করোনাকালে বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দপ্রাপ্ত পাঁচ খাতের একটি স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু বেশি বরাদ্দ পেলে কী হবে, সে অর্থ খরচ বা কাজ বাস্তবায়নে তাদের তেমন নড়চড় নেই। এডিপি বাস্তবায়ন চিত্র বলছে, অর্থবছরের চার ভাগের তিন ভাগ সময় পার হলেও খরচ বা কাজের দিক থেকে তলানিতে থাকা ছয় খাতের একটি স্বাস্থ্য খাত। করোনার মোকাবিলায় সব হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন, ভেন্টিলেটর স্থাপন, স্থাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রয়েছে এ খাতে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সবশেষ তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত সার্বিক এডিপি বাস্তবায়ন অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। গত মার্চ পর্যন্ত জাতীয় গড় ৪২ শতাংশের মতো। করোনার এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবস্থা আরও শোচনীয়। এ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার জাতীয় গড়েরও অর্ধেক, ২১ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবমতে, করোনা মহামারিতে সরকার স্বাস্থ্যসেবা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এমনি এডিপি ও সংশোধিত এডিপিতে স্বাস্থ্যসেবা খাত ও করোনা মোকাবিলার প্রকল্পগুলো ছিল অগ্রাধিকার। গত অর্থবছরের শেষ দিকে করোনা হানা দেয়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দও বাড়ানো হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। কিন্তু কাজের গতি না থাকায় সংশোধিত এডিপিতে তাদের বরাদ্দ কমিয়ে করা হয় ৭ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। অর্থ কমিয়েও বছর শেষে তাদের এডিপির কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন হয়নি। ৭৪ শতাংশ বা ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেও তারা ২ দুই হাজার কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হয়। আশা ছিল, করোনাকালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম বাড়িয়ে মানুষের সেবা বাড়ানো যাবে। গত বছরের সংশোধিত এডিপির সঙ্গে অতিরিক্ত প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরুতে এ বিভাগের জন্য রাখা হয় ৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা।
তবে শুরু থেকে এ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ছিল আগের বছরের মতো। অর্থবছরের ছয় মাসে মাত্র ১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে এ বিভাগ। তবু সংশোধিত এডিপিতে তাদের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয় সরকার।
বাড়তি সোয়া ২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রেলকে টপকে বরাদ্দের দিক দিয়ে শীর্ষ পাঁচে উঠে আসে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দ তাতে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা।
গত ৯ মাস বা মার্চ পর্যন্ত এ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন অবস্থা করুণ। তারা মাত্র ২ হাজার ৫১৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। বাস্তবায়ন হারে সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের মধ্যে তাদের অবস্থান ৫৩তম।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসচিব লোকমান হোসেন মিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনি ফোনে বার্তা পাঠিয়েও উত্তির মেলেনি।
পরে এ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘এখন মন্তব্য করা যাবে না’ বলে কল কেটে দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার এই মহামারি এক বছরে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়। এ সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীন সংস্থাগুলোর সম্মুখসারিতে থাকার কথা। অথচ তাদের কাজ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ সারিতে। তাদের সক্ষমতার অভাবের কারণে পুরো জাতিকেই ভুগতে হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, করোনায় স্বাস্থ্যসেবা খাত ঢেলে সাজাতে এবং এ খাতের বরাদ্দ বাড়াতে বলছে সবাই। কিন্তু টাকা দিলে কী হবে, তা তো খরচ করতে হবে। করোনার এই দুর্যোগের সময় যাদের কাজ সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা, তারা তা পারছে না। এ সময় তাদের আরও শক্ত হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের হাতে থাকা অর্থই খরচ করতে পরছে না। এমনটা কেন হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্বাস্থ্য খাতে
করোনার প্রকোপের শুরুতেই গত বছর এই মহামারি মোকাবিলায় বড় দুই দাতা সংস্থার অর্থায়নে নেয়া হয় দুই প্রকল্প। এপ্রিলে নেয়া এই দুটি প্রকল্প গত বছরের জুনে অনুমোদন দেয় সরকার। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যেকটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন, প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এ দুই প্রকল্পের একটি হচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স’ প্রকল্প। অপরটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডামিক প্রিপেয়ার্ডনেস’।
প্রথম প্রকল্পটির লক্ষ্য কোভিড-১৯ এবং ভবিষ্যৎ মহামারির জন্য পিসিআরসহ আধুনিক মাইক্রো-বায়োলজি ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং ১৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট নিশ্চিত করা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল প্রশিক্ষণের কথাও কথা রয়েছে এতে। প্রকল্পে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অপর প্রকল্পটির লক্ষ্য কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা ও পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো, জেলা হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট স্থাপন, সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সংক্রামক রোগ বিভাগ, জেলা পর্যায়ে এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম ফর ইম্যুনাইজেশন (ইপিআই) ইউনিট এবং সব সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি হাসপাতালে ইনফেকশন প্রিভেনশন ইউনিট স্থাপন। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা আছে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা।
দুই প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর। তবে এক বছর পেরিয়ে প্রকল্পের খুব একটা অগ্রগতি নেই। বরং শুরু থেকে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এসব প্রকল্পে। এখনও দেশের অর্ধেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন হয়নি। হয়নি কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিভিন্ন সংস্থার অধীনে এ রকম আরও ৫৩টি প্রকল্প রয়েছে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউ-এর সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্য খাত খুব দক্ষতা দেখাতে পারেনি। তাদের উচিত ছিল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সেন্টাল অক্সিজেন সিস্টেম চালুর ব্যবস্থা। জেলা পর্যায়ে আইসিউ স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও রয়েছে। এখনও প্রায় ৩৬ জেলায় আইসিইউ নেই, ২৮ জেলায় আছে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রধান সমস্যা সক্ষমতা ও দক্ষতার অভাব। তাদের জিনিসপত্র বিমানন্দরে নষ্ট হবে, হাসপাতালের সামনে উঠানে পড়ে নষ্ট হবে। তবে এটাও ঠিক, বছরে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা খরচের সক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা স্বাস্থ্য খাতের নেই। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালে বেড বেড়েছে, আইসিইউ বেড়েছে। সারা দেশের ১৩০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন দেয়া হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় ২০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঢাকায় করোনার জন্য আড়াই হাজার বেড ছিল। এখন সাত হাজার বেড করা হয়েছে। এটা আমরা রাতারাতি করতে সক্ষম হয়েছি।’
