রাজিয়া সুলতানা। নওগাঁর বাসিন্দা। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে এক লিটারের বোতল ১৮৫ টাকা নির্ধারণের সাত দিন পর বাজারে গিয়ে হতাশ।
শহরের পৌর খুচরা বাজারে তিনটি দোকান ঘুরেও নতুন দামে কোথাও তেল পেলেন না। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক দোকানি বলছেন নতুন দামের তেল নেই। আগের দামে হলে তেল নিতে পারেন। আমার মনে হয় এক ধরনের প্রতারণা করছেন, তারা বেশি দামে তেল বিক্রির জন্য। এগুলো প্রশাসনের দেখা উচিত।’
শহরের মুক্তির মোড়ে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা হলো মেবারক হোসেনের। তিনিও ২০০ টাকা লিটারে তেল কিনলেন।
মোবারক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু বলার নেই, কেউ মানে ঠিকমতো নিয়ম? বাজার মনিটরিং করা দরকার। এখন তেল রেখেই যদি বলে নতুন দামের তেল নাই কী করে বুঝব বলেন?’
সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর করার ঘোষণা এসেছে ২১ জুলাই থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী এক লিটারের বোতল ১৮৫ টাকা আর পাঁচ লিটারের বোতলের দাম হওয়ার কথা ৯১০ টাকা।
খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৬৬ টাকা আর পামঅয়েল বিক্রি করার কথা সর্বোচ্চ ১৫২ টাকা।
দেশের বাজারে যে ঘটনাটি বরাবর দেখা যায়, সেটি দেখা যাচ্ছে আবার। রাজধানীতে কড়াকড়ির কারণে নতুন দাম কার্যকর হতে দেখা গেলেও মফস্বলের চিত্র ভিন্ন। সেখানে কোনো কোনো জেলায় নতুন দামের বালাই নেই, কোনো কোনো জেলায় কেউ আগের দামে কেউ নতুন দামে বিক্রি করছেন। একই জেলায় দেখা গেছে, শহরে নতুন দামে তেল বিক্রি হলেও গ্রামে বেশি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ঘোষণা এলে ব্যবসায়ীরা তা কার্যকর করেন সঙ্গে সঙ্গে। আগের কম দামের পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। কিন্তু কমার ঘোষণা এলে দেখা যায়, এই ব্যবসায়ীরাই আগে বেশি দামে কেনা উল্লেখ করে নতুন দাম কার্যকর করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেন।
গত ২৬ জুন লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে এক লিটারের বোতল ১৯৯ টাকা করার পরও এই চিত্র দেখা গেছে। নতুন দাম কার্যকর হতে সময় লেগে যায় দুই সপ্তাহেরও বেশি।
অথচ আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য যেটি ঘোষণা করা হয়, তখন এর চেয়ে বেশি রাখার কোনো সুযোগই নেই।
রাজিয়ার মতোই নওগাঁর আরেক বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, ‘চারটি দোকান ঘুরে নতুন দামে তেল পেলাম। যে দোকানে যাই তারা বলে তেল নাই, আবার অনেক দোকানি বলছেন আগের দামের তেল আছে। এগুলোর মানে কী?’
