ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি আয়োজিত গবেষণা ও প্রকাশনা মেলায় রসায়ন বিভাগের স্টলের একটি পোস্টার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হোসাইন ওই পোস্টারে দেখিয়েছেন, মানব কঙ্কালের সঙ্গে আরবি বেশ কিছু হরফের মিল রয়েছে। এসব হরফ ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং আল্লাহ লিখতে ব্যবহৃত হয়।
গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকেরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীদেহের হাড়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়ে বিভিন্ন ভাষার হরফের সঙ্গে মেলানো সম্ভব। এ কারণে এ ধরনের বিশ্লেষণ অযৌক্তিক। আর মেলার আয়োজকেরা বলছেন, ওই পোস্টারটির বিষয়বস্তু তাদের জানা ছিল না। সমালোচনার পরপরই সেটি সরিয়ে ফলা হয়।
অধ্যাপক আবুল হোসাইন বলছেন, বিষয়টি কোনো গবেষণালব্ধ জ্ঞান বা ফাইন্ডিংস নয়। মানব কঙ্কাল নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে রিভিউ আর্টিকেল লিখেছেন, পরে সেটি পিয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরিচালিত ইউএসজিএস ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পিয়ার রিভিউড প্রকাশনাকে কখনও কখনও একটি পাণ্ডিত্বপূর্ণ প্রকাশনা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। কোনো লেখকের পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ, গবেষণা বা ধারণাগুলোর বৈজ্ঞানিক গুণমান নিশ্চিত করার জন্য একই বিষয়ের অন্য বিশেষজ্ঞরা এর খুঁটিনাটি দিক যাচাইবাছাই করে অভিমত দেন।
অধ্যাপক আবুল হোসাইনের আর্টিকেলটি ‘সিগনিফিক্যান্স অফ দ্যা স্ট্রাকচার অফ হিউম্যান স্কেলটন’ শিরোনামে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রকাশ করে আমেরিকান জার্নাল অফ মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন। এটি বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি পিয়ার রিভিউ জার্নাল।
রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হয়ে মানব কঙ্কাল পর্যবেক্ষণের কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক আবুল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ফিল্ড রসায়ন। ২০১৬ সালে ড্রাগ নিয়ে কাজ শুরু করি। এই ড্রাগ যেহেতু মানুষের বডিতে কাজ করবে তাই বডির বিভিন্ন সাইজ জানা দরকার ছিল। সেটার জন্য আমি অ্যানাটমি বই পড়েছি। সেটার কেমিক্যাল কম্পোজিশন জানতে বিভিন্ন বই পড়তে হয়েছে।
‘এ কাজ করতে গিয়ে দেখলাম মানুষের বডির ফান্ডামেন্টাল যে অরগান স্কেলিটন (কঙ্কাল) অনেকটা আরবি অক্ষরের সঙ্গে মিলে যায়। আমি মূল গবেষণার কাজ করতে গিয়ে অ্যানাটমি-সম্পর্কিতসহ বিভিন্ন বই পড়েছি। সব বই তো আর সব সময় পড়ব না, তাই বইগুলোর কোথায় কী পেয়েছি সেটা লিখে সবগুলোর একটা সামারি আমি প্রকাশ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমার রসায়নের ফান্ডামেন্টাল গবেষণা আর্টিকেল নয়। এটা একটা রিভিউ আর্টিকেল। আমার সাবজেক্টে কাজ করতে গিয়ে এটা একটা সাইড প্রোডাক্ট।
‘এটা আমি রিভিউ আর্টিকেল হিসেবে মেলায় পোস্টার আকারে শো করেছি। এরপর বিভাগ থেকে যখন বলা হয়েছে এটা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তখন সরিয়ে নিয়েছি।’
অধ্যাপক হোসাইন বলেন, ‘মেলায় আমার যে পোস্টার ছিল সেখানে তিনটা পার্ট ছিল। একটা ছিল সারফেস ক্যামিস্ট্রি, আরেকটা ন্যানো ক্যামিস্ট্রি আরেকটা ছিল ইন্টার ডিসিপ্লিন সায়েন্স অ্যান্ড রিলিজিয়ন নিয়ে। যেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে সেটা ছিল সবশেষ ক্যাটাগরির মধ্যে।
‘এটা কারও পছন্দ হতে পারে বা না হতে পারে। কারও বিশ্বাসের ওপর আঘাত করার কোনো ইন্টেনশন আমার ছিল না।’
অধ্যাপক আবুল হোসাইন রিভিউ আর্টিকেলটি প্রকাশের জন্য ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি জমা দেন। এরপর পর্যালোচনা শেষে ১৬ জানুয়ারি সেটি প্রকাশ করা হয়।
