ভয়-আতঙ্কে থমকে আছে ডলারের বাজার। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই উধাও; লেনদেন নেই বললেই চলে। অতি গোপনে দু-একটা লেনদেন হচ্ছে। গত সপ্তাহের তেজিভাবও কমে এসেছে।
খোলাবাজারে সোমবার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। গত মঙ্গলবার এক লাফে ১১২ টাকায় উঠে গিয়েছিল ডলার।
ব্যাংকগুলোতেও একই অবস্থা। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার যে দামে নগদ ডলার বিক্রি করেছিল ব্যাংকগুলো, চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই দিন রোব ও সোমবারও সেই দামেই ডলার বিক্রি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক সোমবার ১০২ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। বেসরকারি ইস্টার্ন ও সিটি ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য নিয়েছে ১০৭ টাকা।
গত কয়েক দিনের মতো ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে সোমবার ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটাকে আন্তব্যাংক বা ইন্টারব্যাংক রেট বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এই রেট গত এক মাসের বেশি সময় ধরে কার্যত অচল।
ব্যাংকগুলো এখনও এই দরের চেয়ে ৬ থেকে ১২ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। আবার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ১০৪-১০৫ টাকা দিয়ে। আমদানি ঋণপত্র খুলতেও নিচ্ছে ১০৪-১০৫ টাকা।
খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকির কারণে অনেক ব্যবসায়ীই ডলার কেনাবেচা করতে ভয় পাচ্ছেন।
খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গত বুধবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জারে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পাশাপাশি অবৈধভাবে ডলার মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ফলে ডলারের বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সোমবারও এনএসআই সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ পরিদর্শন অব্যাহত থাকবে। রেমিট্যান্স বাড়ছে। আমদানি কমছে। আশা করছি খুব শিগগিরই ডলার বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় সোমবার খোলাবাজারে কোনো ডলার কেনাবেচা হতে দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে ব্যবসায়ীরা ডলার কেনাবেচা করতে ভয় পাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কার্ব মার্কেটের এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে আছি ভাই আমরা। দুই দিন বাসা থেকে বেরই হইনি। খবর নিয়ে জেনেছি, কোনো ব্যবসায়ীই ডলার কেনাবেচা করছে না। একটা-দুইটা লেনদেনের খবর পেয়েছি; তাও খুব গোপনে হয়েছে।’
বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছিল, ডলারের বাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছিল। পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছিল ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছিল, সেই সঙ্গে পড়ছিল টাকার মান।
কয়েক মাস ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা ঠিক করে দিয়েছে, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামকে আন্তব্যাংক দর বলা হয়ে থাকে। এই দর আসলে এখন অচল। বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দরে ডলার কেনাবেচা করতে ব্যাংকগুলোকে কোনো চাপ দিচ্ছে না।
ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো দামে তাদের নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করছে; নগদ ডলারও বিক্রি করছে অনেক বেশি দামে।
এ হিসাবে এক বছরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর ব্যাংক ও খেলাবাজারে বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।
এদিকে বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবারও ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৪ কোটি (১.১৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা) তুলে নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:সার্বিক লোন কার্যক্রম সহজ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে এবার সেন্ট্রালাইজড ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের (সিএডি) আধুনিকায়ন ও কেন্দ্রীয়করণ করেছে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী তারেক রিয়াজ খানের তত্ত্বাবধানে চলছে কেন্দ্রীয়করণ বিপ্লব। তারই অংশ এই ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট।
৭ আগস্ট পদ্মা ব্যাংকের মিরপুর ট্রেনিং ইনিস্টটিউটে ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের আধুনিকায়ন ও কেন্দ্রীয়করণের উদ্বোধন করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খান।
তিনি বলেন, ‘একটি ব্যাংকের অন্যতম বড় শক্তি হল সিএডি। তাদের শক্তিশালী করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ব্যাংকের আর্নিং অ্যাসেটের মান উন্নয়নের পাশাপাশি কোনো লোন যাতে ব্যাড লোন হয়ে না যায় তা এখন আগে থেকেই তদারকি করা যাবে। সবকিছু যাচাই বাছাই করে দেয়া হবে প্রতিটি লোন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারিতে এখন অনেক কিছু সহজ ও দ্রুত সময়ে শেষ করা সম্ভব হবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আহসান চৌধুরী, এসইভিপি ও আরএমডি অ্যান্ড ল’ হেড ফিরোজ আলম, এসইভিপি ও প্রিন্সিপাল মিরপুর ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট সাবিরুল ইসলাম চৌধুরী, এসভিপি ও হেড অব ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট হাবিবুর রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও কমছে না মুদ্রাটির তেজি ভাব, কাটছে না সংকট।
ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে কয়েক মাস ধরে। বেড়েই চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই মুদ্রার দর। কমছে টাকার মান। দুই মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ; এক বছরে বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি।
বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ৮ দিনে (১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট) বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ১৫০ কোটি (দেড় বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোমবারও রাষ্টায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন সংস্থা বাংলাাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেল আমদানি এবং বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এ হিসাবে এই ১ মাস ৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৪ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কখনোই এত কম সময়ে ব্যাংকগুলোর কাছে এত বেশি ডলার বিক্রি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি উল্লম্ফন ও আমদানি ব্যয় কমায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ এটি। যখন বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দেবে তখন ডলার বিক্রি করা হবে। আবার যখন সরবরাহ বেশি হবে তখন কেনা হবে।’
