সবার প্রত্যাশা ছিল সংকটের এই সময়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের মানুষকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বাস্তবধর্মী কিছু পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তেমন কোনো ঘোষণা দেখা যায়নি তার বাজেট বক্তৃতায়। সংকটের মধ্যেও গতানুগতিক বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
এ কথা ঠিক যে, বড় বাজেট দেওয়ার লোভ সামলেছেন মুস্তফা কামাল। তবে উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জনের লোভ সামলাতে পারেননি। তাই তো তিনি দুই বছরের বেশি সময়ের করোনা মহামারির মহাসংকটের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই টালমাটাল অবস্থায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছেন। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার ছক কষেছেন।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনেসের দাম বেড়েই চলেছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাবে এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশে।
এই পরিস্থিতিতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে কীভাবে আটকে রাখছেন, সেটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমি অর্থমন্ত্রীর বাজেটে নতুন কিছু পাইনি। আমার বিবেচনায় এটা একটা গতানুগতিক বাজেট। কিন্তু এই সংকটের সময়ে আমি অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে মূল্যস্ফীতির লামাগ টেনে ধরতে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই পাইনি।
‘দ্রব্যমূল্যের উধ্বগতিতে অসহায় গরিব মানুষ খুবই কষ্টে আছে। তাদের জন্য গতানুগতিক কর্মসূচি ছাড়া নতুন করে কিছু করা হয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতা ১০০ টাকা বাড়ানো হলেও বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত বা বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়নি; বাড়ানো হয়নি সুবিধাভোগীর সংখ্যা। তাহলে গরিব অসহায় মানুষ এই বাজেট থেকে কি পাবে।’
একই কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে পরিস্কার কিছু নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। বাজেটে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ, কিন্তু বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা গতবারের চেয়ে কম, তাহলে কীভাবে সেটি অর্জন করা সম্ভব?’ প্রশ্ন করেন তিনি।
‘বাজেটে কতগুলো বিষয়ে অস্পষ্টতা দৃশ্যমান। ডিমান্ডটাকে কমাব, তখন প্রবৃদ্ধিটাকে অবশ্যই কিছুটা স্যাকরিফাইস করতে হবে। সরকার বলছে, আগে ৮ শতাংশ টার্গেট করা হয়েছিল, সেখান সাড়ে ৭ টার্গেট করেছি। আমার কাছে মনে হয়, সাড়ে ৭ অর্জন করা সম্ভব হবে না। বিশ্ব পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে; বেশিরভাগ দেশই মন্দার দিকে চলে গেছে। নেগেটিভ না হলেও তারা খুব স্বল্প প্রবৃদ্ধিতে আছে; এক, দেড় বা দুই পার্সেন্টে আছে। সেখানে বাংলাদেশে সাড়ে ৭ পার্সেন্ট প্রবৃদ্ধি হবে, এটা আমি মনে করি সঙ্গত নয়।’
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ করে আ হ ম মুস্তফা কামাল আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী অর্থবছরই হবে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার শেষ বছর। তবে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমাগত যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে চলেছে তার শেষ কোথায়, এটা ভেবে দারুণ শংকিত তিনি।
আজীবন লালিত স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিলেও ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া আর করোনা মহামারির প্রকোপে কাবু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য বাজেট পেশ সুখকর হয় নাই একেবারে। খানিকটা ব্যতিক্রম এবার। সুস্থ দেহে, ভারমুক্ত মনে এবার বাজেট উত্থাপন করলেন তিনি।
সংসদে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে বাজেট পেশের অনুমতির আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাথে নিয়ে বিকাল ৩টার দিকে সংসদে আসন নেন অর্থমন্ত্রী।
কালো ব্রিফকেস খুলে আগামী অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের খতিয়ান তুলে ধরেন। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর বক্তৃতার চল বিদায় করে গেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত। আ হ ম মুস্তফা কামাল পুরো প্রক্রিয়াটি প্রতি বছর আরো স্মার্ট করে চলেছেন।
চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে কথা বলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট কাঠামো তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনাটিকে পরিচালন এবং উন্নয়ন এই দুভাগে ভাগ করেছেন পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট মুস্তফা কামাল। পরিচালন ব্যয়ে সবচে বড় খাত ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং চলতি স্থানান্তর। এরপরই আছে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা। ঋণের সুদ পরিশোধের অংকটাও কম নয়, ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।
