ইফতার আরবি ‘ফুতুর’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘ফুতুর’-এর অর্থ নাশতা করা বা হালকা খাবার খাওয়া। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর রোজা সমাপ্তির জন্য পানাহার করাকে ইফতার বলা হয়। ইফতার একটি মহান ইবাদত তা নিজে খাওয়ার মাধ্যমে হোক কিংবা অন্যকে খাওয়ানোর মাধ্যমে হোক। ইফতারের পূর্বমুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘রোজাদারের জন্য দুইটি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে।
একটি হলো ইফতারের সময় (এ সময় যেকোনো নেক দোয়া কবুল করা হয়)। অন্যটি হলো (কেয়ামতের দিবসে) নিজপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (তিরমিজি, ৭৬৬; বুখারি, ৭৪৯২; মুসলিম, ১১৫১) ইফতারের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, যত দিন মানুষ সময় হওয়ামাত্র ইফতার করবে, ততদিন দ্বীন বিজয়ী থাকবে (আবু দাউদ, ২৩৫৫) এবং মানুষ কল্যাণের সঙ্গে থাকবে (বুখারি, ২৮৫২)। অন্য রোজাদারকে ইফতার করানো এক মহান ইবাদত। জায়েদ ইবনে খালেদ আল-জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সম পরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’ (তিরমিজি, ৮০৭; ইবনে মাজাহ, ১৭৪৬; ইবনে হিব্বান, ৮/২১৬; সহিহ আল-জামে, ৬৪১৫)
অন্য রোজাদারকে ইফতার খাওয়ানো আল্লাহর রাস্তায় খরচের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। এতে মানুষকে খাবার খাওয়ানো এবং পিপাসার্তকে তৃষ্ণা মেটানোর প্রতিদানও পাওয়া যাবে। অন্যদের খাবার দেওয়ার ব্যাপারে উম্মতের অনেকেই অগ্রণী ছিলেন। তারা এটাকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করতেন। তারা নিজের ইফতার অন্যকে খাওয়াতেন। ইবনে উমর এতিম ও মিসকিনদের সঙ্গে না নিয়ে ইফতার করতেন না।
আবু সাওয়ার আল-আদাওয়ি বলেন, বনি আদি গোত্রের লোকেরা কেউ কখনও একাকী ইফতার করেনি। তাদের সঙ্গে ইফতার করার জন্য কাউকে পেলে তাকে নিয়ে ইফতার করত। আর যদি কাউকে না পেত, তাহলে নিজের খাবার মসজিদে নিয়ে এসে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে খেত। অন্যদের সঙ্গে মিলে ইফতার করার মাঝে উত্তম মানুষের সাহচর্য হৃদ্যতা-ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। এই হৃদ্যতা ও ভালোবাসা জান্নাতে প্রবেশের কারণ।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ঈমান আনা ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না। আর পারস্পরিক ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের ঈমান হবে না।’ (মুসলিম, ৫৪) তবে অন্যকে ইফতার করানোটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। মানুষকে দেখানোর জন্য নয়। কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক কারণ ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে নয়। অন্যথায় অনেক টাকা ব্যয় করে অনেক মানুষ মিলে ইফতারের আয়োজন করলেও তা কোনো উপকার বয়ে আনবে না।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতিত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করা ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যব্যতীত কোনো ইবাদত-বন্দেগি করলে তা কখনও কবুল হবে না। কোরআনে এরশাদ হয়েছে- “আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন-মরণ সবকিছু বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্য” (সুরা আনআম :১৬২)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া ভিন্ন উদ্দেশ্যে আমল করলে সে আমলে নেকিও পাওয়া যাবে না। পবিত্র কোরআনে মহান রব বলেন, “আর যে সম্পদ তোমরা ব্যয় কর, সেটা তো নিজেদের উপকারের জন্যই করে থাক। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টিব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে খরচ করো না। তোমরা কোনো উত্তম (কাজে) ব্যয় করলে তা তোমাদের পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। (সুরা বাকারা :২৭২)। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা সব আমলের মধ্যে শুধু সেই আমলটুকুই কবুল করেন, যা খালেসভাবে শুধু তার সন্তুষ্টির জন্যই করা হয়’। (নাসাই, ৩১৪২)।
রাসুল (সা.) এর পর সাহাবিদের যুগ শেষে তাবিইন ও তাবে-তাবেইনদের পর মুসলমানদের অধঃপতন শুরু। ধীরে ধীরে বিপুলসংখ্যক মুসলমান নামাজ ছেড়ে দিল কিন্তু মুসলমানিত্বের দাবি বহাল রাখল। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজ আদায় না করাই। যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফির হয়ে গেল (কাফিরের মতো কাজ করল)।’ (মুসলিম, ৮২; তিরমিজি, ২৬১৯)।
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমাদের ও কাফিরদের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজেরই। যে নামাজ ত্যাগ করল সে কাফির হয়ে গেল।’ (তিরমিজি, ২৬২১; ইবনে মাজাহ, ১০৮৮) সাহাবিগণ বলেছেন, যারা কোনো ওজর ছাড়া ফজর ও ইশার জামায়াতে শামিল হতো না আমরা তাদের মুনাফিক মনে করতাম। ইসলামের স্বর্ণযুগে সুদ, ঘুষ তথা হারাম উপার্জন বিরল ঘটনা ছিল। অথচ এসব এখন অতি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সুদ-ঘুষের পক্ষে নানা যুক্তিও তৈরি হয়েছে। কীভাবে, কোন সময় থেকে মুসলমানদের এই স্খলন তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
আমাদের জীবৎকালে ইসলামের একটি বিষয়ের মারাত্মক বিকৃতি হলো। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই আমাদেরকে দায়ী করবে। অপরকে ইফতার খাওয়ানো ইবাদত থেকে পার্টিতে পরিণত হলো। এটি এক ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, পুনর্মিলনী কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বিনোদনে পরিণত হয়েছে। ফলে যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে অপরকে ইফতার খাওয়ানোর ইবাদত ও সওয়াবের কথা বলা হয়েছে তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি আমরা। বরং এসব ইফতার পার্টিতে ইসলামের কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিষয় তথা ফরজের বিধান হামেশাই লঙ্ঘিত হচ্ছে। ইফতারের আগে বক্তৃতায় অনেক ক্ষেত্রে গীবত, পরনিন্দা ও পরচর্চা করা হচ্ছে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “(মানুষের) পেছনে ও সামনে পরনিন্দাকারীর প্রত্যেকের জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।” (সুরা হুমাজাহ : ০১) মহান রব যার ধ্বংস কামনা করেন তার বাঁচার কোনো উপায় আছে কি? রোজা রাখা মানে কেবল না খেয়ে থাকা নয়। রোজা মানে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযম। যেমন, চোখের রোজা, কানের রোজা। জবানের হেফাজত করাও রোজার অংশ। জবানের হেফাজত করা অর্থাৎ মিথ্যা, গীবত, পরনিন্দা, অশ্লীল কথাবার্তা ও ঝগড়া থেকে রিবত থাকা রোজার অবশ্য করণীয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় মিথ্যাচার ও মন্দ কাজ ত্যাগ করেনি তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি, ১৯০৩)।
গীবত বা পরচর্চা একটি পাপাচার। কোরআন মজিদে এটিকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য বলা হয়েছে। কোনো রোজাদার যদি গীবতের পাপে লিপ্ত হয়, তাহলে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে কি? প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হজরত সুফিয়ান সওরী (রহ.)-এর অভিমত ছিল, গীবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তার অমর গ্রন্থ ‘এহইয়া উলুমুদ্দীনে’ প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত মুজাহিদ ও হজরত ইবনে শিরিনের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন গীবত রোজা নষ্ট হওয়ার কারণ। ইফতার ইবাদতের বদলে গুনাহের উপলক্ষ হয়ে পড়ছে।
