কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি এবং খাদ্যসামগ্রীর চড়া দামে বর্তমানে অধিকাংশ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬০ মিলিয়ন মানুষও ভুগছে। এর ফলে সৃষ্ট বিদ্যুৎ সংকট ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি কিছু ক্ষেত্রে তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাকে সন্দিহান করে তুলছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা থেকে বেঞ্জামিন পার্কিন ও নয়াদিল্লি থেকে জন রিড যৌথভাবে এই নিবন্ধ লিখেছেন।
এতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংকট নানা ধরনের দুরবস্থার মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং সেসব দেশকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে, যারা আদর্শ উন্নয়ন অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবিবেচনাপ্রসূত ব্যয় করেছে। এটি এখন দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অর্জিত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল উদীয়মান অর্থনীতির অঞ্চলকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে, যা ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ঋণদাতাদের মধ্যে অন্যতম হলো বেইজিং। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের ওপর চীনের প্রভাবে ভারত বেশ অস্বস্তিতে আছে। চলমান সংকট তাদের হাতকে শক্তিশালী করার বিভিন্ন ইঙ্গিত তারা পাচ্ছে।
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মমর্তা এবং বর্তমানে জর্জ সরস পরিচালিত ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের প্রধান মার্ক ম্যালোক ব্রাউন এমনটাই বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘এই সংকট বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মডেলের দেশগুলোকে বিপদে ফেলছে। গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য জায়গার অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ধসে পড়ছে।’
দুই দশকের মধ্যে গত মে মাসে শ্রীলঙ্কা প্রথম এশিয়া-প্যাসিফিক দেশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় মানুষ বিক্ষোভ করে। ফলে তিনি সেনাবাহিনীর বিমানে গোপনে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
পাকিস্তানের আদালত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে শাস্তির রায় দিয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। যদিও দেশটি আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশগুলো থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে, যা তাকে ঋণখেলাপি হওয়া থেকে রক্ষা করবে। ছোট্ট দেশ নেপাল এবং মালদ্বীপও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে সুস্থ আছে, যার বড় কারণ এর সফল রপ্তানি খাত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও জলবায়ু পরিবর্তজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়তার জন্য আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করেছে। এ ফান্ড থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়নসহ বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ আরও ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দেশব্যাপী জনগণ প্রতিবাদ করেছে। বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য স্কুল ও অফিস সময় কমিয়ে এনেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয়ে বিলাস দ্রব্যের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘানা, ইথিওপিয়া থেকে চিলি পর্যন্ত বিভিন্ন উদীয়মান অর্থনীতির মিল রয়েছে, যেখানে আশির দশকের পর এই প্রথম বৈদেশিক ঋণ সংকট শুরু হয়েছে- যা সেখানে দীর্ঘদিনের সমস্যার কারণে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ জ্বালানি ও খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল, যেমন অপরিশোধিত তেল, কয়লা, খাদ্যসামগ্রী এবং ভোজ্যতেল। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে কেউ কেউ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশটির কাছে ঋণগ্রস্ত রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘যেখানে অন্য সব দেশ চাপের মুখে আছে, সেখানে বাংলাদেশ কোনো গভীর অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়ার মতো বিপদের মধ্যে নেই। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। ঋণদানকারীরা আমাদের প্রজেক্টগুলো সম্পর্কে জানেন, আমাদের ব্যালান্স শিট ভালোমতো জানেন। বাংলাদেশ অর্থ প্রদানের মতো দেশ।’
তিনি ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা ব্রিজের উদ্বোধনকে বিশেষ গুরুত্ব দেন, যা বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চীন নির্মিত স্থাপনা, যেটি ঢাকার সঙ্গে দেশের একটি বিশাল অংশের যাতায়াতের সময় সাশ্রয় করবে।
