‘দেশপ্রেমিক রাজনীতিকেরা সবসময় দেশের জন্য মৃত লাশ হতে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু কখনোই হত্যার আদেশ দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বন্দোবস্তে যায় না’- এমন উক্তিকে ধারণ করেই ৫১ বছরের বাংলাদেশকে যে কেউ একবার দেখে নিতে পারেন তৃতীয় চোখ দিয়ে।
একদিকে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নিথর দেহ পড়ে থাকা এবং তা সে লাল সবুজের বাংলাদেশের জন্যই। অন্যদিকে প্রতিবিপ্লবকারীদের হত্যা করার উৎসবে শাসকশ্রেণি হয়ে পড়ার অযাচিত প্রেক্ষাপট… কষ্ট তাই পাই।
আজও ভুলিনি, ভুলতে পারব না। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত জাতির জনক, আমার বাবা এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও পিতৃতুল্য তিন চাচা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলীর পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার এমন নৃশংস কু-উদ্যোগের জবাব দিতে ইচ্ছে করে। মনকে স্বান্তনা দেয়ার অযুতবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। বাঙালির ভাষা ললাটে ধূসর অস্ত্রের আমদানিতে জাতি নির্বাক হয়ে যখন সবকিছু অবলোকন করছে, ঠিক একই ধারাবাহিকতায় পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়।
অনভিপ্রেত এবং অতি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এমন কালো অধ্যায়ের জন্ম নেয়া নিয়ে উন্নত দেশগুলো বা সংস্থাগুলোর কথিত মানবাধিকার চাইবার দাবি নিয়মিত সংস্কৃতির অংশও হতে পারেনি।
৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। উপলক্ষতাড়িত ট্র্যাজিক দিবস হিসেবে আমরা কেউ কেউ জেলহত্যা ইস্যু নিয়ে কলম ধরছি। অভিমানের উচ্ছ্বাসে রাজনৈতিক ধারাভাষ্য দিয়ে ইতিহাস সংকলনের একটা চেষ্টা!
আমি কী লিখব? সন্তান হিসাবে কী বলব? বঙ্গবন্ধু ও তার তনয়ার আদর্শের সৈনিক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে কী লিখব? ফলত, জানা নেই।
আমার স্মৃতির পাতায় জেল হত্যা এক বেদনাবিধুর ঘটনা। আমার বাবা এ এইচ এম কামারুজ্জামান যেদিন শহীদ হলেন, আমি ও আমার ছোট ভাই স্বপন তখন কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করছি। বাবার মৃতদেহটি দেখার কোনো সুযোগ আমরা পাইনি।
বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক অতন্ত্র সৈনিক। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তার জীবনভাবনার মূল সোপান ছিল। সারাটা জীবন তিনি সেই আদর্শ ভাবনাকে অবিচল নিষ্ঠা এবং সাধনায় ব্রত হয়ে পালন করে গেছেন। নিমগ্ন থেকেছেন সত্য ও নীতির পথে। বঙ্গবন্ধুর নিঃস্বার্থ সহযোদ্ধা হিসেবে আপস করেননি ১৫ আগস্টের হত্যাকারী খুনীচক্রের সঙ্গে। শুধু আমার বাবা নন, অন্য তিন জাতীয় নেতাও ছিলেন একই রকমের ইস্পাতসম মনোবলের অধিকারী।
মায়ের কাছে শুনেছি, সেদিনের নিকষ কালো তিমির রাত্রি করে ঢাকার রাজপথে ছুটে চলা একটি জলপাই রঙের জিপ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। লাফিয়ে নামল কয়েকজন কালো পোশাক পরা অস্ত্রধারী। কারারক্ষীদের গেট খোলার নির্দেশ দিলো তারা।
কারারক্ষীরা শীর্ষ নির্দেশ ছাড়া গেট খুলবেন না। অগত্যা বঙ্গভবনে ফোন করল খুনিরা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যে নির্দেশ এসেছিল সেটা আমাদের সবার জানা। বঙ্গভবনের নির্দেশ পেয়ে গেট খুলে দিলো কারারক্ষীরা।
ভেতরে ঢুকে তাদের আবদার অনুযায়ী জাতীয় চারনেতা তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আমার বাবা এইচ এম কামারুজ্জামানকে ১নং সেলে একসঙ্গে জড়ো করার আদেশ দেয়া হলো। অস্ত্রের মুখে বাধ্য হয়ে কারারক্ষীরা সে নির্দেশ পালন করলেন। খুনি মোসলেম বাহিনী সেই ১নং সেলে ব্রাশফায়ারে নিভিয়ে দিলো জাতির সূর্য সন্তানদের জীবন প্রদীপ। সেকেন্ডের ব্যবধানে হারিয়ে গেল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম চার নেতার প্রাণ স্পন্দন।
বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জন্য ও ইতিহাসের সঙ্গে যাদের নিবিড় সম্পর্ক, সেই গুণী মানুষগুলো হারিয়ে গেলেও হারায়নি তাদের অমর কৃতিত্ব ও অসীম অবদান। তারা গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছিলেন বলেই আজও আমরা তাদের সন্তান হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছুতে পেরেছি।