অধ্যাপক হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আর্টিকেল পাবলিশের পর অনেক মুসলমান এবং আমার শ্বশুর বলেন আরও অনুসন্ধান করতে। এরপর আমি কোরআন-হাদিস নিয়ে বিভিন্ন স্টাডি করি। ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনা আছে এ রকম বেশ কিছু গবেষকের সাহায্যও নিই।
‘এসব করে দেখেছি, কোরআন শরিফের সুরা তীনের একটা আয়াতের সঙ্গে এটার কিছুটা মিল আছে। এরপর আমি ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন লেখাপড়া করে ধর্মের সঙ্গে এটার কোনো লিংক আছে কি না, সেটি দেখার চেষ্টা করেছি। আর এসব নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার একটি জার্নালেও আর্টিকেল সাবমিট করি।’
ইন্দোনেশিয়ার সেই জার্নালটির নাম ‘আর রানিরি: ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ইসলামিক স্টাডিজ।’ এই জার্নালে অধ্যাপক হোসাইনের নিবন্ধটি ২০১৮ সালের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক আবুল হোসাইন বলেন, ‘এটাও রিভিউ আর্টিকেল ছিল। কারণ আমি এখানে তো কোনো ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট করিনি। কোরআন আর হাদিসের বিভিন্ন অংশকে আমি ব্যাখ্যা করেছি। তবে হালকা কিছু থিউরিটিক্যাল গবেষণা ছিল।’
আর রানিরি জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলে অধ্যাপক হোসাইন দাবি করেছেন, মানুষের কঙ্কালের প্রধান অংশ মাথার খুলির সঙ্গে কোরআনে বর্ণিত তিন ফল অর্থাৎ জলপাইয়ের গঠনের মিল আছে। আর এটি আরবি হরফ ‘মিম’-এর মতো।
তিনি বলছেন, মানুষের বুকের পাঁজরের সঙ্গে সিনাই পর্বতের গঠনের মিল আছে। এটি আরবি হরফ ‘হা’-এর মতো। কোমরের সঙ্গে আছে ডুমুর ফলের মিল, যা আরবি হরফ ‘মিম’-এর মতো।
মানুষের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মক্কা নগরীর মিল আছে। এটি আরবি হরফ ‘দাল’-এর মতো। আর এসব হরফের সমন্বয়ে মুহাম্মদ (সা.) নামটি লেখা হয়।
অধ্যাপক আবুল হোসাইন মনে করছেন, মানুষের হাতের পাঁচ আঙুলের গঠনটি আলিফ, লাম, লাম এবং হা এর সদৃশ। এসব হরফের সমন্বয়ে আল্লাহ লেখা হয়।
অধ্যাপক হোসাইন বলেন, ‘আমি রসায়নে কাজ করি বলে কি অন্য কোনো ফিল্ডে কাজ করতে পারব না? রসায়নের অনেক অধ্যাপক পদার্থবিজ্ঞান বা ম্যাথ ফিল্ডেও তো কাজ করেন। আবার ইন্টার ডিসিপ্লিন ফিল্ডেও কাজ করেন।’
কঙ্কালকে ধর্মের সঙ্গে মেলানোয় বিস্ময়
অধ্যাপক আবুল হোসাইনের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রাণিবিদ্যার বিশেষজ্ঞরাও এ ধরনের পর্যবেক্ষণে বিস্ময় প্রকাশ করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নিয়ামুল নাসের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ একজন অন্ধের মতো কথা বললে তো হয় না। আমার কাছে মনে হয় এগুলো একটা সিস্টেম, শুধু মানব কঙ্কাল কেন, যেকোনো প্রাণীর কঙ্কালের ডিজাইন কাছাকাছি। এই ডিজাইনের মধ্যে ধর্মকে নিয়ে এলে কী ঠিক হবে? এসব কথাবার্তা আমাদের মূর্খতার পরিচয় হবে।’
একজন প্রাণিবিজ্ঞানীর অবস্থান থেকে অধ্যাপক নিয়ামুল বলেন, ‘আমরা ওইভাবে (ধর্মের আলোকে কঙ্কালকে ব্যাখ্যা) দেখি না। আমরা একটি প্রাণীর দিকে দেখি। প্রাণীটাকে রক্ষা করার জন্য যা করা দরকার সেটা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করি, সেটাই আমাদের গবেষণা।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কোন কঙ্কাল কার মতো দেখতে সেগুলো নিয়ে বলার সময় আমাদের থাকে না। কঙ্কালের মধ্যে আমরা আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে নিয়ে আসতে পারি না। কঙ্কাল নিজস্ব সিস্টেমে তৈরি। মানব কঙ্কালের মতো আরও অনেক প্রাণীর কঙ্কাল আছে। সেখানে এটা দেখা গেছে, অমুক হরফ দেখা গেছে- এটা তো বলা যায় না।
‘ওইভাবে খুঁজতে গেলে তো অনেক ভাষার অক্ষরই দেখতে পাব। আমাদের ভাষায় হোক, অন্য ভাষায় হোক, কোনো না কোনো ভাষার সঙ্গে তো মিলবে। আমরা তো আসলে এগিয়ে যাচ্ছি, পেছন দিকে ফেরত যাওয়া কী ঠিক হবে?’
তিনি বলেন, ‘ধর্ম তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সেখানে কেন আমি এটাকে এই ছোট জিনিসের মধ্যে নিয়ে আসব?’