আইএমএফ বলেছে, জিডিপির ৩৯ শতাংশ ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ কোনো সংকটের মধ্যে নেই। এই ঋণের অনুপাত প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনেক কম। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেন্দ্র করে প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
যদিও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ভারতের উদ্বেগ তৈরি করেছে, তবে এটি এখনও সংকট থেকে নিরাপদে আছে। ফলে জুলাইয়ে দেশটি এর প্রতিবেশী দেউলিয়া রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।
ম্যালোক ব্রাউন বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ওপর চাপ একটি বিশাল সংকটের অংশ, যা বাস্তবিকই বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপদে ফেলে দেয়।’
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্য প্রণীত মার্শাল প্ল্যানের মতো করে একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে অর্জিত এই শিল্পকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের সহনশীলতা দেখতে পাবেন। পশ্চিম এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলোর সেদিকে তাকানো উচিত... এটিকে ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না।’
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে, যা নতুন দেশকে একটি দুর্ভিক্ষের মধ্যে ফেলে দেয়।
পরের দশকগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়, কর মওকুফ ও বৃহৎ বাজারগুলোতে ডিউটি ফ্রি সুবিধা পায় এবং নারী-পুরুষের বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বৈদেশিক রেমিট্যান্সও পুঁজি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৯১ সাল থেকে দারিদ্র্য ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে অর্ধেক কমে ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। সে সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতেও প্রভূত উন্নয়ন হয়। এর ফলে সাক্ষরতা ও শিশুমৃত্যুর হারেও অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। বর্তমানে বাংলাদেশের ২ হাজার ৫০০ ডলার মাথাপিছু আয় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ‘অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ কোথাও ছিল না, এমনকি মানচিত্রেও না। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে আমাদের কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে।’
১৯৮০ দশকের পর থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দেশের রপ্তানি খাতে ৪ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৮০ শতাংশ অবদান রাখছে, যা দেশের পোশাক শিল্প সমিতির মতে ৫০ বিলিয়ন ডলার। এখানে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এই উন্নতি শ্রমিকদের শোষণ ও ভয়াবহ কর্মপরিবেশের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে আছে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস, যেখানে প্রায় এক হাজার শ্রমিক মারা যান।
আশুলিয়ার ইউনিয়ন নেতা সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগের থেকে কর্মপরিবেশের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট না। এখনও দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৮ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার থেকে আর বাড়েনি। এই মজুরি জুলাই মাসের পর মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির বাস্তবতায় শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট নয়।
শামীম সরকারের ক্যাপ ফ্যাক্টরির অনেক শ্রমিকের মতোই ১৮ বছর বয়সী রেজওয়ানা আকতার দারিদ্র্যের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন কাজের খোঁজে। তার অনেক বন্ধুই এখন বিবাহিত এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে। এই ন্যূনতম মজুরি রেজওয়ানা আখতারের মতো নারীদের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি দিয়েছে। তবুও এখানে জীবন দুর্বিষহ থেকে গেছে, তার ঘরভাড়া বৃদ্ধির হতাশার মধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দেশের গার্মেন্টস শিল্প পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করে।
ঢাকাভিত্তিক পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেভিড হাসানাত জানান, তুলার দাম বর্তমানে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার কোম্পানি ক্রেতা থেকে পণ্যের দাম মাত্র ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে এই ব্যয় আমাদের অনেক বেশি ভোগাবে।’
বর্ধিত আমদানি ব্যয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যা গত বছরের ৪৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ৪০ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে। এটা পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তিতুমীর জানান, তিনি মনে করছেন বছরের শেষ নাগাদ এটি তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের কমে নেমে যাবে, যাকে অর্থনীতিবিদরা খুবই সংকটাপন্ন বলে মনে করেন।
