বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় আর চীন প্রথম, গত দশক পর্যন্ত এমনই ছিল প্রচলিত তুলনা। তবে এ বছর অন্তত ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধিতে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আর এতে পোশাক রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি বস্ত্রশিল্প মালিকদেরও বড় অবদান রয়েছে বলে মনে করেন বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। যুদ্ধ থেমে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই আশার কথা শুনিয়েছেন মোহাম্মদ আলী খোকন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি।
বস্ত্রশিল্প খাতের অবস্থা এখন কেমন? দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কতটা অবদান রাখছে এই খাত?
আমরা বস্ত্র খাতের ব্যাকওয়ার্ড শিল্পের (পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প) সবচেয়ে বড় সংগঠন। আমাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে রপ্তানিতে আমাদের জোগান ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষের বস্ত্রের যে জোগান, সেটি আমরাই দিয়ে থাকি। আমরা বছরে দেশে সাত বিলিয়ন মিটার কাপড় জোগান দিই। যার অনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে আমাদের বছরের টার্নওভার প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমাদের যে বিনিয়োগ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, এটি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। এর সঙ্গে যদি আমরা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বিনিয়োগ যোগ করি, তাহলে মোট বিনিয়োগ হবে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের এই খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তাই সামগ্রিক বিচারে আমাদের বস্ত্র খাতের অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
সবচেয়ে বড় কথা যেটি, সেটি হচ্ছে আমাদের এই ব্যাকওয়ার্ড শিল্প না থাকলে আজকে পোশাকশিল্পের অবদান কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এই যে গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, তাতে কিন্তু আমাদেরও বড় অবদান আছে। আমরা তুলা আনি, সেখান থেকে সুতা বানাই, সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে ডাইং ফিনিশিং করছি। সেখানে প্রিন্টিং হচ্ছে, চেক হচ্ছে, ডেনিম হচ্ছে, টুইল হচ্ছে, গ্যাবার্ডিন হচ্ছে, নিট ফ্যাব্রিক হচ্ছে নিট খাতকে ৯০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা। ওভেন খাতে আমাদের জোগান হচ্ছে রপ্তানির ৪০ শতাংশ। আর ডেনিমের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জোগানদাতা আমরা। বাংলাদেশে জ্বালানির বড় গ্রাহক আমরা। ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমরা ব্যবহার করছি। করোনাভাইরাসের সময় আমরা বিপদে পড়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ উদ্যোগে আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই সময়ের উদ্যোগের কারণে পরবর্তী সময়ে আমরা ভালো করতে পেরেছি। আসলে এই শিল্পটি ভালোর দিকে ছিল। নতুন বিনিয়োগ আসছিল; কর্মসংস্থান বাড়ছিল।
আড়াই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। কিছুদিন সংবাদ সম্মেলন করে বস্ত্র খাতের সংকটের কথা বলেছিলেন। এখন কেমন চলছে?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপে যখন যুদ্ধ লাগল। গত মার্চ থেকে আমাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। নামতে নামতে গত অক্টোবর আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল; এখন যে ভালো সেটি বলব না। গত নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি যে আয় হয়েছে, সেটি অবশ্যই ভালো অর্জন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই যে অর্জন হয়েছে তা হচ্ছে আগে আমাদের অনেকগুলো অর্ডার ছিল, সেটির কারণে হয়েছে। সামনে আমাদের অর্ডারগুলো আছে, কিন্তু খুব স্লো (ধীর) ডেলিভারি। সেগুলোর মধ্যে ক্রেতাদের সে রকম চাপ নেই যে মালটি দিতে হবে। অন্য সময় আমাদের ওপর চাপ থাকত যে মাল দিতে হবে। এমন অবস্থা মাঝে মাঝে হতো যে প্রাইজ যেটিই হোক, আমাকে মাল দিতে হবে।
