× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য শিল্প ইভেন্ট উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট কী-কেন স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও যৌনতা-প্রজনন মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য উদ্ভাবন প্রবাসী আফ্রিকা ক্রিকেট শারীরিক স্বাস্থ্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়া সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ ইউরোপ ব্লকচেইন ভাষান্তর অন্যান্য ফুটবল অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

মতামত
In the special interview Dr Rashid Ahmed Hossain is expected to nominate BNP in Comilla 1 Laksam Manoharganj seat
google_news print-icon

বিশেষ সাক্ষাৎকারে যা বললেন- কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী

বিশেষ-সাক্ষাৎকারে-যা-বললেন--কুমিল্লা-৯-লাকসাম-মনোহরগঞ্জ-আসনে-বিএনপির-মনোনয়ন-প্রত্যাশী-ড-রশিদ-আহমেদ-হোসাইনী-

আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আর প্রতিষ্ঠানটি একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে প্রস্তুত করছে নির্বাচনী রোডম্যাপ।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরের মধ্যে মূল প্রস্তুতির কাজ সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কার, আচরণবিধিমালা জারি, ভোটার তালিকাসহ সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে। আর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ছোট-খাট সহ অন্তত ৪৪টি সংস্কার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যা শীঘ্রই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে ইসি।

এদিকে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা বাংলাদেশের মত কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক সদস্য এবং নেক্সাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিল্পপতি, আনছারিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বিজিএমইএ ফোরামের মহাসচিব ও বিজিএমইএ পরিচালক -- ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী দীর্ঘদিন ধরে মাঠে আছেন দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার কাজে। তবে গ্রুপিং দ্বন্দ্বে দিশেহারা লাকসাম-মনোহরগঞ্জের তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে আশার আলো জুগিয়েছেন দুর্দিনে দলের হাল ধরা নেতা ড. হোসাইনী।

সাবেক ডাকসু সদস্য ও যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী নিউজবাংলা২৪.কমকে একান্ত স্বাক্ষাৎকারে এলাকার উন্নয়নে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানান।

ড. হোসাইনী বলেন, আমার এলাকার শিক্ষিত,আধা শিক্ষিত এবং সব শ্রেণীর মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আর সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি এলাকায় গেলে, আমার কোন সিকিউরিটি লাগে না, আমার কোন বডিগার্ড লাগে না। আমার কাছে সাধারণ মানুষরা খুব সহজেই কাছে আসতে পারে। আর আমি এলাকার মানুষকে বেশি ভালোবাসায় তারা সহজেই আমাকে গ্রহন করে। আমি ছাত্রদল-যুবদল করে আজ বিএনপিতে এসেছি। আমি বিএনপিতে সংস্কার, আবিস্কার ও বহিষ্কার নই। আমি কখনও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। আমি যেদিন থেকে পয়সা কামানো শুরু করেছি ওই দিন থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।

অতীত আর বর্তমান নিয়ে বিএনপির এই নেতা প্রসঙ্গ ক্রমে বলেন, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কথা বলা হয়েছে। এখন যে প্রেক্ষাপট এসেছে আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি হলেও পক্ষান্তরে মানুষ কিন্তু আরও বেশি। যার কারণে প্রশাসনিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে অনেকগুলি থানা, জেলা এমনকি বিভাগও বাড়িয়েছে। এর অংশ হিসেবে লালমাই (লাকসাম) থানা হয়েছে।

যখন ১৯৯৮ সালে আমি বৃহত্তর লাকসাম-এর যুবদলের আহ্বায়ক ছিলাম, তখন লালমাই আমাদের ছিল। আজকে যারা বিএনপি করে, তারা আমার হাতেই সৃষ্টি। আমি তখন যাদের সাথে বিএনপি করেছি তাদের মধ্যে আকতার ভাই,অলিউল্লাহ,সোলায়ইমান চেয়ারম্যান সহ অনেকে এখন নাই। আর লাকসাম যারা রাজনীতি করে তার মধ্যে বহুল আলোচিত শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আবুল কালাম (চৈতী কালাম) আমরা একই ইউনিয়নের। তিনি ২০০১ সালে বিএনপিতে পদার্পণ করে। এটা উনার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে উনি সদা বলেন।

১৯৯৬ সালে বিএনপি পরাজিত হবার পর ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে লাকসামে কথা বলার লোক ছিল না।

১৯৯১ সালে আলমগীর সাহেব এমপি হওয়ার পরেও দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হন।উনি সাংগঠনিকভাবে তেমন তুখোর কোনো রাজনীতিবিদও ছিলেন না।

এ টি এম আলমগীর সাহেব এর আগে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ১৯৯১ সালে নমিনেশন দেওয়ার পর থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। তিনি বিএনপির কর্মী বা নেতা হিসেবে নমিনেশন নেয়নি। উনি তখন চাকরি করতেন । নমিনেশন কনফার্ম করার পরে চাকরি ছেড়ে দেন। দলের নেতাকর্মীদের সাথে তার সে সময় তেমন যোগাযোগ না থাকার কারণে সুসংগঠিত করতে পারেননি, যার ফলে লাকসামে নেতাকর্মী দের মাঝে একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল।আর বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাস করতে পারেনি।উপ নির্বাচন করে পাস করতে হয়েছে।

বিএনপি নেতা ড. হোসাইনী আরো বলেন, পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনে মোকসেদ আলী সাহেব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিএনপি নেতারা তার সাথে চলে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে বিএনপি’র হাল ধরার লোক ছিল না।তখন বৃহত্তর লাকসাম উপজেলার বিএনপির সভাপতি প্রয়াত নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবু নাসের ভূঁইয়া,আমি, নুরুন্নবী চৌধুরী (ছাত্রদলের দায়িত্বে ছিল), সার্বিক দায়িত্বে আরও ছিলেন সাবেক এমপি রাশেদা বেগম হীরা,কাজী আবুল বাশার (শিল্প ব্যাংক কর্মকর্তা-করমচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক), গিয়াসউদ্দিন কালু(আদমজী জুট মিলের সিবিএ, সাধারণ সম্পাদক), এ,কে,এম আতিকুর রহমান লিটন (বৃহত্তর লাকসাম উপজেলা বিএনপি সদস্য)।

আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। তৎকালীন জননেতা মির্জা আব্বাস যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জননেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র।তখন আমরা কুমিল্লার অবিসংবাদিত নেত্রী রাবেয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর ভাই,শাহ মোহাম্মদ সেলিম সবাই মিলে লাকসাম বিএনপি সুসংগঠিত করতে নানান ভাবে চেষ্টা করেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে এক করতে পারছিলাম না। এবং আমরা কাকে দিয়ে দল গোছাবো এর জন্য উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই সময়ে আমাকে যুবদলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন কেন্দ্রীয় নেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্রসহ সিনিয়র নেতাদের কথা অনুযায়ী আমি বৃহত্তর লাকসামের যুবদলের দায়িত্ব নেই। আর আমি ছাত্রদল যুবদল করার পরেই কিন্তু ওই সময় বিএনপি শুরু করি।

