করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে ওলোটপালট করে দিচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে শঙ্কা-উৎকণ্ঠা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব।
চলমান যুদ্ধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। আইএমএফও একই সুরে কথা বলছে। তীব্র খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশেও নানা ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেল, খাদ্য পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জাহাজ ভাড়া বাড়ার কারণে আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। যার ফলে বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে; অস্থির হয়ে উঠেছে মুদ্রাবাজার। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ।
সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক রয়েছে। বাজারে গিয়ে পণ্য কিনতে বেশি খরচ হওয়ায় সরকারের প্রতি ক্ষোভও ঝাড়ছেন অনেকে।
তবে বাংলাদেশকে নিয়ে খুব একটা আশঙ্কায় নেই সরকারের মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় সংকট বাড়ছে ঠিকই, তবে সরকারও ব্যয় সংকোচনের জন্য তড়িৎগতিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য আমদানি ব্যয় কমে আসবে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভের উপর আর চাপ পড়বে।
সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, সরকারি গুদামগুলোতে এখনও ১২ লাখ টনের মতো খাদ্য মজুত আছে। বেসরকারি পর্যায়েও প্রচুর খাদ্য মজুত আছে। বোরো ধানের ভরা মৌসুম চলছে। দেশের কিছু এলাকায় বন্যার পরও বাম্পার ফলনের আভাস দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও এখন বেশ ভালো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে খুব একটা বিচলিত হওয়ার মতো কিছু দেখছেন না তারা।
তবে সরকারকে সব সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতি সব সময় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হলে সেটা করতে হবে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বিরুপাক্ষ পাল ও মঞ্জুর হোসেন এবং ব্যবসায়ী নেতা আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজের সঙ্গে।
তারা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে মহামারি করোনাসহ অতীতে বড় বড় সংকট সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়েছে। এবারও তেমনটাই ঘটবে। কয়েক দিন পর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হবে। এর মধ্য দিয়ে নতুন সাহস-উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেবে সবার মধ্যে। অর্থনীতিতে যোগ হবে গতি।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল
অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও শক্ত ভিক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান সূচকগুলো এখনও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।
আমদানির বাড়ার পরও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে। এই রিজার্ভ দিয়ে ৬ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ধস নামার প্রধান কারণ ছিল রিজার্ভ; দেশটির রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। পাকিস্তানের রিজার্ভও কমে ১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের আগস্টে দেশটির রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ম ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা ছিল গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি সূচক রপ্তানি আয়েও সুবাতাস বইছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তাতে দেখা যায়, এই ১০ মাসে ৪৩ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
জুলাই-এপ্রিল সময়ে প্রবাসীরা ১৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন দেশে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। তবে গত তিন মাস ধরে রেমিট্যান্সপ্রবাহে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত মার্চ মাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল; এপ্রিল মাসে এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চলতি মে মাসে ২৭ দিনে এসেছে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। মাস শেষে মে মাসেও রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তবে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই অর্থবছরের ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই ৯ মাসে ৬৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নতুন উদ্যোমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাপিয়ে পড়েন। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেন। দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছে দেশে। এর ফলে শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতি আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।
একইসঙ্গে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। এ সব কারণেই আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়েছে।
