ফরিদপুরে ভুল অস্ত্রোপচারে প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলার অভিযোগটি সঠিক নয় জানিয়ে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন রোগীর পরিবারের সদস্যরা।
অভিযোগটির বিষয়ে হাসপাতাল ও ডাক্তারের কোনো প্রকার দায় নেই জানিয়ে হাসপাতালে গণমাধ্যমের কাছে শনিবার একটি অঙ্গিকারনামা পাঠিয়েছেন প্রসূতির শ্বশর ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের গেন্দু মোল্লার হাটের রফিক মোল্যা।
এর আগে গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় রফিক মোল্যা তার পুত্রবধূকে নিয়ে শহরের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তি হন। সেখানে রাতে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন পুত্রবধূ। অস্ত্রোপচারের সময় রোগী ও সন্তানকে বাঁচাতে প্রসূতির পরিবারের সম্মতিতে তার জরায়ু কেটে ফেলেন ডাক্তার। এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ফরিদপুরে ‘ভুল অস্ত্রোপচারে প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলার অভিযোগ’ এ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়।
যা ভুল বলে অঙ্গিকারনামায় রফিক মোল্লা বলেন, ‘আমি গ্রামের সহজ সরল কৃষক। আমার পুত্রবধূর অস্ত্রোপচারের পর তার জরায়ু অপসারণের বিষয়টিকে একটি মহল ভুলভাবে আমার কাছে উপস্থাপন করে। আমি অন্যের প্ররোচনায় বিষয়টি প্রথমে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরলে তারা সংবাদ প্রকাশ করে। এর ফলে হাসপাতালের সুনামের যে ক্ষতি হয়েছে এজন্য আমি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবাদকর্মীরা সংবাদে ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য নেননি। তাদের বক্তব্য নিলে আমার ভুল তথ্য উপস্থাপনের সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। এখন আমার পুত্রবধূ ও নাতি সুস্থ আছে। এ হাসপাতালেই তারা চিকিৎসা নিচ্ছে। আমার কোনো অভিযোগ নেই, আমি অন্যের প্ররোচনায় পরে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলাম, আমি ক্ষমা চাই।’
অস্ত্রোপচারের পূর্বে বন্ড সই করা রফিকের জামাতা সোহান শরীফ বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের পূর্বে আমিই স্বাক্ষর করি। অস্ত্রোপচার চলার সময় ওটি রুম থেকে কয়েকবার রোগীর অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাই রক্ত জোগাড় করতে বলেন। কিন্তু আমরা না বুঝেই ডাক্তারকে দোষারোপ করতে থাকি।’
ওই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রসূতি মা রিক্তা বলেন, ‘আমি ও আমার সন্তান সুস্থ আছি। কোথায় কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না। শুধু এটুকু জানি জীবনের চেয়ে বড় মূল্যবান কিছু নেই।’
প্রসূতির অস্ত্রোপচার করেন ডা. কল্যাণ কুমার সাহা ৷ তিনি মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে সপ্তাহে দুইদিন শুক্রবার ও শনিবার চেম্বার ও ওটি করেন। তিনি মূলত ঢাকার পিজি হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ডাক্তার।
ডা. কল্যাণ কুমার সাহা বলেন, ‘ওটিতে নেবার পর রোগীর অবস্থা ভাল ছিল না। মা ও সন্তানের মধ্যে একজনকে বাঁচানোর অবস্থা তৈরি হয়। তখনও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি। কাকে বাঁচাবো মতামত নিই। এরপর অস্ত্রোপচার সঠিক হয়। একটি ছেলে সন্তান হয়। সন্তান সুস্থ ছিল। কিন্তু তখনও মায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। তখনও আমরা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি ও দ্রুত রক্ত জোগাড় করতে বলি। একপর্যায়ে মাকে বাঁচাতে তার জরায়ু কাটতে বাধ্য হই। এখন মা ও সন্তান সুস্থ আছেন। এখানে ভুল অস্ত্রোপচার কোথায় বলুন?’
মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মানিক চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো মতামত বা বক্তব্য নেই। একটি অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে আমার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। যা আইন সমর্থন করে না।’
হাসপাতালটির চেয়ারম্যান নুর মো. মাজেদ বলেন, ‘একটি মহল আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে অপপ্রচার চালানোর জন্য তাদেরকে প্ররোচনা দিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করিয়েছেন। অপরদিকে রোগীর স্বজনরাও তাদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন। আমরা অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছি।’
আরও পড়ুন:করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার মামলায় দণ্ডিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা শারমিন হোসেনকে জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট।
এই জামিন আদেশের ফলে তার মুক্তিতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী। তবে রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে যে আপিলের প্রস্তুতি চলছে।
সোমবার বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ ডা. সাবরিনাকে জামিন দেন।
আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাসুদুল হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
আইনজীবী মাসুদুল হক পরে সাংবাদিকদের বলেন, বিচারিক আদালতের দণ্ডের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল শুনানি না হওয়া পর্যন্ত জামিন দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে জামিন প্রশ্নে রুল জারি করা হয়েছে। এ মামলায় জামিন হওয়ায় এখন তার মুক্তিতে বাধা নেই। কারণ বাকি মামলাগুলোতে তিনি আগেই জামিন পেয়েছেন।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী জানান, এ জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
ডা. সাবরিনা শারমিন ও প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুল চৌধুরীসহ আটজনকে তিনটি পৃথক অভিযোগে গত বছরের ১৯ জুলাই ১১ বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন।
রায়ে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রত্যেককে তিন বছর কারাদণ্ড ও তিন হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড, দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় প্রত্যেককে চার বছর কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৪৭১ ধারায় প্রত্যেককে চার বছর কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও চার মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
তিনটি ধারার সাজা পর পর কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। সে কারণে আসামিদেরকে ১১ বছর করেই সাজা খাটতে হবে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন সাবরিনা, সঙ্গে জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
মামলা থেকে জানা যায়, করোনার ভুয়া সনদ দেয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে আরিফুলসহ ছয়জনকে ২০২০ সালের ২৩ জুন গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর থানা হাজতে থাকা অবস্থায় আরিফুলের ক্যাডার বাহিনী ভাঙচুর ও থানায় হামলা করে পুলিশকে মারধর করে।
এ মামলায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর একই বছরের ২০ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় আদালত। বিচার শেষে আট আসামিকে সাজা দেয় বিচারিক আদালত।
আরও পড়ুন:গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৪১ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এটাই একদিনে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তির রেকর্ড।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২ জুন সকাল ৮টা থেকে ৩ জুন সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপতালে ভর্তি হয়েছে ১৪১ জন।
একদিনে রেকর্ড সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
ঢাকার ভেতরে ভর্তি হয়েছেন ১২৮ জন ডেঙ্গু রোগী আর ঢাকার বাইরে ১৩ জন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৯৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ৩৪৫ জন আর ঢাকার বাইরে ৫২ জন।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ২৭৯ জন আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৮৬৯ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ৬ জন। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ভর্তি হন, মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে কারও মৃত্যু না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হন ১১১ জন। এপ্রিলে ভর্তি হন ১৪৩ জন আর মৃত্যু হয় দুজনের।
মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন আর চলতি মাসের প্রথম দুইদিনে কারও মৃত্যু না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৫৭ জন। এর মধ্যে শুক্রবার একদিনে ১১২ রোগী ভর্তির তথ্য দিয়েছিল অধিদপ্তর।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয় দেশে। সে বছরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আর মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
২০২০ সালে শুরু হয় করোনা, কমে আসে ডেঙ্গুর প্রকোপ। রোগী শনাক্ত হয় ১ হাজার ৪০৫ জন। তাদের মধ্যে মারা যান সাতজন। এ ছাড়া ২০২১ সালে শনাক্ত হয় ২৮ হাজার ৪২৯ জন, মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন মোট ৬২ হাজার। মারা যান ২৮১ জন।
