ফেসবুক-ইউটিউবে বিড়ালের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ‘পুচি ফ্যামিলি’র তাপসী দাশ এবার ১৫ জন বিড়ালপ্রেমীর নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। যারা মূলত তার বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন; তার কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
প্রাণী-সংক্রান্ত তিনটি ফেসবুক গ্রুপ বা পেজকেও মামলায় আসামি করেছেন তিনি। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় অনেককে আসামি করা হয়েছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত সোমবার করা মামলায়। মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করে আগস্ট মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর ডিওএইচএসের বাসিন্দা পার্থপ্রতিম চৌধুরীর স্ত্রী তাপসী দাশ ফেসবুকে ‘পুচি ফ্যামিলি’ পেজ ও ইউটিউবে ‘পুচি ফ্যামিলি অরিজিনাল’ চ্যানেলের কর্ণধার।
তার বিরুদ্ধে বিড়াল আটকে রাখা ও বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সম্প্রতি রাজধানীর পল্লবী, গুলশান, উত্তরার পাশাপাশি সাভার থানায় বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন কয়েকজন বিড়ালপ্রেমী। একই অভিযোগ এনে তাপসীর বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশও পাঠান তারা।
এ ছাড়া তার বিড়াল পালন পদ্ধতি, বিড়াল বিক্রি, অপচিকিৎসাসহ বিড়াল নির্যাতনের নানা অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করেন অনেকেই। তাদের মধ্যে যারা ‘বেশি প্রতিবাদী ভূমিকায়’ ছিলেন, তাদের সবাইকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আসামির তালিকায় রয়েছেন বেসরকারি সংস্থা অ্যানিমেল শেল্টারের (অ্যানিমেল লাভার্স অফ বাংলাদেশ- এএলবি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দ্বীপান্বিতা হৃদি ও কর্মী তাজকিয়া দিলরুবা, বাংলাদেশ ক্যাট ফ্যান্সিয়ার্স সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সারা বিনতে জামান ও পল্লবী থানায় বিড়াল আটকে রাখার অভিযোগকারী মনিরা আলম ওরফে মনিরা আক্তার।
এই মনিরা আলম নিউজবাংলাকে বলেছেন, তার বিড়াল মাথিনের ওপর নির্যাতন ও তাপসীর ‘কর্মকাণ্ডে’ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি।
তাপসীর বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন থানায় যারা অভিযোগ করেছেন কিংবা অনলাইনে তীব্র প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনা করেছেন, তাদের আসামি করা হয়েছে মামলায়। এই আসামিরা হলেন হিয়া চৌধুরী, সাবরিনা, গৌতম সাহা, আমিনুল ইসলাম সুজন, রৌতিক ইসলাম লিনজয়, দিলরুবা রহমান, ফারজানা লিও, অলি উনি নাহার আশা, ইশরাত উদ্দিন, তাহসিন ফারিহা ইয়াছিন ও দিলরুবা।
যে তিনটি ফেসবুক গ্রুপ বা পেজকে আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ক্যান্ডি হাউস (ফেসবুক গ্রুপ/পেজ), কুত্তাওয়ালা-KUTTAWALA (Dog lovers of BD), ক্যান্ডি লায়ন ওজি লাভার্স (Candy Lion Ozzy Lovers) ফেসবুক গ্রুপ/পেজ।
পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশের বিরুদ্ধে সম্প্রতি বিড়াল নির্যাতনের পাশাপাশি বিড়ালপ্রেমীদের চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনার লিখিত অভিযোগ করা হয় বিভিন্ন থানায়। অভিযোগকারীরা রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসে তাপসী দাশের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে সেখানে থাকা বিড়ালগুলোকে তার কবল থেকে বাঁচানোর অনুরোধও করেছেন।
তাপসীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হিসেবে নিউজবাংলাকে তারা বলেছিলেন, পুচি ফ্যামিলির ফেসবুক পেজে ফলোয়ার প্রায় ৯ লাখ। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার আছে ১ লাখ ৪০ হাজার। এসব ফলোয়ারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিড়ালের প্রতি নিষ্ঠুরতা শেখাচ্ছেন তাপসী দাশ।
তাপসী দাশের মামলার প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেছেন, এসব অভিযোগ জানিয়ে মামলার জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন থানায় লিখিত আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি। এখন উল্টো তাদের বিরুদ্ধে ‘হয়রানিমূলক মামলা’ হলো। এই মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে পোষা প্রাণী নির্যাতনের মতো ঘটনাটিকে আড়াল করে প্রকৃত প্রাণিপ্রেমীদের মধ্যে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
আসামিরা বলছেন, পুচি ফ্যামিলির পুচি নামের বিড়ালটিও তাপসী দাশের নয়। পুচি ফ্যামিলির বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিড়াল বিক্রির অভিযোগও তুলেছেন তারা। তাদের দাবি, পুচি ফ্যামিলিকে ডিওএইচএস কর্তৃপক্ষ বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। পুচি ফ্যামিলির ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধের জন্য ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন এসব প্রাণিপ্রেমী।
মামলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অন্যতম আসামি বেসরকারি সংস্থা এএলবির চেয়ারম্যান দ্বীপান্বিতা হৃদি মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুচি ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যারা প্রথম থেকেই কথা বলেছেন, অনেক মানুষই কথা বলেছেন, কিন্তু যারা বেশি প্রতিবাদ করেছেন, তাদের মধ্য থেকে একটি লিস্ট করেছে। এদের মধ্যে ব্যক্তি ও বিভিন্ন অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার গ্রুপ রয়েছে। ১৮ জনের একটি লিস্ট করে মামলার আসামি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তাপসী দাশের বিরুদ্ধে বিড়াল নির্যাতন, অন্যের বিড়াল আটকে রাখা, অপচিকিৎসা, বিক্রি কিংবা আর্থিক মুনাফার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছেন বা প্রতিকার চেয়ে পুলিশ, বিভিন্ন সংস্থা ও সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, তাদের সবাইকে তার মামলার আসামি করেছেন।
‘অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার নিয়ে কাজ করতে এসে উল্টো অ্যানিমেল অ্যাবিউজার আমাদের হ্যারাজমেন্টের মামলায় ঢুকিয়ে দিল।’
প্রাণীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দ্বীপান্বিতা বলেন, ‘সে কেস করার আগেই আমরা ১৩ জুন তার নামে অভিযোগ দিয়েছি। সেটা থানাতেই দিয়েছি, আইসিটি ডিপার্টমেন্টেও দিয়েছি। এরপর তাপসীর কোনো রকম রেসপন্স পাই নাই।