তবে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যংক ইতিামধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ৭৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকারদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আমদানিনির্ভর সব প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বিলাসবহুল প্রায় ২০০ পণ্যের আমদানির উপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে; কমছে টাকার মান। এটা এখন দেশের অর্থনীতির জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২৬ মে পর্যন্ত) ৫৬০ কোটি (৫.৬০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা) তুলে নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর। দুর্বল হচ্ছে টাকা।
গত এক সপ্তাহ ধরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হলেও ব্যাংকগুলো এর চেয়ে ৬ থেকে ৮ টাকা বেশি দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে। খোলাবাজারে বাড়তে বাড়তে ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়ে ১০৪ টাকায় উঠেছিল। গত কয়েক দিন অবশ্য ৯৮ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৪০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে।
ডলারের সংকট কাটাতে এবার প্রবাসী আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে এক দর বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকে কত দামে রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে ও আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলো প্রতিদিন বাজার বিবেচনা করে এই দাম নির্ধারণ করবে। এই এক দাম সব ব্যাংক মেনে চলবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা পর্যালোচনা করবে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই প্রতি ডলারের দাম ৯০ টাকার বেশি হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত বৃহস্পতিবার সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে সভায় বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো এই সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গভর্নর ফজলে কবির।
অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। এই অর্থবছরের ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৫ শতাংশের মতো।
তবে আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ক্যারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স) বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্থবছরের ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক শুন্য সাত বিলিয়ন ডলার।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে যাই বলুক না কেন বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় যুদ্ধের প্রভাব যতোই পড়ুক না কেনো, আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না।’
তিনি বলেন, এই যে আমাদের অর্থনীতি আভো অবস্থায় আছে, এতে অবদান রেখেছে তিনটি খাত- কৃষি, শিল্প ও রেমিট্যান্স। করোনা অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানি আয়ে ৩৬ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রেমিট্যান্স কমলেও কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। রোজার ঈদের আগে এপ্রিল মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সামনে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেও রেমিট্যান্স বাড়বে।
‘আমদানি বাড়ার পরও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান করছে। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এরপরও যারা বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেন, তারা বিজ্ঞানসম্মত কথা বলছেন না।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
‘বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা এখন মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখাটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। নতুন বাজেটে এই বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অসহায় গরিব মানুষকে সহায়তার পাশাপাশি কৃষির উৎপাদন বাড়াতে সার, সেচ, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে।’
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির উপর আছে এখনও। মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা আছে ঠিক। কিন্তু অন্য সূচকগুলোর দিকে তাকালে স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলতে হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ব্যাপক আমদানির পরও রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান করছে। রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশকিছু দিন ধরে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘রেমিট্যান্সে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিলেও কয়েক মাস ধরে আবার বাড়ছে। সামনে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেও বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন প্রবাসীরা। সরকার যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আমদানি ব্যয় কমে আসবে। এরফলে রিজার্ভ আর কমবে না বলে মনে হচ্ছে।’
‘তাই যারা শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করছেন তারা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কথা না বলে মনগড়া কথা বলছেন। অযথা ভয়-আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য বলছেন।’
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে ঠিক। কিন্তু সেটা মন্দা ডেকে আনতে কিনা-সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। আর যদি মন্দা দেখাও দেয়, তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে ঠিক। কিন্তু খুব বেশি সংকটের মধ্যে আমরা পড়ব না।’
