ঈদের ছুটি শেষে পর পর দ্বিতীয় দিন দরপতন হলো। লেনদেনের দিক থেকে আবার সবাইকে ছাড়িয়ে বস্ত্র খাত। তবে শেয়ারদর হারিয়েছে প্রায় সব কোম্পানি।
বিপরীতে এদিন দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এমন সব কোম্পানির, যেগুলোর বেশিরভাগই লোকসানি, লভ্যাংশ বিতরণে ব্যর্থ। আগামীতেও লভ্যাংশ দিতে পারবে- এমন আভাসও নেই।
ঈদের আগে পতনমুখি পুঁজিবাজার ছুটি শেষে ভালো কিছু করবে- এমন প্রত্যাশা ছিল না সেভাবে। আবার ঈদ শেষে সাধারণত কয়েদিন পুঁজিবাজারে লেনদেন হয় কম। তবে এদিক থেকে এবার প্রবণতা বেশ ভালো বলা যায়।
প্রথম কর্মদিবস মঙ্গলবার ৬৭৯ কোটি ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছিল। সেদিন সূচক পড়েছির ১১ পয়েন্ট।
দ্বিতীয় কর্মদিবস বুধবার সূচক পড়ল আরও ৩০ পয়েন্ট, তবে লেনদেন বেড়েছে। হাতবদল হয়েছে ৭০২ কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার টাকার।
আগের দিন বস্ত্র খাতে প্রায় সবগুলো কোম্পানির দর বেড়েছিল। তবে এদিন প্রবণতা পুরো বিপরীত। চারটির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৫১টির দর।
এদিন দর কমেছে সব খাতেই। ৭৭টির বিপরীতে দর কমেছে ২৫৯ টি কোম্পানির দর। অন্যদিকে ৪৫টি দর ধরে রাখতে পারে।
বিপুল সংখ্যক কোম্পানির দর কমেছে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশের আশেপাশে।
অন্যদিকে দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে কেবল দুটি কোম্পানির দর। সব মিলিয়ে একটির দর ৯ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৭ শতাংশের বেশি, চারটির দর ৪ শতাংশের বেশি, তিনটির দর ৩ শতাংশের বেশি, ছয়টির দর ২ শতাংশের বেশি, ১৭টির দর ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯.৫৫ শতাংশ বেড়েছে তালিকাভুক্তির পর লোকসানের কারণে লভ্যাংশ দিতে না পারা মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের দর। গত পাঁচ বছর ধরেই দেখা গেছে, লভ্যাংশ ঘোষণার সময় এলেই এই কোম্পানি ও একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারদর ব্যাপকভাবে বাড়ে।
তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত এই কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ৫ টাকা ৩৪ পয়সা। শেয়ার প্রতি কোনো সম্পদ নেই, উল্টো দায় ৭৩ টাকা ১৫ পয়সা।
এমন একটি কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ারের দর এখন ৩২ টাকা ১০ পয়সা।
মেঘটা পেট ইন্ডাস্ট্রিজের দর বেড়েছে ৪.৫৭ শতাংশ। এই কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি লোকসান ১৮ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি দায় ৪ টাকা ৭৩ পয়সা।
এই কোম্পানিটির সবশেষ শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৩৬ টাকা ৭০ পয়সা।
ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিরোধে জটিলতায় পড়া লিবরা ইনফিউশন ২০১৮ ও ১৯ সালের প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। এমন নয় যে, কোম্পানি মুনাফায় আছে। তবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে লোকসান কিছুটা কমেছে।
২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ২৪ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি। আগের বছর একই সময়ে এই লোকসান ছিল শেয়ার প্রতি ১১ টাকার বেশি।
লোকসান কমার এই খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৮৫৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে লাফ দিয়ে হয়েছে ৯২২ টাকা। অবশ্য কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ আছে ১ হাজার ২৬৪ টাকা।
চীনে কার্যাদেশ পাওয়ার খবরে লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইস্টার্ন ক্যাবলসের দৌড় থামছে না। গত ১৪ জুন দর ছিল ১২৮ টাকা ৯০ পয়সা। সেটি বেড়ে হয়েছে ২০৩ টাকা ৬০ পয়সা। এর মধ্যে আজ বেড়েছে ৭.১৫ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকায় থাকা ওসমানিয়া গ্লাস, ন্যাশনাল টিউব এবং ফাইন ফুডসও লোকসানি কোম্পানি।
এই তালিকার ৯ নম্বরে থাকা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির আর্থিক ভিত্তিও বেশ দুর্বল।
বাকি দুই কোম্পানি নিটল ইন্স্যুরেন্স ও বার্জার পেইন্টস কেবল ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা থাকে, তখন স্বল্প মূলধনি দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দরে হাওয়া দেখা দেয়।
এক্সপো ট্রেডার্সের সিইও শহিদুল হোসেন বলেন, ‘বাজারে নেতিবাচক প্রবণতার কারণ হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা। এর বাইরে কেউই নেই। তারপরও বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে এগিয়ে আছে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কিছু টাকা নিয়ে গেছে। এখন কেউ কিনবে কেউ বেচবে, বাজার এরকম ওঠানামার মধ্য দিয়েই চলবে। এটাই বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম।
‘বলা হচ্ছে ফান্ড ঢুকবে। কিন্তু কীভাবে ঢুকবে, কোথায় থেকে ঢুকবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। নতুন গভর্নর বসেছিলেন, দেখা যাক কী হয়!’
