বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামাল যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে, এমনটি বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ সুফিয়া কামালের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালের এই দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
শনিবার রাতে দেয়া বাণীতে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাহিত্যে সৃজনশীলতা ছিল অবিস্মরণীয়। শিশুতোষ রচনা ছাড়াও দেশ, প্রকৃতি, গণতন্ত্র, সমাজ সংস্কার, নারীমুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখনী আজও পাঠককে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা কবি সুফিয়া কামালের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবি জানান।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে গঠিত আন্দোলনে কবি যোগ দেন। বেগম সুফিয়া কামাল শিশু সংগঠন ‘কচি-কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে ছাত্রী হল নির্মাণ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সুফিয়া কামাল ছিলেন একদিকে আবহমান বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি, মমতাময়ী মা, অন্যদিকে বাংলার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল তার আপসহীন এবং দৃপ্ত পদচারণে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামসহ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি তাকে জনগণের ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে হত্যা করে, যখন এ দেশের ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয়, তখনও তার সোচ্চার ভূমিকা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল।
তিনি আশা করেন, কবি বেগম সুফিয়া কামালের জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। কবির ভাষায়-
‘তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভু নাহি হবে আর/ আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামল এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে / আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।’
নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তাকে বেশির ভাগ সময় সম্বোধন করা হয়। এটা কিন্তু তার প্রতি অবিচার। কারণ নারী জাগরণের পথিকৃৎ বলতে আমরা যা বুঝি, সুফিয়া কামাল শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং যদি বলা যায় তিনি বাঙালি জাগরণের পথিকৃৎ, তবেই বরং তার প্রতি সুবিচার করা হয়। তিনি সুফিয়া কামাল। কেবল সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালি জাতির যেকোনো দুর্যোগের সময় তিনি হাজির হয়েছেন জননীর মতো।
১৯৬১ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নেমে আসে পাকিস্তানি শাসকদের গোপন নিষেধাজ্ঞা। সে বছর পুরো বিশ্বে যেখানে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, সেখানে রেডিও পাকিস্তান কোনো প্রচার করেনি। শুধু তা-ই নয়, কিছু ‘বাঙালি’ বুদ্ধিজীবী দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদগারও করানো হয় নানাভাবে।
ব্যতিক্রম ছিলেন সুফিয়া কামালসহ আরও অনেক বাঙালি সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও লেখক। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার থমথমে পরিবেশের মধ্যেও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পালন করেন তারা। অনুষ্ঠান শেষে একটি দলের সদস্য হিসেবে জয়দেবপুরে বনভোজনে যান সুফিয়া কামাল। সেখানে ‘ছায়ানট’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা আলোচিত হয়। আর সেই সূত্রে ছায়ানটের সভাপতি করা হয় সুফিয়া কামালকে।
এমনটি উঠে এসেছে শিশুসাহিত্যিক ও কলাম লেখক সুলতানা লাবুর লেখায়।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। এরপর ১৯৬৭ সালের জুনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ওই বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন, পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে।
এ সংবাদ ঢাকার সংবাদপত্রে (দৈনিক পাকিস্তান ও অবজারভার, ২৩-২৮ জুন ১৯৬৭) প্রকাশিত হলে ২৫ জুন ১৯ জন বিশিষ্ট বাঙালি এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন- রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানির সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবাদীদের একজন ছিলেন সুফিয়া কামাল।
ছোটবেলা থেকেই সুফিয়া কামাল ছিলেন প্রতিবাদী এবং সমাজ সেবকও। সুফিয়া কামাল নিজেই জানিয়েছেন, ‘চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজ সেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।’