গত ১৭ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা এনইসির (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিার সভাপতিত্বে অনুমোদিত হয়েছে উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপি। এডিপিতে রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিভিন্ন সংস্থা, করপোরেশনের প্রকল্প ব্যয় এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির বরাদ্দ যুক্ত করা হয়েছে উন্নয়ন ব্যয়ে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের খাত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বরাবরের মতো রাজস্ব আয়ের প্রায় সবটাই আহরণ করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে পোয়াবারো এনবিআর কর্মকর্তাদের। একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করে দ্বিগুণেরও বেশি আমদানি শুল্ক দিচ্ছেন আমদানিকারকরা। কাজেই সংশোধিত বাজেটে এবারই প্রথম এনবিআরের লক্ষ্য কমানো হয়নি, বক্তৃতায় গৌরবের সাথে বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার ব্যয়ে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা জোগাড়ে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক থেকে ধার-দেনা করবেন, বিদেশ এবং উন্নয়ন সহযোগিদের থেকে ঋণ নেবেন, আর দেশের মানুষের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে যোগাড় করবেন।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির জন্য ৯টি নিত্যপণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ।’
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর শঙ্কা বছর শেষে এই ব্যয় আরো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে, যা বাজেট ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে স্বীকার করেছেন তিনি।
৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ভর্তুকির বড় অংশ যাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এরপর কৃষি বিশেষ করে সার আমদানিতে। তবে বাজেট বক্তৃতার ৪৪ অনুচ্ছেদে অর্থমন্ত্রী দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে ঘাটতি, তা মূল্য বাড়িয়ে মানুষের ওপর শতভাগ চাপিয়ে দেবে না সরকার।’
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, সামনের দিনগুলোতে দারুণ কৌশলী হতে হবে সরকারকে। যে কোনো একটি সমস্যা ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে।
নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকাই রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষকে আগের মতোই কর দিতে হবে। সংকটকালেও এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় পাবেন না তারা।
মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতিকে উন্নয়নের হারানো গতিতে ফেরানোর বাজেট দিতে এসে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বললেন ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা।
এসব চ্যালঞ্জ মোকাবিলায় ‘অত্যন্ত কৌশলী’ হতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “সঠিকভাবে সমাধান না করা গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির ‘স্থিতিশীলতা বিনষ্ট’করতে পারে।”
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা খরচ করার যে পরিকল্পনা তিনি বাজেটে দিয়েছেন যার ৩৮ শতাংশ তাকে যোগাতে হবে ঋণ করে। তার বাজেটের শিরোনাম, ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’।
সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগে মহামারির আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন গতিতে পৌঁছেছিল, সবিস্তারে তার বিবরণ দিয়ে মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘বিগত দুই বছরের অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কোভিড-১৯ এর প্রভাব কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক তখনই মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত।’
তিনি বলেন, ‘কোভিড মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গত দুই অর্থবছরে নেওয়া উদ্যোগগুলো সরকার আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখবে। তবে, সংকটের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে অগ্রাধিকারও কিছুটা পরিবর্তন হবে।
‘অতিমারির তৃতীয় বছরে এসে আমাদের অগ্রাধিকার হবে আয়বর্ধন ও কর্মসৃজনের ধারা অব্যাহত রেখে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে টেকসই করা ও এর মাধ্যমে অর্থনীতির ভিত্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া। এজন্য আমরা প্রণোদনা কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়ন আগামী অর্থবছরে অব্যাহত রাখব।
‘পাশাপাশি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও সেবা খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনীতির সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর যাতে অতিমারির প্রভাব সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে সব ধরনের নীতি-সহায়তা প্রদান করব। আমি আপনার (স্পিকার) মাধ্যমে জাতির কাছে এ আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, আগামী অর্থবছরই হবে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের শেষ বছর।’
এই আশাবাদের মধ্যেই বাস্তবতা মনে করিয়ে দিয়ে সতর্কবার্তা এসেছে অর্থমন্ত্রীর কথায়।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে ব্যারেল প্রতি ১১৩ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। অপরদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বিশ্ববাজারে অন্তত ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তেল-গ্যাসের পাশাপাশি বৈশ্বিক কমোডিটি মার্কেটের কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে (যেমন গম, ভুট্টা, সানফ্লাওয়ার অয়েল ও রেয়ার আর্থ খনিজ) রাশিয়া ও ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যেরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে।
