৫ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর ১২৫ সদস্য ও আসাদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর ১৪৮ জন নিহত হন। খুব কাছ থেকে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া লাতাকিয়া শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ও খাবার পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এ সংঘাতের শুরু হয়েছে, যা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে মাস তিনেক আগে সিরিয়ার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে বিদ্রোহীরা।
সরকার জানিয়েছে, আসাদ বাহিনীর অবশিষ্টাংশের হামলার জবাব দিচ্ছে তারা। আর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জন্য ব্যক্তিগত হামলার ঘটনাকে দায়ী করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় রবিবার জানিয়েছে, পবিত্র রমজান মাস ও এপ্রিলের মাঝামাঝি ইহুদিদের বসন্তকালীন উৎসব ‘পাসওভার’ ছুটির দিন পর্যন্ত গাজায় যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ইসরায়েল।
জেরুজালেম থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
স্থানীয় সময় শনিবার মধ্যরাতের ঠিক পর এক বিবৃতিতে বলা হয়, রমজানে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ইসরাইল, যা মার্চের শেষের দিকে শেষ হবে এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আট দিনের ইহুদি পাসওভার পালন করা হবে।
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শনিবার শেষ হয়েছে। এর পরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পক্ষ থেকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সায় থাকার কথা জানানো হলো।
এই চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্য ছিল গাজায় এখনও থাকা কয়েক ডজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া এবং যুদ্ধের স্থায়ী অবসানের পথ প্রশস্ত করা।
নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের মতে, ইসরায়েল ও হামাস আলোচনার অচলাবস্থায় রয়েছে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্তাবলীতে তাৎক্ষণিকভাবে তারা একমত হতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে উইটকফ অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
আরও পড়ুন:আরও জিম্মিকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় চলমান ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি স্থগিত করেছে ইসরায়েল।
স্থানীয় সময় রবিবার সকালে ইসরায়েল এ ঘোষণা দেয়।
এর আগে শনিবার হামাস ছয় জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার পর ইসরায়েল প্রায় ৬২০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে বলে আশা করা হয়েছিল। তিন ধাপের চুক্তির প্রথম ধাপে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও জীবিত জিম্মিদের মধ্যে এ ছয়জনই ছিল শেষ দল।
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘লজ্জাজনক অনুষ্ঠান ছাড়াই পরবর্তী জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শনিবারের নির্ধারিত ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমাদের জিম্মিদের অসম্মান করে এমন লজ্জাজনক (জিম্মি মুক্তি) অনুষ্ঠান এবং প্রচারণার উদ্দেশ্যে জিম্মিদের নিন্দনীয় ব্যবহারসহ বারবার (চুক্তি) লঙ্ঘন করেছে হামাস।’
হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য বন্দিদের ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
হামাস মঞ্চে জিম্মিদের ওঠায়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের পরিহিত ব্রেসলেট ও টি-শার্টে অবমাননাকর লেখা সংযুক্ত করে এবং অসম্মানজনক ভঙ্গিতে তাদের ছবি তোলে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি তথ্য অনুযায়ী, মোট ৬৩ জন জিম্মি গাজায় রয়ে গেছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য