মেলা সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ২১ ও ২২ অক্টোবর আয়োজিত হয় গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা।
সেখানে রসায়ন বিভাগের স্টলের জন্য পোস্টার নির্ধারণ কোন প্রক্রিয়ায় হয়েছে জানতে চাইলে বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহিদা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা কমিটি গঠন করে তাড়াহুড়ো করে দেয়া হয়েছে। আর পোস্টারে এমন কিছু ছিল না যে এত তোলপাড় করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশড প্রকাশনাগুলো দেয়া হয়েছে। পোস্টারের জন্য একটা কমিটি করে দেয়া হয়েছিল । তারাই এটি করেছে।’
অধ্যাপক হোসাইনের আলোচিত পোস্টারের ব্যাপারে বিভাগ জানত কি না, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘তিনি (অধ্যাপক হোসাইন) সেভাবে আমাদের শো করে… এমনি একটা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। তবে কে কোনটা দিচ্ছে সেটা অত... (যাচাই) করা হয়নি। তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছিল তো তাই।’
গবেষণা মেলায় রসায়ন বিভাগের স্টল নিয়ে বিভাগটির অ্যাকাডেমিক কমিটি বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করে। এর একটি হলো কো-অর্ডিনেট কমিটি।
এই কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আবু বিন হাসান সুশান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় গবেষণাকর্ম প্রদর্শনের জন্য অ্যাকাডেমিক কমিটির সভায় সব শিক্ষকের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়। ২৫ জন শিক্ষক তাদের গবেষণার পোস্টার দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে কর্তৃপক্ষ জানায় ২৫টা দেওয়া যাবে না। পরে আমরা ১২টা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
‘এরপর প্রশ্ন ওঠে এই ১২টা কারা দেবে। তখন বলা হয়েছে শতবর্ষ উপলক্ষে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া গ্র্যান্ট যারা পেয়েছেন তাদের দিতে হবে। তারা দেয়ার পর কোনো পোস্টারের স্ট্যান্ড খালি থাকলে কেউ সেকেন্ড পোস্টার বা বাকিরা দিতে পারবেন।’
ড. সুশান বলেন, ‘সেই গ্র্যান্ট আবুল হোসাইনও পেয়েছেন। বলা হয়েছে, রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে কে কোনটা দেবে সেটা তার নিজের রেসপন্সবিলিটি। অধ্যাপক আবুল হোসাইনও দিয়েছেন। পরে তিনি যখন একাধিক পোস্টার দিতে চেয়েছেন তাকে বলা হয়েছে কোনো স্ট্যান্ড ফাঁকা থাকলে দিতে পারেন।
‘এরপরই মূলত মেলায় একটা স্ট্যান্ড ফাঁকা দেখে তিনি ওই পোস্টারটি ঝুলিয়েছেন। তবে সমালোচনা শুরু হলে ওনারটা সরিয়ে আরেক অধ্যাপকের পোস্টার দেয়া হয়।’
অধ্যাপক সুশান বলেন, ‘মেলায় বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বই প্ল্যাকার্ড ছাপানো হয়েছে। এগুলোর ভেতর বিভাগের ইতিহাস, অর্জন এবং ভবিষ্যতের তথ্য গেছে। এসব কনটেন্ট বাছাইয়ে একটা কমিটি ছিল। সেগুলো চেক করা হয়েছে। তবে আসলে বিশ্বের কোথাও পোস্টার আগে চেক করে ডিসপ্লে করা হয় না। এটা প্রেজেন্টারের নিজস্ব রেসপন্সবিলিটি।’
অধ্যাপক হোসাইন এমন কোনো কাজ করছেন বলেও কারও জানা ছিল না দাবি করে অধ্যাপক সুশান বলেন, ‘আমরা জানি, উনি ক্রোমিয়াম না কী নিয়ে গবেষণা করছেন। সেটা সায়েন্টিফিক। সেটা ডিসপ্লে হয়েছে। কিন্তু এটার ব্যাপারটা সমালোচনা হওয়ার পর পোস্টার দেখে জানতে পেরেছি।
‘ব্যক্তিগতভাবে ওনার এই পোস্টারটার বিষয়বস্তু আমার লজিক্যাল মনে হয়নি। আমাদের বিভাগে প্রচুর রিসার্চ ফিল্ড আছে, কিন্তু সব বাদ দিয়ে এ রকম একটা বিষয়ে তিনি যে কাজ করেন, সেটা আমরা কেউ জানতাম না। উনিও কখনও জানাননি। আর এটা কোনো রিসার্চ নয়, ওনার থিংকিং হতে পারে। সেটা মেলায় দেয়াটাই প্রাসঙ্গিক ছিল না।’
অধ্যাপক আবুল হোসাইনের পোস্টার নিয়ে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুস সামাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় আবুল হোসাইনের এটা ছাড়াও সায়েন্টিফিক একটা গবেষণাকর্ম ছিল। মেলা শুরুর পরে দুপুরে একটায় স্ট্যান্ড খালি পেয়ে তিনি তার ওই পোস্টারটি লাগিয়ে দেন।
‘আমি শুনেছি এটার ব্যাপারে বিভাগ অবহিত ছিল না। সমালোচনা শুরু হওয়ায় বিভাগের দৃষ্টিতে আসে এবং তাকে ডেকে এটি সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করা হয়। পরে তিনি সেটি সরিয়ে ফেলেন।’
আবদুস সামাদ বলেন, ‘তার এই পোস্টারটা মেলায় আসারই কথা না। এটা তো গৃহীত হয়নি। গবেষণা মেলার সঙ্গে এটা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভাগকে বলেছি যেন ওনাকে সতর্ক করা হয়। আর এটা নিয়ে আমরা উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। স্যারও বলেছেন, ওনাকে সতর্ক করা হোক। অনুষদ থেকেও ওনাকে সতর্ক করা হবে, যাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।’
আরও পড়ুন:পোপ হলেন ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ নেতা। ১.৪ বিলিয়ন মানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। যিশুর প্রধান শিষ্য। ফলে আস্থার দিক থেকে খ্রিষ্টান সমাজ ও চার্চে পোপের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ধরা হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে শুধুমাত্র পুরুষকেই বেছে নেওয়া হয়। সেখানে কোনো নারীর জায়গা নেই।
যাজক হিসেবে সবসময়ই পুরুষদের নির্বাচিত করায় বারবারই প্রশ্নের মুখে পড়েছে চার্চ। কয়েক শ বছর থেকেই যাজকের দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন নারীরা। ১২ বছর ধরে রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর প্রয়াত হয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। তার প্রয়াণের পর এবার নতুন করে শুরু হবে পোপ নির্বাচন। তখন নতুন করে উঠেছে প্রশ্নটি।
