কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে সেঞ্চুরির পর ব্যাংকগুলোতেও ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। এখন ভ্রমণ, জরুরি প্রয়োজন কিংবা চিকিৎসার জন্য কেউ বিদেশে যেতে চাইলে ব্যাংক থেকে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হবে ১০০ টাকার বেশি।
বেসরকারি সোশাল ইসলামী ব্যাংক বৃহস্পতিবার ১০২ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে; কিনেছে ১০০ টাকায়। মেঘনা ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০১ টাকায়।
ইস্টার্ন ব্যাংক ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে, সিটি ব্যাংক ৯৯ টাকায় বিক্রি করছে। প্রাইম ব্যাংক নিচ্ছে ৯৮ টাকা ৫০ পয়সা।
আর রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ৯৮ টাকায় বিক্রি করছে প্রতি ডলার।
খোলা বাজারে বৃহস্পতিবার ১০২ টাকা ৬০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে। অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০১ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আনতে ১০০ টাকা দিয়েছে কয়েকটি ব্যাংক।
এদিকে এক দিনের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে আরও ৫০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি টাকা। এক ডলারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা; বুধবার ছিল ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে টাকা-ডলার বিনিময় হার ঠিক হয়ে থাকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। দাম নির্ধারিত হয়েছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। আর এটাই আজকের আন্তব্যাংক দর।’
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। আর এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়।
অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ২১ দিনেই (১ থেকে ২১ জুলাই) প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারে ডলার সংকট কাটছে না।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকও কমছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই দুই বছর পর এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:নারীকেন্দ্রিক ট্র্যাভেল কোম্পানি ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ এর সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে ব্র্যাক ব্যাংক।
চুক্তির আওতায় নারীদের জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের সেবা 'তারা’র ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ওয়ান্ডার ওম্যাননের কাছ থেকে বিনামূল্যে একটি ভ্রমণ কনসালটেশন সার্ভিস উপভোগ করবেন। একইসঙ্গে সার্ভিস চার্জে ১০ শতাংশ ছাড়, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণে ৭ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় এবং ওয়ান্ডার ওম্যান সামগ্রীতে ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন৷
ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সম্প্রতি দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে বলে ব্যাংকটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এ সময় ওয়ান্ডার ওম্যান এর ফাউন্ডার ও সিইও মিস সাবিরা মেহরিন সাবা, ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব উইমেন ব্যাংকিং ‘তারা’ এবং স্টুডেন্ট ব্যাংকিং ‘আগামী’ মেহরুবা রেজা এবং ‘তারা’র প্রোডাক্ট ম্যানেজার শুভধ্বনি পালসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের মাস্টারকার্ড ‘তারা’ ওয়ার্ল্ড ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ওয়ান্ডার ওম্যান ট্রাইব কার্ডে ২৫ শতাংশ ছাড় পাবেন। ‘তারা’ গ্রাহকেরাও এই চুক্তির অধীনে ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ এর থেকে ইএমআই সুবিধা পাবেন।
স্টুডেন্ট সেগমেন্টের জন্য ‘তারা’ আগামী সেভারস অ্যাকাউন্টের সাথে ৫০০ টাকার একটি ভাউচারও দেওয়া হবে।
এই অফারটি ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক ‘তারা’এবং ওয়ান্ডার ওম্যান যৌথভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের নেটওয়ার্কিং ও সক্ষমতা উন্নয়নে কাজ করবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওয়ান্ডার ওম্যান ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি পুরস্কার বিজয়ী নারীকেন্দ্রিক ট্র্যাভেল কোম্পানি। এই প্ল্যাটফর্মটি বর্তমানে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সক্রিয়। এটি সারা বিশ্বের ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নারী ভ্রমণ উৎসাহীদের একটি প্ল্যাটফর্মের অধীনে নিয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন:পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ১১ দিনে (১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট) ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৭২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তবে এর প্রায় পুরোটাই জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় আমদানি খরচ মেটাতে বিক্রি করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পণ্য আমদানির এলসি খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম দামে ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা চাহিদা মেটাতে বেশি দামে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও এলসি খুলতে বেশি দর নিচ্ছে।
একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যে যার মতো করে দর হাকিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। আবার ইচ্ছেমতো দরে এলসি খুলছে।
