বাজেটে আরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মেডিটেশন সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর–ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে আমদানিকরা লিফটের ভ্যাট। অন্যদিকে, আমদানিকরা বিটুমিনে (আলকাতরা) নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদে বুধবার এই পরিবর্তনের প্রস্তাব আনেন অর্থমন্ত্রী, যা পাস হয় কন্ঠভোটে।
গত ৯ জুন বাজেট ঘোষণায় মেডিটেশন সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এতে প্রবল আপত্তি জানায় মেডিটেশন সেবাগ্রহণকারীরা।
এমন প্রেক্ষাপটে এই সেবার ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে যারা মেডিটেশন সেবা নেবেন, তাদের খরচ কমবে।
বাজেট ঘোষণার সময় আমদানি করা লিফটের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে মোট ৩১ শতাংশ করা হয়। মূলত দেশীয় লিফট শিল্পের সুরক্ষায় বাড়তি কর আরোপ হয়।
লিফট আমদানিকারকরা বলছে, এত বেশি কর দিয়ে লিফট আনলে খরচ অনেক বাড়বে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আবাসনখাতে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লিফট আমদানিতে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়।
বাজেট ঘোষণায় বিটুমিন আমদানিতে বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। দেশে বিটুমিন শিল্প নতুন করে গড়ে উঠেছে। তাই এই শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি করা বিটুমিনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। এতে করে আমদানি করা বি-টুমিন দাম পড়বে বেশি। পক্ষান্তরে, দেশীয় বি-টুমিন শিল্পের চাহিদা বাড়বে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬ হাজার ৭৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
বৃহস্পতিবার নগর ভবনের মেয়র হানিফ অডিটোরিয়ামে এ বাজেট ঘোষণা করা হয়।
এর আগে গত ২৬ জুলাই নগর ভবনের মেয়র হানিফ অডিটোরিয়ামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় পরিষদের পঞ্চদশ করপোরেশন সভায় সর্বসম্মতভাবে এ বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটও অনুমোদন দেওয়া হয় সেই সভায়।
দক্ষিণ সিটির ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে আয় অংশের প্রারম্ভিক স্থিতি ধরা হয়েছে ৫৯৩.৬৯ কোটি টাকা, রাজস্ব আয় ১২০৮.৭০ কোটি, অন্যান্য আয় ৫৭.৮০ কোটি, সরকারি থোক ও বিশেষ বরাদ্দ ৬৫ কোটি এবং মোট সরকারি ও বৈদেশিক উৎস থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪৮১৬.০৯ কোটি টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত করপোরেশন সভায় ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল ৬ হাজার ৭৩১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ১১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করলো সংস্থাটি।
মেয়র পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এটি তার তৃতীয় বাজেট ঘোষণা।
বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদসহ কাউন্সিলর, বিভাগীয় প্রধান এবং আঞ্চলিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:দেশে জ্বালানি মজুত নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে দাবি করছে সরকার। জ্বালানি তেলের আমদানিকারক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, এলসি সংকটের কারণে সম্প্রতি আমদানি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেই সংকট দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি নেই বলেও জানিয়েছে বিপিসি। বিতরণ কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা, যমুনার পক্ষ থেকেও তেল সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
দেশে প্রধান জ্বালানি তেল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ডিজেল। বছরে এর চাহিদা ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৪৫ লাখ টনই আমদানি করা হয়, দেশের গ্যাস খনি ও তেল কূপ থেকে মেলে আরও ১০ লাখ টন।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ডিজেলের মজুত রয়েছে ৪ লাখ ৫ হাজার টন। এ ছাড়া ফার্নেস অয়েল আছে প্রায় ৮২ হাজার ৮০০ টন, অকটেন মজুত ১৪ হাজার ৩০০ টন, জেট ফুয়েল ৫৮ হাজার ৭০০ টন, পেট্রল প্রায় ১৭ হাজার ৬০০ টন এবং কেরোসিনের মজুত আছে ১৩ হাজার ৪০০ টন।
দেশে ডিজেলের মজুতের সক্ষমতা ৬ লাখ টনের বেশি। অকটেন মজুতের ক্ষমতা ৪৬ হাজার টন, পেট্রল ৩২ হাজার টন, কেরোসিন ৪২ হাজার টন। আর ফার্নেস অয়েল মজুত রাখা যায় ১ লাখ ৫০ হাজার টন।
বিপিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, জ্বালানির এই পরিসংখ্যানের চেয়ে প্রকৃত মজুত অনেক বেশি। এই পরিসংখ্যান কেবল বিপিসির মজুত ট্যাংকসংক্রান্ত। তবে দেশের বেসরকারি শোধনাগারগুলোর নিজস্ব মজুত ব্যবস্থাপনায় আরও পেট্রল ও অকটেন রয়েছে। এগুলো বিপণন কোম্পানির সরবরাহ লাইনে আসার অপেক্ষায় আছে।
বিপিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশে সাধারণত ৪৫ দিনের ডিজেল সব সময় মজুত থাকে। তবে এখন তা ৪০ দিনে নেমে আসায় অনেকের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে ডিজেলের বিক্রি বেড়ে যাওয়া ও সীমান্ত এলাকায় ডিজেল পাচার রোধে রেড অ্যালার্ট জারি হওয়ায় মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে গুজবের সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করছে বিপিসি।
উদ্বেগের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি দাবি করে কর্তৃপক্ষ বলছে, ডিজেলের মজুত কিছুটা কমলেও কয়েকটি জাহাজ জ্বালানি তেল নিয়ে চট্টগ্রামের পথে রয়েছে। অন্যদিকে অকটেন ও পেট্রল দেশেই উৎপাদিত হয়। অকটেন ও পেট্রলের স্বল্প দিনের মজুত নিয়ে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তা সঠিক নয়। এই দুই পণ্যের মজুত সাধারণত এমনই থাকে, কখনও তা বেড়ে ১৯-২০ দিনের হয়।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভয় পাবেন না। উদ্বেগের কিছু নেই। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতেও বিপিসির আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ লাইন স্বাভাবিক আছে।’
তিনি বলেন ‘সরকার এরই মধ্যে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে অপচয় রোধ করা যায়, পাচার হতে না পারে এবং যাতে কেউ অবৈধ মজুত গড়ে তুলতে না পারে। এরই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। তারা তেলের মজুত নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে।’
বিপিসি চেয়ারম্যানের ভাষ্য, দেশে ব্যবহৃত পেট্রলের শতভাগই দেশে উৎপাদিত। অকেটেনের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই। তবে কখনও অকটেনের চাহিদা বাড়লে সামান্য পরিমাণ আমদানি করতে হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অক্লান্ত কাজ করছে। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই কারও উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। তিনি জনগণের দুশ্চিন্তা নিজের কাঁধে নিয়ে কাজ করছেন।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। সারা বিশ্ব জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকটের মুখোমুখি। বাংলাদেশকেও এসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবাইকে সেটা মনে রেখে ধৈর্য ধরতে হবে এবং সংকট কাটাতে সরকারকে সহায়তা করতে হবে।’
বিপিসির একজন পরিচালক নিউজবাংলাকে জানান, আগামী আগস্টে ৩ লাখ ৮০ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ঋণপত্র খোলা গেছে মাত্র ১ লাখ টনের। এতে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেশে ডিজেলের মজুত কিছুটা কমেছে। তবে তা উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এরই মধ্যে ভারত থেকে একটি বেসরকারি রিফাইনারিতে অপরিশোধিত তেল এসেছে। কিছু জাহাজ বিপিসির তেল নিয়ে দেশের পথে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কমছে। ফলে সামনে আমদানি আরও বাড়বে। সংকটের কোনো কারণ নেই।‘
দেশে পেট্রল ও অকটেনের স্বল্প দিনের মজুতের তথ্য উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ তথ্য সঠিক নয়। এ দুটি আমাদের দেশীয় পণ্য। এগুলোর মজুত সব সময় এমনই থাকে। গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে কনডেনসেট উৎপাদন বাড়ালে আমাদের উল্টো অকটেন, পেট্রল রাখা জায়গার সংকটেও কিন্তু পড়তে হয়।’
আরও পড়ুন:বড় কোনো সংশোধনী ছাড়াই জাতীয় সংসদে পাস হতে যাচ্ছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট নিয়ে সমাপনী অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের সর্বসম্মত কণ্ঠভোটে পাস হবে এই বাজেট।
এর আগে ৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আগামী অর্থবছরজুড়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার ব্যয়ের বাজেট প্রস্তাব করেন।
এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে মূল লক্ষ্য হলো করোনার অভিঘাত পেরিয়ে দেশকে উন্নয়নের ধারায় প্রত্যাবর্তন। সেই লক্ষ্যে এবার বাজেটের মূল ফোকাস হলো অর্থনীতির সব খাতে সক্ষমতার উন্নয়ন। এ জন্য তিনি এই বাজেটে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন।
ফলে এ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৬ শতাংশের সমান। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার কর-রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক থেকে।
এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা; আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
অপরদিকে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভোক্তাকে মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাজেটে। এ জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে অর্থমন্ত্রী আগামী বছরজুড়ে দেশের মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করেছেন।
আরও পড়ুন:
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে মিতব্যয়ী হতে, সঞ্চয় বাড়াতে, দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে এবং দেশেই চিকিৎসা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া, বিলাসী পণ্য পরিহারের অনুরোধও করেছেন তিনি।
বুধবার রাতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারপ্রধান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেককে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, ব্যক্তিগত সঞ্চয় করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সঞ্চয় বাড়ানো এবং প্রত্যেককে মিতব্যয়ী হতে হবে।
‘দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কথায় কথায় দৌড়ায়ে বিদেশে যেয়ে চিকিৎসা নেয়া যাবে না। দেশেও ভালো চিকিৎসা হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ ঢালাও ব্যবহার করবেন না, অপচয় যেন না হয় সকলেই কিছু কৃচ্ছ্রসাধন করে কিছুটা সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন। আমদানি করা বিলাসী পণ্য পরিহার করে সবাইকে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে।’
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর ইউক্রেনে রুশ হামলার পর দেশে দেশে দেখা দেয়া সংকটের বিষয়টিও উঠে আসে সরকারপ্রধানের বর্ণনায়। এই সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপ সামলে এগিয়ে চলছে বলে মনে করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একে তো করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব, তার ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
‘শত বাধা ও চাপের মুখে পড়লেও আমরা দৃঢ়ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় এগোতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
‘এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা চাই। আমাদের দেশে, বিদেশে, বাইরে সব জায়গায় তো একটা বাধা পেতে হয়। সেটা অতিক্রম করে আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছি। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। এ জন্য জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাই। জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেলে এই বাজেট সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব।’
গত ৯ জুন আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দুই সপ্তাহের বেশি আলোচনা পর্যালোচনার জন্য কিছু পরিবর্তন করে বুধবারের মধ্যে বাজেট পাস করে।
সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, ‘দেশের মানুষ তার প্রত্যেকের জায়গা থেকে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঞ্চয় বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে যে কেউ। সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় তথা অপচয় কমিয়ে এবং আমদানিকৃত বিলাস পণ্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় মনোযোগী হলে দেশ উপকৃত হবে।’
স্থানীয় শিল্পের বিকাশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। তার সরকারকে ব্যবসাবান্ধব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করপোরেট কর হার আরও কমিয়ে কর হার ২ দশমিক ৫০ ভাগ হারে হ্রাস করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বাধা অতিক্রম করে আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছি। তার কারণ, আমাদের দেশের মানুষের আলাদা শক্তি আছে। তারা বুঝতে পারে, অনুধাবন করতে পারে। তখনই তাদের শক্তি বোঝা যায়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য।
‘জাতির পিতার ডাকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এ দেশের মানুষ। স্বাধীনতার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের মানুষকে নিয়েই এগোতে হবে।’
আরও পড়ুন:পাচারের অর্থ-সম্পদ দেশে ফেরত আনতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে যেসব সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সে অনুযায়ী পাচারের সব ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেশে আনার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। শুধু নির্ধারিত হারে কর দিয়ে নগদ টাকা দেশে আনা যাবে।