পোপের মৃত্যু পর বা পদ্যত্যাগ করার পর ১৫-২০ দিন সময় নেয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ। এই সময়ের মধ্যে সারা বিশ্ব থেকে চার্চের সবচেয়ে প্রবীণ কর্মকর্তারা রোমে এসে উপস্থিত হন। তাদের সম্মিলিতভাবে ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’ বলা হয়। ভ্যাটিকান থেকে তাদের কাছে পোপ নির্বাচনে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ আসে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকলকে তাদের পছন্দের ব্যক্তির নাম কাগজে লিখে জানাতে হয়। কঠোর প্রোটোকল অনুসারে, এই নির্বাচনে শুধুমাত্র পুরুষরাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন, কোনো নারী নয়।
পোপ হওয়ার অধিকার থেকে নারীদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি চার্চের দীর্ঘদিনের রীতির সঙ্গে যুক্ত। এই বিষয়টি কেবল পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। ক্যানন আইন (ক্যানন ১০২৪) অনুসারে, শুধুমাত্র দীক্ষিত পুরুষদেরই পোপ হিসেবে নিযুক্ত করা যেতে পারে। আসলে খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস যে প্রভু যীশু কেবল পুরুষদের শিষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, যে নিয়ম ক্যাথলিক চার্চে বহুদিন ধরে চলছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিওন অ্যান্ড পাবলিক পলিসি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর রেভারেন্ড টমাস রিজের মতে, পোপের মতো পদের জন্য অর্ডিনেশন প্রয়োজন এবং নারীদের পুরোহিত হওয়ার অনুমতি নেই।
একবার প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসকে প্রশ্ন করা হয়, নারীরা কি কখনো পোপ হতে পারবেন না? উত্তরে পোপ বলেন, আপনি যদি সেইন্ট দ্বিতীয় জন পলের ঘোষণা ভালোভাবে পড়ে থাকেন তাহলে সেই নির্দেশনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। নারীরা অন্য অনেক কাজে পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো করতে পারেন। তবে পোপ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ওপর বিধিনিষেধ আছে।
ইতিহাসের দিক থেকে, পোপ হওয়ার মানদণ্ড মতবাদের পরিবর্তে নজিরের ওপর ভিত্তি করে। ১৪৫৫ সালে পোপ ক্যালিক্সটাস তৃতীয় ছিলেন পোপ নির্বাচিত হওয়া শেষ অ-পুরোহিত এবং ১৩৭৮ সালে আরবান ষষ্ঠ ছিলেন শেষ অ-কার্ডিনাল পুরোহিত যাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল।
ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, যিশুখ্রিষ্ট ১২ জন পুরুষকে তার শিষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। যারা পরে তাদের পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যান্য পুরুষদের বেছে নিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, চার্চ এই পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। ঠিক সেই কারণেই নারীরা কখনো যাজক হতে পারে না।
পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর বৃহস্পতিবার। এর অর্থ ‘অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত’ বা ‘পবিত্র রজনী’।
আজ সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হবে কদরের রজনী।
যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সারা দেশে রাতটি পালন করা হবে।
মহান আল্লাহ লাইলাতুল কদরের রাতকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন। হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও এ রাতের ইবাদত উত্তম।
এ রাতে আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষণ করা হয়। নির্ধারণ করা হয় মানবজাতির ভাগ্য।
৬১০ সালে কদরের রাতেই মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে সর্বপ্রথম সুরা আলাকের পাঁচ আয়াত নাজিল হয়। এরপর আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর বহনকৃত ওহির মাধ্যমে পরবর্তী ২৩ বছর ধরে মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে বিভিন্ন সুরা নাজিল করা হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
‘শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত। (সূরা আল- কদর, আয়াত ১-৫)।’
হাদিসে বর্ণিত আছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে লাইলাতুল কদর সন্ধান করো (বুখারি ও মুসলিম)।’
মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পবিত্র রাতটি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে দেন। কামনা করেন মহান রবের অসীম রহমত, নাজাত, বরকত ও মাগফিরাত।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ রাত থেকে পরের দিন ভোররাত পর্যন্ত মসজিদসহ বাসা-বাড়িতে এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসকার, দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত করবেন তারা।
এই উপলক্ষে শুক্রবার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের সব মসজিদেই তারাবির নামাজের পর থেকে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন থাকবে।
পবিত্র লাইলাতুল কদর/শবে কদর উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি রেডিওগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
এ ছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সুস্থতায় দেশবাসী যেমন চরম আনন্দ পেয়েছে, তেমনই তাদের অনেকে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। এতদিন দেশের মানুষের বিশাল অংশের একটি ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসক নেই। কিন্তু তামিম ইকবাল যখন বুকে ব্যথা অনুভব করেন, তখন দুই ঘণ্টার মধ্যেই এনজিওগ্রাম, হার্টে স্টেন্ট তথা রিং বসানোসহ সবকিছু হয়ে যায়।
তামিম দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। তাই তার চিকিৎসায় বিলম্ব হয়নি। এই যে দ্রুত গতিতে চিকিৎসাসেবা পাওয়া, সেটি তার জন্য করুণা নয়; বরং ন্যায্য পাওনা।
