জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফাকে বলেছিলেন- ‘আমাদের বাঁচার দাবি’। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলনে তিনি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ৬ দফার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। ৬ দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ।
৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। সেখানে বসেই তিনি পরবর্তী ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন, যা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’ তে ছাপানো হয়। বইটির বিভিন্ন স্থানে ৬ দফা সম্পর্কিত লেখাগুলো সংকলন করেছে আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিচার্স অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। তা থেকে চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরা হলো-
২রা জুন ১৯৬৬
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তর হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য।
অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন। পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?
শুনলাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন।
এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধরতে পারলে কাউকে ছাড়বে না । মীজান ফিরে এসেছে এই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতে ঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুছা সাহেব বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়তো, পূর্বে কোনোদিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।
কোনোমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে? কাগজ এল, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ই জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি।
এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মি. মশিউর রহমান ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না।’
এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছুসংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজেদেরকে চীনপন্থী বলে থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে।
ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।
মওলানা সাহেবকে আমি জানি। কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমনকি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাকে নিষেধও করেছিলেন।
মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেইভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।
৪ঠা জুন ১৯৬৬
ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতল সম্বন্ধে কোন সংবাদ ছাপতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে আরও হকুম দিয়েছে- এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করছে এটা লিখতে পারবা না। ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারব না।’ ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র-তরুণ কর্মীরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেপ্তারের পরও ভেঙে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে। রাজনৈতিক কর্মীদের জেল খাটতে কষ্ট হয় না, যদি বাইরে আন্দোলন থাকে।
৫ই জুন ১৯৬৬
আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে। আরও আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গার। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবি দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত।
যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে যে তাদের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে।
এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলা হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।
এখন একমাত্র চিন্তা কর্মীরা নেতা ছাড়া আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা! আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা তাদের সাথে আছে। কিছুসংখ্যক শ্রমিক নেতা-যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে— তারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্লেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই।
মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কী হবে। তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে।
৬ই জুন ১৯৬৬
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ৬ দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধার চেষ্টা যে তিনি করছেন এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও বোঝেন না।
ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়। আবার বাইরে যাই- কেবল একই চিন্তা! দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজগুলি এল।
ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। যশোরে আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভূতপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। নূরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকেসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করেছেন। তারা ৬ দফা দাবিকে সমর্থন করেছেন এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ এবং তাদের মুক্তি দাবি করেছেন।
আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথসভা করে চলেছেন। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।
আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাতে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন।
ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক একজনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।
৭ই জুন ১৯৬৬
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কী হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীয় ভেদ করে খবর আসলো- দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।
আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনী কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।
আবার খবর এল টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে। সিপাইরা সিপাইদের বলে। ১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ৬ দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।
এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কী করতে পারি। বিকালে আবার গুজব শুনলাম- গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালে একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এতো বোকামি করে? ১৪৪ ধারা দেওয়া হয় নাই। গুলি চলবে কেন?
একটু পরেই খবর এল ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।
বিকালে আরও বহু লোক গ্রেপ্তার হয়ে এল। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও এক মাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল। সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালা বন্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল ও পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, তার থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।
তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯ শে সেপ্টেম্বরও। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল।
গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি। যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে? নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি । তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।
দৈনিক আজাদ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, ‘আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল’। প্রোগ্রামটাও দিয়েছে ভাল করে।
পাকিস্তান অবজারভার হেডলাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। খবর মন্দ দেয় নাই। মিজানের বিবৃতিটি চমৎকার হয়েছে। হলে কি হবে, ‘চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।’
৮ই জুন ১৯৬৬
ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই।
অনেক যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙ্গা। এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল অনেক। কিছুসংখ্যক স্কুলের ছাত্র আছে।
জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভাল ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেফতারের পরে এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, আর কাহাকেও দুই মাস, এক মাস ও কিছু সংখ্যার ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ভাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে! এরা রাতভর কেঁদেছে। ভাল করে খেতে পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে?
জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না। ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এর জেলে আসার পরে খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ায় গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসে নীরবে সমবেদনা জানান ছাড়া আমার কি করার আছে। আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজকে সামলানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।
২টার সময় কাগজ এল। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো । কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই। ধর্মঘটের কোনো সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেস নোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা । কোন জেলার কোন সংবাদ নাই । প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।
খবরের কাগজগুলো দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম। পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়াছে। এটা তো ভয়াবহ খবর। সরকার যখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুণ বেশি হতে পারে ভাবতে আমার ভয় হলো!
কতজন যখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই যেন জনগণের । যেখানে উসকানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই। এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে । এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই । যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোনো গন্ডগোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি।
বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জামি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মী আর জনসাধারণ জানতে পারে। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১টায় শোভাযাত্রা, বিকালে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে এই সর্বনাশ করেছে।
তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?
ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।
যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশে ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সম্পদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি। আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।
সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম। রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।
৯ জুন ১৯৬৬
অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলে মেয়ে না খেয়েই আছে। দুই মাসের সাজা দিয়েছে অনেকে। খবরের কাগজে দেখলাম সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে। এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো। যারা আহত হয়েছে তাদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, ১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?
১২ই জুন ১৯৬৬
দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তার সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭, ১৮, ১৯ জুন জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ আগস্ট এর পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই।
৬ দফার বাস্তবায়ন সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে। ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচ চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনোদিন আমি দেখি নাই। বোধ হয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য । তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।
১৪ই জুন ১৯৬৬
পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুমের খবর আজ আর গোপন নাই। ৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায়? পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত- শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে।
আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাঁচে; থাকতে আর চায় না, এই পাষাণ-কারার ভিতরে। আমার কাছে এসে থেমে গেল। বলল, ‘আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব।’
আমি বললাম, ‘যাও, সকলকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য চিন্তা করিও না।’
ওদের দিকে আমি চেয়ে রইলাম। ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে পেল। মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড়। এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম। শক্তি পেলাম মনে। মনে হলো পারব। বহুদিন জেল খাটতে পারব। এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলনে তখন কে আর রুখতে পারে?
