চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে হঠাৎ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিসহ দামি শেয়ারের দরে দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। বুধবারও তা অব্যাহত ছিল। এসব কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে লাফিয়ে।
মূল্য সংবেদনশীন কোনো তথ্য না থাকলেও কেন বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারের পেছনে ছুটছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বুধবার এসব কোম্পানি লেনদেনে এগিয়ে না থাকলেও শেয়ারপ্রতি দর বৃদ্ধিতে ছিল এগিয়ে। তবে আগের দিনের সূচকের পতন অব্যাহত ছিল। কমেছে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে ভালো কোম্পানিগুলো নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ এর সূচক। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনও।
মঙ্গলবার হাজার কোটি টাকার লেনদেন বিনিয়োগকারীদের নতুন স্বপ্ন দেখালেও তা টেকেনি বুধবার। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মুনাফা হলেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়ায় বড় লেনদেন হচ্ছে না। তবে সূচক এখন সাড়ে পাঁচ হাজারে অবস্থান করায় এ ধরনের পতনকে সাময়িক বলেছেন তারা।
দামি ও বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার
গত রোববার থেকে বাড়তে থাকা বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। এ ছাড়া দামি শেয়ারের দরও বেড়েছে। তালিকাভুক্ত রেকিড বেনকিউজার, ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার, ম্যারিকো, বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, লিন্ডে বিডিসহ দামি শেয়ার ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির মতো কোম্পানির প্রতি আগ্রহী ছিলেন বিনিয়োগকারীরা।
কেন বাড়ছে এসব কোম্পানির শেয়ার দর, প্রশ্নে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে গুজব আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোকে তাদের পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য বলবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব কটি বহুজাতিক কোম্পানি স্বল্প মূলধনি।’
তিনি জানান, সম্প্রতি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০ শতাংশ বোনাস ল্ভ্যাংশ ঘোষণা করে তাদের পরিশোধিত মূলধন ৫৪০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে।
দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘মূলত এ কারণেই হঠাৎ করে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা হওয়া উচিত বলেও মনে করি না। কারণ, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের শাখা অফিসের মাধ্যমে ব্যবসা করে। অনেকগুলো আছে যাদের নিজস্ব কোনো উৎপাদন কারখানা নেই। ফলে এসব কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে আসলে কি করবে?’
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি রেকিড বেনকিউজারের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কোম্পানিটি ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের ১২৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৪ হাজার ৪৬৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৯৬ টাকায়। কোম্পানিটিতে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ।
ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার লিমিটেডে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে দশমিক ৪৩ শতাংশ। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১২ কোটি টাকার কিছু বেশি। কোম্পানিটি সবশেষ ২০১৯ সালে ৫৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩ হাজার ১৪১ টাকা থেকে সর্বোচ্চ উঠেছে ৩ হাজার ৩৪০ টাকায়।
ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডে পরিশোধিত মূলধন ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই কোম্পানির শেয়ারদরও গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাড়ছে। এই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২ হাজার ৮৮ টাকা থেকে ২ হাজার ১৪৬ টাকায় উঠেছে।
বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৪৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। কোম্পানিটি ২০১৮ সালে ১০০ শতাংশ বা ১টি শেয়ারের বিপরীতে ১টি শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি করেছে। এবং ২০২০ জন্য কোম্পানিটি ২৯৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
দামি শেয়ারের মধ্যে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। বুধবার কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৯২ টাকায়।
রেনেটা লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ টাকায়। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর অপরিবর্তিত ছিল। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৯৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
লেনদেনে যারা এগিয়ে
বুধবার সূচক ও লেনদেন কমলেও কোম্পানিভিত্তিক লেনদেনে এগিয় ছিল রবি, সামিট পাওয়ার, লাফার্জহোলসিম, এসএস স্টিল, বেক্সিমকো।
বুধবার রবির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ১২ হাজার ১২৫টির, যার বাজারমূল্য ছিল ৫৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
শেয়ার লেনদেনের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও টাকার অঙ্কে শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। বুধবার বেক্সিমকো লিমিটেডের ৮৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৩টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭৩ কোটি ১৯ লাখ টাকায়।