মুডি অ্যানালিটিক্সের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতিবিদ স্টিভ কোকরেন বলেন, ১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেহেতু খুব বেশি বিপদে পড়েনি। তাই তারা এরপর গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোনিবেশ করেনি, যা তাদের এ বছরের সংকট থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারত।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান কখনই পলিসিমেকিংয়ে উন্নতি করার চেষ্টা করেনি, যা বাংলাদেশ করেছে। বরং তারা বার বার আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার জন্য দেনদরবার করেছে। আর তা কখনোই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে তাদের স্থির করতে এবং তারা তাদের পলিসিতে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
বিশেষভাবে, শ্রীলঙ্কা মহামারির আগে থেকেই বিভিন্ন সমস্যার পথ সৃষ্টি করেছে। দেশটি ২০১৯ সালে জনগণের কর মওকুফের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বন্ড বিক্রি ও চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নেয়, যে অর্থ পরে তারা আয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পাকিস্তানে ট্যাক্স কর্তন এবং রপ্তানি খাত দুর্বল হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ শিলান শাহ বলেন, ‘পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সমস্যা হলো, তাদের ঋণের অধিকাংশই ছিল বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী পুঁজি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।’
সময়োপযোগী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, শক্তিশালী কর্মক্ষেত্র ও জিডিপির তুলনায় ঋণের হার কম থাকায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এর অবস্থান এখনও স্থিতিশীল আছে। কিন্তু এই সংকট পুঁজি করে চীন আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করবে বলে নয়াদিল্লি উদ্বেগের মধ্যে আছে।
বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে উল্লেখ করে ডলার-টাকার বিনিময় হার এখন থেকে বাজারনির্ভরভাবে নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ আগামী জুন মাসের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের ঋণ কিস্তি পাবে বলেও জানান তিনি।
ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের দর-কষাকষি চলছিল। মূলত সে কারণে আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় করছিল না। এর মধ্যে গতকাল জানা যায়, বাংলাদেশ ডলারের বিনিময় আরও নমনীয় করতে রাজি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারে ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ৯ মাসে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি, তবুও বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। এ অবস্থায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, বাজারভিত্তিক করায় হঠাৎ করে ডলারের রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেট ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে এবং তা সেখানেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ডলারের রেট দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা-সরবরাহ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে, বাইরের দেশের নির্দেশে নয়। বর্তমানে বাজারে ডলারের সরবরাহও পর্যাপ্ত রয়েছে।
তবে, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দুবাইভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. মো. হাবিবুর রহমান, কবির আহমেদ, উপদেষ্টা আহসান উল্লাহ এবং নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার একত্রে ছাড় করবে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সকল বিষয় সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে উভয়পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং বিনিময় হার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনার লক্ষ্যে চতুর্থ রিভিউ সম্পন্ন হওয়ার পর উভয় রিভিউয়ের জন্য নির্ধারিত কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে বলে বিগত তৃতীয় রিভিউয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ রিভিউয়ের সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ব্যাংক-ফান্ড সভায় এবিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল।
এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা জুন মাসের মধ্যে পাবে বলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ অর্থ পাওয়া গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসকল সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। এ সকল সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কারিগরি সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। পরস্পরের ওপর আরোপ করা পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য শুল্ক ৯০ দিনের জন্য ব্যাপক পরিসরে কমাতে একমত হয়েছে দুই দেশ। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তেজনা কমাতেই এই চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। খবর বিবিসির।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের আগে চীনের ওপর মার্কিন শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। পরে নতুন শুল্ক যখন ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন তখন তিনি বলেছিলেন তিন মাস সবার জন্য বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক হার প্রযোজ্য হবে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, গঠনমূলক ও দৃঢ় আলোচনার পর উভয় দেশ ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করতে রাজি হয়েছে। এর আওতায় দেশ দুটি পারস্পরিক শুল্ক ১১৫ শতাংশ কমাবে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত বর্তমান ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। অন্যদিকে চীন মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপ করা ১২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। উভয় দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, আগামী ১৪ মে থেকে শুল্কের এই কাঁটছাট কার্যকর হবে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে স্কট বেসেন্ট বলেন, আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আমাদের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। দুই পক্ষের প্রতিনিধিদলই একমত হয়েছে যে তারা বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না। মার্কিন অর্থমন্ত্রী বলেন, উভয় দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে। আমাদের লক্ষ্য ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের পথে অগ্রসর হওয়া এবং এটি তারই সূচনা।
প্রথম দফায় শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল এবং বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও জোরালো হয়েছিল। তবে এবার এই চুক্তির ঘোষণায় বিশ্ব শেয়ারবাজারে তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
শুল্ক কমানোর চুক্তির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাজারে চাঙাভাব দেখা দেখা গেছে। হংকংয়ের প্রধান সূচক ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ স্টক ফিউচারের উত্থান হয়েছে। এছাড়া বাড়তি শুল্ক স্থগিতের খবরে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের দর বেড়ে ছয় মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় শেয়ারবাজারগুলোও উচ্চমুখী প্রবণতায় লেনদেন শুরু করে এবং মার্কিন বাজারগুলোও ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে, এই সময়সীমার মধ্যে চীনের উচিত হবে ফেন্টানিল নামক ভয়াবহ মাদকের অবৈধ রপ্তানি বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। এ বিষয়ে চীনের সদিচ্ছা দেখে ওয়াশিংটন আশাবাদ প্রকাশ করেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের প্রবেশ ঠেকাতে চীন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন।
টাকা পাচার ঠেকাতে বিশেষ ইউনিট গঠন করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মূলত বাণিজ্যের আড়ালে যে বিদেশে টাকা পাচার হয়, তা প্রতিরোধ করতেই এমন উদ্যোগ। দুই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয় বলে মনে করে এনবিআর। এগুলো হলো-আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা এবং ট্রান্সফার প্রাইসিং। এসব কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লোকসান হয় বলে মনে করে এনবিআর।
সম্প্রতি এনবিআর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল নামে ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। সেখানে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) উদ্ধৃতি দিয়ে এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের আড়ালে (মিথ্যা ঘোষণা) ৭০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
টাকার পাচার রোধে এনবিআর তিনটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে। প্রথমত, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার ঠেকাতে দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে বিশেষায়িত একটি ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। এই ইউনিটের সদস্যরা প্রতারণা হয় বা হতে পারে- এমন বিল অব এন্ট্রিগুলো তদারকি ও তদন্ত করবেন। এই ইউনিট গঠন হলে একদিকে টাকা পাচার বন্ধের পাশাপাশি এনবিআরের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়বে।
সাধারণত আমদানিকালে তুলনামূলক বেশি দাম দেখিয়ে অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। মূলত মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এভাবে টাকা পাচার করা হয়। দুই বছর আগে এনবিআর পাচার টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও কেউ তা নেননি।