‘কেননা, মন্দার জন্য প্রধানত খাদ্য সংকটকে দায়ি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে খাদ্য মজুত আছে, চলতি বোরো মৌসুমে যে ধান উৎপাদন হচ্ছে-তা দিয়ে দুই-তিন বছর অনায়াসে চলে যাবে। এরমধ্যে যুদ্ধও স্থিমিত হয়ে আসবে আশা করি। তাই খুব বেশি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আমি দেখছি না।’
বিরূপাক্ষ পাল
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার যে আশঙ্কা করছেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রে বসে তেমনটি কিন্তু দেখছি না। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেশ বেশি ঠিক। কিন্তু এখানে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কাজ বেড়েছে, বেতন বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন চাকরি বা কাজের জন্য যে লোক প্রয়োজন, সেই লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এখানে মন্দা আসবে কি করে। আর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বা বড় অর্থনীতির দেশে যদি মন্দার ছোঁয়া না লাগে, তাহলে বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা করা অমূলক মনে হয় আমার কাছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, মন্দার বিষয়টি সামনে আনার রাজনৈতিক একটি কারণ আছে। সব দেশ বা রাষ্ট্র প্রধানদের সতর্ক করার জন্য এটা প্রচার করা হচ্ছে।’
‘তবে যুদ্ধের কারণে, বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্য থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় রাশিয়া বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেইসঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস ও তেল না পাওয়ায় তারাও সংকটে পড়বে। ইতোমধ্যে সে সংকট দেখা দিয়েছে। এখন সব কিছুই নির্ভর করছে, যুদ্ধ কতোদিন চলবে সেটা উপর।’
যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে কেমন পড়বে- এ প্রশ্নের উত্তরে বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘আমার বিবেচনায় বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রভাবতো কিছুটা পড়বেই। ইউরোপ বাংলাদেশের পোশাকের একটি বড় বাজার। সেখানে সংকট দেখা দিলে, ওই বাজারে হয়তো পোশাক রপ্তানি কম হবে। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, যুত্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে, সে কারণে এখানকার বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে না; উল্টো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।’
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ।
‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি। সেই শক্তি দিয়ে যে কোনো সমস্যা-সংকট মোকাবিলা করতে পারে। অতীতে বহুবার সেটা প্রমাণ করেছেন তারা। আর সেটা করেই পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকে পেছনে ফেলে এই জায়গায় এসেছেন তারা। অন্য কিছু যদি নাও পায়, শুধু ভাত খেয়েই তারা অর্থনীতির চাকা সচল রাখবেন।’
মঞ্জুর হোসেন
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমিও ভয়ের তেমন কিছু দেখছি না। রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে উপরে থাকা অবস্থায় আমি উদ্বেগের কোনো কারণ দেখি না। খাদ্য আমদানি করে চলতে হবে-এমন অবস্থা তো আমাদের নয়। বেশি সমস্যা হলে গম হয়তো আমরা পাবো না, সেক্ষেত্রে তিন বেলাই ভাত খাবে মানুষ। দাম হয়তো একটু বাড়বে, কিন্তু খাদ্য পাওয়ার তো নিশ্চয়তা আছে। প্রচুর খাদ্য আছে আমাদের।’
‘আমি মনে করি, সরকারকে এখন মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ভর্তুর্কির পরিমাণ যদি বেড়ে যায় সেটাও করতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠণী খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। উপকারভোগীর সংখ্যা ও বিভন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। নতুন বাজেটে এ সব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।’
‘আর আমরা তো এখন ফুরফুরে মেজাজে আছি। নিজস্ব অর্থে বহুল প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে ২৫ জুন। এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে সাহস-শক্তি-প্রাণসঞ্চার হবে, তা দিয়ে যে কোনো সংকট মোকাবিলঅ করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ
বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনায় করোনা মহামারি সাহসের সঙ্গে আমরা মোকাবিলা করেছি। আশা করছি, যুদ্ধের প্রভাবও তেমন একটা পড়তে দেবেন না তিনি। আমদানি ব্যয় কমাতে ইতোমধ্যে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।’
‘আমাদের একটাই অনুরোধ থাকবে, এই মুহূর্তে যেনো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো না হয়। তাহলে সরকারের সঙ্গে হাতমিলিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে আমরা যে কোনো পরিস্তিতি মোকাবিলা করতে পারব।’
আরও পড়ুন:সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই সবজির অনেক দাম বেড়েছে। প্রায় সব সবজির দামই ৮০ টাতা থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। এদিকে কাঁচামরিচের দাম প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন আড়াইশ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। বেগুন ও শসার দাম উঠেছে ৮০ থেকে ১২০ টাকার ঘরে। মাছ ও মুরগিও আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, গত সপ্তাহে যেসব সবজির দাম ছিল প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে, সেগুলোর দাম এখন ৬০ থেকে ১০০ টাকা। যেমন—৬০ টাকার গোল ও লম্বা বেগুন এখন ৮০ থেকে ১২০ টাকা, ঝিঙে ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ও ধুন্দল এখন ৬০ টাকা, কাঁকরোল, লতি, বরবটি, করলা ৮০ টাকা, ৪০ টাকার পটোল, ঢেঁড়শ, লাউ, মুলা এখন ৬০ টাকা কেজি।