‘পুলিশ যতবার ফোন দিয়েছে, ততবারই তিনি ঢাকার বাইরে, বাসার বাইরে বলে জানিয়েছেন। কখনও বাসায় তালা মারা বলে জানিয়েছেন। তার মানে এখানে কোনো ইনভেস্টিগেশন হয় নাই। কমপ্লেইন বলেন, উকিল নোটিশ বলেন, এসবের কোনোটির ক্ষেত্রেই আমরা কার্যকর কোনো রেসপন্স পাই নাই।’
এএলবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে, তারা আসলে এই টাইমটা নিয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে উল্টো কেস করার জন্য। আমাদের হ্যারাস করার জন্যই এই কেস করা হয়েছে। কারণ তিনি তার মামলার এজাহারে যা যা বলেছেন, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে অপদস্থ করার কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাদের মানুষজন গালাগাল করছে, এতে তাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
‘এখন আমার কথা হচ্ছে, সে বারবার বলছে, সে বিড়াল নিয়ে ব্যবসা করছে না। আমরা তাকে কখনোই গালিগালাজ করি নাই। সে চেয়েছিল আমাদের দমাতে, ভীতি তৈরি করতে। আমরা এখনও আইনিভাবে তার বাসার বিড়ালগুলো উদ্ধার করে ভালো কোনো পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।’
তাপসীর করা মামলার এজাহারের একটি অনুলিপি নিউজবাংলা পেয়েছে।
এজাহারে তাপসী দাশ বলেছেন, শখের বশে প্রাণীদের প্রতি মায়া তৈরি হওয়ায় তিনি মানুষকে বিনোদন দিতে বিড়ালের কর্মকাণ্ডের ভিডিও অনলাইনে প্রচার করেন। এতে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হন। তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আসামিরা থানায় অভিযোগসহ ডিজিটাল মাধ্যমে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে আর্থিক ক্ষতি করছেন।
তাপসী বলেছেন, তিনি একজন সহজ, সরল, উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র-নম্র ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নারী। পক্ষান্তরে আসামিরা ধূর্ত, তথ্য-সন্ত্রাস, পরধনলোভী ও আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল। একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে ‘পুচি ফ্যামিলি’ নামে ফেসবুক পেজ ও ‘পুচি ফ্যামিলি অরিজিনাল’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের কর্ণধার তিনি।
ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ফলোয়ার সমৃদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলটি পরিচালনা করে আসছেন।
তিনি শখের বশে তার পোষা প্রাণীদের যত্নের জন্য ৬০ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থেকে প্রাণীদের যাবতীয় চিকিৎসা, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সব রকমের সেবাযত্ন দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। এই কাজে তার স্বামী ও তার বাবা তাকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন।
মামলায় তাপসী দাশ আরও বলেছেন, শখ ও প্রাণিকুলের প্রতি মায়ার কারণে পোষা প্রাণীর প্রতি ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে তার ব্যক্তিগত আনন্দ ও ভালোলাগা তথা সমমনা লোকদের হাসি, আনন্দ ও বিনোদন, শখ, আহলাদ ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ‘পুচি ফ্যামিলি’ নামে ফেসবুক পেজ ও ‘পুচি ফ্যামিলি অরিজিনাল’ নামে ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও পোস্ট বা শেয়ার করেন।
মানুষের ভালোবাসা ও তার মানবিক আচরণ বা ব্যবহারের জন্য পেজটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। ফলে প্রায় সাড়ে নয় লাখ ফলোয়ার হয়।
মামলায় তাপসী দাবি করেছেন, তিনি তার জীবনযাত্রার ও বার্ষিক খরচের টাকা দিয়ে পোষা প্রাণীদের আদর-যত্ন, চিকিৎসাসেবা ও ভরণপোষণ করেন। তিনি বলেছেন, তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে উল্লিখিত আসামিসহ অজ্ঞাতপরিচয় অনেক আসামি ও বিভিন্ন পেজ বা গ্রুপ থেকে বিভিন্নভাবে তার মানহানির চেষ্টা করা হয়েছে।
এমনকি আসামিরা তাপসীর ছবির সঙ্গে মিল করে ফেক নিউজ করিয়েছেন। তাপসীকে নিয়ে বাজে বাজে মন্তব্য করেছেন। যেমন: শাকচুন্নি, ডাইনি, রাক্ষসী। তাপসীর স্বামীকে ব্রহ্মদৈত্য, টাকলু বলেছেন। পোষা প্রাণীদের চিকিৎসকদেরও বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন তাপসী দাশ।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, আসামিদের এহেন কর্মকাণ্ডে তাপসী ও তার স্বামীর স্বাভাবিক জীবন যাপনে অশান্তি ঘটছে। আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুচি ফ্যামিলি বয়কটের অপপ্রচার চালানোর পাশাপাশি মানহানিকর স্ট্যাটাস, পিকচার পোস্ট, কমেন্টস ইত্যাদি শেয়ার করছেন, যা সুস্পষ্ট অপরাধ। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে তার প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ জন্য এজাহারে ২০১৮ সালের ডিজিটাল আইনের ২৩/২৪/২৫/২৬/২৭(১)(খ)(গ)(ঘ)/২৯/৩৭/৩৫ ধারায় আসামিরা অপরাধ করেছেন দাবি করে আদালতের কাছে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ শাস্তির প্রার্থনা করেন তিনি। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে আগস্ট মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।
মামলার বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাপসী দাশ ও তার স্বামী পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মোবাইল ফোনে গত চার দিন ফোন করলেও তারা সাড়া দেননি। তাদের ফোন নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে এ-সংক্রান্ত প্রশ্নসংবলিত খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পায়নি নিউজবাংলা।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জাকির হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশের হাতে নির্যাতনের শিকার বিড়ালগুলো উদ্ধার করার জন্য যারা আইনি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিভিন্ন থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন, ফেসবুক-ইউটিউবে যারা তার তীব্র সমালোচনা করেছেন, মামলায় তাদের আসামি হয়েছে। এই মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে পোষা প্রাণী নির্যাতনের মতো ঘটনাটিকে আড়াল করে প্রকৃত প্রাণিপ্রেমীদের মধ্যে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা।’
প্রাণিপ্রেমী ও অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, পুচি ফ্যামিলির বিরুদ্ধে বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ করে তার বাসা থেকে নির্যাতনের শিকার বিড়ালগুলোকে উদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন থানায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি।
অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার সংস্থার এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশ গত সোমবার আমাদের ১৫ জনের নাম ও তিনটি গ্রুপের নাম উল্লেখ করে আদালতে মামলা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারাই তার বিরুদ্ধে বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ করে লেখালেখি করেছেন, তাদের নামে এই মামলা করেছেন। মামলার তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সিআইডিকে।’
তবে সিআইডির জনসংযোগ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে জানান, মামলার নথি এখনও তাদের কাছে পৌঁছায়নি। পৌঁছালেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রাণিপ্রেমীরা জানান, বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ মিরপুর ডিওএইচএস পরিষদকেও জানানো হয়। সেই বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। এখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো, উল্টো তিনিই অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করায় আতঙ্কে রয়েছেন বিড়ালপ্রেমীরা।
তাদের জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার এসআই শরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওনারা যে ধরনের অভিযোগ করেছেন, সে বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারেন তারা।’
পুচি ফ্যামিলিকে ‘বাসা ছাড়ার নোটিশ’
অ্যানিমেল কেয়ার সোসাইটি অফ বাংলাদেশের পরিচালক ও বাংলাদেশ ক্যাট ফ্যান্সিয়ার্স সোসাইটির (বিসিএফএস) চেয়ারম্যান সারা বিনতে জামানের দাবি, মিরপুর ডিওএইচএসের ভাড়া বাসার মধ্যে নোংরা পরিবেশে বিড়াল পালন, নির্যাতন ও নানা ধরনের সমালোচনা তৈরি হওয়ায় পুচি ফ্যামিলিকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তিনি বলেন, ‘ডিওএইচএস কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছেন, তাকে বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে।’
প্রাণীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা অ্যানিমেল শেল্টারের কর্মীরা মঙ্গলবার জানিয়েছেন, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পাওয়ার পর থেকেই পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশ ও তার পরিবারের সদস্যরা আবারও আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিড়াল বিক্রির অভিযোগ
একাধিক বিড়ালপ্রেমী নিউজবাংলাকে জানান, পুচি ফ্যামিলি বিড়াল পালনের কোনো সঠিক নিয়মকানুন মানে না। নিষ্ঠুরতার দৃশ্য ধারণ করে ইউটিউবে আপলোড করেন ভিউ ও সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর জন্য। এর ফলে বিভিন্ন বিড়ালপ্রেমী তার মাধ্যমে বিড়াল কিনে থাকেন। পুচি ফ্যামিলির তাপসী দাশ ও পার্থ চৌধুরী এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিড়াল বিক্রি করে থাকেন।
বিসিএফএসের চেয়ারম্যান সারা বিনতে জামান নিউজবাংলাকে বলেন, তাপসীর কাছে যেসব বিড়াল রয়েছে, তার সবই অন্যের কাছ থেকে অ্যাডাপশনে নেয়া। মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে অ্যাডাপশনে নিয়ে তিনি বিড়ালগুলোর ওপর নির্যাতন করছেন। বিড়াল পালনে অনিয়ম ও নির্যাতনের দৃশ্য দেখে বিড়ালগুলোর প্রকৃত মালিকরা তাদের বিড়াল ফেরত চেয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করার পর বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিয়েছেন তাপসী দাশ ও তার অনুসারীরা। এ কারণে অনেকেই আতঙ্কে রয়েছেন।
‘পুচি ফ্যামিলির পুচিও তাপসী দাশের নয়’
সারা বিনতে জামান আরও বলেন, তাপসী দাশের কাছে পুচি, হাম্বা ও মাথিন নামে বেশ কিছু বিদেশি বিড়াল রয়েছে, যেগুলোর একটিরও প্রকৃত মালিক নন তিনি। এই বিড়ালগুলো যখন তার কাছে মালিকরা দিয়েছিলেন, তখন শর্ত ছিল তিনি ব্রিডিং মেটিং করাতে পারবেন না, কিন্তু সেই নিয়ম মানেননি। হাম্বাকে তিনি মেরে ফেলেছেন। মাথিনকে এখনও নির্যাতন করে থাকেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
জান্নাতি নামে এক নারীর দাবি, পুচি ফ্যামিলির কাছে থাকা ফিউনা বিড়ালের মালিক তিনি। তাপসীর কাছে ফিউনাকে অ্যাডাপশনে দেন প্রেগন্যান্ট অবস্থায়।
জান্নাতি বলছেন, পরবর্তীতে তাপসীর বাসায় ফিউনার একটি বাচ্চা হয়। যেটি পুচি নামে পরিচিত। কাজেই এই পুচির মালিক তিনি। তবে তাপসী পুচিকে নিজের বাচ্চা বলে দাবি করে আসছেন।
মাথিনকে নির্যাতন ও তাপসীর হুমকিতে অসুস্থ মনিরা
নিজের বিড়াল উদ্ধার করার জন্য পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন রাজধানীর শাহজাহানপুরে গৃহিণী মনিরা আলম। মনিরার সেই বিড়ালের নাম মাথিন। দেশি প্রজাতির সেই বিড়াল এখনও উদ্ধার হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, তাপসী দাশ মাথিনের মালিক মনিরা আলমকে নিয়ে ফেসবুকে-ইউটিউবে বাজে বাজে মন্তব্য করেছেন। লাইভে এসে তাকে নিয়ে গালিগালাজও করেছেন।
মনিরা আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানেই শেষ নয়, জিডির পর তাপসীর লোকজন আমার স্বামীকে হুমকি দিয়েছেন। এসব ঘটনায় আমরা পারিবারিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব ঘটনার প্রতিকার চেয়ে বাধ্য হয়ে শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘তাপসীর সঙ্গে আমার ফেসবুকে পরিচয়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার কাছে আমার মাথিনকে দত্তক দিই। পরে যখন দেখলাম সে বিড়ালকে নির্যাতন করে ভিডিও বানাচ্ছে, তখনই তার কাছে আমার বিড়াল চাইলে গালিগালাজ শুরু করেন। এমন ভাষায় গালমন্দ করেছেন, যেগুলো শুনে আমার স্বামী ছেলেসহ আমরা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেছি। এরপর থেকেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’
মনিরা আরও বলেন, ‘মাথিনকে মৌখিক শর্তে তাপসীর কাছে রাখতে দিয়েছিলাম। নির্যাতন করার পর মাথিনকে যখন ফেরত চাইলাম, তখন তাপসীসহ তার ফ্যান ফলোয়াররাও আমাকে ফেসবুকে নোংরা গালিগালাজ করেন। তিনি লাইভে এসে আমাকে যে গালি দেন, তার ভিডিও আছে আমার কাছে। মাথিনকে দেয়ার আগে থেকে তার সঙ্গে কথাবার্তার প্রমাণও আছে আমার কাছে।
‘এসব ঘটনায় আমাদের আমেরিকাপ্রবাসী ছেলে আপসেড হয়ে পড়েছে। সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে মাথিনের ওপর নির্যাতন আরও বাড়িয়েছে পুচি ফ্যামিলি।’
ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল বন্ধের আবেদন