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হোসাইনী বলেন, আমার রাজনীতির জন্ম ১৯৮৬ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির মাধ্যমে। আমি ১৯৯০ সালে নির্বাচিত ডাকসুর মেম্বার ছিলাম। ১৯৮৬ সালে সর্বকনিষ্ঠ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলাম। ১৯৯৪ সালে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। পরবর্তীতে দাদা গয়েশ্বর সভাপতি থাকাকালীন সময়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয় সম্পাদক ছিলাম। এরপরে আমি ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করি। আর তখন প্রথম ২০০৭ সালে নির্বাচিত বিজিএমইএর পরিচালক হয়েছি। এবং সে সময়েই কুমিল্লা জেলা বিএনপি কমিটির আমি সদস্য ছিলাম। সামনে পূর্নাঙ্গ কমিটি আসছে, দলের স্বার্থে আশা করি তারা অবশ্যই আমাকে রাখবে হয়তো। তাই সবার উদ্দেশ্যে বলবো দলের জন্য আমাদের ত্যাগ, দলের জন্য শ্রম, দলের জন্য আমার কমিটমেন্ট যেমন ছিল, তেমনি আছে এবং ভর্বিষৎতেও থাকবে। মনে রাখতে হবে সবার আগে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের নির্বাচন প্রেক্ষাপট নিয়ে ড. হোসাইনী বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারুণ্যের যে চাহিদা বিশেষ করে আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব, উনি যে ভাবে মর্যাদাপূর্ণ দেশ গড়ার লক্ষ্যে ৩১ দফা দিয়েছেন এটা দেশ গড়ার জন্য তরুণদের কাজে আসবে। একটা কথা আছে,এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। সোনার বাংলা গড়তে হলে যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।

হোসাইনী আরো বলেন, যারা সত্যিকার অর্থে এই দলের একনিষ্ঠ কর্মী, যারা ছাত্রদল করেছে, যারা যুবদল করেছে, যাদের ছাত্রদল, যুবদলের ট্যাগ রয়েছে, যারা দুঃসময়ে দল থেকে সরে যায়নি, যাদের ক্লিন ইমেজ, যাদের চরিত্রে দোষ খুঁজে পাবেন না, শিক্ষিত এবং যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, মাদকাসক্ত নয়,যাদের রাজনীতি করার ক্যাপাসিটি আছে,গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদেরকে তারেক রহমান মূল্যায়ন করবে এটা আমার বিশ্বাস। আমার প্রত্যাশা,দল যদি ভালো মনে করে আমাকে নমিনেশন দেয় আমি দল ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করব। আর যদি দল মনে করে আমার চেয়ে ভালো কেউ আছে,তাহলে আমি মাথা পেতে নেব। এক কথায় দলের সাথে আমি কোনদিন বিরোধিতা করি নাই আর কোন দিন করবো ও না। সামনে নির্বাচন, আমি চাই সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে খুঁজে পাক।

দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গ নিয়ে ড. হোসাইনী বলেন, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম তখনও আমরা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারিনি। আমরা ৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান করেছি স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে, তখনও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি, যার কারণে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছে যেটা ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট যেটাই বলি না কেন। আমি আশা করি, যারা শহীদ হয়েছে, রক্ত দিয়েছে সেই শহীদদের রক্তের সাথে কেউ বেইমানি করবেন না।

হোসাইনী আরো বলেন,একটা সত্যিকার চাঁদাবাজ মুক্ত,মাদকমুক্ত,সামাজিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, দুর্নীতিমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় কমিটমেন্ট ও তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ ও দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবো অনন্য উচ্চতায়।

তিনি বলেন, কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) বা লালমাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে নির্বাচন করার জন্য আমি প্রস্তুত আছি। আমি বাংলাদেশের কোন আসনেই ভয় পাই না। আমি মনে করি সারা বাংলাদেশ আমাদের, আমাদের প্রতীক একটাই “ধানের শীষ” আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ, আমার নেতা তারেক রহমান। আমাদের আদর্শ ৩১ দফা। তারেক রহমানের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এবং ধানের শীষের বিজয় হবে ইনশাল্লাহ।

এলাকার জনগণের উদ্দেশে ড. হোসাইনী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে চাই; তারা এখন পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নাই। তারা সবাই প্রতিবাদ মুখর। একসাথে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বো, আমরা কোন চাঁদাবাজ, দখলবাজ মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তকে প্রশ্রয় দিবো না এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাব।যারা এই অপকর্ম করবে আপনারা সাংবাদিকগন স্থানীয় জনগণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে সত্য প্রকাশ করুন। ইনশাল্লাহ সুদিন আমাদের আসবেই।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোঃ সোহেল রানা- প্রতিবেদকঃ নিউজবাংলা২৪.কম

মন্তব্য

আরও পড়ুন

মতামত
AI policy formulation in Bangladesh Higher Education Demand of time

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এআই নীতি প্রণয়ন: সময়ের দাবি

প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এআই নীতি প্রণয়ন: সময়ের দাবি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা এআই) হলো বর্তমান বিশ্বের এক অনন্য প্রযুক্তিগত বিপ্লব। এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সৃজনশীলতার অনুকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এর ব্যাপ্তি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে, শিল্প, স্বাস্থ্য, ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও গবেষণার মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রেও এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এআই টুলস যেমন ChatGPT, Gemini, Claude, GitHub Copilot, Grammarly, MidJourney কিংবা DALL•E ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে এগুলো জ্ঞান আহরণ, তথ্য বিশ্লেষণ, গবেষণা ও সৃজনশীলতাকে সহজতর করছে; অন্যদিকে একাডেমিক সততা, মৌলিকতা এবং গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্নও তুলছে। তাই এআই ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষা ও গবেষণায় এআই টুলসের বিস্তার:

বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এআই ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা সহজেই এআই টুলস ব্যবহার করে লেকচার নোট তৈরি, প্রবন্ধ রচনা, অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান কিংবা থিসিসের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করছে। গবেষণায় তারা লিটারেচার রিভিউ, ডেটা অ্যানালাইসিস, পরিসংখ্যান মডেল তৈরি এমনকি জটিল গ্রাফ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরিতেও এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে। শিক্ষকরাও এআই ব্যবহার করছেন পাঠ পরিকল্পনা, গবেষণার প্রাথমিক ধারণা বা নতুন লেকচার সামগ্রী তৈরি করতে। যেমন একজন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র যখন কোড লেখায় সমস্যায় পড়ে, তখন GitHub Copilot তাকে নির্দিষ্ট সমাধান বা বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তাব করতে পারে। একজন গবেষক যখন শতাধিক প্রবন্ধের রিভিউ করতে চান, তখন ChatGPT বা Elicit দ্রুত সেই কাজকে সারসংক্ষেপ আকারে উপস্থাপন করতে পারে। অন্যদিকে একজন শিক্ষক জটিল কোনো অ্যালগরিদম শেখানোর আগে MidJourney বা DALL•E ব্যবহার করে চিত্র তৈরি করতে পারেন, যা শিক্ষার্থীদের বোঝা সহজ করবে।