কচুরমুখীর কেজি ৫০ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, টমেটো ১২০ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, আলু ২৫ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, কাঁচা কলা (হালি) ৪০ টাকা, কুমড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি। সবজির মধ্যে কেফসি প্রজাতির সবুজ কাঁচামরিচ ২৮০ টাকা কেজি, হলুদ মরিচ ৮০০ টাকা কেজি, চাইনিজ ধনেপাতা ৩০০ টাকা কেজি, গাজর ১৪০ টাকা, শসা (হাইব্রিড) ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি, দেশি শসা ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। আর ২০০ টাকার কাঁচামরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা প্রতি কেজি।
এদিকে বাজারে ব্রয়লার, পাকিস্তানি ও দেশি মুরগির দামও আগের মতোই চড়া। বাজারে আজ ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে। আর পাকিস্তানি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩১০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৫৫০-৬০০ টাকা।
বিক্রেতা শিপন জানান, ‘বড় সাইজের ব্রয়লার এখন কম আসছে, তাই দাম কিছুটা বেশি। পাকিস্তানি ও দেশি মুরগির দাম এক মাস ধরে প্রায় একই আছে, তবে আগে কিছুটা কমে পাওয়া যেত।’
মাছের বাজারেও তেমন কোনও পরিবর্তন নেই। গতকাল শুক্রবার হওয়ায় অনেক ধরনের মাছের দাম কিছুটা বেশি দেখা গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের মতো আজও দুই থেকে আড়াই কেজি ওজনের রুই মাছের দাম প্রতিকেজি ৪৫০ টাকা, দেড় থেকে ২ কেজির দাম প্রতিকেজি ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকা, এক থেকে দেড় কেজির ওজনের রুই মাছের দাম প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকা, আর এক কেজির কম ওজনের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি দরে।
এছাড়া পোয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে, মৃগেল মাছ প্রতি কেজি ২৮০ টাকা, তেলাপিয়ার দাম প্রতি কেজি আড়াইশ টাকা, এক কেজি থেকে কিছুটা বেশি পাঙাশের দাম ১৮০ টাকা কেজি, দেড় কেজি বেশি ওজনের পাঙাশের দাম ২৫০ টাকা কেজি। শিং মাছ প্রতি কেজি সাড়ে পাঁচশত থেকে ৬০০ টাকা। চিংড়ি মাছ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকা প্রতি কেজি, আর ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা কেজি।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল গার্মেন্টস ক্রেতা, বিপনন ও সরবরাহকারী এবং সোর্সিং এক্সিবিশন খ্যাত ইনটেক্স বাংলাদেশের ১৬তম আসর আজ রাজধানীর আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরা (আইসিসিবি)-তে শুরু হয়েছে। এই তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল সোর্সিং শোতে ১০টিরও বেশি দেশের ১২৫টির অধিক কোম্পানি অংশ নিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী ক্রেতা, সরবরাহকারী এবং উৎপাদনকারীদের জন্য একটি গতিশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।
পোশাক খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-এর নিত্য উদ্ভাবনী কৌশল ও উন্নতমানের দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
২০২৬ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইনটেক্স-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা, সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র্য আনা এবং টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পে উদ্ভাবন প্রদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, গেস্ট অব অনার হিসেবে ছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
এছাড়াও বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং এলএবিসিসিআই, কেবিসিসিআই ও বিজিসিসিআই-এর মতো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংস্থার নেতৃবৃন্দও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
মাহবুবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ এখন পোশাক খাতে বিশ্ব বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দ্রুত টেকসই ও মূল্য-সংযোজিত পোশাক উৎপাদনের একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। উদ্ভাবন, কমপ্লায়েন্স এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগে কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটি দায়িত্বশীল ফ্যাশন ও টেক্সটাইল সোর্সিংয়ের পরবর্তী অধ্যায় নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। আমরা বিশ্বাস করি, ইনটেক্স বাংলাদেশের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করবে”
এই বছরের এক্সপোতে বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য প্যাভিলিয়নের মধ্যে ভারতের (টেক্সপ্রোসিল ও পেডেক্সিলের মাধ্যমে) তুলা, মিশ্র সুতা ও টেকসই টেক্সটাইল প্রদর্শন করছে। চীন নিয়ে এসেছে টেকনিক্যাল ফ্যাব্রিক ও গার্মেন্টস ট্রিম। দক্ষিণ কোরিয়া পরিবেশবান্ধব পারফরম্যান্স উপকরণ প্রদর্শন করছে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও জাপান নিয়ে এসেছে প্রিমিয়াম শার্টিং ও বোনা পণ্য। বাংলাদেশি প্রদর্শনকারীরা নিটওয়্যার, ডেনিম এবং ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড উৎপাদন সমাধানের অগ্রগতি তুলে ধরছে।