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১২টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ দিন প্রতি ১০০ নমুনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ‘২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু ২৯ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এছাড়া ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে মোট শনাক্ত হয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১২৭ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫৮২ জন।
এডিশ মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সারা দেশে মশা নিধন কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬ এবং এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে মে মাস থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে এবং জুনে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বরগুনায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি।
এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ২৯৬ জনে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন শনাক্ত ৪২৯ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে— বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪৯ জন; চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৭ জন; ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন; ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৪২ জন; ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৪৫ জন; খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন ও রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৫৮ জন রোগী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারী ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একজন রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এডিস মশার বিস্তার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, 'মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ এবং আগস্টে দশগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এর আগে ২০২৩ সালের পুরো বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের পুরো বছরের (১ জানুয়ারি–৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সর্বমোট হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন।
করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে দেশে আরও ২১ জনের শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।
রবিবার (২৯ জুন) সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় এসব শনাক্ত হয়েছে। তবে, নতুন করে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এই সময়ের মধ্যে।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২ জন। আর দেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫২১ জনের।
গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩৮৩ জন রোগী। এসব রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৬ জন আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৮, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৩৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারাদেশে ৩৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮ হাজার ৭২৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের।
সারাদেশে করোনা ভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পর সিলেট এ ভাইরাসে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার দুপরে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন করে করোনার আক্রমন শুরুর পর সিলেটে প্রথম এই কোন রোগী মারা গেলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, করোনায় আক্রান্ত ৬৯ বছর বয়েসি পুরুষ ১৯ জুন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। এছাড়া সিলেটে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ জন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. মিজানুর রহমান জানান, নিহত ব্যক্তির বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়। তিনি করোনা ছাড়াও আরও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে; গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ছয়জন। এ নিয়ে চলতি জুন মাসেই জেলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা সাতজনে দাঁড়াল।
২৮ জুন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা সালেহা বেগম (৪০) নামে এক নারী শুক্রবার নগরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই তিনি হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
এদিকে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নগরের এবং দুজন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে নগরের শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চারজন এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি জুন মাসে মোট ১৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৬ জন পুরুষ, ৬৩ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে।
মশাবাহীত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালের দুই জেলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় গোটা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরও ১০৫ জন আক্রান্ত রোগী। এ নিয়ে বর্তমানে বিভাগের ছয় জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন। মৃত্যুবরণ করা দুজন হলেন- বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আ. করিম (৫০) ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের রাজপাড়া এলাকার মো. ইউসুফ খন্দকার (৭২)। এর মধ্যে আ. করিম বরিশাল শেরইবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ও বৃদ্ধ মো. ইউসুফ খন্দকার কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। তাই মশার বিস্তার রোধ করতে বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন।
বরগুনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মৃত ১১ জনের মধ্যে ছয়জনেরই বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। শুধু মৃত্যুই নয় এ জেলায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি, বরগুনা জেলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মন্তব্য