আরও পড়ুন:বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিশ্বমানের ডিজিটালাইজ করতে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন পাওয়া গেছে। আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে দেশের শেয়ারবাজারের চেহারা পাল্টে যাবে। ওই সময় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ২৪ ঘণ্টাই লেনদেন করা যাবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এসব কথা বলেছেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে বিশ্বমানের ডিজিটালাইজ করতে এ বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের শুরুর দিকে সুইস ও ইউরোপিয়ান কনসালট্যান্টদের সহায়তায় কাজ শুরু হবে। এতে করে আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে দেশের শেয়ারবাজারের চেহারা পাল্টে যাবে।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ২০২১-২২ অর্থবছরে শীর্ষ ব্রোকারদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এতে সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সিএসই পর্ষদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ডিএসইর সঙ্গে লেনদেনের এতো পার্থক্য কেন। যেখানে (চট্টগ্রাম) এতো ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, সেখানে তো এতো কম লেনদেন হওয়ার কথা না। আমি তাদেরকে লেনদেন বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘আজ যারা পুরস্কৃত হলেন তাদেরকে অভিনন্দন। এই পুরস্কারের ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেখানে প্রতিযোগিতা আছে। আর প্রতিযোগিতা যেখানে থাকে সেখানে উন্নয়ন হবেই। যেখানে প্রতিযোগিতা নেই সেখানে কখনো ভালো বাজার হয় না।
‘আজ সিএসই যাদেরকে পুরস্কৃত করে উৎসাহিত করল তারা আগামীতে আরও ভালো করতে চাইবেন এবং অবস্থা ধরে রাখতে চাইবেন। অন্যদিকে যারা পাননি, তারা আগামীতে পাওয়ার চেষ্টা করবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ক্যাপিটাল মার্কেটের প্রতি যত্নবান উল্লেখ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘উনি দায়িত্ব নেয়ার এক মাসের মধ্যেই শেয়ারবাজারের ১০ বছরের বিনিয়োগ সীমার সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। ক্যাপিটাল মার্কেট ও মানি মার্কেট একসঙ্গে কাজ না করলে দেশের অর্থনীতির মূল লক্ষ্য যে পূরণ হবে না সেটা উনি বুঝতে পেরেছেন।’
চট্টগ্রামে আসার আগে গভর্নরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ সীমা থেকে বন্ডকে বাদ দিতে হবে। আপনি ইক্যুইটি মার্কেটে একটি কোম্পানিকে ২০ কোটি, ৫০ কোটি বা ১০০ কোটি টাকা দিতে পারবেন। কিন্তু একটি ভালো টাইলস, টেক্সটাইল, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি করতে গেলে ৫০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি টাকা দরকার হয়।
‘ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এটা করলে কয়েকটি কিস্তি দিতে না পারলেই উভয় প্রতিষ্ঠান বিপদে পড়বে। এ সমস্যা কাটিয়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বন্ডের মাধ্যমে করার বিষয়ে গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এখন বন্ড কিনতে গেলে আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগ সীমার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এজন্য যেসব বন্ড গ্যারান্টেড ও অ্যাসেট ব্যাকড থাকবে, সেগুলো বিনিয়োগ সীমার বাইরে নেয়া হবে। যেসব ঝুঁকিপূর্ণ বন্ড আছে, সেগুলো হয়তো বিনিয়োগ সীমার মধ্যে থাকবে।’
গত কমিশন সভায় অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) রুলস পাস করা হয়েছে উল্লেখ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে সরকারি ট্রেজারি বন্ডগুলো লেনদেন হবে। সে সুবাদে বাজারে ৫০ বা ৫৮ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে। সুতরাং আজ যারা জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন ১৫ বা ১৮ শতাংশ বলেন, সেটা চলতি মাসেই চলে যাবে ২০-৩০ শতাংশে।’
আরও পড়ুন:পুঁজিবাজারে এক সপ্তাহ টানা দরপতনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিটি শেয়ারে যে সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেটি আপাতত তুলে নেয়ার কোনো চিন্তা নেই। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস অব্যাহত থাকবে।
বিভিন্ন ফোরামে কমিশনের ফ্লোর প্রাইস নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে জানতে পারার পর বৃহস্পতিবার বিএসইসির অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে এ সংক্রান্ত পোস্ট দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ২৮ জুলাই ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে। যা ৩১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়ে বর্তমানেও রয়েছে।’
এতে বলা হয়, ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেয়া হবে বলে নানা মহল থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যা কমিশন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
কমিশন গুজব সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করছে এবং অতি দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও জানানো হয়।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার পর পুঁজিবাজারে ধস ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়। পরে বাজার ঊর্ধ্বগতিতে ফিরলে ধাপে ধাপে তা তুলে দেয়া হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাজারে যে ধস নামে, সেটি ঠেকাতে গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় বার দেয়া হয় ফ্লোর প্রাইস।