এতদিন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের এলসি (ঋণপত্র) খোলার জন্য অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে কিছু ডলার বিক্রি করলেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এখন শুধু সরকারের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার দর ৯৫ টাকায় রাষ্টায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন সংস্থা বাংলাাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি এবং বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে রিজার্ভ থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়।
এর আগে ৮ আগস্ট বিপিসির তেল আমদানি এবং বিসিআইসির সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়।
সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরমধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আর চলতি আগস্ট মাসের ১১ দিনে (১ থেকে ১১ আগস্ট) বিক্রি করা হয়েছে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট মাসে প্রতিদিন ৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন যে ডলার বিক্রি করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম; সরকারের আমদানি খরচই মিটছে না তাতে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বাধ্য হয়ে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দর রাখছে।’
‘একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েই চলেছে। দুর্বল হচ্ছে টাকা। এখন যে করেই হোক টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।’
‘তবে সুসংবাদ হচ্ছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে আমদানি ব্যয় কমছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। দেখা যাক কী হয়?’
ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে কয়েক মাস ধরে। বেড়েই চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই মুদ্রার দর। কমছে টাকার মান। দুই মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ; এক বছরে বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি উল্লম্ফন ও আমদানি ব্যয় কমায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ এটি। যখন বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দেবে তখন ডলার বিক্রি করা হবে। আবার যখন সরবরাহ বেশি হবে তখন কেনা হবে।’
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে রিজার্ভ পরিস্থিতিও সব সময় বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। ঢাকাও বিক্রি করলে রিজার্ভ কমে আসবে। সেক্ষেত্রে অন্য সমস্যা হবে। সে কারণেই ভেবেচিন্তে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি বিক্রি করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাণ্ডবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব দেশের মতো আমাদেরও আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণেই রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়েছে।’
‘তবে সুখের খবর হচ্ছে, আমদানি কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বাড়ছে। শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
এদিকে কিছুদিন ‘স্থির’ থাকার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে আরও ৩০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত সোমবার থেকে এক ডলারের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা।
এর আগে ২৫ জুলাই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমে দুই সপ্তাহের মতো ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল।
অন্যদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর উঠেছে ১২০ টাকা।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলারও বেশি দামে বিক্রি করেছে। বৃহস্পতিবার সিটি ব্যাংক ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এসআইবিএল থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা ২৫ পয়সা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক সোমবার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৪ টাকায়। জনতা ব্যাংক থেকে নগদ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৩ টাকা। আর সোনালী ব্যাংক নিয়েছে ১০২ টাকা।
খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়লে মুদ্রা বিনিময়ের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ব্যাংক থেকে ডলার কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে থাকে। এখন ব্যাংকেও ডলারের সংকট। এ জন্য অনেক ব্যাংক এখন উল্টো খোলাবাজারে ডলার খুঁজছে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। তারপরও সংকট কাটছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, ব্যাংকগুলোতে তার চেয়ে ৭ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০৫ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনেক ব্যাংক ১১০ টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচটি দেশি এবং একটি বিদেশি ব্যাংক। সম্প্রতি ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লেখা চিঠিতে এই নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনার পর ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার
ডলার বিক্রির কারণে রেমিট্যান্স বাড়ার পরও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ চাপের মধ্যে রয়েছে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসের ৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির ফলে আরও কমে গেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক।
১০ দিনেই ৮১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহে ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনেই ৮১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো মাসেই ১০ দিনে এত বেশি রেমিট্যান্স আসেনি দেশে।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে ১০ দিনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।
মাসের বাকি ২০ দিনেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই মাসের মতো আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।’
জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ।
আরও পড়ুন:মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরতা কমানো ও হুন্ডি প্রতিরোধে এবার সারা দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় নগদ বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে বৈদেশিক লেনদেনে নিয়োজিত অথরাইজড ডিলার ব্যাংকগুলোর (এডি) শাখা থেকেই কেবল নগদ ডলার কেনাবেচনার অনুমতি রয়েছে। তবে মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারে ডলারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। চলতি সপ্তাহেই ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের সেবা চালুর অনুমোদন দেয়া শুরু হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার শাখার সংখ্যা খুব কম। যেগুলো আছে সেগুলোর বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকা ও কয়েকটি বিভাগীয় শহরে। ফলে নগদ ডলার কেনাবেচার জন্য মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়।
এ ধরনের সেবা কোন এলাকার কোন শাখায় চালু করা হবে, সেই সম্ভাব্য তালিকা চেয়ে আগামী রোববার দেশের সব ব্যাংকের কাছে চিঠি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রাথমিকভাবে শাখাগুলোতে একটি ডেস্কের মাধ্যমেই এ সেবা চালুর অনুমোদন দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে শেয়ারবাজারের মতো বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ। এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
সবশেষ বুধবার খোলাবাজারে এক ডলার কিনতে ১২০ টাকা গুনতে হয়েছে৷ অথচ আন্তব্যাংকে ডলার রেট ৯৫ টাকা।
আন্তব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য প্রায় ২৫ টাকা। আর ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার রেট অনেক বেশি হওয়ায় হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
এমন প্রেক্ষাপটে ডলার বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল এ পর্যন্ত এক শ’র বেশি মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছে।
এর মধ্যে ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ডলার কেনাবেচায় বিভিন্ন অনিয়মের কারণে শোকজ করা হয়। আর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে। লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করায় ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধির পেছনে কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও পড়ুন:জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ইসলামী ব্যাংক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এই কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।
এ সময় ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী, ওমর ফারুক খান ও জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাকসুদুর রহমান, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান ভুঁইয়া ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামসহ ব্যাংকের নির্বাহী ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) অংশীদারিত্বে চালু করা অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং বন্ডের সাবস্ক্রিপশন সমাপনী (ক্লোজার) অনুষ্ঠান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম এই হাউজিং বন্ডের লক্ষ্য সারা দেশে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের শহুরে ও গ্রামীণ পরিবারগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ঋণ প্রদান করা।
আইএফসি এই বন্ডে ৫ কোটি আমেরিকান ডলারের সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা সাবস্ক্রিপশন করেছে। এটি একটি ডিনোমিনেটেড, নন-কনভার্টিবল, প্রাইভেটলি প্লেসড, রিডিমেবল, আনসিকিউরড, ফিক্সড কুপন বিয়ারিং এবং পাঁচ বছরের সিনিয়র বন্ড, যা ব্র্যাক ব্যাংককে এর অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং ফাইন্যান্স প্রোগ্রাম সম্প্রসারণে সাহায্য করবে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন আইএফসি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হোল্টম্যানের কাছে গত ৪ আগস্ট ঢাকায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে বন্ড সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন বলে ব্যাংকটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এ সময় ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব অব ট্রেজারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন্স শাহীন ইকবাল, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব এসএমই ব্যাংকিং সৈয়দ আব্দুল মোমেন, হেড অব রিটেইল ব্যাংকিং মাহীয়ুল ইসলাম এবং আইএফসির প্রিন্সিপাল ইনভেস্টমেন্ট অফিসার ও কান্ট্রি অ্যাঙ্কর এহসানুল আজিম; সিনিয়র অপারেশন্স অফিসার এফআইজি আপস্ট্রিম মিসেস আয়েশা বেগ ছাড়াও উভয় প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এই সাশ্রয়ী আবাসন ঋণ সুবিধার মাধ্যমে দেশের মানুষ পাকা ও আধা পাকা বাড়ি নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সহজে গৃহঋণ নিতে পারবেন। এই ঋণ সুবিধার আওতায় আবাসন, নির্মাণ এবং এর আনুষঙ্গিক শিল্পের প্রসার ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে আইএফসি এবং ব্র্যাক ব্যাংক যৌথভাবে একটি বাণিজ্যিকভাবে সম্ভাবনাময় ঋণ নিয়ে এসেছে, যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের গৃহঋণ চাহিদা মেটাবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন উৎসাহিত করবে এবং হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সুখবর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি অর্ধেকে নেমে এসেছে; অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে অর্থনীতি; রিজার্ভ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বিশাল ঘাটতিতে পড়ে ওলোটপালট হয়ে গেছে সব হিসাবনিকাশ। সেই আমদানি খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে পণ্য আমদানির জন্য ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ের এই ১১ দিনে ২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। তার আগের মাস জুনের ১১ দিনে খোলা হয়েছিল ২ দশমিক ৩৩ বিলিরয়ন ডলারের এলসি।