নামাজ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক। পুরুষ-নারী উভয়েরই মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায়ের বিধান রয়েছে। কিন্তু মসজিদে নারী ও পুরুষের একই কাতারে কিংবা পাশাপাশি কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্য রোজাদারকে ইফতার খাওয়ানো পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সওয়াবের। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, এমন নারী-পুরুষের একত্রে বসে ইফতার- ইবাদত ইসলামে অনুমোদিত নয়।
বাস্তবে ইফতার পার্টিতে এই নিষেধাজ্ঞা কদাচিৎ মান্য করা হয়। ইফতার পার্টির নামে চাঁদাবাজির ঘটনাও পরিলিক্ষিত হয়। অথচ ইফতার খাওয়ানো ব্যক্তিগত আর্থিক ইবাদত। সমবেত ইফতারের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা আর হালের ইফতার পার্টির চেতনা মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। নামাজ ছেড়ে দেয়া কিংবা সুদ, ঘুষের মতো ভয়ংকর গুনাহের কাজগুলো মুসলমান সমাজে যেমন সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে গিয়েছে তেমনি ইসলামের মূল চেতনা হতে বিচ্যুত ইফতার পার্টির সংস্কৃতিও বোধ করি স্বভাবিক বিষয়ে রূপ পরিগ্রহ করবে।
একজন মুমিনের জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা অর্জন। প্রকৃত মুমিনের সব কর্মপ্রচেষ্টা মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনকে ঘিরে। কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালে মুক্তি পেতে নেক কাজ করাই মুমিনের কর্তব্য। এক্ষেত্রে অন্য কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে ইবাদত গ্রহনযোগ্য হবে না।
যেমন সাময়িক বা জাগতিক কোনো স্বার্থে কিংবা কোনো গোষ্ঠী-দল, সম্প্রদায়, সংস্থা এমনকি কোনো নেকলোকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যও ইবাদত করা যাবে না। কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমরা ইফতারসহ সব ইবাদতে শামিল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অন্যথায়, আমাদের ইবাদত কোনোভাবেই ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে না এবং আমরা রবের কাছ থেকে এর কোনো বিনিময়ও পাব না।
লেখক: প্রাবন্ধিক-গবেষক। অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:দিনে দিনে শুধু ‘মুসলমান’, দিনে দিনে শুধু ‘হিন্দু’ হয়ে ওঠা এই আঁধার নামা সময়ে আবার পড়ি নজরুলের সেই পঙ্ক্তিগুলো- “কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।” (‘বিংশতাব্দী’/‘প্রলয়-শিখা’)। সব কালে সব ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া নজরুলের সেই ‘মানুষ’ আজ কোথায়! যেদিকে চোখ রাখি, কেবল হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। অথচ সেই ‘মহীয়ান মানুষ’-এর দেখা নেই। কোথায় হারিয়ে গেল তার দেখা “সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।”
ঊর্ধ্বাকাশে স্যাটেলাইট উড়লেও বাংলাদেশের হৃদয়ে নানাবিধ ক্ষত লেগে আছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আছে, উন্নয়নের ডামাডোল আছে। কিন্তু বাঙালির মানসজগতের বিকাশ নেই আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। চারপাশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, এখনও বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি।
বিভেদের অনলে পুড়ছে আমাদের হৃদয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে ক্রমশ পচে গলে যাচ্ছে সমাজ। একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুল আজ দুই দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বিংশ থেকে একবিংশ- কতটুকু এগোলাম আমরা... আছে কারো হিম্মত, বলবেন- ‘বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’
আমরা পিছনে হাঁটছি কেন, কেউ কি ভাবছি এ সংকট থেকে উত্তোরণের! অক্টোপাসের মতো ঘিরে থাকা সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির মোকাবিলায় অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তৎপরতা কী? কেবলই পদ-পদবি, গোলটেবিল, টক শো, বড় বড় কলাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের সেমিনার! সারা দিন মাইক্রোফোনে অসাম্প্রদায়িকতার ঝড় তুলে এসে নিজের সন্তানকে বলে দেয়া ‘হিন্দু/মুসলিম বাচ্চাদের সাথে মিশো না’।
আমাদের স্কুলগুলো থেকে, আমাদের পাড়া-মহল্লা থেকে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উধাও হলো কেন, কীভাবে ইভেন্ট, প্রজেক্ট আর শুধুই চাকরি বাঁচানোর আয়োজন হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল! করপোরেট দুনিয়া খুবলে খাছে মননচর্চার সবুজ বাগিচা আর কিছু স্বার্থান্বেষী, আত্মপ্রতারক, মুখোশধারী মানুষ। যারা নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছেন, ম্লান করে দিচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির অমিয় আভা। বিনিময়ে আমরা এগোচ্ছি অসার, আনন্দহীন, বিষণ্ন এক ভবিষ্যতের দিকে।
নজরুল যে মূঢ়তা, যে কূপমণ্ডূকতার মুণ্ডুপাত করতে চেয়েছিলেন দীর্ঘকাল আগে, দীর্ঘকাল পরে আজ আমরা কোথায় আছি! এখনও পান থেকে চুন খসলেই ‘ধর্ম অবমাননার’ অজুহাত তুলে চলে দুর্বলের ওপর নিপীড়ন। ধর্মের নামে উগ্রতার করাল গ্রাসে বন্দি তরুণ সমাজ। ধর্মকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
বাঙালির মানস সরোবরে নজরুল বপন করে দিয়েছিলেন যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বীজ, আজ তা বৃক্ষ, ফলে-ফুলে শোভিত হওয়ার পরিবর্তে জন্ম দিয়েছে এক শুষ্ক, রুগ্ণ, পত্রপল্লবহীন উদ্যানে। তিনি সাম্যের গান গেয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে যে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, এই কাতারটিই হলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির মূল মন্ত্রই মানুষ। মানুষই সে সংস্কৃতির প্রথম ও শেষ কথা, অন্য কিছু নয়-“এক সে আকাশ মায়ের কোলে, যেন রবি-শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।”
‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন- “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ- প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।”
অথচ আজ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মতো অসাম্প্রদায়িক বার্তাবাহী স্লোগান নিয়েও বিকৃত প্রচার। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুদের কবি আর নজরুলকে মুসলমানের কবি বানানোর প্রতিযোগিতায় খুব সুকৌশলে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। উল্টোদিকে, প্রগতির ঝান্ডাধারীরা ব্যস্ত নিজেদের ফায়দা হাসিলে। আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাদের মধ্যে নজরুলের জীবনাদর্শ তুলে ধরার কোনো তাগিদ কোথাও আছে?আছে স্কুলে, বিদ্যায়তনে কোনো আয়োজন কেবল নামকাওয়াস্তে । এ প্লাস ব্যাধির এ বিরূপ সময়ে নজরুলের কবিতার মর্মার্থ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরার জন্য কোনো শিক্ষক কি এগিয়ে আসেন ক্লাস রুমে? নজরুলের নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন আর বাগাড়ম্বর ছাড়া কি উপহার দেয় জন্ম, মৃত্যু দিবসে?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী কর্মসূচি থাকে এসব দিনে? প্রশ্নগুলোর গভীরে গেলে আজকের বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র সম্পর্কে কিছুটা উত্তর মিলবে। যে জাতির জাতীয় কবি নজরুল, সে জাতি আজও কীভাবে পোশাকে ধর্ম খোঁজে, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে মেতে ওঠে হানাহানিতে। কে বোঝাবে ওদের! কবি নিজেই বলে গেছেন- …“মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”…
এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, নজরুল বড় প্রাসঙ্গিক আজ। তার ভাবদর্শনচর্চা বড় প্রয়োজন এখন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে নজরুল আমাদের নিত্য অনুপ্রেরণার নাম। তাকে পঠন-পাঠন ছাড়া হৃদয়ে ধারণ সম্ভব না। তাই শুরুটা করতে হবে তাকে অধ্যয়নের মাধ্যমেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আরও পড়ুন:জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাহিত্যকর্মে আরবি-ফারসি শব্দের বেশ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তার আগেও বেশ কিছু লেখক কবি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তা সীমিত, সীমাবদ্ধস্তরে। নজরুল তার পদ্য-গানে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার অন্যদের তুলনায় বেশি করেছেন। ওই দুটি ভাষা শুধু নয়, উর্দু ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও করেছেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু শব্দ আছে কোনোভাবেই বাংলার সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে অব্যবহৃতই থেকে গেছে।
কবি নজরুল শব্দের ‘মহফিলে’ হরেক ‘কিসিমের’ শব্দের ‘ঝুলঝাপ্পুর’ দেখিয়েছেন বলা হয়। শব্দের রঙ্গনির্মাণ যেমন করেছেন, তেমনি কঠিন আরবি-ফারসি শব্দের ‘গুলমোহর’ও বানিয়েছেন এবং উর্দু হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, “নজরুল মোল্লা-মৌলবীদের মতো ভালো আরবি-ফার্সী না জানলেও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় যুৎসইভাবে ঠাঁই নিয়েছে। আবার কিছু আরবি-ফার্সী শব্দ ‘সুকৌশলে’ ব্যবহার করলেও তা বাংলা হয়ে উঠেনি। বরং আরবি-ফার্সীই রয়ে গেছে। ‘হিম্মত, জাহান্নাম, ঈমান, জানাজা, আসমান, ইনসান, আহাদ, মুর্দা-ইত্যাদি নজরুল ব্যবহৃত শব্দ এখন পুরোদস্তুর বাংলা। অবশ্য বাংলার বাগ্বিধিকে নজরুল উপেক্ষা করেননি, বরং সুসামঞ্জস্যভাবে আরবি-ফার্সী শব্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই লিখেছেন, ‘নীলিম প্রিয়ার নীলা গুলরুখ লাজুক নেকাবে ঢাকা’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ।”
নজরুলের আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে অনেক সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার জাতপাত সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য থেকে আরবী-ফার্সী শব্দ বহিষ্কৃত করতে সেই জাতীয় সাহিত্যিকই উৎসুক যারা বাংলা ভাষা জানেন না।” দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধ্যান করে বলেছিলেন “গত পাঁচ ছয়শত বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের হইয়া গিয়াছে। মুসলমানের ধর্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আরবী ও ফার্সী সাহিত্যে লিপিবদ্ধ। সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাহাদের নিত্যকর্মের জন্য অপরিহার্য। আমাদের যেমন সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ, আরবী ও ফার্সীর সঙ্গে তাহাদের কতকটা তাই।”
এই গভীর ঐতিহাসিক ও সমন্বয়ের সূত্রটি কাজী নজরুলের ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। সে জন্যে তিনি বহুভাষাবিদ গবেষক পণ্ডিত প্রবরের মতো একদিকে যেমন সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন, তেমনি আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ছন্দ ও সুর আনয়ন করে বাংলার কাব্যলক্ষীকে মুসলিম ঢঙ্গে সাজাবার প্রয়াসী হয়ে ইরানি ‘জেওরে’ ভূষিত করতে চেয়েছিলেন। নজরুলের আরবি-ফারসির ব্যবহার যে ভাবসম্পদ বৃদ্ধির জন্য, হিন্দুর দেব-দেবীর নাম গ্রহণ যে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ দূর করার জন্য-সমকালীনরা তা উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই ‘শনিবারের চিঠি’ থেকে শুরু করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেছিলেন।
এমনকি নজরুল সতীর্থরাও তার আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেন। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের অবসান ঘটানোর জন্য পত্রিকার সম্পাদক মিস্টার ওয়ার্ডওয়ার্থ সম্পাদকীয় লেখেন। তিনি উল্লেখ করেন, “কোন একটা ভাষায় অন্যভাষার শব্দ প্রবেশ করবে কিনা; তা লেখকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যে সাহিত্যিকরা অন্যভাষার শব্দ চয়ন করে নিজের ভাষার মধ্যে মিলিয়ে দিতে পারবেন তিনি ততো বড় শক্তিশালী সাহিত্যিক। নিজের সাহিত্যভান্ডার এমনি করে পূর্ণ করেছেন ইংরেজ সাহিত্যিকরা। তারা ডাকাতের মত অন্য ভাষার সুন্দর শব্দগুলি একরকম কেড়ে এনেছেন নিজেদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য।” এটি প্রকাশের পর দেখা গেছে. সমসাময়িক অনেকের লেখায় হরহামেশা উর্দু ও ফারসি শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের ভাববৈচিত্র্যের জন্যই বুঝি নজরুল হাবিলদার কবি থাকাকালীন পারস্যের কবি হাফিজের কবিতা অনুবাদে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এ যেন ‘বাংলার শ্যামকোয়েলার কণ্ঠে ইরানের গুলবাগিচার বুলবুলির বুলি’ তিনিই দেন। নজরুল বাংলার শাপলা-শালুক, পদ্মের সঙ্গে বসরাই গোলাপ-জুঁই-নার্গিস একাকার করে দিয়েছেন। নজরুলের কবিতায় ‘খুন’ রক্ত অর্থে ব্যবহারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে সবার জানা।
নজরুলের একটি হাসির গান আছে ‘রসঘন রসুনের গন্ধতুতো দাদা’। এই গন্ধতুতো শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় গন্ধ-সম্পর্কিত। অনেকটা পাড়াতুতো, জেঠাতুতো অনুসরণেই তৎসম শব্দের সঙ্গে আটপৌরে শব্দ ‘তুতো’র মিতালি ঘটিয়েছেন নজরুল। এই ‘তুতো’ এসেছে কোত্থেকে, সে প্রশ্ন জাগবেই। মূলত ‘তুতো’ শব্দটিই এখানে প্রত্যয়ে পরিণত হয়েছে। যেমন, খুল্লতাত< খুড়াতো বা খুড়তুতো। কিংবা খুল্লতা+উয়া<খুড়তাতুয়া< খুড়তুতুয়া>খুড়তুতো। আর তুতো সহজেই পাড়া সম্পর্কীয় বিষয়ে জড়িয়ে হয়ে গেছে পাড়াতুতো। নজরুল তাকে ‘গন্ধতুতো’ করে বেশ চমৎকার একটি শব্দে বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। নজরুল ব্যবহৃত আরেকটি শব্দ ‘হনুকরণ’। অর্থ হচ্ছে হনুমান বা বাঁদরের মতো অনুকরণ (‘অনুকরণ’ এর ব্যঙ্গাত্মক হনুকরণ-হনুমানের মতো করণীয়)।
নজরুলের বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রথমগ্রন্থ প্রবন্ধের ‘যুগবাণী’। তাতে ‘জাতীয় শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, “যাহাদিগকে মুখ ভেঙচাইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছি, আবার তাহাদেরই অনুকরণ করিতেছি।” নজরুলের ‘ফণীমনসা’ কাব্যগ্রন্থের ‘সাবধানী ঘণ্টা’ কবিতার একটি লাইন “লাল বাংলার হুমকানি,-ছি ছি, এত অসহ্য ও মা।” হুমকানি এসেছে ধমকানির সাদৃশ্যে। ধমককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া গেলেও হুমকানিকে সমীহ করতেই হয়। না হলে যে জীবন রাখা দায়। অবশ্য এই হুমকানি শব্দটি বাঙালির ব্যবহারের ধোপে টেকেনি। হুমকিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, হুমকানির ভয়ে।
সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকায় ১৯২৩ সালে লেখা ‘চানাচুর’ শীর্ষক নিবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, “তখন কি আর ফোকলাদন্তী চুপসায়িত কুককোল অষ্টাবক্রীয় কটি বুড়োদের ওরা বিয়ে করতে চাইবে?”-এখানে চুপসায়িত অর্থ চুপসে গিয়েছে এমন, অথবা তোবড়ানো। অনেকটা তরলায়িত। আলুলায়িত ইত্যাদির সাদৃশ্যে নজরুল লিখলেন চুপসায়িত। প্রকৃত বাংলা চুপসা ধাতুর সঙ্গে ইত প্রত্যয় যোগে সংস্কৃতায়নে বাক্যটিতে নজরুল এক ধরনের রসায়ন ঘটিয়েছেন। সাধু ‘অষ্টাবক্রীয়’-এর চেয়ে অসাধু ‘চুপসায়িত’-এর ওজন ভারী। সংস্কৃতের সঙ্গে আছে ইঙ্গায়ন।
যেমন কেলেঙ্কারি+য়াস=কেলেঙ্কারিয়াস। ‘ধুমকেতু’তে লিখেছেন নজরুল ‘কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড!’ আবার ‘বাঁধনহারা’য় লিখেছেন, “আমি হলে তোর এ বর্ষাস্নাতা সাগর সৈকতবাসিনী করাচীর বর্ণনাটা কি রকম কবিত্বপূর্ণ ভাষায় করতাম অবধান কর, যদিও বর্ণনাটা আন্দাজিক্যালি হত।” ‘আন্দাজ’ ফারসি শব্দ, তার সঙ্গে ইংরেজি ইক্যালি যুক্ত করে নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন নজরুল।
নজরুলের কবিতায় আছে, “মদলোভীরে মৌলভী কন,-পান করে এই শরাব যারা।” মোলবীরূপধারী মৌলোভী অর্থাৎ মদলোভী ব্যক্তি ( মৌলবী শব্দের ধ্বনি সাদৃশ্যে)। নজরুল মৌলোভী শব্দটিকে যুৎসই প্রয়োগ করেছেন। বারোয়ারী সাদৃশ্যে নজরুল লিখেছেন মালোয়ারী। ম্যালিরিয়া রোগের নয়া নামকরণ যেন। “বাঘা শীত কাঁপি থরথর, যেন গো মালোয়ারী।” এভাবে নজরুল সেই ট্রাডিশন সমানে চালিয়েছেন। নজরুল আরবি-ফারসির অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন অনায়াসে। এ যে তার একক কৃতিত্ব। ‘সুব্-উম্মেদ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “তোমাদের এই ইখাওয়ৎকে কেন্দ্র করিয়া আমাদের অন্তরের সত্য স্বাধীন শক্তিকে যেন কোনওদিন বিসর্জন না দিই”। আরবি শব্দ ইখাতওয়ৎ অর্থ ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি। আরবি আখ্ অর্থ ভাই। আখাওয়াৎ-ইখাওয়াৎ দুই উচ্চারণই করা হয়। বাংলায় এ শব্দটি খাপ খাওয়ানো যায়নি বলে নজরুলের পরে তার কোনো ব্যবহার মেলে না।
ঈদ মোবারক কবিতায় ‘সুজদা এনেছে সুখে ডগমগ মুকুলীমন’ লাইনের প্রথম শব্দটি অর্থ হচ্ছে শুভবার্তা বা সুসংবাদ। আবার সুবেহ্ উম্মেদ রচনায় দেখি “পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায় গাহে বুলবুল খোশ এলান।” এই শেষোক্ত শব্দটির অর্থ মধুর স্বর। বুলবুল পাখির মধুর স্বর বোঝাতে এই ফারসি শব্দের ব্যবহার। ঈদের চাঁদ কবিতায় লিখেছেন, ‘জুলমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই’। জিন্দান অর্থ কারাগার। নজরুলের আরেক কবিতায় আছে, “না শিখে আদব এলি বেহেশতে/ কোন বন হতে রে মনহুশ ?” এই আরবি শব্দটির অর্থ হতভাগা। নজরুলের গদ্যে আছে, ‘বাপ বলত হালার পো, মা আদর করে বলত- ‘আফলাতুন’। এই আফলাতুন অর্থ দুর্দান্ত বা জাঁহাবাজ। এছাড়া ব্যবহৃত হয় পরিবর্তিত অর্থে। নজরুলের গদ্যে এমন শব্দের ব্যবহারও দেখা যায়।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের মোর্হরম কবিতায় আছে, ‘শমশের নাও হাতে, বাঁধো শিরে আমামা’- এই আমামা অর্থ পাগড়ি। ফারসি এই শব্দটি বাংলার পাগড়ির নিচেও ঠাঁই পায়নি। মূলত বাঙালির পাগড়ি প্রিয়তা ধোপে টেকেনি। নজরুল-অনূদিত হাফিজের রুবাইয়াতে মেলে, “মুলতুবি আজ সাকী ও শরাব্ / দীওয়ানে হাফিজ জুজদানে।” এই শেষ শব্দটির অর্থ মূলত গ্রন্থ আবরণী বা মলাট। জুজদানে বাংলাভাষার কোনো দানছত্রের ভেতরও আশ্রয় নিতে পারেনি। নজরুল ব্যবহৃত অনেক শব্দই না বোঝা থেকে গেছে। আবার সে যুগে নতুন মনে হয়েছে, এমন শব্দ এ যুগে বাংলায় ঠাঁই পেয়েছে। তবে অনেক শব্দের অর্থ বুঝে নিতে হয়, ‘আন্দাজিক্যালি।’ এসব শব্দের তাৎপর্য জানা থাকলে কাব্যশব্দ তৃপ্ত হয়।
নজরুল আরবি-ফারসি শব্দের পাশাপাশি উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি এবং সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারও করেছেন। যখন যেখানে যা পেয়েছেন তা আত্মস্থ করে নতুন উদ্ভাসনে বাংলা গদ্যে-পদ্যে সংযোজন করে শব্দের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। দজ্জাল, জালিম, খুনিয়াদের বিরুদ্ধে এই শব্দাস্ত্র ব্যবহার করেছেন। হায়দরি হাঁক হেঁকেছেন মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। হিন্দু-মুসলিম দুই সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে সরব ছিলেন নজরুল। শব্দ নিয়ে খেলেছেন ছন্দ তালে লয়ে তানে। নজরুল প্রাচ্য থেকে যেসব শব্দ তার সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে অনুরণিত করেছেন, তাতে প্রাণের স্পর্শ প্রবাহিত করতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। নজরুল কোনো ‘কেলেঙ্করিয়াস’ ঘটনা ঘটাননি। যদিও সমালোচনার তোড়ে মাঝে মাঝে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিও ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন।
নজরুল অভিধান শব্দসূত্রে মুসলিম সংস্কৃতির মনন-চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর, দ্যোতনার দিকে বাঙালিকে উন্মুখ করে তুলতে পেরেছিলেন। শব্দের বাহারে কিংবা যুৎসই শব্দাঞ্জলি দিয়ে পাঠকের ‘দিল ওহি মেরা ফাঁস গেয়ি’ করেছেন। শব্দগুলো নজরুলের ভাষাতেই বলা যায়- “আমাদের যেন জিজ্ঞেস করছে ‘হাঁদাইবা নি’ অর্থাৎ তুমি কি সাঁদাইবা (সাঁ-হাঁ)? অর্থাৎ ভিতরে ঢুইক্যা দেখবা। যদি তাই করনের খাইস থাকে তবে হীরা জহরত পাইবা।”
লেখক: কবি, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত। মহাপরিচালক, প্রেস ইসস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
আরও পড়ুন:আজ নজরুলজয়ন্তী এভাবে না বলে বলতে ইচ্ছে করছে তারই কবিতার সেই চির অমর বাণীর শরণ নিয়ে: আজ নবসৃষ্টির দিন। আজ উল্লাসের দিন।
“আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগলো জোয়ার
দুয়ার ভাঙা কল্লোলে!
আসল হাসি আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর
তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে__
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!”
এমনই উল্লাসমুখর এক আনন্দের দিন -১১ জ্যৈষ্ঠ। বাংলা কবিতার সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠস্বর চির বিদ্রোহী -চিরপ্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৩০৬- ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) আগমনের আলোয় উদ্ভাসিত জন্মদিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তরুণ কবিকে তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সানন্দে বরণ করে নিয়েছিলেন।
বাংলা কবিতার দুই দিকপাল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের স্মৃতিবিজড়িত মাস বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ। কদিন আগেই আমরা উদ্যাপন করেছি পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, আমাদের জাতীয় কবির জন্মদিন- নজরুল জয়ন্তী। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আগমনকে ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ বলেও অভিহিত করেছিলেন কোনো কোনো সাহিত্য সমালোচক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বাংলা সাহিত্যখ্যাতির মধ্যগগনে। ঐ রকম প্রতাপশালী কবির প্রবল অস্তিত্ব উজিয়ে নতুন কবিতা লেখা? চাট্টিখানি কথা নয়। সে এক অসাধ্য সাধনই বটে!