মুক্তির মোড় এলাকার রাজন স্টোরের মালিক রাজন আলী বলেন, ‘আমাদের দোকানে আগের দামের তেল ছিল যা বিক্রি করছি আগের রেটেই। সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে নতুন দামের তেল তুলব দোকানে। তারপর সরকার বেঁধে দেয়া দামেই আমরা বিক্রি করব।’
শহরের কেডির মোড়ের খোকন স্টোরের মালিক খোকন হোসেন বলেন, ‘আমার দোকানে আগের দামের তেল এখনও আছে, তাই সেই দামেই বিক্রি করছি। প্রতি লিটার তেল ২০০ টাকা লিটারে বিক্রি করছি।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, ‘কোনো ক্রেতা আমাদের অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কম দামের তালিকা ‘পাননি’ ব্যবসায়ী বিক্রেতা
রংপুর সিটি বাজারে হারুণ স্টোরের কর্মচারী সিরাজ মিয়া দাবি করেছেন, তেলের দাম যে কমেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তালিকা না পাওয়ায় তিনি আগের দামে বিক্রি করছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরাও নতুন রেট পাইনি। আগের দরে বিক্রি করছি।’
মকবুল হোসেন নামে মুদি দোকানি জানান, এক লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। কারণ, আগে থেকে কিনে রাখা তেল বিক্রি এখনও শেষ হয়নি। আরেক দোকানি বলেন, সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
বাজারের রংপুর স্টোরের মালিক আশিক আলী বলেন, ‘আমরা বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ের রেটের চেয়েও কম দামে বিক্রি করছি। এখনও নতুন কোনো তালিকা আমরা পাইনি।’
তিনি জানান, ফ্রেস কোম্পানির ৫ লিটার তেলের বোতলের গায়ের দাম ৯৯০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করছেন ৯০০ টাকায়। হাফ লিটার তেলের দাম ১০৮ টাকা থাকলেও বিক্রি করছেন ১০০ টাকায়।
বাজারে তেল কিনতে আসা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ধাপ্পাবাজির শেষ নেই। তারা বলছে আগে বেশি দামে কিনেছে, তাই এখন বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে করে সরকারি নির্দেশনার দাম থাকল কই?’
মোহাম্মদ আলী নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘যখন দাম বাড়ার খবর ওঠে তখনই দাম বাড়ে । আর এতদিন হলো দাম কমার এখনো ওরা (ব্যবসায়ী) জানেই না তেলের দাম কমেছে। সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া।’
রংপুর ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, ‘আমরা বাজার মনিটরিং করছি। বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করা হচ্ছে। কেউ দাম বেশি নিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সবাই দাম না কমালে কমাবেন না সাত্তার
একই চিত্র ময়মনসিংহে। বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর শম্ভুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকেটি দোকানেই নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। অনেক ক্রেতা নতুন দামে কিনতে চাইলেও দিচ্ছেন না দোকানিরা।
দোকানি আফজাল মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ২০০ টাকা, পাঁচ লিটার ৯৯৫ টাকা, প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন ১৭৮ টাকা, প্রতি লিটার পাম তেল ১৫২ টাকা ও প্রতি কেজি পাম তেল ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন।
দাম বেশি রাখার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দাম কমানোর আগের দিনও প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি করেছি ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। বর্তমানে দাম কমলেও অনেক ব্যবসায়ী আগের দামেই বিক্রি করছে। তাই আমরাও দাম কিছুটা বেশি রাখছি। তবে একেকজনের কাছ থেকে একেক দাম রাখা হচ্ছে।’
আব্দুস সাত্তার নামে আরেক দোকানি বলেন, সবাই কম দামে বিক্রি করলে তিনিও তা করবেন।
আহসানুল হক নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে দাম বাড়াতেও পারে, কমাতেও পারে। মাঝখান থেকে আমরা সাধারণ ক্রেতারা পড়েছি বিপদে। তারা যে দাম বলে সে দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’
জালাল উদ্দিন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘সব দোহানেই তেলের দাম বেশি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে তেলের দাম কমে আসবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি রাখা হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
একেকজনের কাছ থেকে একেক দাম আদায়
যশোরে ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই তেলের দাম নিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার শহরের কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দাম কমানোর সিদ্ধান্ত কোথাও কার্যকর হয়নি।
বড়বাজার, চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ড, রেলগেট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা এক লিটার ও পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন যথাক্রমে আগের দাম ১৯৫ ও ৯৬০ টাকায়।
শহরের বড়বাজারের মেসার্স তাপস স্টোরের ব্যবসায়ী তাপস কুমার জানান, তিনি অনেক মজুত করেছিলেন। প্রতি এক ও পাঁচ লিটার তেলের বোতল যথাক্রমে ১৯৫ ও ৯৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘আমাদের বেচাকেনার এত তাড়া নেই। এই দামে ক্রেতারা তেল নিলে নিবে না নিলে নাই। আমাদের কিছু করার নাই।’
একই বাজারের ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা লিটার। বোতলজাত ১৯৫ লিটার বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নতুন রেটের তেল এখনও আসেনি। নতুন দামে তেল আসলেই নতুন দামে বিক্রি করব।’
বাহাদুর ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘মূল কথা হলো দেশে সুশাসন নেই। যদি থাকত, তাহলে দাম কমিয়ে দেয়ার পর এখনও সেই দাম কার্যকর হয়নি কেন?’