দেশবাসী অবগত আছেন, আল্লাহর অশেষ রহমত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার অশেষ স্নেহ ও নির্দেশনায় এবং প্রিয় রাজশাহীবাসী ভালোবাসায় আমি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। দেশের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হতে পেরেছি। জাতির পিতা ও আমার বাবার রেখে যাওয়া কাজগুলো সমাধান করার প্রয়াসে দেশসেবায় আত্মনিয়োগের সুযোগ পেয়েছি।
বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো রাজশাহীকে নিয়ে। তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন রাজশাহীর কথা জাতীয় পর্যায়ে পেশ করে এর উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। রাজশাহীতে খেলাধুলার পরিবেশ তৈরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি জানতেন, খেলাধুলার মাধ্যমে গড়ে উঠবে সুস্থ ও সুন্দর যুব সমাজ। তিনি বেশ কিছুদিন রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সমিতির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
বাবা বেশ ধর্মভীরু ছিলেন। ছোটবেলায় তাকে নিয়মিত নামাজ আদায় ও পবিত্র কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করতে দেখেছি। তিনি এত দ্রুত কোরআন তিলাওয়াত করতেন যে, তাকে কোরআনের হাফেজ বলে মনে হতো।
পরের দিকে, বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তাকে আমরা বাসায় তেমন দেখতে পেতাম না। যতক্ষণ বাসায় থাকতেন সর্বক্ষণ নেতা-কর্মীদের দ্বারা সন্নিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। এর ফলে আমরা তেমন বাবার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। আমরা সব ভাই-বোনই বেশ মিস করতাম তাকে। এজন্য আমাদের মাঝে মাঝে রাগও হতো।
বাবা অত্যন্ত নরম স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাই বলে আমরা তাকে ভয় পেতাম না, এমন নয়। তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমাদের ছিল না। কোনো অপরাধ করলে শুধু নাম ধরে ডাকলেই আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত।
বাবার বড় এবং ছোটমেয়ে উভয়েই খুব প্রিয় ছিল। বড় আপা পলিকে বাবা বেশি ভালবাসতেন। মায়ের সংস্পর্শেই আমরা বড় হয়েছি। আমার মায়ের ছিল অসীম ধৈর্য। তিনি বাবার রাজনৈতিক সঙ্গীদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। মায়ের ওই উদারতা ও সহায়তা না থাকলে বাবার পক্ষে অত বড় নেতা হওয়া হয়ত সম্ভব ছিল না।
প্রচলিত একটি কথা আছে, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে কোনো না কোনোভাবে একজন নারীর অবদান আছে। এ কথাটা আমার মায়ের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রযোজ্য বলে আমাদের মনে হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার নয় মাস ছোট ছোট ছেলে-মেয়েসহ তিনি যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে দিন কাটিয়েছেন সেটা সম্ভব না হলে বাবার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব হতো কিনা বলা মুশকিল। বলাবাহুল্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসাও ছিলেন অসীম ধর্যের অধিকারী। তিনিও আজীবন বঙ্গবন্ধুর সব কাজের প্রেরণা ছিলেন।
বাবা ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি প্রথম নির্বাচনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও তার বাবা আবদুল হামিদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে এক চমকপ্রদ ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। ওই ঘটনাটি তখনকার দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আজও অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বলে রাখা জরুরি যে, আমার দাদা আবদুল হামিদ রাজশাহী অঞ্চল থেকে দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে তার ছেলে কামারুজ্জামান নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে আবদুল হামিদ নির্বাচন থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন।
বাবা জানতেন পিতা প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তার পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই তিনি মায়ের কাছে আবদার করলেন, বাপজানকে বুঝিয়ে যেন নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেন! অগত্যা আবদুল হামিদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন।
