২৮ আগস্ট দেশের দৈনিক সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিক প্রচারমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, সেদিন মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পলাতক তারেক জিয়ার বক্তব্য-ভাষণ প্রচার বন্ধ করা এবং সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে (বিটিআরসি) নির্দেশনা দেয়ার পর বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা উক্ত বেঞ্চে ঘৃণ্য ধরনের হট্টগোল শুরু করে, মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের প্রতি ফাইল এবং কাগজের ঢিল নিক্ষেপ করে, যে অবস্থায় বিচারপতিদ্বয় আদালত ছেড়ে খাস কামরায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আদালতে বিএনপি-জামায়াতিদের এ ধরনের গুণ্ডামি এটিই প্রথম নয়। ২৮ আগস্টের ঘটনা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল ২০১১ সালের একই ধরনের মাস্তানির কথা। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আমাদের পবিত্র সংবিধান সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলার অভিযোগে আমার নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি চলাকালে বেশ কিছু বিএনপি সদস্য আইনজীবী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। ঢিল, বোতল, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছিল। আমি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিলে, তিনি চিহ্নিত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
২০১১-এর ঘটনা ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত সদস্য আইনজীবীরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের মাস্তানি করে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এবং এমনকি আদালতের ভেতরেও। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা সারা দিন আদালত কক্ষ দখলে রেখেছিলেন যে কারণে, সেই আদালতে বাকি দিন কোনো কাজ হতে পারেনি। ফলে বহু বিচার প্রার্থীকে বিচারবঞ্চিত হতে হয়েছে।
অথচ এই বিএনপি-জামায়াতি আইনজীবীরাই সর্বদা গলা উঁচু করে গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর আইনের শাসনের কথা বলে শান্ত সমুদ্রে ঝড় তুলতে ভুল করেন না, ভোলেন না তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছে নালিশ করতে।
মামলাটি করা হয়েছে খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়ার বক্তব্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচার বন্ধের আদেশ প্রার্থনা করে। গত কয়েক বছর ধরে এই পলাতক আসামির বক্তব্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে বলে এই মামলার প্রয়োজন হয়েছে কেন না পলাতক আসামির বক্তব্য প্রচার করা শুধু বেআইনিই নয়, দণ্ডনীয় অপরাধও বটে।
আইনের ভাষায় একজন পলাতক আসামিকে বলা হয় ‘আউট ল’। জগৎশ্রেষ্ঠ ব্ল্যাক ল ডিকশনারিতে দেয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আউট ল ‘সেই ব্যক্তি যে আইনে প্রদত্ত সুবিধা এবং সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, সে ব্যক্তি একজন অভ্যাসগত অপরাধী, বিশেষ করে একজন পলাতক আসামি (fugitive)। ’ ব্ল্যাক ল ডিকশনারির সংজ্ঞা থেকে এটি পরিষ্কার যে, ফেরারি আসামি আইনের সুরক্ষা বা সুবিধা কোনোটিই পেতে পারে না।
এ বিধান পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রচলিত, যার কারণে পলাতক থাকাকালে তার পক্ষে প্রতিনিধি বা আইনজীবী কোনো আদালতে বা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির হতে পারে না। সোজা কথায় সে আইনের দৃষ্টিতে একজন অদৃশ্য ব্যক্তি। অদৃশ্য ব্যক্তি বিধায় তার ভাষণ প্রচার হতে পারে না।
এ মামলায় তারেক জিয়া এবং কয়েকজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ছাড়া কেউ পক্ষভুক্ত নয়। তারেক জিয়া পলাতক বিধায় তার পক্ষে আদালতে কেউ হাজির হতে পারে না। তা সত্ত্বেও বিএনপির কিছু আইনজীবী তারেক জিয়ার পক্ষে কথা বলতে আদালতে অন্যায় এবং বেআইনিভাবে হাজির হয়েছেন শুধু আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত করতে। তারা সংশ্লিষ্ট মামলায় কোনো পক্ষের আইনজীবী নয় বিধায়, আদালত তাদের কথা বলার সুযোগ দিতে পারে না।
কেউ কেউ বলছেন, তারেক জিয়ার ভাষণ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া নাকি তার মানবাধিকার লঙ্ঘন। আইনে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, পলাতক থাকা অবস্থায় কোনো আসামি কোনো ধরনের অধিকারই ভোগ করতে পারে না, যে কথা ব্ল্যাক ল ডিকশনারিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তদুপরি আমাদের সংবিধানের ৩৯ক অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের যে অধিকার প্রদান করা হয়েছে, সেটি নিশ্চিতভাবে এমন মানুষের জন্য যে একজন প্রকাশ্য, দৃশ্যমান ব্যক্তি, কোনো পলাতক বা অদৃশ্য ব্যক্তিকে এই স্বাধীনতা দেয়া হয়নি।
একজন ফেরারিকে এই স্বাধীনতা দেয়ার অর্থ তাকে ফেরারি আসামি হিসেবে বিরাজ করতে সহায়তা করা। ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকার অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা বা আদালত অবমাননার জন্য ভোগ করা যায় না। একজন পলাতক আসামির ক্ষেত্রে দুটি নিষেধাজ্ঞাই বিরাজমান, কেন না, তার ভাষণ প্রচার করার অধিকার মানে পলাতক থাকার এবং আদালত অবমাননার অপরাধ চালিয়ে যাওয়া। তার ওপর আদালতের নির্দেশ রয়েছে আত্মসমর্পণ করার।