আকস্মিক অসুস্থতায় মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার পর তামিমের দ্রুত চিকিৎসা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ঘটনাটি সমাজে ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্যকেও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা এত সুন্দর বা সহজ নয়। ভর্তির ফরম পূরণ, সিরিয়ালের অপেক্ষা, হাসপাতালের করিডোরে দীর্ঘ প্রতীক্ষা—আরও কতকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এখানে উন্নত চিকিৎসা পেতে হলে আপনাকে ধনী, জনপ্রিয়ত হতে হবে অথবা আপনার তদবির করার মতো লোক থাকতে হবে। যাদের সেগুলো আছে, তারা ভালো চিকিৎসা পাবে, যাদের নেই তারা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়বেন। ভাগ্য ভালো না হলে বেঘোরে প্রাণটা হারাবেন।
জনগণ তামিমের ঘটনা থেকে জানতে পারল বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই কথাটা ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ছাড়া ভুল। বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা আছে, কিন্তু সেটা সাধারণ জনগণের জন্য সোনার হরিণেরমতো।
আসলে এটি শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, সারা বিশ্বেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুচিকিৎসা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার ৭৪৯ ডলার খরচ করতে হয় স্বাস্থ্যবিমার জন্য। দেশটিতে গত এক দশকে বিমাহীন মানুষের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ বেড়েছে, যা দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
জানলে অনেকে আঁতকে উঠবেন যে, জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর আড়াই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় ভুল চিকিৎসায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অন্য কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। হৃদরোগ ও ক্যানসারে ভুল চিকিৎসার জন্য মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
যদিও ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD) নামে বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণী একটি ফোরাম বলছে, আমেরিকার চেয়ে পৃথিবীর আর কোনো দেশে চিকিৎসা খাতে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না। তবে চিকিৎসায় ব্যয়ের বেশির ভাগ অংশ সরাসরি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নয়, বরং হাসপাতাল নির্মাণ, উন্নয়ন, স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ও ওষুধের উচ্চমূল্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে জনসাধারণ স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পান না।
আমরা যখন একুশ শতকে সামরিকভাবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী রাষ্ট্রের এ চিত্র দেখছি, তখন শত শত বছর আগে ইসলামী ভাবধারার শাসনামলে চিকিৎসা ছিল ধনী-গরিব সবার জন্য সমান। পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডে ইসলামের সোনালি এ দিনগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর আল-মানসুর কালাউনের বিমারিস্তানের (হাসপাতাল) পলিসি স্টেটমেন্টটি দেখলে আপনি হয়তো ফিরে যেতে চাইবেন সেই সময়ে। চলুন দেখে নিই, কী ছিল সেই পলিসি স্টেটমেন্টে।
সেখানে বলা ছিল, ‘হাসপাতাল সকল রোগীকে-পুরুষ ও নারী- সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রাখবে। সব খরচ হাসপাতাল বহন করবে, তা সে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসুক বা নিকটবর্তী এলাকা থেকে, বাসিন্দা হোক বা বিদেশি, সবল হোক বা দুর্বল, উচ্চবিত্ত হোক বা নিম্নবিত্ত, ধনী হোক বা দরিদ্র, কর্মরত হোক বা বেকার, দৃষ্টিহীন হোক বা শারীরিকভাবে সক্ষম, মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ, শিক্ষিত বা নিরক্ষর সবাইকে সমান সেবা দেওয়া হবে।’
এখানে কোনো শর্ত বা অর্থ প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ যদি অর্থ প্রদান করতে না পারত, তাতেও কোনো আপত্তি বা ইঙ্গিত করার সুযোগ ছিল না। সম্পূর্ণ সেবাটি পরম দয়ালু আল্লাহর অনুগ্রহের মাধ্যমে প্রদান করা হতো।
১২৮৪ সালে মিসরের কায়রোতে নির্মিত এই ‘মানসুরি হাসপাতাল’ ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এখানে চারটি বড় আঙিনার কেন্দ্রে জলপ্রপাত ছিল, রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, বহির্বিভাগ, ওষুধ বিতরণ কেন্দ্র এবং শিক্ষার্থীদের জন্য লেকচার হল ছিল।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা শুধু রোগীদের চিকিৎসাই করতেন না, বরং প্রয়োজনে তাদের বাড়িতেও গিয়ে সেবা দিতেন। বিশেষত, জ্বর ওয়ার্ডগুলোকে জলপ্রপাতের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা হতো এবং রোগীদের বিনোদনের জন্য সংগীতশিল্পী ও গল্প বলার ব্যবস্থা ছিল।
বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয় হলো রোগীরা হাসপাতাল থেকে ছাড়ার সময় তাদের হাতে কিছু পরিমাণ অর্থ তুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা আর্থিক সংকটে না পড়ে এবং কাজের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
এবার একটি চমকপ্রদ চিঠি তুলে ধরা হলো, যা দেখলে আপনি অবাক হতে পারেন। আর সেই সঙ্গে ইসলামী শাসনামলের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন।
দশম শতাব্দীতে কর্ডোবার একটি হাসপাতাল থেকে এক তরুণ ফরাসি যুবকের চিঠির কথা আমির গাফার আল-আরশদি কর্তৃক ১৯৯০ সালে বৈরুতের আল-রিসালা এস্টাবলিশমেন্ট থেকে প্রকাশিত The Islamic Scientific Supremacy শীর্ষক গ্রন্থে তুলে ধরা হয়।
চিঠিটির অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো।
‘আপনি আপনার আগের চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, আমার ওষুধের খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাবেন। আমি বলতে চাই, আমার একেবারেই সেই টাকার প্রয়োজন নেই, কারণ এই ইসলামী হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।
‘এ ছাড়াও এ হাসপাতালের আরেকটি চমকপ্রদ দিক হলো—যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাকে হাসপাতাল থেকে একটি নতুন পোশাক এবং পাঁচ দিনার দেওয়া হয়, যাতে তিনি বিশ্রাম ও পুনরুদ্ধারের সময় কাজ করতে বাধ্য না হন। প্রিয় বাবা, আপনি যদি আমাকে দেখতে আসতে চান, তবে আমাকে সার্জারি ও জয়েন্ট চিকিৎসা বিভাগের ওয়ার্ডে পাবেন। ফটক দিয়ে প্রবেশ করার পর দক্ষিণ কক্ষে যান, যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় বিভাগ রয়েছে। এরপর আপনি সন্ধান পাবেন বাত (জয়েন্ট) রোগ বিভাগের।’