আরও পড়ুন:আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বিগত বছরের মতো এবারও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে ওষুধ, চিকিৎসা পণ্য এবং কিছু স্বাস্থ্যসেবা পণ্য উৎপাদনের জন্য রেয়াতি হারে কাঁচামাল আমদানির বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করছি।’
জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার পঞ্চম এবং বাংলাদেশ সরকারের ৫২তম জাতীয় বাজেট।
দেশের ইতিহাসে এবারের বাজেটই সবচেয়ে বড় আকারের। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য তাজউদ্দীন আহমেদ প্রথম ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেছিলেন।
দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অন্যান্য বছরের একই সময়ের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গছে। এর মধ্যে চলতি মাসে এক হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বুধবার অধিদপ্তরের দেয়া বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৫ জন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে রোগী ভর্তি হন ৮৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৮২ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ১৩ জন ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রয়েছেন ২৮৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ২৪২ জন আর অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালে ৪১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ২২ জন। তাদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন এক হাজার ৭২৬ জন। মারা গেছেন ১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ছয়জন। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ভর্তি হন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে কারও মৃত্যু না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হয় ১১১ জন। এপ্রিলে ভর্তি হয় ১৪৩ জন, আর মৃত্যু হয় দুজনের। চলতি মাসে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৩৬ জন।
দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয় দেশে। সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ১৭৯ জন। এ ছাড়া ২০২১ সালে শনাক্ত হয় ২৮ হাজার ৪২৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। আর গত বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয় মোট ৬২ হাজার এবং মারা যান ২৮১ জন।
আরও পড়ুন:বর্ষা আসতে আরও বেশ কিছুদিন বাকি। কিন্তু বর্ষার রোগ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। একইসঙ্গে হাসপাতালে বাড়ছে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
সাধারণত জুন মাসের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এ বছর মে মাস থেকেই এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় মে মাসেই চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুর এই আগাম প্রকোপের নেপথ্যে বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘আগের বছর ডেঙ্গুর সিজনটা দেরিতে শুরু হয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এই ধারাটা নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি পর্যন্ত চলে এসেছে।
‘বর্তমান সময়ে এসে সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে যা দেখেছি সেটি হলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নগরায়নের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত একদমই বৃষ্টিপাত থাকে না। আমরা বার বার বলে এসেছি যে বৃষ্টির সঙ্গে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার একটি সম্পর্ক থাকলেও এখন আর সেটি নেই। ডেঙ্গু এখন আর মৌসম বুঝে হবে না, এটি সারা বছরই বাংলাদেশে থাকবে। বহুতল ভবনগুলোতে পার্কিং স্পেস তৈরি করা হয়েছে। পার্কিংয়ের এই জায়গাতে গাড়ি ধোয়া-মোছা করা হয়। সেখানে যে পানি জমে তাতে আমরা এডিস মশার লার্ভা পাই।
‘একেকটি বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ ১০-১২ বছর ধরে চলে। নির্মাণাধীন সেসব ভবনের বেসমেন্টে আমরা এডিস মশা পাই। ঢাকায় যেসব জায়গায় পানির সংকট আছে, ওয়াসার পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নেই, সেসব এলাকায় ভবন মালিকরা সার্বক্ষণিক পানির সরবরাহ দেন না। এ অবস্থায় ওইসব ভবনের বাসিন্দারা পাত্রে পানি সংরক্ষণ করে রাখেন। সেখানেও আমরা এডিস মশা পাই।’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশার এই যে তিনটি প্রজনন ক্ষেত্রের কথা বললাম সেগুলোর সঙ্গে বৃষ্টিপাতের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ক্ষেত্রগুলো সারা বছর বিদ্যমান। বাংলাদেশের তাপমাত্রা সারা বছরই এডিস মশা প্রজননের উপযোগী। তাই বৃষ্টিহীন সময়েও স্থায়ী প্রজনন ক্ষেত্র থাকার কারণে আমাদের দেশে মৌসুম ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিচ্ছে।
‘মে মাসে যখন বৃষ্টি হয়েছে তখন এডিস মশা নতুন প্রজনন ক্ষেত্র পেয়েছে। প্রকৃতিতে যেহেতু এডিস মশা ছিলোই, তাই এদের প্রজনন বৃদ্ধি পেয়েছে জ্যামিতিক হারে। তাই মে মাসেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে, যেটা আমাদের দেশে আগে কখনোই ছিল না।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্যান-ম্যাল এবং ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ইকরামুল হক বলেন, ‘এডিস মশা বংশ বিস্তারের জন্য যে আবহাওয়া দরকার বাংলাদেশে এখন সেটিই বিরাজ করছে। বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে শীর্ষ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে। বলা হচ্ছে, দেশের গড় যে তাপমাত্রা তার চেয়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ডেঙ্গু চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়তে পারে।