তা ছাড়াও ৩৯ অনুচ্ছেদের দেয়া অধিকার কেবল বাংলাদেশের নাগরিকরাই ভোগ করতে পারেন। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই জানিয়েছে যে, বিদেশে পালিয়ে থাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক জিয়া অনেক আগেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আমাদের দণ্ডবিধির ৫২ক ধারায় কোনো পলাতক আসামিকে সহায়তা করা মারাত্মক অপরাধ। তারেক জিয়াকে পালিয়ে থাকতে সহায়তা করার অপরাধে সহায়তাকারীরও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। দন্ডণ্ডধির সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, ‘আশ্রয় দেওয়া মনে পলাতকের জন্য আবাসের ব্যবস্থা করা, খাবার, পানীয়, অর্থ প্রদান, পরিধেয় বস্ত্র প্রদান, অস্ত্র প্রদান, চলাচলের ব্যবস্থা করা, অথবা এই ধারায় নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নাই এমন অন্য যে কোনো উপায়ে সহায়তা প্রদান করা।’
সুতরাং আশ্রয় শব্দটির ব্যাখ্যা অনেক ব্যাপক, অর্থাৎ এমন কাজও ‘আশ্রয় প্রদানের’ ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত, যার কথা উক্ত ধারায় বিশেষ করে উল্লেখিত নয়। সেই অর্থে তারেক জিয়ার ভাষণ প্রচারকারীরাও দন্ডবিধির ৫২ক ধারার দায়ে অপরাধী। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তারা সাংবাদিকদের বলেছে যে, তারা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে এই মর্মে দরখাস্ত করেছে যে, এই বেঞ্চের ওপর তাদের আস্থা নেই। এ কথা এতই হাস্যকর যে, কোনো আইনজীবীর মুখে এ ধরনের অবান্তর কথা শোভা পায় না।
মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে এ ধরনের দরখাস্ত সে ব্যক্তিই করতে পারেন, যে সংশ্লিষ্ট মামলায় একজন পক্ষ। কোনো আগন্তুক এ ধরনের দরখাস্ত করতে পারেন না। জানা গেছে, একজন আইনজীবী তার এক অনির্দিষ্ট মক্কেলকে পক্ষভুক্ত করার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন, যেই আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালত অত্যন্ত যৌক্তিক এবং আইনসংগত কারণেই নাকচ করে দিয়েছেন।
এ মামলার বিষয়বস্তু এমন কিছু নয়, যাকে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বলা যায়। এখানে বিষয় একটিই, তা হলো তারেক জিয়া পলাতক আসামি বিধায় তার ভাষণ প্রচার করা যায় কি না। সুতরাং এ বিষয়ে অন্য ব্যক্তির কোনো স্বার্থ, যাকে আইনের ভাষায়, লোকাস স্টেন্ডাই, বলে, থাকতে পারে না। এ ধরনের দরখাস্ত করার মানে হচ্ছে আদালতের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা, যার জন্য এসব আইনজীবীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
তা ছাড়াও মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরখাস্ত করতে হয়। পক্ষভুক্তির দরখাস্ত নাকচ হওয়ার পর তারা আপিল বিভাগে দরখাস্ত করতে পারত, কিন্তু সেটি তারা করে নাই, সম্ভবত এই জেনে যে, এ ধরনের অমূলক দরখাস্ত, যার পেছনে কোনো যুক্তি, হেতু বা বিষয়বস্তু নেই, নিয়ে গেলে আপিল বিভাগ ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন। তাই তারা ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য পরে সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপর অনাস্থার দাবি করেছে। আদালত এমন কোনো আদেশই দেয়নি যার জন্য অনাস্থা প্রকাশ করা যায়। একটি সম্পূর্ণ মেধাহীন দরখাস্ত নাকচ করে আদালত আইনের নির্দেশকেই মান্য করেছেন।
এই মাস্তানি কাণ্ডের সময় আদালত যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। ২০১১ সালে আমার বেঞ্চে মাস্তানি করার সময় আমি সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ডেকে সব মাস্তানকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম আদালতের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রক্ষার স্বার্থে। এ ধরনের মাস্তানিকে প্রশ্রয় দিলে শুধু বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই নয়, ধূলিসাৎ হবে আইনের শাসন, সংবিধানের সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র। তাই এসব মাস্তানের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
তারা শুধু আদালত অবমাননাই করেনি, আরও কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। তাদের ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হবে বিচারহীনতাকে প্রশ্রয় দেয়া। বার কাউন্সিলকেও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আদালতের মর্যাদা এবং কর্তৃত্ব নষ্ট হলে কিছুই বাকি থাকবে না, যেসব আইনজীবী মাস্তানি করছেন তাদেরও পথে বসতে হবে।
লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আরও পড়ুন:দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বিচার ব্যবস্থার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি পৃথক বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
গতকাল রোববার সিলেটের দ্য গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে বাণিজ্যিক আদালত শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ প্রস্তাব দেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো পৃথক বিচারিক ফোরাম নেই। এখন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যিক বিরোধগুলো ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার সঙ্গে একই সারিতে নিষ্পত্তি করতে হওয়ায় দ্রুত, কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এটি আমাদের বিচারকদের প্রতি কোনো সমালোচনা নয়। তাদের নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। বরং এটি একটি কাঠামোগত অসংগতি। ফলে মামলার জট যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শুধু অর্থঋণ আদালতে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি মামলা অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