‘পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক সুইফট হতে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করায় সার্বিকভাবে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে আসছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
৬ চ্যালেঞ্জ
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও তিনি বাজেট প্রণয়নের আগে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করেছেন। মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের উপর প্রস্তাব নিয়েছেন। সব আলোচনা ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে আগামী অর্থবছরের ৬টি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন।
সেগুলো হলো-
>> মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা
>> গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান
>> বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা
>> শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন
>> অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা
এবং
>> টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।’
মুস্তফা কামাল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিদ্যমান চাহিদার লাগাম টেনে সরবরাহ বাড়ানোকেই মূল কৌশল ভাবছেন।
তিনি বলেন, ‘সে লক্ষ্যে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা হ্রাস করা হবে। নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের গতি হ্রাস করা হবে এবং একইসময়ে উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে।
‘জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে এবং মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের নেট বৃদ্ধি করা হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে এবং আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।’
একইসঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ‘প্রতিযোগিতামূলক’রাখার চেষ্টার কথাও বলেন মুস্তফা কামাল।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এবং দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্ব। সংগত কারণেই কোভিড-১৯ ও ইউক্রেইন যুদ্ধ উদ্ভূত অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করে দেশের সর্বস্তরের জনগণের জীবন-জীবিকা এবং সর্বোপরি ব্যাপক কর্মসৃজন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা এবারের বাজেটে প্রাধান্য পাবে।
‘বিগত দুই অর্থবছরে আমরা যেভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে করোনা মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিকে মূল গতিধারায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, অনুরূপভাবে আগামী অর্থবছরেও ইউক্রেন সংকট উদ্ভূত বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখব।’
আরও পড়ুন:মোবাইল ফোনের ওপর আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা এফআইসিসিআই।
বাংলাদেশের ব্যবসা ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর বাজেটের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মলনের আয়োজন করে সংগঠনটি। সেখানেই এমন উদ্বেগের কথা জানান এফআইসিসিআই প্রেসিডেন্ট।
গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন।
বাজেট নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ফরেন এফআইসিসিআই প্রেসিডেন্ট ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ বিজয়।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এফআইসিসিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নূরুল কবীর।
এফআইসিসিআই প্রেসিডেন্ট নাসের এজাজ বিজয় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা এই সময় যখন ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো ঠিক হচ্ছে না।’
এর ফলে দেশে এই শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে এমন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে একটি কোম্পানিকে ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) অবদানের ওপর কর দিতে হবে। এটি কোম্পানিটির আয়করের বোঝা ও কার্যকর করের হার বাড়িয়ে তুলবে।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবসায় প্রতিটি ব্র্যান্ডের জন্য ভোক্তা পর্যন্ত তিন-চারটি স্তরে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে যদি মোবাইল ফোন ব্যবসার প্রতিটি স্তরে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়, তবে প্রতিটি মোবাইল ফোনের খুচরা মূল্য প্রায় ১৫-২০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এ ক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হবে এবং মোবাইল ফোন দেশের সিংহভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।
আরও পড়ুন:বাজেটে সিগারেট, বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে যে করের প্রস্তাব করা হয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন তামাকবিরোধীরা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত করের চেয়ে বেশি করারোপের পক্ষে তারা।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেমিনার কক্ষে মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয় আয়োজিত এক আলোচনায় সংসদ সদস্যসহ আলোচকরা এ অভিমত দেন।
তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন, গবেষক এবং অ্যাক্টিভিস্টরা সম্মিলিতভাবে তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপের যে প্রস্তাবনা দিয়েছিল তা বাজেটে একেবারেই প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করেন আলোচকরা।
আলোচনায় অংশ নেয়া সংসদ সদস্যদের মধ্য ছিলেন শিরীন আখতার, ফজলে হোসেন বাদশা, উম্মে ফাতেমা নাজমা, আফতাব উদ্দিন সরকার, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, ডা. সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল, মো. হারুনুর রশীদ এবং মো. সাইফুজ্জামান।
আলোচনায় ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো এক ধাক্কায় অনেকখানি কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। যাতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে তামাক ব্যবহারের মাত্রা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা যায়। কর আদায়ে সুবিধার জন্য সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবনাও ছিল।
‘কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্কহার আগের মতোই রেখে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের দাম অতি-সামান্য বাড়ানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়নি। এতে তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপের সম্ভাব্য সুফল থেকে দেশ বঞ্চিত হবে।’
আলোচকরা বলেন, ‘বাজেটে সিগারেটের ওপর যে কর ধার্য করা হয়েছে তাতে সিগারেটের বিক্রি না কমে উল্টো দেড় শতাংশ বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাজেটে সিগারেটের প্রস্তাবিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট ইতোমধ্যেই বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে কর প্রস্তাব অপরিবর্তিত থাকলে সিগারেট কোম্পানির বিক্রি বৃদ্ধির পাশাপাশি কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগও বেড়ে যাবে।
‘সুপারিশ অনুযায়ী বিদ্যমান কর ব্যবস্থা সংস্কার করলে তামাকের ব্যবহার কমবে, জীবন বাঁচবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে। নিম্ন স্তরে সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি তুলনামূলক স্বল্প আয়ের মানুষকে ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত করবে। উচ্চ স্তরে সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে ধূমপায়ীদের পছন্দের সামর্থ্য সীমিত হবে। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এসব পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করবে।’
সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বলেন, ‘বাজেট অধিবেশন শুরুর আগেই অর্থমন্ত্রীর কাছে তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন অন্তত ১০০ জন সংসদ সদস্য। এরপরও বাজেটে তা প্রতিফলিত না হওয়া লজ্জাজনক।’
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘সংসদ সদস্যসহ অন্য সকল অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অচিরেই বাংলাদেশে তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপ সম্ভব হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হলেও সেটি এখনও সংশোধনের সুযোগ আছে।’
আরও পড়ুন:প্রস্তাবিত বাজেট থেকে মেডিটেশনের ওপর স্থায়ীভাবে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। তারা বলছেন, মেডিটেশন বা ধ্যান মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে বিবেচিত। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা ভ্যাটমুক্ত, তাই মেডিটেশনের ওপর থেকেও ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি।
চলতি বাজেট বক্তৃতায় নীলফামারী-৪ আসনের এমপি আহসান আদেলুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, আপৎকালীন বরাদ্দ বাড়াতে হবে, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে হবে। মেডিটেশন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। আর স্বাস্থ্যসেবা ভ্যাটের আওতামুক্ত। তাই মেডিটেশন সেবাকেও স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে স্থায়ীভাবে ভ্যাটের আওতামুক্ত করার আবেদন করছি।’
পটুয়াখালী-৩ আসনের এমপি এসএম শাহজাদা বলেন, ‘কোভিডের কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার জন্য মেডিটেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর আবার ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এই দুটি জিনিস পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে। একদিকে সিগারেটের ওপর ভ্যাট কমানো হচ্ছে, অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য চর্চার জন্য মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট বসানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, ‘মানসিক স্বাস্থ্য থেকে ভ্যাট বসিয়ে ইনকামের যে টার্গেট নেয়া হয়েছে, সেই টার্গেট যদি আবার সিগারেটের ওপরে আরও চড়াও করে দেয়া হয় তাহলে সেই টার্গেট পূরণ হবে। এই দুটো জিনিস মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে বিবেচনা করার জন্য মাননীয় স্পিকারের মাধ্যমে আবেদন করছি।’
ঢাকা-৮ আসনের এমপি রাশেদ খান মেনন প্রশ্ন রেখে বলেন, মেডিটেশনকে মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বলে একে করের বাইরে রাখা প্রয়োজন। কোভিড প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মন যখন বিপর্যস্ত, সেখানে মেডিটেশনের আশ্রয় নিলে তাকে বেশি মূল্য দিতে হবে কেন?’