৩১ জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। একই সপ্তাহে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও একটি সুখবর আসে। ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে গণনা হবে বলে সার্কুলার দিয়ে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক যুগ ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল বিএসইসি।
এর ফলে শেয়ার কেনার পর সেটির দর বেড়ে গিয়ে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করার কোনো ঝুঁকি রইল না।
এই দুটি খবরে গত সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৩৩১ পয়েন্ট সূচকের উত্থান এবং লেনদেন বেড়ে আড়াই গুণ হয়ে গেলেও চলতি সপ্তাহে পুরো বিপরীত চিত্র। প্রতিদিন লেনদেন আগের দিনের চেয়ে কমতে কমতে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসের তুলনায় শেষ কর্মদিবসে হয়েছে অর্ধেক। আর চার দিনে সূচকে কমেছে ১৬৩ পয়েন্ট। ফ্লোর প্রাইস থেকে বেড়ে গিয়ে যে শেয়ারগুলো ঊর্ধ্বগামি ছিল, সেগুলোর পর আবার ফ্লোরে ফিরছে।
আরও পড়ুন:ফ্লোর প্রাইস দেয়ার আগের দিন বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর ছিল ১১৪ টাকা ২০ পয়সা। তবে আগের পাঁচ দিনের গড়মূল্য হিসাব করে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর নির্ধারিত হয় ১১৫ টাকা ৭০ পয়সা।
গত সপ্তাহে শেয়ারদর বেড়ে ৪ আগস্ট উঠে ১২৭ টাকা ৯০ পয়সায়। চলতি সপ্তাহের চার কর্মদিবসে যতটুকু বেড়েছিল, সেখান থেকে প্রায় সবটুকুই হারিয়ে এখন দর নেমে দাঁড়িয়েছে ১১৭ টাকা ১০ পয়সায়।
কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই একই চিত্র। শক্তিশালী মৌলভিত্তিক গ্রামীণ ফোনও তার ফ্লোর প্রাইস ২৮৬ টাকা ৬০ পয়সার কাছাকাছি ২৮৭ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে এসেছে।
নতুন সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর শেয়ারপ্রতি সাড়ে ১২ টাকা অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ঘোষণার পর শেয়ারদর যতটা বেড়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই এক দিনেই নাই হয়ে গেছে।
লভ্যাংশসংক্রান্ত রেকর্ড ডেট শেষে লেনদেন শুরু হতেই ১৫ টাকা ৪০ পয়সা কমে গেছে শেয়ারদর।
বেক্সিমকো ও গ্রামীণফোনের মতো চিত্র শত শত কোম্পানির। প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা পদ্ধতি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার সপ্তাহে প্রতিদিন বাড়লেও পরের সপ্তাহের প্রতিদিনই পড়ল পুঁজিবাজার।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৮ পয়েন্ট, সোমবার ৪৫ পয়েন্টের পর মঙ্গলবার আশুরার ছুটি শেষে ৭৮ পয়েন্টের পতনে জেঁকে বসা আতঙ্কে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার উধাও হয়ে গেছে শেয়ারের ক্রেতা। ৩২ পয়েন্ট সূচকের পতনের পর ৯ কর্মদিবস পর লেনদেন নেমে এলো পাঁচ শ কোটির ঘরে।
আগের সপ্তাহে ৩৩১ পয়েন্ট সূচকের উত্থান বিনিয়োগকারীদের যতটা আশাবাদী করেছিল, চলতি সপ্তাহে ১৬৩ পয়েন্টের পতন তার চেয়ে বেশি হতাশ করেছে বিনিয়াগকারীদের। আগের সপ্তাহে আর্থিক ক্ষতি তারা যতটা পোষাতে পেরেছিলেন, চলতি সপ্তাহে সেটি উধাও হয়ে গেছে।
ফ্লোর প্রাইসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণার দিন লেনদেন ছিল ৪৪১ কোটি ৭৭ লাখ ৮২ হাজার। আর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর টানা চার কর্মদিবস লেনদেন বেড়ে এক হাজার দুই শ কোটি ছুঁই ছুঁই হয়ে যাওয়ার পর টানা পাঁচ দিনে সূচক ৩৩১ পয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার পর হতাশা কাটার আলোচনা তৈরি হয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুঁজিবাজারে দর সংশোধন, এরপর ধস নামার ৯ মাস পর প্রথমবারের মতো এমন একটি আলো ঝলমলে সপ্তাহ পার করার পর চলতি সপ্তাহে পুরো বিপরীত চিত্র।
আগের সপ্তাহে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল হলেও চলতি সপ্তাহ দেখা দেয় অস্থিরতা। ১০৮ টাকা থেকে ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে খোলাবাজারে দর উঠেছে ১২০ টাকা। যুক্তরাজ্যের পাউন্ড ছুঁয়েছে দেড় শ টাকা।
এই অবস্থায় অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি নানা ধরনের গুজব-গুঞ্জন ডালপালা মেলছে। আর বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। বাজারে বিপুল বিক্রয় চাপ, কিন্তু ক্রেতার অভাব- এই অবস্থায় শেয়ারদর আরও কমছে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের কারণে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের নিচে নামা সম্ভব নয়, এই অবস্থাতেও অনিশ্চয়তার কারণে কিনতে চাইছে না তারা।
যেমন ফ্যামিলি টেক্সের ফ্লোর প্রাইসে ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৮৩টি শেয়ারের বিক্রেতা থাকলেও একজন ক্রেতাও ছিল না।
পাঁচটি কোম্পানির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি, একটি কোম্পানির একটি, একটি কোম্পানির দুটি, ছয়টি কোম্পানির এক শর নিচে, আরও ছয়টি কোম্পানির পাঁচ শর নিচে, আরও তিনটি কোম্পানির এক হাজারের কম, আরও ১৪টি কোম্পানির তিন হাজারের কম, আরও ৯টি কোম্পানির পাঁচ হাজারের কম শেয়ার হাতবদল হয়েছে। যদিও বিক্রেতা ছিল লাখ লাখ শেয়ারের।
দিনভর ৯৬টি শেয়ারের দাম বেড়েছে। আর ১৬৬টি শেয়ারের দাম কমেছে। আগের দামেই লেনদেন হয়েছে ১১৬টি কোম্পানির শেয়ার।