তহমিনা ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির আগাম খবর জানতে পারলে ব্যবসায়ীর বাড়তি দামে বিক্রি শুরু করেন। দাম কমিয়ে সরকার তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে দরে তারা বিক্রি না করে বাড়তি দরে বিক্রি করছেন।’
সেলিম রেজা নামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় পড়েছি তেলের দাম সরকার কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়তে দেখছি না।’
যশোর ভোক্তা অধিকার সহকারী পরিচালক খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, ‘নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দাম শহরে কম, গ্রামে বেশি
হবিগঞ্জ শহরে সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। এতে খুশি ক্রেতারা। তবে গ্রাম এলাকায় নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে তেল।
শহরের চৌধুরী বাজারের মহাদেব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মহাদেব সাহা বলেন, ‘বাজারে নতুন তেল এসেছে। তাই আমরাও সরকার নির্ধারিত ১৮৫ টাকা দরেই সয়াবিন তেল বিক্রি করছি।’
একই বাজারের ব্যবসায়ী নিত্য গোপাল বণিক বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যে কারণে এখন ১৮৫ টাকা দরেই বোতলের তেল বিক্রি করছি।’
শহরের রাজনগর এলকার বাসিন্দা পংকজ চৌধুরী বলেন, ‘সয়াবিন তেল ১৮৫ টাকা লিটারেই কিনেছি। ব্যবসায়ীরা বেশি নিচ্ছে না।’
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার চিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে প্রতিটি দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ ১৮৫ টাকার তেল বিক্রি করছেন ১৯০ টাকা দরে।
আজমিরীগঞ্জ বাজারের পাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী উগ্রসেন পাল বলেন, ‘ডিলাররা আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে। তাই আমাদেরকেও ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
জরিমানাও হচ্ছে
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করায় দুই ব্যবসায়ীকে ৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এ জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খাইরুল ইসলাম।
মেসার্স দেওয়ান ব্রাদার্সকে ৫ হাজার টাকা ও মেসার্স নিমাই স্টোরকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
দাম কমেছে কুমিল্লায়
কুমিল্লা শহরে গত সপ্তাহে প্রতি পাঁচ লিটার তেলের বোতল বিক্রি হয়েছে ৯৮০ টাকা দরে। এ সপ্তাহে দাম কমে হয়েছে ৯২০ টাকা।
বৃহস্পতিবার নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার ও বাদশা মিয়ার বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকারের বেঁধে দেয়া দরেই লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে তেল বিক্রি করছেন দোকানিরা।
রাজগঞ্জ বাজারের ইশাল মুদি দোকানের মালিক আবু জাহের বলেন, ‘পাঁচ লিটারের প্রতি বোতলে ৬০ টাকা কমেছে। এখন আমরা ৯২০ টাকা দরে বিক্রি করছি।’
কেশব স্টোরের মালিক কেশব সাহা বলেন, ‘আমাদের গোডাউনে এখনো আগের রেটের প্রচুর তেল মজুত আছে। আমরা সেই তেলগুলো এখন বর্তমান রেটেই বিক্রি করছি।’
চকবাজার থেকে পাঁচ লিটার তেল কিনেছেন আবু সাইদ। তিনি বলেন, পাঁচ লিটারে ৬০ টাকা কমলেও দাম অসহনীয় পর্যায়ে। প্রতি লিটার তেল ১০০ থেকে ১২০ টাকা হলে সবার জন্য ভালো হতো।’
কুমিল্লা ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিনই বাজার মনিটরিং করছি। সরকার নির্ধারিত দরের বাইরে বিক্রির অভিযোগ পেলে অবশ্যই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
কোরবানি ঈদের পর বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। সবজির দামও আগের মতোই। তবে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের আগের তুলনায় বর্তমানে খুচরায় মোটা চাল (বিআর-২৮, পারিজা) মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা প্রতি কেজিতে। সরু চালের মধ্যে জিরাশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৪ থেকে ৭৮ টাকা, মিনিকেট ৭৬ থেকে ৮০ টাকা এবং কাটারিভোগ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে।
পুরান ঢাকার নয়াবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী নিজাম জানান, ঈদের পর থেকে চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘মিল মালিকদের দাবি অনুযায়ী, ধানের দাম বৃদ্ধির ফলে চালের দাম বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়তে পারে।’
অলিগলির ছোট মুদি দোকানগুলোতে চালের দাম কিছুটা বেশি দেখা গেছে। বংশাল এলাকার মুদি দোকানদার মজিদ মিয়া বলেন, ‘এই ধরনের দোকানে বাকির পরিমাণ বেশি। আমাদের বেশি ইনভেস্ট করতে হয়, তাই কিছুটা বাড়তি দামে চাল বিক্রি করি।’
চালের উচ্চমূল্য ক্রেতাদের মাঝে অস্বস্তি সৃষ্টি করলেও মুরগি, ডিম ও সবজির দাম কিছুটা কমে ক্রেতাদের স্বস্তি দিয়েছে। মুদি পণ্যগুলোর দামেও তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়নি। পেঁয়াজ, আলু ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীও কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