১৮ই জুন ১৯৬৬
আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে। দেখা যাক কি হয়।
বিকালটা ভালই ছিল। বৃষ্টি হয় নাই। হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন। তিনি নেমে এসেছেন দরজার কাছে। আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, চিন্তা করিও না। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। দেখ না আমাকে একলা রেখেছে। সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে। কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে। আমি এদের ক্ষতি করতে চাই না। তাই চলে এলাম আমার জায়গায়। শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম। জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!
২৮শে জুন ১৯৬৬
খবরের কাগজ এসেছে। ভাসানী সাহেবের রাজনৈতিক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। যখন গুলি চলছিল, আন্দোলন চলছিল, গ্রেপ্তার সমানে সমানে চলেছে তখন দেখলাম শুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার দেখলাম দুই তিন দিন পরে কোথায় যেতে ছিলেন পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। হঠাৎ অসুস্থ মানুষ আবার বাড়ির বাহির হলেন কি করে? যখন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য কর্মীরা কারাগারে-এক নারায়ণগঞ্জে সাড়ে তিনশত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে, তখনও কথা বলেন না। আওয়ামী লীগ যখন জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করল তখন একদল ভাসানীপন্থী প্রগতিবাদী (!) এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে সরকারের সাথে হাত ও গলা মিলিয়েছে। এখন তিনি হঠাৎ আবার সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিজে ময়দানে নামবেন।
মওলানা সাহেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষতাবে আইযুৰ খানকে সমর্থন করে চলেছেন। মাওলানা সাহেবের সাথে যদি যুক্তফ্রন্ট করতে হয় তবে আইয়ুব সাহেবই বা কি অন্যায় করেছেন? মওলানা সাহেব তো দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশে গণআন্দোলন বা দেশের জনগণের দাবি পূরণ ছাড়া বৈদেশিক নীতিরও কোনো পরিবর্তন হতে পারে। জনগণের সরকার কায়েম হলেই, জনগণ যে বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে বলবে, নির্বাচিত নেতারা তাহাই করতে বাধ্য।
ডিক্টেটর যখন দেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং একটা গোষ্ঠীর স্বার্থেই বৈদেশিক নীতি ও দেশের নীতি পরিচালনা করছে তার কাছ থেকে কি করে এই দাবি আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছি না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, খাদ্য, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে তখন পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে এখন এসেছেন যুক্তফ্রন্ট করতে।
আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতা ও কর্মী কারাগারে বন্দি কেহ কেহ আত্মগোপন করে কাজ করছে, এখন যে কয়েকজন বাইরে আছে তারা কিছুতেই এদের সাথে যোগদান করতে পারে না। আর ছয় দফা দাবি ছেড়ে দিয়ে কোনো নিম্নতম কর্মসূচি মেনে নিতে পারে না। ছয় দফাই নিম্নতম কর্মসূচি।
কোনো আপোষ নাই। জনগণ যখন এগিয়ে এসেছে, দাবি আদায় হবেই। আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। জনগণকে আর ধোঁকা দেওয়া চলবে না। অনেক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়ে গেছে। আর না।
ভাসানী সাহেব এগিয়ে যান আইয়ুব সাহেবের দল নিয়ে। এখন তো তিনি সুখেই আছেন, আর কেন মানুষকে ধোঁকা দেওয়া? আওয়ামী লীগ বা তার নেতারা যদি ছয় দফা দাবি ত্যাগ করে আপোষ করতে চান তারা ভুল করবেন। কারণ তাহলে জনগণ তাদেরও ত্যাগ করবে।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক বাবু ও আবদুল মান্নানের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে। বিচারে কি হয় দেখা যাক।
২রা জুলাই ১৯৬৬
আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলছে। ছয় দফা। জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে পাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ফেডারেল না মেনে আমাদের শাসকগোষ্ঠীও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের আওতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের নয়া দাবি চাই, অন্যকে দিতে চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।
১৮ই জুলাই ১৯৬৬
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতেছে। কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। তবুও দেখে আনন্দই হলো যে, ২৩ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করেছে। কাজ করে যেতে হবে। ৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপোষ হবে না। আমাদেরও রাজনীতির এই শেষ।
ন্যাপের সভাপতি নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সব দলকে এক করতে চান, আজ তাদের সভায় বলেছেন। নিম্নতম কর্মসূচি দিয়ে চুপচাপ তাঁহার নতুন বাড়ি বিন্নাচর গ্রামে যেয়ে বসে থাকলেই দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আওয়ামী লীগ শুরু করেন সেই সময় হতে এই ভদ্রলোক বহু খেল দেখাইছেন। মিস জিন্নাহর ইলেকশন ও অন্যান্য আন্দোলনকে তিনি আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করার জন্য বানচাল করতে চেষ্টা করছেন পিছন থেকে। তাকে বিশ্বাস করা পূর্ব বাংলার জনগণের আর উচিত হবে না। এখন আর তিনি দেশের কথা ভাবেন না। আন্তর্জাতিক হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আইযুব-ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম পাঠান আর কাগজে বিবৃতি দেন। বিরাট নেতা কিনা? আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের মজলুম জননেতা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঁচুক আর মরুক তাতে তার কি আসে যায়। আইয়ুব সাহেব আর একটা ডেলিগেশনের নেতা করে পাঠালে খুশি হবেন। বোধহয় সেই চেষ্টায় আছেন।