হাতবদল হয়েছে ৫৮১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, যা আগের দিন ছিল ৭৯৯ কোটি ৪৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
লেনদেনের বিষয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন, ‘এখন বাজারের মোটিভ একটাই। আগেও বলেছি, এখনও বলছি কম দামে শেয়ার কিনতে চান বাজারের বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সেটার প্রভাব লেনদেনে।’
আরও পড়ুন:গত এক বছরে টালমাটাল পুঁজিবাজারেও মুনাফা করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের তিনটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
এগুলো ইউনিটপ্রতি ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ দেড় টাকা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। পুঁজিবাজারে একেকটি ইউনিট ৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৯ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হচ্ছে।
২০২১ সালের জুলাই থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থবছরের হিসাব পর্যালোচনা করে বুধবার ফান্ড তিনটির ট্রাস্টি কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো হলো এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড, এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড ও এসইএমএল আইবিবিএল শরীয়াহ্ ফান্ড।
ফান্ড তিনটির মুনাফা পুঁজিবাজারের এক বছরের সার্বিক অবস্থার তুলনায় বেশ ভালো। ২০২১ সালের প্রথম কর্মদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইর সার্বিক সূচক ছিল ৬ হাজার ২১৯ পয়েন্ট, যা অর্থবছর শেষে গত ৩০ জুন ছিল ৬ হাজার ৩৭৬ পয়েন্ট।
এক বছরে বেড়েছে ২.৫২ শতাংশ। তবে তিনটি ফান্ডের ইউনিট মূল্যের বিবেচনায় বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাবেন এর চেয়ে বেশি।
তিনটি ফান্ডই এবার আয়ের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
সবচেয়ে বেশি দেবে এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড
তিনটি ফান্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেবে এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড। এর ইউনিটধারীরা প্রতি ইউনিটের বিপরীতে ১৫ শতাংশ বা দেড় টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন।
বর্তমানে ফান্ডটির ইউনিট মূল্য ৮ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিটমূল্যের ১৭ দশমিক ০৪ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা এক বছরের লভ্যাংশ হিসেবেই পাবেন।
ফান্ডটি যত টাকা আয় করেছে, লভ্যাংশ দেবে তার চেয়ে বেশি। এবার এটির ইউনিট প্রতি আয় (ইপিইউ) হয়েছে ৯৩ পয়সা। এটি গত বছরের প্রায় অর্ধেক।
২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে ফান্ডটি ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৮৭ পয়সা আয় করে দেড় টাকা করে লভ্যাংশ দিয়েছিল।
জুন শেষে ইউনিট প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিইউ) দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৫৪ পয়সায়। ২০২১ সালের জুন শেষে যা ছিল ১২ টাকা ৩০ পয়সা।
২০১৯ সালে ফান্ডটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রতি বছরই বিনিয়োগকারীরা ফান্ডটি থেকে লভ্যাংশ পেয়েছেন
৮ টাকা ৬০ পয়সার ফান্ডে লভ্যাংশ ৬০ পয়সা
এসইএমএল আইবিবিএল শরীয়াহ্ ফান্ডের ইউনিটধারীরা ইউনিট প্রতি ৬ শতাংশ বা ৬০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ পাবেন।
এই ফান্ডটির ইউনিট দর এখন ৮ টাকা ৬০ পয়সা। এই হিসেবে ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা পাবেন লভ্যাংশ হিসেবে।
এই ফান্ডটির ইউনিট প্রতি আয় (ইপিইউ) হয়েছে ৫২ পয়সা।
আগের বছর ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৩৫ পয়সা আয় করে ১ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছিল ফান্ডটি। ওই বছর আয়ের তুলনায় লভ্যাংশ কম হওয়ার কারণ ছিল তার আগের বছর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান সমন্বয়।
এবার সমন্বয়ের কোনো হিসাব ছিল না বলে আয়ের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়া গেছে আগের বছরের রিজার্ভ থেকে।
জুন শেষে এই ফান্ডটির ইউনিট প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিইউ) দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৮৩ পয়সা, যা আগের বছর ছিল ১১ টাকা ৩১ পয়সা।
ফান্ডটি ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে কেবল তারা লভ্যাংশ দিতে পারেনি লোকসানের কারণে।
ফান্ডগুলোর রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ ঘোষিত লভ্যাংশ পেতে হলে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে ওই দিন পর্যন্ত ফান্ডের ইউনিট ধরে রাখতে হবে।
ইউনিটপ্রতি ৫০ পয়সা লভ্যাংশ
এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫ শতাংশ বা ইউনিট প্রতি ৫০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা করেছে।
এই ফান্ডটির ইউনিট দর এখন ৯ টাকা ১০ পয়সা। এই হিসাবে ইউনিটদরের ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ হিসেবে পাবেন।
এই ফান্ডটির এবার ইউনিট প্রতি আয় (ইপিইউ) হয়েছে ৪৬ পয়সা।
আগের বছর ফান্ডটি ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৪ পয়সা আয় করে দেড় টাকা করে লভ্যাংশ দিয়েছিল। ওই বছর লভ্যাংশ কম হয়েছিল আগের বছর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৭ পয়সা লোকসান সমন্বয়ের কারণে। গত বছর কোনো লোকসান না থাকায়, এবার আয়ের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দিতে পারবে ফান্ডটি।