এক সপ্তাহ ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় নেমে এসেছে, যেখানে ঈদের আগে তা ছিল ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। ডিমের দামও কমে প্রতি ডজন ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় এসেছে। বিক্রেতারা বলছেন, ঈদের পর বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম এবং চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় দাম কমেছে।
বাজারে আগত বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, কোরবানির ঈদের পর অনেক ঘরেই এখনো মাংস রয়েছে। ফলে ডিম ও মুরগির চাহিদা কম। তবে তারা আশঙ্কা করছেন, কিছু দিন পর চাহিদা বাড়লে মুরগির দাম আবারও বেড়ে যেতে পারে।
পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার ও নয়াবাজারে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইসঙ্গে সোনালি মুরগির দামও কিছুটা কমেছে—বর্তমানে তা প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মাছের বাজারে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি; বড় ইলিশসহ অন্যান্য মাছের দাম তুলনামূলক বেশি।
সবজির বাজারেও দেখা গেছে ইতিবাচক প্রবণতা। পুঁইশাক, বেগুন, পেঁপে, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গে ও মিষ্টি কুমড়ার মতো সবজি ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যেই বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে এসব সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ৪০ টাকা বেশি ছিল। বড় বাজারের তুলনায় ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে দাম আরও কিছুটা কম।
ভারত সরকারের আমদানি নিষেধাজ্ঞার পর যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে তৈরি পোশাকের ৩৬টি ট্রাক আটকা পড়েছে। পেট্রাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ‘গেইট পাস’ অনুমতি না পাওয়ায় পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো ভারতে যেতে পারেনি বলে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান।
ভারত সরকারের আমদানি নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জানতে চাইলে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, ‘এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমরা পাইনি। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। বেনাপোল বন্দর দিয়ে শনিবার পর্যন্ত সব পণ্য রপ্তানি হয়েছে।’
‘তবে রোববার সকাল থেকে অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হলেও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, পোশাক জাতীয় কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি ৩০ থেকে ৩৫ ট্রাক পণ্য এখানে আটকে আছে।’
বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, পোশাকসহ প্রায় সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত সরকার।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক মাসের মাথায় ভারতের এই পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এল, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার কথা বলেছে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গত বছর (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রায় ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এদিকে বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। যেসব পণ্যের এলসি/টিটি এরই মধ্যে হয়ে গেছে সেসব পণ্য যাতে আমদানি করা যায় তার জন্য কাস্টমসে আলোচনা চলছে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার পণ্য ভারতে রপ্তানি করে, গত অর্থবছরে তা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে রপ্তানি হয়েছে ১১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার পণ্য। যেসব দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে, তার মধ্যে ভারত একটি, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশের মত পোশাক পণ্য স্থলপথেই রপ্তানি হয়। ফলে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা এ খাতের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দেখা দেবে বলে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান আরও বলেন, ‘স্থলপথে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্যত ভারতের সঙ্গে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। আমদানিকারকরা বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে থাকে কলকাতায়। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। নৌপথে পণ্য পরিবহন করা এসব রপ্তানিকারকদের পক্ষে সম্ভব না। এতে খরচের পাশাপাশি সময়ের কারণে সেটা তারা পারবেন না।’
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে গার্মেন্টস সামগ্রী আমদানি নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। স্থলপথে এসব পণ্য রপ্তানিতে খরচ অনেক কম হতো কিন্তু সমুদ্র ও বিমান পথে পণ্য রপ্তানিতে খরচ অনেক বেশি হবে।’
