দেশে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ যাগত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা এ বছর ২.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করতে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষিখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।নীতিমালায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ২০ শতাংশ করা, সেচ ও কৃষিযন্ত্রপাতি খাতে ২ শতাংশ বরাদ্দ, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের সিআইবি সার্ভিস চার্জ মওকুফ, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতা বৃদ্ধি, খিরা, কচুর লতি, বিটরুট, কালোজিরা, আদা, রসুন, হলুদ, খেজুর গুড় ইত্যাদি নতুন ফসল ঋণ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত এবং অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন সম্ভাবনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণের নির্দেশনা। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কৃষি ও পল্লী খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অর্থনীতি গঠনে এ নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্যনিরাপত্তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনীহার ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের ৩৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগের বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। তবে গত অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে এক বছরে কৃষিঋণ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন বেশি। পুরো অর্থবছরে কৃষিঋণ আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সবমিলে গত জুন শেষে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বকেয়া স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ২৩২ কোটি টাক, যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জরিমানা হিসেবে অনর্জিত অংশ কেটে নিবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে তহবিলে জমা করা হবে এবং জমাকৃত অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা হবে। । যেসব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা পল্লি অঞ্চলে নেই, তাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) নিবন্ধিত এনজিও সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে এবং তারা যেন অতিরিক্ত সুদ নিতে না পারে, সে জন্য সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষিঋণ বিতরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য প্রতিবছর কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণাকরা হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা (২০২৫-২৬) বছরেধরা হতে পারে সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, প্রতিবছর কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও ব্যাংকগুলোর ছলচাতুরির কারণে তার উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো অন্য খাতে ঋণ দিয়ে তা কৃষিঋণ বলে চালিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন ফরমালিটিসের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের অধিকাংশই এনজিও নির্ভরতায় বিতরণ করে।
কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার পেছনে চারটি কারণকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এগুলো হলো- গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুদের হার বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট। সাম্প্রতিক গত বছর দুটি বন্যায় কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় কৃষি ঋণ বিতরণ কমে আসায় আসন্ন খরিপ, রবি ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও এর আগের খরার প্রভাবে এবার আরো বেশি করে কৃষি ঋণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে জোর না দেয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি সামনের দিনগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে উঠতে পারে।যদিও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনিশ্চয়তার প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষিতে ঋণপ্রবাহ কমলেও সামনের দিনগুলোয় তা আবারো বাড়বে।এ ব্যাপারে কৃষিঅর্থনীতিবিগন মনে করেন ‘সাম্প্রতিক দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে এবার কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বন্যা-উত্তর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবার আরো বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না থাকায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। ফলে খরিপ /রবি মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আমদানি নিশ্চিতের পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে ডলার সংকট। তাই সার্বিক কৃষিপণ্য সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দিতে পারে।’এ ব্যাপারে ব্যাংকারদে র মন্তব্য হলো গত বছর জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রভাব কমে এসেছিল। তখন মানুষ বের হতে পারেনি। আবার ১০-১২ ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষি ঋণ বিতরণে এটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কৃষি ঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় এটা আমাদের দিতেই হবে। আগামীতে আশা করছি ঋণ বিতরণ বাড়বে।’ কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহকে একটি বড় প্রভাবক বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের,তদের মতেঋণ না পেলে প্রান্তিক কৃষক কীভাবে উৎপাদন করবে? গতবার আলু উৎপাদন কম হওয়ায় চালের ওপর চাপ পড়েছে। তাই আগামীতে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ঋণের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে ।
গত বছরের শেষ দিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণ বিতরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; বিশেষত জুলাই-আগস্টে ঋণ বিতরণ ও লেনদেন কমে যায়। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ঋণ বিতরণে গতি ফিরেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে হবে এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা এবং কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। এখানে উল্লেখ্য যে গত বছরের মত এ বছরও আগের আশঙ্কাটি রয়েই যাবে সম্প্রতি ষোষিত জতিীয় সংসদ ইলেকশনের কারনে যা আগামী রমজানের আগে সংগঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ।এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কৃষকের মনে স্বস্থি নেই বিধায় কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। তাই কেবল কৃষি ঋন নয়,তার জন্য নীতি সহায়তা জরুরী যাতে কৃষক বেচে থাকতে পারে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা সময়ের দাবি ।