সারা বিশ্বে এখন মন্দার ভাব। সেটির প্রভাব কিন্তু আমাদের দিকে আসছে। কিন্তু একটি কথা আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা ভালো আছি; অনেক বড় বড় দেশের চেয়ে ভালো আছি। এই তো আমি ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে এলাম, নিজ চোখে দেখে এলাম, তাদের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। বাংলাদেশে আমরা যতটা খারাপ করি, তার তুলনায় প্রচার-প্রচারণা বেশি। যেটি ইউরোপে হয় না। ইউরোপে অনেকের ঘরে খাওয়া নেই, কিন্তু আপনি এটির খবর দেখবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে যদি ৯০টি ভালো সেবা পাওয়া যায়, আর ১০টি খারাপ সেবা পাওয়া যায়। আমরা ১০টির খবর পাই। আর ৯০টির খবর পাওয়া যায় না। আমি ৫টি কিস্তি আগে দিয়েছি এই খবর হয় না। কিন্তু বিসমিল্লাহ গ্রুপ টাকা নিয়ে গিয়েছে সেই খবর হয়। আমি গণমাধ্যমের সবাইকে বিনীত অনুরোধ করব যে আপনারা দেশকে নিয়ে পজিটিভ নিউজ করেন। বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে; আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সমালোচনার পাশাপাশি দেশের ভালো খবরও প্রচার করুন দয়া করে।
একটি কথা আমি বারবার বলে থাকি, কোনো দলের রক্ষণভাগ যত শক্তিশালী, তাকে গোল দেয়া তত কঠিন। আমাদের পোশাকশিল্পের রক্ষণভাগ শক্তিশালী, অর্থাৎ আমরা বস্ত্র খাত হলাম পোশাকশিল্পের রক্ষণভাগ। আমরা শক্তিশালী বলেই পোশাক খাতের অনেক অর্জন হচ্ছে। গ্যাস ও বিদুৎ-সংকটের কারণে আমরা সরকারকে বলেছিলাম যে দরকার হলে আমরা একটু টাকা বাড়িয়ে দিই, আপনারা আমাদের বিদ্যুৎ দেন। আমরা বলেছিলাম আমরা যদি ১ লাখ ডলারের জ্বালানি পাই, তাহলে কিন্তু আমরা ২৪ লাখ ডলার আর্ন করতে পারি। এই পরিসংখ্যান যখন আমরা তুলে ধরেছিলাম; বলেছিলাম যে আমরা সরকারকে সহায়তা করতে চাই। আমরা যদি একসঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করি, তাহলে কিন্তু সংকট কাটিয় ওঠা যায়। আমরা যদি সংকটের সময় দোষারোপ করি, তাহলে কিন্তু জাতি সংকট থেকে উদ্ধার হতে পারব না।
এখন কি গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট কেটেছে? আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি?
উন্নতি হয়েছে ঠিক; কিন্তু সংকট কিন্তু পুরোপুরি কাটেনি। আমরা এটি বুঝি যে সরকার ইচ্ছে করে ব্যয় সংকোচন করেনি। এ ক্ষেত্রে সবাই মিলে সরকারকে সহায়তা করা উচিত বলে আমি মনে করি। বিশ্বের সব দেশ সংকটকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করার কারণে কিন্তু সংকট কাটিয়ে উঠেছে। জাতীয় সংকটে সব দল এক হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সংকটটিকে বিশ্বের দরবারে আরও বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ফায়দার জন্য। দেশকে কিন্তু আমরা ছোট করছি। আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বলব, দেশকে ছোট করে কোনো লাভ নেই। সমস্যা থাকবে, তার সমাধান থাকবে। জ্বালানির সমস্যা সারা বিশ্বের সমস্যা। সুতরাং আমরা মনে করি, সবাই মিলে কাজ করলে এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। আগে আমাদের কোনো জিনিস আনতে যদি ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হতো, এখন ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এই অবস্থা হয়েছে। আমাদের টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। বাংলাদেশে যে উন্নয়নকাজ হয়েছে, গত ১০ বছরে এগুলোকে আপনি ফেলে দেবেন কীভাবে।
এখন একজন রিকশাওয়ালাও রিজার্ভ (বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা মজুত) নিয়ে কথা বলে। এটি আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত। রিজার্ভ নিয়ে চিন্তা করার জন্য রাষ্ট্রের অনেক লোকজন আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে বলে আমি মনে করি। তখন বিশ্ব অর্থনীতির বাজার কিন্তু বিশেষভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। এই বাজারটিকে ধরার প্রস্তুতি এখন আমরা নিচ্ছি। আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতি ঠান্ডা হয়ে এলে অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে তখন দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এখন বিশ্ব অর্থনীতির যে খারাপ অবস্থা, সেটি একসময় সহনীয় হয়ে যাবে। আর সহনীয় হয়ে গেলে আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সবাই মিলে সেই প্রস্তুতিই নিতে হবে। যুদ্ধ থেমে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আমার বিশ্বাস।
দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এতে কি আপনারা উদ্বিগ্ন?