গত ৩০ জুন শেষে ফান্ডটির ইউনিট প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিইউ) দাঁড়ায় ১০ টাকা ৮০ পয়সা, আগের বছর যা ছিল ১১ টাকা ৮৪ পয়সা।
এই ফান্ডটি ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে বাজারে ধসের মধ্যে কেবল তারা লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
আরও পড়ুন:
জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পর এবার আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্যানেল ব্রোকার হলো দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্রোকারহাউজ সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড।
রাজধানীর সিটি সেন্টারে সিটি ব্রোকারেজের প্রধান কার্যালয়ে বুধবার এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে।
ফলে এখন থেকে আইসিবি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী বা গ্রাহকরা সিটি ব্রোকারেজের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারবেন।
সিটি ব্রোকারেজের নিজস্ব অ্যাপ ‘সিটি ইনফিনিট’ ব্যবহার করে যে কোনো জায়গা থেকে শেয়ার কেনাবেচা যাবে।
একই সঙ্গে সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডের গ্রাহকরা আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড থেকে মার্জিন লোন পাওয়ার যোগ্য হবেন।
সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এম আফফান ইউসুফ এবং আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জিএম অসিত কুমার চক্রবর্তী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
অনুষ্ঠানে সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডের এফপিভি ও বিক্রয় প্রধান সাইফুল ইসলাম, এসএভিপি এবং করপোরেট প্রধান সাইফুল ইসলাম মাসুম, হেড অফ রিটেইল মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল উপস্থিত ছিলেন।
আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল আমিন তালুকদার, উপ-প্রধান নির্বাহী মেহমুদ হাসান মুরাদ, শামীম পারভেজ ও মোহাম্মদ আসাদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
গত ৪ আগস্ট জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্যানেল ব্রোকার হিসেবে চুক্তি স্বাক্ষর করে সিটি ব্রোকারেজ।
আরও পড়ুন:এক যুগের চাওয়া ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনার ঘোষণা আসার পরে আবারও উল্টো পথে পুঁজিবাজার।
এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আসার টানা তিন কর্মদিবস দরপতন হলো পুঁজিবাজারে। এর মধ্যে রোববার ৮ পয়েন্ট, সোমবার ৪৫ পতনের পর মঙ্গলবার আশুরার ছুটি শেষে বুধবার আরও ৭৮ পয়েন্ট পড়ল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স। অর্থাৎ তিন কর্মদিবসেই ১৩১ পয়েন্ট কমল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক।
অথচ প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এক্সপোজার লিমিট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর আগের সপ্তাহে টানা পাঁচ কর্মদিবসে সূচক বেড়েছিল ৩৩১ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে লেনদেনে দেখা গিয়েছিল ঊর্ধ্বগতি।
গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনার ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই বাজারমূল্য ধরা হবে।
এতদিন বাজারমূল্য অথবা ক্রয়মূল্যের মধ্যে যেটি বেশি, সেটিকে ধরেই ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা করা হতো। এর ফলে কোনো শেয়ারের দর বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতো।
সেটি না করলে এক দিন শেয়ার ধরে রাখলেই ব্যাংককে জরিমানার একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যে কারণে এদিকে দৃষ্টি রাখতে হতো কোম্পানিগুলোকে।
এটিকে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসেবে ধরা হতো। আশা করা হচ্ছিল, এই সমস্যার সমাধান হলে বাজারে বিক্রয়চাপ কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়বে।
তবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৪৬ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ইস্যুতে নতুন করে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। এর পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন ইস্যুও যোগ হয়েছে।
শেয়ারগুলো দর হারানোর সঙ্গে সঙ্গে কমছে লেনদেন। টানা তিন দিন সূচকের পাশাপাশি লেনদেন কমে নেমে গেছে হাজার কোটি টাকার নিচে।
রোববার আগের দিনের তুলনায় লেনদেন কমেছিল কমই। সোমবার সূচক অনেকটাই কমলেও লেনদেন গতি ধরে রাখে। তবে বুধবার দেখা গেল ধপাস।
সোমবারের তুলনায় এদিন লেনদেন কমেছে প্রায় ২০৯ কোটি টাকা। হাতবদল হয়েছে ৭৯৯ কোটি ৪৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকার শেয়ার। সোমবার হাতবদল হয়েছিল ১ হাজার ৮৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার টাকার শেয়ার।
এদিন ২৭৯টি কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে। বিপরীতে বেড়েছে কেবল ২৬টির দর। আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ৭৪টি শেয়ার।
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ তুলে দেয়ার কারণে এখন সূচকের পতনের সুযোগ বেড়েছে। ফ্লোর ও এক্সপোজার লিমিট ইস্যুতে এক সপ্তাহে বাজার ৫ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দুই শতাংশের পতনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটিই বাজারে বড় দরপতনের কারণ।