বিড়াল নির্যাতনের (অ্যানিমেল অ্যাবিউজ) অভিযোগ এনে পুচি ফ্যামিলির ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধের জন্য ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে ভার্চুয়াল পিটিশন করেছে বেসরকারি সংস্থা এএলবি। এই আবেদনের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ফেসবুক-ইউটিউবে কাজ করছেন প্রাণিপ্রেমীরা।
আরও পড়ুন:তীব্র তাপপ্রবাহে পানির জন্য হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীতে। পানির অভাবে ব্লাস্টসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের শিকার হচ্ছে বোরো ধান। ধানের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে অন্যান্য ফসলও। পানির সংকট হওয়ায় আমের মুকুল ঝরে যাচ্ছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ধান চাষি আজমত উল্লাহ জানান, পানির অভাবে ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ধানে পোকাড় আক্রমণ হচ্ছে। ধানের থোড়া আসায় পানির দরকার হলেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকদিন বরেন্দ্রের গভীর নলকূপে সেচের জন্য ঘুরছেন। তবে সিরিয়াল পাচ্ছেন না।
জেলার কয়েকটি আম বাগান ঘুরে দেখা যায়, প্রচুর পরিমাণ আম ঝড়ে পড়ছে। গাছের নিচে ঝড়া আম স্তুপ হয়ে আছে।
চারঘাট উপজেলার আমচাষী জব্বর আলী বলেন, পানির অভাবে আম ঝড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই আম ঝড়ে যাচ্ছে। পানি দিয়েও আম ঝড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। পানিও ঠিক মত উঠছে না। এবার আমের ফলন ঠিক মত হবে না।
অন্যান্য চাষীরাও বলছেন একই কথা। পানি না থাকায় বালায় নাশক স্প্রেও দেয়া যাচ্ছে না। ফলে পোকামাকড় আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরেন্দ্রের অপরিকল্পিত সেচ প্রকল্পের কারণে এই অঞ্চলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। ফলে পানির সংকট সৃষ্টি হয়ে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে বোরো ধানের উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন, বোরো ধানের জমিতে কম পক্ষে ৩ সেন্টিমিটার পানি থাকা প্রয়োজন। তা না হলে ধানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। ধানের থোড়া তে প্রচুর পরিমাণ চিটা দেখা দেয়। আর পানির অভাবে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ হয়ে ধান গাছ হলুদ হয়ে যায়। যেভাবেই হোক বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানির ধরে রাখতে হবে। এবার যেভাবে তাপ প্রবাহ ও পানির সংকট তৈরি হয়েছে এটা আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকলে বোরোর উতপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, তাপ প্রবাহের ফলে আমের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পানির সংকট তৈরি হওয়ায় আম ঝড়ে পড়ছে। আমের ঝড়ে পড়া রোধে আম গাছের গোড়াতে সপ্তাহে অন্তত একদিন পানি দিতে হবে হবে। কৃষকদের আমরা গাছের গোড়াতে পানি দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এ বছর রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. শীতাংশু কুমার পাল বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর পানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অপরিকল্পিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের কারণে পানির স্তর আরো বেশি দ্রুত নিচে নেমেছে। গভীর নলকূপেও এখন ঠিম মত অয়ানি উঠছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কমিয়ে নদী থেকে জমিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি জমানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রশিদের দাবি, সমালোচকরা পানি সংকটের বিষয়ে বরেন্দ্রের ঘাড়ে এককভাবে দোষ চাপাচ্ছে। পানির সংকট মোকাবিলায় নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি জমিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পদ্মা নদী থেকে আশেপাশের অঞ্চলে সেচের পানি সরবারাহ করতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নষ্ট হয়ে যাওয়া গভীর নলকূপ গুলোও মেরামত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, তীব্র তাপ প্রবাহের ফলে কিছুটা পানি সংকট তৈরি হলেও তা দ্রুত সমাধান করতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। বোরো ধানের জমিতে পানি পানি সরবারাহের বিষয়ে বরেন্দ্র অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সাবিনা বেগম জানান, বোরো ধানের জমিতে পানি সরবাহর নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর একযোগে কাজ করার ব্যাপারে সমন্বয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে কথা বলা হচ্ছে যেন সেচের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবারাহ নিশ্চিত করা যায়।
ছিয়াত্তর বছর বয়সী আবদুর রহিম স্ত্রীকে হারিয়েছেন দেড় যুগ আগে। পরিবারের সদস্য বলতে এক ছেলে, তাও থাকেন প্রবাসে। ছেলে প্রবাসে যাওয়ার পর অন্য ঘরে চলে গেছেন ছেলের বৌও। তাই রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হয় নিজেকে।
জীবন যুদ্ধে তিনি কখনও দমে যাননি, তবে এবার হার মেনেছেন টিউবওয়েলের পানির কাছে। ১৫ থেকে ১৬ বার টিউবওয়েল চাপার পরেও মিলছে না এক গ্লাস পানি। তাই পানি সংকটের কারণে গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজ হচ্ছে ব্যাহত।
তাই অধিকাংশ সময় বাড়ির পাশে থাকা মসজিদে গিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করছেন আবদুর রহিম।
এদিকে গৃহবধূ ছানোয়ারা খাতুন গৃহস্থালির সব কাজ করেন একাই। বাড়িতে রয়েছে তিনটি গাভি ও চারটি ছাগল। এর মধ্যেই আজ সপ্তাহ দুয়েক ধরে টিউবওয়েলে উঠছে না পানি। খাওয়া থেকে ওজু, গোসল সব কিছুতেই বেগ পেতে হচ্ছে পানি সংকটের কারণে।
ছানোয়ারা খাতুন জানান, তীব্র তাপদাহের মধ্যে আজ সপ্তাহখানেক ধরে বাড়িতে থাকা গরুর গোসল করাতে পারেননি তিনি, তবে নিজে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে গোসল করে আসেন।
মেহেরপুরের গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ফলে এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট এখন চরমে পৌঁছেছে। একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তারা সুপেয় পানির সংকটের কথা জানান। বিশেষ করে মুজিবনগর উপজেলার, জয়পুর, আমদহ, তারানগর, বিশ্বনাথপুর; সদর উপজেলার শালিকা, আশরাফপুর, আমদাহ, বুড়িপোতা, আলমপুর এবং গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের আমতৈল, মানিকদিয়া, কেশবনগর, শিমুলতলা, রইয়েরকান্দি, সহড়াবাড়িয়া, মিনাপাড়া, ভোলাডাঙ্গা, কুমারীডাঙ্গা কাথুলি ইউনিয়নের গাঁড়াবাড়িয়া, ধলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি শুষ্ক মৌসুম শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে।
দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা, এবং পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। আগামীতে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলেও জানান তারা।
গ্রামবাসীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হস্তচালিত অনেক টিউবওয়েল। যেখানে আগে ভূগর্ভের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীরতা থেকেই পাওয়া যেত সুপেয় পানি। গত এক দশকে ক্রমেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
জেলায় গভীর-অগভীর মিলিয়ে ৯ হাজার ৯১৩টি নলকূপ আছে। এর মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ২ হাজার ২৩৯টি।
গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামের পল্লি চিকিৎসক মতিন বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা দিয়ে বেড়াই। আজ ১০ দিন ধরে আমার বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না। রোদের মধ্যে সারা দিন গ্রাম গ্রাম ঘুরে বাড়ি এসে যদি পানি না পাই তাহলে কেমন লাগে? আমি তাই মসজিদের নলকূপে গিয়ে গোসল সেরে আসি।’
একই এলাকার দিনমজুর সিরাজ বলেন, ‘আমি সারা দিন মাঠে কাজ করি। বাড়িতে দুটি গরুও পালন করি অথচ গরু দুটি আজ কয়দিন গা ধোয়াতে পারিনি। আবার মাঠে এক বিঘা ধানের আবাদ আছে, তাতে সেচ দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হচ্ছে। যেখানে দুই ঘণ্টা মেশিনে পানি দিলে হয়ে যেতো। সেখানে এখন চারটা ঘণ্টা পানি দিয়েও হচ্ছে না।’
এ অঞ্চলের আবহাওয়া নির্ণয়কারী চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই চুয়াডাঙ্গাসহ এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এখানে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অঞ্চলে আপাতত আজকে বৃষ্টির সম্ভবনা নেই।’
মেহেরপুরের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন জানান, সুপেয় পানির সমস্যা নিরূপণে যেসব এলাকায় সংকট সেখানে ১০টি বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি ৯০০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এসব এলাকায় ৫০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে, তবে অতিবৃষ্টি ও পানির অপচয় রোধ করা না গেলে পানি সংকটের সমাধান মিলবে না।
আরও পড়ুন:ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটেছিল বাংলাদেশ তথা এশিয়ার অন্যতম বড় এই শিল্প দুর্ঘটনা।
সেদিন অত্যন্ত ব্যস্ততম সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামে একটি ৯ তলা ভবন ধসে মারা যান ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক, আহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচেও যেন মরে গেছেন।
লোমহর্ষক এই ট্রাজেডির সাথে সাথে আল আমিন মিয়া, জিয়াদ হোসেন, তাহমিনা আক্তার ও বীথিসহ অনেক শিশু, কিশোরের জীবনেও নেমে আসে ট্রাজেডি। সেদিনের হতাহতের অনেকের সন্তানই এখন নিঃসঙ্গতা আর অর্থাভাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে।
এমন দুর্ভাগা ২১ শিশু, কিশোর-কিশোরী মমতার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে গাইবান্ধার ‘অরকা হোমস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। কেউ হারিয়েছে বাবাকে, কেউ বা মাকে। কেউ কেউ আবার বাবা-মা উভয়কে হারিয়ে একেবারেই হয়েছে নিঃস্ব। কারও কারও বাবা-মা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আজীবনের জন্যও। এ ছাড়াও আরও ৩১ জন এতিম-অসহায় শিশু-কিশোর-কিশোরীর ঠিকানা হয়েছে অরকা হোমসে।
বাবা-মা হারানো দেশের বিভিন্ন জেলার এসব শিশুর লেখাপড়া, খেলাধুলা ও বিনোদনসহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন (অরকা)।
২০১৪ সালে অরকা হোমসের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায়। রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই একই বছরের ২২ ডিসেম্বর গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অরকা-হোমস প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন তলাবিশিষ্ট দুটি এবং পরবর্তীতে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চার তলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। যেখানে ৫২ জন এতিম অসহায় শিশু, কিশোর-কিশোরী বসবাস করছে।
এর মধ্যে ২১ জন মেয়ে ও ৩১ জন ছেলে রয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমানে ২১ জন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিশু-কিশোর-কিশোরী রয়েছে। সেখানে তারা থেকে-খেয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৯ জন মেয়ে, ১২ জন ছেলে। এই ২১ জন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানকার ৩১ জন শিশু-কিশোরের কেউ মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে, কেউ কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে আবার কারও কর্ম-সংস্থান হওয়ায় অরকা হোমস ছেড়ে চলেও গেছেন।
কেবল মা হারাদের মধ্যে ওই সময়ে (২০১৪) আসা সব থেকে কম বয়সী শিশু ছিল সৌরভ। সৌরভের বাড়ি জামালপুর জেলার সদর উপজেলার বলমুই পাড়া গ্রামে। সৌরভ যখন অরকা হোমসে তখন বয়স মাত্র ছয় বছর। সৌরভের বয়স এখন ১৭। সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছয় বছর বয়সে আসা শিশু সৌরভের তখনকার কোনো কিছুই মনে পড়ে না। তবে, বড় হওয়ার সাথে সাথে সবই জেনে গেছে সৌরভ। প্রতিবছরই পড়ে পত্রিকার পাতায়, দেখে টেলিভিশনে। হতে হয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি। মনে না থাকলেও যেন আজকের এই দিনে সৌরভকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দেন গণমাধ্যমকর্মীরাই।
একান্ত সাক্ষাৎকারে নিউজবাংলার গাইবান্ধার এই প্রতিবেদককে সৌরভ জানায়, তারা বাবা বাদশা মিয়া কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় তার মা কল্পনা বেগম সাভাবের একটি পোশাক শ্রমিকের কাজ নেয়। তার মা ওই ভবনের তিন তলায় পোশাক কারখানার অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান তিনি। এরপর এতিম সৌরভের জায়গা হয় গাইবান্ধার অরকা হোমসে।
সৌরভ বলে, ‘শুনেছি আমার যখন ছয় বছর; তখন মা রানা প্লাজায় মারা যায়। ধ্বংসযজ্ঞের ১৬ দিন পর মাকে খুঁজে পায় বাবা-ভাই ও আমার স্বজনরা। তখন নাকি মায়ের দেহ গলে পঁচে গেছিলো, কিন্তু তার গলায় থাকা পোশাক কারখানার আইডি কার্ড দেখে বাবা-মাকে চিনে নেয়।’