নুরুল আমীন সাহেব সকল দলকে ডাকবেন একটা যুক্তফ্রন্ট করার জন্য। ৬ দফা মেনে নিলে কারও সাথে মিলতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নাই। মানুষকে আমি ধোঁকা দিতে চাই না। আদর্শে মিল না থাকলে ভবিষ্যতে আবার নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিতে বাধ্য। সেদিকটা গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আইয়ুব সরকারের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হলে আদর্শের সাথে যাদের মিল নাই তাদের সাথে এক হয়ে গোঁজামিল দিয়ে থাকা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে আইয়ুব সাহেবের ক্ষতি কিছু করা গেলেও জনগণের দাবি আদায় হবে না।
এত অত্যাচারের মধ্যেও ৬ দফার দাবি এগিয়ে চলেছে। শত অত্যাচার করেও আন্দোলন দমাতে পারে নাই এবং পারবেও না। এখন যারা আবারও যুক্তফ্রন্ট করতে এগিয়ে আসছেন তারা জনগণকে ভাঁওতা দিতে চান। যারা আন্দোলনের সময় এগিয়ে আসে নাই তাদের সাথে আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ এতে উপকার থেকে অপকার হবে বেশি। কোনো নিম্নতম কর্মসূচির কথা উঠতেই পারে না। নিম্নতম কর্মসূচি হলো ৬ দফা। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক না হলে কোনো দাবি আদায় হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পূর্বে ঠিক হওয়া দরকার।
১৯ জুলাই ১৯৬৬
মওলানা ভাসানী সাহেব হঠাৎ সুস্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ৬ দফা সমর্থন করেন না। তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন। কারণ, তার পার্টির জন্ম হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। কাগমারি সম্মেলনের কথাও তিনি তুলেছেন। তিনি নাকি দেখে সুখী হয়েছেন যে, একসময়ে যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করবার জন্য তার বিরোধিতা করেছেন তারাই আজকাল স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছেন।
মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়াছেন, ভুলবার যদিও কোনো কারণ নাই, সামান্য কিছুদিন হলো ঘটনাটা ঘটেছে। খবরের কাগজগুলি আজও আছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কর্মীরা আজও বেঁচে আছে। তারা জানে, বিরোধ ও গোলমাল হয় বৈদেশিক নীতি নিয়ে। সে গোলমালও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সম্মেলনের পূর্বের রাতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ। মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায়ও হবে। জনগণ ৬ দফাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে।
২০শে জুলাই ১৯৬৬
নুরুল আমিন সাহেব ঐক্যবদ্ধ হতে অনুরোধ করেছেন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকলেই দাবি আদায় হয় না। নূরুল আমীন সাহেব যাদের নিয়ে দল করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আব্দোলনের ও জেলে যাবার কথা শুনলে প্রথমে ঘরের কোণেই আশ্রয় নিয়ে থাকেন। আর পিছন থেকে আন্দোলনকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। বেশি গোলমাল দেখলে পাসপোর্ট নিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিদেশে রওয়ানা হয়ে যান।
৬ দফার দাবিতে যে গণঐক্য দেশে গড়ে উঠেছিল, যার জন্য হাসিমুখে কত লোক জীবন দিল, কত লোক কারাবরণ করছে, তখন এই ঐক্যবদ্ধ করার আগ্রহশীল নেতারা কেউ ঘর থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরা সংগ্রাম করবে! অন্য কেহ বিশ্বাস করলে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। কারণ এদের আমি জানি ও চিনি।
আওয়ামী লীগ সংগ্রামী দল, সংগ্রাম করে যাবে। আদর্শের মিল নাই, সামান্য সুবিধার জন্য আর জনগণকে ধোঁকা দেওয়া উচিত হবে না। নিম্নতম কর্মসূচিই ৬ দফা। সেই সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি, কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, গরিব কর্মচারীদের সুবিধা ও খাদ্য সমস্যা সম্বন্ধে কর্মসূচি নেওয়া চলে। তবে ৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবে না।
২৫শে জুলাই ১৯৬৬
আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে জনগণকে অনুরোধ করেছে, যে পর্যন্ত ৬ দফা দাবি আদায় না হয়। যদিও শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ, তথাপি সরকার অত্যাচার করে চলেছে। গুলি হলো, গ্যাস মারল, শত শত কর্মীকে জেলে দিল, বিচারের নামে প্রহসন করল, কত লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে কে তা বলতে পারে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ১১ জন মারা গেছে ৭ই জুনের গুলিতে।
আমরা পাকিস্তানকে দুই ভাগ করতে চাই বলে যারা চিৎকার করেছে তারাই পাকিস্তানের ক্ষতি করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া উচিত। তারা আলাদা হতে চায় না। পাকিস্তান একই থাকবে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হয়।
২৩ শে মার্চ ১৯৬৭
লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য দুই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীর কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে।
আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যদি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। চিরদিন কাহাকেও শাসন করা যায় না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে।
৮–১০ই এপ্রিল ১৯৬৭
আজ ৮ই এপ্রিল জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সাওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জিয়াউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করে । প্রায় চার ঘণ্টা চলে।
৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশ রক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেক কিছু। আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না। আমার সম্পদ ছলেবলে-কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।
২২ এপ্রিল ১৯৬৭
আজ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ, মালিক গোলাম জিলানী, গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, নজরুল ইসলাম, এম এ আজিজ, আবুল হোসেন এবং আরো অনেকে জেল গেটে কোর্টে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যশোর থেকে আব্দুর রশিদ, খুলনা থেকে আবদুল মোমেন এসেছিল। অনেক আলাপ হলো। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা?
নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করায় আপত্তি অনেকেরই নাই। তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জেল খাটছে। এই দাবি পূরণ না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনো পথ নাই। আমি আমার মতামত দেই নাই। কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে তাদের পথ ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপিয়ে দিতে যাব কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভাল জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো।
২৩ এপ্রিল- ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭
আমি জানি ৬ দফা দাবি পূরণ হওয়া ছাড়া এদের বাঁচানোর উপায় নাই। আজ আমি এক বৎসর দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে আছি। আমার সহকর্মীরাও আছে। আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। এক দল ৬ দফা ছাড়া আপোষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসূচিতেই রাজি।
৩-২৩ শে মে ১৯৬৭
শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএম-এ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে অ্যাকটিং সভাপতি ও অ্যাক্টিং সম্পাদক রেনুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।
আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুল, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএম-এ যোগদান করতে রাজি নয়।
খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সে পিডিএম-এর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে।
তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নুরে আলম, নূরুল ইসলাম- আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিত নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম-এর পক্ষে। কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএম-এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে।
আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানসপুত্র বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই। তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকেদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী।
৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই। তবে এই সকল বড় বড় নেতা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না আমার জানা আছে। মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে।
১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি, পিডিএম-এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। এজন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন।
আমার ব্যক্তিগত মত- ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি। বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে; তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই।
এও বলেছি- এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোন আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা হয়েছে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আব্দুর রশিদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম-এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। তারা সভায় যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়; ৬ দফার আর প্রয়োজন নেই তাদের কাছে।
২৭-২৮মে ১৯৬৭
জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে- ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএফ কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই।
এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। আমেনাকে বললাম, ‘৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা।’
২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, যাতে ৭ই জুন ‘৬ দফা দাবি দিবস’ পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।
সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাকে দমাতে হবে- এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮
রাত ১২টার দিকে আমাকে জেলার সাহেব ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বললো, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার। এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে।
দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১টা মামলা দায়ের করেছে আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে। এরপরও এদের ঝাল পড়ল না, ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। ডেপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কাণ্ড। সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ‘অভ্যর্থনা’ করার জন্য। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’ আমি তাকে বললাম, ‘নিশ্চয় আপনার কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব।‘ তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, ‘আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।‘ আমি বললাম- ‘ঠিক আছে, চলুন কোথায় যেতে হবে।’
সামরিক জিপে চড়ে এসে পৌঁছলাম একটা ঘরের সামনে। এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিচ্ছে। আমাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক কামরাবিশিষ্ট। একটা দালান। সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে। দু’খানা খাট পাশাপাশি। একটা খাটে একটা বিছানা আছে। আর একটা খাট খালি পড়ে আছে। একজন কর্মচারী- যার নাম লেফটেন্যান্ট জাফর ইকবাল সাহেব। তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে, সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন। আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই। কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
গত বছরের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আনিকা মেহেরুন্নেসা শাহি। তার ইচ্ছা ছিল এলাকায় বিচারক হয়ে ফেরার; ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার। সে ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে সোমবার লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এ ছাত্রী।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি ছাত্রীনিবাস থেকে রবিবার রাতে ঝুলন্ত অবস্থায় আনিকাকে উদ্ধার করে নিউ মার্কেট থানা পুলিশ। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান।
আনিকার বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামে। সেখানে সোমবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, তার শতবর্ষী দাদা আলহাজ সোলাইমান আলী মণ্ডল হতভম্ব হয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন। কান্না থামছিল না ফুফু আক্তার বানুর।
আনিকার এমন মৃত্যুতে বিস্মিত পরিবারের সদস্য ছাড়াও প্রতিবেশীরা চেয়েছেন ঘটনার রহস্য উদঘাটন।
পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ হোসেনের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন আনিকা মেহেরুন্নেসা শাহি। ২৪ বছরের এ তরুণী ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ২০২০-২১ সেশনে ভর্তি হন ঢাবির দুর্যোগ বিজ্ঞান ও স্থিতিস্থাপকতা বিভাগে।
এ বিভাগের পড়াশোনা শেষ করে আইনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিচারক হতে চেয়েছিলেন আনিকা।
গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নওগাঁয় সম্মুখসারিতে ছিলেন আনিকা। পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলায় মাইক হাতে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে সড়কে দাঁড়ান তিনি।
সুষ্ঠু তদন্ত দাবি
পরিবারসহ এলাকাবাসীর দাবি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আনিকার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হোক।
বকুল নামের একজন মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখি আনিকার মরদেহ ফ্যানের সাথে ঝুলছিল, কিন্তু অর্ধেক মেঝেতে লেগে ছিল। আমার জানা মতে একটা ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল।
‘আমরা ঢাকায় আছি। তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। তবে আমরা যখন যাই, তখন দেখি লক ভাঙা ছিল। মনে হয় তাকে কেউ নামানোর চেষ্টা করেছিল।’
বুটেক্স ছাত্র আটক
আনিকার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) এক ছাত্রকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
বাহিনীর ধারণা, প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন ঢাবির এ ছাত্রী। তবে এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:নওগাঁয় অনিয়ম করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিইসি) বীজ ও সারের ডিলারশিপ নিয়েছেন সরকারি কলেজের প্রভাষক ও কৃষি কর্মকর্তা। তাদের স্বজনদেরও একই সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন তারা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ অনুসারে, একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে অন্য কোথাও থেকে কোনো ধরনের সুযোগ- সুবিধা নেওয়ার বিধান নেই। একই সঙ্গে একজন ব্যক্তি একের অধিক ডিলারশিপ নিতে পারবেন না।
অন্যদিকে আচরণ বিধিমালার ১৭ (১) নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘এই আইনের অন্য বিধান অনুসারে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না অথবা দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো কাজ কিংবা চাকরি নিতে পারবেন না।’
অনিয়মে যুক্তদের ভাষ্য
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ী নওগাঁতে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ফজলে রাব্বি। তিনি তার স্ত্রী সম্পা বেগমের নামে বিএডিসির বীজের লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে কৌশলে ডিলারশিপ বিক্রি করে খাচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নওগাঁ শহরে বসবাস করলেও তারা পোরশা উপজেলায় ‘সাইফ ট্রেডার্স’ নামের ঠিকানা ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়ে রেখেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্পা বেগম তার নামে লাইসেন্স স্বীকার করে বলেন, ‘আমি নওগাঁ বসবাস করলেও পোরশায় আমার দোকান রয়েছে। ওখানে একটি ছেলে আছে। সে দোকান চালায়।’
দোকানের ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী রাব্বি নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে চাকরি করেন। তিনি সব বলতে পারবেন।’
সাইফ ট্রেডার্স নামের কোনো দোকান পোরশা বাজারে পাওয়া যায়নি। দোকানের সঠিক ঠিকানা কোথায় জানতে চাইলে সম্পা কোনো সদুত্তর না দিয়ে কথা না শোনার ভান করে ফোনের সংযোগ কেটে দেন। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফজলে রাব্বির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই লাইসেন্সটা আমার স্ত্রী সম্পার নামে করা আছে।’
নিয়মিত বীজ তোলেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাই অফিসে আসেন, চা খেয়ে যান। আপনাদের অনেক সাংবাদিক আসে; চা খেয়ে যায়।
‘সবার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আপনি অফিসে আসেন, চা খেয়ে যান।’
ওই বক্তব্যের পর সংযোগটি কেটে দেন তিনি।
এদিকে জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার মেসার্স জিমান ট্রডার্স নামে নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ফারুক হোসেন নিয়ে রেখেছেন বিএডিসির সার লাইসেন্সের ডিলারশিপ। প্রোপাইটারে জায়গায় রয়েছে তার নিজের নাম।
তার ছেলে জিমানের নামে নিয়ামতপুর বাজারে রয়েছে দোকান। নিয়মিত বিএডিসির সার ও বীজ তুলে বিক্রি করেন তিনি।
এ বিষয়ে নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘লাইসেন্সটা অনেক আগে করা ছিল। তখন আমার কলেজ সরকারি হয়নি। ২০১৮ সালে আমার কলেজ সরকারি হয়েছে।’
‘তাহলে দীর্ঘ সাত বছর ধরে সরকারি ডাবল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। এটার সুযোগ রয়েছে কী?’