সেই প্রায় অসম্ভব কাজটিই করেছিলেন অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণকবলিত ভারতীয় উপমহাদেশ যখন শৃঙ্খল মুক্তির স্বপ্নে উত্তাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টালমাটাল পৃথিবী শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর। ঠিক তেমনি সময়ে রাশিয়ায় ঘটে গেল বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) স্বৈরাচারীর জার শাসকের পতন ঘটিয়ে দিলো শ্রমিক বিপ্লব। সেই সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীতে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম শৃঙ্খল ছেঁড়ার কবিতায়-গানে মুখর করে তুললেন এই উপমহাদেশ।
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন ১৮ বছরের টগবগে যুবক কাজী নজরুল ইসলাম। অবহেলা অনাদরে বড় হওয়া পিতৃমাতৃহীন দুখু মিয়া বেঙ্গল প্লাটুনে যোগ দিয়ে দেশ এবং সমাজকে দেখার তৃতীয় নয়ন যেন পেয়ে গেলেন। অসাধারণ মেধা আর প্রতিভা বলে নেতৃত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন মাত্র তিন বছরের সৈনিক জীবনে। কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন তিনি। এখানেই ব্যাপকভাবে শিখেছিলেন ফার্সি সাহিত্য আর সংগীত।
যুদ্ধশেষে বেঙ্গল প্লাটুন ভেঙে দেয়ার পর হাবিলদার কবি কলকাতায় ফিরেই শৃঙ্খল ছেঁড়ার গানে আর কবিতায় কাঁপিয়ে দিলেন ইংরেজ শাসকদের ভিত্তিমূল।
“কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট/
রক্ত জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী”...
কিংবা ১৯২১ সালে লেখা সেই চির অমর কবিতা বিদ্রোহী:
“বল বীর -
বল -উন্নত মম শির।
শির নেহারি, আমারি নতশির, ওই শিখর হিমাদ্রির।”...
এই বলে যে কবিতার সূচনা, তার পরিণতি এই দৃপ্ত অঙ্গীকারে-
“মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।”...
সমগ্র বাংলা সাহিত্যর অঙ্গনই চমকে উঠেছিল এই অভিনব উচ্চারণে। এমন কবিতা কেউ কখনো পড়েননি, শোনেননি!
অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, চন্দ্রবিন্দু, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উত্তাল তরঙ্গ তুলে দিয়ে গেল বাঙালির হৃদয়ে। শৃঙ্খল ছেঁড়ার দৃপ্ত সাহসের অগ্নিমশাল ছড়িয়ে দিল বাঙালির চেতনায় মননে। ব্রিটিশ শাসক কারারুদ্ধ করল কবিকে। নিষিদ্ধ করল তার একাধিক কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু তাতে কী! নির্ভীক কবি আর উচ্চকণ্ঠে উঠলেন কারাগারে বসেই:
“এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।”
স্বদেশের মুক্তির জন্য এমন দ্রোহের দাবানল যার হৃদয়ে, তিনিই শোনালেন মর্মস্পর্শী প্রেমের গান, বিরহের গান। নিজের অস্তিত্বের কথাও জানান দিলেন এই বলে: “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/আর হাতে রণ-তূর্য!”
প্রেমে আর দ্রোহের এক অভূতপূর্ব কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা গানের জগতেও এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছিলেন তিনিই।
যে অর্থে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহী কবি, যে অর্থে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত দ্রোহী কবি, নজরুলকে সেই অর্থে যেমন নতুন কবিতার জন্য বিদ্রোহী বলা যায়, ততধিক বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি বাংলা কবিতায় নতুন বিষয় সংযুক্ত করে।
এদিক থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে তার কিছুটা সাহায্য আছে। মাইকেল যেমন মেঘনাদবধ কাব্য লিখে কবিতার আঙ্গিকে ভাষায় তেমনি হাজার বছরের হিন্দু-পুরাণের প্রচলিত মিথ ভেঙে দিয়ে রামায়ণ কাহিনিকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন, রাবণকে দেশপ্রেমিক নায়কে পরিণত করেছিলেন, তেমনি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রচলিত কাব্যধারণা এবং আঙ্গিক ভেঙে দিয়ে নতুন কাব্যভাষা এবং বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, যা তাকে গণমানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দিয়েছিল প্রবল রবীন্দ্রপ্রভাবের যুগেও।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা (১৯২১) লিখে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষের মহিমাকে তিনি এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা তার আগে বাংলা সাহিত্যেই বিরল।
‘শুন হে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।
এই কবিতা নজরুলের আগেই রচিত হয়েছিল চন্ডীদাসের হাতে। মানুষের মহিমা এখানে উচ্চারিত হলেও মানুষের বিপুল শক্তি এবং অমিত সম্ভাবনার কথা নজরুলের আগে কেউ বলেননি এমন নতুন ছন্দে নতুন উপমায়। এমন রক্তে ঝাঁকুনি দিয়ে।
সমাজের শাসন-শোষণ, বঞ্চনা আর শক্তিধরদের শক্তির তাণ্ডব দেখে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত কবি জাগাতে চেয়েছিলেন ঘুমন্ত সমাজকে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী কবিতার কাব্য জীবনের সূচনাতেই বলশেভিক বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। প্রমাণ আমরা পাই তার সাহিত্যে যেমন, তেমনি পাই কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদসহ অনেকের স্মৃতিচারণমূলক রচনা থেকেও।
বিদ্রোহী কবিতায় হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় মিথ যেভাবে তিনি অকপটে ব্যবহার করেছেন তা বিস্ময়কর! অসাম্প্রদায়িক নজরুল হিন্দু এবং মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা বার বার আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু অবিচল বিশ্বাস থেকে তিনি সরে দাঁড়াননি। তিনি চেয়েছিলেন মানুষে মানুষে মিলন। অবিভক্ত বাংলাসহ পরাধীন সমগ্র ভারতবর্ষকেই জেনেছিলেন মাতৃভূমি বলে। যে কারণে ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় সুস্পষ্টভাবে বলতে পেরেছেন:
“ওরা হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন!
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।”
সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল নজরুলের কণ্ঠ। ধর্মান্ধ লোভী মোল্লা আর পুরোহিতদের তিনি সমান ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন। বার বার বাধার মুখে পড়েছেন। কিন্তু তাতে তিনি অসাম্প্রদায়িক আদর্শ থেকে একচুল সরেননি। নারী-পুরুষের বিভেদ বৈষম্য তিনি মুছে দিতে চেয়েছেন।
“বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
এমন উদার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কাজী নজরুল ইসলাম নারী-পুরুষের মর্যাদাকে সমান করে দেখেছেন আজীবন। কুলি-মজুর, শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়ে ছিলেন সোচ্চার! তার গানে কবিতায় আমরা বার বার সেই উদার মানবিকতার পরিচয় পাই। নজরুল চেয়েছিলেন শোষণমুক্ত এমন এক সমাজ যে সমাজে মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষে, ধনী-গরিবের কোনো বিভেদ থাকবে না। মানবিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে মানুষ। তার ব্যত্যয় দেখেছেন যেখানে, সেখানে ফুঁসে উঠেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একই সঙ্গে এমন দ্রোহী আর এমন প্রেমিক কবি ও বাংলা কাব্যে বিরল বললেও অত্যুক্তি হয় না।
বাংলা গানের জগতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত বা সেসময়ের গীতিকবিদের গান শুনলেই বোঝা যেত, এটা রবীন্দ্রসংগীত, এটা ডি এল রায়ের লেখা এবং সুরের গান। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গান এতো বিচিত্র সুর আরোপ করেছেন, এমন এমন নতুন রাগ এবং সুর সৃষ্টি করেছেন যা অভূতপূর্ব।
সে যুগে হিজ মাস্টার্স ভয়েস বা এইচএমভি কেবল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেই গানের রয়্যালটি দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করত। অন্য কোনো গীতিকবি এইচ এমভিতে গান লিখে কোনো রকম রয়্যালটি পেতেন না। নজরুল দ্বিতীয় কোনো গীতিকবি যিনি এইচএমভির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন রয়্যালটিসহ। বাংলা গানে যে অবদান তিনি রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয়।
একইসঙ্গে তিনি ইসলামিক গজল এবং শ্যামাসংগীত লিখেছেন আশ্চর্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে। বাংলা গানের জগতে এমন বিপরীত ধারার সব সংগীত রচনার কোনো দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই।
নজরুল ইসলাম বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর (১৮৯৯-১৯৭৬) কিন্তু তার সাহিত্যচর্চার জীবন মাত্র দুই দশকের। ১৯২০ সাল থেকে ধরলে ১৯৪২ মাত্র ২২ বছর। ওই বছর ৯ জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে ছোটদের একটি আসরে নজরুলের ১০ মিনিটের একটি গল্প বলার কথা ছিল। গল্প বলতে শুরু করেই থেমে গিয়েছিলেন কবি। কোনো চিকিৎসাতেই তিনি আর বাকশক্তি ফিরে পাননি। লেখনীর ক্ষমতাও হারিয়েছেন সেদিন থেকেই। যেন নিজের ভবিষ্যৎ তিনি জানতেন! না হলে অনেক আগেই গুবাক-তরুর সারি কবিতায় কী করে লিখলেন: “তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ!