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫৫৫ কোটি (৫.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা জুনে ছিল ৭৯৬ কোটি (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ জুন থেকে জুলাই মাসে এলসি খোলা কমেছে ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ। জুনে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৭৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে সেটি ১১৭ কোটি ডলার কমে ৬৫৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক আর্থিক বছরে পণ্য আমদানিতে এত ব্যয় হয়নি।
অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনেই ৮১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো মাসেই ১০ দিনে এত বেশি রেমিট্যান্স কখনই আসেনি দেশে।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে ১০ দিনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।
এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ৭৭২ কোটি টাকা।
বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আরও বেশি।
মাসের বাকি ২০ দিনেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই মাসের মতো আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।’
জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে এটি বেশি ১২ শতাংশ।
প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের আগস্ট মাসের ১০ দিনে (১ থেকে ১০ আগস্ট) ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত (১ মাস ১০ দিনে) ২৯১ কোটি (২.৯১ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ২৫৪ কোটি ৭০ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে কয়েক দিন আগে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ-হতাশা এবং আগামী দিনগুলোতে কী হবে, এই প্রশ্ন সবার মধ্যে, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
‘মহামারির মধ্যে ওই সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন প্রবাসীরা’- এই মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতিতে যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে, সেই সংকট কাটাতেও সবার আগে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসীরা। আবার বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।’
আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে এটা সত্যিই স্বস্তির খবর। এভাবে আমদানি কমলে আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লে খুব শিগগিরই আমাদের সংকট কেটে যাবে।
‘এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু এখনও ভালো অবস্থায় আছে। রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে। আমদানি কমছে। সমস্যা যেটা, সেটা হচ্ছে, ডলারের অস্থির বাজার এবং ব্যালান্স অফ পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে। মূল্যস্ফীতি এখনও খুব বেশি ওপরে উঠেনি। জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতির কারণে সেটা হয়তো বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন যেটা করতে হবে, সেটা হলো, ডলারের বাজারকে যে করেই হোক স্থিতিশীল করতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এ জন্য কিছু সময়ের জন্য হলেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো উচিৎ। তাহলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমে আসবে; টাকার চাহিদা বাড়বে, ডলারের বিপরীতে শক্তিশারী হবে।
‘এই কাজটি এখন সরকারের নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরিভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; গড়ে প্রতিদিন ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২০-২১ অর্থবছরে। সে সময় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৭৯ ডলার প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এসেছিল।
এসব হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্সে রয়েছে ঊর্ধ্বগতি। এই প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে এবং এই অর্থবছরে নতুন রেকর্ড তৈরি হবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে সাড়ে ৭ লাখ লোক কাজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে গেছেন। তারা ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন। সে কারণেই ঈদের পরও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এই ইতিবাচক ধারা পুরো অর্থবছর জুড়েই অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।’
সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ে; ঈদের পর কমে যায়। তবে এবার কোরবানির ঈদের আগে যে গতিতে রেমিট্যান্স এসেছে, সেই ধারা ঈদের পরেও অব্যাহত আছে।
দেশে গত ১০ জুলাই কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামে। ঈদের ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ঈদের পরে ২১ দিনে এসেছে ১১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের কিছু বেশি।
ঈদের পরেও কেন রেমিট্যান্স বাড়ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে ডলারের দর বেশ খানিকটা বেড়েছে। প্রণোদনার পরিমাণ দুই শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। এসব কারণে প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সে কারণেই বাড়ছে রেমিট্যান্স।’
তিনি বলেন, ‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি ডলার ৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে। তবে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকা পর্যন্ত দরে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করেছে।