যেমন বেক্সিমকো লিমিটেড, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, বেক্সিমকো ফার্মা, ইউনিক হোটেল, ওরিয়ন ফার্মার মতো কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এগুলো সূচকের বড় পতনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে।
বাজারের এই চিত্র ভাবিয়ে তুলেছে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীনকে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগের কর্মদিবসের পতনটা স্বাভাবিক দর সংশোধন ছিল। তবে আজকেরটা শুধু দর সংশোধন নয়, এর সঙ্গে বেশ কিছু মোটিভ যুক্ত হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যদি পতনের কারণ হতো তাহলে রোববারেই বড় পতন হতো।’
তিনি বলেন, ‘কম দামে শেয়ার কেনার একটা মোটিভ রয়েছে। ৩০০ পয়েন্ট বেড়েছে সেটা হয়তো ২০০ পয়েন্ট ফেলে কম দামে শেয়ার কিনতে চান বাজারের বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।’
সব খাতেই দরপতন
ঢালাও পতনের দিন কোনো খাতেই স্বস্তি মেলেনি। প্রায় সব খাতেই সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে।
তবে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি ছিল বস্ত্র খাতে। এই খাতে লেনদেন হয়েছে দেড় শ কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ১৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকার, যা মোট লেনদেনের ২১.০২ শতাংশ।
তবে ৭৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ৪৫টি কোম্পানির দরপতন হয়েছে খাতটিতে। মাত্র ৬ দশমিক ৯০ শতাংশের দর বেড়েছে আর আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ১৫.৫২ শতাংশ কোম্পানির।
আর কোনো খাতের লেনদেন ১০০ কোটি স্পর্শ করতে পারেনি। ৩টি বা ২১ শতাংশ কোম্পানির বৃদ্ধি দেখা গেছে বিবিধ খাতে। দরপতন হয়েছে ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ কোম্পানির। আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার।
খাতটিতে লেনদেন হয়েছে ৯৬ কোটি ৩৪ লাখ অর্থাৎ মোট লেনদেনের ১৩.২৫ শতাংশ।
লেনদেনের ১০ শতাংশের বেশি হয়েছে প্রকৌশল ও ওষুধ খাতে।
তবে প্রকৌশলে ৮৩.৩৩ শতাংশ আর ওষুধ খাতে ৯৩.৫৫ শতাংশ কোম্পানির দরপতন হয়েছে।
পঞ্চম স্থানে থাকা জ্বালানি খাতের ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা লেনদেনের পাশাপাশি ৭৮.২৬ শতাংশের দরপতন ও ৮.৭০ শতাংশের দরবৃদ্ধি দেখা গেছে।
ব্যাংক খাতে ৪টি কোম্পানি বা ১২.১২ শতাংশের দরবৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৬০ শতাংশ কোম্পানির দর।
এ ছাড়া খাদ্য, বিমা, পেপার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আইটি ও পাট খাতে ব্যাপক পতন হলেও সামান্য অল্প কিছুসংখ্যক কোম্পানির দর বৃদ্ধি হয়েছে।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ দর বেড়েছে উৎপাদনে না থাকা লোকসানি কোম্পানি জুট স্পিনার্সের। সর্বশেষ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৯০ টাকা ৮০ পয়সায়।
দ্বিতীয় স্থানে ছিল সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ। ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ বেড়ে প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ ৫ দশমিক ০১ শতাংশ দর বেড়েছে এস আলম কোল্ডরোল স্টিলের। শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৩৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
এ ছাড়া শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে আমান ফিড, অ্যাপেক্স স্পিনিং, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ডমিনেজ স্টিল, বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স।
দরপতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর কমেছে মোজাফফর স্পিনিংয়ের। ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ দর কমে সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ২৯ টাকা ৪০ পয়সায়।
৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর কমেছে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সোনারগাঁও টেক্সটাইলের। হাতবদল হয়েছে ৬১ টাকা ৪০ পয়সা। সোমবার ছিল ৬৬ টাকা।
তৃতীয় স্থানে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের দর ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমে ১৯ টাকায় লেনদেন হয়েছে।
এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে বিডি থাই ফুড, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল, এসকে ট্রিমস, তুং হাই নিটিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ম্যাকসনস ইন্ডাস্ট্রিজ ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৯৬ পয়েন্ট সূচক কমেছে ওয়ালটন হাইটেকের দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২২ পয়েন্ট কমিয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
লাফার্জ হোলসিমের দর ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৪ দশমিক ৬২ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ওরিয়ন ফার্মা, ইউনাইটেড পাওয়ার, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনিক হোটেল ও আইসিবির দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৩৪ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৪ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বার্জার পেইন্টস। কোম্পানির দর শূন্য দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে।
আর কোনো কোম্পানি এককভাবে এক পয়েন্ট সূচকে যোগ করতে পারেনি।
ব্র্যাক ব্যাংক, ম্যারিকো বাংলাদেশ, সোনালী পেপার, ইউনিলিভার, ইস্টার্ন ব্যাংক, আমান ফিড, এস আলম স্টিল, ট্রাস্ট ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ০২ পয়েন্ট।