সোমবার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, ‘মেডিটেশনে ট্যাক্স দেয়া হয়েছে। সেটা কমিয়ে গতবারের মতো জিরো করার আহ্বান জানাই।’
খুলনা-৫ আসনের নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘মেডিটেশনের ওপরে একটি শুল্ক আরোপ হতে যাচ্ছে। এটা যাতে না হয় সে দাবি জানাচ্ছি।’
এ ছাড়া সংসদের বাজেট বক্তৃতায় মেডিটেশনের ওপর থেকে ভ্যাট আরোপ প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রস্তাব করেন বরিশাল-৪ আসনের এমপি পংকজ দেবনাথ।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অথচ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য প্রকাশিত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার গাইডলাইনে যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম চর্চার কথা বলেছে।
আরও পড়ুন:সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নীতি-সহায়তার মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও সহজ করা, যাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হন উদ্যোক্তারা। কিন্তু কখনও কখনও এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়, ব্যবসা সহজ হওয়ার পরিবর্তে কঠিন হয়ে পড়ে। এমনই কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবারের বাজেটে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় করপোরেট কর। এ নিয়ে টানা তিন অর্থবছর এ কর হ্রাস করা হলো। শেয়ারবাজারে অতালিকাভুক্ত করপোরেট করহার ৩০ থেকে আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয় নতুন বাজেটে।
এ খবরে প্রথমে ব্যবসায়ীরা খুশি হলেও পরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। বাজেট ঘোষণার পর এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে যে আদেশ জারি করা হয়, তাতে বলা আছে, কম হারে করপোরেট করের সুবিধা পেতে হলে শর্ত মানতে হবে। তা না হলে আগের রেটেই কর দিতে হবে।
আগের দুবার শর্তহীনভাবে করপোরেট কর ছাড় দেওয়া হলেও এবার কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
তবে এসব শর্তের বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এর মাধ্যমে ‘ক্যাশলেস লেনদেন’ (নগদ মুদ্রাবিহীন লেনদেন) চালু করতে যাচ্ছে সরকার, যা বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে সম্ভব নয়। বাজেটের এ উদ্যোগ কার্যকর হলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে দেয়া শর্তটি হলো: সব প্রকার প্রাপ্তি ও আয়ের পাশাপাশি ১২ লাখ টাকার বেশি ব্যয় ও বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হতে হবে। যেসব কোম্পানি এই শর্ত মানবে না, কর ছাড়ের সুবিধা পাবে না তারা। কোম্পানি ছোট হোক বা বড়, সবার ক্ষেত্রেই এ শর্ত প্রযোজ্য।
বাজেটে এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে যুক্তি হিসেবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের প্রাধান্য রাজস্ব আহরণের অন্যতম অন্তরায়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে নগদ লেনদেন হ্রাস করা গেলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার।’
তবে এনবিআরের এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্যাশলেস লেনদেনের উদ্যোগ বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এখানকার অর্থনীতির ৮৫ শতাংশই ছোট ও মাঝারি, যার বড় একটি অংশ নগদ লেনদেন হয়ে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে। এদের পক্ষে সব লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেল কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব নয়।
এ ছাড়া দেশে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। কাজেই বাজেটে দেয়া এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি কার্যকর হলে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ছোট ও বড় প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ লেনদেনের সীমা এক হতে পারে না। বড় প্রতিষ্ঠানের লেনদেন বেশি হয়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ছোট প্রতিষ্ঠানকে যে শর্ত দেয়া হয়েছে, বড় প্রতিষ্ঠানকেও একই শর্ত মানতে হবে; যা অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রুপালী চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজেটের এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে সব লেনদেনকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। যদি তা না করে এটি করা হয়, তা হলে দেশের কোনো কোম্পানি বাঁচবে না। ক্যাশলেস সমাজব্যবস্থা চালু করা এত সহজ নয়।’
মোদি সরকারের প্রথম মেয়াদে ক্যাশলেস বা নোট বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হলেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে তিনি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। এবারের বাজেটে সেই পথেই হাঁটার ইঙ্গিত দিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, করপোরেট করে ছাড় দিয়েছে ঠিক, ছাড়ের চেয়ে নেয়ার ব্যালেন্সটি অর্থমন্ত্রীর পক্ষেই বেশি যাচ্ছে।