লাফার্জহোলসিম লিমিটেডের লেনদেন হয়েছে ৫৮ কোটি ১৯ লাখ টাকার শেয়ার। সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেডের মোট ৩১ কোটি ১৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
দিনের সর্বোচ্চ দরে নতুন কোম্পানির শেয়ার
৯ মার্চ থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করেছে লুব রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দ্বিতীয় দিনেও কোম্পানিটির শেয়ারদর ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রথম দুদিন শেয়ার দর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার সুযোগ থাকে। তৃতীয় দিন থেকে স্বাভাবিক নিয়মে ১০ শতাংশ করে বাড়তে পারে শেয়ারদর। এ হিসেবে বৃহস্পতিবার থেকে স্বাভাবিক লেনদেনে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
বুধবার কোম্পানিটির ১ কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার ২৭টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। মঙ্গলবার কোম্পানিটির মাত্র ৪২১টি শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।
এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করেছে ইজেনারেশন লিমিটেড। মাত্র সাত কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর দিনের সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়ে ১০ টাকার শেয়ার পৌঁছেছে ৩৯ টাকা ৪০ পয়সায়। এখন কিছুটা উত্থান-পতন থাকলেও দর কমে আসার প্রবণতাই বেশি। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৩৭ টাকা ২০ পয়সায়।
তালিকাভুক্ত হওয়ার পরপরই বিনিয়োগকারীদের প্রবল আগ্রহের কারণে এসব কোম্পানির শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে যখন শেয়ার সরবরাহ বাড়ে তখন উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে লোকসান গুনতে হয়।
গত চার মাসের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া রবি, এনার্জিপ্যাক, ডমিনোস স্টিল ও ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্সের শেয়ার উচ্চমূল্যে কিনে এখন লোকসান গুনছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিশ্লেষক বক্তব্য
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। হাজার কোটি টাকায় লেনদেনের দিন যারা শেয়ার কিনেছে তারা বুধবার শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। তবে কিনতে পারবে।’
তার মতে, এটা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো যে উত্থানপতনের মধ্যেই সূচক সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্টে আছে। এখানে হঠাৎ করে কোনো বড় ধরনের পতন হয়নি। আগের যেমন কয়েক দিন পুঁজিবাজার ভালো থাকার পর শেয়ার বিক্রির চাপে এক দিনেই শত পয়েন্ট সূচকের পতন হতো।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ২৭ দশমিক ৭১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬৩ পয়েন্টে। শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২ দশমিক ২৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৩ পয়েন্টে। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস ৩০ সূচক ১৫ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৯ পয়েন্টে।
এদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৮৭৯ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এ হিসেবে লেনদেন কমেছে ১৬৪ কোটি টাকা।
এদিন ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে সবচেয়ে কম কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে। মাত্র ৬৪টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে লেনদেন। দর কমেছে ১৭৩টির আর পালটায়নি ১১৪টির।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ৮৩ দশমিক ০৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ১৭৩ দশমিক ৬৭ পয়েন্টে। লেনদেন হওয়া ২২৬টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৫০টির, কমেছে ১১৬টির ও পালটায়নি ৬০টির। মোট লেনদেন হয়েছে ৬৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
আগ্রহ ও অনাগ্রহের কোম্পানি
বুধবার ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এসএস স্ট্রিল লিমিটেডের ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা ৯০ পয়সা।
তবে দর বৃদ্ধির শীর্ষে ছিল সদ্য তালিকাভুক্ত কোম্পানি লুব রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। লেনদেনের দ্বিতীয় দিনে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির নিয়ম অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারের এমন দর বেড়েছে।
তৃতীয় স্থানে ছিল রহিমাফুড, যার শেয়ারদর বেড়েছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার ১৯৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২১১ টাকা ৯০ পয়সা। এ ছাড়া এ তালিকায় ছিল বিকন ফার্মা, বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ, ফরচুন, লিব্রা ইনফিউশন, এক্টিভফাইন, ওয়ালটন ও লিন্ডে বিডি।
দর পতনের দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়ার ফিন্যান্স লিমিটেড, এদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ৪ টাকা ৩০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৪ টাকা। দর কমেছে ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ ছাড়া সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের শেয়ারদর কমেছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এ তালিকায় আছে এশিয়া প্যাসিফিক ইনস্যুরেন্স, সাভার রিফ্যাক্টরিস, শাইনপুকুর সিরামিক, ইজেনারেশন লিমিটেড, মাইডাস ফিন্যান্স।