আমি যখন ব্যবসায় আসি ’৮৭ সালে, তখন উত্তাল আন্দোলন এরশাদবিরোধী। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে-পিঠে লিখে শহীদ হলেন নূর হোসেন। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান, এর পরও দেশে আন্দোলন হয়েছে- এগুলো দেখতে দেখতে আমরা ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বাধাবিপত্তি-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই আমরা ব্যবসায়ীরা ব্যবস্যা করছি। উৎপাদন করছি, কর্মসংস্থান করছি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
৩৫ বছরের ব্যবসায়ী হিসেবে আমি মনে করি, এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ব্যবসায়ীদের থাকা উচিত। প্রত্যেক জিনিসের সিজন থাকে। পিঠা উৎসব শীতকালে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো একটি ফেস্টিভ ব্যাপার। এতদিন কিছু ছিল না, এখন দেখা যাচ্ছে সমানতালে দুটো দলই করছে। দুই দলেরই প্রচুর লোকজন হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এটিকে এনজয় করছে ফেস্টিভ হিসেবে। সুতরাং আমি আতঙ্কিত নই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নতুন কিছু নয়। এর চেয়ে খারাপ সময় আমরা দেখেছি। সেই তুলনায় বাংলাদেশ এখন অনেক ভালো আছে। বাংলাদেশে অর্থনীতি বলেন, অর্থনীতির সাইজ বলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের অবস্থান ৪১তম। আমরা যদি ধরে নিই আগামী পাঁচ বছরে আমাদের অর্থনীতির সাইজ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে।
এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের অর্থনীতি কত ছিল। কয়েক মিলিয়ন ডলারের ছিল। অর্থনীতি আস্তে আস্তে ট্রিলিয়ন ডলারের দিতে এগোচ্ছে। প্রাইভেট ব্যাংকগুলো নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। কিন্তু এই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যে অবদান আছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, বাংলাদেশের শিল্পে, আমাদের বস্ত্র সেক্টরে যে বিনিয়োগ আছে তার বেশির ভাগ টাকা বেসরকারি ব্যাংক থেকে আসছে। সুতরাং দু-একটি ব্যাংকের খারাপ দিক নিয়ে আপনি সারা ব্যাংকিং খাতের ওপর ঢালাও কথা বলতে পারেন না। সংকট থাকবে; এর মোকাবিলা থাকবে। এই মুহূর্তে আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বস্ত্র খাত কতটা অবদান রাখছে?
অর্থনীতিতে আমাদের অবদান যদি হিসাব করেন, এটাকে কোনোভাবে খাটো করে দেখা যায় না। বাংলাদেশের ৫২ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে সরাসরি ১ কোটি ১০ লাখ লোক কাজ করে এখানে। ৫২ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতি, এটা হলো রপ্তানি, এতে স্থানীয়ভাবে আমাদের সেক্টরের ৮ বিলিয়ন ডলার, অন্যান্য সেক্টর মিলিয়ে ডোমেস্টিক প্রোডাক্টকে ধরলে আরও ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১৩ বিলিয়ন ডলার হবে। সব মিলিয়ে ৬৫ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার আমাদের ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট। আমাদের টোটাল ইকোনমিতে আমাদের টোটাল ইন্ডাস্ট্রির অবদান হলো ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এটা ২০২২ সালের তথ্য হিসাব করে আমি বললাম। তাহলে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মধ্যে যদি ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ অবদান হয়, তাহলে ভেবে দেখেন কত বড় অবদান আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির।
আমাদের কৃষির অবদান ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সার্ভিস সেক্টর থেকে ৫১ শতাংশ পাচ্ছি। শিল্প থেকে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ অবদান আসছে তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ টেক্সটাইল থেকে আসছে। আমরা কাজ করছি, সরকারও সহায়তা করছে। আগামীতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার হবে। করোনা শেষ হয়ে গেছে। এখন চিন্তা করার সময়ে হয়েছে যে, কোন বাজারটিকে আমরা আগে দখলে নেব।
বস্ত্র খাতে নতুন বিনিয়োগ কেমন আসছে? কর্মসংস্থান কেমন বাড়ছে?
আমাদের সেক্টরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগ এসেছে। এগুলোর কোনোটাই বন্ধ হয়নি। আরও হওয়ার কথা ছিল, যুদ্ধের কারণে স্থগিত আছে। আমি বলব, ব্যাকওয়ার্ড শিল্পে আমাদের যে অবস্থানটা আছে, বর্তমানে আমাদের যে টেকনোলজি, ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনারি মেশিনারিজ আমাদের আছে। চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, পৃথিবীর এমন কোনো টেকনোলজি নেই যে আমাদের নেই। আমরা প্রস্তুত। বলব যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ, কোনোটাতে ৭০ ও কোনোটাতে ৪৫ শতাংশ প্রস্তুত। আপনারা বলতে পারেন ৪৫ শতাংশ কেন ৭০ শতাংশ হলো না।