নতুন বাজেটে আরেকটি পদক্ষেপের কথা বলেন অর্থমন্ত্রী, যা কার্যকর হলে ব্যবসায়ীরা আরও হয়রানির স্বীকার হবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, বকেয়া আয়কর পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়া হবে।
এটিরও তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে দেশীয় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা মহল থেকে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, ‘করোপোরেট ট্যাক্স রেট কমানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা একদম ধোঁকাবাজি। এটি কার্যকর হলে কোম্পানি কর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
তিনি মনে করেন, কর বিভাগ এখনও স্বচ্ছ নয়। ‘আন্ডারহ্যান্ড’ লেনদেন ছাড়া ব্যবসা করা যায় না। এসব কাজে তো বিল-ভাউচার থাকে না। তা হলে এসব খরচ ব্যাংকিং চ্যানেলে কীভাবে দেখাবে ব্যবসায়ীরা? করপোরেট কর কমলে কোম্পানির কোনো লাভ হবে না। বরং ব্যবসা-বাণিজ্য আরও কঠিন হবে।
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো আইন হতে পারে না। ১০০ জনের মধ্যে ২ জন যদি ডিফল্টার হয়, সেটাকে খারাপ বলা যায় না।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া (এফসিএ) বলেন, ‘আমাদের দেশে লেনদেন এখনও বেশির ভাগ অনানুষ্ঠানিক বা ইনফরমাল। বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হয়তো ব্যাংকের মাধ্যমে ছোট কিছু লেনদেন করা সম্ভব। কিন্তু ছোটরা (বিজনেস টু কাস্টমার) নগদ লেনদেনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ সব টাকা ব্যাংকে লেনদেন করতে পারবে না তারা।’
দেশে ডিজিটালাইজড লেনদেনের অবকাঠামো পুরোপুরি গড়ে না ওঠায় বাজেটের এই উদ্যোগ বাস্তবসম্মত নয় বলে জানান তিনি। তবে কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনের বর্তমান যে বিধান আছে, তা সঠিকভাবে প্রতিপালন করলে প্রস্তাবিত নিয়মের দরকার নেই বলে তিনি মনে করেন।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, ‘যে কোম্পানির বার্ষিক লেনদেন বা টার্নওভার ৩ হাজার কোটি টাকা, তার জন্য যে নিয়ম, আবার যে কোম্পানির ৩ কোটি টাকা, তার জন্যও একই নিয়ম– এটা ঠিক নয়।’
এটি বৈষম্যমূলক কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবটি ভালো। তবে এখনই প্রয়োগ করা উচিত হবে না। সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে কৌশল নিতে হবে। লেনদেনের সীমা বাড়িয়ে ধাপে ধাপে সব লেনদেন ক্যাশলেস করা দরকার, যাতে সব লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে আসে। ফলে কর আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাবে।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি সামস মাহমুদ বলেন, ‘বাজেটে কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে টাকার যে সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তা কোনোমতেই মানা সম্ভব নয়। দেশে অনেক সাপ্লায়ার রয়েছে। তারা সাধারণত ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করে না। কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা ব্যাংকে এই লেনদেন করতে চায় না। কাজেই ক্যাশলেস লেনদেন চালুর জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কার্যকর করা কঠিন হবে।
আরও পড়ুন:আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এই সম্মাননীয় ফেলো একই সঙ্গে রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে বলেছেন।
রোববার ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী আছে’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি এ পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের প্রত্যাশা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, তা তিনটি পর্যায়ে পর্যালোচনা করে দেখান।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত স্বাস্থ্যগত অতিমারির প্রভাব আমরা পার করে এলেও এর আর্থসামাজিক যে প্রভাব নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ওপর পড়েছে, তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, গত ১০-১৫ বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি এ রকম চাপে পড়েনি। তৃতীয়ত, বিশ্বে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
‘এই তিনটি বিষয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব কিছু মোকাবিলা করার জন্য অনেক চিন্তা, দক্ষতা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেট পর্যবেক্ষণ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য মূল্যস্ফীতিকে মূল সূচক হিসেবে ধরতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত বিনিময় হার ও সুদের হারে সমতা আনতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং টিসিবিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকায় রাখতে হবে।