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমার কক্ষের পাশে একটি গ্রন্থাগার এবং একটি হলঘর রয়েছে, যেখানে চিকিৎসকরা একত্রিত হয়ে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শোনেন এবং এটি পড়াশোনার জন্যও ব্যবহৃত হয়। হাসপাতালের প্রাঙ্গণের অপর পাশে রয়েছে স্ত্রীরোগ বিভাগের ওয়ার্ড, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। হাসপাতালের আঙিনার ডান দিকে রয়েছে বিশাল একটি হল, যেখানে সুস্থ হওয়া রোগীদের পুনরুদ্ধারের জন্য কিছুদিন রাখা হয়। এই কক্ষে একটি বিশেষ লাইব্রেরি ও কিছু বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে।
‘প্রিয় বাবা, হাসপাতালের প্রতিটি স্থান অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিছানা ও বালিশ দামাস্কাসের সূক্ষ্ম সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকে। কম্বল তৈরি হয় নরম ও মসৃণ প্লাশ কাপড় দিয়ে। প্রতিটি কক্ষে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা আছে, যা পাইপের মাধ্যমে বিশাল একটি ঝরনার সঙ্গে সংযুক্ত। শুধু তাই নয়, প্রতিটি কক্ষে গরম রাখার জন্য চুলাও রয়েছে।
‘খাবারের ব্যবস্থা এত ভালো যে, প্রতিদিন রোগীদের জন্য মুরগির মাংস ও সবজি পরিবেশন করা হয়। এমনকি, অনেক রোগী সুস্থ হয়েও হাসপাতাল ছাড়তে চান না শুধু এখানকার সুস্বাদু খাবারের প্রতি ভালোবাসার কারণে।’
চিকিৎসাব্যবস্থাকে পুঁজিবাদ ও ইসলাম সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চিকিৎসা একটি লাভজনক ব্যবসা, অন্যদিকে ইসলাম চিকিৎসাকে মানবসেবার অংশ হিসেবে দেখে, যেখানে মুনাফার পরিবর্তে সবার জন্য সুলভ ও ন্যায়সঙ্গত চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া হয়।
ইসলামে চিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইসলামে রাষ্ট্রকে জনগণের কল্যাণ এবং তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি দায়িত্বশীল হতে নির্দেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসাসেবা।
ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসাসেবা এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি।’ হাদিসটি ইসলামি শাসনামলে চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রগতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
এ ছাড়া ‘যে ব্যক্তি মুসলিম ভাইয়ের কোনো দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরি করবেন’ এবং ‘মুসলিম একে অপরের ভাই। যদি কেউ তার ভাইয়ের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন’ ধরনের হাদিস তৎকালীন চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত করতো সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে।
সে সময় ভুল চিকিৎসায় কারও মৃত্যু হলে তাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখা হতো, তাই দক্ষতা ছাড়া কেউ এ পেশায় আসত না, যা ভুল চিকিৎসা রোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
চিকিৎসাসেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যালোচনা নিয়ে ইবন আল-উখওয়া (Ibn al-Ukhuwa) তার গ্রন্থ মা’আলিম আল-কুরবা ফি তালাব আল-হিসবাতে কয়েকটি বিষয়টি উল্লেখ করেন।
• যদি রোগী মারা যান, তবে তার পরিবারের সদস্যরা প্রধান চিকিৎসকের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। তারা চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখান।
• যদি প্রধান চিকিৎসক মনে করেন যে চিকিৎসক তার কাজ যথাযথভাবে করেছেন, তবে তিনি পরিবারকে জানান যে এটি একটি স্বাভাবিক মৃত্যু।
• কিন্তু যদি চিকিৎসকের অবহেলা প্রমাণিত হয়, তবে প্রধান চিকিৎসক পরিবারকে বলেন, ‘তোমাদের আত্মীয়কে ভুল চিকিৎসার কারণে হত্যা করা হয়েছে। চিকিৎসকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করো!’
এই ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতির কারণে শুধু অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরাই চিকিৎসাব্যবস্থায় কাজ করতে পারতেন।
ইসলামি সভ্যতায় আধুনিক হাসপাতালের ধারণা নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময়েই জন্ম নিয়েছিল। ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে চিকিৎসাসেবার মূল কেন্দ্র ছিল মদিনার মসজিদ, যেখানে রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাঁবু স্থাপন করা হতো। বিশেষ করে, গাজওয়া খন্দকের সময় নবী (সা.) আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য রুফাইদা বিনতে সাদ (রাঃ)-এর তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ তাঁবু স্থাপন করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে ইসলামী খলিফারা চিকিৎসাসেবা আরও সংগঠিত করেন এবং ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল প্রবর্তন করেন, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলে গিয়ে জনগণকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করত।
১৩০০ শতকের চিকিৎসক ও পর্যটক আবদুল লতিফ আল-বাগদাদির এক চমৎকার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করব, যা ইসলামি শাসনামলে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নত অবস্থার চিত্র তুলে ধরে।
দামেস্কে শিক্ষকতা করা এ চিকিৎসক এক চতুর পার্সি যুবকের গল্প বলেছেন, যিনি নূরী হাসপাতালের চমৎকার খাবার ও পরিষেবার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসক তার অসুস্থতা নিয়ে সন্দেহ করলেও তাকে তিন দিন ধরে ভালো খাবার পরিবেশন করেন। চতুর্থ দিনে, চিকিৎসক তার কাছে এসে মৃদু হেসে বললেন, ‘আরবীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী, আতিথেয়তা তিন দিনের জন্য হয়ে থাকে। এখন দয়া করে বাড়ি ফিরে যান!’