এক্সপোর মূল্যবোধ আরও বাড়াতে ইন্টারেক্টিভ বিজনেস ফোরাম (আইবিএফ) দুটি সেশনের আয়োজন করেছে। প্রথম সেশনে টেক্সটাইল উৎপাদন ও ফ্যাশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হবে, অন্যদিকে দ্বিতীয় সেশনে বৈশ্বিক শুল্ক ও বাণিজ্য পরিবর্তনের বাংলাদেশি রপ্তানির প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে। এই সেশনগুলোতে এ শিল্পের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অংশ নিচ্ছেন, যা ব্যবসায়িক স্থিতিস্থাপকতা ও বৃদ্ধির কৌশল প্রদান করবে।
প্রদর্শনীর পাশাপাশি, ইনটেক্স বাংলাদেশ ২০২৫-এ ব্যবসায়িক সভা (বি২বি), ভিআইপি নেটওয়ার্কিং এবং ক্রেতা-সরবরাহকারীদের মধ্যে ম্যাচমেকিং সুবিধা রয়েছে— যা সোর্সিং ও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা প্রদান করছে।
ওয়ার্ল্ডেক্স ইন্ডিয়ার আয়োজিত এই ইভেন্টটি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিজিবিএ, ইপিবি এবং আইবিসিসিআই, এলেবিসিসিআই, কেবিসিসিআই ও বিজিসিসিআইয়ের মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার সমর্থন পেয়েছে।
বাংলাদেশ যখন আরও উদ্ভাবনী ও টেকসই টেক্সটাইল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, ইনটেক্স বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের সাপ্লাই চেইনের সাথে দেশটিকে সংযুক্ত করার একটি প্রধান সমর্থক হিসেবে কাজ করছে।
দেশে ২০২৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ—এফডিআই আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২৩ সালে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্টে বিদেশি বিনিয়োগ আসার ওই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ১৩ শতাংশ।
ভারতের হার ১৪ শতাংশ। ভুটানের মতো দেশে এ হার ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে অর্থের ঘোষণার পরিমাণও কমেছে।
ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ১৭৫ কোটি ডলার। গত বছরের তুলনায় যা ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮৫ কোটি টাকা।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের বাইরে সর্বাধিক ৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব যখন আরো গভীর সহযোগিতা ও বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন ঘটছে তার বিপরীত। ২০২৪ সালে বৈশ্বিকভাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ধাক্কা। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে মন্দা, শিল্প খাতে চাপ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি কম মনোযোগ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য উত্তেজনা, নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক বিভাজন বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশকে আরো জটিল করে তুলছে।
তবে অন্ধকারে কিছুটা আশার আলোও রয়েছে। ডিজিটাল অর্থনীতিকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এর প্রবৃদ্ধি এখনো অসম। ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে ডিজিটাল পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ডিজিটাল সংযুক্তি হতে পারে অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি, যদি তা সবার কাছে পৌঁছানো যায়। প্রতিবেদনটি সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজিএস) অর্জনে সহায়তা করার বিষয়ে ব্যবহারিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ সময়টাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একসঙ্গে কাজ করার, যাতে আরো সহনশীল ও টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলা যায়। সে লক্ষ্যে প্রতিবেদনটি বিভিন্ন নীতিগত ধারণা ও পরামর্শ তুলে ধরেছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং এর আগ থেকে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। যার প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হলেও সেটি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ এ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে এফডিআই প্রবাহ বেড়েছিল ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রবাহ ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে প্রবাহ হয়েছে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কম্বোডিয়ায় এফডিআই প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে হয়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাকিস্তানে এফডিআই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
২০২৩ সালে ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশে (এলডিসি) এফডিআই ১৭ শতাংশ বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাড়িয়েছে। এর প্রায় ৫০ শতাংশ প্রবাহ কেন্দ্রীভূত ছিল কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ, উগান্ডা এবং সেনেগাল—এ পাঁচ দেশে। গত এক দশকে স্বল্পোন্নত দেশের বহিঃখাতগুলোয় অর্থায়নের অন্যান্য উৎসের তুলনায় এফডিআই প্রবৃদ্ধিই পিছিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন সহায়তা এবং রেমিট্যান্স হার স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় বেশি। ওই বছর বৈশ্বিকভাবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ ১০ শতাংশের বেশি কমে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে স্থবির ছিল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ধানের আরও তিনটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে একটি লবণাক্ততা সহনশীল, একটি উচ্চফলনশীল বোরো এবং অন্যটি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী। এ নিয়ে ব্রি আটটি উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড জাতসহ মোট ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।