তবে এই সুযোগের পাশাপাশি সমস্যা হলো—শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা চিন্তা না করে সরাসরি এআই-সৃষ্ট কন্টেন্ট জমা দিচ্ছে। ফলাফল হলো, তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে এআই-সৃষ্ট লেখা ব্যবহার করলে তা নকল বা একাডেমিক অসততার মধ্যে পড়ে। এই দ্বৈত বাস্তবতাই নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছে।

উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা ও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট:

বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহারের নীতি নির্ধারণে পদক্ষেপ নিয়েছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পরীক্ষায় এআই ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অ্যাসাইনমেন্ট বা গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমায় অনুমোদিত। এমআইটি গবেষণাপত্র বা প্রকল্পে এআই ব্যবহার করলে তা স্পষ্টভাবে ডিক্লেয়ার করার বিধান চালু করেছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক সততা বজায় রাখতে ঘোষণা দিয়েছে যে, এআই ব্যবহারের তথ্য গোপন করা এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এআই-কে শিক্ষার সহায়ক টুল (Assistive Tool) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে প্লেজারিজম ও একাডেমিক অসততার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। প্রথমত, এআই-কে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, স্পষ্ট নিয়ম ছাড়া এআই ব্যবহার করলে একাডেমিক মান ভেঙে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষক—তিন পক্ষকেই সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নীতি প্রণয়ন করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় এআই ব্যবহারের ধারা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও এর বিস্তার দ্রুত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহার করে নোট তৈরি, অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস লিখছে। গবেষকরা ডেটা প্রসেসিং বা লিটারেচার রিভিউতে এর সহায়তা নিচ্ছেন। তবে এই ব্যবহার এখনো নিয়ন্ত্রিত নয়, যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার প্রতি অনীহা এবং নকলের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো ডিজিটাল বিভাজন। সব শিক্ষার্থী সমানভাবে প্রযুক্তিতে দক্ষ নয়। যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী, তারা সহজেই এআই ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ বা প্রযুক্তি-অপরিচিত শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। এই বাস্তবতায় এআই নীতিমালা শুধু একাডেমিক সততা রক্ষার জন্য নয়, বরং সমতা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি হয়ে উঠেছে।

এআই নীতিমালা কেন জরুরি:

নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহার একাধিক সমস্যা তৈরি করবে। প্রথমত, একাডেমিক সততা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি শিক্ষার্থীরা পুরো অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস এআই দিয়ে লিখে জমা দেয়, তবে তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের কোনো সুযোগ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এআই ভুল তথ্য বা কল্পিত রেফারেন্স দিতে পারে (hallucinations), যা যাচাই ছাড়া ব্যবহার করলে গবেষণা আনরিল্যাইবেল হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষকরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্ত হবেন, কারণ কোনটা শিক্ষার্থীর নিজের অবদান আর কোনটা এআই-এর তৈরি—তা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হবে। শিক্ষকেরা ভাববেন শিক্ষার্থীর কাজ আসলে তার নিজের নয়, আবার শিক্ষার্থীরা মনে করতে পারে শিক্ষক অযথা সন্দেহ করছেন। এভাবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই এক ধরনের অনাস্থা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাবে।

আমাদের দেশের জন্য প্রস্তাবিত নীতি:

আমি মনে করি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখনই একটি সুসংগঠিত ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই নীতিমালায় প্রথমত স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যে কোনো কাজেই এআই ব্যবহার করলে তা উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, থিসিস বা গবেষণাপত্রে আলাদা সেকশনে ‘এআই ব্যবহারের ধরন’ (Usages Type) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ‘ব্যবহারের সীমারেখা’ (limit) নির্ধারণ করতে হবে। যেকোনো পরীক্ষায় এআই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে, পরীক্ষার হলে যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইস নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র। অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টে সীমিত ব্যবহার অনুমোদিত হতে পারে, তবে ব্যবহারের ধরন ও প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে জমা দিতে হবে। গবেষণায় এআই ডেটা বিশ্লেষণ, লিটারেচার সারসংক্ষেপ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মৌলিক গবেষণার যুক্তি বা ফলাফল তৈরিতে এর ওপর নির্ভর করা যাবে না।

তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য পাশাপাশি গাইডলাইন থাকতে হবে। প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে এমনভাবে যাতে সরাসরি এআই দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না হয়। এজন্য হাইয়ার থিঙ্কিং ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রশ্ন করার উপর জোর দিতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়াভিত্তিক (Process based) করতে হবে—চূড়ান্ত ফলাফলের পাশাপাশি কাজের ধাপগুলো জমা দিতে হবে। পাঠদানে শিক্ষকরা এআই-কে সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, যেমন জটিল বিষয় ব্যাখ্যায় ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি করা।

চতুর্থত, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করতে হবে। এতে তারা এআই-এর সীমাবদ্ধতা, নৈতিকতা ও কার্যকর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাবেন।

সবশেষে, বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বদলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য। এতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে এআই ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য বজায় থাকবে।

এটা সত্য যে,- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় এর ব্যবহার একদিকে যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিচ্ছে। সঠিক নীতিমালা ছাড়া এই প্রযুক্তি একাডেমিক সততা ও মৌলিকতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে, আবার সঠিকভাবে ব্যবহার করলে শিক্ষার মান, গবেষণার গতি এবং সৃজনশীলতা বহুগুণে বাড়াতে পারে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখনই জরুরি একটি সুস্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং গবেষক—সবার দায়িত্ব, অধিকার ও সীমারেখা নির্ধারিত থাকবে।

লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য

মতামত
Pesticides challenge the production of safe food

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, চ্যালেঞ্জ কীটনাশক

সমীরণ বিশ্বাস
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, চ্যালেঞ্জ কীটনাশক

বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা শুধু পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর সাথে জড়িত রয়েছে খাদ্যের মান, পুষ্টিগুণ এবং নিরাপত্তা। বাংলাদেশসহ অনেক কৃষিনির্ভর দেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং ফসলকে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কৃষকরা অতিরিক্তভাবে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার একদিকে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, অন্যদিকে পানির উৎস দূষিত করছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যে, দীর্ঘমেয়াদে এসব রাসায়নিক খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ, স্নায়ুবিক সমস্যা এমনকি প্রজনন জটিলতা তৈরি করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারার অন্যতম কারণও হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য মান বজায় রাখতে ব্যর্থতা। যদিও সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ-GAP’ বা উত্তম কৃষি চর্চা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জৈব সার ও বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারের দিকে জোর দিচ্ছে, তবে বাস্তব প্রয়োগে এখনও বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পথে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এখন জরুরি প্রয়োজন।