পরিশেষে, তামিম ইকবাল যে দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছেন, তা যেন কোনো ‘বিশেষাধিকার’ না হয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য হয়—সেই লক্ষ্যে এমন সমাজের জন্য কাজ করা জরুরি যে সমাজ রুফাইদা (রা.)-এর তাঁবু বা কালাউনের হাসপাতালের মতো ‘কাউকে অর্থ বা পরিচয় জিজ্ঞাসা করবে না, শুধু নিশ্চিত করবে মানবতা।’ কেননা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু মুনাফাকেন্দ্রিক, সেহেতু এ ব্যবস্থা বহাল রেখে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য সুচিকিৎসা বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্ন হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:যেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের সারি, রোদের সাথে শুভ্র মেঘদলের নিত্য লুকোচুরি খেলা, সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক এক মসজিদ। সে মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে আজানের সুমধুর ধ্বনি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৭০০ ফুট উঁচুতে সবুজ পল্লব আর নিসর্গের বুক চিঁড়ে সপ্রতিভ দাঁড়িয়ে আছে একটি মসজিদ। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্থানে নির্মিত মসজিদটির নাম ‘দারুস সালাম জামে মসজিদ’। এর অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালির রুইলুই পাড়ায়।
সেনাবাহিনীর দানকৃত এক একর ভূমির ওপর নির্মিত এ মসজিদটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৮ টাকা। এতে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
চার তলা ভিতের ওপর দণ্ডায়মান দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি উচ্চতায় ২২ ফুট। এতে রয়েছে চারটি গম্বুজ ও একটি সুউচ্চ মিনার।
মসজিদটির পূর্ব-পশ্চিমের দৈর্ঘ্য ৬৫ ফুট, উত্তর-দক্ষিণের প্রস্থ ৮১ ফুট এবং সামগ্রিক আয়তন ৫ হাজার ২৬৫ বর্গফুট।
সৌন্দর্যে অপরূপ মসজিদটি নির্মাণে ২০২০ সালে যৌথভাবে উদ্যোগ নেয় সেনাবাহিনী ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সাজেকের রুইলুই পাড়ায় হ্যালিপ্যাডের পাশে মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক চট্টগ্রাম ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান।
মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লাগে ঠিক দুই বছর। বর্তমানে সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে।
দারুস সালাম জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব মো. মনিরুজ্জামান বাসসকে বলেন, ‘২০২২ সালের পহেলা রমজানের এশা এবং খতম তারাবির নামাজের মাধ্যমে এই মসজিদে নামাজ আদায়ের সূচনা হয়। বর্তমানে প্রাত্যহিক পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতের পাশাপাশি জুমা এবং খতম তারাবির নামাজ আদায় করা হয় এখানে।
‘তারাবির জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও দুইজন হাফেজ নিয়োগ করা হয়েছে। এসব জামায়াতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অসংখ্য পর্যটক অংশ নেন।’
সাজেকে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার পর্যটকের সমাগম হয়। আর বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ গুণ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী পর্যটক।
মসজিদ না থাকায় এত বছর নামাজ আদায়ে বেশ বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে মুসলিম পর্যটকদের। তবে এখন স্বাচ্ছন্দ্যেই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকরা।
প্রকৃতির অবারিত সবুজের মাঝে সুনসান পরিবেশে এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়ে পর্যটকরা দারুণ উচ্ছ্বসিত।
রাজধানী ঢাকা থেকে সাজেকে ঘুরতে আসা পর্যটক সোহেল আরমান বাসসকে বলেন, ‘চার বছর আগেও একবার এখানে এসেছিলাম। মসজিদ না থাকায় তখন জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারিনি। তবে এবারে এসে মসজিদের এমন নিরব-নির্মল পরিবেশে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করতে পেরে অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছি।’
দারুস সালাম মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক যুবরাজ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোন, স্থানীয় কটেজ-রিসোর্ট-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের দান-অনুদানে এই মসজিদের সার্বিক ব্যয় নির্বাহ করা হয়। উঁচু পাহাড়ের কারণে সাজেকে পানি পাওয়া যায় না। ফলে মসজিদে অজুসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার্য সকল পানি কিনে ব্যবহার করতে হয়।
‘প্রতিদিন এ মসজিদে গড়ে ৫ হাজার লিটার পানি লাগে। আর প্রতি লিটার পানিতে ১ টাকা করে দৈনিক ৫ হাজার টাকা খরচ হয় কেবল পানি বাবদ। এ ছাড়া আরও আনুষাঙ্গিক অনেক খরচ রয়েছে। তবে ব্যয়বহুল হলেও সবার সহযোগিতা নিয়ে এ মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:হিজরি ১৪৪৬ সালের সাদাকাতুল ফিতরের হার জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১০ টাকা এবং সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররমের সভাকক্ষে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সাদাকাতুল ফিতর নির্ধারণ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় সাদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা মুফতি আবদুল মালেক।
এতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ইসলামী শরিয়াহ মতে, আটা, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনিরের মতো পণ্যগুলোর যেকোনো একটি দিয়ে ফিতরা প্রদান করা যাবে।
গম বা আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে অর্ধ সা’ বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ১১০ টাকা প্রদান করতে হবে। যব দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ৫৩০ টাকা, খেজুর দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ২ হাজার ৩১০ টাকা, কিসমিস দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ১ হাজার ৯৮০ টাকা এবং পনির দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ২ হাজার ৮০৫ টাকা ফিতরা প্রদান করতে হবে।