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে উদ্বিগ্ন স্বজন, প্রিয়জনদের জটলা কিংবা ভিড় লেগেই থাকে রাতদিন। কেউ নিজেকে সম্বরণ করে বুকে পাথর বেঁধে চুপচাপ থাকেন। কিন্তু তাদের দেখলেই অনুমান করা যায় অনেক কষ্ট বেদনা আর দুশ্চিন্তায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেই অবর্ণনীয় কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলছেন, হাঁটাচলা করছেন। আইসিইউর ভেতর জীবন-মৃত্যুর সন্নিক্ষণে কারো বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান কিংবা স্ত্রী। কখন যে কী হয়ে যায়, ভেতর থেকে কখন কী খবর আসে? কেউ কেউ নিজেকে সংবরণ করতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আর ফুপিয়ে কাঁদেন। এমনিতেই অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা হিসেবে বিবেচিত আইসিইউর ভেতরে সাধারণের প্রবেশাধিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। মুমূর্ষ রোগীদের জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ এবং সবশেষ প্রচেষ্টা চলে এখানে। এখানে রোগীর শরীরের সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের এবং যন্ত্রপাতির নলের ছড়াছড়ি। সেই সব যন্ত্রপাতির নানা ধরনের অদ্ভুত শব্দ কানে আসে শুধু। এখানে থাকা ডাক্তার এবং নার্সদের সতর্ক ব্যস্ততা চোখে পড়লেও এক ধরনের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে থাকে। জানা গেছে, দেশের কমপক্ষে ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। মারাত্মক অসুস্থ বা জীবন বিপন্ন- এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার দরকার হয়। আইসিইউতে রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। রোগীর বিশেষ সহায়তার দরকার হয়। চিকিৎসায় বিশেষ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি আইসিইউর নার্সদের থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বিশেষায়িত সেবার খরচ তুলনামূলক কম। তাই মানুষের আগ্রহ থাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা থাকেনা সবার। আত্মীয়দের ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকায় উপায়হীন আত্মীয়রা মুমূর্ষ রোগীদের নিয়ে ফেরত চলে যান বাড়িতে। তেমন কিছু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুগ্ন চেহারা আবারও আমাদের সামনে চলে আসে। দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে, জটিল রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে আইসিইউ সেবার প্রয়োজনও বাড়ছে। কিন্তু মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এই সেবা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই এমন জেলার মধ্যে রয়েছে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নাটোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, ভোলা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ। এ ছাড়া বাগেরহাট ও মাদারীপুর জেলায় সরঞ্জাম থাকলেও আইসিইউ চালু নেই। রাজধানীর একাধিক বড় সরকারি হাসপাতালেও এই শয্যা নেই। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) এক হাজার শয্যার। সারাদেশের গুরুতর আহত রোগী প্রতিদিন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। জানা গেছে, এই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। জাতীয় নাক-কান-গলা হাসপাতালেও এ ধরনের কোনো শয্যা নেই। সরকারের লক্ষ্য ছিল, সব জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার। করোনা মহামারির সময় সব জেলায় আইসিইউ চালু করা হয়েছিল। প্রায় ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তখনকার আইসিইউকে এখন কাজে লাগাতে কোনো অসুবিধা নেই। ১০ শয্যার আইসিইউ শয্যা চালু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সেবা চালু থাকবে সপ্তাহে সাত দিনের ২৪ ঘণ্টা। এতে থাকবে নয়টি অত্যাবশ্যকীয় সেবা ও চারটি ঐচ্ছিক বা বাড়তি সেবা। ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন ১৩ জন ও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসক থাকবেন ৭ জন। সার্বক্ষণিক নার্স থাকবেন ১৬ জন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন আরও ১৬ জন। কেন্দ্র চালাতে ছোট-বড় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম লাগবে মোট ৬৩ ধরনের। আর ওষুধ লাগবে ৪৯ ধরনের। আইসিইউ শয্যা আছে এমন প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যায়, মানুষ অপেক্ষায় থাকেন কখন একটি শয্যা খালি হবে। যারা সরকারি হাসপাতালে চেষ্টা করেও শয্যার ব্যবস্থা করতে পারেন না, তারা যান বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিক হাসপাতালের একটি অংশকে আইসিইউ হিসেবে ব্যবহার করেন। যথাযথ অনুমতি নিয়ে আইসিইউ সেবা দেন এমন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কম। তারা প্রতিদিনের আইসিইউ শয্যা ভাড়া নেন ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসকের ফি, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় এর বাইরে। দিনে মোট ব্যয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কোনো রোগীকে যদি দুই দিন, তিন দিন বা এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকতে হয়, তাহলে বহু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতাল যত বড়, তার আইসিইউর খরচ তত বেশি। এই ব্যয় অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। অনেকে অর্ধেক পথে চিকিৎসা বন্ধ করেন, অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনা যেমন অত্যন্ত মর্মান্তিক, তেমনি তা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার রুগ্ণদশাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেও কোনো আইসিইউ শয্যা খালি না পেয়ে বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেন, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব কমই আছে। ২২ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। মারাত্মক অসুস্থ, জীবন বিপন্ন এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ দরকার হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ বিশেষায়িত সেবার খরচ অনেক বেশি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। যেসব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে, সেখানকার অবস্থা অনেকটা ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী’। লালমনিরহাট জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা প্রয়োজন, এমন রোগী এলে তারা রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন। এ রকম ঘটনা আরও অনেক জেলাতেই ঘটে থাকে। করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে দেশে আইসিইউ সমস্যা কত প্রকট। সেই সময় কোনো কোনো হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে কিছু আইসিইউ খোলা হয়েছিল। আবার আইসিইউ খুললেই হবে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতির জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। ১০ শয্যার একটি আইসিইউর জন্য ১৩ জন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক প্রয়োজন। ৫ বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারির মধ্যেই তখনকার সরকারপ্রধানের নির্দেশনা ছিল প্রতিটি জেলায় আইসিইউ সেবা চালু করার। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদাসীনতার কারণে জেলায় জেলায় সেই সেবা চালু হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এ দুর্ভাগ্য দেশবাসীকে আর কত দিন বয়ে বেড়াতে হবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৫৪৮টি। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩৪৮টি। অর্থাৎ মোট শয্যা ছিল ৮৯৬টি। গত দুই বছরে সরকারি হাসপাতালে আরও আইসিইউ শয্যা যুক্ত হয়েছে। ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। একইভাবে ১৩টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যা করে আইসিইউ চালু করা হয়েছে। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এখন ১ হাজার ১২৬টি। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে এমন শয্যা আছে আরও প্রায় এক হাজার।