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, এখন বেশি বিক্রি করা হচ্ছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাণ্ডবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব দেশের মতো আমাদেরও আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণেই বেশি ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়ছে।
‘তবে সুখের খবর হচ্ছে, আমদানি কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বাড়ছে। শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
এদিকে কিছুদিন ‘স্থির’ থাকার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে আরও ৩০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে সোমবার এক ডলারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৯৫ টাকা।
এর আগে সবশেষ ২৫ জুলাই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমে দাঁড়ায় ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা।
অন্যদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে সোমবার ডলারের দর উঠেছে ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলারও বেশি দামে বিক্রি করেছে। সিটি ব্যাংক ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এসআইবিএল থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা ২৫ পয়সা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক সোমবার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৪ টাকায়। জনতা ব্যাংক থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা। আর সোনালী ব্যাংক নিয়েছে ১০২ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৭ শতাংশের মতো। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১২ শতাংশ।
খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়লে মুদ্রা বিনিময়ের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ব্যাংক থেকে ডলার কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে থাকে। এখন ব্যাংকেও ডলারের সংকট। এ জন্য অনেক ব্যাংক এখন উল্টো খোলাবাজারে ডলার খুঁজছে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। তারপরও সংকট কাটছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, ব্যাংকগুলোতে তার চেয়ে ৭ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০৫ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনেক ব্যাংক ১১০ টাকা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচটি দেশি এবং একটি বিদেশি ব্যাংক। সোমবার ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লেখা চিঠিতে এই নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনার পর এবার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার
ডলার বিক্রির কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ চাপের মধ্যে রয়েছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসের ৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির ফলে আরও কমে গেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক।
আরও পড়ুন:প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচটি দেশি এবং একটি বিদেশি ব্যাংক।
দেশি পাঁচ ব্যাংক হচ্ছে- ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ও সাউথইস্ট ব্যাংক। আর বিদেশি ব্যাংকটি হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম সোমবার রাতে নিউজবাংলাকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘ট্রেজারি অপারেশনে অতিরিক্ত মুনাফা করায় পাঁচটি দেশি এবং একটি বিদেশি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায় জরুরিভিত্তিতে ওই ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণ করতে সোমবার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
এদিকে কিছুদিন ‘স্থির’ থাকার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে আরও ৩০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে সোমবার এক ডলারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৯৫ টাকা।
এর আগে সবশেষ ২৫ জুলাই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমে দাঁড়ায় ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা।
অন্যদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে সোমবার ডলারের দর উঠেছে ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলারও বেশি দামে বিক্রি করেছে। সিটি ব্যাংক ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এসআইবিএল থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা ২৫ পয়সা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক সোমবার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৪ টাকায়। জনতা ব্যাংক থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা। আর সোনালী ব্যাংক নিয়েছে ১০২ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে টাকা-ডলার বিনিময় হার ঠিক হয়ে থাকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। সোমবার ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। দাম নির্ধারিত হয়েছে ৯৫ টাকা। আর এটাই আজকের আন্তব্যাংক দর।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৭ শতাংশের মতো। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১২ শতাংশ।
খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়লে মুদ্রা বিনিময়ের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ব্যাংক থেকে ডলার কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে থাকে। এখন ব্যাংকেও ডলারের সংকট। এ জন্য অনেক ব্যাংক এখন উল্টো খোলাবাজারে ডলার খুঁজছে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। তারপরও সংকট কাটছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, ব্যাংকগুলোতে তার চেয়ে ৭ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০৫ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনেক ব্যাংক ১১০ টাকা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