এনবিআরের দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, বিদেশি কূটনীতিক মিশনে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের জন্য এটাশে পদ সৃষ্টি করা। এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা এবং ট্রান্সফার প্রাইসিং ইস্যুটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। যেসব দেশ থেকে পণ্য আসে, সেখানে পণ্যের মূল্য কত, তা জানা সম্ভব হয় না। আবার নানাভাবে বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার হয়। এনবিআর বলছে, বিভিন্ন দূতাবাসে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বড় বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোতে রাজস্ব খাতে কর্মকর্তাদের জন্য এটাশে পদ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে এনবিআর। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, ভারতের মতো দেশ এমন পদ সৃষ্টি করেছে বলে এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এনবিআরের তৃতীয় সুপারিশ হলো, পাচার টাকা ফেরত আনতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া; যেসব দেশে পাচার হয়, সেখানে তদারকি ও পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি; আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করা। এসব করা হলে পাচার টাকা চিহ্নিত করে ফেরত আনা সহজ হবে। এ ছাড়া টাকা পাচারে সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলেছে এনবিআর।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, টাকা পাচারের কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় সরকার। টাকা পাচার বন্ধ করতে পারলে অর্থনীতি আরও চাঙা হবে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে টাকা পাচারের হিসাব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
দেশ থেকে কারা, কীভাবে, কোথায় টাকা পাচার হয়েছে- সেই চিত্র তুলে ধরে শ্বেতপত্রে বলা হয়, টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি- এসব কর্মকাণ্ডের অর্থ পাচার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মূলত বাড়ি কিনে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করে টাকা পাচার করা হয়।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি এবং আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার চার দিনের চীন সফরের তৃতীয় দিন শুক্রবার দুই দেশের মধ্যে এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও স্মারকগুলো স্বাক্ষর হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ফেসবুক পোস্টে জানানো হয়, সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুই দেশের কালজয়ী সাহিত্য ও শিল্পকর্মের অনুবাদ ও সৃজন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও খবর আদান-প্রদান, গণমাধ্যম, ক্রীড়া এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিময় সহযোগিতা। এর পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে পাঁচ বিষয়ে সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে।
এগুলো হলো বিনিয়োগ আলোচনা শুরু করা, চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, একটি রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং একটি কার্ডিয়াক সার্জারি গাড়ি অনুদান।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের উত্থাপিত বিষয়গুলো চীন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং।
স্থানীয় সময় শুক্রবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট এ কথা জানান।
ড. ইউনূসের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের বৈঠককে অত্যন্ত সফল উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ইউএনবিকে বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশকে দেওয়া চীনা ঋণের সুদের হার কমানো ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দেশটির সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি ছিল।’
তিনি বলেন, ‘বৈঠকে আলোচনা অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ, গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ হয়েছে।’
প্রেস সচিব বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এটি ছিল প্রথম দ্বিপক্ষীয় বিদেশ সফর। এখন পর্যন্ত এটি একটি বড় সফলতা।’
প্রেসিডেন্ট শির বক্তব্যের বরাতে শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপনে চীন তার দেশের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট শি ফুজিয়ান প্রদেশের গভর্নর থাকাকালীন দুইবার বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন। সে কথাও উল্লেখ করেছেন চীনের রাষ্ট্রপ্রধান।