আরও পড়ুন:চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে ৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রফতানি হবে বাংলাদেশ থেকে।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এ ঘোষণা দেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, সমাপ্ত অর্থবছর ২০২৪-২৫ এ বাংলাদেশ পণ্য খাতে ৫০.০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪৮.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৭% এবং পূর্ববর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৮.৫৮% বেশী।
সেবা খাতের লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫০ বিলিয়নের বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৫.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.১৩% বেশী।
অর্থবছরে রপ্তানি খাতে অর্জিত প্রবৃদ্ধির গতিধারা, পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, বিশ্ব বাণিজ্যের সাম্প্রতিক গতিধারা, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, অংশীজনদের মতামত, বিগত অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা এবং লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জনের হার ও পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ইত্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর পরিদর্শনে গিয়ে বস্ত্র ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘সরকার বিভিন্ন স্থলবন্দর প্রাইভেট সেক্টরের কাছে হস্তান্তর করার পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে, যেসব স্থলবন্দর থেকে সরকার কোনো রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না, সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
শনিবার দুপুরে হিলি স্থলবন্দর পরিদর্শনের সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ২৪টি স্থলবন্দর রয়েছে, যার মধ্যে ইতোমধ্যে চারটি স্থলবন্দর বন্ধ করা হয়েছে। আরো চারটি অলাভজনক স্থলবন্দর বন্ধের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘উন্নয়নশীল স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং ধাপে ধাপে এসব বন্দরের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
হিলি স্থলবন্দর সভাকক্ষে কাস্টমস, বন্দরের কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যবসায়ীরা রাস্তা-ঘাট সংস্কার, ওয়্যারহাউজ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে দ্রুত সেসব সমাধানের অনুরোধ করেন।
উপদেষ্টা হিলি স্থলবন্দর ও কাস্টমস বিভাগের বিভিন্ন অবকাঠামো ঘুরে দেখেন এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, রংপুর কাস্টমসের বিভাগীয় কমিশনার অরুন কুমার বিশ্বাস, হিলি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার এ এস এম আকরামসহ আরো অনেকেই।
স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যাদি (ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডাল) বিক্রয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীতে ৬০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে আজ (১০ আগস্ট) হতে পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
শনিবার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে টিসিবি।
টিসিবির উপপরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন (শুক্রবার ছাড়া) এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৫টি, গাজীপুর মহানগরীতে ছয়টি, কুমিল্লা মহানগরীতে তিনটি এবং ঢাকা জেলায় আটটি, কুমিল্লা জেলায় ১২টি, ফরিদপুর জেলায় চারটি, পটুয়াখালী জেলায় পাঁচটি ও বাগেরহাট জেলায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ১০ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ দিন (শুক্রবার ছাড়া) টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হবে। দৈনিক ট্রাক প্রতি ৫০০ জন সাধারণ মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্যাদি (ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডাল) বিক্রয় কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। যে কোনো ভোক্তা ট্রাক থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন।
ভোক্তা প্রতি ভোজ্যতেল দুই লিটার ২৩০ টাকা, চিনি এক কেজি ৮০ টাকা এবং মসর ডাল দুই কেজি ১৪০ টাকায় বিক্রি করা হবে। স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডধারীর কাছে বিক্রয় মূল্য আগের ন্যায় বহাল থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত বাংলাদেশি পণ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার পর থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে এই সময়ের আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে তোলা পণ্য নতুন শুল্ক এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ সুবিধা কাজে লাগাতে আগাম পণ্য পাঠিয়ে রফতানিকারকরা জোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, এই রফতানিতে জোয়ারের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, রফতানিকারকদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৮০০ কনটেইনার রফতানি হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরের ১৯টি ডিপোতে জমা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০টি ২০ ফুট এককের রফতানি কনটেইনার। যার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রমুখী।