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল। আমরা চাই না আর কোনো অসুস্থ মানুষ আইসিউ সেবা না পেয়ে মারা যান। যেসব জেলা হাসপাতালে আইসিউ নেই, জরুরি ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। কেবল অবকাঠামো দিয়ে তো চিকিৎসা হয় না। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর আসে বছরের বছর যন্ত্রপাতি হাসপাতালে পড়ে থাকে, বসানো হয় না। বসানো হলেও দক্ষ লোকবলের অভাবে কাজে লাগানো যায় না। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা কেন উপেক্ষিত হলো, এর জন্য কারা দায়ী, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল চিত্র বেরিয়ে এসেছিল, তা লজ্জাজনক। এ লজ্জার মাত্রা আর বাড়তে দিতে না চাইলে সরকারের উচিত সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ কোনো ফল দেবে না। জেলা শহরের জেনারেল হাসপাতালে হঠাৎ করে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের চিকিৎসার জন্য এখনো ভরসার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সরকারি এই হাসপাতাল। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আসলে তেমন উন্নয়ন ঘটেনি এখনো সেখানে অনেক অনেক টাকা খরচ করে মোটামুটি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সুবিধা পান রোগীরা। কিন্তু এজন্য রোগীর পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়। অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল-ধনী পরিবারের হয়তো তেমনভাবে গায়ে লাগে না। সেই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে তিল তিল করে বানানো নারীর সখের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার কেউ কেউ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বসতবাড়ি-ঘর, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট পর্যন্ত বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা জোগাড় করেন। তবুও উন্নত চিকিৎসা করে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে যায় মানুষ। তবে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে ছুটে যায় সরকারি হাসপাতালে। সেখানে যতটুকু চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু তেমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে যদি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে তো সংকট বলে ধরে নেওয়া যায়। তখন রীতিমতো দুর্যোগ নেমে এসেছে সাধারণ, অসচ্ছ্বল, দরিদ্র মানুষগুলোর ওপর। সন্তানসম্ভবা বউ-ঝি, অসুস্থ সন্তান, বাবা-মাদের নিয়ে এসে হতাশ হয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দুচোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে তারা। যাদের গাটে টাকা পয়সা আছে, সামর্থ্য রয়েছে, যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বল তারা বিকল্প হিসেবে শহরের গুটিকতক ক্লিনিক বেসরকারি ছোট হাপাতালে ছুটে যায় হয়তোবা। কারণ, সন্তানসম্ভবা একজন নারীর নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। তখন অপেক্ষা করা চলে না। অতএব, বেসরকারি ছোটখাটো ক্লিনিকের শরণাপন্ন হতে হয় বাধ্য হয়েই। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকেনা তাদের কাছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ৭১-এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অগণিত শহীদের ত্যাগ আর অসংখ্য মা-বোনের অশ্রুর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই ভূখণ্ড। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। অথচ আজ প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক জাতি হয়ে উঠতে পেরেছি? নাকি আমরা কেবল নিছক নিজপ্রেমিক, যাদের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে—‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’
আজকের বাংলাদেশকে ঘিরে যে সব চিত্র আমরা প্রতিদিন দেখি, তাতে এ প্রশ্ন অমূলক নয়। শহরের রাস্তায় নামলেই বোঝা যায় আইন ভাঙা যেন এক ধরনের স্বভাব। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র পার্কিং করা অনেকের কাছে যেন বীরত্বের প্রমাণ। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালানো, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা কিংবা বাসে ভাড়া না দেওয়ার জন্য তর্কে জড়ানো—এসবকে আমরা প্রতিদিনের জীবনের অংশ হিসেবেই মেনে নিচ্ছি। অথচ এগুলোই ইঙ্গিত দেয় আমাদের মানসিকতার। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে তোলার বদলে আমরা যেন শিখেছি কেবল ব্যক্তিগত সুবিধাটাই আগে দেখতে।
প্রশাসন ও রাজনীতির ছবিটাও ভিন্ন নয়। আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে ‘জনগণের সেবা’ প্রায়শই কেবল একটি স্লোগান। ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় যন্ত্রে রূপ দেওয়া হয়, আর বিরোধী দলে থাকলে রাষ্ট্রকে অচল করার চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে! যে নেতারা জনগণকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন, তারাই সামান্য সর্দি-জ্বরের জন্য বিদেশে উড়াল দেন, সন্তানদের পড়ান বিদেশি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি সম্পদও গড়ে তোলেন বিদেশে!-এইগুলো এখন নিত্য সংবাদ। এইসব নিউজ নিয়মিত স্ক্রল হতে থাকে সাধারণের ঘরে ঘরে আর তখনই মানুষ হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে—এই তথাকথিত নেতাদের দেশপ্রেম কোথায়? নাকি তাদের প্রকৃত লক্ষ্য কেবল নিজেদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করা?
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ভেজাল খাবার, নকল ওষুধ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী—এসবের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষের সীমাহীন মুনাফার লোভ। তারা জানে এর ফলে মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তবু ব্যক্তিগত লাভের কাছে সব দায়বদ্ধতা গৌণ হয়ে যায়। সমাজে যেকোনো ক্ষতি তাদের কাছে অস্পষ্ট, কারণ তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ শুধু নিজের লাভক্ষতির খাতায়।
