বিশ্বায়নের এই সময়ে সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন বাড়তি গতি। তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেকে পিছিয়ে পড়ছে; হারিয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে অন্যরা। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ক্ষেত্র।
সংবাদমাধ্যমেও ঘটে চলেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। প্রযুক্তিতে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। সংবাদপত্রের পাতা ও টেলিভিশনের পর্দা থেকে পাঠক-দর্শকের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে ভর করে সামনের দিনগুলোতে সংবাদমাধ্যম কোন পথে ধাবিত হবে, সেই উপলব্ধি থেকেই জন্ম ‘নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম’-এর। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশের পর সংবাদমাধ্যমটি ইতোমধ্যে পাড়ি দিয়েছে তিনটি বছর।
সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ বর্ষে হাঁটা শুরু করল নিউজবাংলা।
‘খবরের সব দিক, সব দিকের খবর’ স্লোগানকে ধারণ করে যে আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা থেকে কখনোই বিচ্যুত হয়নি এই নিউজ পোর্টাল। হাজারো খবরের ভেতর থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটি বের করে সবার আগে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করে চলেছেন প্রতিষ্ঠানের সংবাদকর্মীরা।
খবরকে খবরের মতো করেই তুলে ধরার চেষ্টা থেকেছে সবসময়। তাতে রং চড়ানো বা নিজস্ব মতামত যুক্ত করে পাঠকের কাছে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা থাকেনি কখনোই।
খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে এর বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছে; কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বড় বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাই করে চলেছে নিউজবাংলা।
নীতি-আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলার সময়টাতে সতত পাশে থেকেছেন বোদ্ধা পাঠক। তারা সাদরে গ্রহণ করেছেন শুভ এই প্রয়াসকে। মতামত দিয়ে উৎসাহিত করেছেন। সে সুবাদে বেড়েছে পরিচিতি। দিনে দিনে বেড়েছে পাঠক। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন পাঠকশ্রেণি। ভারি হয়েছে অর্জনের পাল্লা।
নিউজবাংলার তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে এসে যতটুকু অর্জন ও অগ্রগতি, তার বড় অংশই প্রাপ্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মালিক কর্তৃপক্ষের। তারা পাশে থেকেছেন বলেই দায়িত্বরত সংবাদকর্মীরা স্বাধীনভাবে লিখতে পেরেছেন। পাঠক পেয়েছে প্রকৃত খবরটি।
নিউজবাংলার প্রাণভোমরা প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা-মালিক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সংবাদকর্মীর কাছে তিনি প্রিয় নাফিজ ভাই।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মহান মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে কোনো আপস নয়—এটাই হলো তার প্রথম নির্দেশনা। এর বাইরে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে তিনি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের দিয়েছেন অবারিত স্বাধীনতা।
সত্য প্রকাশে তার পক্ষ থেকে কখনোই বাধা আসেনি; বরং তিনি উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের অযাচিত কোনো চাপ এলে তিনি সামনে থেকে মোকাবিলা করে যাচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। প্রতিষ্ঠান সাবলীলভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই সহায়তার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন।
নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রকাশক শাহনুল হাসান খান, যার সার্বক্ষণিক সতর্ক দৃষ্টি থাকে এই পোর্টালে। প্রকাশিত খবরে কোনো ভুল, অসঙ্গতি বা ঘাটতি দেখামাত্র তিনি হাতে তুলে নেন টেলিফোন। ও প্রান্ত থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্বশীল সংবাদকর্মীদের ধরিয়ে দেন খবরের অসম্পূর্ণতা বা বিচ্যুতি। আর সে সুবাদে পাঠক পায় সর্বাঙ্গীন নির্ভুল খবর।
চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত দৈনিক বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের কণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত নন এমন মানুষ দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে প্রখ্যাত এ ক্রীড়া ধারাভাষ্যকারের।
ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক বাংলার পাশাপাশি নিউজবাংলার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত। সে সুবাদে এই নিউজ পোর্টালের কর্মীরা পেয়েছেন একজন প্রাণপ্রিয় অভিভাবক।
বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মৃদুভাষী মানুষটির ধীরস্থির ভাবনা, সিদ্ধান্ত ও সময়োপযোগী নির্দেশনা নিউজবাংলার পথচলায় বাড়তি উদ্যম এনেছে। প্রতিটি কর্মী তার কাজের প্রতি হয়েছেন আরও আন্তরিক। তার স্নেহমাখা নির্দেশনায় কর্মীরা কাজের প্রতি হয়েছেন আরও আন্তরিক।
সাফল্যমাখা দীর্ঘ কর্মময় জীবনে চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত সাংবাদিকতা পেশায় সেভাবে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে জানার ব্যাপ্তি ও কর্মোদ্যম দিয়ে তিনি সুচারুভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন দেশের প্রথম সারির দুটি সংবাদমাধ্যমকে। তার দিকনির্দেশনা থেকে সংবাদকর্মীরা প্রতিনিয়ত শিখছেন নতুন আঙ্গিকে, নতুনভাবে। আর তাতে সমৃদ্ধ হচ্ছে নিউজবাংলা।
কাজপাগল আরেক ব্যক্তিত্বের নাম বিশেষভাবেই নিতে হয়। তিনি হলেন নিউজবাংলা ও দৈনিক বাংলার নির্বাহী পরিচালক আফিজুর রহমান। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক ব্যস্ত রয়েছেন প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দিক নিয়ে।
কোনো প্রতিষ্ঠান সুচারুরূপে চলতে গেলে তার আয়ের দিকটি বড় একটি বিষয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমান সে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়ে চলেছেন। আর তাতে শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
নির্বাহী পরিচালকের সতর্ক দৃষ্টি থাকে নিউজপোর্টালের খবরেও। গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কি না, দায়িত্ব পালনে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো ঠিকমতো নেয়া হচ্ছে কি না- এমন নানা বিষয়ে থাকে তার সতর্ক দৃষ্টি।
তৃতীয় বর্ষপূর্তির এই ক্ষণে এবার কথা বলতে হয় নিউজবাংলার পথপরিক্রমা নিয়ে। যাত্রার শুরু থেকে এ পর্যন্ত সুযোগ্য অনেক সংবাদকর্মী যুক্ত হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। তাদের অনেকে চলে গেছেন। আবার নতুন করে যুক্ত হয়েছেন অনেকে।
নিউজবাংলার যাত্রাটা হয়েছিল অভিজ্ঞদের পাশাপাশি একঝাঁক তরুণ সংবাদকর্মীকে নিয়ে। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম নিতে হয় সঞ্জয় দে’র। বার্তাপ্রধানের চেয়ারে বসে তিনি যোগ্যতার সঙ্গে পুরো টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নির্বাহী সম্পাদক হাসান ইমাম রুবেল, পরিকল্পনা সম্পাদক শিবব্রত বর্মণ ও প্রধান বার্তা সম্পাদক ওয়াসেক বিল্লাহ আল ফারুক সৌধ’র।
বিশেষ সংবাদদাতা আবদুর রহিম হারমাছি, বাণিজ্য সম্পাদক আবু কাওসার, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক রুবায়েত ইসলাম (ক্রীড়া), প্রধান প্রতিবেদক তানজীর মেহেদী, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আজহারুল ইসলাম, মুস্তফা মনওয়ার হাশেম সুজন, ভিজ্যুয়াল টিমের মোস্তাফিজুর রহমান ও আইটি বিভাগের অর্ণব- বলতে হয় তাদের কথাও।
এস এম নূরুজ্জামান, ইমতিয়াজ সনি ও বনি আমিনের সমন্বয়ে গড়া ‘ইনভেস্টিগেটিভ সেল’-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো নিউজবাংলার পথচলাকে আরও গতিশীল করেছে।
বস্তুত নিউজবাংলা টিমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেধার সমাবেশ ঘটেছে, যাদের সম্মিলিত চেষ্টাতে প্রতিষ্ঠানটি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। নিউজ পোর্টালটিকে পাঠকপ্রিয় করে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সুযোগ্য এই সংবাদকর্মীদের অনেকেই বর্তমানে নিউজবাংলার সঙ্গে নেই। ছড়িয়ে পড়েছেন মিডিয়া জগতের নানা স্থানে। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার্থে ও কর্মের তাগিদে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
