প্রথমে ৩৫০ শতাংশ। পরে ২০ শতাংশ ও ১০ শতাংশ।
২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মুন্নু অ্যাগ্রোর বোনাস শেয়ারের হিসাব এটি।
প্রথমে কোম্পানিটির নাম ছিল মুন্নু স্টাফলার। তখন তারা উৎপাদন করত পাটকলের যন্ত্রাংশ। এখন উৎপাদন করে কৃষি যন্ত্রপাতি।
এই ব্যবসা পরিবর্তনের জন্য পরিশোধিত মূলধন ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয় তিন বছর আগে। আর তখন একে কেন্দ্র করে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়ে যায় ২০ গুণের মতো।
কিন্তু যারা উচ্চমূল্যে সেই শেয়ার কিনেছেন, তারা এখন ব্যাপক হতাশ। কারণ বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়েছেন তারা। ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার দর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে নামতে পারছে না বটে। কিন্তু লোকসান গুনে কেউ শেয়ার বেচতেও পারছেন না। কারণ এই ফ্লোর প্রাইসেও নেই ক্রেতা।
যে কোম্পানির শেয়ার দর ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে থাকত, ২০১৮ সালে সেটি হঠাৎ করেই বাড়তে বাড়তে চলে যায় ৫ হাজার ৮০০ টাকায়।
১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে তখন কাজ করেছে ভালো লভ্যাংশ দিয়ে কোম্পানি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা।
ওই বছর কোম্পানিটি সাড়ে ৩০০ শতাংশ বোনাস অর্থাৎ প্রতি ১০০ শেয়ারের বিপরীতে সাড়ে ৩০০টি শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়।
ওই বছর উচ্চ মূল্যে যারা শেয়ারটি কিনেছেন, তাদের সবাই পড়েন বিপাকে।
বোনাস শেয়ার যোগ হওয়ার পর ৫ হাজার ৮০০ টাকার শেয়ারের দাম সমন্বয় হয় এক হাজার ২৮৮ টাকা।
পরের দুই বছর কোম্পানিটি যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় লভ্যাংশ হিসেবে।
এই হিসাবে তিন বছর যিনি শেয়ারটি ধরে রেখেছেন, তার শেয়ারের দাম পড়ে ৯৭৬ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু এর এখন বাজার মূল্য কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে ৭৯৪ টাকা ৮০ পয়সায়।
তাও প্রতি শেয়ারে বর্তমানে লোকসান ১৮১ টাকা ৬০ পয়সা। আর তিন বছরের বোনাস শেয়ার বিবেচনায় আনলে আগের দামে লোকসান দাঁড়ায় এক হাজার ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা।
কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার কথা বলা হচ্ছে এই কারণে যে, গত বছর প্রতিটি কোম্পানির সর্বনিম্ন শেয়ারদর বেঁধে দিয়ে যে ফ্লোর প্রাইস ঘোষণা করা হয়, তাকে মুন্নু অ্যাগ্রোর এই দাম ঠিক করা হয়।
এই দাম ঠিক করার পর ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার যোগ হলেও ফ্লোর প্রাইস পাল্টায়নি। পাল্টালে দাম দাঁড়াতে পারত ৭২২ টাকা ৬০ পয়সা।
কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কাছে এর বর্তমান দাম যে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না, তা স্পষ্ট কোম্পানিটির লেনদেনের চিত্রে।
এই দামে গত এক মাসে এক দিনে সর্বোচ্চ ২৫টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। প্রতিদিন বিক্রেতা থাকে, কিন্তু ক্রেতা থাকে না কেউ।
কোম্পানি সম্প্রসারণ, ব্যবসা পরিবর্তনের পর মুনাফায় বৃদ্ধি হয়েছে, এমন নয়। ২০১৮ সালে ৩৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার সময় শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৮ টাকা ৭৪ পয়সা। শেয়ার সংখ্যা বাড়ায় পরের দুই বছর এই আয় কমে হয় যথাক্রমে ২ টাকা ৭৪ পয়সা ও ২ টাকা ১২ পয়সা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছে এক টাকা ১৭ পয়সা।
কোম্পানি সচিব বিনয় পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে আমাদের কাছে বিনিয়োগযোগ্য নগদ অর্থ ছিল। তখন আমাদের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৪৬ লাখ টাকা। আমাদের কোম্পানি সম্প্রসারণের জন্য তখন বিএসইসি ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা ৩৫০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিলাম। নগদ লভ্যাংশ দিলে টাকাগুলো চলে যেত। তাই বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে আমরা আমাদের কোম্পানির সম্প্রসারণে ব্যয় করেছি।’
তারপরও কোম্পানিটি কেন ভালো হয়নি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের আগে জুট মেশিনের স্পেয়ার পার্টস তৈরি করতাম। সেখানেই আমাদের টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৯ সালে এসে আমরা আমাদের কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে অ্যাগ্রো বেইস পোডাক্ট তৈরিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন আমরা হারভেস্টিং মেশিন, ভুট্টা মাড়াই মেশিন তৈরি করছি।
‘এই প্রজেক্টের বয়স বেশি দিন না হওয়ায় এখনও মুনাফা আসেনি। তবে আগামীতে ভালো সম্ভাবনা আছে।’
কোনো কোম্পানি অনেক বেশি বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর খবরে যারা বিনিয়োগ করেছেন, মুন্নু অ্যাগ্রোর মতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বড় লোকসানে পড়েছেন। তবু অনেক বেশি বোনাস শেয়ার দেবে, এমন খবরে বাড়তি দাম দিয়ে হলেও শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কমতি নেই।