আরও পড়ুন:ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি ২০১৭ সালে ১০ টাকার শেয়ারপ্রতি ৬৯ টাকা ৫৫ পয়সা লোকসান দেয়ার পর বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারলেই বাঁচে। একপর্যায়ে দর নেমে আসে দুই টাকার ঘরে। সেই কোম্পানির শেয়ার এখন ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো।
ওই বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি কোনো সম্পদ ছিলই না, ছিল ৬৬ টাকা ৪০ পয়সার দায়।
গত ১৪ জুলাই কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৬ টাকা ২০ পয়সা। সেদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৩২৪ পয়েন্ট। সেখান থেকে ধস নেমে ফ্লোর প্রাইস ঘোষণার দিন ২৮ জুলাই সূচকের অবস্থান নামে ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্ট। অর্থাৎ ১০ কর্মদিবসে কমে ৩৪৪ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট।
তবে বাজারের গতির বিপরীতে গিয়ে এই সময়ে বিআইএফসির শেয়ারদর এই সময়ে বাড়ে ৫১ শতাংশের বেশি। সেদিন শেয়ারদর দাঁড়ায় ৯ টাকা ৪০ পয়সা। ১০ দিনে বাড়ে ৩ টাকা ২০ পয়সা।
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার আসার পর পাঁচ দিনে ৩৩১ পয়েন্ট সূচক বাড়ার পর বিআইএফসির শেয়ারদর বাড়ে আরও বেশি।
একপর্যায়ে তা ১৩ টাকা ৬০ পয়সায় উঠে যায়। অবশ্য এখন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১২ টাকা ২০ পয়সায় নেমেছে।
২০১৭ সালের হিসাব দেয়ার পর বিআইএফসি ২০১৯ সালের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করেছে। এই বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১২ টাকা ২০ পয়সা।
২০১৭ সালের তুলনায় লোকসান কমলেও শেয়ারপ্রতি দায়ের দিক থেকে আরও অবনতি হয়েছে। ২০১৯ সাল শেষে শেয়ারপ্রতি দায় দাঁড়ায় ৯৪ টাকা ২৭ পয়সায়।
এমন একটি কোম্পানির শেয়ারদর ১৮ কর্মদিবসে শতভাগের বেশি বেড়ে যাওয়া কোনো স্বাভাবিকতার মধ্যে পড়ে না- এটা বলাই যায়।
বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, বিআইএফসির মতো ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব শেয়ারদরই একইভাবে ঊর্ধ্বগামী।
সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বাড়ছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের দর।
ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া এসব কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও দেশসেরা কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়েনি সে রকম।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কোম্পানির দর বাড়ার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলোর দর বাড়ে জুয়াড়িদের কারণে। আর গুজবে কান দিয়ে কিছুটা দাম বাড়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারী।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং
২০১৯ সালে কোম্পানিটি ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে লোকসান দিয়েছে ১২৬ টাকা ৩৬ পয়সা। পরের বছর লোকসান দাঁড়ায় ৩১ টাকা ৩০ পয়সা। ২০২১ সালের আর্থিক হিসাব এখনও প্রকাশ হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া ওই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব শেষে জানানো হয়, তিন প্রান্তিক মিলে শেয়ারপ্রতি লোকসান ৭ টাকা ৭১ পয়সা। আর শেয়ারপ্রতি দায় ১৫২ টাকা ৬৪ পয়সা।
গত ২০ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫ টাকা। গত দুই কর্মদিবস কিছুটা কমার পরও এখন ৬ টাকা ৭০ পয়সা। বেড়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা বা ৩৪ শতাংশ। দুই দিন আগে তা ছিল আরও বেশি, ৭ টাকা ১০ পয়সা।
গত বছর কোম্পানিটির সাবেক এমডি পিকে হালদারের যোগসাজশে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আলোচনায় আসে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল
২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি ৫৬ পয়সা লাভের পর ২০১৯ সালে ৬ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান হয়। ২০২০ সালে ৩ টাকা ৮ পয়সা এবং ২০২১ সালে সর্বশেষ ৮ টাকা ৩ পয়সা লোকসান গুনেছে কোম্পানিটি।
গত ২ নভেম্বর বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এক কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড।
স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থ আদায় না করেই অবলোপন বা রাইট অফ করছে। এভাবে নানা অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ শেষ করে দায় পরিশোধের সক্ষমতা হারাচ্ছে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানটি। শত কোটি টাকা আটকে রেখে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ২০ জুলাই এই কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৬ টাকা ৯০ পয়সা। এক পর্যায়ে গত রোববার উঠে যায় ৯ টাকা ৪০ পয়সায়। পরদিন কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ টাকায়। এই কয়দিনে বেড়েছে ২ টাকা ১০ পয়সা বা ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এই কোম্পানির শেয়ারদরে অস্বাভাবিকতা আগেও দেখা গেছে। ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এর শেয়ারদর ১৫ টাকা ৫০ পয়সায় উঠে গিয়েছিল। পরে আবার ৬ টাকা ৬০ পয়সায় নেমেও যায়।
ফাস ফাইন্যান্স
পি কে হালদারের ঋণে কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া কোম্পানি এটিও।