আরও পড়ুন:ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাজধানীর মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে রোববার এই সভা হয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ ইসলামী ব্যাংক শাখার সহযোগিতায় আয়োজিত এ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল হাসানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ব্যাংকের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতিন, পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও অধ্যাপক কাজী শহীদুল আলম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আ. ব. ম ফারুক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান লাল্টু, ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাকসুদুর রহমান, ইসলামী ব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিষদ শাখার সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম (মেহেদী) ও সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান সাইদ বক্তব্য রাখেন।
দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন ব্যাংকের শরীআহ সেক্রেটারিয়েটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ শামসুদ্দোহা। অনুষ্ঠানে প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি বিভাগ থেকে এক সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘বিদেশে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ বা অফশোর ট্যাপ অ্যামনেস্টি বিধান সংক্রান্ত বিধিবিধান শাখা পর্যায়ে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রদর্শন করতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের মধ্যে তা বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থ আইনের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা যুক্ত করে সরকার করদাতাদের বিদেশে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থ আয়কর রিটার্নের মাধ্যমে প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, করদাতারা তাদের বিদেশে থাকা নগদ টাকা, ব্যাংকের আমানত, যেকোনো ধরনের ব্যাংক নোট এবং কনভার্টেবল সিকিউরিটিজ বা ইনস্ট্রুমেন্ট দেশের আয়কর রিটার্নে বিনা প্রশ্নে দেখাতে পারবেন। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এসব অর্থ দেশে আনতে হবে। এজন্য তাদের ঘোষিত অর্থের ৭ শতাংশ কর দিতে হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছর কার্যকর হওয়ার শুরুর দিন ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কেউ অবশ্য এ সুযোগ নেননি।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ৩১১ জন করদাতা ঘোষণা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ করেছেন। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর হিসেবে পেয়েছে ১১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি।
আরও পড়ুন:খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১৫ টাকা পেরিয়ে গেছে। সোমবার দুপুরে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার রেকর্ড ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না।
দেশে মুদ্রাবাজারের ইতিহাসে এক দিনে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের এতটা অবমূল্যায়ন হয়নি। এর আগে ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ১১২ টাকা।
প্রতি ডলার ১০৮ থেকে ১১০ টাকা দরে সোমবার খোলাবাজারে বেচাকেনা শুরু হয়। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে তা ১১৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ডলারের দর অনেক বেড়েছে।
খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে শেয়ারবাজারের মতো বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ।
রাজধানীর মতিঝিলে যমুনা মানি এক্সচেঞ্জের স্বত্বাধিকারী আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে ডলারের সংকট। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার নেই। অনেকে ডলার কিনে ধরে রাখতে চাইছে। এ জন্য লাগামহীন দর বাড়ছে।’
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকও কম আসছেন। এ কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ কমে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেশ কিছুদিন ধরেই টানা কমছে। সোমবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও ২৫ পয়সা বৃদ্ধি পায়। প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে।
আরও পড়ুন:২০১০ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি আয় ১৫ টাকা ৫৫ পয়সা। আর এক যুগ পর ২০২২ সালের অর্ধবার্ষিক হিসাব শেষে শেয়ারপ্রতি লোকসান ৫৪ পয়সা। এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংক বা এনবিএলের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪৪১ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার ২৮০ টাকা। সে সময় শেয়ার সংখ্যা ছিল ৪৪ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ১২৮টি। ওই বছর ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৬৮৬ কোটি ৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪০ টাকা।
প্রতি বছর বোনাস শেয়ার দিতে দিনে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ারসংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। বর্তমানে পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৭৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭১০ টাকা। শেয়ারসংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৭ টাকা।
এই হিসাবে ছয় মাসে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ১৭৩ কোটি ৮৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬৮ টাকা। লোকসানের এই বৃত্ত থেকে বের হতে না পারলে বছর শেষে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটির শেয়ারদরও কমতে কমতে তলানিতে নেমেছে। ২০১০ সালে শেয়ারদর ছিল ২০০ টাকা ছাড়িয়ে, এখন তা অভিহিত মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমেছে। একপর্যায়ে ৬ টাকাতেও লেনদেন হয়েছে।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের অঙ্কটা ৬ হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালকদের সঙ্গে দুই দিন আলোচনায় বসেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
যে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে টেনে তোলার কথা গভর্নর বলেছেন, তার মধ্যে তিনি নাম উল্লেখ করেছেন কেবল ন্যাশনালের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা উত্তরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। একে একে ১০ ব্যাংকের সঙ্গে এ রকম সভা হবে। তবে কোনো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে সভা হবে, তা জানি না।’