এ বিষয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ৭ আগস্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য পাঠাতে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। তবে যারা আগাম উৎপাদন সম্পন্ন করেছিলেন, তারা ১ আগস্টের আগেই রফতানি নিশ্চিত করেছেন। ফলে জুলাই মাসে রফতানিতে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের এশিয়ান-ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম জানান, জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে ৩৯৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে, যার মধ্যে ৮২ কোটি ডলারের পোশাক গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর ৬০ শতাংশ রফতানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন। পরবর্তীতে ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের তৃতীয় দফা আলোচনার পর চুক্তির ভিত্তিতে পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামানো হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি শুল্ক কার্যকর ছিল, ফলে মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৩৫ শতাংশের বেশি। তৈরি পোশাকে আগে শুল্ক ছিল প্রায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, শুল্ক কার্যকরের ক্ষেত্রে বন্দর থেকে পণ্য ছাড়কাল থেকেই সময় গণনা করা হয়। এপ্রিলেও একই পদ্ধতিতে ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক কার্যকর হয়।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহারে পাল্টা শুল্ক ছাড় থাকায় বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ পোশাক খাত তুলানির্ভর এবং বাংলাদেশের আমদানিকৃত তুলার বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক এড়াতে রফতানিকারকরা আগেভাগেই কনটেইনার পাঠিয়েছেন ডিপোতে। এর প্রভাবে আগস্টেও ডিপো থেকে আমেরিকামুখী রফতানি বেশি হবে।
তিনি জানান, প্রতি মাসে গড়ে ৬০-৬৫ হাজার কনটেইনার রফতানি হলেও জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজারে; যার মধ্যে ৮১ হাজার কনটেইনার ইতোমধ্যে রফতানি হয়েছে।
গত বছরের রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের পর অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহে বড় ধরনের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশে নিট এফডিআই প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৮৬৪.৬৩ মিলিয়ন ডলার। যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ১১৪.৩১ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে বিনিয়োগ ছিল ৪০৩.৪৪ মিলিয়ন ডলার।
এই বিনিয়োগ প্রবাহ ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায়ও ৭৬.৩১ শতাংশ বেশি। তখন নিট এফডিআই ছিল ৪৯০.৪০ মিলিয়ন ডলার।
ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট বা মূলধনী বিনিয়োগেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এটি দাঁড়ায় ৩০৪.৩৮ মিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৮.৪৩ মিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনার প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের ‘আস্থার প্রতীক’। যদিও দেশ এখনো মুদ্রা অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বাসসকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ এখনো প্রত্যাশার তুলনায় কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, এই সমস্যা দ্রুত সমাধান খুবই কঠিন।
বাসসর সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, উচ্চ-প্রভাবসম্পন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের সমস্যার সমাধান এবং বড় বিনিয়োগের একটি শক্তিশালী পাইপলাইন তৈরি করা এই চারটি প্রধান অগ্রাধিকারের ওপর জোর দিচ্ছে বিডা ও বেজা।
বিডা প্রধান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট -২০২৫’ এর সাফল্য তুলে ধরে বলেন, ৭ থেকে ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন এবং এতে প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা পান এবং বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত এবং লাভজনক হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, বেজা নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, যাতে বিনিয়োগ প্রক্রিয়াগুলোর বাস্তব অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়।
ভারসাম্যপূর্ণ শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) একটি ‘জাতীয় মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো তিন ধাপে বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।
জাতীয় মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে ২০৪৬ সালের মধ্যে ২০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে । যা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কৌশলগতভাবে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রস্তুত হওয়া এই মাস্টার প্ল্যানটি ভূমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো প্রস্তুতি এবং বিনিয়োগকারীর আস্থার মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথম পর্যায়ে, অর্থবছর ২৫ থেকে অর্থবছর ৩০ পর্যন্ত যেগুলোর উন্নয়ন কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে বা পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এমন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এদিকে, দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) তাদের নতুনভাবে ডিজাইন করা ওয়েবসাইট চালু করেছে। যা বিনিয়োগ অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নতুন এই প্ল্যাটফর্মে বিডার এফডিআই হিটম্যাপ অনুযায়ী সম্ভাবনাময় খাতগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, নীতিমালা, এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ফোকাল পয়েন্ট সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিডার লোগোও নতুনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।