সৌরভ বলে, ‘মায়ের আয় করা টাকায় আমাদের পরিবার চলত। মা চলে যাওয়ার পর আমাদের ভালো চলছিল না। পরে এখানে রেখে যায় বাবা। একমাত্র বড় ভাই বিয়ে করে সংসার করছে। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। এখন খোঁজ-খবর রাখছে বয়স্ক (বৃদ্ধ) দাদা। এখানে আমি ভাল আছি।’
মাকে মনে পড়ে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ বলে, ‘সব সয়ে গেছে। ছয় বছরের শিশু থাকতেই আমি মাকে হারিয়েছি তো, এখন খুব একটা কষ্ট হয় না! তবে, প্রতিবছর এই দিনটি আসলে সাংবাদিক এবং বিভিন্নভাবে মায়ের কথা মনে পড়ে।’
কোনো স্বপ্ন আছে- এমন প্রশ্নে সৌরভ বলে, বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। আর শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে আমার মা জীবন দিয়েছেন। একটা মা হারা শিশুর আশ্রয় হয়েছে অরকা হোমসে। আমিও এরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখি। যেখানে অসহায়-এতিম ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও আমাদের মতো গরীব ঘরের সন্তানেরা বিনা টাকায় খেয়ে- থেকে পড়া লেখা করতে পারেব। তারাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে। এভাবেই দেশটি একদিন সহযোগিতার হাতেই পূর্ণ হবে। হয়তো তখন কেনো মাকে শ্রমিকের কাজে গিয়ে জীবন দিতে হবে না।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারি ম্যানেজার মিল্লাত মন্ডল। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় (২০১৪) থেকেই অরকা হোমসে আছেন। পরে সৌরভকে নিয়ে কথা হয় তার সাথে।
সৌরভের সম্পর্কে জানতে চাইলে স্মৃতিচারণ করে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, ২০১৪ সালে সৌরভ যখন এখানে আসে তখন ওর বয়স ছয় বছর। তখন এটি এতো প্রসারিত ছিল না, ছিল না জনবলও। ও এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে আসার পর টানা এক মাসেরর বেশি সময় ধরে সৌরভ প্রায় সার্বক্ষণিক মায়ের জন্য, বাড়ির জন্য কেঁদেছে। ওকে আমরা সবাই অনেক স্নেহে মানুষ করেছি। কারণ, সব থেকে ছোট এবং কম বয়সের ছিল সেদিনের মা হারা শিশু এই সৌরভ।
তিনি আরও বলেন, মা হারা সৌরভ অনেক ভদ্র এবং নম্র। সৌরভ প্রচণ্ড মেধাবী। এখানে আসার পর পড়া-লেখা শুরু হয় সৌরভের। সৌরভ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসেই প্রথম (এক রোল)। আর এবার নবম শ্রেণিতে উঠেছে সৌরভ। সৌরভ জীবনে অনেক বড় হোক।
শুধু সৌরভই নয়, আল আমিন মিয়া, জিয়াদ হোসেন, তাহমিনা আক্তার, বীথিসহ হোমসে আশ্রয় হওয়া সবারই আছে প্রায় একই রকম শোকগাথা ইতিহাস। তবে, এতিম-অসহায় এই শিশুদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করেই চলেছেন অরকা হোমস।
ক্যাম্পাসটি ঘুরে দেখা যায়, প্রকৃতির ছাঁয়াঘেরা অরকা হোমসের পুরো ক্যাম্পাস। এক ক্যাম্পাসের ভেতরেই সকল ভবন। চারতলা ভবনটিতে থাকে ছেলেরা। আর মেয়েরা থাকে তিন তলার দুটি ভবনের একটিতে। এখানে থাকা শিশু-কিশোরের সবাই পড়াশোনা করছে পাশের মুসলিম একাডেমিতে।
এখানে আছে খেলার মাঠ, লাইব্রেরি ও বিনোদনের ব্যবস্থা। এছাড়া তাদের দেখভালের জন্য রয়েছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক, একজন ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, নারী কেয়ারটেকারসহ আটজন। তাদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকজন গৃহশিক্ষকও। রয়েছেন শরীরচর্চার শিক্ষক। ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। নামাজের জন্য ক্যাম্পাসের ভিতরের রয়েছে সুন্দর পাকা মসজিদ।
গাইবান্ধা অরকা হোমসের তত্বাবধায়ক মো. জাহিদুল হক নিউজবাংলকে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধ্বসের পর ২০১৪ সালে মাত্র ৮টি বাচ্চা নিয়ে গাইবান্ধায় অরকা হোমসের যাত্রা শুরু হয়। এখন এখানে বাচ্চা রয়েছে ৫২টি। তার মধ্যে ২১ টি বাচ্চা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বাবা-মা হারানো; বাকিরা এতিম অসহায়। তাদের পড়াশোনা থেকে সবকিছুই আমরা দিচ্ছি। এছাড়া তাদের কর্মসংস্থান এবং মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাও আমাদেরি দায়িত্ব।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন অরকার দেশ-বিদেশে থাকা সদস্যদের আর্থিক সহায়তায়ই মূলত হোমসের ব্যয় মেটানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিজিএমইএ প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক অনুদান দিয়ে আসছে।’
তবে, সম্প্রতি তারা (বিজিএমইএ) সেই সহযোগিতা করতে গরিমসি করছেন বলে অভিযোগ ছিল তত্ত্বাবধায়কের।
প্রান্তিক জনগণের যাতায়াত সুবিধা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর ওপর ৩৬৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়। তবে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে আসছে না সরকারের ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি। সেতুর দুই পাশে সংযোগ সড়কের অভাবে দুই বছর ধরে কালীগঙ্গায় ঠাঁই দাড়িয়ে আছে সেটি।
উপজেলা এলজিইডি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঘিওরের সিংজুরী ইউনিয়নের বৈকুণ্ঠপুর কালীগঙ্গা নদীর ওপর ৩৬৫ মিটার দৈর্ঘের সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডারস এবং মেসার্স কহিনুর এন্টাইপ্রাইজ। সংযোগ সড়ক ছাড়াই ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
এরপর সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত। প্রথমার্ধে সেতু নির্মাণের ব্যয় ৩০ কোটি থাকলেও পরবর্তীতে সংযোগ সড়ক ও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের আরও পাঁচ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এরপর সেতু ও সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় উন্নয়নকাজের ব্যয় ধরা হয় ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ৪৫৪ হাজার টাকা। তবে সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় বাড়ানো হলেও নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যবহারোপযোগী হয়নি সেতুটি।
স্থানীয় মির্জাপুর এলাকার কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ দেখে ভাবছিলাম, আমাদের দীর্ঘ দিনের কষ্ট দূর হবে, কিন্তু ব্রিজের দুই পাশে রাস্তা না থাকায় আমরা কেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারি না। আগের মতো নৌকায় করেই খেতের ফসল আনতে হচ্ছে। আমাগো মনের আশা মনেই রইল। তাহলে সরকার এত টাকা দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করল কেন?’