ব্যাংকটির এই দশার কারণ আকাশচুম্বী খেলাপি ঋণ, যেগুলোর আদায় হওয়ার আশা ক্ষীণ। নামে-বেনামে ঋণ, পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বসহ নানামুখী সংকটে থাকা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দেশের যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি। ফলে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ব্যাংকটির কারণে।
ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে লোকসানি
কোনো একটি কোম্পানির এক বা দুই প্রান্তিক খারাপ হতেই পারে। তবে এনবিএলের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে আগের বছরের চেয়ে খারাপ করেছে ব্যাংকটি।
এনবিএলের পতন শুরু মূলত ২০১২ সাল থেকে। ২০১০ সালে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করার পর শেয়ারসংখ্যা ও পরিশোধিত মূলধন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পর এক বছর অবস্থান অনেকটাই ধরে রাখে ব্যাংকটি।
২০১১ সালে শেয়ারসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৯টি। ওই বছর ব্যাংকটি শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ৭ পয়সা হিসেবে মুনাফা করে ৬০৮ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭৮৯ টাকা। তবে পরের বছর থেকে তা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে।
২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৬ সালে এনবিএল শেয়ারপ্রতি আয় করে ২ টাকা ৮৪ পয়সা। পরের বছর তা কমে হয় ২ টাকা ২ পয়সা। ২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি আয় আরও কমে হয় ১ টাকা ৪৫ পয়সা, যা পরের বছর নেমে হয় ১ টাকা ৪১ পয়সা।
২০২০ সালে আয় আরও কমে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১৮ পয়সায় নামে যা ২০২১ সালে নামে শেয়ারপ্রতি ১২ পয়সা। অর্থাৎ ওই বছর মুনাফা হয় ৩৮ কোটি ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪৮ টাকা।
মুনাফা তলানিতে নামার পর প্রথমবারের মতো পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা এনবিএল থেকে কোনো লভ্যাংশ পাননি। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১৮ পয়সা লোকসান দেয়ার পর দ্বিতীয় প্রান্তিকের অবস্থা আরও খারাপ হয়। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়ায় ৩৬ পয়সা।
অর্থাৎ দুই প্রান্তিক মিলিয়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫৪ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে এই আয় ছিল ২৮ পয়সা।
৩০ জুন শেষে এনবিএলের শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১৫ টাকা ৪৯ পয়সা। গত ডিসেম্বরে তা ছিল ১৭ টাকা ২৯ পয়সা।
পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাঁচ গুণ
২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। সেটি বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশই ফিরে আসেনি। এর মধ্যে করোনার দুই বছর ২০২০ আর ২০২১ সালেই খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২২ লাখ টাকা।
২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৭৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
করোনা মহামারির সময় ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়, ২০২০ সালের পুরো সময় ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি হবে না। পরের বছর সুবিধা কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়।
ব্যবস্থাপনা-অনিয়মের অভিযোগ
গত কয়েক মাসে এনবিএলের ঋণসহ নানা বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে ব্যাপক। এবার ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টি উঠে এলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। অনিয়ম থেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও দেয়া হয় ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কিছুদিন কোনো পর্ষদ সভা না হলেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।
গত বছরের মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে ব্যাংকটিকে নতুন করে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি ব্যাংকটির জন্য বড় অঙ্কের ঋণ ও একক গ্রাহকের ঋণসীমা নতুনভাবে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে নতুন করে ঋণ দিতে হলে ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি বিতরণ করা ঋণ আদায় বাড়ানোর কথা বলা হয়।
এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে ব্যাংকে ঋণসহ নানা অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঋণ বিতরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর আবারও বড় অনিয়ম শুরু হয়।
চলতি বছরের ১২ মে ব্যাংকটি কোন কোন খাতে ঋণ দিতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে এসএমই ঋণ, কৃষিঋণ, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দেয়া ঋণ, জমা থাকা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ, শতভাগ নগদ জমা দিয়ে ঋণপত্র (এলসি) ও অন্যান্য পরোক্ষ ঋণ (নন-ফান্ডেড) সুবিধা।
এসব বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ
সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর বেহাল দশায় জর্জরিত কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা উত্তরণে উদ্যোগ নিয়েছেন।
এরই অংশ হিসেবে ১৮ জুলাই এনবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়ে এনবিএলের সার্বিক আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়নের জন্য ২৪ জুলাই এক পর্যালোচনা সভায় যোগ দিতে বলা হয়। ওই সভায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান, এমডি ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাকে (সিএফও) উপস্থিত থাকতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২৪ জুলাই ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভুঁইয়া, পরিচালক খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন, এমডি মেহমুদ হোসেন এবং ২৫ জুলাই ব্যাংকটির পরিচালক রন হক সিকদার ও এমডি মেহমুদ হোসেন গভর্নরের সঙ্গে সভা করেন।
সভায় নিয়মের মধ্যে থেকেই ব্যাংক চালাতে হবে মর্মে কঠোর বার্তা দেন গভর্নর।
আরও বলা হয়, ব্যাংকটির খারাপ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা চুক্তি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। চুক্তিতে ব্যাংকটির সব পরিচালককে সই করতে হবে। এতে তিন বছরে কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে, তা উল্লেখ থাকবে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য