কীটনাশকের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশে কীটনাশকের ব্যবহার, ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশেষ করে পোকামাকড় ও রোগবালাই ফসল উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যা মোকাবিলায় দেশে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। সে সময় ‘বোকার ফসল পোকায় খায়’ স্লোগানকে সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় কর্তা ব্যক্তিরা কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রথমদিকে সীমিত আকারে কীটনাশক ব্যবহার করা হলেও, ধীরে ধীরে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে মোট কীটনাশক ব্যবহার ছিল মাত্র ৪ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃষকদের ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে। এর ফলে ফসল উৎপাদনে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেলেও, অযাচিত ব্যবহার বাড়তে থাকে। এরপর থেকে কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত ৫০ বছরের মধ্যে ব্যবহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে (২০২২ সালে) দেশে কীটনাশকের ব্যবহার প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের তুলনায় এটি দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি কেবল উৎপাদনের চাহিদা পূরণের কারণে নয়, বরং কৃষকদের সচেতনতার অভাব, বিকল্প প্রযুক্তির স্বল্পতা এবং কোম্পানির প্রচারণার ফলেও ঘটেছে।

অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের প্রভাব এখন ভয়াবহ আকারে দেখা যাচ্ছে। একদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে নদী-খাল-জলাশয়ে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ মিশে পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। মাছ, পাখি ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব কীটনাশক মানুষের খাদ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে খাদ্য উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে, অন্যদিকে কীটনাশকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন জৈব বা বায়োপেস্টিসাইডের ব্যবহার বৃদ্ধি, সমন্বিত বালাই দমন (IPM) পদ্ধতির প্রসার এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি। একই সঙ্গে সরকারের নীতিগত সহায়তা ও গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, ১৯৫৩ সালে শুরু হওয়া কীটনাশক ব্যবহারের যাত্রা আজ আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সাথে এখন সময় এসেছে নিরাপদ খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার।

কীটনাশকে পোকা নিয়ন্ত্রণ ও মানব ঝুকি:

কীটনাশক আধুনিক কৃষিতে পোকামাকড় দমন এবং ফসল রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এর অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান শ্বাসনালী, চামড়া এবং খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, লিভার ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত কৃষকদের প্রায় ৬৪% নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করার কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন। খোলা মাঠে কীটনাশক ব্যবহারের সময় কৃষকরা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী যেমন মাস্ক, গ্লাভস বা বিশেষ পোশাক ব্যবহার করেন না। ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক সরাসরি তাদের শরীরে প্রবেশ করে। একইসঙ্গে কীটনাশক অবশিষ্টাংশ খাদ্যে থেকে গিয়ে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। শিশু ও গর্ভবতী নারীরা এসব ঝুঁকিতে বেশি ভোগেন। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আজ ঘরে ঘরে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে। কৃষকরা ফসল রক্ষার জন্য অযাচিতভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করেন, কিন্তু এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকার ফলেই আক্রান্ত হচ্ছেন। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এ খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। তবে আশার কথা হলো, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে দেশ। ইতোমধ্যে দেশে ১১০টি নিবন্ধিত বায়ো পেস্টিসাইড বা জৈব কীটনাশক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ। পাশাপাশি সরকার সচেতন পদক্ষেপ হিসেবে ৪০টি ক্ষতিকর কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে। এসব উদ্যোগ টেকসই কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এখনো সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজারে জৈব কীটনাশকের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। রাসায়নিকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে বায়ো পেস্টিসাইড ও সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (IPM) বাড়ানো গেলে কৃষি হবে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে জৈব ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ এবং কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান CABI এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সালেহ আহমেদ বলেন; কীটনাশকের ব্যবহার সীমিত করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর জন্য নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

সাংবাদিকদের ভূমিকা:

কীটনাশক ব্যবহার কমানো এবং সতর্কতায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে তারা সঠিক তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেন। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব যেমন ক্যান্সার, পরিবেশ দূষণ ও মাটির উর্বরতা হ্রাস, এসব বিষয় সংবাদ প্রতিবেদন, টক শো কিংবা ফিচার আকারে প্রচার করলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সাংবাদিকরা কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতামত, জৈব ও বায়ো কীটনাশকের সুবিধা এবং কীভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব সে বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন। এভাবে গণমাধ্যম কৃষকদের বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে কীটনাশক বিক্রেতা ও কোম্পানিগুলোর অনিয়ম বা অবৈধ ব্যবসা উন্মোচন করাও সাংবাদিকদের দায়িত্বের অংশ। এতে সরকার নীতিনির্ধারণে আরও সতর্ক হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সাংবাদিকদের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজে আস্থা তৈরি করে। তারা শুধু সমস্যার চিত্র নয়, সমাধানের পথও দেখাতে পারেন। সঠিক তথ্য প্রচার এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলে কৃষকরা সচেতন হবে, জনগণ নিরাপদ খাদ্যের দাবি তুলবে এবং সরকার নীতি সংস্কারে উদ্যোগী হবে। ফলে কীটনাশক ব্যবহারের ঝুঁকি কমে যাবে এবং একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠবে।

কীটনাশকের ভয়াবহতা আজ দেশের কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুতর হুমকি। মাত্রাতিরিক্ত ও অযাচিত কীটনাশক ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, পানির উৎসকে দূষিত করছে এবং মানুষের শরীরে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠছে। এই ভয়াবহ বাস্তবতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। তারা সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে কৃষক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করছেন। সাংবাদিকরা শুধু সমস্যার দিকটি তুলে ধরেননি, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে জৈব বা বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহারের উপকারিতাও প্রচার করেছেন। এছাড়া সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কীটনাশকের তথ্য, ভেজাল ব্যবসায়ীদের অনিয়ম এবং কৃষকদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ফলে অনেক কৃষক এখন সচেতন হচ্ছেন এবং কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। বলা যায়, সাংবাদিকদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই কীটনাশকের ভয়াবহতা নিয়ে সামাজিক আলোচনা এবং সচেতনতা কার্যকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মূল বাধা হলো কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। যতদিন না পর্যন্ত কৃষকরা বিকল্প পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকবেন, ততদিন পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন কৃষকদের সচেতন করা, যাতে তারা বুঝতে পারেন কীটনাশক কেবল ফসলের ক্ষতি ঠেকায় না, বরং মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে। সমাধান হিসেবে জৈব সার, জৈব কীটনাশক এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি, কৃষি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। সরকারকে কঠোরভাবে কীটনাশকের বাজার নিয়ন্ত্রণ, মান যাচাই এবং ভর্তুকির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে নিরাপদ খাদ্য শংসাপত্রের ব্যবস্থা বাড়ানো অপরিহার্য। অবশেষে বলা যায়, কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়, এটি স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষার সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ‘বেশি উৎপাদন নয়, নিরাপদ উৎপাদন’ এটাই হওয়া উচিত কৃষির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। কীটনাশক কমিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিলে কৃষক, ভোক্তা এবং দেশের অর্থনীতি সবাই উপকৃত হবে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।

মন্তব্য

মতামত
The thirteenth parliamentary elections will be festive

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে উৎসবমুখর

আমিন রায়হান
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে উৎসবমুখর

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের এ সময় ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার, নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ইতোমধ্যে জনসমক্ষে এসেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন কেবল জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি জনগণের মতামত প্রকাশ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের একটি মৌলিক অধিকার। তাই নির্বাচন যতটা স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে, দেশের গণতন্ত্র ততটাই সুসংহত হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেন কোনো ধরনের সহিংসতা বা অনিয়মের ঘটনা না ঘটে। সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিও দেশের জনগণের মাঝে একটি আস্থার এবং ভরসার পরিবেশ তৈরি করেছে। অতীতে দেখা গেছে, সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলে ভোটাররা নিরাপদ বোধ করেন এবং নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এবার সশস্ত্র বাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মত ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।

অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, প্রার্থীদের মনোনয়ন যাচাইসহ নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে আরো কার্যকর ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা হবে এই আশা সবার।

তবে নির্বাচনকে সফল করার জন্য কেবল সরকারি প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন যেন প্রতিযোগিতামূলক হয়, সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। নির্বাচন কমিশনকেও হতে হবে দৃঢ়, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে যাচ্ছে। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরো মজবুত করবে এবং জনগণের আস্থাও ফিরে আসবে।

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু করেছে। রাজধানী থেকে তৃণমূলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠ গোছানো শুরু হয়েছে। ইসি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করেছে। সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। ইসি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ চলমান রেখেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সরকারের পটপরিবর্তন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সদা তৎপর। ম্যাজিস্ট্র্যাসি ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সেনাবাহিনী। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচন। ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার কৌশল ঠিক করার কাজ শুরু করেছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। তবে জুলাই সনদ, বিচার এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি বলেও দাবি করছেন অনেকে। আগামী রোজার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে ইসি। এ ছাড়া সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।

অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নেতারা বলেছেন, ইতোমধ্যে দেশের মানুষ এবং তাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনমুখী হয়েছেন। নির্বাচনের আগে সংস্কার ও ছাত্র জনতার হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সরকার কতটা করে, সেদিকেও নজর রাখার কথা বলছে তারা। এছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে এই দলগুলো।

নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কিন্তু এ সংশয় নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার পর কাটচে। তফসিল ঘোষণা হলে দেশ নির্বাচনী উৎসবে মাতবে। এতে করে সব ধরনের অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা কেটে যাবে। আশার কথা, অভিযোগ আর সংশয় ছাপিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি সারছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, দাবি আদায়ের চেষ্টা আর ভোটের মাঠের প্রস্তুতি চলবে পাশাপাশি।

জুলাই ঘোষণাপত্র কিংবা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে আপত্তি নেই বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল বিএনপির। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলেও অভিহিত করেছে দলটি। তাদের দাবি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে যাবে। এরই মধ্যে নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতিও শুরু করেছে দলটি। ভোটের মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে বৈঠক করেছে বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব। ভোটের মাস-তারিখ নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও জুলাই ঘোষণাপত্র এবং সংস্কার নিয়ে কিছু আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সংস্কার প্রক্রিয়ার আইনগত ভিত্তি নিয়ে সংশয়ে জামায়াতে ইসলামী। আর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও বিভিন্ন দাবিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও চালাতে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি দল। তারা বলছে, দ্রুত আইনগত বিষয়টি নিশ্চিত করে, এই সংস্কারের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। এছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের আরো বেশি কিছু করার রয়েছে বলেও মনে করে দলটি। সংস্কার ও বিচার নিয়ে দাবিদাওয়া থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেভাগেই শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। তিনশ আসনে প্রার্থী ঠিক করার বিষয়টিও অতীতে জানানো হয়েছিল দলটির পক্ষ থেকে।

এদিকে, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে বলে আবারো দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। জুনের মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সদস্য সচিব নির্বাচন আয়োজন করা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদেরও নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে, কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার ও বিচারকাজ বাস্তবায়নসহ অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সরকার কতটা দৃশ্যমান করে সেদিকে নজর রাখবেন তারা।

দেশের সব নাগরিক জানে, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নয়। সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য এ সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়া বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শেষ দুটি দায়িত্ব পালনের জন্য বেশকিছুটা সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এতে বিচারে ত্রুটি থেকে যেতে পারে। বিচারকার্য যাতে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের হয়, তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। অন্যথায় এ বিচারকার্য নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকতে পারে। আর বড় ধরনের কোনো সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়াটাই যৌক্তিক। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রাথমিক কার্যক্রম সূচনা করে যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এসে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

মহলবিশেষ নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণকে সন্দিহান করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ এমনো বলার চেষ্টা করছেন যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। তারা নানা ধরনের কল্পকাহিনী প্রচার করছেন। সরকারের বিভিন্ন অর্গানের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি সেনাবাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজে দেবে না।

প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকার সংশ্লিষ্টরা বারবার বলেছেন, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তাদের মতে, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা নানাভাবে বাধা দেবে। বাংলাদেশের এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা বাধা দেবে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে, যাতে নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য এ মহলটি চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ ধরনের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তারা আরো বেশি তৎপর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয় তবে এ বাধা দূর হবে। তাই এ মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইসি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় রয়েছে। আশার কথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি সকল বাহিনী একটি ভালো নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে সহযোগিতা করতে বদ্ধপরিকর। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মানুষ একটি ভোট উৎসবের জন্য মুখিয়ে আছে।

আবারো বলছি, সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। আর রাজনৈতিক দলসহ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ভেদাভেদ ভুলে জাতির এই ক্রান্তিকালে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে; যেমন ঐক্য গড়ে উঠেছিল গত বছর আন্দোলনকালে।

লেখক: সাংস্কৃতিক, ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক।

মন্তব্য

ডাকসুর ছাত্ররাজনীতি থেকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন

মীর আব্দুল আলীম
ডাকসুর ছাত্ররাজনীতি থেকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে ইতিহাস আবারও নতুন মোড় নিল। ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অপ্রত্যাশিত জয় যেন শুধু ছাত্ররাজনীতির নয়, গোটা জাতীয় রাজনীতিরও সঙ্কেত। ঠিক এ সময়েই ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের দাপট আর বিরোধীদের প্রত্যাশা মিলেমিশে তৈরি করছে অনিশ্চয়তার দিগন্ত। এর মধ্যেই উঠেছে পিয়ার পদ্ধতির দাবি যা বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার খেলায় নয়, বরং ভোটের আসল অংশীদারিত্বে গণতন্ত্রের মানদণ্ড গড়তে হবে। তিনটি বিষয় আলাদা মনে হলেও, আসলে এগুলো একসুত্রে বাঁধা বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে হাঁটবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে এখন খোঁজার পালা। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নব্বইয়ের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল ছাত্রসমাজ। তাই আজ ডাকসুর এই পরিবর্তন শুধু একটি শিক্ষাঙ্গনের ঘটনা নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির দিকদর্শনও বটে।

ছাত্ররাজনীতির নতুন অঙ্ক:

ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের উত্থান বাংলাদেশে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো প্রভাবশালী সংগঠনগুলো এত বছর ধরে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ডাকসুকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার ফলাফল দেখিয়ে দিল, তরুণ প্রজন্ম আর কেবল পুরোনো মুখ ও স্লোগান দিয়ে তুষ্ট হতে চাইছে না। অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিল শিবিরকে কেবল মতাদর্শের কারণে নয়, বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিকল্প খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতার কারণে। এটি এক ধরনের ‘প্রতিবাদী ভোট’, যা বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।