অনুরূপ অনেক প্রতিভাবান, অভিজ্ঞ ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্য সংবাদকর্মী যুক্ত হয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানে। সমাবেশ ঘটেছে একঝাঁক তারুণ্যের। সম্মিলিত চেষ্টা আর অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করে চলেছেন তারা। সে সুবাদে পাঠক পাচ্ছেন ভিন্ন আঙ্গিকের নতুন নতুন খবর। পথচলায় গতি বাড়ছে নিউজবাংলার।
নিউজবাংলার সাফল্যগাঁথা নিয়ে কিছু বলতে গেলে গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করতে হবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় সাংবাদিকদের। ব্যুরো, অফিস ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্বরত এ সংবাদকর্মীরা এককথায় নিউজবাংলার প্রাণ। দায়িত্ব পালনে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। নিত্যদিন জোগান দিচ্ছেন নতুন নতুন খবরের। নানামুখী প্রতিকূলতা, ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা তুলে আনছেন খবরের ভেতর থেকে খবর। প্রতিভাবান ও কর্মঠ এমন কর্মীবাহিনী পেয়ে গর্বিত নিউজবাংলা।
অনলাইন নিউজ পোর্টালকে বলা হয় ‘নিউজ হাব’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে আরও বেশি করে খবরমুখী করেছে। বেড়েছে পাঠকের চাহিদা। যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। সেই চাহিদা পূরণে নিউজবাংলা দেশ-জাতির গুরুত্বকে সামনে রেখে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নিউজবাংলা পাঠক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারছে তার প্রমাণ মেলে পাঠকের সাড়ায়। দিন দিন বাড়ছে এই পোর্টালের পাঠক সংখ্যার ব্যাপ্তি। আর তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও নতুন কিছু পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়াশ পাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের অকৃপণ সহায়তা এবং কর্মীবাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় নিউজবাংলা এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে- এমনটা প্রত্যাশা।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম
আরও পড়ুন:যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে আগে দুটি দলকে চিঠি দিয়ে যে শর্তহীন সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তা কোনো ভাবেই কাকতালীয় বা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়, বরং গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস বলেই মনে হচ্ছে ।
নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইট অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১, তার মধ্যে ফরমায়েশি চিঠি পেলো মাত্র দুটো দল, আওয়ামী লীগ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি প্রাপ্তির কথা জানায়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে যে নিঃস্বার্থ সংলাপ মোড়লরা চাচ্ছেন, তাহলে বাকি ৩৮টি নিবন্ধিত দল কী দোষ করল?
তারা দেশে প্রচলিত আইন মেনে নিবন্ধিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে এই ৩ দলের বাইরে দেশে আর কোনো দল নেই বা তাদের হিসেবে তারা দল নয়? শর্তহীন সংলাপ চাইলেন ভালো কথা একটিবার চিঠিতে সহিংসতা বন্ধের কথা বললেন না কোনো? নাকি সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস আপনাদের আইনের শাসনের বাইরে?
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর থেকে গত ১৭ দিনে বিএনপির হরতাল-অবরোধে সারা দেশে অগ্নিসংযোগের ১৫৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩৫টি ঘটনায় পোড়ানো হয়েছে যানবাহন। আগুনে ৯৪টি বাস, ৩টি মাইক্রোবাস, ২টি প্রাইভেটকার, ৮টি মোটরসাইকেল, ১৩টি ট্রাক, ৮টি কাভার্ড ভ্যান, ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ২টি পিকআপ, ২টি সিএনজি, ১টি নছিমন, ১টি লেগুনা, ফায়ার সার্ভিসের ১টি পানিবাহী গাড়ি, ১টি পুলিশের গাড়ি, বিএনপির ৫টি অফিস, আওয়ামী লীগের ১টি অফিস, ১টি পুলিশ বক্স, ১টি কাউন্সিলর অফিস, ২টি বিদ্যুৎ অফিস, ১টি বাস কাউন্টার এবং ২টি শোরুম পুড়ে যায়।
গত ১৭ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৫টি করে বাস পোড়ানো হয়েছে। বিএনপি কার্যত মাঠে নেই, আন্দোলনের নামে তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই চোরাগোপ্তা হামলা এবং আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে কী করে সংলাপ হতে পারে? আপনি যদি রাজনৈতিক সচেতন হন, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন গত এক কয়েক মাসে বিএনপির আল্টিমেটাম আর দফার শেষ নেই। একবার ২৭ দফা, একবার ৩১ দফা, সর্বশেষ ১ দফাসহ নানা কথা বলছে দলটি।
একবার বলছে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। একবার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। একবার বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। এখন পিটার হাসের সংলাপের ওপর ভর করেছে তারা। বিএনপি আসলে কী চায়? বিএনপির সর্বশেষ ঘোষিত কমিটিতে চেয়ারপার্সনের ৭৩ জন উপদেষ্টা আছেন, আমার কৌতূহল হয় তারা আসলে কি উপদেশটা দেন ! যে দলটি একসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অপরিপক্ব নেতৃত্ব দেখে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার সত্যি কষ্ট হয়।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ইতিহাস সুখের নয়, তাদের সঙ্গে যখনই সংলাপের কথা এসেছে, তখনই হয় সংলাপ বর্জন করেছে অথবা শর্ত জুড়ে দিয়ে তা বানচাল করে দিয়েছে। এরা ২০১৪-তে সংলাপে অংশ নেয়নি অন্যদিকে ২০০৭ ও ২০১৮ তে সংলাপে বসলেও শর্ত জুড়ে দিয়ে মিথ্যাচার করে সংলাপগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিন্তু ১৫ অক্টোবরেই শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তা নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, শর্তহীন সংলাপে রাজি নয় বিএনপি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে ‘শর্তহীন সংলাপ’ হতে পারে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় আলাপ-আলোচনা করার জন্য নির্দেশ দেন, বিএনপি তার প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ইলেকশন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার পর ধারাবাহিক ভাবে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার জন্যে বসেছে, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ডাকে একবারও সভায় যোগদান করেনি।
তারা সেখান গেলে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিলে, কমিশন যদি না শুনতো বা না বাস্তবায়ন করতো তারা তখন সেটা নিয়ে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে পারতো কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে শুধু দোষারোপের রাজনীতি করলে তো আপনি জনগণের সমর্থন পাবেন না । মানুষকে বোকা বানানো এখন আর সহজ না, গ্রামের চায়ের দোকানে বসে তারা মেগাবাইট গিগাবাইটের হিসেবে করে, নির্বাচনে কারচুপির জন্যে ক্যাপিটল হিলের ভাঙচুরের বিষয়ে তারা তর্ক করে।
সুতরাং আপনার আন্দোলনের বিষয়বস্তুর খবর ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে তারা একমুহূর্তেই পাচ্ছে , আপনি জনগণের মনে স্থান করে নিতে পারছেন না, কারণ জনগণের আস্থা অর্জন করার মতো কিছু আপনি করেনি, এখনও করতে পারছেন না। আপনাদের ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের আরব বসন্তের কথা মনে আছে নিশ্চই, তখন বিবিসিতে একটা প্রোগ্রাম দেখাতো ‘হাউ ফেসবুক চেঞ্জ দা ওয়ার্ল্ড’ অর্থাৎ ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে, আরব বসন্তের সময়ই প্রথম ফেসবুকে গ্রুপ খুলে মানুষকে একত্রিত করার মতো বিষয় ঘটেছিল।
আর তার একযুগ পর এখন পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম বর্তমান আর তাতে বিএনপি জামাতের কর্মীরা খুব সক্রিয়, মানুষ যদি তাদের বিশ্বাস করতো বা আন্দোলনে সমর্থন দিতো তাহলে কোনো বাধাই আর বাধা হতো না তাদের জন্যে। মানুষ আরব বসন্তের মতো রাস্তায় নেমে আসতো। আসলে মিথ্যা বা ষড়যন্ত্রের উপরে হওয়া আন্দোলন খুব বেশিদূর যেতে পারে না। নেতৃত্বহীন-ভেঙে পড়া বিএনপির এখন একমাত্র ভরসা বিদেশি প্রভুরা, জনগণ নয়। ডোনাল্ড লু আপনি সংলাপ চাইলেন একবার বিএনপির দণ্ডিত নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইলেন না কেন? সংলাপ কার সঙ্গে করা সম্ভব?