এই হলেন সুফিয়া কামাল। কবি-লেখক, সমাজসেবক-সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী। বাঙালি জাতিসত্তার এক মহিরুহ। ১৯১১ সালের ২০ জুন সোমবার বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে তার জন্ম। বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন। আরব্য উপন্যাসের হাতেম তাইয়ের কাহিনি থেকে নানি তার ডাক নাম রাখেন হাসনা বানু। আর দরবেশ নানা তার নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন।
সুফিয়া খাতুনের বাবা পেশায় ছিলেন উকিল। কিন্তু তার সাত বছর বয়সে সুফি সাধক হওয়ার প্রেরণায় ঘর ছাড়েন বাবা। বাধ্য হয়ে মাসহ নানার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। ওদিকে তার নানা বাড়ির সবাই ছিলেন রক্ষণশীল মুসলিম। শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার হওয়ায় তার নানার বাড়ির কথ্যভাষা ছিল উর্দু। এ কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শেখার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানো ছিল হারাম পর্যায়ে। তবে সেখানে ছিল বিশাল পাঠাগার। মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় লুকিয়ে সেই পাঠাগার থেকে বই পড়তেন সুফিয়া কামাল।
মায়ের কাছে বাংলা শেখেন। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সুফিয়া কামালের জেদের কাছে হার মেনে পায়জামা-আচকান আর মাথায় টুপি পরে ছেলের ছদ্মবেশে তাকে কিছুদিনের জন্য স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হলো তার পরিবার। বাকিটা শিখেছেন নিজেই। তাকে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার প্যারীলাল বাবু ও তার বড়ভাই সৈয়দ আবদুল ওয়ালী। মাত্র সাত বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই সুফিয়াকে নিজের স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। কিন্তু তার পরিবারের অতি রক্ষণশীলতার কারণে আর সে সুযোগ হয়নি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিশীল ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সুফিয়া এন. হোসেন নামে (তখনও তার নাম সুফিয়া কামাল হয়নি) লেখা প্রকাশিত হতে লাগল বিভিন্ন পত্রিকায়। এজন্য পরিবার থেকে প্রচুর সমালোচনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছেন নেহাল।
১৯২৮ সালে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে বিমানে উড্ডয়ন করেন সুফিয়া। এ জন্য বেগম রোকেয়া তাকে অভিনন্দন জানান বিশেষভাবে। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গেলে বিশ্বকবির হাত থেকে গোরা উপন্যাস পান উপহার হিসেবে।
১৯৩০ সালে ছবিসহ মহিলা ‘সওগাত’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। স্বামীর অনুমতিক্রমে মহিলা সওগাত বঙ্গাব্দ ভাদ্র ১৩৩৬ সংখ্যায় ছবিসহ তার ‘বিড়ম্বিতা’ কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৯৩২ সালে ক্ষয়রোগে স্বামীর মৃত্যুর পর চরম দুর্ভোগে পড়েন সুফিয়া। পরের বছর কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান তৎকালীন এডুকেশন অফিসার ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায়। তিন মাসের মধ্যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে নিয়োগ পান।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রামের চুনতীর কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৩৯ সালে। এরপর থেকে তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুফিয়া কামাল।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের এক মেয়েসহ কলকাতা ব্রেবোর্ন কলেজ সেন্টারে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন। দাঙ্গার পর কংগ্রেস একজিবিশন পার্কের মধ্যে ‘রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু করেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতার ‘সওগাত’ অফিস থেকে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ নামে নারীদের জন্য নতুন একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। নতুন এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল।
প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিও করেছিলেন সুফিয়া কামাল। আর এভাবেই তিনি একের পর সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন।
দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া কামাল। নতুনভাবে শুরু করেন তার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে সমাজ-সচেতন নারীদের এক সমাবেশে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি।’ সুফিয়া কামাল এ সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হন। তারপর জড়িয়ে পড়েন বাংলা ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন।