নির্বাচনি এলাকা সফরে গিয়ে ভিন্ন চিত্র প্রত্যক্ষ করলেন আমার বাবা। এলাকার মুরুব্বিদের বক্তব্য হলো, দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন করতে অভ্যস্ত বিধায় তারা হারিকেন (মুসলিম লীগের নির্বাচনি প্রতীক) ছাড়া অন্য কোনো মার্কায় ভোট দিতে পারবেন না। আবদুল হামিদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বাবাকে দায়ী মনে করে তারা তাকে সমর্থন দেয়া থেকে বেঁকে বসলেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা বহু চেষ্টা করে অন্তত একটা জায়গায় রফা করতে সমর্থ হলেন যে, আবদুল হামিদ সাহেব যদি এলাকায় এসে তার পক্ষে ভোট চান, তাহলে তারা বাবাকে ভোট দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
এমন একটি পরিস্থিতিতে বাবা তার বাপজানের কাছে কথাটা বলতে সাহস না পেয়ে মায়ের কাছে বায়না ধরলেন, পিতা যেন তার পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু আবদুল হামিদের কাছে কথাটা বলতেই তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন। একটা দলের সভাপতি হয়ে তিনি অন্য দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না, সে যেই হোক, এটা তার সাফ কথা।
বাবা হতাশ হয়ে এক রকম প্রচার বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বসে রইলেন। পিতার সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় এটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। সুতরাং মাঠে গিয়ে লাভ কী? তাই তিনি জানিয়ে দেন পিতা তার পক্ষে কাজ না করলে তিনি আর নির্বাচন করবেন না।
এভাবেই কিছুদিন চলে গেল। সত্যি সত্যিই ছেলে নির্বাচনি কাজে অংশগ্রহণে বিরত থাকায় পিতা আবদুল হামিদ নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলের জীবনের প্রথম নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় তিনি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়লেন। অগত্যা রাজশাহী জেলার মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাটোরের মধু চৌধুরীকে ডেকে তিনি তার হাতে দলের সভাপতি ও সাধারণ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের আবেদনপত্র দুটি ধরিয়ে ঘটনা খুলে বললেন। এরপর পুত্রের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে নেমে তাকে বিজয়ী করতে সক্ষম হলেন।
বাবার সেই বিজয় প্রথম হলেও আর কখনও তিনি কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। তবে দাদা আবদুল হামিদের এ রাজনৈতিক নৈতিকতার ঘটনা সব সময়ের জন্যই বিরল দৃষ্টান্ত তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এ ঘটনা শিক্ষার বার্তা বয়ে আনতে পারে। সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমার দাদা আবদুল হামিদের সুযোগ্য সন্তান এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও তার নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আজও জাতীয় নেতার আসনে রয়েছেন।
আমার বাবা তার আদর্শভিত্তিক নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির কারণে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ এই ১৩ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনেই কখনও পরাজিত হননি। এটা সম্ভব হয়েছিলো তার অসাধারণ কর্মদক্ষতা, গণমুখী সাংগঠনিক তৎপরতা আর চূড়ান্ত রাজনৈতিক সততার কারণে।
এরই ফলে তিনি রাজশাহীবাসীকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সামিল করতে পেরেছিলেন। তার এই দক্ষতা ও যোগ্যতাই তাকে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির মতো দলের সর্বোচ্চ পদে সমাসীন করেছিল।
৩ নভেম্বর সকালেই বাবার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন আমাদের মা। মা অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে যে মানুষটি কখনও আশাহত হননি সেই মানুষটি বাবার মৃত্যু সংবাদে মুষড়ে পড়েছিলেন! এ সময় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আর আত্মীয়-স্বজনে ভরে যায় আমাদের বাড়ি।
মা চাচ্ছিলেন বাবার লাশটা রাজশাহীতে এনে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করতে। কিন্তু খুনিরা তাতে বাধ সাধে। মা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বাধ্য হয়ে বাবার মৃতদেহ রাজশাহীতে আনার অনুমতি দেয় ঘাতকচক্র। তবে বাবার লাশ কাউকে দেখতে দেয়া হয়নি। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার করুণ বেদনা ও দহন সহ্য করেই আমার মা এবং আমরা জীবনসংগ্রাম করেছি।
মায়ের কাছে শুনেছি, বাবার রক্তমাখা লাশটার বুকের ওপর চালচাপা দেয়া ছিল। মুখটা দেখে মনে হয়, কী নিদারুণ কষ্টে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। কী অপরাধ ছিল বাবার, যার জন্য তাকে হত্যা করা হলো? এর জবাব কে দেবে? কারও কাছে আছে?