যে দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৭৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী সে দলের সঙ্গে? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন এবং দুর্নীতি ও অপরাধের অন্য চারটি মামলায় ২৮ বছরের কারাদণ্ড সহ মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ২১ আগস্টে ২৭ জন মানুষ হত্যা তো আছেই, তা ছাড়া বার বার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে বিএনপি। এমন একটি দলের সঙ্গে কী করে সংলাপ হতে পারে?
নির্বাচনের ট্রেন এখন প্লাটফর্মে, বিএনপি দল হিসেবে উঠতে না পারলে, তরুণ-প্রবীণ নেতৃত্বের অনেকেই সেই ট্রেনে উঠার জন্যে প্রস্তুত। বিএনপিকে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আসতে হলে অবশ্যই দণ্ডিত অপরাধীদের দল থেকে বের করে তারপর অন্য আরেকটি গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপের কথা বলতে হবে।
বিগত দুটো নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনের আগেও যে সহিংস পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত তৈরি করেছে তাতে তাদের সঙ্গে সংলাপের দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নয়। বরং তাদের উচিত সহিংসতা পরিহার করে সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেয়া, কোনো বিদেশি প্রভুর মাধ্যমে নয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উন্নয়নে তার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, যৌক্তিক মানসিকতা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তিনি এখন বিশ্বখ্যাত নেতা হিসেবে পরিচিত।
আওয়ামী লীগ সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার, প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেছে এবং অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটি জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য কাজ করে আসছে। এই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন মানুষের ভাগ্যের উন্নতি হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য দেয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে এবং তিনি জনগণের কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্ব বিস্মিত। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল থেকে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে এবং ২০৪১ সালে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার বড় প্রমাণ হলো গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় দেশ।
শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা ইতোমধ্যে একটা ধাপ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), তৃতীয়টি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা।
গত ১৫ বছরে দেশ পেয়েছে পদ্মা সেতু ও রেল সেতু। ঢাকা মেট্রোরেল, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের প্রতিশ্রুতি তিনি অসম্পূর্ণ রাখেননি।
এরমধ্যে রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়লেও তিনি এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে দেননি। নতুন সেতু ও সড়কের মাধ্যমে অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারিতে দলের অগণিত নেতা-কর্মী সবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। নৌকা দ্রুত গতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অন্ধকার থেকে এখন আলোর পথে।
শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা যিনি বিশ্বের কাছে আলোর আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শুধু একটি বিরল মাত্রাই দেননি, দেশে বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও জোরদার করেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রায়ই তাকে শুধু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, যা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের মতোই অতুলনীয় এবং তার অতুলনীয় নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিস্তৃতি তার প্রশংসা ছাড়া বোঝা যায় না।
অনেকের হয়তো মনে নেই যে, ২০২০ সালে শেখ হাসিনাসহ ১৮৯ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান মিলেনিয়াম ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। তিনি কেবল সেই ঐতিহাসিক দলিলের স্বাক্ষরকারী হিসাবে ইতিহাসে নিজের জন্য একটি স্থান তৈরি করেননি। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক অঙ্গীকারের অংশীদার করে তুলেছেন। সেই অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে তিনি বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ৮টি সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ১৯৯০ সালের ৫৮ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৮ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে কমে প্রতি হাজারে ২১ হয়েছে।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জন প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে ৬৯ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী দের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩১ জন, ভারতে ৩৮ জন, পাকিস্তানে ৬৭ জন।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং এই লক্ষ্যগুলি তার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, শিশু সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ও অভিনন্দন। আমরা সবসময় তাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থে কথা বলতে দেখেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আজ আমরা ২০৪১ সালের দিকে তাকিয়ে আছি, যখন আমরা বিশ্ব দরবারে উন্নত বিশ্বের অংশ হতে চাই। ভবিষ্যতের দুনিয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজ আমরা যে বিশ্বে বাস করছি, সেখানে বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা এবং অপর্যাপ্ততা বাড়ছে। সুযোগ যেমন আছে, তেমনি দুর্বলতাও তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যিনি শুধু তার দেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা- বিশ্বের আলো।
শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছেন। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চান শিক্ষার্থীরা শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করুক, বাকিটা সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী চান বাংলাদেশের শিশুরা শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হোক। উপযুক্ত শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি সবাইকে সত্যিকারের শিক্ষিত শিশু হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তিনি সংখ্যালঘুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা দেশবাসীর সেই স্বপ্ন সঠিক পথে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগের নৌকাকে দৃঢ় করে দেশের মানুষ আজ সুখ-সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী নারীদের বুকের দুধ সরবরাহকারী ভাতা ইত্যাদি চালু করা হয়েছে।
সবার কল্যাণই শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত নীতি। ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। নৌকার কারণে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ওই রেজুলেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে বলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশন জানিয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরি করায় জাতিসংঘের স্বীকৃতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেছে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি।
শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, ভূমিহীনদেরও বিনামূল্যে ঘর দিচ্ছে সরকার। সরকার শুধু ঘর নির্মাণ ের মাধ্যমে তার দায়িত্ব পালন করছে না, সরকারি প্রকল্পগুলো তাদের জীবন ও জীবিকাও প্রদান করছে। এ পর্যন্ত ২১টি জেলাকে গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি মুজিববর্ষে প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩৩০টি এবং তৃতীয় ধাপে ২ দফায় মোট ৫৯ হাজার ১৩৩টি ঘর বিতরণ করা হয়। আরও ২২ হাজার ১০১টি ঘর বিতরণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশের জনগণ বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টিকা পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দেশের মানুষের জন্য সঠিক সময়ে টিকা আনতে পারে। এই সাফল্যের মূল কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোভিড-১৯ মোকাবেলার পাশাপাশি তিনি সে সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ব। সে সময় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছিল।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে মন্তব্য করা সমালোচকদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়ন ছিল একটি থাপ্পড়। শেখ হাসিনার হাত ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে সকল নাগরিক সেবা হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। এই ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকতে পারবে না। আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছরের সাফল্যই নৌকার বিজয়ের আসল হাতিয়ার।