আরেক কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সেতুর পাশে আমার দেড় শতাংশ কৃষিজমি আছে। সেতুর রাস্তার জন্য আমার জমি নিতে চাইছে। এলাকার মানুষের ভালোর জন্য আমার জমি দিতে চাইছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে খালি শুনতেছি, আমাগো জমি অধিগ্রহণ করা হবে, কিন্তু জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় জমিতে আগের মতো ইরি ধানের আবাদ করছি।’
স্থানীয় বালিয়াবাধা এলাকার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণের পর একদিনের জন্যও কেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারে নাই। সেতুটি ব্যবহার করতে পারলে সেতুর আশপাশের অন্তত ৫০টি গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো।
‘সেতুটি ব্যবহারের উপযোগী না হওয়ায় আমাদের ও আশপাশের এলাকার মানুষকে ১৫ কিলোমিটার ঘুরে জেলা শহরে যেতে হচ্ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেতুটি ব্যবহারের উপযোগী করবে সরকার।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মাসুদ মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণের পর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার জমির মালিকদের বাধার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ করতে হয়েছে। এখন সংযোগ সড়কের জায়গা বুঝে পেলেই আমরা কাজ শুরু করব। আর সংযোগ সড়কের কাজ করতে আমাদের সময় লাগবে ৪-৫ মাস। আমরা যত দ্রুত পারব, তত দ্রুত কাজ শুরু করব।’
এ বিষয়ে ঘিওর উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই ভূমি জটিলতা কেটে যাবে এবং সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজন সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য খোঁজ খবর নিচ্ছে।’
ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে মানিকগঞ্জ ডেপুটি রেভিনিউ কালেক্টর এল এ শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মামুনুর রশিদ বলেন, ‘সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ৪.৯৬ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। ইতোমধ্যে ভূমি মালিকদের ৭ ধারা নোটিশ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে খুব দ্রুত ভূমির মালিকদের তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।’
আরও পড়ুন:অন্ধকার ঘরে চৌকির ওপর বসে আছে ১৫ বছর বয়সী রিয়াজ। গলায় শেকল পরিয়ে ঝুলানো বড় তালা। শেকলের অন্য প্রাপ্ত চৌকির সঙ্গে প্যাঁচানো। কোনোভাবে যেন শেকল খুলে বা চৌকি ভেঙে বাইরে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করেছে পরিবারের সদস্যরা।
দীর্ঘ তিন বছর ধরে এভাবেই শেকলবন্দি রিয়াজ। মাঝে-মধ্যে বাবা ও মায়ের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার সুযোগ মিললেও ছাড়া মেলে না এই কিশোরের।
ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে মা নার্গিস খাতুন ও বাবা লিটন হোসেনের সঙ্গে এভাবেই দিন কাটছে ছেলেটির।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সাত বছর আগে শহরের আরাপপুর এলাকায় থাকা অবস্থায় কিছু বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে চুরি করা শুরু করে রিয়াজ। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই চুরি করে সে। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে শহরসহ আশপাশের জেলাতে গিয়েও সে চুরি করেছে।
চুরি করা অনেকটা নেশার মতো রিয়াজের কাছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ ওকে বাড়িতে দিয়ে গেলেও তার চুরি বন্ধ হয়নি। নানা স্থান থেকে একের পর এক অভিযোগ পেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন বাবা-মা। উপায়ান্তর না পেয়ে সন্তানকে শেকলে তালাবদ্ধ করে রাখা শুরু করেন তারা। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ তিনটি বছর। তারপরও সুযোগ পেলেই পালিয়ে যায় রিয়াজ। আবারও জড়িয়ে পড়ে চুরি ঘটনায়।
লিটন হোসেন বলেন, ‘রিয়াজ সুযোগ পেলেই চুরি করে। চুরি করাটা যেন ওর নেশা। উপায় না পেয়ে বাবা হয়েও তিন বছর ধরে সন্তানকে গলায় শেকল পরিয়ে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছি। কী করব বলেন! যেখানে যায় সেখান থেকেই চুরি করে।
‘আমরা উপায় না পেয়ে বেঁধে রেখেছি। কতবার পুলিশ এসে বাড়িতে দিয়ে গেছে। কত ডাক্তার দেখিয়েছি, কোনো সমাধান হচ্ছে না।’
মা নার্গিস খাতুন বলেন, ‘আমার দুটি সন্তান। বড় সন্তান মেয়ে। ছেলেকে এভাবে রাখতে আমার খুব খুবই কষ্ট। আমি কিচ্ছু চাই না। শুধু চাই ও পড়াশোনা করুক। অন্য ছেলেদের মতো খেলা করুক, ঘুরে বেড়াক।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক কোনো সমস্যার কারণে রিয়াজ এমন কাজ বার বার করছে। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা দিলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘কয়েকটি কারণে শিশু রিয়াজ একই কাজ বার বার করছে। পরিবারে যদি এমন কেউ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকত তাহলে এমনটা হতে পারে।
‘ওর মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেও এমনটা হতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি মোটিভেশন দিলে ছেলেটির এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।’
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রতি বছর ঈদ, পহেলা বৈশাখ ও সাংগ্রাই উৎসব ঘিরে ব্যাপক পর্যটকের সমাগম হয়। বছর ঘুরে এসব উৎসব এলেও এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। বিশেষত জেলার রুমা ও থানচিতে পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। হোটেল-রিসোট পড়ে থাকছে ফাঁকা। দেখা মিলছে না দেশি-বিদেশি পর্যটকের।
সম্প্রতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর পর্যটন খাতে কালো ছায়া পড়েছে। ভয়ে ও আতঙ্কে পর্যটকরা আগে থেকে করে রাখা বুকিং বাতিল করছেন। ফলে ভরা মৌসুমেও লোকসানের মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসা-সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম বান্দরবান। জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ। ইতোমধ্যে এসব স্পটের খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থানচির অবস্থান। আর রোয়াংছড়ি ২০ কিলোমিটার ও রুমার দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার।
বান্দরবান-থানচি সড়কের মাঝামাঝি জীবননগর নামক স্থানে রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট নীলগিরি। নীল দিগন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ম্রো অধ্যুষিত।
থানচি-আলিকদম সংযোগ সড়কে থানচি সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ক্রাউডং (মারমা) ডিম পাহাড় (বাংলা)। নৌপথে সাংগু নদী বেয়ে তিন্দু ইউনিয়নে রয়েছে রাজা পাথর (বাংলা)।
এরপর রয়েছে রেমাক্রী খাল। জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের রোয়াংছড়ি উপজেলার শীলবাঁধা পাড়ায় দেবতাখুমের অবস্থান। এছাড়াও রয়েছে অনেক পর্যটন স্পট।
বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত প্রাকৃতিক হ্রদ হলো বগা লেক। রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে তিন হাজার সাতশ’ ফুট উচুঁতে এর অবস্থান। লেকটি পাহাড় চূড়ায় ১৫ হাজার একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
বগা লেক নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হল বিজয় (তাজিং ডং)। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ৫শ’ ফুট। রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে এর অবস্থান।