পৃথক বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি কারও একক কোনো দাবি নয় বরং বাণিজ্যিক মামলাগুলো বিশেষায়িত আদালতে নির্দিষ্ট সময়সীমা ও কার্যকর রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সবাই দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এই দাবি জানিয়ে আসছে।
প্রধান বিচারপতি বৈশ্বিক উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, রুয়ান্ডা, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো বাণিজ্যিক আদালত গড়ে তুলে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এসব দেশের অভিজ্ঞতাগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বহন করে।
প্রধান বিচারপতি প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থার সাতটি মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- স্পষ্ট ও একীভূত এখতিয়ার নির্ধারণ, আর্থিক সীমারেখা ও স্তরভিত্তিক কাঠামো, বাধ্যতামূলক কেস ম্যানেজমেন্ট ও কঠোর সময়সীমা, সমন্বিত মধ্যস্থতা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার (যেমন, ই-ফাইলিং, ডিজিটাল ট্র্যাকিং, হাইব্রিড শুনানি), সবার জন্য ন্যায়সংগত প্রবেশাধিকার এবং জবাবদিহি ও কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক আদালতের কার্যক্রম হবে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন সিলেটের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাফর আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফান লিলার।
বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল আবার পেছানো হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমানের আদালত গতকাল সোমবার আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন দিন ধার্য করেন।
এ পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা মোট ১২০ বার পিছিয়ে এসেছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নির্মমভাবে খুন হন। ঘটনার সময় বাসায় তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ উপস্থিত ছিলেন। সাগর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামিরা হলেন — রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল ইসলাম ওরফে অরুন, আবু সাঈদ, সাগর-রুনির বাড়ির দুই নিরাপত্তা রক্ষী পলাশ রুদ্র পাল ও এনায়েত আহমেদ এবং তাদের ‘বন্ধু’ তানভীর রহমান খান।
এদের মধ্যে তানভীর ও পলাশ জামিনে রয়েছেন, বাকিরা বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন বারবার পিছিয়ে আসায় এ মামলার দ্রুত বিচার ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশায় সংশ্লিষ্ট পক্ষের মাঝে উদ্বেগ বিরাজ করছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় পুলিশের সদস্যসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের শুনানি আজ।
সোমবার (২৮ জুলাই) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ এই শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ আজ এই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি করবেন বলে জানানো হয়েছে।
এর আগে, শুক্রবার (২৫ জুলাই) কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ছয় আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এই ছয় আসামি হলেন— সাবেক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরীফুল ইসলাম, রাফিউল, আনোয়ার পারভেজ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী আশেক।
গত ১০ জুলাই পলাতক ২৬ আসামিকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে, ৩০ জুন আবু সাঈদ হত্যায় পুলিশের সদস্যসহ মোট ৩০ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই বিকালে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত প্রথম শিক্ষার্থী।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ধানমণ্ডির বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ রবিউল হোসেন ভূঁইয়া তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে কোন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তিনি জানান, তথ্য এলে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালে খায়রুল হক শপথ নেন। পরের বছর ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৩ সালে তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা একই পদে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয় সাবেক এই বিচারপতিকে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছিল না।
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীসহ বহু হতাহতের ঘটনায় আজ বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে দেশের সকল আদালত।