আমাদের জ্বালানি সেক্টরে যেটা হলো কি, আপনি জানেন যে ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কানেকশনটা খুবই মন্থর গতিতে যাচ্ছে, যেটা গ্যাসের যতটুকু চাহিদা সেই তুলনায় আমাদের কূপগুলো খনন হয়নি। আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস বা সম্পদ সেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং যার কারণে আমাদের ওভেন শিল্পগুলোতে প্রচুর গ্যাসের দরকার হয়। এত দিন যদি আমাদের সেই পরিমাণ ইউটিলিটি থাকত, তাহলে হয়তো সেটা হয়ে যেত। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক সম্পদ, এই সম্পদের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে, মেয়াদ থাকে, তারপর আস্তে আস্তে নিম্নমুখী হতে থাকে। সুতরাং যেটা ২৭০০ এমএমসি গ্যাস উঠত চার-পাঁচ বছর আগে, সেটা ২৩০০ এমএমসিতে নেমে এসেছে। এটাকে পূরণ করার জন্য আমরা এলএনজি কিনছি। আমরা লং টার্মে ৫০০ এমএমসিএফটি কিনছি প্রতিদিন। আমাদের শর্ট টার্মে সেখান ২০০ আমরা কিনছি। কখনো আসছে, কখনো আসতে পারছে না। যুদ্ধের কারণে বিগত দুই-তিন মাসে আসতে পারছে না। প্রাইস অনেকটা হাই হয়ে গেছে। এসব কারণে আমাদের ওভেন শিল্পগুলো আমরা সেভাবে আগাতে পারিনি। কিন্তু আমাদের যে ইয়ার্ন বলি, ইয়ার্নে আমরা ৯০ শতাংশ সফল, ম্যান-মেড ফাইবারে আরও ৫ শতাংশ এগিয়ে যাব। ২০২৩ সালে সম্ভবত আমরা ৯৫ শতাংশ অর্জন করব।
ডেনিমে আমরা প্রায় পুরোটাই সফল হয়েছি। ওভেন-নিটে তো আমাদের পুরো সাপ্লাই ঠিক আছে। আমরা আগামীতে চেষ্টা করব, আমরা দেখছি সরকার অনেক চেষ্টা করছে যে, নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করা যায় কিনা। আসলে কি, আমদানিনির্ভর জ্বালানি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি সাসস্টেইনেবল (টেকসই) হওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের নিজস্ব যে গ্যাসগুলো আছে, আগামী পাঁচ বছরে যদি আমাদের পাইপলাইনে যুক্ত হয়, আমি জানি সরকার কাজ করছে, বিভিন্ন জায়গায় কূপ খুঁজছে, সংস্কার করছে, ভোলায় দেখে আসলাম প্রতিদিন ১ থেকে ১০০ অতিরিক্ত গ্যাস থাকে সেটা জাতীয় গ্রিডে যোগ করার জন্য চেষ্টা করছে। সেটাকে লিক্যুইড ফর্মে আনার জন্য পাইপলাইনে। এভাবে দেখা গেছে, সিলেটের হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে নতুন আরেকটা কূপ পাওয়া গেছে। আমরা যদি নিজস্ব রিসোর্সগুলো ব্যবহার করতে পারি, আবার যদি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে গ্যাসনির্ভর পাওয়ার প্ল্যান্ট যদি কমে আসে, সেই বিদ্যুৎটা যদি শিল্পে সাপ্লাই দেয়া যায়, তাহলে আমি মনে করি যে অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর বর্তমানে অর্থনীতিতে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ যে শিল্পের অবদান তা ৪০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা যদি গ্যাসকে রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট করতে পারি, আমরা যদি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারি এবং এটা যদি শিল্পে ব্যবহার করতে পারি, অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
আমদানি কমছে। এটা একটা স্বস্তির খবর। তবে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেশ কমে গেছে। এতে কি দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না?
এখাতে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ক্যাপিটাল মেশিনারি কিন্তু গ্রোসারি জিনিস নয় যে প্রতিদিন আমদানি করা হয়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায়, দুই বছরে একবার আনতে হয়। আপগ্রেশনের কারণে বা অন্য কারণে আমদানি করতে হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানি কমে গেছে এটা আশঙ্কার কিছু নেই। শিল্পের কাঁচামাল (র-ম্যাটেরিয়াল) আমদানি কমে গেলে আশঙ্কার কারণ আছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি না এলে উৎপাদন হবে না, র-ম্যাটেরিয়াল আসবে না, টাকাও দরকার নাই। কিন্তু আমার মেশিন আছে, কিন্তু র-ম্যাটারিয়ালের কারণে মেশিন বন্ধ আছে এটা আশঙ্কার বিষয়। কিন্তু মেশিনারি আমদানির হ্রাসে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
সহায়ক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য আপনার প্রত্যাশা কী?