বিডা তাদের ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টালেরও হালনাগাদ সংস্করণ চালু করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সেবার গুণগতমান বৃদ্ধি।
এই ওএসএস পোর্টালটি ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চালু করা হয় এবং বর্তমানে ৩৫টি সরকারি সংস্থা, ১২টি ব্যাংক ও ৫টি চেম্বার সংস্থার ১৩৩টি সেবা একত্রে প্রদান করে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, ‘আগামী মাসগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় থাকলে বিনিয়োগ প্রবাহ আরও বাড়বে।’
এফবিসিসিআইর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের পথে বাধাগুলি মোকাবেলা করতে বিডা এবং বেজা কয়েক মাস ধরে আরও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কিছু সফল ইভেন্টের আয়োজন করেছে। এছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর ব্যবস্থা আরও সহজ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
বেপজার নির্বাহী পরিচালক আবু সাইয়েদ মো. আনোয়ার পারভেজ বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেপজার ইপিজেড এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মেশিনারি, নির্মাণ সামগ্রী এবং অন্যান্য মূলধনী খাতে (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ছাড়া) ২৯২.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
আনোয়ার পারভেজ বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৩টি নতুন বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বেপজার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
তিনি বলেন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশ থেকে আগত বিনিয়োগকারীরা শিল্প কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে এসব চুক্তিতে সই করেছেন।
পারভেজ বলেন, ‘এই চুক্তির আওতায় মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৯৭.৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সম্ভাব্য ৫৯ হাজার ৪০৮ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করবে, যার মধ্যে রয়েছে: তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, কৃষিভিত্তিক পণ্য, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য, প্যাকেজিং সামগ্রী, তাঁবু, কৃত্রিম চুল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, খেলনা এবং কম্পোজিট আইটেম।
তিনি আরও বলেন, এই বিনিয়োগগুলো চালু হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রকৃত বিনিয়োগ প্রবাহ আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের পর দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সময়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, রপ্তানি আয়ের উন্নতি এবং অর্থপাচার রোধে দৃশ্যমান উদ্যোগের ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে শক্তিশালী অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার মান ডলারের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে, কারণ নিয়মিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে, যার ফলে ডলারের বিনিময় হার কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৯ জুলাই থেকে ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে পাঁচ দিনে আন্তঃব্যাংকে ডলারের বিক্রয়মূল্য ২ টাকা ২০ পয়সা কমে ১২২.৩ টাকা থেকে ১২০.১ টাকায় দাঁড়ায়। ওই দিন ডলারের ক্রয়মূল্য ছিল ১১৯.৫ টাকা।
বিনিময় হার বেশি ওঠানামা না করে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করেছে এবং এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার কিনেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকার মান বেড়ে গেলে দেশে মূল্যস্ফীতি কমানো সহজ হয়, তবে ডলারের মান খুব দ্রুত পড়ে গেলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসী আয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের ফলে ৩ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ডলারের আন্তঃব্যাংক বিক্রয়মূল্য ১২২.৮৯ টাকায় দাঁড়ায়।
২০২২ সালে কোভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে টাকার মান পড়তে শুরু করে। ওই বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত টাকার মান ৩০ শতাংশ কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকার মান সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বেড়েছে, তা সম্ভব হয়েছে কয়েকটি কারণে: প্রবাসী আয় বেড়ে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, অবৈধ অর্থ লেনদেন ও মানি লন্ডারিং কমেছে, বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ সহায়তা এসেছে।
২০২৫ সালের মে মাসে আইএমএফ-এর শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করে। ব্যাংকারদের মধ্যে ভয় ছিল এতে ডলারের দর আরও বাড়বে, তবে বাস্তবে বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, নেট রিজার্ভ ২৪.৯৯ বিলিয়ন ডলার।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রবাসী আয় বাড়ছে, অর্থপ্রবাহে ভারসাম্য এসেছে এবং ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে।