২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ১৪ টাকা ৬১ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটি পরের বছরের আর্থিক প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করেনি। ওই বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত আয় ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ হয়েছে প্রায় এক বছর পর।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই বছরের তিন প্রান্তিকে ফাস ফাইন্যান্সের শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৭ টাকা ২০ পয়সা। এর এই সময় পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি দায় আছে ২০ টাকা ৫৯ পয়সা।
গত ১৯ জুলাই এই কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৪ টাকা ৯০ পয়সা। বর্তমান দর ৬ টাকা ৩০ পয়সা। বেড়েছে ১ টাকা ৪০ পয়সা বা ২৮ দশমিক ৬০ শতাংশ।
তবে দর আরও বেড়ে হয়েছিল ৬ টাকা ৭০ পয়সা।
গত বছর সেপ্টেম্বরেও কোম্পানিটির শেয়ারদর অস্বাভাবিকবাবে বাড়তে দেখা যায়। নানা গুজব-গুঞ্জনে এক পর্যায়ে তা ১১ টাকা ৭০ পয়সায় উঠে যায়।
ফারইস্ট ফাইন্যান্স
এই কোম্পানিটি চলতি অর্থবছরের কোনো প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করেনি এখনও। ২০২১ সালের চূড়ান্ত হিসাবও দেয়নি। ওই বছরের ১ নভেম্বর প্রকাশ করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত হিসাব দিয়েছে।
এতে দেখা যায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা। শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য কেবল ১ টাকা ১৫ পয়সার।
গত ১৯ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫ টাকা ২০ পয়সা। বর্তমান দর ৬ টাকা ৩০ পয়সা। বেড়েছে ১ টাকা ১০ পয়সা বা ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
তবে দর বেড়েছিল আরও বেশি, ৬ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত।
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্তও কোম্পাটির দর অস্বাভাবিকহারে বাড়তে দেখা যায়। সে সময় দর উঠে ১০ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত। গত ২২ মে নেমে আসে ৪ টাকা ৭০ পয়সায়।
ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড
২০২১ সালের আর্থিক হিসাব ও চলতি অর্থবছরের দুই প্রান্তিকের হিসাব একসঙ্গে প্রকাশ করেছে কোম্পানিটি। এতে দেখা যায় গত ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের এর শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৮ টাকা ৪৭ পয়সা। আর গত জুন শেষে দুই প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ১২ পয়সা।
কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি কোনো সম্পদ নেই, উল্টো দায় আছে ১৮ টাকা ৪৪ পয়সার।
এই কোম্পানির শেয়ারদর গত ২০ জুলাই ছিল ৫ টাকা। বর্তমান দর ৬ টাকা। অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে বেড়েছে এক টাকা বা ২০ শতাংশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরেও একবার শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তা উঠে যায় ৯ টাকা ৯০ পয়সায়।
প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স
এই কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি ৯৩ টাকা লোকসান দেয়ার পর ২০২১ সালের আর্থিক হিসাব এখনও প্রকাশ করেনি।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী কোম্পানিটি ওই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ৬ টাকা ৩৩ পয়সা লোকসান দিয়েছে। তখন প্রতি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ ছিল ৯ টাকা ৮১ পয়সার।
গত ১৯ জুলাই এই কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৬ টাকা ৪০ পয়সা। বর্তমান দর ৭ টাকা ৭০ পয়সা। এই কয়দিনে বেড়েছে ১ টাকা ২০ পয়সা বা ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
সোমবার দর ৮ টাকা ১০ পয়সাতেও উঠেছিল, পরে সেখান থেকে কমে ৪০ পয়সা।
এই কোম্পানির দর বাড়া শুরু হয় গত ২২ মে। সেদিন হাতবদল হয় ৬ টাকা ১০ পয়সা দরে।
গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এই কোম্পানিটির শেয়ারদরে এবারের চেয়ে বেশি উল্লম্ফন দেখা যায়। সে সময় দর ৫ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়ে যায় ১৪ টাকা ৬০ পয়সায়। সেখান থেকে পরে নেমে আসে ৬ টাকায়।
‘এর কারণ জুয়া’
যেসব কোম্পানির অদূর ভবিষ্যতে মুনাফায় ফেরা বা লভ্যাংশ দেয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই, সেসব কোম্পানির শেয়ারদরে এভাবে লাফ দেয়ার পেছনে জুয়াড়িয়াদের প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক বলেন, ‘এসব কোম্পানি তো আর রাতারাতি ভালো হয়ে যায় না। কিন্তু তারপরও এগুলোর দাম বাড়ে, এর কারণ হলো জুয়া খেলা। জুয়াড়িরা এসব শেয়ারের দাম টেনে তোলে। আর গুজবে কান দিয়ে অনেকেই এই শেয়ার কেনেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশে যদি ২০ লাখ বিনিয়োগকারী থাকেন, এর মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ হাজার হবে যারা প্রকৃত বিনিয়োগকারী। তারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করেন। বাকিরা ওমুক ভাই, তমুক ভাইকে ফলো করে শেয়ার কেনেন।
‘এসব গুজব এবং জুয়াড়িদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো তিন বারের মধ্যে একবার উইন করেছে, তাই বেশি টাকা বানানোর আশায় সেই পথই বারবার অনুসরণ করে। এতে জুয়াড়িরা লাভবান হয়, কিন্তু তারা কোনো আয় করতে পারেন না।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য