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে গভীরভাবে যেটি উপলব্ধি করি তা হলো—আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই দেশপ্রেমের বড় ঘাটতি লুকিয়ে আছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মূলত মুখস্থভিত্তিক ও পরীক্ষামুখী। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের বদলে ভালো গ্রেড ও সার্টিফিকেট পাওয়াকেই বড় লক্ষ্য মনে করে। এর ফলে তারা শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শেখে, কিন্তু সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আমি প্রায়ই দেখি, অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী স্নাতক শেষ করেই স্বপ্ন দেখে বিদেশে পাড়ি জমানোর। বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি বা স্থায়ীভাবে বসবাস করাই যেন তাদের জীবনের বড় সাফল্য। অথচ তাদের সেই মেধা ও শ্রম যদি এই দেশেই কাজে লাগত, তাহলে দেশের অর্থনীতি, গবেষণা এবং সামাজিক উন্নয়ন বহুগুণ এগিয়ে যেত। এ প্রবণতা আমাদের জন্য একধরনের ‘ব্রেইন ড্রেইন’ তৈরি করছে অনেকদিন ধরেই।
দেশের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষার আরেকটি বড় সমস্যা হলো নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব। পাঠ্যক্রমে দেশপ্রেম বা নাগরিক দায়িত্বের আলোচনা থাকলেও তা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে আমরা শিশু-কিশোরদের সমাজসেবা, নাগরিক দায়িত্ব কিংবা জনস্বার্থে কাজ করার সুযোগ খুব কমই দিই-(জাপান কিংবা ফিনল্যান্ডে নৈতিক শিক্ষা এবং দেশপ্রেম শিশুকাল থেকেই চর্চা করা হয়)। ফলে তারা পেশাজীবনে প্রবেশ করে কেবল ব্যক্তিগত উন্নতি ও আর্থিক লাভের দিকে মনোযোগী হয়।
এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা জরুরি-বিশেষ করে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অল্প বয়সেই শিশু-কিশোরদের মননে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে আমরা যদি কেবল সিলেবাস শেষ করাকে বড় সাফল্য মনে করি, তবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিন্তাশীলতা, গবেষণা-মনস্কতা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে উঠবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত প্রশ্ন করার জায়গা, মতামত প্রকাশের জায়গা এবং সৃজনশীলতার জায়গা। আর এই সার্বিক ইনক্লুসিভ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
এখানে পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও বড়। আমরা সন্তানদের বলি—ভালো চাকরি করো, ভালো বাড়ি-গাড়ি করো। কিন্তু খুব কমই বলি—ভালো নাগরিক হও, দায়িত্বশীল হও, সমাজ ও দেশের কল্যাণের কথা ভাবো। বরং প্রায়শই শোনা যায়—‘অন্যরা যাই করুক, তুমি কেবল নিজেরটা দেখো।’ এভাবেই প্রজন্ম বেড়ে ওঠে স্বার্থপরতার শিক্ষায়। এর পরিণতিতে দেশপ্রেমের জায়গায় ক্রমে গড়ে ওঠে নিছক নিজপ্রেম।
অবশ্য দিনশেষে, পুরো চিত্র এতটা অন্ধকার নয়-এখনো আমরা দেখি তরুণদের অনেকেই পরিবেশ আন্দোলনে নেমে পড়ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে কিংবা প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। এ সবই আশার আলো। তবে এই ছিটেফোঁটা আলোকে বিস্তৃত আলোর স্রোতে রূপ দিতে হলে আমাদের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
প্রকৃত দেশপ্রেম মানে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়া নয়; বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ট্রাফিক আইন মেনে চলা, কর দেওয়া, মানসম্মত পণ্য তৈরি করা, সৎভাবে দায়িত্ব পালন করা—এসবই দেশপ্রেম। শিক্ষক যদি আন্তরিকভাবে পড়ান, ব্যবসায়ী যদি ন্যায্য মান বজায় রাখেন, রাজনীতিবিদ যদি সত্যিই জনগণের স্বার্থে কাজ করেন—তাহলেই দেশপ্রেম বাস্তব রূপ পাবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এখন আত্মসমালোচনা। আমরা কি সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে প্রস্তুত, নাকি কেবল নিজেদের স্বার্থেই সব আয়োজন? নিজের ভেতরের সেই নিছক নিজপ্রেমিক মানুষটাকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশপ্রেমিক মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে উন্নয়ন হবে খণ্ডিত, টেকসই হবে না। শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষালয়গুলোই এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। শিক্ষা যদি শিশুকিশোর, তরুণদের শেখাতে পারে—দেশের স্বার্থই আসল স্বার্থ, কেবল নিজের নয়, অন্যের কল্যাণও জরুরি—তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব। একেকজন নাগরিক যদি ছোট ছোট দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তাহলে সমষ্টিগতভাবে দেশ এগোবে অনেক দূর।
তাই, আজ আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো—নিজস্বতার গণ্ডি ভেঙে দেশকে বড় করে ভাবা। দেশপ্রেম কোনো অলঙ্কার নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতা। যদি আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি, তবে আমাদের দেশকে সত্যিই একটি আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলার ঐতিহ্যে এখনো কিছু কিছু পথা বা অন্ধ নিয়ম রয়েছে যা জাহেলিয়া যুগ থেকে হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনের মাধ্যমেও এগুলো কে সহজে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারই একটি অন্ধ নিয়ম হচ্ছে- যৌতুক। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে- বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে। (বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫)।
আমাদের সমাজে কিছু মূর্খ, অশিক্ষিত (প্রকৃতপক্ষে তারা শিক্ষিত, কিন্তু কাজে কর্মে শিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে!!!) লোক রয়েছে যারা যৌতুক দেয়া এবং নেয়াকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাদের এই ধরনের অহেতুক সমর্থনের পিছনে আদৌ কোন যুক্তি আছে কি না বা থাকলে সেটা কি আমার তা জানা নেই ।
বাংলাদেশের ১৯৮০ সনের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুকের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ: যৌতুক অর্থ (ক) কোনো এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে, অথবা (খ) বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোনো সময়ে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে কোনো সম্পত্তি বা জামানত। (যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, আইন নং ০৫)।
বিয়ের সময় একটা মেয়ের যে কি পরিমাণ মানসিক কষ্ট হয় তা শুধু মেয়েরাই বোঝে। একটা মেয়ে কে তার পরিবার, সমাজ, এতদিনের গড়ে ওঠার পরিবেশ সব কিছু ছেড়ে আসতে হয়। তো যখন একটি মেয়েকে নেবার পরও তার বাবা-মা র কাছে যৌতুক চাওয়া হয় তখন পাএ পক্ষ কোন বিবেচনায় সেটা করে? তারা কি মনে করছে যে মেয়েটা ঐ ছেলেটার চেয়ে যোগ্যতায় কম, তাই অর্থ বা সম্পওি দিয়ে মেয়েটা কে ছেলেটার সমান হতে হবে? এর অর্থ কি এই নয় যে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর সেটা মাপার জন্য মেয়েটাকে অর্থ সহকারে পাল্লাতে ওঠাতে হবে । যাতে দুই পাল্লা সমান হয়!!! আবার এভাবেও ভাবা যায় মেয়েরা ছেলেদেরকে তুচ্ছ ভাবে, আর তাই তাদের কে ওরা নতুন জীবন শুরুর পূর্বেই দান করে ছোট করে রাখে। কিন্তু এভাবে কি আর কেউ ভাববে???