১৯৫৬ সালে দিল্লিতে সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নেন সুফিয়া কামাল। ওই বছরের ৫ অক্টোবর ‘কচিকাঁচার মেলা’ নামে প্রগতিশীল শিশু সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয় তার বাসভবনে। তিনি ছিলেন এর উপদেষ্টা।
বাংলার আরেক মহীয়সী বেগম রোকেয়া ছিলেন তার আদর্শ। ১৯৬০ সালে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠিত হয়। তার উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ রাখার প্রস্তাব করা হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবের কারণে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানকে বলেছিলেন, ‘আপনি সব শুনুন এবং এর একটা সমাধান করে দিয়ে যান।’ তখন আইয়ুব খানের জবাব ছিল, ‘ওধার তো সব ইনসান হ্যায়, এধার তো সব হাইওয়ান’। অর্থাৎ ওদিকে তো সব মানুষ, এদিকে সব জানোয়ার। আইয়ুব খানের মুখের উপর জবাব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল, ‘আপ তো উও হাইওয়ানকৌ প্রেসিডেন্ট হ্যায়’। অর্থাৎ আপনি তো সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সুফিয়া কামাল। মিছিলেরও নেতৃত্ব দেন। গঠন করেন ‘মহিলা সংগ্রম পরিষদ’।
পাকিস্তানের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পেয়েছিলেন ১৯৬১ সালে। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের কারণে তিনি সে পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলে ত্রাণ বিতরণেও এগিয়ে আসেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানিরা তার ওপর কড়া নজর রেখেছিল। দুরবিন দিয়ে তার বাসায় গোয়েন্দাগিরি চালাত। তার বাসার সামনে কেউ এলে তল্লাশি চালাত, যানবাহনের নম্বর লিখে রাখত। এর মধ্যে মার্চে খবর রটে যায় সুফিয়া কামালকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। বিদেশে এ খবর প্রচারিত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। এ থেকে বাঁচতে পাকিস্তানি সরকারি প্রচার মাধ্যম তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতে লাগলেন। তাদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তিনি যে বেঁচে আছেন শুধু এটুকু জানাতে রাজি হলেন। তাতেই ওরা রাজি হয়ে গেল।
তারপর তার সঙ্গে যা কথা হলো-
প্রশ্ন: আপনি কেমন আছেন?
সুফিয়া কামাল: আমি মরিনি।
প্রশ্ন: সাহিত্যকর্ম কেমন চলছে?
সুফিয়া কামাল: এ অবস্থায় যেমন চলে।
এরপর আরও অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে। তিনি জবাব দেননি।
তার নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সোভিয়েত সরকার। তাকে বিশেষ বিমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে তিনি জানালেন, ‘এখন আমি এ দেশ ছেড়ে বেহেশতেও যেতে রাজি নই। আমার দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, সোয়াস্তি লাভ করুক। এ দেখে যেন আমি এ মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারি।’
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তার অনেক প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন তার কাছে রেশন কার্ড রেখে ঢাকা ছেড়েছিল। ওসব কার্ড দিয়ে চাল-ডাল তুলে নিজের বাসায় এনে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধারা সময় সুযোগ করে বাসার পিছনের দেয়াল ডিঙিয়ে এসে তার কাছ থেকে নিয়ে যেতেন সেগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে সদা তৎপর ছিলেন এই মহীয়সী। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সময় তাকে হত্যা করার জন্য ময়মনসিংহ থেকে আল বদরের বিশেষ ক্যাডার নিয়ে আসা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর সতর্ক প্রহরার কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আর সেই ক্যাডাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়।
এটুকুতেই থেমে থাকেননি সুফিয়া কামাল। নিজের দুই মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য হাসাপাতাল গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তার দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল।
মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের কাজে জড়িয়ে পড়েন সুফিয়া কামাল। তিনি ছিলেন ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা’র সভানেত্রী। আর ‘মহিলা পরিষদ’-এর মাধ্যমে নারী সমাজের সার্বিক মুক্তির কাজ তার কখনও থেমে ছিল না।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সুফিয়া কামালের ছিল অকৃত্রিম সম্পর্ক। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর সরকারি বাড়িতে থাকার সময় ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন। তিন দিনের নোটিসে বাড়িও ছাড়তে হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারকে। বেগম মুজিব সিদ্ধেশ্বরীতে একটি বাড়ি ভাড়া নিলেও সরকারি হুমকি ধামকিতে ওই বাড়িটাও ছাড়তে বাধ্য হন। তখন এগিয়ে এসেছিলেন সুফিয়া কামাল। তার প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকার ভাড়ায় ওঠেন বেগম মুজিব।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর বৈরী পরিবেশেও তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন। আবার চরম বৈরী পরিবেশে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনে অন্যতম সহায়ক ছিলেন সুফিয়া কামাল। এই ট্রাস্টই ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করে সেটাকে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর করে।
১৯৯০ সালে আশি বছর বয়সেও তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার জন্য রাজপথে মিছিলের নেতৃত্ব দেন, তা-ও কারফিউর মধ্যে।
দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন সুফিয়া কামাল। তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এটাও তিনি তার সেবা ও মহত্ত্ব দিয়ে অর্জন করেছেন। ১৯৮৪ সালে মস্কো থেকে তার ‘সাঁঝের মায়া’র রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মস্কোতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুফিয়া কামাল। তখনই এক রুশ তরুণ কবি তাকে বলেছিলেন, ‘আপনি গোর্কির মা উপন্যাসের জননী’।
সুফিয়া কামাল ছিলেন অসম্ভব সাহসী এক দেশপ্রেমিক। তার মানসিক শক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি জীবনে অনেকবার ভেঙেছেন, আবার উঠে শুধু দাঁড়ানইনি, ছুটেছেন। শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য ভাবতেন। সকলের জন্য কিছু করার থাকলে করতেন। আর এ কারণেই সকলের মা হওয়ার গুণ ছিল তার। বাংলা, বাংলাদেশ ও বাঙালিদের জন্য তার অসংখ্য অবদান।
আজীবনের সংগ্রামী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে অনেকগুলো প্রথম কাজ করা সুফিয়া কামালও ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি নারী, যাঁকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
সুফিয়া কামালের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বেগম রোকেয়া এ দেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ। নারী সমাজে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা বৈপ্লবিক।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী সমাজে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা বৈপ্লবিক।
‘বেগম রোকেয়ার জীবন ও তার আদর্শ বাস্তবায়ন এদেশের নারী সমাজকে আলোকিত ও আত্মনির্ভরশীল করতে প্রেরণা যোগাবে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কঠোর রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন এদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত।
সোমবার বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, ‘আমি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
‘তিনি নিজ জীবনের বাস্তবতার মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে নারীর পশ্চাদপদ অবস্থান। উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষাই নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রধান অবলম্বন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, নারী শিক্ষার বিস্তারের মধ্য দিয়ে নারীমুক্তি ছিল বেগম রোকেয়ার জীবন-সংগ্রামের লক্ষ্য। বিশেষভাবে পিছিয়ে পড়া এদেশের মুসলিম নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য তিনি সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
‘আর নারীমুক্তির বাণী বহন করতে গিয়ে তাকে সমাজের গোঁড়া রক্ষণশীলদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কর্তব্যকর্মে অদম্য ও অবিচল।’
বেগম রোকেয়া তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের মূলে আঘাত হেনেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, ‘সংসার, সমাজ ও অর্থনীতি- জীবনের এই তিনটি ক্ষেত্রে নারীকে স্বায়ত্তশাসিত ও আত্মমর্যাদাশীল হতে তিনি গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আর এজন্য তিনি বিশ্বাস করতেন নারীকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
‘শত কুপমণ্ডুকতার বাধা সত্ত্বেও নারী সমাজকে স্বাবলম্বী করতে তিনি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।’