মাত্র ৫২ বছরের জীবনে তিনি অর্ধেকটাই কাটিয়েছেন আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অন্যান্য জাতীয় নেতাসহ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কাজে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। নিজের স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকাবার ফুরসৎ পাননি, সেই মানুষটাকে হত্যা করা হলো! কেন করা হলো, তা বলার সময়ও হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমার বাবাসহ অপরাপর তিন নেতা বেঁচে থাকলে সবকিছু রাজনৈতিক অপশক্তির ইচ্ছায় হতে পারত না। কারণ জাতীয় ওই চার নেতার দেশ ও দল পরিচালনা করার ক্ষমতা ছিল।
একবার কি এই প্রজন্ম চিন্তা করতে পারে, শেখ হাসিনা যদি আমার বাবাদেরকেও ১৯৮১ সালের পরে পেয়ে যেতেন, আওয়ামী লীগকে কী রোধ করা যেত? সামরিক শাসকেরা যত্রতত্র ক্ষমতার মসনদে বসতে পারত? ক্ষমতার বিরাজনীতিকরণ হতে পারত? গণতন্ত্রের জায়গায় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত?
জিয়া নামের এক শাসককে কী বলা যায়? ঘাতক, নাকি স্বৈরাচার? হ্যাঁ কিংবা না ভোটের প্রচলনের মাধ্যমে কে গণতান্ত্রিক আবহে স্বৈরতন্ত্রকে পরিচিত করে তুলেছিলেন? আমার বাবারা বেঁচে থাকলে মোশতাক- জিয়া-এরশাদদের কথিত শাসন চলত না এই বাংলায়।
এদিকে ১৯৮১ সালের ১৯ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে এসে তার পিতা বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের খুনিদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের দাবিতেও সোচ্চার ছিলেন। তার শাসনামলে বিচার হয়েছে। জাতি কলংকমুক্ত হয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৯ মে থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা চার জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যদের অতি আপনজনের মতো আগলে রেখেছেন। বড় বোনের স্নেহ দিয়ে তিনি আমাদের নির্মাণে সদা সহযোগিতা করে চলেছেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমি মহান আল্লাহর দরবারে তার সুস্থতা কামনা করি। তিনি বেঁচে থাকলেই বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে বিশ্বকে জানান দিতে পারবে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি! এগিয়ে যেতেই হবে।
প্রতি বছর ৩ নভেম্বর ফেরে! শোকার্ত অনুভবে বাবার ওই দুই মায়াবী চোখের মাঝে দৃষ্টি দিলেই প্রদীপ ভাসে। যে প্রদীপের শক্তি আমাকে বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি করতে তাগিদ দেয়। আমার পরিবারে সেই রক্ত, যে রক্ত বেঈমানি করতে জানে না।
বাবা বঙ্গবন্ধুর জন্য আনুগত্যের ঘড়্গ নিয়ে দেশপ্রেমকে স্বাগত জানিয়ে জীবনই দিয়ে গেছেন। আমি তারই কন্যা শেখ হাসিনার ভাই হিসাবে তার জন্য জীবন সঁপে দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। বাবার সৎ আত্মা আমার পিছু নেয়। তাগিদ রেখে বলেন, ‘তুমি এগিয়ে যাও। বাংলাদেশের জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য সেরাটা দাও।‘
এক ফালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি প্রায়শই। বাবার চিরপ্রস্থানকে মেনে নিতে পারিনি, পারব না। উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত মতবাদ আমার অহোরাত্রগুলোকে অনুসন্ধানী ও সত্যান্বেষী করে বলে, ‘যখন ভিতরে কোনো শত্রু থাকে না, তখন বাইরের শত্রুরা তোমাকে আঘাত করতে পারে না।‘
জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! জয় শেখ হাসিনা! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সভাপতিমণ্ডলির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন।
আরও পড়ুন:পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশের আলোচিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও নিগার সুলতানা জ্যোতি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তারা বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান।
নতুন বছরের আগের দিন শনিবার রাতে ফেসবুকে ভেরিফায়েড পেজে এক পোস্টে সাকিব লিখেন, ‘শুভ নববর্ষ! আশা করি আমাদের সবার জীবনে এই নতুন বছর অঢেল সুখ, শান্তি এবং আনন্দ নিয়ে আসবে।’
নিজ ভেরিফায়েড পেজে ‘শুভ নববর্ষ ১৪৩১’ লেখা একটি পোস্টার শেয়ার করে ওপেনার তামিম ইকবাল এক বাক্যে লিখেন, ‘সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।’
এ দুই তারকা ছাড়াও অনেকেই নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলে বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ডানহাতি পেসার তাসকিন আহমেদ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেন, ‘নববর্ষে নবরূপ রাঙিয়ে দিক প্রতিটি মুহূর্ত। সুন্দর সমৃদ্ধ হোক আগামীর দিনগুলো। শুভ নববর্ষ সকলকে।’
নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ লিখেন, ‘আনন্দ, উন্নতি ও শুভকামনার বার্তা নিয়ে নতুন বছরের সূচনায় ভরে উঠুক সকলের জীবন। সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ ১৪৩১।’
জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি লিখেন, ‘নববর্ষে নবরূপ রাঙিয়ে দিক প্রতিটি মুহূর্ত। সুন্দর সমৃদ্ধ হোক আগামীর দিনগুলো। শুভ নববর্ষ।’
আরও পড়ুন:মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ বাংলা নববর্ষ-১৪৩১ উদযাপন উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করে হয়েছে।
উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের শহীদনগর বাজারে রোববার নববর্ষ উদযাপন কমিটি ও শাপলা সবুজ সংঘের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী ৩১তম বৈশাখী মেলা শুরু হয়।
বর্ষবরণ উপলক্ষে কমলগঞ্জে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রা শেষে মাইজগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের নিয়ে দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বর্ষবরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নববর্ষ উদযাপন কমিটির সভাপতি পতনঊষার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অলি আহমদ খান সভাপতিত্ব করেন। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পতনঊষার ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার তওফিক আহমদ বাবু, বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক আবদুল হান্নান চিনু, আবুল ফজল চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিছবাউর রহমান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম, পতনঊষার ইউপি সদস্য তোয়াবুর রহমান তবারক, শাপলা সবুজ সংঘের সভাপতি নারায়ণ মল্লিক সাগর, শহীদনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল বশর জিল্লুল, প্রবাসী ইমদাদুল হক ইমরান, নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকে।
এদিকে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলায় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সব পণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে।
পহেলা বৈশাখের দিন রোববার থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে সোমবার পর্যন্ত। মেলায় উঠেছে হরেক রকমের পণ্য।
মেলা দেখতে ভিড় করেছে শিশু, কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সীরা। দীর্ঘদিন পর মেলা হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে আগত দর্শনার্থীরা।
আরও পড়ুন:পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ থেকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে।
ঐক্য, সাংস্কৃতিক গর্ব ও স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক শোভাযাত্রাটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পীসত্তা ও চেতনার মন্ত্রমুগ্ধকর প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে রোববার সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে আরম্ভ হয়। খবর ইউএনবির
উৎসাহী অংশগ্রহণকারীদের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রা শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব এবং শিশু পার্কের মতো ঐতিহাসিক স্থান হয়ে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা অতিক্রম করে। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত ও প্রতীকী নিদর্শন সম্বলিত শোভাযাত্রাটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি করে এবং আনন্দ-উল্লাসে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়
সৃজনশীলতা ও শৈল্পিক প্রকাশের লালনের জন্য পরিচিত চারুকলা অনুষদ সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সূচনা স্থান। অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আয়োজিত এই আয়োজনে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের প্রচার ও সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে।
শোভাযাত্রাটি টিএসসিতে সমাপ্তির পথে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বাতাস হর্ষধ্বনি, সংগীত এবং অংশগ্রহণকারী ও দর্শকদের সম্মিলিত উল্লাসে অনুরণিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বাংলা নববর্ষের আগমনই উদযাপন করে না, প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালি মানুষের সহনশীলতা ও চেতনার সাক্ষ্য বহন করে।
আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে এই জাতীয় আয়োজন ঐক্য, স্থিতিস্থাপকতা ও একাত্মতার বোধকে লালন করার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব নিশ্চিত করে।
বাংলা নতুন বছর ১৪৩১ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলা নববর্ষের আগের দিন শনিবার এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন বলে বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলা নতুন বছর ১৪৩১ আমাদের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে।’
দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘শুভ নববর্ষ, ১৪৩১। উৎসবমুখর বাংলা নববর্ষের এই দিনে আমি দেশবাসীসহ সকল বাঙালিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’
তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এটি সর্বজনীন উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। আবহমান কাল ধরে নববর্ষের এই উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণ স্পন্দনে, নব অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে বাঙালি রচনা করে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, আনন্দ ও ভালোবাসার মেলবন্ধন।’
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যে পহেলা বৈশাখ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে। কৃষিকাজের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর ‘ফসলি সন’ হিসেবে বাংলা সন গণনার যে সূচনা করেন, তা কালের পরিক্রমায় সমগ্র বাঙালির কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মারক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
“পহেলা বৈশাখ বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি। এই উদযাপন আমাদের শেকড়ের সন্ধান দেয়। এর মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় জাতিসত্তার পরিচয়।”
বৈশাখের প্রথম দিনকেন্দ্রিক উৎসবের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির প্রতিটি ঘরে, জনজীবনে এবং আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ এক অনন্য উৎসব। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে হালখাতার পাশাপাশি যাত্রাগান, পালাগান, পুতুলনাচ, অঞ্চলভিত্তিক লোকসংগীত, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেলার বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে যেমন লোকজ-সংস্কৃতি প্রাণ ফিরে পায়, তেমনি দেশের অর্থনীতি তথা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমৃদ্ধ হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসে।’
আরও পড়ুন:‘আমার বয়স অনেক হয়েছে, তবুও আমি সুস্থ আছি নিয়মিত লাঠি খেলার কারণে। আমার যারা ওস্তাদ ছিল, সবাই মারা গেছে। তাদের শেখানো লাঠি খেলা দেখিয়ে গ্রামের মানুষকে আনন্দ দিয়ে থাকি।’
কথাগুলো বলছিলেন নওগাঁ সদর উপজেলার দারিয়াপুর গ্রামের সাহাজ আলী সরদার। ৬০ বছর বয়সী এ ব্যক্তি শুক্রবার বিকেলে জেলা শহরের মুক্তির মোড়ে অংশ নেন লাঠি খেলায়।
বাউল আখড়া বাড়ির চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ খেলার আয়োজন করা হয়।
লাঠি খেলা দেখতে আসা ভীমপুর এলাকার বাসিন্দা মুমিন সরদার (৩৫) বলেন, ‘গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলাটি এখন আর দেখতেই পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সংগঠন প্রতি বছর এ খেলার আয়োজন করে বলে আমরা যুবসমাজ দেখতে পারি।
‘গ্রামীণ খেলাগুলো টিকিয়ে রাখতে আমাদের সবাইকে চেষ্টা করা উচিত।’
শহরের পোস্ট অফিসপাড়ার মীম বলেন, ‘আমরা সবাই এখন ভিডিও গেইমের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। তাই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো দেখলে অন্যরকম ভালো লাগে।
‘বেড়াতে এসেছিলাম। ঢোলের শব্দ শুনে এসে দেখি লাঠি খেলা হচ্ছে। খুব ভালো লাগছে অনেক পুরোনো লাঠি খেলা দেখে।’
লাঠি খেলার দলের সদস্য আবদুস সামাদ (৫৫) বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৩ বছর, তখন আমার বাবার কাছ থেকে লাঠি খেলা শিখেছি। একসময় প্রচুর খেলা দেখানোর জন্য দাওয়াত পেতাম।
‘এখন আর পাই না, তবে এটা ভেবে ভালো লাগে যে, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এখনো লাঠি খেলাকে টিকিয়ে রেখেছেন।’
দারিয়াপুর গ্রামের সাহাজ আলী সরদার (৬০) বলেন, ‘একটা সময় ছিল প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে দাওয়াত পেতাম, তবে এখন আর আগের সময় নেই।