কত অদ্ভূত আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। আর কত নিকৃষ্ট মানুষের রুচি। যেখানে মেয়েরা মূল্যহীন। মেয়েদের কোনো কিছুর কোনো দাম নেই । পাত্র পক্ষ মনে করে তাদের ছেলেকে তারা টাকা খরচ করে বড় করেছে। আর তাই সেটা বিয়ের সময় করায় গন্ডায় উসুল করে নেবে। তো মেয়েটা কে কি তার বাবা-মা অর্থ ছাড়াই বড় করেছে? সেই টাকা কে দেবে? মেয়ে র বাবা-মায়ের কি কষ্ট হয় না নিজের মেয়েকে কষ্ট করে বড় করে অন্যের কাছে দিয়ে দিতে? নাকি সব কষ্ট শুধু ছেলেদের বেলাতেই? যারা এই ধরনের যৌতুক দাবি করে তারা যে কি পরিমাণ নিচু মানসিকতার, তা ভাবতেও ঘৃণা লাগে। সততাহীন, বিচার বুদ্ধিহীন, রুচিহীন জীবন ওদের। ইসলাম একে কখনোই সমর্থন করেনি। তো সমাজ ওদের মত ঘৃণ্যদের কে আর কত প্রশ্রয় দেবে? আইনত ব্যবস্থা থাকা সত্বেও কেন তা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না? এর উওর কোথায়???
আসুন আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। কঠোর প্রতিবাদ করি এবং সমস্বরে যৌতুক কে ‘না’ বলি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়। সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য এ সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শেষ দুটি দায়িত্ব পালনের জন্য বেশকিছুটা সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এতে বিচারে ত্রুটি থেকে যেতে পারে। বিচারকার্য যাতে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের হয়, তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। অন্যথায় এ বিচারকার্য নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকতে পারে। আর বড় ধরনের কোনো সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়াটাই যৌক্তিক। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রাথমিক কার্যক্রম সূচনা করে যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এসে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশে নানা ধরনের সমস্যা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান সমস্যা দিন দিন আরও বাড়ছে এবং গভীরতা লাভ করছে। নতুন নতুন অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল সমস্যা এসে যুক্ত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান করা বর্তমান সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় সরকার হিমশিম খাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে সরকার বিব্রত হচ্ছে। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে ঘোষিত সময় মোতাবেক আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। সরকার তার কৃত অঙ্গীকার মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা। সরকার সেই গণপ্রত্যাশা পূরণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা করেছেন, তার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তিনি আগামী নির্বাচনের পর আর কোনোভাবেই সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি বর্তমান দায়িত্ব শেষ করতে পারলেই খুশি।
মহলবিশেষ নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণকে সন্দিহান করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলার চেষ্টা করছেন যে, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। তারা নানা ধরনের কল্পকাহিনি প্রচার করছেন। সরকারের বিভিন্ন অর্গানের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি সেনাবাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
দেশের অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে গণঅধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুরের ওপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা এবং তৎপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধান উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলেন। ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রধমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা নানাভাবে বাধা দেবে। বাংলাদেশের এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা বাধা দেবে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে, যাতে নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য এ মহলটি চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তারা আরও বেশি তৎপর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে, তাহলে সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করবে। তাই এ মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
আমরা দেশের সাধারণ নাগরিকরাও অনুধাবন করতে পারছি, মহলবিশেষ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচন যতই নিকটবর্তী হবে, এদের তৎপরতা ততই জোরদার হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও তার বিপুলসংখ্যক স্থানীয় নেতাকর্মী এখনো দেশে রয়েছে। তারা পরিস্থিতির চাপে এখন হয়তো চুপ করে আছে; কিন্তু সুযোগ পেলেই ছোবল মারার জন্য চেষ্টা চালাতে পারে। বিগত সরকার তাদের সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। দলীয় সমর্থকদের অনৈতিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বশীভূত করে রাখা হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সেই সমর্থক কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। তারা বর্তমানে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতাও করছে না। এদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সুযোগ পেলেই এসব কর্মকর্তা সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা চাইলেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। বিগত সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের যদি প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাতে পারে। তাই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিগত সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখা যেতে পারে।
গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক বছর পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বরং পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেন এমনটি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে বিগত সরকারের অনুগত সদস্য রয়েছে। এরা কোনোভাবেই সরকারকে সফল হতে দিতে চাইবে না। বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই এভাবে মব সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করা যায়নি। সফল গণ-আন্দোলনের পর কেন এমন সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটবে? এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা, তা অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন। সরকারের সামান্য উদাসীনতা রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মব সন্ত্রাসের ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এর ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। দাবি আদায়ের নামে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসবে, এটি কারও কাম্য হতে পারে না। আন্দোলনের নামে কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালানো হতে পারে।
এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটতে দেওয়া যাবে না। সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। আর রাজনৈতিক দলসহ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ভেদাভেদ ভুলে জাতির এই ক্রান্তিকালে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে; যেমন ঐক্য গড়ে উঠেছিল গত বছর আন্দোলনকালে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অপরাধীদের ঐক্য দৃঢ় হয় স্বার্থের কারণে। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐক্য বিনষ্ট হয় উদাসীনতার কারণে। যারা দুর্নীতিবাজ বা নানা ধরনের অপরাধকর্মে যুক্ত, তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য গড়ে ওঠে। দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুষ্ট চক্রকে প্রতিহত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কাছে দেশ বা জাতির স্বার্থ বড় নয়। তারা স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে। বর্তমান সরকার যেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়, তাই এ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। তাই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে এ সরকারের দায়িত্ব শেষ করাই হবে যৌক্তিক।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