যখন বাংলাদেশের সংকট তীব্র হয়, সবকিছু যখন অনিশ্চয়তাকে ঘিরে ঘোরে, বাংলার আকাশে কালো মেঘ জমে থাকে, তখন শেখ হাসিনা আমাদের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ান। একজন মানুষ অদম্য সংকল্প ও নিষ্ঠার সাথে ভয়ের কালো মেঘ মুছে দেয় এবং দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। যখনই মনে হয় যে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমরা একটি খারাপ সময়ের মুখোমুখি হই, একমাত্র ত্রাণকর্তা যিনি দক্ষতার সাথে খারাপ দুঃস্বপ্নদূর করেন তিনি হলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার পরিচয় একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতার চেয়েও বেশি, তিনি একজন অদম্য সাহসী মানুষ। তিনি একজন যোদ্ধা এবং একজন অভিভাবক। তিনি সাহসের সাথে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করেছেন, তবুও, এখন তিনি বিশ্বের সেরা উদাহরণ এবং বিশ্ব নেতারা বৈশ্বিক সংকট পরিচালনায় তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
লেখক একজন কলামিস্ট ও গবেষক
আরও পড়ুন:১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবস’ জাতীয় জীবনে একটি বেদনাদায়ক দিন। সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে-যার নজির পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এ ধরনের দৃষ্টান্ত কোথাও নেই।
সেদিন জাতীয় চার নেতার মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী যিনি বঙ্গবন্ধুর আজীবন সৈনিক ছিলেন, স্বাধীনতার পরে স্বরাষ্টমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন, কামরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের নেতা ছিলেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন যিনি মেহেরপুরের আম্রকাননে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন, তাদেরকেও হত্যা করা হয়।
যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গের কারোরই চিহ্ণ রাখা যাবে না। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করেছিল এবং আওয়ামী লীগ যাতে নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায় সে কারণে জাতীয় চার নেতার হত্যাযজ্ঞ।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অনেকেই অনেকভাবে, যেটা ভয়ে হোক কিংবা আতঙ্কে হোক আত্মগোপনে ছিল। অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককেই নানাভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো খুনী মোশতাকের স্বৈরশাসিত সরকারের কেবিনেটে যোগদানের জন্য। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন থেকেই তারা জিয়া এবং মোশতাকের কুনজরে পড়েন।
মোশতাক-জিয়া গংরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তেসরা নভেম্বরে তাদের নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এখানে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকেই তার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম খন্দকার মোশতাক যে ছিল বেইমান, খুনী মোশতাক।
সে যে কাজটি করেছে সে কাজটি সায় দেয়ার জন্য কিংবা উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। উপরন্তু জেলখানায়ও জাতীয় চার নেতার কাছে নানান সময়ে বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠানো হয়। যেন মোশতাকের কেবিনেটেই তারা যোগদান করেন। কিন্তু তাঁরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।
হত্যার ঘটনা জাতির জন্য চরম বিপর্যয়কর ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য হত্যাকারীরা তেসরা নভেম্বর ঘটায়। সে কাজে তারা কতটুকু সফল হয়েছে আজকের প্রজন্ম তা বিচার করবে।
আমাদের মনে আছে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথা বলতেন। আমরা তখন তাঁর বক্তব্য শুনতাম। রণাঙ্গন থেকে তিনি বিভিন্ন সাক্ষাতকার দিতেন এবং এগুলো আমাদের কাছে অনুপ্রেরণামূলক ও যুদ্ধে যোগদানের জন্য উৎসাহের কারণ ছিল। আমাদের কাছে মনে হতো প্রবাসী সরকার যেন বাংলাদেশের মধ্য থেকেই দেশ পরিচালনা করছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা সকলের জন্যও একটা সাহস সঞ্চারী আইকন।
তাজউদ্দীন আহমদ কোথায় যাননি? কলকাতা থেকে শুরু করে মেঘালয়, আসাম সব জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য, বেগবান করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যে যোগাযোগ সেটা তাজউদ্দীন আহমদের সংযোগেই হয়েছিল। তিনি অনেক সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশের যোদ্ধা ছিলেন। সম্মুখসারির সমর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আর আমরা মাঝে মধ্যেই তৎকালীন বেতারে তাজউদ্দীনের ইংরেজি বক্তব্য শুনতাম। তাঁর যে উচ্চারণ ছিল তার দ্বারা আমরা অনেকেই অনুপ্রাণিত হতাম।
একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। যেমন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই একটা ষড়যন্ত্র চলছিল এবং সেই গোষ্ঠীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে মোশতাকের নেতৃত্বে।
আমরা শুনেছিলাম এই মোশতাক গোপনীয়ভাবে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করতো। সে কারণে তার ক্ষমতা অনেকটা খর্ব করে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। আর এসব কারণেই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে। খন্দকার মোশতাক স্বাধীনতার পরেও তার মুখোশ উম্মোচন করেনি, দলের মধ্যে থেকেই তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে গিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান যাকে বঙ্গবন্ধুই সেনাবাহিনীদের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ করেছিলেন, এই পদতো আর সেনাবাহিনীতে ছিল না, বঙ্গবন্ধু জিয়াকে খুশি করার জন্যই এমনটা করেছিলেন। অথচ তারাই ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
আমি বলতে চাই এরাই বিশ্বাসঘাতক; যেটা আমি মনে করি দল যারা করেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যারা, তারা সকলে এই বিশ্বাসঘাতককতার নমুনা ১৯৭৫ সালেই দেখেছেন। আমরা পরবর্তীতেও আরও দেখেছি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আবার জিয়া ও জেনারেল এরশাদ-এর সাথে হাত মিলিয়েছিল, বেগম জিয়ার সঙ্গে কেউ কেউ দল করেছিল।
বর্তমানে সময়েও বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এখনতো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিমিয়ে ক্ষমতায়। আজকে তিনি যদি ক্ষমতায় না থাকতেন আপনারা দেখতেন যেকোনো ক্রাইসিসে কত উৎকন্ঠা জন্মাত।
আজকে উন্নয়ন বলেন আর জয়বাংলা বলেন সবকিছুই এই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী এবং আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে।
আসলে বিশ্বাসঘাতকতা কোনো কিছুর ক্রাইসিস হলেই বেশি দেখা যায়। যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচনে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০০১ সালে যে নির্বাচনটিতে সংবিধানকে শ্রদ্ধা করে শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিশ্বাসঘাতকরা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে পরাজিত করে। তার ফলে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল সকলে আমরা তা জানি। বাংলাদেশের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ কিংবা ২০১৮ এর কথা অনুযায়ী যখন কোনো ক্রাইসিস আসে তখনই একটি গোষ্ঠী নড়াচড়া শুরু করে। নানান ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। যেমন আমরা উত্তরা ষড়যন্ত্র দেখেছি।
গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩)-এর যে ঘটনা সেটাও দেখুন। একটি দেশের সেনাবাহিনীর যিনি নাইন ডিভিশনের জিওসি ছিলেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণেই আস্থার সঙ্গে তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখেন দেশের যখন ক্রাইসিস পিরিয়ড তখনই এই বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা জাতীয় নেতারা করেননি। এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। সেটা আমাদের কর্মক্ষেত্র হোক আর অন্য যেখানেই হোক না কেন? এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