উল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই একাধিক জায়গা হতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা আমার অন্যায় হয়েছে। আমি তিন মাস আগে ডিসি অফিসে লাইসেন্স বাতিলের আবেদন জানিয়েছি।’
এদিকে ধারাবাহিকভাবে গত মাসেও সরকারি গুদাম থেকে সার তুলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সটা আমার ছেলের নামে হস্তান্তর করা হবে। তার প্রক্রিয়া চলছে।’
অপরদিকে ধামইরহাট উপজেলার ধামইরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক তৌহিদুল ইসলাম তার নিজ নামে নিয়ে রেখেছেন বিসিআইসির সার ডিলারশিপ। সরকারি গুদাম থেকে নিয়মিত সার তুলে উপজেলার আমাইতাড়া বাজারে বিক্রি করছেন তিনি।
এ বিষষে জানতে ধামইরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক তৌহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আসলে ওটা অনেক আগে করা হয়েছিল। পরে আমার কলেজ সরকারীকরণ হয়।
‘সরকারি একাধিক জায়গা হতে সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি বেআইনি হয়েছে। আমি লাইসেন্সটা ট্রান্সফার করে দেব।’
‘আপনি তো এখনও নিয়মিত সার তোলেন।’ এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘আসলে এখন ইরি-বোরো মৌসুম চলছে তো। তাই একটু তুলতেছি।’
যা বলছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা
ডিলারশিপের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে বিএডিসি কিংবা বিসিআইসির ডিলারশিপ লাইসেন্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা এটা করতে পারে না।’
‘আপনার অধিদপ্তরে এমন অনেকে রয়েছে। তাহলে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?’
এমন প্রশ্নে প্রোগ্রামের ব্যস্ততার কথা বলে ফোন লাইন কেটে দেন এ কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ইউএনও, কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে জেলা কমিটিকে প্রস্তাব পাঠাই। তারপর অনুমোদন দেওয়া হয়।
‘সরকারি চাকরি করে বিএডিসি কিংবা বিসিআইসির ডিলারশিপ লাইসেন্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পূর্ব অনুমতিও নিতে পারত এ ক্ষেত্রে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িতে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অজ্ঞাত মুখোশধারীরা গত রবিবার রাতের বেলায় জমিদার বাড়ির পুরোহিতকে ধরে নিয়ে জঙ্গলে বেঁধে রাখে। টাকা-পয়সা এবং জমিদারেরও খোঁজ করে তারা।
এমন পরিস্থিতিতে ডাকাত আতঙ্কে রয়েছেন বাড়ির লোকজন।
মুখোশধারীরা ঘণ্টা তিনেক ধরে বাড়িটির বিভিন্ন কক্ষ ও আশপাশে তল্লাশি চালানোর কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
এতে দেখা যায়, রবিবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে জমিদার বাড়ির পুরোহিত বাদল ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী নেলী চক্রবর্তী ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে দুজন মুখোশধারী ধরে জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে পুরোহিতকে বেঁধে ফেলে।
জমিদার বাড়ির পুরোহিত বাদল ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাতে ঘুমানোর আগে স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়েছিলাম। এর মধ্যেই দুজন মুখোশধারী আমাদেরকে ধরে বাড়ির পাশে জঙ্গলে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। এ সময় মুখোশধারীরা জমিদার কোন ঘরে জানতে চায়। সিন্দুকের খোঁজও চায় তারা।
‘বাড়ির তিন তলায় ওঠার চেষ্টাও করে। ঘণ্টা তিনেক ধরে বাড়িটির বিভিন্ন কক্ষ ও আশেপাশে তল্লাশি চালায়।’
বাড়ির কেয়ারটেকার স্বপন সাহা বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবত জমিদার বাড়িতে চাকরি করছি। দেশের বিভিন্ন জায়গার লোকজন এখানে ঘুরতে আসেন। পুরো বাড়ি তাদের ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করি।
‘কিন্তু অতীতে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। এই ঘটনার পর থেকে বাড়ির লোকজন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।’
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িটিতে জমিদারের একমাত্র শেষ বংশধর মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী বসবাস করছেন। নিঃসন্তান ব্যক্তিটির স্ত্রী কিছুদিন আগে লোকান্তরিত হন। বাড়িটিতে বর্তমানে তিনি ছাড়া কয়েকজন কর্মচারী ও পুরোহিত অবস্থান করছেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে বাড়িটিতে অজ্ঞাত কয়েকজন মুখোশধারী হানা দেয়। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে চারজনকে দেখা যায়।
বাড়ির মালিক মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী বলেন, ‘মুখোশধারীরা হয়তো ধনদৌলত নিতে কিংবা আটকে রেখে টাকা-পয়সা দাবি করতে চেয়েছিল। তবে বাড়ির লোকজন সজাগ হয়ে যাওয়ার মুখোশধারীরা সেটা করতে পারেনি।’
জানতে চাইলে হোসেনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মারুফ হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন:বিনা নোটিশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, বগুড়ার আকস্মিক উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছে।
এ ধর্মঘটে বুধবার সকাল ৮টা থেকে নওগাঁর সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রয়েছে, যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন চালকরা।
কী বলছেন ভুক্তভোগীরা
যানবাহন না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী লোকজনও। তাদের একজন বেসরকারি সিম কোম্পানির কর্মী আল-আমিন।
তিনি বলেন, ‘বাসা থেকে সকাল সাড়ে আটটায় মোটরসাইকেল নিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে তেল শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আধা কিলোমিটার ঠেলে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় পেট্রল পাম্পে নিয়ে আসি।
‘পাম্প বন্ধ থাকায় আবার ঠেলে নিয়ে চলে যেতে হয়। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
আবদুল মান্নান নামের এক বাইকচালক বলেন, ‘আমি জানতাম না পেট্রল পাম্প মালিকদের ধর্মঘট চলছে। পেট্রল পাম্পে এসে দেখি পাম্প বন্ধ। তেল দেওয়া হচ্ছে না।
‘এখন তেল ছাড়া আমরা কীভাবে চলি? আগে জানানো হলে তাও সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ে অবস্থিত মেসার্স সাকিব ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকেই অফিসগামী মোটরসাইকেল আরোহী ও জ্বালানিচালিত বিভিন্ন যানবাহনগুলো পাম্পে এসে বন্ধ থাকায় ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যানবাহন চালকদের। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান চান যানবাহন চালকরাও।
‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সকল পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই আমাদেরও বন্ধ রাখতে হয়েছে।’
প্রেক্ষাপট
পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহীর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়কে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সওজ বগুড়া। ওই সময় সান্তাহারের হামিম ফিলিং স্টেশন ও আনিকা ফিলিং স্টেশনে তেলের মিটার উচ্ছেদ করা হয়।
তারা জানান, পূর্বঘোষণা, নোটিশ বা আনুষ্ঠানিক চিঠি না দিয়ে এ উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্টস এবং পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী বিভাগ’ সব পেট্রল পাম্প বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ ট্রেন ব্যবহার করেন। হঠাৎ করে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার সুযোগে বাসের ওপর বাড়তি যাত্রীর চাপ বেড়েছে। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বাসের টিকিটের মূল্য বেড়ে গেছে।
খুলনা থেকে নওগাঁ যাওয়ার জন্য সকালে রেলওয়ে স্টেশনে এসেছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।
তারা জানান, খুলনা থেকে নওগাঁ যেতে তারা সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে কোনো টিকিট পাননি। বাসে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তাতে ভাড়া গুনতে হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এ পথে নিয়মিত ভাড়া ৫০০ টাকার বেশি নয়।
শ্রমিকদের একজন সান্তনু বলেন, ‘সকাল থেকে আমরা কয়েকজন এখানে এসে বসে আছি। কয়েকজন গিয়ে বাসের খোঁজ নিয়েছে; কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
‘অতিরিক্ত ভাড়ায় আমরা যেতে পারছি না। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি ট্রেন চালু হয় কি না। না হলে সন্ধ্যার দিকে বাসে করে রওনা দেব।’
সান্তনুর মতো অনেক দূরপাল্লার যাত্রীকে খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা বাসে করে গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন।
খুলনা থেকে উত্তরবঙ্গে দৈনিক একাধিক ট্রেন যাতায়াত করে। এর মধ্যে কপোতাক্ষ ও সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস খুলনা থেকে রাজশাহী, রূপসা ও সীমান্ত এক্সপ্রেস খুলনা থেকে চিলাহাটি, মহানন্দা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রকেট এক্সপ্রেস খুলনা থেকে পার্বতীপুর, নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট, বেনাপোল ও মোংলা কমিউটার খুলনা থেকে বেনাপোল যাতায়াত করে।
এ ছাড়া সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেস খুলনা থেকে ঢাকাতে যাতায়াত করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে এর মধ্যে কোনো ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়নি। ফলে হাজার হাজার হাজার যাত্রী স্টেশনে এসে ফিরেছেন।
রেলওয়ের রানিং স্টাফরা মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে এ সুবিধা সীমিত করা হয়।
ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত বুধবার রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ২৭ জানুয়ারির মধ্যে দাবি পূরণের আলটিমেটাম দেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন তারা।
খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সোমবার রাত ১২টা থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ। আজ কোনো ট্রেন চলেনি। টিকিট বুকিং দেওয়া যাত্রীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
এ সমস্যার সমাধান কবে হবে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন:দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে নব্বইয়ের দশকে নির্মিত ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি।
এমন পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালতে কর্মরতদের।
সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থদের অবহিত করে গণপূর্ত বিভাগের ঝালকাঠি অফিস ২০১৯ সালে চিঠি চালাচালি করলেও বিষয়টি এখনও ফাইলবন্দি।
ভবনটি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই সংস্কার অথবা পুনর্নির্মাণের দাবি আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর জরাজীর্ণ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ৫ নভেম্বর বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবর পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠান।
ভবন পরিদর্শনকালে তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলী, গণপূর্তের ঝালকাঠির নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ উপস্থিত ছিলেন। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা।
কী ছিল পরিদর্শন কপিতে
ঝালকাঠি গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী অনিরুদ্ধ মন্ডল, মো. বদরুজ্জামান, মো. ইমরান বিন কালাম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল-মাসুম স্বাক্ষরিত ওই পরিদর্শন কপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ভবনটির দুই তলায় করিডোরের বেশ কিছু স্থানে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়ছে। এ ছাড়াও নলছিটি কোর্ট রুমের পরিদর্শনকারীদের বসার ওপরের ছাদের অংশ খসে পড়েছে। এ সমস্ত স্থানে মরিচা পড়ে রড উন্মুক্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় তলা এবং নিচ তলার করিডোরের বেশ কিছু বিম ও কলামে ফাটল লক্ষ করা গেছে।
‘ভবনটির নিচ তলায় হাজতখানার ছাদের বেশ কিছু অংশসহ করিডোরের বিভিন্ন অংশে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়েছে। এসব স্থানেও মরিচা পড়ে রড বের হয়ে আছে। নিচ তলার বিভিন্ন কলাম এবং বিমের ফাটল লক্ষ করা গেছে। কিছু স্থানে কলাম ফেটে রড বের হয়ে গেছে।’
পরিদর্শন প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ‘ভবনটির দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ১৯৮৯-৯০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ২০০৪-০৫ সালে তৃতীয় তলার উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে বিম কলামে ফাটল থাকায় এবং ছাদের কনক্রিট খসে পড়ায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
‘এমতাবস্থায়, উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত ডিজাইন বিভাগের মতামতসহ পরবর্তী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রয়োজন।’