নির্বাচন সামনে এলে সবার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর বিষয়টি জোরেসরে উত্তাপিত হয়। অবশ্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি করে? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ও কম নয়। নিজেদের হুন্ডা ও গুন্ডা বাহিনী সামলানোর দায়িত্ব নের্তৃবৃন্দের ওপর বর্তায়। দায়িত্বশীল নেতাদের আচারণবিধি ও বহুলাংশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করার জন্য উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর ব্যাপারে দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা প্রতিনিয়ত গুরুত্ব পাচ্ছে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামী বিশাল শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বিএনপিকে ঠেকাতে ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি এবং গন অধিকার পরিষদ নিয়ে জোট বাধার প্রক্রিয়া শুরু করছে।নির্বাচনের আগে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও তৎপরতা জানান দিতে এবার রাজপথে নামছে জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং ফ্যাসিবাদের দূসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি সামনে রেখে মাঠে নামার ঘোষণার মাধ্যমে তিন দিনের কর্মসূচি এরমধ্যে এসেছে। জামায়াত রীতিমতো বিএনপিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাচ্ছে। এনসিপি ও এবি পার্টি অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পিআর দাবি থেকে কিছুটা পিছুটান হঠলেও জামায়াতের এদের নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের বিশাল বিজয়ে জামায়াতে ইসলামীর মাঝে আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়েছে। এরা এখন খুব ফুরফুরে মেজাজে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিজয়ে জামায়াতে ইসলামী এসিড টেস্ট হিসেবে দেখছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণ তাদের পাশে থাকবে বলে এই ধারণাটি তাদের মনোবল অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
তারেক জিয়া বহুপূর্ব থেকে বলে আসছে আগামী সংসদ নির্বাচন এতটা সহজ নয় খুব কঠিন পরীক্ষা হবে। দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে যাদের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন আছে বিএনপি ও বসে নেই। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যারা তাদের সহযোগী ছিল বর্তমানে এদের নিয়েই এগুতে চাচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরও আগে থেকেই আগামী সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের অঙ্গীকার করেছে। তাছাড়া রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে তারেক জিয়ার ৩১ দফা কর্মসূচি সংস্কারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে -- এ মনোভাব নিয়ে বিএনপি প্রচারণা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জনগন বিএনপির সেবা পাবে এই আত্মবিশ্বাস এদের ও কম নয়।
রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে আসছে। প্রথম ধাপে দলগুলোর সাথে আলাদাভাবে বসেছিল কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি দল ও জোট নিয়ে ২৩ দিন সংলাপ হয়। দুই ধাপের সংলাপে ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয় যার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে কমিশন। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় ঝুলে আছে জুলাই সনদে স্বাক্ষর।
নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কার্যকারিতা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। দলগুলোর বিশ্বাস -- প্রশাসনকে একটি দলের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য নির্বাচনের সময় কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব এমনকি কেন্দ্র দখলের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শ ঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভরসা করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারন নিয়ে ভাঙ্গা ও বাগের হাটে চরম অরাজকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা ভাঙ্গা থানা ও নির্বাচন অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ভয়ে স্থানীয় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। পুলিশের এমন ব্যর্থতায় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে কিভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়?
চলতি বছরের শুরুর ৫ মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১৪১টি মব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে আহত হয়েছে ২৮৯ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে তা উঠে এসেছে। পুলিশ কোথায় ছিল?
তৌহিদি জনতার ব্যানারে রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার মাজারে হামলা হয়েছে । কবর থেকে লাশ উঠিয়ে আগুন দিয়ে পুড়ানো-- সংহিতার জঘন্যতম কার্যক্রম দেশের জনগণকে দেখতে হলো। কিন্তু এ ঘটনায় পুলিশ বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখতে পারিনি। ১৮ আগস্ট কুমিল্লার হোমনায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে জনতা ৪টি মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে৷ সেখানেও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। প্রশাসন এমন দুর্বল হওয়াতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থেকে যাচ্ছে। সরকার আরো কঠোর হউক এটা ও জাতীর প্রত্যাশা।
কিন্তু মব যারা করছে এরাতো এদেশের ছাত্র জনতা ও যুব সমাজ। এরা কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ততা আছে। তা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে শঙ্কা থাকলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নির্বাচন কিভাবে হবে। তাইত বিভিন্ন দলগুলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন।
আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সবচেয়ে বেশি শষ্কা প্রকাশ করে সোচ্চার জামায়াত। এ বিষয়ে দলটি সরকারের কাছে দাবি ও জানাচ্ছে। ৬ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে জামাতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সাথে দেখা করে নির্বাচনের পূর্বে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আহবান জানান ডা: তাহের। তিনি আরও বলেন এ বিষয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চাই।’
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তা কথা জানাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও। দলটির মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খান বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সবার জন্য সমান সুযোগ, তা দেখা যাচ্ছে না।কারণ সরকার একটি পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। প্রশাসন ও মনে করছে একটি দল ক্ষমতায় যাবে। আর আমাদের ট্রাডিশন হলো - যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের পক্ষে সবাই চলে যায়। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে।
‘নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘এখনই কিসের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখন তো নির্বাচন কমিশন ভোটের মাঠেই নামেনি। তবে আমরা চাই একটি গুনগত ও মানসম্পন্ন নির্বাচন যাতে হয়, সে উদ্যেগ নেওয়া। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আশা-নিরাশায় মাঝে আছি। সরকার ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারবে।’
তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসে নি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা।আমরা সবাই এটাই চাই। আমরা আশা করি সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করার করবে। কারণ ড.ইউনূস একটি ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আর ও বলেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে যারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারাই তার কারণ ভালো বলতে পারবেন। এতে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না সেটাও প্রশ্নের বিষয়।
তবে সরকার দৃঢ়ভাবে বলেছে, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট লাখের বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবে। সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে ৮০ হাজারের বেশি। ড. ইউনূস বলেছেন আসন্ন নির্বাচনটি হবে ইতিহাস সেরা সুন্দর নির্বাচন। এ ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা অপরিহার্য। গত তিনটি নির্বাচনের জন্য দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে দেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই সম্ভব হবে বলে অনেকেরই অভিমত।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। যে কোন দলেই নির্বাচনের বেলায় পেশিশক্তির উত্থানকে নিজেদেরকে প্রতিহত করতে হবে। যারা পেশিশক্তি দেখাবে স্ব স্ব দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি । এ ব্যাপারে আমাদের ছাত্র/ যুব সমাজকে কাজে লাগানো যেতে পারে।যে ছাত্র/যুব সমাজ নিরাপদ সড়ক এর আন্দোলন ও স্বৈরাচার সরকার পতনের ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছে,এরাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন নির্বাচনের এত আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে মন্তব্য করার যুক্তি নেই। নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলে বিষয়টি সামনে আসবে। তাছাড়া এসিড টেস্ট হিসেবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গ্রহনযোগ্যভাবে হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অমনটি হবে সে আশাবাদ আমরা করতেই পারি।
লেখক : মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বাস করে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়বে। অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করছেন, এটি মূল সমস্যাকে আড়াল করার কৌশল হতে পারে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংক একীভূতকরণ আমাদের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করবে, নাকি আরও বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে?