সংশোধনীতে নতুন করে একটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। তা হলো, দেশের বাইরে কারও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে সেই সম্পদ অর্জনের উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে। সন্তোষজনক জবাব পাওয়া না গেলে ওই সম্পদের মূল্যের সমপরিমাণ জরিমানা অথবা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
নতুন বাজেটে এটিসহ আর কিছু কর প্রস্তাবে পরিবর্তন এনে অর্থবিল-২০২২ পাস হয়েছে।
বুধবার জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এসব সংশোধনী আনেন। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিদেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত আনতে গত ৯ জুন ঘোষিত বাজেটে বিশেষ সুযোগ দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়, স্থাবর সম্পদ দেশে আনার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ এবং অস্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিয়ে ফেরত আনা যাবে। আর কেউ যদি নগদ টাকা দেশে আনতে চায় তাকে কর দিতে হবে ৭ শতাংশ।
এ নিয়ে দেশ জুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মূলত এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট প্রস্তাবে এই সংশোধন আনা হয়েছে।
সংশোধনীতে শুধু নগদ টাকা আনার সুযোগ রেখে বাকি দুটি অর্থাৎ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ আনার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে।
কোম্পানির করপোরেট কর সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সংশোধন আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানি বছরে ৩৬ লাখার টাকার বেশি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করবে তারা কম হারে করপোরেট কর পরিশোধের সুবিধা পাবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই সীমা ছিল বছরে ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানিকে ছাড় দেয়া হয়েছে।
নতুন কোম্পানির বার্ষিক রিটার্ন জমার নিয়ম সহজ করা হয়েছে। যেসব কোম্পানির ব্যবসার বয়স এক কিংবা দুই বছর সেসব কোম্পানি শুধু টিআইএন সনদ দিলেই রিটার্ন গ্রহণ করা হবে। সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক দলিলপত্র জমা না দিলেও চলবে। তবে তৃতীয় বছর থেকে সব ডকুমেন্টসহ রিটার্ন জমা দিতে হবে।
শ্রমিকদের কল্যাণে সব প্রতিষ্ঠানে একটি তহবিল থাকার কথা। নিয়ম অনুযায়ী, মালিক পক্ষ ওই তহবিলে যে পরিমাণ টাকা দেয় তা কোম্পানির খরচ হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে করে কোম্পানির ওপর করের চাপ কমে।
প্রস্তাবিত বাজেটে খরচের বিধান বাতিল করলেও সংশোধন করে তা ফের আগের অবস্থানে নেয়া হয়। তবে এই সুযোগ এক বছরের জন্য বহাল থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়।
আরও পড়ুন:মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনায় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের অবস্থান হবে এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই অবস্থান আগামী অর্থবছরও অটুট থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
জাতীয় সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট আলোচনার উপর সমাপনী বক্তব্যে বুধবার তিনি এমন তথ্য দেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের গত ১৩ বছরের অনন্য অর্জনসমূহ রূপকথার গল্পগাঁথাকেও হার মানায়। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সময়ে জিডিপিতে ১৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল প্রথম। যেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চায়নার প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭৭ শতাংশ।’
এ সময় অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানান, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাবে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর এবং আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার হবে এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও দেশের অর্থনীতির এই ক্রমোন্নতিতে নেতৃত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।
বাজেটের সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গও টানেন। আ হ ম মুস্তফা কামাল দাবি করেন, পদ্মা সেতুর হাত ধরে তিনি আমাদের বিশ্ব মানচিত্রে এক ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য