প্রেসিডেন্ট শির উদ্বৃতি দিয়ে শফিকুল আলম বলেন, তিনি বাংলাদেশি আম ও কাঁঠাল খেয়েছেন। এগুলো সুস্বাদু। আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশ আগামী মৌসুমে এ দুটি ফল চীনে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করবে।
চীনা প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা চীনের পিপলস গ্রেট হলে করা বৈঠকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
তারা দুই দেশের সম্পর্ককে জোরদার করা ও ঢাকা-বেইজিংয়ের পারস্পরিক ও কৌশলগত স্বার্থকে এক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার উপায় নিয়েও আলোচনা করেন।
আরও পড়ুন:বাংলাদেশের বাজারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সি৩২ ইলেকট্রিক বাইক এনেছে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড রিভো। অত্যাধুনিক ৭২ ভোল্ট ২৬ অ্যাম্পিয়ার সম্পূর্ণ গ্রাফিন ব্যাটারি পরিচালিত এই ইলেকট্রিক বাইকের উদ্বোধন ঘোষণা করেন রিভো বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ভেন নি।
ফিচার
সি৩২-এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য শক্তিশালী ১৮০০ ওয়াট মোটর, যা ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্স নিশ্চিত করে। বাইকটির ইকো মোডে গতি ৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টা এবং একবার চার্জে এটি ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে।
অন্যদিকে স্পোর্ট মোডে সর্বোচ্চ গতি ৬০ কিলোমিটার/ঘণ্টা এবং এক চার্জে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
সি৩২ ইলেকট্রিক বাইকে উন্নত ৭২ ভোল্ট ২৬ অ্যাম্পিয়ার গ্রাফিন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে, যা পাঁচ শতাধিক চার্জিং সাইকেল সাপোর্ট করে এবং প্রতিটি পূর্ণ চার্জে মাত্র ২.০৮ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে।
ব্যাটারিটি সম্পূর্ণ চার্জ হতে ১০.৬ ঘণ্টা সময় নেয়, যা রাতে চার্জ দিয়ে দিনব্যাপী ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত।
নিরাপত্তা এবং আরামকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে রিভো সি৩২। এতে রয়েছে সামনে ডিস্ক ব্রেক এবং পিছনে ড্রাম ব্রেক সিস্টেম, যা সর্বোচ্চ স্টপিং পাওয়ার নিশ্চিত করে।
ফ্রন্ট ও রিয়ার হাইড্রোলিক সাসপেনশন থাকার ফলে রাইডাররা মসৃণ ও আরামদায়ক রাইড উপভোগ করতে পারেন। এমনকি অপ্রশস্ত বা অসমান রাস্তাতেও।
রাতে নিরাপদ যাত্রার জন্য সি৩২-এ রয়েছে পূর্ণ এলইডি লাইটিং সিস্টেম, যার মধ্যে এলইডি হেডলাইট, টেইললাইট এবং টার্ন সিগন্যাল অন্তর্ভুক্ত।
রিভো সি৩২ শুধু শক্তিশালী পারফরম্যান্সই দেয় না, এটি ডিজাইনেও বেশ কার্যকর। ১৪০ কেজি ওজনের মজবুত অথচ হালকা ফ্রেম এবং সামনে ও পিছনে ৯০/৮০-১২'' ভ্যাকুয়াম টায়ার যুক্ত বাইকটি দুর্দান্ত গ্রিপ এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করে।
২০৫ এমএম পর্যন্ত গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স থাকায় এটি যেকোনো ধরনের রাস্তার জন্য উপযোগী। সিট বাকেটে ২৪ লিটার স্টোরেজ স্পেস রয়েছে, যা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বহনের জন্য আদর্শ।
ব্যবহারকারীবান্ধব ডিজাইন এবং আরামের সমন্বয়ে এটি শহরের যাতায়াতকারী এবং দূরপাল্লার রাইডারদের জন্য একটি পারফেক্ট পছন্দ।
এখন থেকে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যে বাংলাদেশের সব শোরুমে পাওয়া যাচ্ছে।
সি৩২ যাতায়াতকে সহজ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করতে উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী পারফরম্যান্স নিশ্চিত করছে, যা প্রতিদিনের যাত্রীদের পাশাপাশি পরিবেশ সচেতন রাইডারদের জন্য আদর্শ হতে পারে।
আরও পড়ুন:আলু রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এ স্থলবন্দর দিয়ে নতুন করে আরও ১০৫ টন আলু গিয়েছে নেপালে।
এ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৫৫৪ টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হলো।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কোয়ারিনটিন ইন্সপেক্টর উজ্জল হোসেন জানান, বুধবার বিকেলে স্থলবন্দর দিয়ে পাঁচটি ট্রাকে ১০৫ টন আলু নেপালে গেছে।
তিনি জানান, আলুগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এগুলো রপ্তানি করছে থিংকস টু সাপ্লাই ও ফাস্ট ডেলিভারি নামে দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে থিংকস টু সাপ্লাই ৪২ ও ফাস্ট ডেলিভারি ৬৩ টন রপ্তানি করে। এ ছাড়াও বন্দরটি দিয়ে হুসেন এন্টারপ্রাইজ, ক্রসেস এগ্রো, সুফলা মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং লোয়েড বন্ড লজিস্টিক নামের কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও নেপালে আলু রপ্তানি করছে।
উজ্জ্বল হোসেন বলেন, রপ্তানিকারকরা প্রয়োজনীয় নথিসহ অনলাইনে আবেদন করলে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের ল্যাবে পরীক্ষা করার পর ফাইটোসেনেটারি সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। রপ্তানিকৃত আলুগুলো স্টারিজ এবং লেডিও রোজেটা জাতের।
মন্তব্য