আজ সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতি আপিল বিভাগ তাদের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন। এদিকে আজ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগেও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অন্যদিকে, প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. আজিজ আহমদ ভূঞা স্বাক্ষরিত অধস্তন আদালতে নীরবতা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে হৃদয়বিদারক এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকার ২২ জুলাই সারা দেশে শোক দিবস ঘোষণা করেছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করছেন। বিচার বিভাগীয় পর্যায়েও বিষয়টি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা আবশ্যক। এমতাবস্থায়, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২২ জুলাই দেশের সকল অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সেই সাথে দেশের সকল অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে। এছাড়া ২২ জুলাই হতে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সকল জেলা জজশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
সারাদেশে মুজিব শতবর্ষ পালন ও শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল নির্মাণের আর্থিক হিসাব চেয়ে ৬৪ জেলায় চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধানে উপপরিচালকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের উপপরিজালক আকতারুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুদক জানায়, ৬৪ জেলা পরিষদ বরাবর পাঠানো চিঠিতে মুজিবর্ষ পালনে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, ব্যয় করা মন্ত্রণালয়ের নাম, ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ, ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তার নাম পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া, জেলায় কতগুলো এবং কোথায় ম্যুরাল তৈরি হয়েছে, ম্যুরাল নির্মাণে কত টাকা খরচ হয়েছে, ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তার পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন ও শেখ মুজিবের ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে ওই অর্থ অপচয় ও ক্ষতিসাধন করার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। তাই রেকর্ডপত্র দ্রুত দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর আগে দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি স্থাপন করে আওয়ামী লীগ সরকার। টানা ১৫ বছর ধরেই ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও প্রতিকৃতি তৈরির মহোৎসবে মেতে উঠেছিল দলটি। অভিযোগ রয়েছে, অপ্রয়োজনীয় ম্যুরাল ও ভাস্কর্য তৈরিতে ৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়ে থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, পুরো প্রকল্পই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
সূত্র জানায়, জেলা পরিষদে পাঠানোর আগে একই চিঠি বাংলাদেশ বেতার, কৃষি গবেষণা কাউন্সিলেও পাঠানো হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর মুজিববর্ষ পালনে অর্থ অপচয় ও এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হবে বলে জানিয়েছিল দুদক।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি), অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেছেন, মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাস করে এ দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করা যাবে না। অপরাধী যেই হোক বা যে দলেরই হোক, আমরা তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করব।
শনিবার (১২ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে ঘটে যাওয়া ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণের অগ্রগতিসহ আরও কয়েকটি ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করেন র্যাবের ডিজি। ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন।
এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, ‘র্যাব এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোনো ধরনের অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের বিষয়ে তৎপর রয়েছে। দেশে বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তাদের যেন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। মব ভায়োলেন্স সৃষ্টির অপরাধে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ জন অপরাধীকে র্যাব আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।’
‘গত ২ জুলাই লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানায় সন্ত্রাসী কর্তৃক মব সৃষ্টির মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের আহত করে আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা ৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। এ ছাড়াও গত ৩ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় একই পরিবারের মা ও দুই সন্তানের ওপর মব ভায়োলেন্সের অযাচিত ঘটনায় ৬ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
সলিমুল্লাহ মেডিকেলের সামনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত এজাহারনামীয় ৪ নম্বর আসামি আলমগীর (২৮) এবং ৫ নম্বর আসামি মনির ওরফে লম্বা মনিরকে (৩২) আমরা গতকাল (শুক্রবার) রাজধানীর কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।’
‘এ ঘটনায় আমরা ছায়া তদন্ত করছি, আর পুরো বিষয়টি দেখছে ডিএমপির তদন্ত বিভাগ।’
র্যাবের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য