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ব্যবসায়ীরা জড়াতে চাই না। বিরোধী দল হোক বা সরকারি দল হোক, দেশকে নিয়ে প্রপাগান্ডা (গুজব) ছড়ানো থেকে প্রথমে আমাদের বিরত থাকতে হবে। পৃথিবীর কোনো জাতি এটা করে না। দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে, এর সুফল কিন্তু আমরা নাগরিক হিসেবে সবাই পাব।
জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব যাদের জন্য আজকে মুক্ত স্বদেশ তাদের লাল সালাম। দেশটা স্বাধীন না হলে আমরা কয়টা বাঙালি শিল্পের মালিক হতাম। সুতরাং আমি বলব, জাতি হিসেবে ’৭১ সালে একত্রিতভাবে, সম্মিলিত শক্তি না হলে আমরা কিন্তু পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারতাম না। সুতরাং প্রত্যেকটা সংকটে আমাদের এক হতে হবে। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে কাজ-ক্ষমতা দেখলে হবে না। ’৭১ সালে যেমন জাতীয় ঐক্য হয়েছিল। আমি মনে করি অর্থনীতি সংকটে ঐক্য হওয়া উচিত। প্রপাগান্ডা ছড়ানো ঠিক নয়।
এ দেশের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। যে দেশ নিজের টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারে, বিভিন্ন ধরনের টানেল করতে পারে- সেই জাতিকে কখনো আপনি খারাপ বলতে পারেন না। আমি বলছি, ১০টা ব্যাংকের ক্লায়েন্ট খারাপ করছে, সেটা যদি ৩০টা টিভি চ্যানেল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচার করে, তাহলে ৯০টা ক্লায়েন্ট যে ভালো করছে তাদের আমরা কেউ চিনি না। আমরা খারাপকে চিনি, ভালোকে চিনি না। আমি মনে করি, আমাদের ঐক্য থাকতে হবে। জাতীয় অর্থনীতি ও দেশকে বাঁচাতে হবে। দেশটা আমার, আপনার দেশ। দেশর সুনাম নষ্ট করা যাবে না। জাতি হিসেবে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল গার্মেন্টস ক্রেতা, বিপনন ও সরবরাহকারী এবং সোর্সিং এক্সিবিশন খ্যাত ইনটেক্স বাংলাদেশের ১৬তম আসর আজ রাজধানীর আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরা (আইসিসিবি)-তে শুরু হয়েছে। এই তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল সোর্সিং শোতে ১০টিরও বেশি দেশের ১২৫টির অধিক কোম্পানি অংশ নিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী ক্রেতা, সরবরাহকারী এবং উৎপাদনকারীদের জন্য একটি গতিশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।
পোশাক খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-এর নিত্য উদ্ভাবনী কৌশল ও উন্নতমানের দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
২০২৬ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইনটেক্স-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা, সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র্য আনা এবং টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পে উদ্ভাবন প্রদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, গেস্ট অব অনার হিসেবে ছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
এছাড়াও বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং এলএবিসিসিআই, কেবিসিসিআই ও বিজিসিসিআই-এর মতো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংস্থার নেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
মাহবুবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ এখন পোশাক খাতে বিশ্ব বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দ্রুত টেকসই ও মূল্য-সংযোজিত পোশাক উৎপাদনের একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। উদ্ভাবন, কমপ্লায়েন্স এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগে কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটি দায়িত্বশীল ফ্যাশন ও টেক্সটাইল সোর্সিংয়ের পরবর্তী অধ্যায় নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। আমরা বিশ্বাস করি, ইনটেক্স বাংলাদেশের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করবে”
এই বছরের এক্সপোতে বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য প্যাভিলিয়নের মধ্যে ভারতের (টেক্সপ্রোসিল ও পেডেক্সিলের মাধ্যমে) তুলা, মিশ্র সুতা ও টেকসই টেক্সটাইল প্রদর্শন করছে। চীন নিয়ে এসেছে টেকনিক্যাল ফ্যাব্রিক ও গার্মেন্টস ট্রিম। দক্ষিণ কোরিয়া পরিবেশবান্ধব পারফরম্যান্স উপকরণ প্রদর্শন করছে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও জাপান নিয়ে এসেছে প্রিমিয়াম শার্টিং ও বোনা পণ্য। বাংলাদেশি প্রদর্শনকারীরা নিটওয়্যার, ডেনিম এবং ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড উৎপাদন সমাধানের অগ্রগতি তুলে ধরছে।
এক্সপোর মূল্যবোধ আরও বাড়াতে ইন্টারেক্টিভ বিজনেস ফোরাম (আইবিএফ) দুটি সেশনের আয়োজন করেছে। প্রথম সেশনে টেক্সটাইল উৎপাদন ও ফ্যাশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হবে, অন্যদিকে দ্বিতীয় সেশনে বৈশ্বিক শুল্ক ও বাণিজ্য পরিবর্তনের বাংলাদেশি রপ্তানির প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে। এই সেশনগুলোতে এ শিল্পের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অংশ নিচ্ছেন, যা ব্যবসায়িক স্থিতিস্থাপকতা ও বৃদ্ধির কৌশল প্রদান করবে।
প্রদর্শনীর পাশাপাশি, ইনটেক্স বাংলাদেশ ২০২৫-এ ব্যবসায়িক সভা (বি২বি), ভিআইপি নেটওয়ার্কিং এবং ক্রেতা-সরবরাহকারীদের মধ্যে ম্যাচমেকিং সুবিধা রয়েছে— যা সোর্সিং ও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা প্রদান করছে।
ওয়ার্ল্ডেক্স ইন্ডিয়ার আয়োজিত এই ইভেন্টটি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিজিবিএ, ইপিবি এবং আইবিসিসিআই, এলেবিসিসিআই, কেবিসিসিআই ও বিজিসিসিআইয়ের মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার সমর্থন পেয়েছে।
বাংলাদেশ যখন আরও উদ্ভাবনী ও টেকসই টেক্সটাইল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, ইনটেক্স বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের সাপ্লাই চেইনের সাথে দেশটিকে সংযুক্ত করার একটি প্রধান সমর্থক হিসেবে কাজ করছে।
দেশে ২০২৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ—এফডিআই আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২৩ সালে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্টে বিদেশি বিনিয়োগ আসার ওই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ১৩ শতাংশ।