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা বলেন, বছরে ১০ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয় ভারতে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেশিরভাগ আমদানিকারকেরা বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী। এ পথে রফতানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, পাট, পাটের তৈরি পণ্য, গার্মেন্টস, তৈরি পোশাক, কেমিকেল, বসুন্ধারা টিসু, মেলামাইন, মাছ উল্লেখ্যযোগ্য।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে দাবি করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
এ বাস্তবতা তুলে ধরে বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপদেষ্টা এমন মন্তব্য করেন।
‘আমরা নিশ্চয় এই অবস্থানগুলোকে তুলে ধরবো এবং সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবো। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভৌগলিকভাবে সংযুক্ত দুটি দেশ আমরা। এটা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার একটা প্রক্রিয়া। উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে এটার একটা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত আনতে পারবো। আমাদের আরও কিছু বন্দর এখনও খোলা আছে,’ বলেন শেখ বশিরউদ্দীন।
তিনি জানান, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি। স্থানীয় স্থলবন্দরে বিশেষ করে আখাউড়া ও ডাউকি সীমান্তভিত্তিক কিছু সিদ্ধান্তের কথা শুনেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। এখন বিষয়টি বিশ্লেষণ করবো।’
তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যকে স্বাভাবিক বাণিজ্য প্রবাহ বলে মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা যেটা আমাদের থেকে নেয়, সেটা সুলভ মূল্যের কারণেই নেয়। আমরাও একই কারণে তাদের পণ্য কিনি। সুতরাং এখানে স্বাভাবিক বাণিজ্য প্রবাহের বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরবো।’
‘আমরা আমাদের বৈচিত্রকরণ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি ঘটাবো,’ যোগ করেন শেখ বশিরউদ্দীন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি যে আসবাব যায়, তা না। পোশাকপণ্য যায়, আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মাধ্যমেই এগুলো পাঠিয়ে থাকি। দুপক্ষের জন্যই লাভজনক বিধায় এগুলো যায়। আশা করি, উভয় দেশের ভোক্তা ও উৎপাদনের স্বার্থে এটা চলমান থাকবে।’
এর আগে ট্রান্সশিফমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ায় কী ধরনের প্রবাহ পড়েছে, জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা দাবি করেন, ‘ট্রান্সশিফমেন্টের কোনো প্রভাব আমাদের ওপর নেই। নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে নিজস্বভাবেই এই সমস্যা সমাধান করেছি।’
সূত্র: বিডিনিউজ, ইউএনবি
বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে উল্লেখ করে ডলার-টাকার বিনিময় হার এখন থেকে বাজারনির্ভরভাবে নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ আগামী জুন মাসের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের ঋণ কিস্তি পাবে বলেও জানান তিনি।
ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের দর-কষাকষি চলছিল। মূলত সে কারণে আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় করছিল না। এর মধ্যে গতকাল জানা যায়, বাংলাদেশ ডলারের বিনিময় আরও নমনীয় করতে রাজি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারে ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ৯ মাসে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি, তবুও বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। এ অবস্থায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, বাজারভিত্তিক করায় হঠাৎ করে ডলারের রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেট ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে এবং তা সেখানেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ডলারের রেট দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা-সরবরাহ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে, বাইরের দেশের নির্দেশে নয়। বর্তমানে বাজারে ডলারের সরবরাহও পর্যাপ্ত রয়েছে।
তবে, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দুবাইভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. মো. হাবিবুর রহমান, কবির আহমেদ, উপদেষ্টা আহসান উল্লাহ এবং নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার একত্রে ছাড় করবে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সকল বিষয় সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে উভয়পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং বিনিময় হার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনার লক্ষ্যে চতুর্থ রিভিউ সম্পন্ন হওয়ার পর উভয় রিভিউয়ের জন্য নির্ধারিত কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে বলে বিগত তৃতীয় রিভিউয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ রিভিউয়ের সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ব্যাংক-ফান্ড সভায় এবিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল।
এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা জুন মাসের মধ্যে পাবে বলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ অর্থ পাওয়া গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসকল সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। এ সকল সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কারিগরি সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
পবিত্র রমজান মাসে দাম সহনীয় রাখতে টাটকা ফলের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, গত ১৬ মার্চ জারি করা দুটি প্রজ্ঞাপনে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম কর সম্পূর্ণ অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ১০ মার্চ পৃথক প্রজ্ঞাপনে ফল আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ফলে মোট শুল্ক কমানো হয়েছে ১৫ শতাংশ।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, রমজানে দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বৃহত্তর জনস্বার্থে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের দাবি, বৃহত্তর জনস্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, ডিম, পেঁয়াজ, চাল, খেজুর, কীটনাশকসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণ শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম করের উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যাহতি দিয়েছে।
আরও পড়ুন:যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গত ৪ মাসে ভারত থেকে ১৮ হাজার ৮০০ টন চাল আমদানি করা হলেও দেশের বাজারে দামে প্রভাব পড়ছে না।
দেশের চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত ৯২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত কোটায় এসব চাল আমদানি করে।
চলতি অর্থবছরে ১৭ নভেম্বর থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত এসব চাল আমদানি করা হয়। তবে ভারত থেকে চাল আমদানি অব্যাহত থাকলেও দেশের বাজারে দামে প্রভাব পড়ছে না।
গত ১৩ মার্চ বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৩৫০ টন চাল আমদানি করা হয়। এ নিয়ে গত চার মাসে ১৮ হাজার ৮০০ টন চাল আমদানি হয় এ বন্দর দিয়ে।
গত ৬ মার্চ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আরিফুল ইসলামের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বেসরকারিভাবে নন বাসমতি সেদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে এলসি খোলার সময়সীমা আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলো।’
দেশের চালের বাজার স্থিতিশীল ও ক্রেতা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার দেশের শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরের দেশ থেকে চাল আমদানির অনুমতি দেয়। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে বাইরের দেশ থেকে চাল আমদানির এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, আটটি চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গত বছরে ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৮০০ টন চাল আমদানি করেছে। সারা দেশে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৯২ প্রতিষ্ঠানকে। দুই লাখ ৭৩ হাজার টন সেদ্ধ এবং এক লাখ ১৯ হাজার টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাদের।
অনেক প্রতিষ্ঠান এ সময়ের মধ্যে আমদানি করতে পারেনি। তারপরও সরকার ২৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয় আমদানি করা চাল বাজারজাত করার জন্য। আশানুরূপ চাল আমদানি না হওয়ায় পরে তা প্রথম দফায় ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ায় সরকার। তারপরও আমদানি ধীরগতির কারণে আবারও সময় বাড়ায় সরকার।
এভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানি না হওয়ায় চতুর্থবারের মতো আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে সব চাল আমদানি হলে বাজারে চালের দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে চাল আমদানি অব্যাহত থাকলেও বাজারে দামের ওপর প্রভাব পড়ছে না। রোজার শুরু থেকেই সব ধরনের চালের দাম কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। অব্যাহতভাবে চালের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, চালের দাম কমানোর জন্য সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও মিলছে না সুফল। ভারত থেকে চাল আমদানি হলেও দেশীয় চালের দামের ওপর তার প্রভাব পড়ছে না।
তারা বলছেন, রোজার শুরুতেই সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। পণ্যটির অস্বাভাবিক এ মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। রোজায় সবজিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে পারলেও চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