তারেক রহমান বেগম রোকেয়ার কর্মময় জীবন ও আদর্শ নারী সমাজকে আরও উদ্যমী ও অনুপ্রাণিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আরও পড়ুন:ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির ২০২৪ সালের বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের একমাত্র নারী রিক্তা আক্তার বানু। পেশায় নার্স হলেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রতিবন্ধীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখায় প্রশংসিত হয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণা জাগানো ও প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করে বিবিসি।
পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ১০০ নারীকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিভাগগুলো হলো- জলবায়ুকর্মী, সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া, রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি এবং বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি। এর মধ্যে বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে নির্বাচিত হয়েছেন রিক্তা আক্তার বানু।
বিবিসি বলেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করেন নার্স রিক্তা আক্তার বানু। সেখানে অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়।
অটিস্টিক এবং সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত কন্যা সন্তানকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে না পেরে নিজের জমি বিক্রি করে তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের নাম ‘রিক্তা আক্তার বানু লার্নিং ডিজেবিলিটি স্কুল’।
বর্তমানে ৩০০ শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে সেখানে। এটি প্রতিবন্ধিতার প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শেখার প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের জন্য নির্মিত হলেও এখন এটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকা শিশুদের জন্যও সেবা দিয়ে থাকে।
বিবিসির এ বছরের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর মধ্যে রয়েছেন- নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস, ধর্ষণ থেকে বেঁচে যাওয়া গিসেল পেলিকট, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ রেবেকা আন্দ্রাদে ও অ্যালিসন ফেলিক্স, গায়িকা রে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ট্রেসি এমিন, জলবায়ু প্রচারক আদেনিকে ওলাদোসু এবং লেখক ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের গাজা, লেবানন, ইউক্রেন ও সুদানের প্রাণঘাতী সংঘাত এবং মানবিক সংকট থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী রেকর্ডসংখ্যক নির্বাচন-পরবর্তী সামাজিক বিভাজনের সাক্ষী হওয়া পর্যন্ত নিত্যনতুন উপায়ে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হয়েছে নারীদের।
বিবিসির এই ১০০ নারী এ বছর নারীদের ওপর যে চাপ পড়েছে তা স্বীকার করেছেন। তারা তাদের দৃঢ়তার মাধ্যমে পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছেন। কারণ বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে।
এই নারীদের অনেকেই জলবায়ুর জরুরি অবস্থার প্রভাব নিয়েও সচেতন। তাই এখানে জলবায়ুর অগ্রদূতদের তুলে ধরা হয়েছে যারা তাদের সম্প্রদায়কে এর প্রভাব মোকাবিলা করতে সহায়তা করছেন।
আরও পড়ুন:সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে কমিশনের প্রধান করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, সোমবার এই কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনে নয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। তারা হলেন- ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা মেক্সিকোকে বেছে নিয়েছেন গর্ভপাতের জন্য। দেশটির গাইনোকোলজিস্টদের পরামর্শে তারা গিয়ে ঢুকছেন অপারেশন থিয়েটারে।
টেক্সাসের হিউস্টন থেকে মেক্সিকোতে এসেছেন স্যান্ড্রা নামের এক নারী। যুক্তরাষ্ট্রের ওই রাজ্যে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। তাই তিনি বাধ্য হয়ে গর্ভপাতের জন্য মেক্সিকো এসেছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত দেশটির ১৫টি রাজ্য গর্ভপাতকে বৈধতা দিয়েছে।
মেক্সিকোর নারীবাদী সংগঠনগুলো গর্ভপাত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে দুশ’ কিলোমিটার দূরের জনপদ মন্টারের বাসিন্দা স্যান্ড্রা কারদোনা ও ভ্যানেসা গিমেনেয। এই দুই নারী গর্ভপাত করাতে আসা আমেরিকান নারীদের তাদের বাসায় স্বাগত জানান।
সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা এই নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতে ইচ্ছুক নারীদের জন্য অবৈধ পথে গর্ভপাতে ব্যবহৃত কিট সরবরাহ করছেন। তবে এসব কিট মেইলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো অসম্ভব। তাই অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা এসব কিট যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য, এসব কিট ব্যবহার করে নারীরা যেন নিজ বাসায়ই সহজে গর্ভপাত করাতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের প্রচারণায় উঠে এসেছে গর্ভপাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়টি। অনুমান করা যায়, বিশেষ করে নারী ভোটারদের কাছে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গর্ভপাতের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে বসতঘরে আটকে রেখে এক যুবতীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করানোর চেষ্টা এবং মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ঢাকা থেকে গর্ভপাত করতে আসা টিমের এক নারী সদস্যকে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন স্থানীয়রা।
মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে শ্রীনগর উপজেলার পশ্চিম সিংপাড়া গ্রামের ইদ্রিস আলীর বাড়িতে এই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পশ্চিম সিংপাড়া গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে রিপন শেখ চারদিন আগে ঢাকার মিরপুর থেকে এক যুবতীকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। ওই যুবতীকে রিপন নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়।
বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরে তাদের শারীরিক সম্পর্ক এবং এক পর্যায়ে ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এরপর বিয়ের জন্য চাপ দেয়ায় চারদিন আগে ওই নারীকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন রিপন।
তারা জানান, দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা ওই নারীকে মঙ্গলবার দুপুরে জোরপূর্বক গর্ভপাত ঘটাতে ঢাকা থেকে একটি টিম নিয়ে আসেন রিপন। এ সময় তিনি গর্ভপাতে রাজি না হওয়ায় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে জোরপূর্বক গর্ভপাত ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।
এসময় ওই যুবতীর আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। পরে যুবতীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এছাড়া ওই সময় গর্ভপাত ঘটানোর টিমের আম্বিয়া নামে এক নারীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তবে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে রিপন শেখ পালিয়ে যান।
রিপনের প্রথম স্ত্রী তানিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী রিপন ওই নারীকে ঘরে আটকে রেখে অজ্ঞাত দুই নারীর সহায়তায় জোরপূর্বক গর্ভপাত করানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়।’
প্রতিবেশী মো. মামুন জানান, রিপন স্ত্রী পরিচয়ে যে নারীকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি দুই মাসের গর্ভবতী। রিপন লোকজন নিয়ে জোরপূর্বক গর্ভপাতের চেষ্টার পাশাপাশি ওই নারীকে অমানবিক নির্যাতন করেছে।’
তন্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আকবর বলেন, ‘রিপন ওই যুবতীকে হাতুড়িপেটা করেছে। পরে যুবতীকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মো. কাশফি জানান, নির্যাতনের কারণে ওই নারী স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। তার হাত ও পায়ের হাড় ভাঙা। তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
শ্রীনগর থানার ওসি মো. ইয়াসিন মুন্সী বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এক নারীকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
আরও পড়ুন:‘গ্রামের মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে ফুটবল খেলে’ – এ ‘অপরাধে’ হামলা করা হয়েছিল খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা গ্রামে সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমির নারী খেলোয়াড়দের ওপর। যা নিয়ে সারা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। পরে তাদের পাশের দাঁড়িয়েছিল দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) পর্যন্ত, তবে বছর না যেতে সেই কিশোরী ফুটবলারদের মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২২ সালে স্থানীয় কয়েকজন ক্রীড়া সংগঠক সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নিয়মিত স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ৩০ থেকে ৪০ জন কিশোরী অনুশীলন করতেন। ২০২৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে নারী ফুটবলারের ওপর হালমার ঘটনা ঘটে। যা নিয়ে পরদিন একটি হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের হয়েছিল।
