বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস যেন এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার কাহিনী। ‘সুষ্ঠু এবং ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন-এই দুই শব্দই বহু বছর ধরে জনমানসে আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। কারও কাছে নির্বাচন মানে একদিনের উৎসব, আবার কারও কাছে তা একেবারেই অচল গণতন্ত্রের প্রতীক। গত দেড় দশকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলো এই সন্দেহকেই প্রবল করেছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, ভোটকেন্দ্র ফাঁকা পড়ে থাকা, ‘রাতের ভোট’-এর অভিযোগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণ-সব মিলিয়ে জনমনে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতির আঙিনায় আবারও ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন একটাই-এবার কি সত্যিই একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোট হবে? নাকি আগের মতোই নিয়ন্ত্রিত প্রহসনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক-সবার কণ্ঠেই তাই একই দ্বিধা ও উৎকণ্ঠা। একদিকে জনগণের প্রত্যাশা প্রবল; অন্যদিকে শঙ্কার ছায়াও ঘন। রাজনীতির ময়দান যেমন দুই ভাগে বিভক্ত, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলও কড়া দৃষ্টি রেখেছে ঢাকার দিকে। অনেকে বলছেন, শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলেই হবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলে দিয়েছে, ক্ষমতার লড়াইয়ে দলগুলো নিজেদের স্বার্থকেই আগে দেখবে। তাই জনগণ এখন তাকিয়ে আছে আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিকে। আরেকটি দিকে-যে শক্তি অতীতে কখনও আস্থার প্রতীক হয়েছে, আবার কখনও সমালোচিতও হয়েছে। সেই শক্তি হলো সেনাবাহিনী। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ২০২৬ সালের নির্বাচন নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা, তার বড় নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। এই বাস্তবতায়, সেনাবাহিনীকে ঘিরে জনআশা ও আশঙ্কার ভারসাম্য কীভাবে দাঁড়াচ্ছে-তা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।
হাসিনা আমলের নির্বাচনী সংশয়-অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ভোটার আচরণে ‘শেখা অসহায়ত্ত’তৈরি করেছে: অনেকে বিশ্বাস করেন, ফল আগে-থেকেই নির্ধারিত; ভোটে যাওয়া সময়ের অপচয় ও ঝুঁকি। এই মানসিকতা ভাঙতে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়; দরকার ‘প্রসেসিভ জাস্টিস’-প্রক্রিয়াগত ন্যায়বিচারের দৃশ্যমান প্রমাণ। যেমন: আগাম রাতে ব্যালট সুরক্ষা, ব্যালট-বক্স/ভোটকক্ষ লাইভ-লগিং, ইন্টারনেট সচল রাখা, অভিযোগ-ডেস্কে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ কর্মকর্তা, এবং ‘টাইম-বাউন্ড রেড্রেসাল’। প্রতিটি ধাপে যদি মানুষ দেখে-একটি অভিযোগ উঠলেই তাৎক্ষণিক নথিভুক্ত হয়, ভিডিও-ফিড রিভিউ হয় এবং অপকৃতির শাস্তি/পুনঃভোটের সিদ্ধান্ত হয়-তবে ২০২৫-এর ‘রিপিট রিস্ক’কমে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখানে ‘ফেসিলিটেটর অব প্রসেস’-কার্যকর, দৃশ্যমান ও জিরো-টলারেন্স।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে সেনাবাহিনীকে দুইটি পরস্পর-সম্পর্কিত কারণে আস্থার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়: (ক) সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং (খ) রাজনৈতিক দলীয় দ্বন্দ্বের বাইরে তুলনামূলকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়। সাম্প্রতিক দশকে আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশি কাঠামোতে দলীয়করণের অভিযোগ প্রবল হওয়ায় সাধারণ নাগরিকের ‘ন্যূনতম নিরপেক্ষতার’ প্রত্যাশা প্রায় এককভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গণমাধ্যম জরিপে এই আস্থার ধারাবাহিকতা ফুটে উঠলেও বাস্তব প্রয়োগে প্রশ্ন হলো-কোন শর্তে এই আস্থা কার্যকরভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়? অভিজ্ঞতা বলছে, শুধুমাত্র উপস্থিতি নয়; স্পষ্ট ম্যান্ডেট, অপারেশনাল স্বাধীনতা, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও জবাবদিহিমূলক কমান্ড-চেইন নিশ্চিত হলেই ভোটকক্ষভিত্তিক নিরাপত্তা তৈরি হয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ‘ডিটারেন্স’ বা ভীতি-নিবারক প্রভাব তখনই জন্ম নেয়, যখন সম্ভাব্য গণ্ডগোলকারীরা বুঝতে পারে-কারচুপি বা সহিংসতার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক, দৃশ্যমান ও সমানভাবে আইনপ্রয়োগ হবে। ফলে আস্থার প্রতীক হওয়া কেবল ভাবাবেগ নয়, এটি প্রক্রিয়াগত নকশা, স্বচ্ছতা ও বাস্তব প্রয়োগের ফাংশন; যার অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মর্যাদা প্রতীকী হয়ে পড়ে, কার্যকারিতা কমে যায়।
ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের কার্যকারিতা: ১৯৯১/১৯৯৬/২০০১-এর অভিজ্ঞতা দেখায়-শৃঙ্খলাবদ্ধ, ক্ষমতাসম্পন্ন ও দ্রুত-প্রতিক্রিয়াশীল সেনা-উপস্থিতি ভোটদানে আস্থা বাড়ায়। ২০১৮-তে সীমিত ম্যান্ডেটের ফলে উপস্থিতি ‘সিম্বলিক’ হয়ে পড়ে। শিক্ষা: (ক) কেন্দ্র-পর্যায়ে স্পষ্ট ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’-কখন সতর্কতা, কখন আটক, কখন পুনঃভোটের সুপারিশ; (খ) ‘এসক্যালেশন-ম্যাট্রিক্স’-ঘটনা-স্তর নির্ভর প্রতিক্রিয়া (ভাঙচুর/দখল/হামলা/ব্যালট কারচুপি); (গ) একীভূত কমান্ড-সেন্টার-ইসির সঙ্গে রিয়েল-টাইম লিঙ্ক, ভিডিও-ফিড ও জিপিএস-ট্র্যাকিং। তবেই ভোটকক্ষের ‘ফ্লোর কন্ট্রোল’ সম্ভব হয় এবং কারচুপির উইন্ডো সঙ্কুচিত হয়।
প্রশাসন ও পুলিশের দলীয়করণ যেন না থাকে। নির্বাচনের আগে ও চলাকালে প্রশাসন/পুলিশের পক্ষপাত অথবা ভয়-ভীতি সৃষ্টির অভিযোগ একটি ‘স্ট্রাকচারাল ডিফেক্ট’-যেখানে বদলির রাজনীতি, মামলা-ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার, এবং ক্যারিয়ার-ইনসেনটিভের বিকৃতি মিলেমিশে প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতাকে ক্ষয় করে। এই ক্ষয় যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন কেবল নির্বাচন কমিশনের আহ্বান বা প্রশাসনিক সার্কুলার দিয়ে নিরপেক্ষতা ফেরানো যায় না; দরকার ‘থার্ড-পার্টি এনফোর্সমেন্ট। এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি মধ্যস্থ শক্তি হিসেবে কাজ করে: (ক) পুলিশি একচ্ছত্রতা কমে, (খ) নির্বাচনী এলাকায় ‘চেকস-অ্যান্ড-ব্যালান্সেস’ তৈরি হয়, (গ) প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপরে চাপ কমে। তবে শর্ত হল—সেনাবাহিনীর দায়িত্বসংজ্ঞা স্পষ্ট, নাগরিক অধিকার রক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ-নির্দেশনা দৃশ্যমান এবং যেকোনো অভিযোগের দ্রুত স্বাধীন তদন্তের ব্যবস্থা রাখতে হবে; নইলে ‘মিলিটারাইজড পোলিং’ নিয়ে পাল্টা অবিশ্বাস জন্মাতে পারে।
বৈশ্বিক গণতন্ত্রের মানদণ্ড এখন কেবল ভোটগ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়; ‘ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল’-এই তিন স্তরের গ্রহণযোগ্যতা একসঙ্গে নিশ্চিত করতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ বা জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা যখন সেনাবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতির কথা বলেন, এর পেছনে তিনটি যুক্তি কাজ করে: (ক) প্রশাসন-নিরপেক্ষতার ঘাটতি পূরণের ‘ট্রাস্ট-সাপ্লিমেন্ট’, (খ) সহিংসতা-প্রবণ নির্বাচনী ভূগোল-গ্রামীণ/শহুরে ‘হটস্পট’-এ দৃশ্যমান শক্তি প্রক্ষেপণ, এবং (গ) ফল-গ্রহণযোগ্যতার ন্যূনতম শর্ত পূরণ। দেশীয় সক্ষমতার প্রশ্নে তাই প্রয়োজন ‘হাইব্রিড মডেল’: নির্বাচন কমিশনের নীতিনির্ধারণ; মাঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ-র্যাব-আনসার-আর নিরপেক্ষ ‘ওভারওয়াচ’ ও ‘র্যাপিড কারেকটিভ’ হিসেবে সেনাবাহিনী। এই বিন্যাস আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে সহায়ক, কারণ দায়িত্ব বণ্টন স্পষ্ট, জবাবদিহি নির্ধারিত এবং মানবাধিকার-সম্মত আচরণবিধি প্রয়োগযোগ্য হয়।
এদিকে ইন্টারনেট বন্ধ করা আধুনিক কালে নির্বাচনী স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাত; এতে ভোটকেন্দ্রের ‘আই-উইটনেস’ হারিয়ে যায়। করণীয়: (ক) নির্বাচনী সময়ে ইন্টারনেট-শাটডাউন নিষিদ্ধ করার আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক প্রোটোকল; (খ) সেনাবাহিনীর সাইবার/সিগন্যাল কর্পসকে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার মনিটর’ হিসেবে নিয়োগ-কোনো এলাকার ব্যান্ডউইথ অস্বাভাবিকভাবে কমলে তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট; (গ) কেন্দ্রভিত্তিক সিসিটিভি-ফিডের নির্ভরযোগ্য ব্যাকআপ (লোকাল + ক্লাউড), যাতে ‘ব্ল্যাকআউট’ হলেও প্রমাণ থাকে। এতে ডিজিটাল কারচুপির ঝুঁকি কমে এবং তথ্যপ্রবাহে জনগণের আস্থা বজায় থাকে। তরুণ ভোটারের আস্থা-পলিটিক্যাল ইফিকেসি, প্রমাণভিত্তিক সংকেত ও অংশগ্রহণের নতুন ব্যাকরণ তৈরি করবে। ৪ কোটিরও বেশি তরুণ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে হলে ‘বিশ্বাসযোগ্য সংকেত’ দিতে হবে-কথায় নয়, প্রমাণে। যেমন: প্রথম দুই ঘণ্টায় প্রতিটি কেন্দ্রে সেনা-টহল দৃশ্যমান; সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ ‘ইনসিডেন্ট ড্যাশবোর্ড’; অভিযোগ করলে ৩০ মিনিটে টিম পৌঁছাবে-এমন এসএলএ প্রকাশ। পাশাপাশি তরুণদের জন্য ভোটকেন্দ্রে কিউ-ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ সহায়তা ডেস্ক, প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যবস্থা ও নিরাপদ যাতায়াত কোরিডর ঘোষণা করা যেতে পারে। যখন তরুণ দেখে ‘সিস্টেম আমার জন্য প্রস্তুত’, তখনই তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতার বোধ জাগে। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ পাহারা এই বার্তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