বাংলাদেশ যার হাত ধরে স্বাধীন হয়েছিল তাকে কোনভাবেই অপমান করা, অশ্রদ্ধা করা- এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে হতে দেয়া যাবে না। এই বিষয়ে আমাদের সবসময় সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আর আমরা যারা শিক্ষকতা করি এটাতো কোনো রাজনীতির পর্যায়ে পড়ে না। রাজনৈতিক মত তো সকলেরই আছে। কিন্তু দেশের যে মূল আদর্শ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এগুলোর বিরোধীদের সঙ্গে আপোস হওয়া উচিত নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এরা যেন বাংলাদেশের উন্নয়নে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় এবং সে ধরনের সুযোগ যাতে না পায়, সচেতন থাকতে হবে। বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে- আজকের বেদনাদায়ক ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা দিবসে’র অঙ্গীকার এটা হলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ সফল হবে। জয় বাংলা।
লেখক: অধ্যাপক, কলামিস্ট এবং ট্রেজারার-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এ দেশে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা জন্মেছেন শত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য।
সেই রকম এক ঝাঁক মানুষের গল্প মিশে আছে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে। গ্রামীণ ব্যাংক সব সময় সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভাগ্যহত মানুষের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সহায়তার বিশ্বস্ত হাত।
দেশের প্রান্তিক জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সুপরিকল্পিত রূপরেখায় অভাবের গ্রহণকাল কাটিয়ে স্বচ্ছলতার আলো দেখছেন অনেকেই।
এদেরই মধ্যে একজন, সাভারের ধামসোনা ইউনিয়নের বাসিন্দা মাকসুদা আক্তারের মেয়ে, মার্জিয়া । দুই ভাই বোনের মধ্যে ছোট মার্জিয়া মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তার বাবাকে হারান। দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে অভাবের সংসারে মা মাকসুদা কোনো রকমে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিন কাটাতে থাকেন।
মায়ের এই কষ্ট লাঘব করার জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়ে পরিবারকে কিছুটা সাহায্য করে মার্জিয়া। নিজেকে স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন তার দুচোখ জুড়ে। একটি ল্যাপটপ হলে অনেকেরই মতো আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে আয়ের একটি পথ খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন আশা নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ধামরাই সরকারি কলেজে স্নাতক সম্মান কোর্সে ভর্তি হন মার্জিয়া।
ল্যাপটপ কেনার ইচ্ছা আরও তীব্র হয়। বাবা নেই, কার কাছে আবদার করবে? মা কে বলে কী হবে, মা যে দরিদ্র অসহায়। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য মার্জিয়ার মা একদিন তাকে জানান, সদস্যের শিক্ষিত সন্তানদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নবীন উদ্যোক্তা ঋণ প্রদান করে থাকে গ্রামীণ ব্যাংক। মার্জিয়ার চোখে মুখে আশার সঞ্চার হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে প্রথম দফায় ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ল্যাপটপ কিনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন মার্জিয়া। পরবর্তী সময় দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে অন্য কম্পিউটার সামগ্রী কিনে আউটসোর্সিং ব্যবসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যায়।
মার্জিয়ার মতো আরেক বাবা হারানো মেয়ে সুরাইয়া পারভিন।
মানিকগঞ্জের মহাদেবপুর ইউনিয়নের বড়ংগাইল গ্রামের বাসিন্দা সুরাইয়ার মা রাফেজা খাতুনের স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন পার করছেন। আত্মীয়স্বজন সাহায্য তো দূরের কথা উল্টো মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। মা রাফেজা খাতুন দমে যাওয়ার পাত্র না, মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দুই মেয়েকে নিয়ে সে গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বারস্থ হলেন। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে দুই মেয়েকে শিক্ষাবৃত্তি দেয়া হয়। সুরাইয়ার মতো এতিম মেয়েরা পেয়ে যায় গ্রামীণ ব্যাংকের মতো অভিভাবক। সুরাইয়া এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।
মার্জিয়া সুরাইয়া যে স্বপ্ন দেখছে, সে স্বপ্ন পূরণ করে আজ সমাজে সফল এবং উদাহরণ তৈরি করেছে ববিতা রানি আর মাখন চন্দ্র। দুজন হতদরিদ্র পরিবার থেকে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তিনবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়াই যাদের স্বপ্ন ছিল, সেই তারাই এখন মানুষ গড়ার কারিগর।
গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসিন্দা ববিতার পরিবারে সম্বল বলতে ছিল বসতবাড়ি ২০ শতাংশ জমি, মাঝারি আকারের দুটি আর ছোট সাইজের ৪টি লিচু গাছ। ববিতার মা মুড়ি ভাজার কাজ করতেন। টাকা পয়সার অভাবে ববিতার বোনের অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায়। ববিতার নিজের ও লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। ববিতার পাশে এসে দাঁড়ায় গ্রামীণ ব্যাংক। আজকে সে শ্রীপুর ভাংনাহাটি রহমানিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক। সংসারের হাল ধরেছে, স্বাবলম্বী হয়েছে। মাকে নিয়ে সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সিংহীমারা গ্রামের বাসিন্দা মাখন চন্দ্রের মা সুনীতি রাণী রায়। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন কেনার মাধ্যমে শুরু করেন স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলা।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। জীবনে তিনি যে কষ্ট করছেন, তার ছেলেমেয়ে যেন সেই কষ্ট না করে সেটা ভেবে দিন রাত সেলাই মেশিনে কাজ করতেন।
হতদরিদ্র মাখন এইচএসসি পরীক্ষার পর পড়ে বিপাকে। পড়াশোনার খরচ চালাবে কে? এমন অবস্থায় পাশে দাঁড়ায় গ্রামীণ ব্যাংক। মাখনের মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সন্তানের জন্য উচ্চ শিক্ষা ঋণ নেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন মাখন চন্দ্র রায়।
সেখান থেকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি মাখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছে। মাখন আজ শিক্ষিত সমাজে সফল এবং প্রতিষ্ঠিত।
এভাবে বহু মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে সহায়তা করছে গ্রামীণ ব্যাংক। প্রতিকূলতাকে জয় করার সারথি গ্রামীণ ব্যাংক।
ব্রাসেলস থেকে ফিরেছেন গৃহকর্তা। গাড়ি-বারান্দায় মমতায় জড়ানো ফুল নিয়ে উপস্থিত কন্যাসম নিদ্রা ও নতুন বর এন্ড্রু। উপস্থিত অনেকের কাছেই তারা অচেনা, রহস্য অজানা। স্বয়ং গৃহকর্তা সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সালাম করালেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
দীর্ঘদিনের গৃহকর্মী শেরপুরের মেয়ে নিদ্রা গত ২৪ অক্টোবর জাতির পিতার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার উপস্থিতিতে বিয়ে করেছে নেত্রকোণার ছেলে এন্ড্রুকে। আজ বর-কনে যুগলকে গৃহকর্তা, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আশীর্বাদ করলেন। যেন আটপৌঢ়ে বাঙালি মায়ের প্রকৃত রূপ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার কাছে ঘরে-বাইরে সকলেই সমান। ব্যক্তিগত বড় কর্তা থেকে বাগানের মালি, নেই কোনো ভেদাভেদ। যার বাড়ির দৃশ্য সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলামের কথাটাই সত্য, ‘যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান’, যার বিশ্বাসের বেদীমূলে ‘আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের’।
নিদ্রা-এন্ড্রুর বরণদৃশ্য দেখে কেবলই মনে হলো, ‘তুমি দেশের তুমি দশের, তুমি আমাদের মতো কেউ…তুমি বাংলাদেশের নেতা।’
জয়তু শেখ হাসিনা।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক
আরও পড়ুন:বাতাসে পূজা পূজা গন্ধ। শুরু হয়ে গেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। আকাশে সাদা মেঘ, দিকে দিকে কাশফুলের শুভ্রতা আর বাতাসের বদলে যাওয়া ঘ্রাণ- সবই বার্তা দিচ্ছে শারদীয় উৎসবের।
তাহলে এটা কোন মাস বাংলায়? শরৎ? না, হেমন্ত!
তবে যে এই ক্ষণে বাজলো শারদীয় দুর্গাপূজোর ঢাক? এবার কি দেরি হয়ে গেলো তবে?
না, পূজা ঠিক সময়েই হচ্ছে৷ শরৎ বা হেমন্ত মুখ্য নয়। মুখ্য তবে কী? ওই যে! বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ভরাট কণ্ঠে আবৃত্ত মহালয়ার আগমনীর সেই ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’!