এ হামলায় যারা আহত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল খেলোয়াড় মঙ্গলী বাগচী।
মঙ্গলী বলে, ‘আমাদের ওপর হামলার ঘটনায় ছয় মাস পার না হতে মাঠ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পরিকল্পিতভাবে আমাদের কোচকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। যারা আমাদের যে আর্থিক সহায়তা করতেন, তারাও দূরে সরে যান। সামাজিক চাপ ও রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলিকে শেষ করে দেয়া হয়।’
আক্ষেপ নিয়ে মঙ্গলী বলে, ‘হামলার পর আমাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা নিয়ে জনপ্রতিনিধীরা এসেছিলেন। তারা বলেছিলেন আমাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, থাকা খাওয়া খরচ ও একটি মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী, তবে তারও মধ্যে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’
খেলোয়াড় মঙ্গলী বাগচীর মা সুচিত্রা বাগচী বলেন, ‘স্বপ্ন নিয়ে তো মেয়েকে মাঠে পাঠিয়েছিলাম। মার খাওয়ার পরেও তারা ফুটবল ছাড়েনি। এখন তো তাদের কৌশলে মাঠের বাইরে পাঠানো হল। মেয়েটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
‘প্রতিবেশীরা তাকে এখন হেয় প্রতিপন্ন করছে। আমাদের মেয়েরা ফুটবলের যে সুনাম এনেছিল, তার ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পারলাম না।’
মঙ্গলী বাগচী ও তার খেলার সাথীরা এখনও সবাই মাঠের বাইরে। ইতোমধ্যে তাদের চারজন খেলোয়াড়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ কেউ দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে মাঠে কাজ করছে। বাকিরা বাড়িতে অলস সময় কাটাচ্ছে বলে জানায় সে।
মঙ্গলী বাগচী জানায়, এই ক্লাবের কিশোরীদের উপর নির্ভর করে খুলনা জেলা ও বিভাগীয় নারী ফুটবল দল গঠন করা হতো। তাদের পারফরমেন্সের ওপর নির্ভর করতো খুলনার দল বিজয়ী হবে কি না।
শুধু খুলনা জেলা নয় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যান্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও কিশোরীরা প্রশিক্ষণ নিত ক্লাব থেকে। ক্লাবের খেলোয়াড় স্বর্ণা, পূজা রায়, জ্যোতি, ঋতু, প্রীতি, তারা, দেবী, সীমা ও সাদিয়া নাসরিন অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিল। যারা সবাই এখন মাঠের বাইরে।
ক্লাবটি গঠনও করা হয়েছিল খুলনার নারী ফুটবলারদের অগ্রগতির জন্য। স্থানীয় তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত
১০ বছর ও বিভাগীয় পর্যায়ে ৫ বার তারা বিজয়ী বা রানার্সআপ হওয়ার সাফল্য রেখেছিল, তবে তারা যখন প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে অধ্যয়ন শুরু করতো, তখন আর ফুটবলের প্রশিক্ষণ পেত না। এই কিশোরীদের ফুটবল খেলার সাথে ধরে রাখতে তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ওই বিদ্যালয়েরই শিক্ষক দেবাশীষ মন্ডল।
তিনি বলেন, ‘এতগুলো ফুটবলপ্রেমী মেয়ের কথা চিন্তা করেই আমরা কয়েকজন মিলে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করি। তবে এখন বন্ধ আছে আর্থিক সংকটের কারণে। যারা অর্থ প্রদান করতেন, তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে আর অর্থ দিচ্ছেন না।’
তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘এদের মাঠে টিকিয়ে রাখতে এখনও উদ্যোগ না নিলে মেয়েরা খেলা থেকে বের হয়ে যাবে। আর এরা মাঠে না থাকলে খুলনা বিভাগীয় নারী টিমে দুর্বল হয়ে যাবে।’
সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমির কোচ মো. মোস্তাকুজ্জামান বলেন, ‘জেলা ও বিভাগীয় দলে যে নারী খেলোয়াড়রা খেলতেন, তারা প্রায় সবাই আমাদের শিক্ষার্থী। ক্লাবটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার উচিত এ ক্লাবটাকে আবার সচল করা। মেয়েদেরকে মাঠে ফিরিয়ে আনা, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’
তবে ক্লাবটির এই দুরবস্থা সম্পর্কে জানে না বলে জানান খুলনা জেলা ফুটবলের অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এই সম্পর্কে আসলে আমার জানা ছিল না। তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা এই নারী খেলোয়াড়রা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পদ। আমি অতি দ্রুত ক্লাবটাকে সচল করে নারী খেলোয়াড়দেরকে মাঠে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করব।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য