প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ
সম্প্রতি জজ আদালত ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনের ছাদের ওপর থেকে খসে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে অনেক পিলারেও। ভারি বৃষ্টি এলেই ছাদ ও দেয়াল চুষে পানি পড়ে মেঝেতে। নষ্ট হয়ে যায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র।
দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় তিন তলা ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিচারকের এজলাস, খাসকামরা, পেশকার, সেরেস্তাদারের কক্ষ, নকল কক্ষ, হাজতখানাসহ প্রতিটি কক্ষই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই চলছে আদালতের কার্যক্রম। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
যা বলছেন আদালত সংশ্লিষ্টরা
আদালতের জরাজীর্ণ অবস্থার বিষয়ে কথা হয় আবদুর রহমান, তৈয়ব আলী, কামরুল ইসলাম, মুরাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে।
তাদের একজন বলেন, ‘আদালত ভবনের ভিতরে প্রবেশের পর কার্যসম্পাদন করে বের হওয়া পর্যন্ত আমরা থাকি আতঙ্কে। প্রায় সময়ই ছাদের পলেস্তারা খসে নিচে পড়ে।
‘বর্ষায় তো বারান্দায় পানি জমে যায়। দেয়ালে পানি চুষে অনেক ফাইল নষ্ট হয়ে যায়।’
আইনজীবী মানিক আচার্য্য বলেন, ‘ভবনটি ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তার সংস্কার করছে না কর্তৃপক্ষ। বিচারকরা যদি ভালো পরিবেশে বিচারকার্য পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে বিচারকার্যে মনোনিবেশও করতে পারেন না।
‘ঝালকাঠির বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীসহ সকলেই আমরা এ ভোগান্তিতে রয়েছি। বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থদের বিষয়টি অবগত করলেও এখনও কোনো ভূমিকা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’
আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট ফয়সাল বলেন, ‘ড্যামেজড ভবনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা এবং নতুন ভবন নির্মাণ অথবা টেকসই সংস্কারের জন্য গণপূর্তের চিঠি চালাচালি হলেও দীর্ঘদিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাইনি। জনস্বার্থে দ্রুত নতুন আদালত ভবন নির্মাণ জরুরি।’
আইনজীবী আক্কাস সিকদার বলেন, ‘বর্তমানে এ আদালতে ১৬ হাজার দেওয়ানি মামলা এবং দেড় হাজার ফৌজদারি মামলা চলমান। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে।
‘আদালত ভবনের নিচ তলায় হাজতখানার পশ্চিম দিকে মসজিদের সামনে একাধিকবার ধসে পড়েছে ছাদের অংশ। এখন এই ভবন অস্থায়ী সংস্কার না করে এটি ভেঙে এখানে নতুন ভবন করা উচিত।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘নব্বই দশকে দোতলা জজ আদালত ভবনটি নির্মাণের পর ২০০৬ সালে এর ওপর আরও এক তলা বর্ধিত করে তৃতীয় তলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে নিচ তলার অনেক পিলারে ফাটল ধরেছে। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আদালতের স্টাফ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা রয়েছেন আতঙ্কে।
‘হাজতখানা সরিয়ে পার্শ্ববর্তী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনে নেওয়া হয়েছে। ভবনে আগতদের নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দ্রুত এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।’
জরাজীর্ণ ভবনের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ ঝালকাঠির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়সাল আলম ও বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আমানুল্লাহ সরকার একই ধরনের বক্তব্য দেন।
তাদের একজন বলেন, ‘ভবন পরিদর্শনের রিপোর্ট ২০১৯ সালে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন ভবনের জন্য সম্ভাব্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে আছে।
‘সেখান থেকে অর্ডার হলেই গণপূর্ত বিভাগ টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যসম্পাদন করবে।’
ক্যাপশন: ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের ভেতরের জরাজীর্ণ অংশ। ছবি: নিউজবাংলা
আরও পড়ুন:ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আওয়ামী লীগের পলাতক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানকে কৌশলে পুনর্বাসনের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীসহ স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক ও কিছু ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট এ ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
জনসেবা অব্যাহত রাখতে নিয়ম অনুসারে ইউপি সদস্য সুমন রানাকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ করে বাকি প্যানেল গঠন করা হয়।
বর্তমানে ইউপিতে নাগরিক সেবা অব্যাহত থাকলেও প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কৌশলে অনাস্থা এনে এরশাদ আলীসহ অন্যরা পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় আছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি কৌশল জানাজানি হলে ইউনিয়নবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতায় যেকোনো সময় ওই ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
পলাতক চেয়ারম্যানকে পুনর্বাসনের ‘কৌশল’
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রথমে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক বরাবর শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব এনে একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ৯ জন ইউপি সদস্য।
পরে সেই আবেদনের জের ধরে ১৩ জানুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডের পাতায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ মো. এরশাদ আলী স্বাক্ষরিত এক পাতার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের রেজুলেশন ও অপর একটি পাতায় আটজন ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত পাতা সংযুক্ত করা হয়। এ পাতায় সভার স্থান দেখানো হয় ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে।
ওই রেজুলেশনে বলা হয়, ‘অদ্যকার অত্র আলোচনায় শুকানপুকুরী ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে ইউপির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সভায় বিস্তর আলোচনা করা হয়। এরপর সভার সভাপতি প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলীর উপস্থিতিতে সদস্যদের জানান, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্বেচ্ছাচারিতা করে আসছেন, যা জেলা প্রশাসকের বরাবরে অনাস্থার প্রস্তাব আনয়ন করি।