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ।"
সেই ১৯২১ সালে লেখা বিদ্রোহী কবিতাতেই তো তিনি লিখছেন: “আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!”
এরকম নিজেকে জানা বা আত্ম-আবিষ্কারশক্তি কেবল মহাসাধকেরাই অর্জন করেন। সুফিবাদের দর্শন তার অস্তিত্বে বিরাজমান ছিল। তার বহু লেখায, বক্তৃতায় সুফিতত্ত্বের পরিচয় আমরা পাই।
যা-ই হোক, স্বল্প পরিসর সাহিত্যিক জীবনে তিনি যে অসামান্য সৃষ্টিসম্ভারে পূর্ণ করে গেছেন বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে, তার তুলনা নেই। মানব মুক্তির বাণী বাহক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন। যিনি দ্রোহী সত্তায় মুখর হয়ে “ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে” কিংবা ‘খেয়ালী-বিধির বক্ষ’ বিদীর্ণ করে দিতেও সামান্য ভয় পান না, তিনি যে কত বড় বিদ্রোহী, তা ওই একটি কবিতা থেকেই প্রমাণিত!
একদিন গানের বাণীতেই চিরবিদ্রোহী চির প্রেমিক কবি লিখেছিলেন:
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে”।
তার কথাই সত্য হয়েছে। বাঙালি তাকে ভুলতে পারেনি, পারবেও না। চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি বাঙালির হৃদয়ে।
গানের বাণীতে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন: “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই”।
বাংলাদেশ তার সেই আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে চিরনিদ্রায় শায়িত করেছে তাকে। কিন্তু তার যে আকাঙ্ক্ষা আজও বাংলাদেশ পূরণ করতে পারেনি, তা হলো সমাজে এখনও প্রবলভাবে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতা। সব ধর্মের মধ্যেই এখন প্রবল উগ্রতা দৃশ্যমান। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের শোষণ-বঞ্চনা এতটুকুও কমেনি।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির জাঁতাকলে, বৈষম্যমূলক অর্থব্যবস্থায় দিন দিন গরিব আরও গরিব হচ্ছে, অর্থনীতি বিস্তৃত হচ্ছে প্রসারিত হচ্ছে, উন্নয়নের সীমানা যত প্রসারিত হচ্ছে, ধনী ততই আরও ধনী হচ্ছে। নারী নির্যাতন সমাজ থেকে আমরা মুছে ফেলতে পারিনি। নারীনীতি ঘোষণা করেও তা মৌলবাদী ধর্মান্ধদের চাপের মুখে বাস্তবায়ন করা যায়নি।
নজরুলজয়ন্তীতে কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন তখনই সার্থক হবে যখন আমরা কবির স্বপ্নের শোষণহীন অসম্প্রদায়িক সমতার আর মানবিক মমতার সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: জ্যেষ্ঠসাংবাদিক ও কবি। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।
আরও পড়ুন:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াকালীন ড. মুনতাসীর মামুন আমাদের দ্বিতীয়বর্ষে ইডরোপের ইতিহাস পড়াতেন। ক্লাসে রেনেসাঁ পড়ানোর সময় বলেছিলেন ইতিহাস পড়তে হলে ধর্মকে সব কিছুর ওপরে রাখতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে ইতিহাসকে মিলিয়ে নিলে ইতিহাস বুঝতে সমস্যা হবে। তখন বিষয়টি বুঝতে পারিনি। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করেছি। ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের তত্ত্বাবধানে ‘যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন (১৯৭১-২০১২)’ নিয়ে গবেষণা কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনে সাহসী মুনতাসীর মামুনের অবদান সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য যেমন অবিরাম লিখেছেন, তেমনি মাঠের আন্দোলনে থেকেছেন সক্রিয়। আমার মতো অনেক তরুণকে মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
মুনতাসীর মামুন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে মুনতাসীর মামুনের লেখালেখি বিষয়ে ১২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও মুনতাসীর মামুনের লেখালেখি ও অন্য অনেক বিষয় বাকি রয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে শুধু লেখালেখি নয়, আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা মুনতাসীর মামুনের আজকের মুনতাসীর মামুন হয়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি লেখালেখির জন্য বিএনপি জোট সরকারের সময়ে ২০০২ সালে কারাবরণ করেন।
ছাত্রাবস্থায় অধ্যাপক মামুন আমাদের বলেছিলেন সামাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন হয়েছে যে, এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি বা সেনাবাহিনী প্রধান হতে পারবেন না, বা হতে দেয়া হবে না। তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তাই এত কিছু বুঝতে পারিনি। পরবর্তীকালে অবশ্য মুনতাসীর মামুনদের লেখালেখি ও দাবির ফলেই বঙ্গবন্ধুকন্যার সময়ে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই উদ্যোগটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
এরপর ছাত্রজীবন শেষে এম ফিল করার সময়ে স্যারের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়। তখন একদিন খুলনায় গিয়েছি একটি কাজে। আমাদের এক সহপাঠী আমাকে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জানার পর মামুন স্যার কেমন আছেন জানতে চাইল। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। সবাই যেখানে স্যারকে ভয় পায় সেখানে সে স্যারের খবর নিচ্ছে! কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বলল যে, মামুন স্যারের ট্রাস্টের টাকায় পড়ালেখা করে আজ সে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। মুনতাসীর মামুন স্যার যে বিভাগের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের নিজের ট্রাস্টের টাকায় পড়াতেন তা ছাত্রাবস্থায় জানতেই পারিনি। স্যারকে যখন বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম তখন তিনি বললেন, আমি কি মানুষকে জানানোর জন্য এসব করি যে তোমাদের বলব।
অন্য আরেকদিন স্যারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় মুক্তিযুদ্ধ কোষের কাজ করছি এই সময়ে একজন মহিলা সঙ্গে একটি মেয়েকে নিয়ে স্যারের বাসায় ঢুকলেন। স্যারকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছেন। স্যার বললেন, সব ঠিক আছে ‘বিজনেস টক’ করো, বিষয় কী বলো। মহিলা মেয়ের পরীক্ষার ফিস জমা দিতে হবে বলে জানালেন। স্যার সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিলেন। আমি তাকিয়ে আছি দেখে মহিলা জানালেন যে, তার এই মেয়েটিকে স্যার পড়াচ্ছেন। পরে জানতে পারলাম এই মহিলা শিক্ষকদের কোয়ার্টারের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা ট্রাস্টের মাধ্যমে মুনতাসীর মামুন গরিব ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন যা পরবর্তীকালে কাজের সুবাদে জানতে পেরেছিল। এ তো গেল মানবিক দিকের কিছু।
এখন আমার দেখা সাহসী মুনতাসীর মামুন সম্পর্কে কিছু কথা বলব। স্যারের সঙ্গে কাজ ও এম ফিল করার সুবাদে বেশি সময় থাকা হতো তার সঙ্গে। এই সুযোগে নির্মূল কমিটির বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম। মামুন স্যার যখন বক্তৃতা করতে মঞ্চে ওঠেন, তখন দর্শক সারিতে একটু নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। কেন এমন হয় বুঝতে কিছু সময় লেগেছিল। মামুন স্যার বক্তৃতায় এমন কিছু কথা বলবেন যে, তা অনেকের বলার সাহস নেই বা বলতে চান না। কিন্তু কোনো অন্যায় হলে সেটার প্রতিবাদ তিনি দৃঢ়কণ্ঠে করবেন এটা সবাই জানত তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকতেন। তিনি সব সময় দর্শক-শ্রোতার মন বুঝে বক্তৃতা করেন বলে মনে হয়েছে। কারণ কখনই অযথা বক্তৃতা দীর্ঘ করেন না। যা প্রয়োজন তাই বলে শেষ করেন।
মুনতাসীর মামুনের বক্তৃতায় একটা বিষয় সুম্পষ্ট করে বলেন যে, ১৯৬৮ সাল থেকে রাস্তায় আছেন তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপক্ষে যেকোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার তার আছে। অপর পক্ষে যিনিই থাকুন না কেন। এমনকি নিজের চাচা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনেক কাজের সমালোচনা করে পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আপন চাচার বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখে প্রতিবাদ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সামরিক সরকার, জোট সরকার বা বর্তমান সরকারের যেসব সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে করেছেন তখনই দৃঢ়ভাবে পত্রিকায় লিখে বা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।
অনেকের মতো তিনি শুধু এসি রুমে বসে বক্তৃতা করে বা ক্লাস নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাজপথে থেকে দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এই সাহস ও আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা আমাদের মতো অনেক তরুণকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে উজ্জীবিত করেছে। তার পরিবার মানস গঠনে সহায়তা করলেও পরিবারের পরিচয়ে তিনি পরিচিত হননি।
পরিবারকে পিছনে রেখে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছেন। পিতৃব্য ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্নেহ পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু নিজের কর্মগুণে তাদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন। যদিও একটি লেখায় মুনতাসীর মামুনের আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে অবদান তুলে ধরা সম্ভব নয়। তারপরও এই লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে মানবিক ও সাহসী মুনতাসীর মামুনের ভূমিকা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