সে হিসাবে কোনো প্রবাসী এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ ডলার দেশে পাঠালে ১১০ টাকার সঙ্গে নগদ প্রণোদনার ২ টাকা ৫০ পয়সা যুক্ত হয়ে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।
কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর প্রায় একই। সে কারণেই প্রবাসীরা এখন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে দেশে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন বলে জানান ব্যাংকাররা।
রেমিট্যান্স বাড়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখানে কর্মরত আমাদের প্রবাসীরা বেশি আয় করছেন। দেশেও বেশি টাকা পাঠাতে পারছেন।
‘দেশে ডলারের সংকট চলছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে। রিজার্ভ কমছে। এই মুহূর্তে রেমিট্যান্স বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ও তেমন পূর্বাভাস দিয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর জুড়ে (২০২১-২২) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে নতুন অর্থবছরে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
এই অর্থবছরে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শ্রমিক নতুন করে বিদেশে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাওয়া যাবে।’
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালচাল নিয়ে তৈরি করা পাক্ষিক প্রতিবেদনেও রেমিট্যান্স নিয়ে সুসংবাদের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২১ জুলাই প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার ইতোমধ্যে রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সব প্রবাসী তাদের কর্মস্থলে ফিরেছেন। টাকার বিপরীতে ডলার বেশ খানিকটা শক্তিশালী হয়েছে।
‘এই বিষয়গুলো আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স বাড়াতে সাহায্য করবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়, রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আসবে।
আরও পড়ুন:
খেলাপি ঋণ কমানো নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যেই গত তিন মাসে অনাদায়ী এই ঋণ বাড়ল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
মার্চে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাসে তা বেড়েছে ১১ হাজর ৮১৬ কোটি টাকা।
করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ ও ২০২১ সাল জুড়ে কয়েক দফায় কোনো ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা সামান্য পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ ছিল। এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার বেশিরভাগই শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর পরপরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
কেবল টাকার অঙ্কে নয়, শতকরা হিসাবেও খেলাপি বেড়েছে। জুন শেষে বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। মার্চ শেষে খেলাপি ছিল ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জুনে মোট ঋণ দেয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা, যা মার্চে ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা।
২০২০ সাল থেকে দফায় দফায় খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধা বাড়ানো হয়। এখন অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো গেলেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করছেন না। ব্যাংকগুলো নানামুখী চেষ্টা করেও তাদের থেকে টাকা আদায় করতে পারছে না।
২০২১ সালে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কেউ এ হারে টাকা দিলে আগের তারিখ দেখিয়ে নিয়মিত থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে ব্যবসায়ীদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোসহ নগদ এককালীন জমা দেয়ার হার কমিয়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো হয়।
এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নতুন সার্কুলারে ঋণ খেলাপিদের আরও ছাড় দেয়া হয়। পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়।
খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে
রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ও বেসিক- এই ছয় ব্যাংকের জুন শেষে মোট ঋণ ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মার্চ শেষে এই ছয় ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ০১ শতাংশ।
তিন মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা।
টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণ বেশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে
বেসরকারি ব্যাংকগুলো জুন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ০১ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
মার্চ পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঋণ ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত তিন ব্যাংক
কৃষি, প্রবাসীকল্যাণ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন- বিশেষায়িত এ তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এটা তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৫ হাজার ৪৭২৮ কোটি টাকার ঋণ।
মার্চে এ তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। তারা বিতরণ করে মোট ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকার ঋণ।
এই তিন ব্যাংকে তিন মাসে খেলাপি ঋণ টাকা অংকে বাড়লেও শতকরা হিসাবে কমেছে।
বিদেশি ৯ ব্যাংক
বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো মোট ঋণ দিয়েছে ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
মার্চে এই ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো মোট ঋণ দিয়েছে ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য