হ্যাঁ, দুর্গাপূজা শুরুর নির্ধারিত মাসটি আশ্বিন। মহালয়ার মধ্য দিয়ে আশ্বিনেই শুরু হয় দুর্গাপূজা, আগমনী যাকে বলে।
এই দুর্গাপূজা কত পুরনো? বা মানব সভ্যতায় ঈশ্বরবিশ্বাসীদের জন্য এই দেবীরূপের প্রকাশ কত প্রাচীন?
সর্বপ্রাচীন যে গ্রন্থে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় তা হচ্ছে ঋগ্বেদ। যদিও সেখানে সঙ্গতভাবেই দেবীর প্রতিমা পূজার কোনো বর্ণনা বা নির্দেশনা ছিলো না। মূলত বৈদিক ধর্মীয় দর্শন আর বর্তমানে প্রচলিত ধর্মীয় আচারাদির মাঝে নদীর স্রোতে মেশা পলির মতোই যোগ হয়েছে সহস্রাব্দের বিবিধ লোকাচার, বিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার ও সময়ের বা পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তায় উপলব্ধ নিদান, বিধান।
মূলত পূজা হিসেবে, দুর্গাপূজার সূচনা রাজা সুরথের হাত ধরে বলেই প্রাচীনতম তথ্যসূত্র পাওয়া যায়।
মার্কন্ডেয় পুরাণে রাজা সুরথকে দেবী দুর্গার পূজারী ও মর্ত্যে তার প্রচারক বলে উল্লেখ করা হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই সুরথ রাজার জয়কৃত রাজ্যের রাজধানী ছিলো স্বপুর (পুরাণে উল্লিখিত নাম), যা কিনা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে অবস্থিত৷ বলা হয়, সুরথ রাজা যে বিপুলসংখ্যক পশু বলি দিতেন দুর্গাপূজায়, তা থেকেই বলিপুর নামের উদ্ভব যা কালের বিবর্তনে বোলপুর রূপ ধারণ করেছে।
দেবী মাহাত্ম্যের ১২তম এবং ১৫তম লাইন ‘তত: স্বপুরমায়াতো নিজেদেশাধিপোহভবৎ’ অনুসারে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরের বর্তমান ‘সুপুর’ (স্বপুর)-এর রাজা ছিলেন। এ থেকে আমরা দুটি বিষয় নিশ্চিত হতে পারি।
এক, দুর্গাপূজা প্রচলনের প্রাচীনতম তথ্যসূত্র বাংলা অঞ্চলেই এই দেবীর প্রথম উপাসনার সংবাদ দেয়।
দুই, বাংলা অঞ্চলের ভূমিকন্যা বলে গণ্য করা যায় এই দেবীরূপকে। সে কারণে বাংলা অঞ্চলের হিন্দুদের মাঝেই দুর্গাপূজা উদযাপনের মাত্রা সবচেযে অনন্য। শুধু তাই নয়, বাঙালির কাছে দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; দুর্গাপূজা আক্ষরিক অর্থেই বাঙালি হিন্দুর জীবনের, তার পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই সুরথ রাজা শাক্ত ছিলেন। শাক্ত হচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের একটি মতবাদ বা শাখা। এরা শক্তির পূজারী। এবং সচরাচর শাক্তরা শক্তির প্রকৃত রূপ বলতে মাতৃশক্তিকেই জ্ঞান করে। এ অর্থে শাক্তরা মাতৃপূজারী, যে কারণেও সুরথ রাজার দেবী দুর্গার উপাসক হওয়ার প্রেক্ষাপট ছিলো।
এই সুরথ রাজা দুর্গাপূজা করতেন বসন্তকালে। সেটাই সঙ্গত ছিলো তৎসময়ে। কেননা হিন্দু ধর্মে পৌষ থেকে চৈত্র পর্যন্ত পূজাদি করার প্রচলন বিদ্যমান বহুলাংশে। কারণ হিন্দু জনপ্রিয় মতবাদগুলোর বিশ্বাস অনুযায়ী, এ সময়ে স্বর্গের দেবতারা জেগে থাকেন। অর্থাৎ এটি তাদের দিবাকাল, পৃথিবীর ছয় মাসে তাদের এক দিন হয়, আর অপর ছয় মাস তাদের এক রাত।
পরবর্তীতে রামায়ণে, বিশেষত এর বাংলা সংস্করণগুলোতে আমরা দেখতে পাই, যার মাঝে উল্লেখযোগ্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ; যে অবতার পুরুষ রাম-রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আগে দেবী দুর্গার বন্দনা করেন যুদ্ধে জয় প্রার্থনার জন্য। এ পূজা তিনি শরৎকালে করেন। যেটি অকাল ছিলো দুর্গাপূজার জন্য৷ এ কারণে এই পূজাকে অকালবোধন বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
মূলত পূজার এই ধরনটিই বিবিধ কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অধিক জনপ্রিয়তা পায়৷ আজ আমরা যে পূজা দেখতে পাই প্রতি বছর, তা মূলত সেই রামচন্দ্রের করা পূজারই বার্ষিক উদযাপন ও পালন।
তবে উল্লেখ থাকে যে, প্রতি বছর বসন্তকালেও কিন্তু দুর্গাপূজা হয়। ওই যে, রাজা সুরথের ধারা অনুযায়ী। তবে তা ততোটা ঘটা করে আজ আর পালিত হয় না। এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়।
এ তো গেল কেবল দুর্গাপূজা প্রচলনের ইতিহাস। কিন্তু যার প্রচলনের ইতিহাস এটি, তার আবির্ভাবের বর্ণনা আবার ভিন্ন। অর্থাৎ পুরাণ অনুসারে মহিষাসুর বধের সেই আখ্যান। যে আখ্যান অনুযায়ী, পূজা করার সূচনা সেই রাজা সুরথের আমলে এবং যে বিশ্বাসের পালন রামচন্দ্রও করেছেন রামায়ণমতে। পৌরাণিক সে আখ্যান এই যে, যখন মহিষাসুর নামক শক্তিশালী ও রূপ বদলে সক্ষম, পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে অত্যন্ত পারঙ্গম অসুর স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল জয় করে দেবতাদের অতিষ্ঠ করে তোলে এবং সব দেবতা তার কাছে পরাজিত হন তখন সব দেবতার সম্মিলিত ক্রোধের তেজস্বীতে প্রকাশিত হোন শক্তির এক তেজস্বিনী রূপ। সব দেবতা যাকে দেন নিজ নিজ অস্ত্রাদি, উপচার ও ব্যবহার্য। আর এসব একা ধারণ করতে সেই দেবী হয়ে ওঠেন দশভূজা। দশ হাতে তিনি ধারণ করেন খড়্গ, ত্রিশুল, কমন্ডলু, শঙখ, চক্র ইত্যাদি। বাহন হয় সিংহ৷
যুদ্ধে প্রবল শক্তিধর মহিষাসুরকে তিনি পরাজিত করেন। দেবতার বরে যে ছিলো সব দেব, যক্ষ, গন্ধর্ব ও পুরুষের অবধ্য। প্রবল অহঙ্কারে যে প্রমত্ত হয়ে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলো নারী বা মাতৃশক্তিকে, যাদের থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য বর গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করেনি। তাই তো দেবী দুর্গাকে সামনে দেখেও সে হেসে কটাক্ষ করতে শুরু করে। তাচ্ছিল্য করে ও ঘরে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তৎপরবর্তীতে শোচনীয়ভাবে যখন সে মাতৃশক্তির কাছে পরাজিত ও আহত হয় তখন মৃত্যুকালে সে-ই আবার মা দুর্গার কাছে শরণাগত হয় এবং প্রার্থনা করে মায়ের পূজার আগে যেন তার পূজাও হয়৷ আর এ জন্যই প্রতি বছর দুর্গাপূজায় দেবী দুর্গার পূজার প্রথম আনুষ্ঠানিকতাই শুরু হয় মহিষাসুরের পূজার মধ্য দিয়ে।
এটিই সংক্ষেপে দেবী মাহাত্ম্য, অর্থাৎ ঈশ্বরের এই দেবী রূপের লীলামাহাত্ম্য হচ্ছে এই বর্ণনাটিই। কিন্তু এটিকে আবার বিশ্লেষিত করা যায় নানা মতবাদ দিয়ে, যা এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে প্রাসঙ্গিক বিধায় এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে হিন্দু ধর্মের বহমান নানা ধারা বা মতবাদের সবাই প্রচলিত বিশ্বাসের সব ক্ষেত্রে ঐকমত্য না হলেও প্রতিটি কষ্টিপাথরে নিজস্ব দর্শনানুযায়ী বিশ্লেষণের পরও সব মতবাদই ধারণ করছেন এমন এক সত্তা বা কল্পনা হচ্ছেন দেবী দুর্গা।