বাংলাদেশের মতো সীমিত ভূখণ্ড ও জনবহুল একটি দেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৬২টি ব্যাংক। অনেক বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরেই এটিকে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন এক সমান হয় না, তেমনি সব ব্যাংকের পারফরম্যান্স সমানভাবে সফল হবে না, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সমস্যার জায়গা হলো, কেন কিছু ব্যাংক ধীরে ধীরে সরকারের জন্য এক বিরাট বোঝায় পরিণত হচ্ছে? সরকার তো মূলত জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়। প্রশ্ন উঠছে, যে সব ব্যাংক দক্ষতার অভাবে, দুর্বল ব্যবস্থাপনা কিংবা খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে টিকে থাকতে পারছে না, তাদের বাঁচাতে কেন সরকারকে এতো তৎপর হতে হচ্ছে? এর পেছনে মূল কারণ হলো, ব্যাংক খাতের প্রতি জনআস্থা ও আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কোনো ব্যাংক হঠাৎ ধসে পড়লে বা বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে পড়েন সাধারণ আমানতকারীরা, যাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় এক মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। আর এ দায়ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে সরকারের ওপর, বিশেষত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। তাই অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই সরকার চায় না ব্যাংক খাত নিয়ে হঠাৎ কোনো বড় ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হোক। কারণ ব্যাংকের পতন কেবল আর্থিক খাতকেই অস্থিতিশীল করে না, বরং শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগেও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক দেশেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বা নতুনভাবে গঠন করতে একীভূতকরণের পথে হেঁটেছে।
বাংলাদেশও শিগগিরই সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে পরিচালন ব্যয় কমবে, দক্ষতা বাড়বে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে। পাশাপাশি, দুর্বল ব্যাংকগুলোর কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তা মোকাবিলায়ও এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তবে প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুদৃঢ় পরিকল্পনা এবং কঠোর নিয়ন্ত্রক তদারকি অপরিহার্য। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর। আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংক খাতকে সুস্থ-সবল পথে পরিচালিত করাই হওয়া উচিত সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
একীভূতকরণের পক্ষে যুক্তি অর্থনীতিতে ‘ইকোনমিজ অব স্কেল’ নামে একটি ধারণা আছে। এর অর্থ, বড় প্রতিষ্ঠানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়, কারণ সম্পদ, প্রযুক্তি ও জনবল বেশি পরিসরে ব্যবহার করা যায়। ব্যাংক একীভূত হলে আলাদা আলাদা ভবন, শাখা, আইটি সিস্টেম ও জনবল ধরে রাখার ব্যয় কমবে। এতে কার্যক্রম আরও সাশ্রয়ী হবে। অন্য একটি বড় সুবিধা হলো গ্রাহক আস্থা। দুর্বল ব্যাংক যখন তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আমানতকারীরা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। আমাদের দেশে বারবার ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের মধ্যে ভরসা কমে গেছে। একীভূতকরণ অন্তত কিছুটা হলেও সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।
একীভূতকরণের গোপন ঝুঁকি তবে একীভূতকরণ কোনো জাদুকরী সমাধান নয়। অর্থনীতির আরেকটি বহুল আলোচিত ধারণা হলো ‘ঠু বিগ টু ফেইল এর মানে, কোনো প্রতিষ্ঠান এত বড় হয়ে গেলে তার পতন গোটা অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে যদি দুইটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা হয়, তাহলে নতুন ব্যাংকটি আরও অস্থির হতে পারে। দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি যদি থেকে যায়, তবে একীভূতকরণের পর সমস্যাগুলো আরও জটিল আকারে ফিরে আসবে। এছাড়া একীভূতকরণের সময় মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও সাংগঠনিক সংস্কৃতি একত্র করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। অনেক কর্মী পদ হারানোর আশঙ্কায় আতঙ্কিত হন, আবার এক ব্যাংকের সংস্কৃতি আরেক ব্যাংকের সঙ্গে মেলে না। ফলে নতুন ব্যাংকের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার অনুমোদিত ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিনেন্স’ এর অধীনে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যেই এই একীভূতকরণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীদের টাকা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। তবে এক্সিম ব্যাংক বলছে তাদের আর্থিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আছে, তাই তারা একীভূত হওয়ার পক্ষে নয়। তারা স্বাধীনভাবে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ মনে করেন, তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা এক্সিম ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে জোর করে যুক্ত করা ঝুঁকিপূর্ণ। এতে আমানতকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনেকে সরাসরি মত দিয়েছে- ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া ভালো, একীভূত করলেই সমস্যা মিটবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পুনর্গঠন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক এতে সহায়তা করতে পারে বলে আলোচনা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
ভারতে কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করা হয়েছিল। ভারত সরকার বলেছিলেন এতে দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘গভর্নেন্স দুর্বল হলে কেবল ব্যাংক জোড়া লাগিয়ে সমাধান আসে না।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও বড় ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর সেগুলো এত বড় হয়ে দাঁড়ায় যে সরকার বাধ্য হয় ট্যাক্সপেয়ারদের অর্থ দিয়ে তাদের বাঁচাতে। এতে নৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো জানে, ব্যর্থ হলেও সরকার উদ্ধার করবে। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সতর্ক বার্তা। শাসনব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হিসেবে একটি কথা বলেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থ। তার বিখ্যাত উক্তি হলো ‘ইনস্টিটিউশন্স ম্যাটার অর্থাৎ একটি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা শক্তিশালী, সেটাই তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের আসল নিয়ামক। অপ্রিয় হলেও সত্যি কথাটা হলো, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতার মূলেই আছে শাসনব্যবস্থার সমস্যা, রাজনৈতিক নিয়োগ, দুর্বল বোর্ড, স্বচ্ছতার অভাব এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করে একীভূতকরণ করলে সেটি কেবল বাহ্যিক রূপ বদলাবে, ভেতরের দুর্বলতা অটুটই থাকবে।