বাংলাদেশের নির্বাচন আঞ্চলিক পরিসরে ‘সিকিউরিটি এক্সটারনালিটি’ তৈরি করে-শরণার্থী প্রবাহ, সীমান্ত-টানাপোড়েন, লজিস্টিকস করিডর, ব্লু-ইকোনমি। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ইমেজ দুইভাবে গুরুত্বপূর্ণ: (ক) প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তির কাছে স্থিতিশীলতার বার্তা-নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণযোগ্য; (খ) কূটনৈতিক দরকষাকষিতে নৈতিক উচ্চভূমি-‘আমরা প্রক্রিয়া-নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত করেছি’। এতে নিষেধাজ্ঞা/ভিসা-নীতির ঝুঁকি কমে, উন্নয়ন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বাড়ে। অর্থনীতি অনিশ্চয়তাকে অপছন্দ করে। একতরফা নির্বাচনের আশঙ্কা ‘পলিটিক্যাল রিস্ক প্রিমিয়াম’ বাড়ায়-ঋণ ব্যয়, বিমা, ইনভেন্টরি কস্ট সব ওঠে। সমাধান: নির্বাচনী ক্যালেন্ডার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড স্টেবিলিটি প্লেবুক’ প্রকাশ-কোন জেলায় কত প্লাটুন, শিল্পাঞ্চলে ২৪/৭ কুইক-রেসপন্স,পোর্ট/কাস্টমস/হাইওয়েতে সুরক্ষা কোরিডর। চেম্বার/বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জয়েন্ট কমান্ড সেল খোলা যায় যাতে সরবরাহ-শৃঙ্খল ব্যাহত না হয়। সেনা-নেতৃত্বাধীন এই স্থিতিশীলতা সংকেত বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়ায়, বাজারে ভোলাটিলিটি কমায়।
গ্রামে ‘লোকাল নেটওয়ার্ক’-ইউনিয়ন-ভিত্তিক তদারকি, চৌকিদার-দারোয়ান, দলীয় প্রভাবশালী-ভোটকেন্দ্র দখলকে সহজ করে। প্রতিকার: (ক) মাইক্রো-জিওগ্রাফিক রিস্ক স্কোরিং-গত নির্বাচনের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভূগোলগত দূরত্ব মিলিয়ে কেন্দ্রে-ভিত্তিক ঝুঁকিমাত্রা; (খ) ঝুঁকি-উচ্চ কেন্দ্রে আগাম ‘স্ট্যাটিক’ সেনা-পোস্ট; (গ) নারী-ভোটারের জন্য আলাদা নিরাপদ প্রবেশপথ ও টহল; (ঘ) রাত-সার্ভেইলেন্স-গ্রামীণ রাস্তায় মোবাইল প্যাট্রোল ও ড্রোন নজরদারি। এতে ‘ব্যালট বাক্স ভরার’ ঐতিহ্যগত অবকাশ কমে, এবং গ্রামীণ ভোটার সাহস পায়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ যেন এক সুস্পষ্ট বার্তা-সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে এখানে ‘নিরাপত্তা’ শব্দের অর্থ কেবল বাহ্যিক হুমকি থেকে রক্ষা নয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখা, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা। সংবিধান ভোটাধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানেই দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি, এবং নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি কেন্দ্রগুলো দখল হয়ে যায়, ভোটাররা ভয়ে ঘরে থাকে, বা ব্যালট আগেই ভর্তি হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের সেই মৌলিক অধিকার কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এটি শুধু ভোটের প্রসঙ্গ নয়, পুরো দেশের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের প্রশ্ন। এ ধরনের পরিস্থিতি রোধ করাই সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। কারণ নিরাপত্তা মানে কেবল জীবন বাঁচানো নয়; মানুষের রাজনৈতিক অস্তিত্ব, নাগরিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও রক্ষা করা। সংবিধান জনগণের সার্বভৌমত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আর জনগণের ভোট ছাড়া সেই সার্বভৌমত্বের কোনো অর্থ থাকে না।
সেনাবাহিনী যদি ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে, তা কেবল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নয়-বরং সংবিধান রক্ষার সরাসরি প্রয়াস। এটি হবে গণতন্ত্রকে মর্যাদা দেওয়া, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা এবং দেশের ভবিষ্যৎকে সংহত করার এক বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে, নির্বাচন আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। ফলে সেনাবাহিনীকে এই মুহূর্তে নিরপেক্ষভাবে এবং দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে হবে—যা হবে সাংবিধানিক কর্তব্য, নৈতিক দায়িত্ব এবং দেশের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি।
উপসংহার: বাংলাদেশের মানুষ এখন অনন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখে। তবে হাসিনা আমলের বারবার প্রহসনমূলক নির্বাচন সেই বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যখন ভোটকেন্দ্রগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে, অথচ ফলাফল আগেই লেখা হয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে-আমাদের মতামতের কি কোনো মূল্য আছে? দীর্ঘ মেয়াদি এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রকে মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। জনগণ রাজনীতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, বিমুখ হয় এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই মুহূর্তে জাতির প্রত্যাশা একটাই-বর্তমান সরকার এবং সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে, ভোটকেন্দ্রকে নিরপেক্ষ করবে এবং নাগরিকদের নিরাপদ পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করবে। সরকার এবং সেনাবাহিনী যদি সত্যিকারের নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তারা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং পুরো জাতির ভবিষ্যৎকে বাঁচাবে। এটি হবে দেশের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক, যা ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক মান, জনগণের আস্থা এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সবকিছুকে পুনঃসংহত করবে। অন্যথায়, বাংলাদেশ আবারও অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক সংকট এবং গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার অন্ধকারে ঠেলে যাবে। প্রতারণামূলক নির্বাচনের কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হবে, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং জনগণ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই আজকের এই মুহূর্তে সরকার ও সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শুধু নির্বাচন নয়, বরং জাতিকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। এই পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হলে আগামী প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবে; ব্যর্থ হলে ইতিহাসের কঠিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
সরকার এবং সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষ ও দৃঢ় অবস্থান দেখায়, তবে তারা কেবল ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে না, বরং দেশের গণতন্ত্রকে নতুন প্রাণ দেবে, জনগণের আস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে এবং জাতীয় ভবিষ্যতের রূপটাই স্থির করবে। এটি হবে এক যুগান্তকারী অধ্যায়, যা ইতিহাসে উজ্জ্বলভাবে লেখা থাকবে।
লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবষেক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।s
বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ যা আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২৪ সালের হিসাবের ভিত্তিতে দেশের মোট জিডিপির আকার ৪৫০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৫৪ বছর বয়সের বাংলাদেশ এখনো অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে পারেনি। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও ঘাটতি বাজেট পূরনের জন্য ও দেশটিকে বৈদেশিক সাহায্যদাতা সংন্থার উপর নির্ভরশীল হতে হয় যা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। সরকারের বাজেট ঘাটতি প্রায় উন্নয়ন বাজেটের সমান এবং অর্থ অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠেনা। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়না। যেমন ২০২৪-২৫ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্জন হয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা ও ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আরও উল্লেখ্য যে কর জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার সকলের নিচে অবস্থান করছে। অর্থ মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দেশি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঋণের পরিমান উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। সরকারের ঋণের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, বিমা, ট্রেজারি বন্ড, সেভিং বন্ড, প্রাইস বন্ড ইত্যাদি। প্রতি বছর সরকার রাজস্ব টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। করের ফাঁকির পরিমাণ বেড়েছে, কর এলাকার প্রসার সঙ্কুচিত হয়েছে, পরোক্ষ করের উপর নির্রশীলতা বাড়ছে ইত্যাদি।