রুমা উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। শীত মৌসুমে এই পর্বত দেখতে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে।
এছাড়াও রয়েছে কেওকারাডং, জলপ্রপাতের পানি ঝিরসহ অনেক পর্যটন স্পট। আবার জেলার থানচিতে পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে নাফাখুম ঝরনা, আমিয়াখুং ঝরনা, ভেলাখুং ঝরনা, সাত ভাই খুং ঝরনা, লাংলুক ঝরনা, লৈক্ষ্যং ঝরনা, চিংড়িৎ ঝরনা।
প্রকৃতি এতোসব সম্ভার সাজিয়ে বসে আছে। কিন্তু তা দেখার জন্য পর্যটকের আগমন ঘটছে না। সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভয় আর আতঙ্কে তারা পার্বত্য এসব পর্যটন স্পট এড়িয়ে চলছেন।
পর্যটন-সংশ্লিষ্টরা জানান, বান্দরবান জেলায় পর্যটকদের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায়। বিরাজমান পরিস্থিতিতে এই তিন উপজেলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। ফলে এসব দর্শনীয় স্থানে যাতায়াত করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন পর্যটকরা। অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ। যানবাহন চলাচলও সীমিত। সন্ধ্যার আগেই লোকজন ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে।
রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ চলে গেল। এসব উৎসবের ছুটিতে এখানে হোটেল-মোটেলের শতভাগ রুম বুকিং হওয়ার কথা। কিন্তু এবার সেসবের কিছুই হয়নি।
হঠাৎ করে ২ এপ্রিল রাতে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরদিন দুপুরে থানচি সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে অস্থির হয়ে পড়েছে বান্দরবান।
কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। আর এই খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে ভয়-আতঙ্কে মুখ ফিরিয়ে নেয় পর্যটকরা। অথচ এই সময়টাতে থানচি রেমাক্রীতে হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম হওয়ার কথা ছিল।
পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, পর্যটক না আসার কারণে এই ঈদ মৌসুমে তাদেরকে লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনতে হবে।
নৌকার এক মাঝি জানান, থানচিতে পর্যটকের ছুটে চলার একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। এখানে নৌকার সংখ্যা রয়েছে পাঁচ শতাধিক। আর এসব নৌকা চালানোর জন্য সমসংখ্যক মাঝি রয়েছেন। তাদের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটক। নৌকা চালাতে পারলে সংসারের চাকা ঘুরবে, অন্যথায় উপোস থাকতে হবে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারা দিনশেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন।
থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন বলেন, ‘সরকারিভাবে পর্যটকদের এই এলাকা ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। তবে এমন পরিস্থিতি শোনার পর আর কেউ এখানে ঘুরতে আসবে বলে মনেও হয় না। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিটরা অনেক কষ্ট ও লোকসানে পড়বে বোঝা যাচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কেএনএফ-এর শতাধিক অস্ত্রধারী ২ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুমা উপজেলার ইউএনও অফিস সংলগ্ন মসজিদ ও ব্যাংক ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকের টাকাসহ ডিউটিরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা যাওয়ার সময় রুমা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকেও অপহরণ করে। পরদিন থানচি উপজেলা শহরের সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয়।
যৌথ অভিযান চালিয়ে সোনালী ব্যাংকের অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব ও সেনাবাহিনী। এরপর কেএনএফের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এসব ঘটনায় আটটি মামলা করে পুলিশ। ঘটনার পরপরই জড়িতদের ধরতে এবং সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ৬ এপ্রিল যৌথ বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। দুদিনের অভিযানে ১৮ নারীসহ ৫৬ জনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। বাকি সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন:প্রথমে প্রবাস ফেরত ও টাকাওয়ালা ব্যক্তিদের টার্গেট, পরে তাদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে নারী দিয়ে প্রেমের ফাঁদ পেতে ডেকে আনেন ডেটিংয়ের জন্য। প্রস্তাবিত স্থানে আগে থেকেই তৈরি থাকেন চক্রের সদস্যরা। ওই ব্যক্তি পৌঁছানোমাত্র তাকে আটকে রেখে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দাবি করেন।
চাঁদা না পেলে মারপিটসহ জোরপূর্বক নকল বিয়ে দেন কাজী ডেকে। দেনমোহর ধার্য করেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। পরে ডিভোর্সের নামে সেই দেনমোহরের টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এমনই প্রতারক চক্রের সন্ধান মিলেছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে চাম্বলতলা গ্রামে।
গত ২১ মার্চ এই চক্রের সদস্যদের কাছে প্রতারণার শিকার হন ঘাটাইল উপজেলার রহমতখাঁর বাইদ গ্রামের দুলাল মন্ডলের প্রবাস ফেরত ছেলে নাজমুল ইসলাম। এরপর বিচার চেয়ে তিনি টাঙ্গাইল আদালতে কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন।
আসামিরা হলেন- মো. জাহিদুল হাসান জাহিদ, সৌরভ তালুকদার, হুমায়ুন সিকদার রানা, বাবুল হোসেন, মো. জুয়েল, রিজান, সুজন, রায়হান, কাজী মো. তাহেরুল ইসলাম তাহের ও রাশেদা বেগম।
মামলার বিবরণে জানা যায়, পাঁচ মাস আগে দেশে ফেরেন নাজমুল ইসলাম। গত ২১ মার্চ চাম্বলতলা গ্রামের আবু তালুকদারের বাড়িতে তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে যান তিনি। সেখানে খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ৯টার দিকে সৌরভ তালুকদারের মাধ্যমে নাজমুলকে ডেকে নিয়ে নাজিম উদ্দিনের বাড়ির উত্তর পাশের গজারী বাগানে নিয়ে যান জাহিদুল। সেখানে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তারা। চাঁদা না দিলে নাজিম উদ্দিনের নাবালিকা মেয়ে সুমাইয়ার সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়।
সে সময় টাকা দিতে অস্বীকার করায় ব্যাপক মারধরের শিকার হন নাজমুল। পরে তারা কয়েকটি কার্টিজ পেপারে খুনের ভয় দেখিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তার স্বাক্ষর নেন এবং সুমাইয়াকে কাবিন ছাড়াই বিবাহের নামে নাজমুলের বাড়িতে জোরপূর্বক তুলে দেন। এমনকি পরবর্তীতে ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করলে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়।
তবে মুক্তি পেয়ে আদালতে মামলা করেন বলে নিউজবাংলাকে জানান নাজমুল।
ঘটনার বিষয়ে সুমাইয়া জানায়, সে নাজমুলকে চিনত না। জাহিদুল তার দুঃসম্পর্কের মামা হয়। জাহিদুলের কথায় সে এমনটি করেছে। প্রথমে সে রাজি না হওয়ায় তাকে মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ তার।
স্থানীয়দের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রটি এমন প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা নারীদের ব্যবহার করছে। আর স্থানীয় কাজীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।
এদিকে জানতে চাইলে ওই বিয়ে পড়ানোর কথা অস্বীকার করেন কাজী তাহেরুল ইসলাম তাহের। জানান, এ ধরনের বিয়ে তিনি পড়াননি। তবে তাকে ডেকে নেয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে ঘাটাইল থানার ওসি আব্দুস ছালাম মিয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য