তিনি বলেন, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এটি উদ্বেগের কারণ হয়নি, বরং টাকার ওপর আস্থা বেড়েছে।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, এখন প্রবাসীরা বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, কারণ ডলারের দামের আকস্মিক পরিবর্তনের গুজব আর নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের জিইডি সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ১২২.৪৫ থেকে ১২২.৭০ টাকার মধ্যে স্থির ছিল। এই স্থিতিশীলতা ব্যবসা ও বাণিজ্য পরিকল্পনায় সহায়ক।
তিনি বলেন, দেশের বহিঃবাণিজ্য খাত এখন ভালো করছে, নীতিগতভাবে ভালো ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এবং রপ্তানি বৈচিত্র্য বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ডলারের দাম অতিরিক্ত পড়ে যাওয়াও ভালো নয়, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল থাকুক। বেশি বাড়া বা কমা- দুটোই খারাপ।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ৮.৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয় এবং টাকার মানকে শক্তিশালী করেছে।
শুধু ২০২৫ সালের জুলাই মাসে, বাংলাদেশ ৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে, যা গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকেই এসেছে ৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা এ খাতে ধারাবাহিক ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখায়।
আরিফ হোসেন খান বলেন, এক বছর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং অর্থনীতি, প্রশাসন ও নীতিগত সংস্কারে বড় পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়।
এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আগের সময়ের মতো এলসি খোলার জটিলতা এখন নেই। ডলার ও বিনিময় হার নিয়ে এখন আর কোনো সংকট নেই, যা আমদানিকারকদের জন্য ভালো সংবাদ।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল কাইউম চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহতভাবে বেড়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক স্বস্তি এনেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে, যা মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করে অর্জিত হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কর্তৃক সোমবারে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে রপ্তানি ৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি খাতে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, যদিও শেষ মাস জুনে রপ্তানি আয় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়নের তুলনায় বেশি।
জুন মাসের এই মন্দার জন্য বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর অর্ডার হ্রাস, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা, দেশে গ্যাস সংকট এবং ঈদ উপলক্ষে দীর্ঘ ছুটিকে দায়ী করেছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রপ্তানি হয়েছে ১৩৩.৪৯ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ১১০.৫৬ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০.৭১ শতাংশ বেশি।
চিংড়ি রপ্তানি আয় ৩১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ২১ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৪৭.৬২ শতাংশ বেশি। কৃষিপণ্য রপ্তানি ৯০.৫০ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের ৮০.১৯ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১২.৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওষুধ খাতের রপ্তানি ১৯ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের ১২ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৫৮.৩৩ শতাংশ বেশি। প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি ২১.১৬ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ১৯.৭০ মিলিয়নের তুলনায় ৭.৪১ শতাংশ বেশি।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ১২৭ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের ৯৮ মিলিয়নের তুলনায় ২৯.৫৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ৩৮ মিলিয়ন ডলার (আগের বছরের ২৭ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৪০.৭৪% বেশি), ক্রাশড লেদার ৯.২৪ মিলিয়ন ডলার (৭.৫৮ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২১.৯৩% বেশি), এবং চামড়ার জুতা ৮০ মিলিয়ন ডলার (৬৪ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২৫% বেশি)।
পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ৫৫.৪৪ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ৫২.৮৪ মিলিয়নের তুলনায় ৪.৯১ শতাংশ বেশি। বিশেষায়িত টেক্সটাইল রপ্তানি ৩০ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের ২৭ মিলিয়নের তুলনায় ১১.১১ শতাংশ বেশি।
হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ৬৮ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ৬০ মিলিয়নের তুলনায় ১৩.৩৩ শতাংশ বেশি। নন-লেদার ফুটওয়্যার রপ্তানি ৫১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের ৩৬ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৪১.৬৭ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন বাংলাদেশ অর্থনীতি ও রপ্তানিকারকদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে, তারপরও আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে যাতে বৈশ্বিক বাজার থেকে বেশি শেয়ার দখল করা যায়।
প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে সরকারকে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বন্দর ও কাস্টমসের দক্ষতা বাড়াতে হবে, যাতে পণ্য সরবরাহের সময় বা ‘লিড টাইম’ কমানো যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মন্তব্য