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় উৎসব। আরও সহজ ভাষায় বললে বলে ফেলতে হয়- বাঙালি হিন্দুর পরিচয় আর দুর্গাপূজা একে অপরের সমান্তরাল।
নিরপেক্ষভাবে বললে, শুধু বাঙালি হিন্দুই নয়, গোটা বাঙালি জাতির ব্যাপ্তির দিক থেকে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও উৎসবমুখর উদযাপনটির নাম দুর্গাপূজা।
২০২১ সালে ইউনেস্কো একে ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দুর্গাপূজাকে ধর্ম ও শিল্পের সর্বজনীন মিলন ক্ষেত্রের সর্বোত্তম উদাহরণ হএসবে দেখা হয় এবং সহযোগী শিল্পী ও ডিজাইনারদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রান্তের হিমালয়-কন্যা নেপালে যার নাম দাশাইন, আর বিপরীতের শেষতম প্রান্তে কোথাও বা তার নাম নবরাত্রি (তামিলনাড়ু) কোথাও বা কুল্লু দাশেরা (মাইশোর, কর্ণাটক ইত্যাদি)।
আর মাঝের পুরো ভূমিটি জুড়ে এই উদযাপন বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে মাতিয়ে তোলে; রাঙিয়ে তোলে সমগ্র ভারতবর্ষকে নয়টি দিন জুড়ে। আর আজ তো বিশ্বায়নের যুগে প্রবাসী হিন্দুদের কারণে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে তা নানা ধরনে, নানা আয়োজনে।
দুর্গাপূজা শুধু ব্যাপ্তিতে নয়, বৈচিত্র্যেও অনেকটা বিস্তৃত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ভূখণ্ডেও এক দুর্গাপূজায় যে পরিমাণ ভিন্নতা দেখা যায়, বাস্তবে পশ্চিমা মহাদেশগুলোতে ততো বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো উপলক্ষ অত্যন্ত দুষ্কর৷ এটি প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক উর্বরতার প্রমাণ নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে যেমন প্রতিমা বা প্যান্ডেলের ধরণ দেখা যায়, শতখানেক কিলোমিটার দিক বদলাইলেই উত্তর-পূর্বের সিলেট অঞ্চলে তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আর যদি যাওয়া হয় দক্ষিণবঙ্গের দিকে, তবে দেখা মিলবে আড়ম্বরের অন্যতর রূপ।
আধ্যাত্মিক দিক থেকেও দুর্গাপূজার আছে এমন কিছু অনুষঙ্গ যা বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত ধর্মীয় আচারাদির মধ্যে অত্যন্ত স্বকীয়। দুর্গাপূজাই খুব সম্ভবত এখন অবধি চলমান সবচেয়ে বড় চর্চা যেখানে মানুষের পূজা সরাসরি হয়। দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা হয়। যেখানে একটি নাবালিকা কন্যাশিশুকে দেবীরূপে পূজিত করা হয়। পূজার এই দিনের সব আনুষ্ঠানিকতা এই উপলক্ষকে ঘিরেই আয়োজিত ও পালিত হয়।
এছাড়াও দুর্গাপূজাকে ঘিরে লৌকিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাও অনন্য৷ যেমন, পুরো ভারতবর্ষে পূজা হয় দেবী দুর্গার, যিনি মহিষাসুরকে বধ করেছেন। কিন্তু বাঙালি তার লোকাচারের সঙ্গে মিলিয়ে একেও বানিয়ে বসে আছে ঘরের মেয়ের নাইওর আসার আখ্যান। অর্থাৎ বাঙালি পূজার পাঁচটা দিনকে গণ্য করে এভাবে যে, বাড়ির মেয়ে পার্বতী (দুর্গা) তার পূত্র-কন্যাসহ নাইওর এসেছেন পিতৃগৃহে।
আগে সম্পন্ন বাঙালি গৃহস্থ তার বাড়িতে নাইওর আসা কন্যাকে সমাদর করতেন, আপ্যায়ন করতেন পাঁচ দিন ধরে; হুবহু সেভাবেই বাঙালি দুর্গাপূজায় নিজস্ব সেসব আচার পালন করে। যেমন অষ্টমীতে নিরামিষ রান্না করে খাওয়ানো’ নবমীতে মাছ-ভাত আর পিঠাপুলিতে একদম থালা সাজিয়ে আপ্যায়ন। দশমীতে শাঁখা-সিঁদুরে বাড়ির মেয়েকে সাজিয়ে বিদায় জানানো। প্রতিমা বিসর্জনের যে দৃশ্য সাধারণ্যে দৃশ্যমান তা কেবল মাটির প্রতিমার বিসর্জনই সোজা বাংলা। মূল বিসর্জন হয় ঘট বিসর্জন, যা দৃশ্যমান প্রসেশনের আগেই হয়। প্রসেশনের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মূলত আধ্যাত্মিক কোনো মাহাত্ম্য নেই। এটি নিছক পূজা শেষে পুজার উপাচারাদি, প্রতিমা ইত্যাদির নদীতে বিসর্জন।
দুর্গাপূজার অর্থনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাবও পড়ে ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবেই। ২০১৩ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বছরে ২৫ হাজার কোটি রুপির বাজার সৃষ্টি হয় কেবল দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এবং এই বাজারের বার্ষিক বৃদ্ধির হার তখন ছিল ৩৫ শতাংশ। এছাড়া কুমার, বিশেষ প্রকৃতির তাঁতী ইত্যাদি শ্রেণীর পেশা টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম এই দুর্গাপূজা।
তবে অর্থনৈতিক গুরুত্ব, সামাজিক গুরুত্ব ইত্যাদিকে ছাপিয়ে যায় যে জিনিসটি সেটি হচ্ছে এই পূজার রাজনৈতিক গুরুত্ব।
দুর্গাপূজা কোনো বিচিত্র কারণে বঙ্গীয় জনপদে সব সময়ই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। বিশেষত এ অঞ্চলে সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশ বিস্তৃতি পায় ১৬ শতকে। তারপর থেকে দুর্গাপূজা সব সময়েই ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক উপলক্ষ হিসেবেও। বাঙালির বিদ্রোহ, বিপ্লব ও বোমাবাজির রাজনীতি থেকে তোষামোদ ও চাটুকারিতার রাজনীতি- সর্বত্রই দুর্গাপূজা প্রবল গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হয়ে দেখা দিয়েছে বার বার, বহুবার।
যেমনটা দেখা যায় ব্রিটিশ আমলে৷ ইংরেজবিরোধী জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার জন্য হিন্দু নেতারা যুবসমাজকে এক করা ও স্বাচ্ছন্দ্যে কর্মকাণ্ড চালানোর অন্যতম উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দুর্গাপূজাকে।
এমনকি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসও সে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পূজা মণ্ডপে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে পূজার শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন বিপবী জাতীয়তাবাদের স্ফুলিঙ্গ।
বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথের সিমলা ব্যায়াম সমিতির পূজায় অষ্টমীর দিনটি পালিত হতো বীরাষ্টমী হিসেবে৷ এদিনে সারা বছরে রপ্ত করা সব কসরৎ দেখাতে ব্যায়ামবীরেরা উপস্থিত হতেন, আয়োজন হতো কুস্তি, অসিখেলা, লাঠিখেলা, ছুরিখেলার। শপথ পাঠ ইত্যাদিও হতো। এই ব্যায়াম সমিতি সুভাষচন্দ্রকে পূজা আয়োজক কমিটির সভাপতিও করেছিলো।
তবে দিনশেষে ধর্মীয় আচার বা উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য যতটা না অর্থনীতি বা রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এর সামাজিক প্রভাব।
আর সে জায়গায় নিঃসন্দেহে বাঙালির দুর্গাপূজা এখনও অসাধারণ এক উপলক্ষ। আজও বাঙালির ধর্ম-নির্বিশেষে আনন্দে ভাসার দিনগুলোর মাঝে পাঁচটি দিন আসে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে। মেলা বা নাটিকা, সঙ্গীতায়োজন ইত্যাদি কেবল হিন্দুদের নয়, পুরো জাতির বিনোদনের একটি উৎস হয়ে ওঠে। পূজার আয়োজনে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মুসলিমদের আন্তরিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আক্ষরিক অর্থেই এটি ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রতি বছর একবার করে মজবুততর করে।
তাই এখনও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা শারদোৎসব। এবং নিঃসন্দেহেই তা থাকবে আবহমান।
সেই শারদোৎসবের মঙ্গলদীপ উদ্ভাসিত করুক, নির্মল করুক, দূর করুক অজ্ঞানতার অন্ধকার। ঋত, ঋদ্ধ হোক বাংলাদেশ।
বছর দশেক আগের কথা। আমার শ্বশুর বাড়ি খুলনা থেকে হঠাৎ এক মধ্য রাতে খবর আসলো আমাদের প্রিয় একমাত্র মুরব্বি মনসুর কাক্কু মারা গেছেন। আমরা জানালাম যে আমরা রওনা দিচ্ছি। সে সময়ে খুব সহজে দ্রুত খুলনায় পৌঁছানো যেতো না। সকাল হতে তখনও দেরি। বহু কষ্টে এক চেনা মানুষকে ধরে একটা ভাড়া গাড়ি নেয়া হলো। শেষ রাতেই আমরা রওনা দিলাম।
সময় মত মাওয়া ঘাটে পৌঁছাতে পারলেও, ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুর প্রায়। ফেরি পার হয়ে খুলনা পৌঁছাতে আমাদের বিকেল হয়ে গিয়েছিল। কাক্কুর দাফন হলো আসরের নামাজের পর। গাড়ি রাতেই ফেরত দিতে হবে বিধায়, সন্ধ্যা নামার আগেই রওনা হতে হয়েছিল। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে মধ্য রাত। আমরা বাসায় ঢুকেছিলাম রাত দুটো থেকে তিনটার মধ্যে।
এ বছরের এপ্রিলে আবারও শ্বশুর বাড়ি খুলনা যাওয়া হয়েছিল। অবসকিওরের শো যেদিন, ঠিক সেই দিনেই সকাল দশটায়, এবার গ্রীনলাইনের বিশাল বাসে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় খুলনায় পৌঁছেছিলাম। দুপরের খাবার শেষে, আরাম করে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। রাতে শ্বশুর বাড়ি থেকে আবারও সকাল দশটার বাসে ঢাকা রওনা হয়ে দুপুরে ঢাকায় মায়ের সাথে ভাত খেলাম। দুটো সময়ের কথা বললাম।
একটি পদ্মা সেতু হবার আগে এবং আরেকটি হবার পর। পরিষ্কার বুঝলাম, পদ্মা সেতু শুধু সহজ যোগাযোগ নয়, সময়, শ্রম, আরাম এবং পকেটের নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমাদের মত মধ্যবিত্ত মানুষের পথের খরচ তিনভাগ থেকে এক ভাগে নিয়ে এসেছে।
গত কয়েক বছর ধরে চারদিকে শুনছি, এতো উন্নয়নের জোয়ার শুধু দুর্নীতি প্রশ্রয়ের পথ। পদ্মা সেতু বা যমুনা সেতু করবার কি দরকার ছিল? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেল করবার প্রয়োজনই ছিল না, যেখানে ঢাকার যানজটের সমাধান নেই। হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন এয়ারপোর্টের দরকার কতটা ছিল? কর্নফুলী টানেলের কাজ কী? এমন শত শত প্রশ্ন বাতাসে ঘুড়ে বেড়ায়। অথচ সকলেই এই যোগাযোগ বা সুবিধাজনক ব্যবস্থাগুলোর সুবিধা ভোগ করছে প্রতি মুহূর্তে।
আমি খুব সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ ভাবনা থেকে এই ধরনের উত্তর খুঁজে নিয়েছি। হ্যাঁ গত কয়েক বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে বহু গুণে। হয়তো পদ্মাসেতুর বালু, রড বা সিমেন্ট বেশি দরে সরবরাহ করে সাত পুরুষ থেকেও বেশি অর্থ আয় করেছেন তারা। আপনাদের কি মনে হয় না একবারও যে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সকল কালো ক্ষতগুলো সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন? আসলে কোথায় কিসের জন্য কতটা দুর্নীতি বা অতি ব্যয় হয়েছে, তার সবই তিনি জানেন।
মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী সবচেয়ে আগে যেটা জানেন, সেটা হচ্ছে, বিশ্বে ভৌগলিক মানচিত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও অত্যন্ত জরুরি অবস্থানে আছে। তিনদিকে স্থল, একদিকে জল। প্রতিবেশী যে কোন দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষার মত আদান প্রদানের বিষয়গুলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হলে কখনও সহজ ভাবে সম্পন্ন হবে না। তাই তিনি নিজে ক্ষমতার সাথে বাজি ধরে দেশ জুড়ে নানাবিধ উন্নয়নের কাজে হাত দিয়েছেন।
পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, করোনা, মহামারি, অর্থ সংকট, তেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ সব বিষয়গুলোকে মাথায় নিয়েই এই বাজিতে নিজের পুরো ক্ষমতা ঢেলে দিয়েছেন। তিনি আরো বেশি ভালো করে জানেন, তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় উন্নয়নমূলক কাজগুলো সম্পন্ন করবার জন্য জনগণের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে। আবার অন্যদিকে এও জানেন, যারা দুর্নীতি করবার তারা তা করবেই। তবে তিনি একটি বিষয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তা হচ্ছে আগামীর বাংলাদেশে এসব দুর্নীতিবাজরা ধুলায় উড়ে যাবে। স্থায়ী হবে প্রতিটি স্থাপনা, যোগাযোগ, চুক্তি সমূহ। আগামী প্রজন্ম এই সবগুলো সুবিধা দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নির্ভয়ে উপভোগ করবেন।
যে কোন উন্নয়নশীল দেশের প্রথম শর্ত সে দেশের সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থান। তাই শেখ হাসিনা দেশের ভবিষ্যতের জন্য নিজের বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেম দিয়ে সেই সমৃদ্ধির পথ পাকা করে যাচ্ছেন। এতে আগামীর বাংলাদেশ হবে আত্মনির্ভরশীল, নিরাপদ এবং বাসযোগ্য।
লেখক: শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
মন্তব্য