‘সাধারণত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক অভিঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে তাদের আয় বাড়ে না। আগামী অর্থবছরে কীভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়া যায়, তা বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর সুযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বেশি হতে হবে, যেটি এই অর্থবছরে কমে গেছে।’
‘প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও প্রশাসনবান্ধব। যেখানে দুর্নীতি ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। বেআইনি পথে উপার্জনকারীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এই বাজেট সংবিধানবিরোধী।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এবারের বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে এবং আমরা একটি জনবান্ধব বাজেট পাব।
‘কিন্তু দেখলাম এবারের বাজেট হয়েছে ব্যবসাবান্ধব ও প্রশাসনবান্ধব। যেখানে দুর্নীতি ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। যারা বেআইনি পথে উপার্জন করছে তাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। অর্থাৎ এই বাজেট সংবিধানবিরোধী বাজেট।’
সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার বলেন, ‘শিশুদের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ে। যেমন পারিবারিক ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পুষ্টিহীনতা ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পায়। এ কারণে এসব ঝরে পড়া শিশু ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি হতে পারে না।
‘শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে শিশুদের একটি আলাদা অধিদপ্তর করার প্রস্তাব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ছে। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যে প্রকল্প আছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ এ দেশের বড় একটি অংশ, যাদের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে পণ্যমূল্যের সামঞ্জস্য নেই। অতিমারিকালে বেশির ভাগ শ্রমিকের বেতন কমে যায়। কার্যাদেশ বাতিল হয় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ে।’
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এই সময়ে উদ্যোক্তাদের যদি সরকারি সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কেন বাড়ে না। শ্রমজীবীদের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা বাজেটে নেই। মালিকপক্ষ উন্নতির ভাগীদার হয়, আর ক্ষতির ভাগীদার হয় শ্রমিক। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।’
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে- যেমন নারীদের কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে বাজেটে কোনো বরাদ্দ দেখা যায়নি। ‘অতিমারিকালে সহিংসতা অনেক বেড়েছে। সেখানে সামাজিক সুরক্ষার বাজেটে সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো বরাদ্দ নেই। এ সময়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েশিশু ও বাল্যবিয়ের শিকারদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে বাজেটে উল্লেখ নেই। এসব বিষয় যেসব আইনে লিখিত আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।’
অভিযানের নির্বাহী পরিচালক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘সরকার নিম্নআয়ের মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের সুফল দলিতরা ভোগ করতে পারে না। দলিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা সুনির্দিষ্টভাবে বাজেটে উল্লেখ করা হয় না। দলিতদের সুবিধার্থে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আলাদা শাখা থাকা উচিত।
‘এখন থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি অর্থবছরের বাজেট এসডিজিকেন্দ্রিক হতে হবে এবং দলিতদের প্রতি বাজেটে সংবেদনশীল হওয়ার সদিচ্ছা সরকারের থাকতে হবে।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ বলেন, ‘২০৩০ সালের এসডিজি এজেন্ডা যত এগিয়ে আসছে, বাজেট আলোচনা তত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ইতোমধ্যে বাজেটসংক্রান্ত অনেক কার্যক্রম চালিয়েছে, যেখানে বাজেটের প্রতি জনমানুষের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রত্যাশাগুলো কতখানি পূরণ হয়েছে, সেটি বিবেচনা করাই এই ব্রিফিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।’
আরও পড়ুন:প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর আহবান জানিয়েছে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে শনিবার ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিড্স (সিটিএফকে) এর সহায়তায় প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব মতামত তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদসহ তামাকবিরোধী নেতারা।
জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘বহুল ব্যবহৃত সস্তা সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে শলাকাপ্রতি মাত্র ১০ পয়সা। গুল, জর্দা ও বিড়ির দাম ১ পয়সাও বাড়ানো হয়নি। এভাবে তামাকের ব্যবহার কমবে না। আমাদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে রাজস্ব আয় বহুগুণ বাড়বে এবং তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম হবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে তামকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে। এতে রাজস্ব আহরণে জটিলতা কমবে, সহজ তামাক করনীতি বাস্তবায়নের পথে একধাপ এগিয়ে যাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।’
প্রজ্ঞা ও আত্মার পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বর্তমানে সিগারেট বাজারের ৭৫ শতাংশই নিম্ন স্তরের দখলে যার প্রধান ভোক্তা মূলত তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। মধ্যম, উচ্চ এবং অতি উচ্চ স্তরে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সিগারেটের নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২ দশমিক ৫০ টাকা সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা দরকার। মধ্যম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮ দশমিক ৭৫ টাকা শুল্ক, উচ্চ স্তরে একই পরিমাণ সিগারেটের খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা শুল্ক এবং প্রিমিয়াম বা অতি উচ্চ স্তরে খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭ দশমিক ৫০ টাকা সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা প্রয়োজন।
ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১ দশমিক ২৫ টাকা সম্পূরক শুল্ক এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা শুল্ক আরোপ করা দরকার।
প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা শুল্ক আরোপ করা প্রয়োজন।
বাজেট বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক, সিটিএফকে’র সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজর মো. আতাউর রহমান, গ্রান্টস ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম, আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:কালো টাকার মালিক সংক্রান্ত অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সাম্প্রতিক বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।
বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে ঢাকায় যার ফ্ল্যাট-প্লট আছে তিনি কালো টাকার মালিক। আমার ঢাকায় কোনো বাড়ি নেই। তবে ২০১১ সালে আমি পূর্বাচলে প্লট পেয়েছিলাম। তার মানে অর্থমন্ত্রীর নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি কালো টাকার মালিক হয়ে গেছি।
‘মাননীয় স্পিকার, আমরা ঢাকায় যারা আছি- আপনি, রাষ্ট্রপতি, আমি সবাই কালো টাকার মালিক। তবে আমি আইন লঙ্ঘন করে কালো টাকার মালিক হয়েছি কি না সংসদে এর ব্যাখ্যা চাই।’
জাতীয় পার্টির এই সদস্য বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী মনের মাধুরি মিশিয়ে কথার ফুলছড়ি দিয়ে এই বাজেট প্রণয়ন করেছেন, যার পাঠোদ্ধার কঠিন। সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা ছিল চলতি বাজেটে। এবারের বাজেটে তা এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে বাজেটে তার উল্লেখ নেই।’
পাচারের অর্থ ফেরাতে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বলেছেন ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিলে পাচারকৃত অর্থ বৈধ হয়ে যাবে। আমি যখন ব্যবসা করি ২৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। তাহলে বিদেশে টাকা পাঠিয়ে ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে হালাল করব। এই সুযোগ দেয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বেআইনি, অনৈতিক। দেখা যাবে এই সুযোগ নিয়ে ভবিষ্যতে অনেকে টাকা পাচার করছে।
‘সিগারেটের ওপর আমরা ট্যাক্স বাড়াতে বলি। জনগণ চায় ১০০ ভাগ ট্যাক্স বাড়ানো হোক সিগারেটে....। কিন্তু ট্যাক্স বাড়ান না। তামাকের ওপর ট্যাক্স বাড়ান, সিগারেটের ওপর ট্যাক্স বাড়ান। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’
চুন্নু বলেন, আওয়ামী লীগের এক এমপি বিএনপির কথা বলতে গিয়ে এরশাদ সাহেবকে স্বৈরাচার বলেছেন। যার লগে করলাম চুরি সেই বলে চোর। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এতো খাতির করলাম, তিন/চারবার জোট করলাম। নির্বাচন করলাম, ক্ষমতায় আনলাম, আসলাম। আর সেই আওয়ামী লীগের ভাইয়েরা যদি জিয়াউর রহমানকে গালি দিতে গিয়ে এরশাদকে গালি দেন তাহলে আর যাই কোথায়? তাহলে তো নতুন করে ভাবতে হবে- কী করবো কোথায় যাবো।’
আওয়ামী লীগ দলীয় এক সংসদ সদস্যকে উদ্দেশ করে জাতীয় পার্টির এই সদস্য বলেন, ‘কী, ভালো লাগে না? লাগবে, সময় আসছে। চিন্তা কইরেন না।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য