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা যায় যে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৩০ বিলিয়ন টাকা এবং বাংলাদেশ অনিবন্ধিত ৬ লাখ বিদেশি কর্মী কর ফাঁকি দিয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার উপরে যা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র দুর্বল কর কাঠামো ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকের উপর ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে। যেমন ২০২২ সালের শেষ থেকে ২০২৪ ডিসেম্বর পযর্ন্ত ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৩,০৯,৮৮৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এই আমানতের ৮৭% সরকার ঋণ হিসাবে নিয়েছে এবং বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন এত বেশি ঋণ নেয় এবং কেনই সুদে-আসলে তা পরিশোধ করতে হয়। একজন উপদেষ্টা বলেছেন সরকার ঋণ নেয় বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য। ইআরডির তথ্য বলছে ২০২৪-২০২৫ বৈদেশিক ঋণের ৬৮% ব্যয় হয়েছে পূর্বের বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন ২০২৫-২৬ বছরের বাজেট হবে ঋণের দুষ্ঠু চক্র ভাঙার বাজেট। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের বিষয়ে ২০২৪-২৫ সময়ে প্রথম ৮ মাসে ৪১টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং আই,এম,এফ/বিশ্বব্যাংক এর কাছে অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে যা দুঃখজনকও বটে। রিজার্ভ বাড়াতে হবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে তাহলেই এটি টিকসই হবে। বিভিন্ন মাধ্যম বলছে বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বেশি যার কারণ রাজনৈতিক বিশেষত: দ্বীপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চীন ও রাশীয়ার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি। এখন সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুকি হলো এই সকল ঋণের পরিশোধ। ই,আর,ডি বলছে ২০২৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদশিক ঋণ নিয়েছে তার জন্য ২০২৯ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে। বিগত সরকার যত ঋণ নিয়েছে সবই বিতর্কিত ঋণের মধ্যে পড়ে যায় একটা মৌকুফের সুযোগ থাকতে পারে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বৈদেশিক উৎসের ঋণের ওপর অধিক নির্ভর করছে। বাজেট ঘাটতির বড় একটি অংশ, প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া হবে। বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। চলতি অর্থবছরের ২১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রির গতি কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ছাড় কমে যাওয়াই এর পেছনে অন্যতম কারণ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা মূল বাজেট থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি ব্যয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা।
আবার রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ হাতে নেওয়া হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ নামের একটি নতুন প্রকল্প। এটির মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮ কোটি ৮০ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক হাজার কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এই ঋণ পাওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এদিকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি নিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান জানান, ১২ জুন সরকারি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতা বাড়াতে ২৫ কোটি ডলারের একটি ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। সেই ঋণের মধ্যে রাজস্ব বোর্ড সংস্কারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে ঋণ রয়েছে। তবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ চুক্তি কবে নাগাদ হতে পারে সেটি ইআরডি বলতে পারবে। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বাংলাদেশের রাজস্ব সংগ্রহ অত্যন্ত কম, যা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। দেশে রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত ২০১২ অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। এই সময়ের মধ্যে কর জিডিপির অনুপাত ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বশেষ গত বছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। এটি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমকক্ষ দেশগুলোর অনুপাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্য কম। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের চিহ্নিত করা তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো- প্রথমত, বাণিজ্য সম্পর্কিত করের ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা। দ্বিতীয়ত, একটি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থা থাকলেও সেটি অসংখ্য ছাড় এবং সংক্ষিপ্ত হার দিয়ে চিহ্নিত। যেটি দারিদ্র্যবান্ধব না হলেও রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাজে আসছে না। তৃতীয়ত, আয়করের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাড়, কর্তন এবং অবকাশ সুবিধা দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হলেও রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সুনির্দিষ্ট নীতি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় রাজস্ব আদায় কাঙ্খিত পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে যেসব সংস্কার নিশ্চিত করা হবে সেগুলো হলো-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট বিজনেস প্রসেস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পরিবর্তন এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ। এছাড়া প্রশিক্ষণ, বিশ্লেষণী ও নীতি বিশ্লেষণ সক্ষমতা জোরদারকরণ, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং একটি শক্তিশালী গবেষণা ও পরিসংখ্যান ইউনিট প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি সংস্থাটির সেবা প্রদান ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য তৈরি মাস্টার প্ল্যান বিশ্লেষণ, পরিবর্তন এবং সে অনুসারে স্বয়ংক্রিয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। আরও আছে, আয়কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে সহজ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়করণ, বিদ্যমান ও নতুন সিস্টেমগুলোর মধ্যে কার্যকর আন্তঃসংযোগ স্থাপন এবং নতুন সিস্টেম প্রবর্তন। এনবিআর সংস্কারের কার্যক্রম হিসাবে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর উভয় ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার তৈরি করা হবে। এছাড়া এনবিআরের বিদ্যমান ও প্রস্তাবিত সিস্টেম যেমন এ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ড, আইভিএএস এবং আয়কর সংক্রান্ত অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আইবিএ এসপ্লাস প্লাস ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডেটা প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করা হবে। করদাতাদের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। রাজস্ব বোর্ডের জনবল, কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি আধুনিক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি। কর প্রশাসনের জনবলের দক্ষতা বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। একটি পূর্ণাঙ্গ আয়কর প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য সমীক্ষা ও নকশা তৈরি করা হবে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান চেয়েও অনেক সূচকেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অতি দারিদ্র পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র্য হার কমেছে। এই প্রবণতাকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবে মনে করা হয়। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগন। এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারনে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য অনেকটাই কমে আসছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার প্রধান কারন, এদেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ একসময় দারিদ্রের করালগ্রাসে নিমজ্জিত ছিল, একথা সত্যি। তবে তখন নানা প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক দ্বিধাবিভক্তি, দায়সারা মনোভাব, নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডের অশুভ তৎপরতা প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থা নেই। ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নতুন নতুন অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। দেশ ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানান আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. আগের অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলÑখোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং জনগণ তাতে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এ গুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। তাই এখন একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি গিয়ে পড়ে সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরে। গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে বেসামাল অর্থনীতিকে অনেকটা লাইনে আনা গেলেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়েছেন অনেক মানুষ। সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় কৃষকেরা একের পর এক ফসলে লোকসান গুনছেন। ঋণগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা এই আর্থসামাজিক বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর পবায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা এবং মোহনপুরে পানচাষির আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কেননা এ দুটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফসলে ন্যায্য দাম না পেয়ে ও ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো নাগরিকের অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের দিক থেকে যে ধরনের জোরালো উদ্যোগ থাকা দরকার, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। ১৬ আগস্ট পবা উপজেলার বামনশিখর গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা মরে গেলাম।’ অন্যদিকে মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে ১৮ আগস্ট আকবর হোসেন নামের এক কৃষক ঋণের চাপ ও পান চাষে লোকসানের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা দেখছি যে দুটি ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য আর ঋণের চাপ আত্মহত্যা ও স্বজন হত্যার মতো মর্মান্তিক পথ বেছে নেওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মিনারুল অভাব লুকিয়ে রাখতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত তাকে এমন ভয়াবহ পথে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে আকবর প্রমাণ করলেন, আমাদের কৃষকদের এখনো কতটা অনিশ্চয়তা ও সুবিধাহীনতার মধ্যে বাস করতে হয়। একদিকে তিনি ১৩টি এনজিওর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, অন্যদিকে পান চাষ করে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষকেরা কেন তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন না। কৃষকদের সুরক্ষা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি। এ ভূমির কৃষক–প্রজাদের দীর্ঘ লড়াইয়ে কয়েক দশক আগে যে মহাজনি প্রথার উচ্ছেদ হয়েছিল, সে ব্যবস্থা কেন আবার নতুন করে ফিরে আসবে? কৃষকেরা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারেন, সে সংস্কার করাটাও জরুরি। সরকারকে অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। সরকারকে অবশ্যই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বাজারের হাল দেখে এটিই স্পষ্ট হয় যে বাজারের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণিপেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেই দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সরবরাহ চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এই অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে এসেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে বেশে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, বিএনপি সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করার বিষয়ে একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল মনে করে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না। তারা মনে করে সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) আছে, সেগুলো হলো: ১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্ন আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরামের; ২. রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি: ভিন্নমত আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের; ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির; ৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের; ৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা: বিএনপি (গঠনপ্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), কিছু অংশে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির; ৬. উচ্চকক্ষে পিআর: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৭. উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ: বিএনপি, এনডিএমের ভিন্নমত; ৮. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা: সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ৯. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দলের ভিন্নমত; ১০. ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ: বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ভিন্নমত; ১১. ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া: জামায়াতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাকের পার্টি, জেএসডি ও বিএসপির ভিন্নমত আছে।
সার্বিক পরিস্থতি বিবেচনায় বলা যায়, এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মেঘ পুরোপুনি কেটে যায়নি। তবে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের টক শো, গোলটেবিল, সভা-সেমিনারÑসর্বত্রই এখন আলোচনার প্রধান বিষয় নির্বাচন। সম্প্রতি গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম যে, নির্বাচন কমিশন সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে। এতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, সামান্য যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা-ও হয়তো কেটে যাচ্ছে। দু’একটি রাজনৈতিক দল এখনো কিছু শর্ত দিচ্ছে এবং শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জন করার হুমকি দিচ্ছে। এগুলোকে অবশ্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় বা দর-কষাকষির কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক জোট গঠনে এখন অনেক বেশি তৎপর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মূলত তিনটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দল, সমমনা জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। যত দূর জানা যায়, এই জোটে আরো কয়েকটি দল অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত যে বিএনপি কোনোক্রমেই আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাবে না।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ নিয়ে জোট বাঁধার বিষয়ে অনেকটাই ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এর বাইরে এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল পৃথক জোট গঠনেরও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই জোট বিএনপির সঙ্গে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু আশার আলো দেখা গেলেও গত ১৫ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমরা শুনি, বিশ্বাসও করতে চাই যে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া, ভোটগণনা, ফলাফলের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জাতির কাছে একটা সংশয় আছে।’
রাজনীতিতে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি ঘটতে পারে এমন আলোচনা সর্বমহলে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির মহাসচিব তাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চারদিকে আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন, চারদিকে একটু চোখ-কান খোলা রাখেন। দেখবেন কতগুলো ঘটনা ঘটছে, যে ঘটনাগুলোর আলামত ভালো না। এদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে।’ তার এই বক্তব্য থেকেও মনে হয় যে বিদ্যমান পরিস্থতিতে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট রয়েছে। এমনকি রাজনীতিতে ঐক্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও একতা নেই।
৩১ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্ট নিয়েও বেশ আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদ তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না।...’