‘তাই ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের (পলাতক) মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখা একান্ত জরুরি মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
রেজুলুশনে উল্লেখ করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে পলাতক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পরিষদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা তথা জনসেবা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা নিয়ে দুই ইউপি সদস্যের ভাষ্য
কারণ জানতে এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করা দুজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে। তারা হলেন মো. আমজাদ ও ধর্ম নারায়ণ রায়।
ইউপি সদস্য আমজাদ বলেন, ‘৪ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে আমার বাড়ির সামনে স্থানীয় সাবেক দুজন সদস্য মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। তারা আমাকে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি অন্যান্য ইউপি সদস্যরাসহ বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত। রাতের খাবারের বিশাল আয়োজনও করা হয়েছে। আমি কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
‘পরে জানানো হলো, আমাকে বর্তমান প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে স্বাক্ষর করতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। তিনি খুব ভালোভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এসবই আলোচনা হচ্ছে। এরপর এক প্রকার জোর করেই আমাকে রাতের খাবার খাওয়ানো হলো এবং পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করতে হলো। কিন্তু আমি সিলমোহর দিইনি।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘একই তারিখে স্থানীয় বাসিন্দা তোষর এবং রফিকুল আমাকে একটা জায়গায় সমস্যার কথা বলে কৌশলে ইউনিয়ন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিএনপির অন্যান্য রাজনীতিক নেতাসহ অন্যান্য ইউপি সদস্যরা রয়েছেন। আমাকে রাতের খাবারের জন্য বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারণে এত আদর-আপ্যায়ন, বুঝতে পারছিনা। জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর পাই না।
‘সমাজ রক্ষার্থে সকলের সাথে রাতের খাবার খেলাম। এরপর আমাকে এক প্রকার চাপ দেওয়া হয় প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার বিরুদ্ধে অনাস্থা কাগজে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু আমি তার সমর্থক। তিনি ভালো মানুষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাক্ষর দিতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাক্ষর করেছে। আমি কেন করব না, এ কথা তোলে। অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর সই করে সেখান থেকে আসতে হয়েছে। পরে আমি লিখিত চিঠি দিয়ে বিষয়টি প্যানেল চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।’
ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ভবেষ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘প্যানেল চেয়ারম্যান-১ সুমন রানার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে অনাস্থা আনা হয়েছে, তা আমার কাছে ভিত্তিহীন মনে হয়েছে।’
সচিব আরও বলেন, ‘পরিষদে তিনি (সুমন রানা) সবার সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন এবং নাগরিক সেবা অব্যাহত রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে আমাকেও কেউ কোনো দিন কোনো মৌখিক অভিযোগ দেননি।’
সভার বিষয়ে যা বললেন ইউপি সচিব ও সদস্য
ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বলেন, ‘৪ জানুয়ারি, ৭ জানুয়ারি ও ১৩ জানুয়ারি কোনো সভা ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমসহ পরিষদের কোনো স্থানে অনুষ্ঠিত হয়নি। যেসব সভার কথা বলা হচ্ছে, তা গোপনে বা প্রকাশ্যে অন্য কোথাও হয়ে থাকতে পারে। তা আমার জানা নাই।’
ইউপি সদস্য ধর্ম নারায়ণ রায় বলেন, ‘১৩ তারিখ সকাল ১১টায় প্যানেল চেয়ারম্যান-২ সভা ডেকেছিল। আমি সময়মতো পরিষদে আসলেও সভা হয়নি।
‘আমি জানতে চাইলে তিনি গোপনে স্থানীয় দুলাল নামের এক লোকের বাসায় মিটিং হবে বলে জানান। কিন্তু আমি সেখানে যাইনি। পরিষদের কাজ শেষে বাড়ি চলে আসি।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যানের ভাষ্য
স্থানীয় বাসিন্দা জিলানি হোসেন বলেন, ‘যে চেয়ারম্যান জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি, তিনি জনগণের কথা ভাববেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি আমাদের দুর্ভোগে ফেলে আজও পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন। আমরা নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা তার পুনর্বাসন চাই না।
‘পরিষদ তাকে ছাড়া বেশ ভালো চলছে। আমরা সুন্দর সেবা পাচ্ছি। শুনছি অনেকে পলাতক চেয়ারম্যানের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে। আমরা নতুন কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেব না।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্যানেল চেয়ারম্যান-২ এরশাদ আলী ইউনিয়ন পরিষদে সভা না করা এবং কোনো ব্যক্তির বাসায় বসে সভা করার বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিষদে সভা করতে পারেননি।
তিনি কেন পলাতক ও বিতর্কিত চেয়ারম্যানকেই পুনর্বাসন করতে চান, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বর্তমান দায়িত্বরত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলেন।
অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যান সুমন রানার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পরিষদে নাগরিক সেবা অব্যাহত আছে কি না, তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার আহ্বান জানান।
ইউনিয়ন বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়িতে পরিষদের কোনো বৈঠক হয়নি; সিদ্ধান্তও হয়নি। আমার হাত ভেঙে যাওয়ায় আমি অসুস্থ। তাই রাজনীতিক নেতা ও পরিষদের সদস্যরা দেখতে এসেছিল। এর বেশি কিছু না।’
তবে চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, ‘আবেদনসহ অন্যান্য কাগজ আমি পেয়েছি। উভয় পক্ষকে ডেকে শুনানি করা হবে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
‘কোনো কৌশলগত বিষয় আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে। তবে নিয়ম-বহির্ভূত কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য