৭২তম জন্মদিনে আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা স্যার! জাতিকে আপনার আরও অনেক কিছু দেয়ার আছে। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লেখক: গবেষক-প্রবন্ধকার। সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। জুনের শেষ সপ্তাহে উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ চান না। এটা তিনি আগেও বলেছেন। এটা তার বড় ও উদার মনের পরিচয় বহন করে। তারপরও একশ্রেণির মানুষ পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে রাখার আবদার করে চলেছেন। বলা হচ্ছে, সর্বস্তরের মানুষ শেখ হাসিনার নামে পদ্মা সেতুর নাম চাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। অমর শিল্পী মান্না দে’র গাওয়া সে গানটিই হোক পাথেয় “হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে”। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম এদেশের মানুষের হৃদয়ে লেখা আছে এবং থাকবে। যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে এবং তা থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
এটা কেউ অস্বীকার করবে না এবং সবাই জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপেই এই পদ্মা সেতু স্বপ্ন থেকে আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার সাহসের ফসল। তারপরও এই সেতুর নাম পদ্মা সেতু রাখাই যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সাহসের ফসল। বঙ্গবন্ধু যেমন আছেন আমাদের রক্ত পতাকায়। বাংলাদেশের পতাকায় আমরা সব সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। বাংলাদেশের প্রতিটি পথে-প্রান্তরে, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আমরা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই, যেমনটা বাংলাদেশের সব পথ আজ মিশেছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ায়। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিনই বাংলার মানুষ দেখতে পাবে বঙ্গবন্ধুকে।
বাংলাদেশের এই যে অদম্য যাত্রা তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এক সময় চাঙা হয়ে ওঠেন; নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। তখন শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই নেতা-কর্মীরা কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করে।
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কালো অন্ধকার গ্রাস করেছিল, সেই অন্ধকার তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকট- সীমাবদ্ধতার পর দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহু মুক্তির পালা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, বিকাশ এবং মুক্তির লক্ষ্যে অগ্রণী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য তার বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, যুক্তিবাদী মানসিকতা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা এবং অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব অঙ্গনে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে । পিতার মতোই তিনি বিশ্ববিখ্যাত নেতা হিসেবে পরিচিত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরামহীনভাবে নিরন্তর জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল এবং দঢ় নেতৃত্বে ‘বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়’। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে এবং ২০৪১ সালে একটি ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার বড় প্রমাণ হলেঅ গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২,৮২৪। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কয়েকটি শীর্ষদেশগুলোর মধ্যে একটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন প্রথমটি হলো- ডিজিটাল বাংলাদেশ যা ইতোমধ্যে একটি পর্যায়ে এসেছে, দ্বিতীয়টি, ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা, তৃতীয়টি, ২০৪১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার এবং চতুর্থটি, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন।
গত চার দশকে তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য লড়াই করেছেন। সংগ্রামের এই গতিপথ ছিল প্রতিকূল। শেখ হাসিনা, যিনি অলৌকিকভাবে ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উনয়ন প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৩৯টি হাই-টেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মিত হচ্ছে।
কৃষি-শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আধুনিক প্রযুক্তি সবকিছুর অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে নতুন পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা করতে হবে। বাংলাদেশকে আমূল বদলে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এদেশ। দুর্বল, অনুন্নত, নড়বড়ে অবস্থা থেকে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রচলিত অবকাঠামোর আধুনিক রূপান্তর সম্ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করছে প্রতিদিন। যেসব খাত কিংবা ব্যবসা আগে অবহেলিত অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে চলছিল সেগুলোতে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অমিত সম্ভাবনার হাতছানি এদেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত, আগ্রহী করে তুলছে। অবহেলা-অযত্নে লালিত সেই সম্ভাবনাময় খাতগুলো ক্রমেই জেগে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ, দপ্তর, মন্ত্রণালয়গুলো সময়ে সময়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। ফলে সম্ভাবনার নতুন খাতের বিকাশ ঘটে চলেছে। সম্ভানাময় নতুন খাতগুলো বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনে, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই অক্ষম-দুর্বল, মেধাহীন নয়। তারা অনেক পরিশ্রম করতে পারে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ যারা এর আগে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আর অসহায়ত্বের বেড়াজালে নিজেদের বন্দি করে রেখেছিল, তারা এখন নিজের মেধা-বুদ্ধিমত্তা, শক্তি-সাহস, পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজেই নিজের ভাগ্য নতুনভাবে গড়ে তুলছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা, জনপদের চিত্র। সম্ভাবনার উজ্জ্বল চমক দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অবিশ্বাস্য রকমের। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪১তম স্থানে উঠে এসেছে।
এই পদ্মা সেতু যাতে না হতে পারে তার জন্য অনেকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গোটা জাতিকে হতাশায় ফেলে দেয়। কিন্তু সমগ্র জাতিকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবেন। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যা। বাংলাদেশে যখন সংকট তীব্র হয়, যখন সবকিছু আবর্তিত হয় অনিশ্চয়তায়, বাংলার আকাশে কালো মেঘ জমে থাকে, তখন শেখ হাসিনাই আমাদের শেষ ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়ান। একজন ব্যক্তি অদম্য সংকল্প এবং কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে ভয়ের কালো মেঘকে সরিয়ে দেন, দেশের মানুষ আশার আলো দেখে। যখনই মনে হয় যে সবকিছু শেষ হয়ে আসছে, তখন আমরা খারাপ সময়টির মুখোমুখি হই, তবে একজন ত্রাণকর্তাই দক্ষতার সঙ্গে দুঃস্বপ্নটি সরিয়ে ফেলেন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
অতিভক্তি ভালো নয়। শেখ হাসিনাকে যারা ভালোবাসেন তারা কেন একটি স্থাপনার নামের মধ্যে তাকে সীমিত করতে চান। শেখ হাসিনা এখনও দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, এটা তার প্রত্যয়। তার সামনে আরও অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে মানুষের জন্য আরও বৃহত্তর কল্যাণের পথ প্রশস্ত করার। তার কাছে মানুষের প্রত্যাশার ইতি ঘটেনি। তাই তাকে তার মতো চলতে দেয়াই ভালো। তার নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ করার প্রস্তাব তাকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দেয়ারই নামান্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের নামে পদ্মা সেতুর নাম চান না। এমনকি শেখ রেহানা চান না বলেও জানা গেছে।
গণতন্ত্রকে সুসংগঠিত করতে বাংলার পথ-প্রান্তর চষে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। গত ৫০ বছরে সবচেয়ে সৎ রাজনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। তিনি না ফিরলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না। জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান হয়েছে। নয়তো অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া সম্ভব হতো না। তিনি না থাকলে নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে পাথর বিছানো পথ, তাই সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেই সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষের সবচেয়ে বড় উপহার পদ্মা সেতু। এটি শুধু পদ্মা পারাপারের সেতুই নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস এমন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছে যে, আমরা যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারি। আর এই আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছেন আমাদের সময়ের সাহসী প্রধানমন্ত্রী। পিতা দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতা আর কন্যা দিলেন সমৃদ্ধি, ঘর-বারান্দা চলাচলের পথ সাজিয়ে দিচ্ছেন। গ্রাম যাচ্ছে নাগরিক জীবনে।