অন্যদিকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের অভিযোগ তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা বর্জন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাংলাদেশ বাসদ, বাসদ মার্কসবাদী দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমন একটি প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আগে অনেকে বলেছিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখতে হবে, আজ তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখলাম।’
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে দলীয় সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আদালত এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকা একটি রিট পিটিশনের (১৫০৫১) উল্লেখ করেন। আদালত বলেছেন, ‘মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের শুনানির জন্য প্রস্তুত অবস্থায় বিচারাধীন আছে। এ পর্যায়ে কারও পক্ষে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয় মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’
এমন নানা ধরনের মত-ভিন্নমত এবং অনৈক্য পরিস্থিতি আমাদের ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে মাঠে নেই, তারা তো এমনিতেই বিদ্যমান মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে আছে। আর যেসব দল মাঠে সরব রয়েছে তারা যদি নিজেরা কোনো বিষয়ে একমত না হয়ে বিভেদ তৈরি করতে থাকে তাহলে রাজনীতির সংকট আরও বাড়তে পারে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা চাই, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে কোনো প্রশ্ন তৈরি হোক- সেটি আমরা চাই না। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দিয়ে দেবে, অন্য দলকে দেবে। কাজেই এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক স্থায়ী হওয়া উচিত না।
আগামী নির্বাচনে যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে এ বিষয়ে কোনা সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্টট বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে কয়েকবার হয়েছে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই এখানেও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন এবং নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতা অধিকভাবে লক্ষণীয়।
মোটাদাগে বলতে গেলে বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান টানাপোড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতোপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধি বিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের বর্ণ ব্যবস্থা সমাজকে চারটি বর্ণে বিভক্ত করে যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা তাদের গুরুতর পাপের কারণে এই ব্যবস্থার বাইরে পড়ে তাদের বহিষ্কৃত বা অস্পৃশ্য হিসাবে বঞ্চিত করা হয় এবং বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে বিবেচনা করা হয়। বর্বর এবং যারা অধার্মিক বা নীতিহীন তারাও বহিষ্কৃত বলে বিবেচিত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজে কেউ বহিষ্কৃত ও নীতিহীন থাকুক তা আমরা কেউ ই চাই না । আমরা চাই সম্প্রীতি। আর এই শব্দের অর্থ হলো বন্ধুত্ব, সদ্ভাব, সৌহার্দ্য, শান্তি, বা মিলমিশ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে মানুষে মানুষে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকে এবং সকলে মিলেমিশে থাকে। ধর্ম ও বর্ন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘এই বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, উপজাতি—সবাই মিলে অত্যন্ত শান্তিতে, সম্প্রীতিতে আমরা বসবাস করে যাচ্ছি।
তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি ‘এই দেশ আমাদের সবার। সবাই একসঙ্গে এই দেশে সুন্দরভাবে ও শান্তিতে বসবাস করব। এখানে কোনো জাতি-ধর্মে, গোত্রের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই আমরা এ দেশের নাগরিক।
প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার রয়েছে। সেভাবেই আমরা আমাদের সামনের সোনালি দিনগুলো দেখতে চাই।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি জন্মাষ্টমীর মিছিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে এসব কথা বলেন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের হাজার হাজার ভক্ত এখানে উপস্থিত আছেন। এখানে বাদ্য বাজছে। এই আনন্দে সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে নেওয়ায় উনারা সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।’
তিন বাহিনী প্রধানদের এই যৌথ উপস্থিতি উৎসবকে আরো বর্ণাঢ্য এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি, ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তিনি আরো বলেন, ‘আজকের এই জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে আদর্শ, সেই আদর্শ এখান থেকে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। এই আদর্শের ভিত্তিতে আমরা এই দেশে সুন্দরভাবে একসঙ্গে বাস করব। এই আনন্দ মিছিল ১৯ ও ২০ শতকে একসময় এক সঙ্গে হতো। একদিকে হিন্দুদের রথ যাত্রা উৎসব অন্যদিকে মুসলমানদের তাজিয়া মিছিল , চলতো ঘন্টার পর কোন অসুবিধা বা বিশৃংখল পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না তারপর ধীরে ধীরে এটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইদানিং আবার শুরু হয়েছে।আশা করি, এই উৎসব ও মিছিল সব সময় জারি থাকবে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান আশ্বস্ত করেন সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে যত ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা চান, ইনশাআল্লাহ সেটা তারা দেবেন।
সেনাপ্রধানের মতে আজকের এই অনুষ্ঠানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত আছেন, তাদের মাধ্যমে আজকের এই সম্প্রীতির বার্তা সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে।
সবাই ভালো থাকবেন। তিনি বলেন আজকের অনুষ্ঠানের এই এলাকা আমার স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। আজিমপুর, পলাশীতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি। সবার মঙ্গল কামনা করছি।’
অনুষ্ঠানে সবাইকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসের আহবান জানিয়েছেন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। এই আদর্শের ভিত্তিতে আমরা সুন্দরভাবে এ দেশে একসঙ্গে বসবাস করব। শ্রীকৃষ্ণ যেন সমাজে ন্যায় ও আলোর সত্য প্রজ্বালন করেন। আসুন, পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে দেশকে আরো শক্তিশালী করি।’
বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা শুধু অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসই জোগায় না, ন্যায়ের পথেও চলতে শেখায়। আমরা সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। কখনো ধর্মীয় ভেদাভেদ আমাদের মধ্যে কাজ করেনি। এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব।’ সবাই মিলে কাজ করলে বিশ্বের মানচিত্রে এই বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উল্লেখ্য যথাযথ মর্যাদা ও হিন্দু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি ‘শুভ জন্মাষ্টমী’ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। গীতাযজ্ঞ, নামসংকীর্তন, কৃষ্ণপূজাসহ নানা আয়োজনে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে রাজধানীর ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় এবং আনন্দঘন পরিবেশে হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসব উদযাপন করেছে।উদ্বোধনী বক্ত্যব্য শেষে প্রদীপ প্রজ্ব্বালনের মধ্য দিয়ে তিন বাহিনীর প্রধানরা জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশেই আজিমপুর দায়রা শরীফে প্রস্তুতি চলছিল মুসলমানদের ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ উদযাপনের প্রস্তুতি।
আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহর’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহর সোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে। কিন্তু কেন? জেনে রাখা দরকার :-
সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে ওঠার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।পারসিক প্রভাবিত অঞ্চলসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বহু যুগ ধরে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এ অঞ্চলের সুফি-সাধকসহ দিল্লি সালতানাতের শাসকবর্গ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আখেরি চাহার সোম্বা পালন করতেন।
আমরাও দেখতে পেয়েছি যথাযোগ্য মর্যাদায় তা উদযাপিত হয়েছে। এবং দুই ধর্মের দুইটি উৎসব মহা ধুমধামে যার যার সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকে সম্পাদন করতে পেরেছেন আয়োজকেরা।
এবার আসি অন্য আলোচনায়,
সামনে নির্বাচন সমাগম, সেনাবাহিনীকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় আসন্ন নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দায়িত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন সুশীল সমাজ। এ প্রসংঙ্গে
সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে এত দীর্ঘ সময় মাঠে থাকতে হয়নি। তাই সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দূরত্ব থাকলে তা দূর করতে হবে।’ সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে দান কালে এ কথা বলেন সেনাপ্রধান।
উক্ত অনুষ্ঠানে পদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। এসময় সব সেনা স্থাপনার কর্মকর্তারা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন সেনাসদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইস্যুতে নানা কটূক্তির জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এসব মন্তব্যে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম। তারা আমাদের সন্তানের বয়সী। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে।’
সেনাপ্রধান আরো বলেন, ‘সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন। মাঠে দায়িত্ব পালনের সময় পেশাদারি দেখাতে হবে। প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না।’নাম উল্লেখ না করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘একজন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ তদন্তাধীন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না।আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে। নৈতিক স্খলনের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সেনাপ্রধান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সতর্ক করে বলেন, ‘একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই কেউ যাতে অপরাধে জড়াতে না পারে, সে বিষয়ে আগেভাগেই খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সেটি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।’
অতএব আমাদের সকল শ্রেনীপেশার জনগণকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে নির্দিষ্টহারে অংশগ্রহণ এর ভিত্তিতে এই দেশে আসন্ন নির্বাচনকে দ্রুত সুষ্ঠ এ সার্থক করে একটি সরকার গঠনে সক্রিয় থাকতে হতে হবে ।
প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম এক সদস্য লাল পিঁপড়া ছোট অথচ পরিবেশে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এই ক্ষুদ্র প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা শুধুমাত্র এক পোকা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নিঃশব্দ এক প্রহরী। কিন্তু আজ এই নীরব প্রহরীর অস্তিত্ব বিপন্ন। অসংযত ও অবাধ শিকারে তারা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই তাদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।
পিঁপড়া সামাজিক, পরিশ্রমী ও চতুর প্রাণী। আমাদের দেশে খুদে পিঁপড়া, ডেঁয়ো পিঁপড়া, সুড়সুড়ে পিঁপড়া, বিষ পিঁপড়া, লাল পিঁপড়া ছাড়াও বহু প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। একটু কম বিষাক্ত বড়ো আকৃতির লাল পিঁপড়ারা বন্য এবং দলবেঁধে গাছের মাথায় বাসা বানিয়ে থাকে। ভাওয়াল ও মধুপুরের গজারী বনে গাছের মাথায় এদের বাসা বেশি দেখা যায়। এ এলাকায় স্থানীয় নাম ‘গজারী কুত্তা’। অনেকে ‘রামকুত্তা’ ‘কুড়িলের’ বলেও ডাকে। তাছাড়া সারা দেশে আম, লিচু, মেহগিনি গাছসহ অনেক গাছেই লাল পিঁপড়ার বাসা চোখে পড়ে। ওখানেই জীবনচক্রের ধাপগুলো সম্পূর্ণ করে।
বিচিত্র এদের জীবন। দলবদ্ধভাবে রানির অধীনে বাসা তৈরির কাজ করে ওরা। গাছের মগডালে প্রথমে অনেকগুলো পাতা জোড়া দিয়ে বল আকৃতির বানায়। লালার সাহায্যে এক রকম আঠা তৈরি করে পাতা জোড়া লাগায়। শক্ত চোয়াল দিয়ে পাতা মুড়িয়ে গোল করার আগে ভেতরে আলাদা আলাদা কুঠুরি বানায়। কর্মী পিঁপড়ারা ভবিষ্যতের খাবার সংগ্রহ করে রাখে। গোল আকৃতির বাসা এত মজবুত হয় যে বৃষ্টির পানি পর্যন্ত ভেতরে ঢোকে না। বসন্তকালে একটি কলোনিতে বেশ কিছু পুরুষ ও রানি পিঁপড়া জন্ম নেয়। এই সময় উভয়ের ডানা গজায়। এক সময় বাইরে এসে বংশ বৃদ্ধির জন্য ঝাঁক বেঁধে উড়াল দেয়। মিলনের পর নতুন রানি ডিম পেড়ে পৃথক কলোনির সৃষ্টি করে। ডিম দেখতে চিকন সাদা মুড়ি বা ভাতের মতো দেখায়। বেশি ডিম পাওয়া যায় শীতের শেষে। মাছ ধরার টোপের জন্য লাল পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা বেশি। লাল পিঁপড়ার ডিমের টোপ বড়ো মাছেরা সহজেই গেলে। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই ডিমের চাহিদা বেশি।
লাল পিঁপড়া শুধু একটি ক্ষুদ্র পোকা নয়; তারা বন্যপ্রাণী হিসেবে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বনের গাছে, মাঠে, মাটির নিচে, এমনকি মানব আবাসের আশপাশেও তারা বাসা গড়ে দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করে। রানির নেতৃত্বে পিঁপড়ারা জটিল সামাজিক ব্যবস্থা মেনে কাজ করে; খাদ্য সংগ্রহ, বাসা নির্মাণ, বংশবৃদ্ধি সবকিছুই দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়।
তাদের বাসা সাধারণত গাছের উপরের পাতাগুলো থেকে তৈরি হয়, যেখানে পাতা একত্র করে লালা দিয়ে শক্তিশালী বাসা বানানো হয়। বসন্তকালে ডানা গজিয়ে তারা উড়াল দিয়ে নতুন কলোনি গড়ে বংশ বিস্তার করে।
পরিবেশে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম ও বহুমাত্রিক। প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি তার অবিস্মরণীয় ভূমিকার মাধ্যমে জীবজগতে সমতা ও সুষমতা বজায় রাখে। প্রথমত, লাল পিঁপড়া কৃষিক্ষেত্রে এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা শুঁয়োপোকা, মশা, মাছি ও অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিস্তার রোধ করে, যা আমাদের ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান উন্নত করে। এই কারণে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পায়। পরিবেশে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং জলবায়ুর ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, তাই লাল পিঁপড়ার এই প্রাকৃতিক ভূমিকা পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিকভাবে, লাল পিঁপড়া পরিবেশের এক নীরব কর্মী, যারা আমাদের কৃষি, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রাখে। তাই তাদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও আইনগত ব্যবস্থা, যাতে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদটি আগামী প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
অপরিকল্পিত শিকার ও রাসায়নিক ব্যবহার লাল পিঁপড়ার বিপন্নতার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীকে ধ্বংস করতে অবাধ শিকার চালানো হয়, যা তাদের প্রজাতি সংকটের মুখে ফেলে। পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রে ও পরিবেশে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগ করা হয়, যা লাল পিঁপড়াসহ অন্যান্য গুণান্বিত জীবজন্তুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, ফসলের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। তাই, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য লাল পিঁপড়াসহ প্রাকৃতিক জীবজগতের সুরক্ষা ও অবাধ শিকার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা
লাল পিঁপড়া বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অতি মূল্যবান উপাদান হলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নেই, যার ফলে তারা সঠিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অবৈধ শিকার রোধে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। লাল পিঁপড়ার উপর সুনির্দিষ্ট আইনগত সুরক্ষা না থাকায় তাদের বাসস্থান বিনষ্ট হওয়া, অবৈধ শিকার ও পরিবেশ দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হলে অবৈধ শিকার ও বাসস্থান ধ্বংস প্রতিরোধ সম্ভব হবে, যা লাল পিঁপড়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সমাজে তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কার্যকর মনিটরিং ও সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধও বৃদ্ধি পাবে, যা টেকসই উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। তাই লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে সফলতা অর্জনের জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে করণীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যার মধ্যে অন্যতম হলো আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ, যা লাল পিঁপড়াকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। এতে বাসস্থান রক্ষা, অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং জরিমানা বিধানসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। একই সঙ্গে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় লাল পিঁপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃতির এই অনন্য উপাদানের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারে। এছাড়াও, ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশবান্ধব আয়সূত্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা তাদের জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত করবে। বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য লাল পিঁপড়ার জীবনচক্র, বাসস্থান, প্রজনন ও বিপদ নির্ণয়ের ওপর নিয়মিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সবশেষে, স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকৃতির সুরক্ষায় তাদের দায়বদ্ধ করা হলে সংরক্ষণ কার্যক্রম অধিক কার্যকর ও টেকসই হবে। এই সমন্বিত উদ্যোগেই লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে বাস্তব পরিবর্তন আসবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে কার্যকর ও টেকসই ফলাফল অর্জনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এর আওতায় প্রথমত, লাল পিঁপড়ার ঘন ঘন আবাসস্থলগুলো সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যা সংরক্ষিত জোন হিসেবে পরিচিত হবে এবং সেখানে বিশেষ সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, ডিম আহরণ বা পিঁপড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, যাতে অবৈধ শিকার ও অতিরিক্ত আহরণ রোধ করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। তৃতীয়ত, অবৈধ শিকার, বাসা ভাঙা ও পরিবেশ বিনষ্টের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণ করে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের deterrent হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষ, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত পরিবেশ মনিটরিং ও প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে লাল পিঁপড়া সংরক্ষণের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব হবে। এইসব উপাদান নিয়ে গঠিত একটি সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো লাল পিঁপড়া সংরক্ষণে একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করবে এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
সেলিম রানা,
গণমাধ্যম কর্মী ও কলামিস্ট
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমঝোতার অভাব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সব সময়ই সংকটময় করে তোলে। বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে ঘিরে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। সেনাবাহিনী সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সংবেদনশীল নাম। কারণ জনগণের আস্থা, বাহিনীর শক্তি এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য শুধু সেনাসদস্যদের উদ্দেশে নয়, বরং জাতির উদ্দেশে একটি পরোক্ষ বার্তাও বটে। এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জাতীয় নির্বাচন, সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া। তিনি সেনাসদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশ এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই কথার মধ্যে শুধু একটি অনুপ্রেরণা নেই, বরং এর মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা রয়েছে যে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালনে কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট হবে না। বাংলাদেশে অতীতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় একটি প্রত্যাশা কাজ করেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিলো গৌরবান্বিত। এবার সেনাপ্রধান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাহিনী কেবল রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে কাজ করবে, কোনো দলের হয়ে নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন এবং দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না। নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে সেনাদের উপস্থিতি জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক হলেও, একই সঙ্গে এটি এক ধরনের অনেকেরই ভয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায় তারা বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং যে কোনো মূল্যে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তাই সেনাপ্রধানের এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে বাহিনীকে অবশ্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এটি কেবল নির্বাচন নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই বাহিনী নিয়ে নানা মন্তব্য, সমালোচনা এমনকি অপপ্রচার চালানো হয়। সেনাপ্রধান এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব মন্তব্যে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। যারা করছে, তারা অনেকেই তরুণ এবং তাদের বয়স সেনা সদস্যদের সন্তানের বয়সি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এই ধৈর্যশীল মনোভাব বাহিনীর মনোবল রক্ষা করার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। কারণ সেনাবাহিনী যদি সমালোচনার মুখে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাত, তবে তা গণমানুষের সঙ্গে অযাচিত দূরত্ব তৈরি করত। বরং সহনশীল মনোভাব দেখিয়ে সেনাপ্রধান এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন—সেনাবাহিনী জনগণের বিপরীতে নয়, বরং জনগণের সঙ্গেই আছে।
বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার বিষয়েও সেনাপ্রধান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এক সেনাসদস্যের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে এবং প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইভাবে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগও তদন্তাধীন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে কোনো অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না। এখানে দুই দিকের বার্তা রয়েছে, একদিকে সেনাবাহিনী কোনো অনৈতিকতা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সহ্য করবে না, অন্যদিকে বাহিনীর সদস্যদের অধিকার ও ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা হবে। এই ভারসাম্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই আলোচনায় থাকে। জনগণ প্রায়শই আশা করে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে, জালিয়াতি বা অনিয়ম কম হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে অভিযুক্ত করে থাকে যে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। সেনাপ্রধান এই প্রেক্ষাপটে ঘোষণা দিয়েছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন, যা এর আগে হয়নি। তাই জনগণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এখন জরুরি।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার নির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের সময় বাহিনী কেবল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে না, বরং মানুষের আস্থা অর্জন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি জনগণ সেনাদের উপস্থিতিকে আশ্বাস হিসেবে না দেখে, বরং ভয় হিসেবে দেখে, তাহলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেনাপ্রধানের বার্তা ছিল আস্থা ফিরিয়ে আনার কৌশল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক অস্থির বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এখনো মীমাংসিত হয়নি। জনগণের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কোন পথে হাটবে এবং কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন হবে কি না। যদিও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বারবার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেই আস্থার প্রতিশ্রুতি বহন করে। তিনি আগেই বলেছিলেন, নির্বাচনের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করবে একটি নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমাধানের অংশ নয়, বরং একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করবে। কেবল নির্বাচনই নয় সেনা প্রধান তার বক্তব্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তা হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিবর্তে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি কেবল সেনাবাহিনীর জন্য নয়, দেশের সার্বিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—অপরাধ দমনে প্রতিরোধই প্রধান সমাধান।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রসঙ্গও তিনি তুলেছেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। এই বার্তা শুধু সেনা সদস্যদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা বোঝাচ্ছে, বাহিনী এসব প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেবে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেস ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে সেনাসদস্যদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে সেনাবাহিনী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বক্তব্য এক ধরনের স্থিতিশীলতার বার্তা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কারণ নির্বাচনের সময় কেবল সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহনশীল না হয়, তবে সেনাবাহিনী যতই পেশাদার হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবেই। তাই সেনাপ্রধানের বার্তাটি আশ্বাসজনক হলেও, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিলতা তা কতটা বাস্তবায়িত হতে দেবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