ভারতের হার ১৪ শতাংশ। ভুটানের মতো দেশে এ হার ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে অর্থের ঘোষণার পরিমাণও কমেছে।
ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ১৭৫ কোটি ডলার। গত বছরের তুলনায় যা ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮৫ কোটি টাকা।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের বাইরে সর্বাধিক ৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব যখন আরো গভীর সহযোগিতা ও বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন ঘটছে তার বিপরীত। ২০২৪ সালে বৈশ্বিকভাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ধাক্কা। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে মন্দা, শিল্প খাতে চাপ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি কম মনোযোগ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য উত্তেজনা, নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক বিভাজন বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশকে আরো জটিল করে তুলছে।
তবে অন্ধকারে কিছুটা আশার আলোও রয়েছে। ডিজিটাল অর্থনীতিকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এর প্রবৃদ্ধি এখনো অসম। ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে ডিজিটাল পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ডিজিটাল সংযুক্তি হতে পারে অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি, যদি তা সবার কাছে পৌঁছানো যায়। প্রতিবেদনটি সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজিএস) অর্জনে সহায়তা করার বিষয়ে ব্যবহারিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ সময়টাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একসঙ্গে কাজ করার, যাতে আরো সহনশীল ও টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলা যায়। সে লক্ষ্যে প্রতিবেদনটি বিভিন্ন নীতিগত ধারণা ও পরামর্শ তুলে ধরেছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং এর আগ থেকে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। যার প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হলেও সেটি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ এ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে এফডিআই প্রবাহ বেড়েছিল ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রবাহ ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে প্রবাহ হয়েছে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কম্বোডিয়ায় এফডিআই প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে হয়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাকিস্তানে এফডিআই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
২০২৩ সালে ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশে (এলডিসি) এফডিআই ১৭ শতাংশ বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাড়িয়েছে। এর প্রায় ৫০ শতাংশ প্রবাহ কেন্দ্রীভূত ছিল কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ, উগান্ডা এবং সেনেগাল—এ পাঁচ দেশে। গত এক দশকে স্বল্পোন্নত দেশের বহিঃখাতগুলোয় অর্থায়নের অন্যান্য উৎসের তুলনায় এফডিআই প্রবৃদ্ধিই পিছিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন সহায়তা এবং রেমিট্যান্স হার স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় বেশি। ওই বছর বৈশ্বিকভাবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ ১০ শতাংশের বেশি কমে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে স্থবির ছিল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ধানের আরও তিনটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে একটি লবণাক্ততা সহনশীল, একটি উচ্চফলনশীল বোরো এবং অন্যটি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী। এ নিয়ে ব্রি আটটি উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড জাতসহ মোট ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।
নতুন উদ্ভাবিত তিনটি জাত হলো; লবণাক্ততা সহনশীল ব্রি-১১২, উচ্চফলনশীল বোরো ব্রি-১১৩ ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ব্রি-১১৪। গত বুধবার জাতীয় বীজ বোর্ডের (এনএসবি) ১১৪তম সভায় নতুন এ তিনটি জাত অনুমোদন করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সভাপতিত্বে বোর্ড সভায় ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানায়, নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততা সহনশীল ও মাঝারি জীবনকালীন রোপা আমনের জাত। এ জাতের ডিগপাতা প্রচলিত ব্রি ধান-৭৩-এর চেয়ে খাড়া। ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ১৪ থেকে ৬ দশমিক ১২ টন ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতের জীবনকাল ১২০ থেকে ১২৫ দিন এবং গাছের উচ্চতা ১০৩ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার। গাছের কাণ্ড মজবুত। এ কারণে ঢলে পড়ে না। এ জাতের ধানের চাল মাঝারি চিকন ও সাদা। ভাত ঝরঝরে। এটি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। দানা মাঝারি চিকন ও শিষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। জীবনকাল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ফসল কর্তনের পর মধ্যম উঁচু থেকে উঁচু জমিতে সূর্যমুখী ও লবণ সহনশীল সরিষা আবাদের সুযোগ তৈরি হবে।