চাল ব্যবসায়ী দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘রোজার শুরুতেই চালের দাম কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। রোজার আগের ৬৪ টাকা কেজি দরের ২৮ জাতের চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৬৯ টাকায়, ৭২ টাকার মিনিকেট ৭৬ টাকায়, ৫২ টাকার মোটা চাল ৫৬ টাকায়, ৮৪ টাকার বাসমতি চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৮ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে।
‘আমদানি করা ভারতীয় একটি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি দরে। তবে বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে ভারতীয় চালের চাহিদা কম।’
তিনি বলেন, ‘রোজার মধ্যে চালের দাম কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারতীয় চাল আমদানি অব্যাহত থাকলেও বাজারে দামের ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। তবে সামনে নতুন চাল বাজারে উঠলে সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে পারে।’
বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) শামিম হোসেন জানান, ভারত থেকে আমদানি করা চালের ট্রাক স্থলবন্দরে ঢুকলেই দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা দ্রুত ছাড় করার ব্যবস্থা নেন, যাতে আমদানি করা চাল দেশের বাজারে দ্রুত সরবরাহ করা যায়।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান জানান, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে বেনাপোল স্থলবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব কম হওয়ায় আমদানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের সময় স্বল্পতা ও আর্থিক সাশ্রয় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ায়। পণ্য পরিবহনে যাতায়াত ব্যবস্থা রয়েছে উন্নত।
তিনি আরও জানান, এ বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করার পর অতি দ্রুত পৌঁছাতে পারে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের বাজারে।
বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গত চার মাসে ভারত থেকে ১৮ হাজার ৮০০ টন চাল আমদানি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চাল আমদানির জন্য সরকার আবারও এক মাস সময় বাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন:দেশে জ্বালানি তেলের দাম মার্চে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
এক অফিস আদেশে শনিবার এমন তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ‘মার্চ মাসের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে সরকার। এ জন্য বিদ্যমান মূল্য কাঠামো অনুযায়ী ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটার ১০৫ টাকা, অকটেন ১২৬ টাকা এবং পেট্রল ১২২ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।’
এর আগে গেল ৩১ জানুয়ারি পেট্রল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের মতো জ্বালানি তেলের দাম লিটারে এক টাকা বাড়ানো হয়, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে যা কার্যকর করা হয়।
জানুয়ারিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক টাকা কমানো হয়েছিল। পেট্রল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিত ছিল।
গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন:সবার আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তিনি বলেন, একদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন করে ভ্যাট আরোপ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
এক বিবৃতিতে সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন বা সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে চিন্তা করার যেন কেউ নেই। টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন দিনে দিনে বড় হচ্ছে।
‘এখন প্যান্ট-শার্ট পড়েও স্বল্প দামে চাল-ডাল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসংখ্য মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় অনেকেই ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে না পেরে একবুক কষ্ট নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরছে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের কাছে মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম কেনা দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকরা সন্তান ও পরিজনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন না; কিনতে পারছেন না জীবন রক্ষাকারী ঔষধ।
‘এমন বাস্তবতায় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা।’
জিএম কাদের বলেন, ‘দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করি। আমরা মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা বলেই যাব।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে সরকার দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য