প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের ধাক্কা: ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সবসময় ডাকসুর মতো সংগঠনকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার প্রদর্শনী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের প্রথম ডাকসু নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই এই দুই সংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য করেছে। কিন্তু এখন শিবিরের উত্থান তাদের জন্য বড় ধাক্কা। প্রশ্ন উঠছে, কেন এত বছর ক্ষমতা ভোগ করার পরও তারা তরুণ সমাজকে ধরে রাখতে পারল না? এটি মূলত ব্যর্থতার ফল যেখানে ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকেছে, অথচ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যাকে উপেক্ষা করেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে পিয়ার পদ্ধতির প্রশ্ন:

প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা ‘পিয়ার পদ্ধতি’ বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে। ভারত, নেপাল, জার্মানি অন্য অনেক দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশে বারবার অভিযোগ উঠেছে বড় দুই দলের বাইরে ছোট দলগুলোর কোনো অস্তিত্ব টিকে থাকে না। ডাকসুর ফলাফল সেই দাবিকে নতুন করে সামনে এনেছে। তরুণরা মনে করছে, ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলে অন্তত সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথ খুলবে।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সংশয়: বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস বিতর্কে ভরা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ অভিযোগ সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এখন ভোটের প্রতি আস্থাহীন। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মনে তীব্র সংশয়। মানুষ ভাবছে, এবার কি সত্যিই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, নাকি আবারও ক্ষমতার দাপটে একতরফা ফল বেরিয়ে আসবে? ভোটকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা সবকিছু মিলিয়েই এখন জাতির সামনে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

ছাত্রশিবিরের বার্তা: শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভোট দিয়ে আসলে একটি বড় বার্তা দিয়েছে তারা পুরোনো শক্তিগুলির প্রতি আস্থা হারিয়েছে। অনেকে বলছে, এটি মতাদর্শের ভোট নয়, বরং পরিবর্তনের ডাক। এই প্রবণতা যদি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়, তবে দুই বড় দলের প্রভাব ক্রমশ ভেঙে পড়বে। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে বিকল্প খুঁজছে, তা ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে।

বড় রাজনৈতিক দল আর ক্ষমতাসীনদের চিন্তা:

শিবিরের উত্থান ক্ষমতাসীনদের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। কারণ তারা জানে, শিক্ষাঙ্গনের বাতাসই একদিন জাতীয় রাজনীতির ঝড়ে রূপ নেয়। ১৯৮০-এর দশকে এরশাদের পতনের সময় যেমন ছাত্রদের আন্দোলন বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এখন যদি তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ বাড়তে থাকে, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে আগামী বছরগুলোতেও সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বিরোধীদের উল্লাস:

বিরোধীরা শিবিরের সাফল্যকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার শুরু করেছে। তারা দাবি করছে এটি জনতার পরিবর্তনের ইচ্ছার প্রতিফলন। ডাকসুর নির্বাচনে শিবিরকে ভোট দেওয়া অনেকটা ‘প্রতীকী বিদ্রোহ’, যা জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিরোধীদের ভাষ্য যদি শিক্ষার্থীরা এভাবে আস্থা হারিয়ে বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে সাধারণ মানুষও ফেব্রুয়ারিতে একই পথে হাঁটতে পারে হয়তে।

প্রশাসনের ভূমিকা:

বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডাকসুর ভোটেও সেই অভিযোগ থেকে রেহাই মেলেনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি প্রশাসন সঠিকভাবে পরিচালনা না করে, তবে তার বৈধতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থা ফেরানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রশাসন যদি কোনো দলের পক্ষ নেয়, তবে নির্বাচন যতই অংশগ্রহণমূলক হোক না কেন, তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

তরুণ প্রজন্মের হতাশা:

বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ তরুণ, এবং এরা মূলত চাকরি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার চায়। কিন্তু বারবার নির্বাচনে বিতর্কের কারণে তারা হতাশ হয়েছে। ডাকসুর ফলাফল অনেকটা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম। তরুণরা বিকল্প শক্তিকে ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল তারা পুরোনো রাজনীতির ব্যর্থতায় ক্লান্ত। এই হতাশা যদি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বড় আকার ধারণ করে, তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন শক্তি জন্ম নিতেও পারে।

পিয়ার পদ্ধতি না এলে সংকট:

বাংলাদেশে বর্তমানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতি চালু আছে। এতে যে দল এক ভোট বেশি পায়, সেই দল পুরো আসন জিতে যায়। এর ফলে অনেক সময় ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হয় না। যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা লাখ লাখ ভোট পেলেও আসন পেল হাতে গোনা। তরুণরা মনে করছে এই অন্যায় পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে পিয়ার পদ্ধতি জরুরি। নইলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলও বিতর্কিত হবে এবং সংকট আরও গভীর হবে।

আন্তর্জাতিক নজরদারি:

বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে সবসময় নজর রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, জাতিসংঘও বারবার স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। ডাকসুর নির্বাচনের ফল আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার খোরাক। প্রশ্ন উঠছে যদি শিক্ষার্থীরা বিকল্পকে বেছে নিতে পারে, তবে ফেব্রুয়ারিতে ভোটাররা কী করবে? আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে যদি নির্বাচন নিয়ে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

অর্থনীতি ও অস্থিরতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই চাপে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের পতন সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। এর মধ্যে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হয়, তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাবে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যদি সহিংসতা ছড়ায়, তবে সেই দৃশ্য পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।

রাস্তায় উত্তাপ: বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই রাস্তায় উত্তাপ। নির্বাচন এলেই সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ, হরতাল শুরু হয়। এতে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাকসুর ফলাফল বিরোধী শিবিরকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। তারা রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোও ক

পাল্টা কর্মসূচি দেবে। ফলে ফেব্রুয়ারির আগে দেশজুড়ে উত্তেজনা বেড়ে সহিংসতার আশঙ্কা বহুগুণ বাড়বে।

পথ কোনদিকে? শেষ প্রশ্ন একটাই- বাংলাদেশ সামনে কোন পথে হাঁটবে? ডাকসুর নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম স্পষ্ট করে বলেছেতারা পরিবর্তন চায়। এখন জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই বার্তা শুনবে? নাকি আবারও পুরোনো দখলদার রাজনীতির পুনরাবৃত্তি হবে? ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। যদি এই নির্বাচনও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে বাংলাদেশ আবারও অনিশ্চয়তা, বৈধতার সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপে ডুবে যাবে।

শেষ কথা: ডাকসুর ফল কেবল ক্যাম্পাসের ভোট নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির আগাম ইঙ্গিত। তরুণরা যে পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছে, তা উপেক্ষা করলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ইতিহাস সাক্ষী, ছাত্ররাজনীতি বহুবার জাতীয় আন্দোলনের সূচনা করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।

এই তিনটি ইস্যু আলাদা হলেও, মূল প্রশ্ন আসলে একটাই বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে?

মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

মন্তব্য

মতামত
Begum Khaleda Zia From the unparalleled leader to patriot

বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীন নেত্রী থেকে দেশনেত্রী

রাজু আলীম
বেগম খালেদা জিয়া: আপসহীন নেত্রী থেকে দেশনেত্রী

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন এক নাম, যিনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র, আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এক শোকস্তব্ধ মুহূর্তে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি একটি অস্থিরতা ও নেতৃত্ব সংকটের মুখে পড়ে। সে সময় একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ নয়, বরং দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তার হাতে গড়া আন্দোলন ও নেতৃত্বে বিএনপি ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি গণআন্দোলনের শক্তিতে, যার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের পর থেকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। মাত্র দুই বছরের মধ্যে, ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি পূর্ণাঙ্গ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সেই সময় সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠনে, যা পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে তার আপসহীন অবস্থান এবং দৃঢ় নেতৃত্ব তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে রাজনৈতিক অভিধানে অমর করে রাখে। আন্দোলনের সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন—১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে—কিন্তু প্রতিবারই তিনি দৃঢ়ভাবে রাজনীতির মঞ্চে ফিরে এসেছেন। সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল তার নেতৃত্বের পরীক্ষার আসল ক্ষেত্র। ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে। এরপরের ইতিহাস হলো বিএনপির অভ্যুদয়ের ইতিহাস। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়। এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করেনি, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে একটি নতুন গতিপথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালে, তখন দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে। তার নেতৃত্বে এ সময় দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা পায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৬ সালের পর রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং ২০০৭ সালের ১/১১ এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা তার ও তার দলের জন্য নতুন সংকট তৈরি করে। এই সময় খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়, যা তার রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে তোলে।

২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপির ওপর শুরু হয় তীব্র দমননীতি। হাজার হাজার মামলা, গ্রেপ্তার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে এক অমানবিক সময়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনগুলোতেও উঠে আসে এই নিপীড়নের চিত্র। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও চালানো হয় প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা পরে হাইকোর্ট দশ বছরে উন্নীত করে। একই বছরের অক্টোবরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের সাজা ঘোষণা হয়। এর ফলে তিনি বন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন কারাগারে কাটান। পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাকে রাখা হয়েছিল, যা ছিল মানসিক ও শারীরিক কষ্টকর অভিজ্ঞতা।

তার এই বন্দিত্ব শুধু একজন রাজনীতিকের নয়, বরং গণতন্ত্রের উপর আঘাত হিসেবে ধরা হয়। বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো মনে করত, এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ। দীর্ঘ কারাজীবনের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। তবে এই মুক্তি পূর্ণ স্বাধীনতা নয়; তিনি কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় গুলশানের ফিরোজায় থাকেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও, তার উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

এই দীর্ঘ সময় তার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রাম, কারাবাস এবং গৃহবন্দিত্বে ভরা। কিন্তু খালেদা জিয়ার যে রাজনৈতিক পরিচয়, তা হলো আপসহীন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব। তিনি কখনোই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আপস করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেননি। বরং তার কারামুক্তি দিবস প্রতি বছর বিএনপি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে হয়ে ওঠে এক প্রতীকী দিন, যা মনে করিয়ে দেয় রাজনীতিতে তার অবদান ও ত্যাগের কথা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এই মুক্তি কেবল তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ফেরানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক প্রতীকী ঘটনা। গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণে তার ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় আসে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রতীক, যিনি নিপীড়ন, কারাবাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির মুখোমুখি হয়েও তার আদর্শ থেকে সরে আসেননি।

আজ যখন আমরা খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস স্মরণ করি, তখন কেবল একজন নেত্রীর মুক্তি উদযাপন করি না, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামী পথকেও স্মরণ করি। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পাল্টাতে হলে দৃঢ় নেতৃত্ব ও আপসহীন অবস্থানের প্রয়োজন। তার কারাবাস ও মুক্তির ইতিহাস আসলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসেরই অংশ।

বিএনপির জন্ম, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দর্শন এবং খালেদা জিয়ার হাতে সেই দর্শনের বিকাশ আজও প্রাসঙ্গিক। তার নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, বরং সংগ্রাম, ত্যাগ এবং আপসহীনতার মাধ্যমেই তাকে এগিয়ে নিতে হয়। খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস তাই কেবল একটি তারিখ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়, যা নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই কখনো থেমে থাকে না।

রাজু আলীম, কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য

তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
তাফসীরে হিদায়াতুল কোরআন

অনুবাদ:

(১০) তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব, তখন কি আমাদেরকে আবার নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতকেই অস্বীকার করে। (১১) ( হে নবী,) বলে দাও: তোমাদের জীবন হরণ করবে মৃত্যুর ফেরেশতা, যাকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। (১২) তুমি যদি তাদের দেখতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে নতশিরে দণ্ডায়মান হবে! (তারা বলবে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শোনলাম। এখন আমাদেরকে (একবার দুনিয়াতে) পাঠিয়ে (সুযোগ) দিন, আমরা সৎকাজ করবো। আমরা (এখন) দৃঢ় বিশ্বাসী। (১৩) আমি চাইলেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানবজাতি উভয়ের দ্বারা জাহান্নাম ভরে দেব।’ (১৪) সুতরাং তোমরা যে এ দিবসের সাক্ষাত ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ গ্রহণ কর। আমিও তোমাদের ভুলে গেলাম এবং তোমাদের কর্মের দরুন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাক।

মর্ম ও শিক্ষা-

ইতোপূর্বে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, তার কিতাব কোরআন এবং রিসালাতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ঈমানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তা হলো কিয়ামত ও আখিরাত। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং এরপর সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। সবারই পুনরুত্থান হবে। কিয়ামত হবে, আখিরাত আছে। তখন প্রতিটি মানুষকে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে।

বাতিলপন্থিদের আখিরাতে অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি-

অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিরা মনে করে, মৃত্যুর পর তারা যখন মাটিতে মিশে যাবে, তখন তাদেরকে আর পুনরুত্থিত করা হবে না তারা মনে করে, দুনিয়ার জীবনই শেষ। দুনিয়ার মৃত্যুই শেষ। এরপর আর পুনর্জীবন নেই। সুতরাং দুনিয়াতে তারা যে কর্মই করুক, সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে না। কোনো কিছুর হিসাব দিতে হবে না। এ জবাবদিহির চেতনা ও অনুভূতি না থাকার কারণে, তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে।

ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানুষের জীবন হরণ-

সকল প্রাণীরই মৃত্যু আছে। নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছুই মারা যাবে, কিন্তু মানুষের মরণ এবং অন্যান্য প্রাণীর মরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত সকল প্রাণীকে আল্লাহই প্রাণ দেন, কিন্তু শুধু মানুষের বেলায় বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের নিকট থেকে মানুষের জীবন সঞ্চার করেন। আর এখানে আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মৃত্যুর সময় হবে তখন অন্য প্রাণীর মতো মানুষের প্রাণ বায়ু এমনিতে উড়ে যাবে না বরং ফেরেশতা এসে তার জান কবজ করবেন। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রাণ সঞ্চার করার কথা বলে যেমন সম্মান দেয়া হয়েছে, তেমনি মৃত্যুর সময়ও মানুষের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাতেই মানুষের জান কবজ হবে।