নতুন উদ্ভাবিত তিনটি জাত হলো; লবণাক্ততা সহনশীল ব্রি-১১২, উচ্চফলনশীল বোরো ব্রি-১১৩ ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ব্রি-১১৪। গত বুধবার জাতীয় বীজ বোর্ডের (এনএসবি) ১১৪তম সভায় নতুন এ তিনটি জাত অনুমোদন করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সভাপতিত্বে বোর্ড সভায় ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানায়, নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততা সহনশীল ও মাঝারি জীবনকালীন রোপা আমনের জাত। এ জাতের ডিগপাতা প্রচলিত ব্রি ধান-৭৩-এর চেয়ে খাড়া। ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ১৪ থেকে ৬ দশমিক ১২ টন ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতের জীবনকাল ১২০ থেকে ১২৫ দিন এবং গাছের উচ্চতা ১০৩ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার। গাছের কাণ্ড মজবুত। এ কারণে ঢলে পড়ে না। এ জাতের ধানের চাল মাঝারি চিকন ও সাদা। ভাত ঝরঝরে। এটি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। দানা মাঝারি চিকন ও শিষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। জীবনকাল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ফসল কর্তনের পর মধ্যম উঁচু থেকে উঁচু জমিতে সূর্যমুখী ও লবণ সহনশীল সরিষা আবাদের সুযোগ তৈরি হবে।
ব্রি ধান-১১৩ জাতটি বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি-২৯-এর বিকল্প হিসেবে ছাড়করণ করা হয়েছে। এটি মাঝারি চিকন দানার উচ্চফলনশীল জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা এবং ধান পাকলেও সবুজ থাকে। গাছ শক্ত ও মজবুত বিধায় সহজে হেলে পড়ে না। জাতটির গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন। চালের আকার-আকৃতি মাঝারি চিকন ও রং সাদা। দেখতে অনেকটা নাজিরশাইলের মতো। এ ধানের চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৮ শতাংশ এবং ভাত ঝরঝরে। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় দেখা গেছে, জাতটি ব্রি ধান-৮৮-এর চেয়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এ জাতের গড় ফলন হেক্টরে ৮ দশমিক ১৫ টন। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে জাতটি হেক্টরে ১০ দশমিক ১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, নতুন ব্রি ধান-১১৪ বোরো মৌসুমের দীর্ঘ জীবনকালীন ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। গাছ মজবুত এবং হেলে পড়ে না। পাতার রং গাঢ় সবুজ। এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৭ দশমিক ৭৬ টন। দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালি বর্ণের। ভাত ঝরঝরে হয়। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে এ জাতের ধান চাষে কৃষককে ব্লাস্ট রোগ নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হবে না, উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হবে।
ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, জাতগুলো অনুমোদন লাভ করায় এখন আমরা এসব ধানের বীজ বাজারজাত করতে পারব। কৃষকেরা এ জাতের ধান চাষ করে লাভবান হবেন। তাদের উৎপাদনও বাড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় অনেক সময় ধান চাষ করা যেত না। এখন আমাদের ব্রি ধান-১১২ সেসব এলাকায় সহজে চাষ করা যাবে। এ ছাড়া অন্য জাতগুলো আমাদের ধান উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
সূত্র: বাসস
আগামী ২১ ও ২৮ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এর অধীনে সব কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর কার্যালয় খোলা থাকবে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও ওই দুই দিনও খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মূলত রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। গতকাল বুধবার এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে এনবিআর। গত ২ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২২ জুন বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) মোট ৩ লাখ সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে। এটি সাময়িক হিসাব। ভ্যাটের রিটার্ন দাখিলের হিসাবের এই সংখ্যা আরও বাড়বে। লক্ষ্য অর্জনে শুধু জুন মাসেই সব মিলিয়ে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে।
এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। মূল লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে উল্লেখ করে ডলার-টাকার বিনিময় হার এখন থেকে বাজারনির্ভরভাবে নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ আগামী জুন মাসের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের ঋণ কিস্তি পাবে বলেও জানান তিনি।
ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের দর-কষাকষি চলছিল। মূলত সে কারণে আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় করছিল না। এর মধ্যে গতকাল জানা যায়, বাংলাদেশ ডলারের বিনিময় আরও নমনীয় করতে রাজি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারে ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ৯ মাসে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি, তবুও বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। এ অবস্থায় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, বাজারভিত্তিক করায় হঠাৎ করে ডলারের রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেট ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে এবং তা সেখানেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ডলারের রেট দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা-সরবরাহ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে, বাইরের দেশের নির্দেশে নয়। বর্তমানে বাজারে ডলারের সরবরাহও পর্যাপ্ত রয়েছে।
তবে, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দুবাইভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. মো. হাবিবুর রহমান, কবির আহমেদ, উপদেষ্টা আহসান উল্লাহ এবং নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার একত্রে ছাড় করবে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সকল বিষয় সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে উভয়পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং বিনিময় হার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনার লক্ষ্যে চতুর্থ রিভিউ সম্পন্ন হওয়ার পর উভয় রিভিউয়ের জন্য নির্ধারিত কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে বলে বিগত তৃতীয় রিভিউয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ রিভিউয়ের সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ব্যাংক-ফান্ড সভায় এবিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল।
এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা জুন মাসের মধ্যে পাবে বলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ অর্থ পাওয়া গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে। ফলে মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসকল সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। এ সকল সংস্কার কর্মসূচির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কারিগরি সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। পরস্পরের ওপর আরোপ করা পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য শুল্ক ৯০ দিনের জন্য ব্যাপক পরিসরে কমাতে একমত হয়েছে দুই দেশ। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তেজনা কমাতেই এই চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। খবর বিবিসির।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের আগে চীনের ওপর মার্কিন শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। পরে নতুন শুল্ক যখন ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন তখন তিনি বলেছিলেন তিন মাস সবার জন্য বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক হার প্রযোজ্য হবে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, গঠনমূলক ও দৃঢ় আলোচনার পর উভয় দেশ ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করতে রাজি হয়েছে। এর আওতায় দেশ দুটি পারস্পরিক শুল্ক ১১৫ শতাংশ কমাবে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত বর্তমান ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। অন্যদিকে চীন মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপ করা ১২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। উভয় দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, আগামী ১৪ মে থেকে শুল্কের এই কাঁটছাট কার্যকর হবে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে স্কট বেসেন্ট বলেন, আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আমাদের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। দুই পক্ষের প্রতিনিধিদলই একমত হয়েছে যে তারা বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না। মার্কিন অর্থমন্ত্রী বলেন, উভয় দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে। আমাদের লক্ষ্য ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের পথে অগ্রসর হওয়া এবং এটি তারই সূচনা।
প্রথম দফায় শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল এবং বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও জোরালো হয়েছিল। তবে এবার এই চুক্তির ঘোষণায় বিশ্ব শেয়ারবাজারে তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
শুল্ক কমানোর চুক্তির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাজারে চাঙাভাব দেখা দেখা গেছে। হংকংয়ের প্রধান সূচক ৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ স্টক ফিউচারের উত্থান হয়েছে। এছাড়া বাড়তি শুল্ক স্থগিতের খবরে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের দর বেড়ে ছয় মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় শেয়ারবাজারগুলোও উচ্চমুখী প্রবণতায় লেনদেন শুরু করে এবং মার্কিন বাজারগুলোও ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে, এই সময়সীমার মধ্যে চীনের উচিত হবে ফেন্টানিল নামক ভয়াবহ মাদকের অবৈধ রপ্তানি বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। এ বিষয়ে চীনের সদিচ্ছা দেখে ওয়াশিংটন আশাবাদ প্রকাশ করেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের প্রবেশ ঠেকাতে চীন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন।
মন্তব্য