‘সবাই বিভিন্ন ধরনের অনলাইন গেইম নিয়ে ব্যস্ত। গ্রামীণ খেলাগুলোর মাধ্যমে যুবসমাজ বিভিন্ন ধরনের নেশা থেকে বিরত থাকবে বলে আমি মনে করি।’
আয়োজনের বিষয়ে বাউল আখড়া বাড়ির সভাপতি সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘লাঠি খেলা হলো গ্রামীণ ঐতিহ্য। এটি যেন বিলীন না হয়ে যায়, সে জন্য আমরা আয়োজন করেছি, যাতে মানুষেরা গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত এখানে বাউল গানের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু আমরা গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে কিছু করতে পারি না। কারণ লাঠি খেলাও আমাদের ঐতিহ্য। আমরা প্রতি বছর লাঠিখেলা ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
আরও পড়ুন:যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে নওগাঁর এক হাজার ৩০০টি স্থানে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শহরের নওজোয়ান মাঠে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন নওগাঁ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের প্রেস ইমাম মুফতি রেজওয়ান আহম্মেদ।
ওই জামাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যরিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন, জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
এদিকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উৎসব উদযাপনের জন্য জেলা প্রশাসন বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনে সঠিক মাপ ও নিয়মে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, পটকা ও আতশবাজি বন্ধ, সরকারি শিশু পরিবার, এতিমখানা, জেলখানা ও হাসপাতালে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন। এ ছাড়াও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ঈদের দিন ও পরবর্তী সময়ে তরুণদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চলাচল রোধ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়।
জেলায় সুষ্ঠুভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য ও গোয়েন্দাদের নজরদারি বাড়ানো হয়।
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা শেষে বুধবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা।
বাংলাদেশের আকাশে মঙ্গলবার চাঁদ দেখা না যাওয়ায় ঈদ উদযাপন হবে বৃহস্পতিবার, তবে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে এবারও ঈদ উদযাপন হয়েছে বিভিন্ন জেলায়।
দেশের নানা প্রান্তে ঈদ উদযাপনের খবর জানিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।
কুড়িগ্রাম
জেলার রৌমারী, রাজীবপুর ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চারটি গ্রামে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। আলাদা আলাদা ঈদ জামাতে পাঁচ শতাধিক মুসল্লি অংশ নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
সকালে রৌমারী উপজেলার শৈলমারী ইউনিয়নের গয়টাপাড়া গ্রাম, রাজিবপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব করাতিপাড়া গ্রাম ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা ও পাইকেরছড়া গ্রামে ঈদের এসব জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ঈদের জামাত আদায় করা রৌমারী উপজেলার শৈলমারী ইউনিয়নের গয়টাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মোত্তালেব বলেন, ‘আমরা প্রায় পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে রমজানের রোজা রাখা, ঈদের নামাজ আদায় ও ঈদ উৎসব পালন করে আসছি।’
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা পুলিশের নিরাপত্তায় পূর্ণ উৎসবমুখর পরিবেশে কুড়িগ্রামের চারটি গ্রামে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক সেবায় জেলা পুলিশ সবসময় নিবেদিত।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জেলা সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার তিন শতাধিক মানুষ বুধবার ঈদ উদযাপন করেছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের মোমিন টোল ও বাগানপাড়া এলাকায় সকালে দুটি ঈদের জামাতে দুই শতাধিক মুসল্লি অংশ নেন।
অন্যদিকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের রাধানগর ও ছিয়াত্তর বিঘি এলাকার বিভিন্ন পরিবারের শতাধিক সদস্য সকালে ঈদের নামাজ আদায় করেন ছিয়াত্তর বিঘি আম বাগানে।
গত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখার পাশাপাশি ঈদ উদযাপন করে আসছেন এসব গ্রামের লোকজন।
মৌলভীবাজার