গবেষকদের ধারণা, ব্যাংক একীভূতকরণকে কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র দুর্বল ব্যাংক নয়, বরং একে অপরকে পরিপূরক ব্যাংককে একত্র করতে হবে। একীভূত হওয়ার আগে দুর্বল ঋণ আলাদা করে বিশেষ পুনরুদ্ধার সংস্থার কাছে দিতে হবে। কোন ব্যাংক কেন একীভূত হচ্ছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দূর করতে ন্যায্য সুযোগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা ছাড়া একীভূতকরণ শুধু কাগুজে সমাধান হবে। তাই বাংলাদেশের ব্যাংক একীভূতকরণ পরিকল্পনা একই সঙ্গে সুযোগ ও ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে সুচিন্তিত ও স্বচ্ছভাবে একীভূত করলে এটি আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে, তবে জোরপূর্বক বা রাজনৈতিক প্রভাবে হলে বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সংখ্যায় কম নয়, মানে ভালো ব্যাংক তৈরি করা, যেখানে আমানতকারী সততা, পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। আমাদের প্রয়োজন কম ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংক। যেখানে জনগণের টাকাই হবে আসল নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
লেখক ‘ডিজিটাল গভার্নেন্স ইন দ্য ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর’ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল. ডিগ্রিধারী এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), মিরপুর-২, ঢাকার মহাপরিচালকের সচিবালয়ের ফ্যাকাল্টি রিলেশনশিপ উইং-এ মূল্যায়ন ও ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
‘শিক্ষা’ এই শব্দটির মাঝে রয়েছে একটি জাতির ভিত্তি গড়ার শক্তি। যুগে যুগে শিক্ষা বদলেছে, বদলেছে তার পদ্ধতি, কিন্তু শিক্ষা অর্জনের মৌলিক উদ্দেশ্য কখনও বদলায়নি মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলা। মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী, আর সেই কৌতূহলের পথ ধরে সে খুঁজে পায় জ্ঞান। শিক্ষা হল সেই আলো, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। যুগে যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে নানা পরিবর্তন। গুহাচিত্রে শেখা থেকে শুরু করে প্রাচীন গুরুকুল, পাঠশালা, আধুনিক বিদ্যালয় ও আজকের ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষ সবকিছুই সময়ের দাবিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন, এবং গ্লোবাল কানেকটিভিটির প্রভাবে শিক্ষা একটি নতুন রূপ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? ২১শ শতাব্দীতে এসে আমরা এক পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে প্রযুক্তি, তথ্য, ও নতুন চিন্তাধারার প্রভাবে বদলে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা। তাই এখনই সময়, আমরা ভাবি: আগামী দিনে শিক্ষার চেহারা কেমন হবে?
আগামী দিনের শিক্ষা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতা-ভিত্তিক এবং আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমাদের চিন্তা করার ধরন, শেখার প্রক্রিয়া, এমনকি শেখার জায়গাটাও বদলে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা আর শুধু বই আর খাতা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয় এখন শিক্ষার হাতিয়ার হলো ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগের দিনে শিক্ষক ছিলেন মূল জ্ঞানদাতা, আর ছাত্র ছিল শ্রোতা; কিন্তু ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হবেন একজন গাইড, আর শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে নিজের শেখার প্রধান চালক।
প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা, তাদের শেখার ধরনও ভিন্ন। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা একেকজনের সক্ষমতা ও আগ্রহ অনুযায়ী আলাদা পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করবে। কেউ যদি চিত্রকলায় ভালো হয়, তবে সে হয়তো তার পাঠের বড় একটা অংশ সেই শিল্পভিত্তিক দক্ষতায় ব্যয় করবে।
আগে যেখানে পুরো শ্রেণিকক্ষে একটাই পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো, এখনকার ও আগামী দিনের শিক্ষা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন, গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী তাদের জন্য আলাদা কনটেন্ট ও মেথড থাকবে।
এভাবে শেখা হবে স্বাধীন, উদ্দীপনামূলক ও দারুণ কার্যকর। আগামী ২০ বছরে এমন অনেক পেশা চলে যাবে, যা আজ রয়েছে। আবার এমন অনেক পেশার জন্ম হবে, যার কথা আমরা এখনো জানি না। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে শুধু তথ্য মুখস্থ করানো নয়, বরং বাস্তব জীবনে টিকে থাকার উপযোগী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া।
বর্তমানের পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে চাপ ও প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ননির্ভর, যেখানে শিক্ষার্থীর মৌলিক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, দলগত কাজের ক্ষমতা প্রাধান্য পাবে।
শুধু দক্ষতা নয়, ভবিষ্যতের সমাজে প্রয়োজন হবে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি। প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই হোক, যদি মানুষ মানবতা ভুলে যায়, তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই শিক্ষা হবে এমন, যেখানে শেখানো হবে—
বাংলাদেশেও শিক্ষার এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে। নতুন কারিকুলামে দক্ষতা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট স্কুল উদ্যোগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে, এখানেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
এসব মোকাবিলা করে আমরা যদি প্রযুক্তি ও মানবিকতাকে একত্রিত করে শিক্ষার পথকে রচনা করতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ সত্যিই হবে আশাজাগানিয়া। শিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই। এটি হবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, মানবিক মূল্যবোধনির্ভর, দক্ষতা ও স্বাধীনচেতা মননের উৎস। পরিবর্তনের এই ঢেউ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত শিক্ষার এই পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পথ তৈরি করা, যেখানে তারা কেবল ভালো পরীক্ষার্থী নয় ভালো মানুষ, দক্ষ পেশাজীবী ও সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
শেষ কথায়
বিখ্যাত দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন
‘If we teach today’s students as we taught yesterday’s, we rob them of tomorrow.’
তাই আজকের শিক্ষা হতে হবে আগামীর জন্য। শিক্ষা যেন হয়ে ওঠে জীবনের জন্য শিক্ষা শুধু পাস করার জন্য নয়।
লেখক: প্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট
মন্তব্য