ব্রি ধান-১১৩ জাতটি বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি-২৯-এর বিকল্প হিসেবে ছাড়করণ করা হয়েছে। এটি মাঝারি চিকন দানার উচ্চফলনশীল জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা এবং ধান পাকলেও সবুজ থাকে। গাছ শক্ত ও মজবুত বিধায় সহজে হেলে পড়ে না। জাতটির গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন। চালের আকার-আকৃতি মাঝারি চিকন ও রং সাদা। দেখতে অনেকটা নাজিরশাইলের মতো। এ ধানের চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৮ শতাংশ এবং ভাত ঝরঝরে। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় দেখা গেছে, জাতটি ব্রি ধান-৮৮-এর চেয়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এ জাতের গড় ফলন হেক্টরে ৮ দশমিক ১৫ টন। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে জাতটি হেক্টরে ১০ দশমিক ১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, নতুন ব্রি ধান-১১৪ বোরো মৌসুমের দীর্ঘ জীবনকালীন ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। গাছ মজবুত এবং হেলে পড়ে না। পাতার রং গাঢ় সবুজ। এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৭ দশমিক ৭৬ টন। দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালি বর্ণের। ভাত ঝরঝরে হয়। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে এ জাতের ধান চাষে কৃষককে ব্লাস্ট রোগ নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হবে না, উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হবে।
ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, জাতগুলো অনুমোদন লাভ করায় এখন আমরা এসব ধানের বীজ বাজারজাত করতে পারব। কৃষকেরা এ জাতের ধান চাষ করে লাভবান হবেন। তাদের উৎপাদনও বাড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় অনেক সময় ধান চাষ করা যেত না। এখন আমাদের ব্রি ধান-১১২ সেসব এলাকায় সহজে চাষ করা যাবে। এ ছাড়া অন্য জাতগুলো আমাদের ধান উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
সূত্র: বাসস
আগামী ২১ ও ২৮ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এর অধীনে সব কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর কার্যালয় খোলা থাকবে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও ওই দুই দিনও খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মূলত রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। গতকাল বুধবার এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে এনবিআর। গত ২ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২২ জুন বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) মোট ৩ লাখ সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে। এটি সাময়িক হিসাব। ভ্যাটের রিটার্ন দাখিলের হিসাবের এই সংখ্যা আরও বাড়বে। লক্ষ্য অর্জনে শুধু জুন মাসেই সব মিলিয়ে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে।
এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। মূল লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে উল্লেখ করে ডলার-টাকার বিনিময় হার এখন থেকে বাজারনির্ভরভাবে নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ আগামী জুন মাসের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের ঋণ কিস্তি পাবে বলেও জানান তিনি।
ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের দর-কষাকষি চলছিল। মূলত সে কারণে আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় করছিল না। এর মধ্যে গতকাল জানা যায়, বাংলাদেশ ডলারের বিনিময় আরও নমনীয় করতে রাজি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারে ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ৯ মাসে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি, তবুও বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। এ অবস্থায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, বাজারভিত্তিক করায় হঠাৎ করে ডলারের রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেট ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে এবং তা সেখানেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ডলারের রেট দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা-সরবরাহ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে, বাইরের দেশের নির্দেশে নয়। বর্তমানে বাজারে ডলারের সরবরাহও পর্যাপ্ত রয়েছে।
তবে, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দুবাইভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. মো. হাবিবুর রহমান, কবির আহমেদ, উপদেষ্টা আহসান উল্লাহ এবং নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার একত্রে ছাড় করবে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সকল বিষয় সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে উভয়পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং বিনিময় হার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনার লক্ষ্যে চতুর্থ রিভিউ সম্পন্ন হওয়ার পর উভয় রিভিউয়ের জন্য নির্ধারিত কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে বলে বিগত তৃতীয় রিভিউয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ রিভিউয়ের সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ব্যাংক-ফান্ড সভায় এবিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল।
এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা জুন মাসের মধ্যে পাবে বলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ অর্থ পাওয়া গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসকল সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। এ সকল সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কারিগরি সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। পরস্পরের ওপর আরোপ করা পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য শুল্ক ৯০ দিনের জন্য ব্যাপক পরিসরে কমাতে একমত হয়েছে দুই দেশ। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তেজনা কমাতেই এই চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। খবর বিবিসির।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের আগে চীনের ওপর মার্কিন শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। পরে নতুন শুল্ক যখন ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন তখন তিনি বলেছিলেন তিন মাস সবার জন্য বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক হার প্রযোজ্য হবে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, গঠনমূলক ও দৃঢ় আলোচনার পর উভয় দেশ ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করতে রাজি হয়েছে। এর আওতায় দেশ দুটি পারস্পরিক শুল্ক ১১৫ শতাংশ কমাবে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত বর্তমান ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। অন্যদিকে চীন মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপ করা ১২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। উভয় দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, আগামী ১৪ মে থেকে শুল্কের এই কাঁটছাট কার্যকর হবে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে স্কট বেসেন্ট বলেন, আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আমাদের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। দুই পক্ষের প্রতিনিধিদলই একমত হয়েছে যে তারা বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না। মার্কিন অর্থমন্ত্রী বলেন, উভয় দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে। আমাদের লক্ষ্য ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের পথে অগ্রসর হওয়া এবং এটি তারই সূচনা।