‘গত বছরের তুলনায় এবার মে মাসেই ডেঙ্গু রোগী পাঁচ গুণ বাড়ার প্রথম কারণ আবহাওয়া পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত, বাতাসে যে আর্দ্রতা থাকে, সেটি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে ৫০-৮০ শতাংশ। সেটা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ২৫-৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য খুবই সহায়ক। অর্থাৎ আমাদের দেশের তাপমাত্রা এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী।
‘এই আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব উষ্ণ দেশেই পড়ছে। আর এর প্রভাবে সেসব দেশেও ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সার্ভে করে দেখেছি, ঢাকা শহরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। সেসব নির্মাণস্থল এবং বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে পানি জমে থেকে এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে।’
আরও পড়ুন:দেশে ডেঙ্গু ও করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারা দেশে ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী।
২৪ ঘণ্টার হিসাবে সোমবার সর্বশেষ ডেঙ্গুতে দেশে ৭২ জন এবং ১৫৯ জন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মৌসুমের আগেই বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকবে। বাড়তে পারে করোনাও। এখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডেঙ্গু
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৭২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকায় নতুন ভর্তি রোগী ৫৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৪ জন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগী ২২৬ জন এবং ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগী ১৯৮ জন। অন্যান্য বিভাগে বর্তমানে ভর্তি রোগী ২৮ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী ১ হাজার ৮৪৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মোট ভর্তি রোগী ১২৩৫ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগী ৬০৮ জন।
এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০৪ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১০২৭ জন, ঢাকার বাইরে ৫৭৭ জন।
এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
করোনা
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫৯ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
আগের দিন ১ হাজার ৩২৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ কমেছে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। রোববার শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
করোনা আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা যাননি। এখন পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৪৬ জন। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
করোনা আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে ২১ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে ২০ লাখ ৬ হাজার ২৩৩ জন। সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। রোববারও এই হার একই ছিলো।
আরও পড়ুন:কোভিড-১৯ টিকা কার্যক্রমে এবার দেশে এসেছে নতুন বুস্টার ভ্যাকসিন ভিসিভি (ভ্যারিয়েন্ট কন্টিনিউইং ভ্যাকসিন)। নতুন এ টিকার ৩য় ও ৪র্থ ডোজ চলতি সপ্তাহেই দেয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ফাইজার-ভিসিভি কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম শুরু সংক্রান্ত একটি সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে ৩০ লাখ ডোজ ভিসিভি টিকা হাতে পাওয়া গেছে। এ টিকার ৩য় ও ৪র্থ ডোজ চলতি সপ্তাহ থেকেই দেশের সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ের স্থায়ী কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রে দেয়া হবে।’
‘ভিসিভি ভ্যাকসিন ব্যবহারে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও ইতিবাচক মতামত দিয়েছে।’
শুরুতে কারা এ টিকা পাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ভিসিভির তৃতীয় ডোজ পাবেন ১৮ বছর বা তদুর্দ্ধ বয়সী ব্যক্তিরা; চতুর্থ ডোজ পাবেন ৬০ বছর বা তদুর্দ্ধ বয়সী জনগোষ্ঠী এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ১৮ বছর বা তদুর্দ্ধ বয়সী ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলা ও সম্মুখসারির যোদ্ধারা।
‘তৃতীয় ডোজ দেয়া হবে টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্তির ৪ মাস পর আর চতুর্থ ডোজ পাবেন তৃতীয় ডোজ প্রাপ্তির ৪ মাস পর।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘চলমান কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সফলভাবে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ। বিশ্বে যত ভ্যাকসিন হয়েছে তার ১১ শতাংশ ভ্যাকসিন পেয়েছি আমরা। তা থেকে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮৮.৫১ শতাংশ মানুষকে প্রথম ডোজ, ৮২.১৮ শতাংশকে দ্বিতীয় ডোজ, ৩৯.৬২ শতাংশকে তৃতীয় ডোজ ও ১.৮৫ শতাংশ মানুষকে টিকার ৪র্থ ডোজ এর মধ্যেই দেয়া হয়েছে।’
এ সময় স্বাস্থ্য অধিপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) নাজমুল হক খানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য