২০১০ সালের পর থেকে শতভাগের বেশি বোনাস শেয়ার দেয়া প্রায় সব কোম্পানির ক্ষেত্রেই একই চিত্র দেখা গেছে।
২০১২ সালে ডেল্টা লাইফ ২১০০ শতাংশ অর্থাৎ একটি শেয়ারের বিপরীতে ২১টি, ২০১৩ সালে ফ্যামিলিটেক্সের ১০০ শতাংশ, ২০১৭, ১৮ ও ১৯ সালে স্টাইল ক্রাফটের যথাক্রমে ৮০, ৪১০ ও ১৫০ শতাংশ, জেমিনি সি ফুড ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে ৫০ ও ১২৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ডাচ বাংলা ব্যাংক ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পর কোম্পানিগুলো ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারেনি।
এ কারণে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণে লোকসানে আছেন বিনিয়োগকারীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে কেবল বহুজাতিক দুটি কোম্পানিই শতভাগ বা তার চেয়ে বেশি বোনাস শেয়ার ইস্যুর পরও দর ধরে রাখতে পেরেছে।
কোম্পানি দুটি হলো ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেড বা বিএটিবিসি ও বার্জার পেইন্টস। যদিও বোনাস শেয়ার নেয়ার পর লোকসান কাটাতে বেশ কিছু সময় লেগেছে বিনিয়োগকারীদের।
২০১৮ সালে ২০০ শতাংশ বোনাস ও শেয়ার প্রতি ৫০ টাকা নগদ এবং ২০২০ সালের জন্য আবার ২০০ শতাংশ বোনাস ও শেয়ার প্রতি ৬০ টাকা নগদ মুনাফা দিয়েছে বিএটিবিসি।
দুই বছরে ধরে রাখার পর বিনিয়োগকারীরা ২০১৮ সালে উঠা চার হাজার ৮০০ টাকার সঙ্গে সমন্বয় করতে পেরেছেন।
একই পরিস্থিতি বার্জার পেইন্টসের।
২০১৮ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম তিন হাজার টাকার কাছাকাছি চলে যায়। দুই বছর পর এখন শেয়ার পর দেড় হাজার টাকার কিছু বেশি। ফলে লোকসান কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বিনিয়োগকারীরা।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব কোম্পানি বড় অংকের বোনাস শেয়ার দেয়, সেসব কোম্পানিতে মূলত দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হয় বেশি। বিনিয়োগকারীরা মনে করে সমন্বয়ের পর দর বাড়লে তারা লাভবান হবেন। কিন্ত যখন দেখা যায় সেই শেয়ার আর বিক্রি করা যাচ্ছে না তখনই সমস্যা তৈরি হয়।
‘এ জন্য কোম্পানির কাছে টাকা থাকলেও সেটির বিপরীতে বড় অংকের বোনাস দেয়ার প্রবণতা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।’
বিনিয়োগকারীদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্যের সভাপতি মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে বোনাস দিয়ে সেই অর্থ বিনিয়োগ করে না। ফলে কোম্পানির আয় বাড়ে না। এতে সার্বিক কোম্পানি ও শেয়ার দরের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে বিএসইসিকে অনেক আগেই বলেছিলাম যেসব কোম্পানি ন্যূনতম পাঁচ বছর টানা নগদ লভ্যাংশ দেবে না তাদের কে যেন বোনাস লভ্যাংশ দেয়ার অনুমতি না দেয়া হয়। কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েই দুই তিন বছর টানা বোনাস দিয়ে পরে আর টিকে থাকতে পারে না। কিন্ত বড় অঙ্কের বোনাস লভ্যাংশ প্রলোভনে শেয়ার দর বাড়লেও পরে তা আর টিকে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।’
পরের পর্বে থাকছে স্টাইলক্রাফটের কাহিনি
আরও পড়ুন:শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গত ০২ জুন, সোমবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জনতা ব্যাংক জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতি।
জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মজিবর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম মরতুজা, মোঃ ফয়েজ আলম ও মোঃ আশরাফুল আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আবেদিন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভা সঞ্চালনায় ছিলেন কার্যকরী সভাপতি শাহ জাহান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইকবাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি এস. এফ. এম. মুনির হোসেন, সহসভাপতি মজিবুর রাহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ছানোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। আবার ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতায় এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই হবে। ওই ১১টি সেবা হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণে; সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রাপ্তিতে; সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারের নতুন লাইসেন্স গ্রহণে; ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়নে; চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, আইনজীবী ও কর আইনজীবী, অ্যাকচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণে; পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খোলায়; এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মচারীর কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে এবং মোবাইল ফোনের হিসাব রিচার্জের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্য কোনো অর্থ প্রাপ্তিতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তিতে; ত্রি-চক্র মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার (২ জুন) বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