প্রথম দফায় শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল এবং বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও জোরালো হয়েছিল। তবে এবার এই চুক্তির ঘোষণায় বিশ্ব শেয়ারবাজারে তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
শুল্ক কমানোর চুক্তির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাজারে চাঙাভাব দেখা দেখা গেছে। হংকংয়ের প্রধান সূচক ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ স্টক ফিউচারের উত্থান হয়েছে। এছাড়া বাড়তি শুল্ক স্থগিতের খবরে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের দর বেড়ে ছয় মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় শেয়ারবাজারগুলোও উচ্চমুখী প্রবণতায় লেনদেন শুরু করে এবং মার্কিন বাজারগুলোও ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে, এই সময়সীমার মধ্যে চীনের উচিত হবে ফেন্টানিল নামক ভয়াবহ মাদকের অবৈধ রপ্তানি বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। এ বিষয়ে চীনের সদিচ্ছা দেখে ওয়াশিংটন আশাবাদ প্রকাশ করেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের প্রবেশ ঠেকাতে চীন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন।
টাকা পাচার ঠেকাতে বিশেষ ইউনিট গঠন করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মূলত বাণিজ্যের আড়ালে যে বিদেশে টাকা পাচার হয়, তা প্রতিরোধ করতেই এমন উদ্যোগ। দুই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয় বলে মনে করে এনবিআর। এগুলো হলো-আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা এবং ট্রান্সফার প্রাইসিং। এসব কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লোকসান হয় বলে মনে করে এনবিআর।
সম্প্রতি এনবিআর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল নামে ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। সেখানে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) উদ্ধৃতি দিয়ে এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের আড়ালে (মিথ্যা ঘোষণা) ৭০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
টাকার পাচার রোধে এনবিআর তিনটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে। প্রথমত, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার ঠেকাতে দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে বিশেষায়িত একটি ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। এই ইউনিটের সদস্যরা প্রতারণা হয় বা হতে পারে- এমন বিল অব এন্ট্রিগুলো তদারকি ও তদন্ত করবেন। এই ইউনিট গঠন হলে একদিকে টাকা পাচার বন্ধের পাশাপাশি এনবিআরের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়বে।
সাধারণত আমদানিকালে তুলনামূলক বেশি দাম দেখিয়ে অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। মূলত মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এভাবে টাকা পাচার করা হয়। দুই বছর আগে এনবিআর পাচার টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও কেউ তা নেননি।
এনবিআরের দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, বিদেশি কূটনীতিক মিশনে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের জন্য এটাশে পদ সৃষ্টি করা। এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা এবং ট্রান্সফার প্রাইসিং ইস্যুটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। যেসব দেশ থেকে পণ্য আসে, সেখানে পণ্যের মূল্য কত, তা জানা সম্ভব হয় না। আবার নানাভাবে বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার হয়। এনবিআর বলছে, বিভিন্ন দূতাবাসে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বড় বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোতে রাজস্ব খাতে কর্মকর্তাদের জন্য এটাশে পদ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে এনবিআর। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, ভারতের মতো দেশ এমন পদ সৃষ্টি করেছে বলে এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এনবিআরের তৃতীয় সুপারিশ হলো, পাচার টাকা ফেরত আনতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া; যেসব দেশে পাচার হয়, সেখানে তদারকি ও পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি; আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করা। এসব করা হলে পাচার টাকা চিহ্নিত করে ফেরত আনা সহজ হবে। এ ছাড়া টাকা পাচারে সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলেছে এনবিআর।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, টাকা পাচারের কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় সরকার। টাকা পাচার বন্ধ করতে পারলে অর্থনীতি আরও চাঙা হবে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে টাকা পাচারের হিসাব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
দেশ থেকে কারা, কীভাবে, কোথায় টাকা পাচার হয়েছে- সেই চিত্র তুলে ধরে শ্বেতপত্রে বলা হয়, টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি- এসব কর্মকাণ্ডের অর্থ পাচার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মূলত বাড়ি কিনে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করে টাকা পাচার করা হয়।
মন্তব্য