কিয়ামতে পুনরুত্থান-

কিন্তু মৃত্যুই শেষ নয়। আয়াতে বলা হয়েছে, অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ মৃত্যু এলো, কবর দেয়া হলো, দিনে দিনে মানুষের লাশ পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেলো, এটাই শেষ নয়। বরং এক নির্দিষ্ট সময়ে কিয়ামত আসবে। আল্লাহর নির্ধারিত ফেরেশতা সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। সেই আওয়াজে কবর থেকে সকল মানুষ পুনরুজ্জীবিত হয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। সৃষ্টির প্রথম মানুষ থেকে শেষ মানুষ সবাই হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। তা হবে অগণিত মানুষের বিরাট সমাবেশ।

কিয়ামতের দিনের হিসাব ও বিচার-

কিয়ামতের দিনের সেই বিরাট সমাবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। সেদিন সকল মানুষ আল্লাহর সম্মুখীন হবে, সবাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব হবে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে)। উল্লেখ্য, মানুষকে শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য পালনে সে কতটুকু স্বার্থক হলো, আর কতটুকু ব্যর্থ হলো, তার হিসাব দিতে হবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে, সেদিন আল্লাহর বিচারের রায় তাদের পক্ষে যাবে। তারা মুক্তি পাবে এবং অনন্তকালের জান্নাতের শান্তির স্থান পাবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তারা সেদিন কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বিচারের রায় তাদের বিপক্ষে যাবে। তারা অনন্তকালীণ শাস্তির দোযখে পতিত হবে।

সময় থাকতে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত-

কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী ও বাতিলন্থীদের কি পরিণাম হবে, এখানে আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছেন। একথাও বলা হয়েছে, সময় ফুরিয়ে গেলে পরে আফসোসে কোন কাজ হবে না। শত আকুতি মিনতি করলেও লাভ হবে না। এখান থেকে আল্লাহ একথাটি বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, সময় থাকতে শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত। সময় শেষ হয়ে গেলে কান্না কাটি করেও লাভ নেই। কাজেই দুনিয়ার জীবনে সত্যপথ গ্রহণ করা উচিত এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করা উচিত।

আখিরাতে বিশ্বাস, জবাবদিহিতা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা-

এখানে শুধু অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিদের জন্যই শিক্ষা নয়, বরং সত্যপন্থি ও ঈমানদারদের জন্যও শিক্ষা রয়েছে। তা হলো এই যে, তারা যখন কিয়ামত ও আখিরাতের জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে, তখন তাদের উচিত আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধানকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা। অলসতায় গা ভাসিয়ে দেয়া ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্বাস অনুযায়ী আমল ও কর্ম হতে হবে। ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন চালালেই আখিরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে। তা না হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। উল্লেখ্য, কারো যদি ঈমান থাকে এবং তার কর্ম ঈমানের দাবি অনুযায়ী না হয়, বরং বিচ্যুতি ও অপরাধই বেশি হয়, তাহলে তার শাস্তি হতে পারে। ঈমানের কারণে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু অবহেলাজনিত অপরাধ থাকলে যদি ক্ষমা পাওয়া না যায় তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে দোযখে শাস্তি ভোগ করার পর ঈমানের কারণে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া যাবে। কাজেই এ শাস্তি থেকেও আত্মরক্ষার জন্য ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন যাপন করা উচিত।

সত্যগ্রহণে মানুষের স্বাধীনতা-

আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে হিদায়াত দিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। আর তা করেননি যৌক্তিক কারণে। আল্লাহ যদি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে হিদায়াত দিয়ে দিতেন, তাহলে সৎপথে চলার পুরস্কার এবং বাতিলের পথে চলার শাস্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ তখন কেউ বাতিলের পথে চলবে না। কাজেই শাস্তির প্রশ্নই উঠে না। আর যেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে সবাই সৎ পথে চলে, সেহেতু পুরস্কারেরও কোন অর্থ থাকে না। এজন্যই ফেরেশতাদের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি নেই। কারণ তারা বাধ্যতামূলকভাবেই আল্লাহর অনুগত। শুধু মানুষ ও জিন জাতিকেই মত ও পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোন্ পথে চললে আল্লাহ খুশি হন তা কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আর কোন্ পথে চললে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তারও বর্ণনা রয়েছে তাতে। এছাড়া সত্য পথে চললে কি পুরস্কার রযেছে, আর বাতিলের উপর চললে কি শাস্তি রয়েছে, তাও বলে দেয়া হয়েছে। এসব বলে দেয়ার পর মানুষ ও জিন জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তারা বুঝে-শুনে নিজ পথ বেছে নিতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের পূর্ণ স্বাধীনাত দেয়া হয়েছে।

কিয়ামতে অপরাধীদের প্রতি তিরস্কার-

কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী, বাতিলপন্থী ও মুশরিকরা শুধু শাস্তিই পাবে না, বরং তাদেরকে তিরস্কার করা হবে। তারা দুনিয়াতে যেভাবে সত্যপন্থিদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, কিয়ামতের দিন তাদের প্রতি বিদ্রূপ করা হবে। যেমন তাদের বলা হবে, তোমরা তো আখিরাতকে ভুলে গিয়েছিলে, এখন মজা ভোগ করো। বলাবাহুল্য, শাস্তির মজা বা স্বাদ ভোগ করার কথা বলা বিদ্রূপাত্মক। শাস্তি কখনো মজা হতে পারে না।

আখিরাত অস্বীকার করাই বিপথে চলা ও শাস্তির মূল কারণ-

অবিশ্বাসী বাতিলপন্থিরা নবী, রাসূল, আল্লাহর কিতাব কোরআন, রাসূলের আদর্শ ও ইসলামী জীবনাদর্শের সবকিছুকেই অস্বীকার করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো আল্লাহর কাছে আখিরাতের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করা। এ বিষয়টিকেই এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কারণ আখিরাত অস্বীকার করলে জবাবদিহিতার কোন ভয় থাকে না, শাস্তি বা পুরস্কারের প্রশ্ন উঠে না। সুতরাং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে, তাদের নিকট অন্যায় ও মন্দ পথ ছেড়ে ভালো পথে চলার কোন অনুপ্রেরণাই থাকে না। মন্দ পথে চললে যদি দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ ও শন্তি পাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য এটাই তো ভালো, কারণ আখিরাত তো নেই। কাজেই যারা আখিরাত অবিশ্বাস করে তারা তাদের পক্ষে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। অপরদিকে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে, এ বিশ্বাস তাদের সকল কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ যখন তারা কোন কাজ করতে চায়, তখনই তার বিবেক প্রশ্ন করে, এটা ভালো কি মন্দ। মন্দ হলে আখিরাতে জবাব দিতে হবে। এভাবে কিয়ামত ও আখিরাতে বিশ্বাস মানুষের আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে।

ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক, সূরা সাজদাহ, পর্ব ৩

মন্তব্য

p
উপরে