ঘরে বসে যেসব ক্রেতারা কেনাকাটা করতে চান, তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা আগামী অর্থবছর থেকে খানিকটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় থেকে কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্যের দাম বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে পেশ হলো বাজেট। এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।’
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মুদ্রানীতি সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। বহু দেশ সংকটে পড়ে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে- কেউ সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে, কেউ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণনির্ভরতার ফাঁদে পড়ে গেছে।
আজ, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্রমশ পশ্চিমকেন্দ্রীকতা থেকে সরে পূর্ব ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আইএমএফ তার প্রাসঙ্গিকতা ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন।
ঋণ সহায়তা, নাকি ঋণের ফাঁদ?
আইএমএফ সাধারণত এমন শর্তে ঋণ দেয়, যার মধ্যে থাকে কঠোর ব্যয়সংযম, ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারমুখী সংস্কার; কিন্তু এই শর্তগুলো অনেক সময় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। স্থানীয় শিল্প ধসে পড়ে, বৈষম্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা এর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০১৮ সালে আইএমএফ ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ প্যাকেজ ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। ফল ছিল বিপরীত- মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায় এবং দেশটি আবার মন্দার মুখে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে শুধু অর্থনৈতিক সমীকরণ দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণ চলে না।
আইএমএফের নীতিনির্ধারণ কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শক্তির ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নত দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংগঠনের ভোটের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি আজ দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠানের উত্থান
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং ল্যাটিন আমেরিকান রিজার্ভ ফান্ড (FLAR) নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। (NDB) এর সহায়তা তুলনামূলকভাবে শর্তমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক। এখানে প্রতিটি দেশের ভোটের ও প্রতিনিধিত্বের সমান সুযোগ আছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু আর্থিক বিকল্প নয়- এরা এক নতুন উন্নয়ন দর্শনের বাহক। সেই দর্শনে উন্নয়ন নির্ধারিত হয় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে, বাইরের চাপ বা রূঢ় শর্ত নয়।
বিশ্ব আজ বহুমেরু। অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে নানা অঞ্চলে। এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে আইএমএফকে নিজস্ব কাঠামো ও দর্শনে রূপান্তর আনতে হবে। প্রয়োজন গভর্ন্যান্সের সংস্কার, নীতিনির্ধারণে সমান অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীল ঋণ নীতিমালা।
আইএমএফ যদি সত্যিই বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হতে চায়, তাহলে তাকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাসম্মত এটি শুধু আইএমএফের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্ন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দ কর তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরমর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময়ে এবারের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।’
‘গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এই সরকারের এই সময়ে অন্যতম সাফল্য ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা,’ যোগ করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঋণ বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিল। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, দায়-দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা।’
তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে কোনো চমক থাকছে না।’
‘যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে, তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে,’ বলেন তিনি।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও ব্যক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।’
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বিতর্ক সংগঠন এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
মন্তব্য