সব মিলে বলা যায়, সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দিকনির্দেশনা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তাও। তিনি পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের ওপর জোর দিয়ে জাতিকে এক ধরনের আস্থা দিতে চেয়েছেন। যখন রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিভাজন ও অবিশ্বাস তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বার্তা জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেনাবাহিনী দেশের জন্য, কোনো দলের জন্য নয়। আর সেই কারণেই এই বক্তব্য বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাদা পাথরে কালো হাত পড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জের ‘সাদাপাথর’। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ, যেন এক বিরাণভূমী। এই নজিরবিহীন পাথর লুটের ঘটনায় দেশবাসী হতবাক। এক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আরো সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল। এদিকে পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক দুই শত কোটি টাকার উপরে। এটি সত্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পাথর লুট শুরু হলেও এতদিন নিস্ক্রিয় ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ এক বছর ধরে সাদা পাথর লুটপাট চলেছে। এখন বলতে গেলে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর বাংলাদেশের আলংকারিক সৌন্দর্যের একটি অনন্য প্রপঞ্চ।
যতদূর চোখ যায়, কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ পানি, ওপরে নীল আকাশ, আর সবুজ পাহাড়ে মেঘের আলিঙন। সেহেতু যে ভাবেই বলি না কেন, এটি প্রকৃতির এক অপরূপ স্বর্গরাজ্য। বস্তুত সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে প্রকৃতির এই রূপের আধার হলো উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এখানের সাদা পাথর, রোপওয়ে, পাথর কোয়ারি, আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ধলাই নদের বুকে স্বচ্ছ পানি, আর সাদা পাথরের মুগ্ধতায় মন ভরে যায় পর্যটক’সহ সবার। এটি লক্ষ্যনীয় যে যে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে সাদা পাথর। মনে হয় যেন, প্রকৃতি শুভ্র বিছানা বিছিয়ে রেখেছে। মাঝখানে স্বচ্ছ ঢেউ খেলানো নীল পানি। চারদিকে ঘিরে আছে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়; আর তার ওপর যেন আছড়ে পড়েছে মেঘ। এতদ্ব্যতীত চারপাশে আছে সবুজ প্রকৃতি। সব মিলিয়ে প্রকৃতির যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এই অপূর্ব স্থানটি উপভোগের জন্য ছুটে আসেন এই সাদা পাথরের দেশে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভোলাগঞ্জ সীমান্তে প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা। একদিকে যোগানদাতা হিসেবে ধলাই নদের পানি। অন্যদিকে ঝরনার পানি প্রবাহ ভোলাগঞ্জকে রূপে রানী করে সাজিয়ে তুলেছে। তাছাড়া সবুজ পাহাড় ও সাদা-কাল মেঘের হাতছানি। বস্তুত বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুনে। বর্ষায় এই নদের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা পাথরের বিছানা নদীর শোভা বাড়িয়ে তুলে। তাছাড়া সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায়।
২০২১ সালে আমার এখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের উৎস মুখের পাথর পরিবেষ্টিত জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা সাদা পাথর নামে পরিচিত। আসলে সাদাপাথর এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তূপের কারণে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে তৈরি এ স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে অভিহিত। মজার ব্যাপার হলো যে, ধলাই নদ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে চারপাশ ঘুরে আবার মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ধলাই নদের পানির সঙ্গে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর সাদা পাথর নেমে আসে। আর এই পাথর উত্তোলনকে সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোলাগঞ্জ থেকে সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ এই রোপওয়ে চলে গেছে ছাতক পর্যন্ত, যা ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে রোপওয়ের টাওয়ারগুলো কেবল কালের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। রোপওয়ে বন্ধ হলেও থেমে নেই পাথর উত্তোলন। এখনো অনেক স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস এই পাথর উত্তোলন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে সাদা পাথর তুলে নিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত সাদা পাথর কংকাল সার করে তুলেছে। এই পাথর লুট নিয়ে পাল্টাপাল্টি অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আইনগতভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নাকি করা হয়েছে বলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করছেন। তথ্যমতে জানা যায় যে, পাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরিপূর্বক ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদা পাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পূনস্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আবার প্রতিপাদ্য কথাই ফিরে আসি। সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পট সাদা পাথর এখন বিরাণভূমি। কোথাও আর পাথর নেই। উল্লেখ্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদা পাথর এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ছবি ভাইরাল হয়। তারপর থেকেই দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমালোচনা ও প্রতিবেদনকে তোয়াক্কা না করেই দেখা গিয়েছে যে শত শত ট্রাকে সাদা পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান একটি পত্রিকাকে বলেন, সাদা পাথর লুটের ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ১৯১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আছে আরও ৩১০ জন। এরমধ্যে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। সাদা পাথর লুট হওয়া নিয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা চাই একটি পাথরও যেন লুট না হয়। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এর মধ্যে ১৭/০৮/২০২৫ তারিখের আর একটি পত্রিকায় দেখলাম ৩২টি মামলা হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে ১৭ জনের নাম বার বার আসছে।
প্রকাশ থাকে যে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেতো, দেখা যেতো সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। অথচ সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি। বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়েছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পূর্বেও কিছুটা উল্লেখ করা হলেও আবারও বিশ্লেষনের জন্য আলোকপাত করতে হচ্ছে। বস্তুত সিলেট নগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। ঠিক এক বছর আগেও এই স্থানের সৌন্দর্যের সুবাদে হৃদয় আবেগময় হয়ে কবি মন হয়ে দাঁড়াতো। কেননা ‘যতদূর চোখ যায়, দুই দিকে কেবল সাদা পাথর, আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল আরেকদিকে পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। মনে হতো কাশ্মীরের মতো স্বর্গরাজ্য। সৌন্দর্যের যেন এক অনবদ্য ক্যানভাস।’ কিন্তু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবস্থা নেয়ার পরও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কি না, সে ব্যাপারে অনেকে সংশয় পোষন করে থাকেন।
সত্যি কথা বলতে কি, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে মূলত সাদা পাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনের স্থবিরতা বা ভীতিই এই পাথর লুট হওয়ার কারণ। আসলে প্রশাসনের কঠোর না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা উক্ত স্বচ্ছ পানির আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়। এদিকে এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ংকর রকম তোড় তৈরি হয়। এর মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি, সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে এদিক ওদিক প্রবাহপূর্বক টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ।’ শুধু তাই নয়, পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোন ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হলে, তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। এটি সত্য যে, ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি। আর এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতি তৈরির অভিঘাত সৃষ্টির পথ সুগম করে। তাই সঙ্গতকারণেই যথেচ্ছার ভাবে পাথর লুট বা সরানো মোটেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যে সাদা পাথর লুট হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ঠিক চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এর ন্যায়। যাহোক, এই সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিয়ামক নয়। এর সুবাদে পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, ভবিষ্যতে যাতে এ রকম অনাহুত নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সে ক্ষেত্রে সবাই সজাগ থাকতে হবে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। আর এর পেছনে, বাইরের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তাও তলিয়ে দেখতে হবে।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
মন্তব্য