দেশের সব বিভাগ থেকে সংগৃহীত আটা, যব, খেজুর, কিসমিস ও পনিরের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে এ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়। মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী উপর্যুক্ত পণ্যগুলোর যেকোনো একটি পণ্য বা এর বাজারমূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন।
উপর্যুক্ত পণ্যগুলোর স্থানীয় খুচরা বাজার মূল্যের তারতম্য রয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও সাদাকাতুল ফিতরা আদায় হবে।
আরও পড়ুন:পবিত্র রমজান উপলক্ষে জীবনের সর্বস্তরে সংযমের বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রমজানকে সামনে রেখে শনিবার সন্ধ্যায় দেওয়া বাণীতে এ বার্তা দেন।
পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসীসহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে বাণীতে তিনি বলেন, ‘সিয়াম সাধনা ও সংযমের মাস মাহে রমজান আজ আমাদের মাঝে সমাগত। পবিত্র এ মাসে আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্য লাভ ও ক্ষমা লাভের অপূর্ব সুযোগ হয়।
‘সিয়াম ধনী-গরিব সবার মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে।’
তিনি বলেন, ‘আসুন, পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-বিদ্বেষ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও সংঘাত পরিহার করি এবং জীবনের সর্বস্তরে পরিমিতিবোধ, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করি। সিয়াম পালনের পাশাপাশি বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করি এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকি।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘মহান আল্লাহ আমাদের জাতীয় জীবনে পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষা কার্যকর করার তাওফিক দান করুন। মাহে রমজান আমাদের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে ক্ষমা ও হেফাজত করুন, আমিন।’
আরও পড়ুন:দেশে রমজান মাস এলে বাজারে হু হু করে বেড়ে যায় খাদ্যপণ্যের দাম। এমন বাস্তবতায় ভিন্ন চিত্র সামনে এনেছেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মুদি দোকানি শাহ আলম।
রমজান উপলক্ষে ইফতারসামগ্রীর দাম কমিয়ে দিয়েছেন শাহ আলম। লাভ ছাড়াই পণ্য বিক্রি করছেন তিনি।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার মধ্য চরকুমিরা গ্রামে শাহ আলমের এ মুদি দোকান। পাশেই নিজ বাড়ি।
তিনি জানান, গেল দুই বছর রমজানে কেজিতে এক টাকা লাভে ইফতারসামগ্রী বিক্রয় করেন। অবশ্য এবারও কেজিতে এক টাকা লাভে উপজেলার ভাটিয়ালপুর এলাকায় তার নিজের অন্য একটি দোকানে ইফতারের ৮ রকমের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন তিনি। সেটা তার ভাই ও বোন দেখাশোনা করছেন। তবে আরেক দোকানে লাভ ছাড়াই বিক্রি করছেন পণ্য।
শাহ আলম বলেন, ‘নিজ বাড়ির পাশে কোনো লাভ ছাড়াই কেনা দামেই পবিত্র মাহে রমজানের আটটি ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছি। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মুড়ি, ছোলা, খেসারির ডাল, বেসন, চিড়া, চিনি, খেজুর ও সয়াবিন তেল।’
শাহ আলমের দোকানে মূল্য তালিকা সাঁটানো রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও তার দোকান পরিদর্শন করেছেন।
এ দোকানি ইউএনবিকে বলেন, ‘বছরের ১১ মাসই তো ব্যবসা করি। এই মাসে কোনো ব্যবসা (লাভ) করব না। পাশে আমার আরেকটি মুদির দোকান রয়েছে। গরিব, মেহনতি মানুষের জন্য কিছু একটা করার জন্য এ বছর রমজানে ক্রয়মূল্যেই রোজাদারের জন্য আটটি খাদ্যপণ্যসামগ্রী বিক্রয় করার সিদ্বান্ত নিয়েছি। এখন থেকেই শুরু করছি এসব পণ্য বিক্রি।’
অন্যান্য বছর রমজানে মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা বিক্রয় হলেও এবার রমজান মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল বিক্রয় করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ব্যবসায়ী শাহ আলম।
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার রমজানের মালপত্র বিক্রির অর্ডার পেয়েছি এ এলাকার লোকজন ও প্রবাসী ভাইদের কাছ থেকে।’
তার দোকান পরিদর্শন করে দেখা যায়, শাহ আলম, তার ভাতিজা সাকিবসহ (১৯) এসব পণ্য সামগ্রী প্যাক করছেন। দোকানে মালামালে পূর্ণ।
রমজানে দূরের বাজারে না গিয়ে বাড়ির পাশে শাহ আলমের মুদি দোকান থেকে ক্রয়মূল্যে ইফতারসামগ্রী কিনতে পেরে আশপাশের ক্রেতারা খুশি বলে জানান অটোচালক আরজু মিয়া (৪০), আইয়ুব আলী বেপারি (৫০), অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আবদুল খালেক (৭৭), বেলায়েত হোসেন (৫০), ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাকিব বেপারি (১৮) ও আবুল বেপারি (৬০)।
তারা বলছেন, শাহ আলমের দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করলে সুবিধা। দূরের বাজারে গিয়ে বিভিন্ন দোকানে দাম যাচাই-বাছাই করতে ঘুরতে হয় না।
শাহ আলম এসব পণ্য প্যাক করে মালামাল রিক্সা-ভ্যানে করে বাড়িতে বাড়িতে বাড়িতেও পাঠিয়ে দেন বলে জানান একজন গৃহিণী ও তার বাবা।
গেল দুই বছর ১ টাকা লাভে রমজানের পণ্য বিক্রয় করে ব্যাপক সাড়া পান শাহ আলম। গত বছর সরকার তাকে পুরস্কৃতও করে।
পাশের মুদি দোকানদার বেলায়েত হোসেন বেপারিসহ কয়েকজন শাহ আলমের এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
এদিকে রমজান উপলক্ষে বিনা লাভে ক্রয়মূল্যে ইফতারসামগ্রী বিক্রয় করায় শাহ আলমকে অভিনন্দন জানিয়েছে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
সম্প্রতি তার দোকানে গিয়ে যেকোনো ব্যপারে শাহ আলমকে সহযোগিতার হাত বাড়ানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলার সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল ইমরান।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য