জেলার শতাধিক পরিবারের মুসল্লিরা ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন।
সকাল সাতটায় মৌলভীবাজার শহরের সার্কিট হাউস এলাকার আহমেদ শাবিস্তা নামক বাসায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
নামাজে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নারী ও পুরুষ মুসল্লিরা অংশ নেন। এতে ইমামতি করেন উজান্ডির পির আলহাজ আব্দুল মাওফিক চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘কোরআন ও হাদিস অনুসারে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে রোজা এবং ঈদ করতে হয়। সেই অনুসারে আমরা আজ ঈদের নামাজ আদায় করলাম।’
ময়মনসিংহ
জেলার গৌরীপুরের বাহাদুরপুর নূরমহল সুরেশ্বর দরবার শরিফে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদুল ফিতর উদযাপন হচ্ছে।
সকাল ৯টায় ঈদের জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা মো. ইব্রাহিম। এ জামাতে ময়মনসিংহ সদর, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, শম্ভুগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েক শ আশেকান, মুরিদ ও ভক্ত অংশ নেন। নারীদের জন্য আলাদা জামাতের ব্যবস্থা করা হয়।
সুরেশ্বর দরবার শরিফের পীর সৈয়দ শাহ্ নূরে আফতাব পারভেজ নূরী বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে চাঁদের মিল রেখেই প্রতি বছর এখানে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। তাই এবারও আমরা বাংলাদেশে এক দিন আগে থেকে রোজা রাখা শুরু করি এবং ঈদুল ফিতর উদযাপন করি।’
শেরপুর
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিল রেখে শেরপুরের ছয়টি গ্রামে ঈদুল ফিতর উদযাপন হয়েছে।
গ্রামগুলো হলো সদর উপজেলার উত্তর চরখারচর ও দক্ষিণ চরখারচর, নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী পশ্চিমপাড়া ও গোবিন্দনগর ছয়আনি পাড়া, নকলা উপজেলার চরকৈয়া এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার বনগাঁও চতল।
স্থানীয় লোকজন ছাড়াও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকেও মুসল্লিরা ওইসব গ্রামে ঈদের নামাজ আদায় করতে যান।
প্রতি বছর সদর উপজেলার বামনেরচর গ্রামে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হলেও এবার সেখানকার বেশ কিছু মুসল্লি নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী পশ্চিমপাড়া এলাকায় ঈদের নামাজ আদায় করেন।
সকাল সাতটা থেকে ১০টার মধ্যে এসব গ্রামে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি জামাতে ২০০ থেকে ২৫০ জন মুসল্লি অংশ নেন। এসব জামাতে পুরুষ মুসল্লিদের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নেন।
টাঙ্গাইল
জেলার দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের শশীনাড়া গ্রামে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে অর্ধশতাধিক পরিবার উদযাপন করছে ঈদুল ফিতর।
সকাল আটটায় স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নেন।
গত ১২ বছর ধরে ওই এলাকার লোকজন সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ ও রোজা পালন করে আসছেন।
ঝালকাঠি
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিল রেখে জেলার রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের ডহরশংকর গ্রামে বুধবার ঈদ উদযাপন করেন স্থানীয়রা।
এ গ্রামের বসবাসরত বাসিন্দাদের একটি অংশ রোজাও রাখেন এক দিন আগে থেকে। তাদের মতে, যেকোনো দেশে চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখা ও ঈদ উদযাপন করা যাবে।
ডহরশংকর গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারের ২০০ মুসল্লি প্রতি বছর এভাবে ঈদ উদযাপন করে আসছেন। বেশ কয়েক বছর আগে এ নিয়ে এলাকার অন্য মুসল্লিদের সঙ্গে হট্টগোল হলেও বর্তমানে তারা নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করছেন।
সকাল আটটায় মঠবাড়ি ইউনিয়নের ডহরশংকর গ্রামের নাপিতের হাট এলাকায় দারুস সুন্নাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদের জামাত আদায় করা হয়। এতে পৃথক স্থানে নারীরা একই জামাতে অংশ নেন। জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম।
ঈদ উদযাপনকারী মুসল্লি মোনাসেফ মৃধা বলেন, ‘আমরা পূর্বপুরুষ থেকেই সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করে আসছি। গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার এক যুগ যাবত মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিল রেখে ঈদের নামাজে উপস্থিত হচ্ছেন।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য