তিনি সাহসিকতার সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা করছেন এখনও, এখন এটি বিশ্বের সেরা উদাহরণ এবং বিশ্ব নেতারা বিশ্বব্যাপী সংকট পরিচালনার জন্য তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তার সাহসকে আরও অদম্য করে তুলেছে। নামকরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জোর দবরদস্তি করা ঠিক হবে না পদ্মা সেতু নদীর নামেই থাকুক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আরও পড়ুন:স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল সংগ্রামের। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতি-সচেতন ছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অতি উৎসাহী কর্মী ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিবিরোধী তথা গণবিরোধী ভূমিকার কারণে অবস্থান পরিবর্তন করতে দেরি করেননি। তিনি ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে, জুলুমের বিরুদ্ধে। তার জীবন নিবেদিত ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নানামুখী তৎপরতায়। নিজের জীবনের সুখ-শান্তি হেলায় উপেক্ষা করেছেন। বাংলার মানুষের দুঃখ মোচনের লড়াইয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ছিলেন বলেই তিনি ১৯৬৯ সালেই হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জনরায়ে তারই হওয়ার কথা পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নেতা ইয়াহিয়া খান বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ না করে চাপিয়ে দেয় এক বর্বর যুদ্ধ।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবকে বাধ্য হয়েই যুদ্ধের মোকাবিলায় ডাক দিতে হয় জনযুদ্ধের, স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অকৃত্রিম বন্ধুর মতো বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশ পায় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি থেকেও হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। তার নামেই চলে ৯ মাসের অসম সাহসী যুদ্ধ এবং তার প্রেরণাতেই ঘটে যুদ্ধজয়। বন্দি মুজিব বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়েন। তার সাহস, মনোবল এবং মানুষের প্রতি তার দরদের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বেই।
নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির টানাপড়েনে কোন দিকে যাবে তা নিয়ে যখন অনেকের মনেই সংশয় ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে, তিনি বিশ্ব শান্তির পক্ষে। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু যারা যুদ্ধবাজ, যারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পছন্দ করে, তাদের ব্যাপারে কোনো নমনীয়তা ছিল না বঙ্গবন্ধুর।
শান্তি আন্দোলনের প্রতি শেখ মুজিব আগ্রহী ছিলেন বরাবরই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ওই বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস’। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তার কথা বলা বা মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। তার সফর অভিজ্ঞতার কথা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
১৯৫৬ সালের ৫-৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
বঙ্গবন্ধুর সরকারের দৃঢ় অবস্থান ছিল কোনো সামরিক জোটে যোগ না দেয়া। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশ্বের ১৪০ দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জুলিও কুরি হচ্ছে বিশ্ব শান্তি পরিষদের একটি সম্মানজনক পদক। ফরাসি পদার্থ বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রীর নাম ইরেন কুরি। তারা দুজনেই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। ইরিনার মা-বাবাও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী দম্পতি পিয়েরে কুরি ও মাদাম কুরি। পরে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে ‘জুলিও কুরি’।
বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’ পদক। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাই এ পুরস্কার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং।
১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ সেদিন থেকেই বাঙালি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের যে অমানবিক অবস্থান, তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসীনীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা, তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রতিক্রিয়া নিজেই দেখেছেন। সে সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ ও অনাহারীদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তার আছে। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ এটি তার প্রত্যাশাই শুধু নয়, নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এগিয়ে আসাও। তাই স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে জোর দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি এটাও বলেছিলেন, প্রয়োজনে আলেন্দের পরিণতি বরণ করব, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না।
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। তিনি জীবন দিয়েছেন কিন্তু আপসের পথে হাঁটেননি। বঙ্গবন্ধু শরীরী উপস্থিতি আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু তার আদর্শ আছে। যদিও এখন বিশ্বব্যাপী রাজনীতির ধরন এবং প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। শোষিতের পক্ষের বিশ্বশক্তি দুর্বল। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযেগিতা চলছে। শান্তির ললিত বাণী পরিহাসের মতো শোনায়। তার পরও বলতে ইচ্ছে হয়, হাল ছেড়ো না বন্ধু...
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির দিনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আরও পড়ুন:২৩ মে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, সে কথাটি আজ অনেকেরই স্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। অথচ ১৯৭৩ সালের সেই দিনটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মাননা পদক। পঞ্চাশের দশকে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক জোলিও এবং তার স্ত্রী ইরেন কুরির নাম অনুসারে ১৯৫৯ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তির জন্য প্রদেয় পদকের নামকরণ করেন এই বিজ্ঞানী দম্পতির নামে, ১৯৫৮ সালে ফ্রেডেরিক জোলিওর প্রয়াণের পর। উভয়ে যৌথভাবে নোবেল বিজয়ী এই দম্পতি শুধু বিজ্ঞান চর্চাই অবদান রাখেননি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে গোটা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন। ফ্রেডেরিকের একান্ত প্রচেষ্টায় গঠিত এই বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রথম সভাপতি তিনি নিজেই ছিলেন।
এই দম্পতি নোবেলপ্রাপ্তির সঙ্গে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা দিয়েই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তিদের পদক প্রদান শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে, যা ১৯৫৮ সালে ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পরও চলতে থাকে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব মহান ব্যক্তির হাতে এ পদক দেয়া হয় তাদের মধ্যে ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ভিয়েতনাম মুক্তির নায়ক হো চি মিন, চিলির সালভাদর আয়েন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ। এরা সবাই সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই পদকপ্রাপ্ত ৪৮তম রাষ্ট্রনায়ক। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকে এই বিরল সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলে ১৯৭৩-এর ২৩ মে ২৩তম এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে সেই পদক পরিয়ে দিয়েছিলেন সংস্থার সে সময়ের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র। অনুষ্ঠানে রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার মহানায়ক নন, তিনি সারা বিশ্বের, বিধায় বিশ্ববন্ধু।’ এভাবেই একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের পর এই পদককে দ্বিতীয় শীর্ষ আন্তর্জাতিক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর সেই বিরল সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা, ঠিক আমাদের স্বাধীনতার পর পরই, যা জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে অনেক গৌরবময় করে তুলেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে এ পদক প্রদানের জন্য শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বের কথাই বিবেচনায় নেয়া হয়নি, বিশ্ব সভাগুলোয় গোটা মানবজাতির জন্য তার ভাষণ এবং অবদানের কথাও বিবেচনায় আনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে, ১৯৭৩-এ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এবং কমনওয়েলথ সম্মেলনে তার ভাষণগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছিল শান্তি পরিষদ।
এসব আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, যথা শাসক এবং শোষিতের মধ্যে, আর তিনি শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর সেই মন্তব্য তাকে এক বিশেষ গুরুত্ববাহী দার্শনিকের পর্যায়ভুক্ত করে দিয়েছিল। তিনি শুধু কথার মধ্যেই তার প্রচেষ্টা সীমিত রাখেননি, তার নীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে ছিলেন মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর জনগণকে সমর্থন প্রদান করে। আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তিনি সে দেশের যুদ্ধরত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে ভারত বিভাগের আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সময়, যাতে বঙ্গভূমিতে কমবেশি ১০ লাখ লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, তখন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অসাধারণ, যা বহু রাজনৈতিক নেতাও করতে পারেননি। সিভিল সাপ্লাই-মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে খাদ্য আনতে। তিনি নিজ উদ্যোগে অনেক লঙ্গরখানা খুলে বহু বুভুক্ষু মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছিলেন। নিজের লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেছেন দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত মানুষের পক্ষে।
সোহরাওয়ার্দী সে সময়ের তরুণ শেখ মুজিবের ভূমিকা দেখে অবাক হয়েছিলেন। একই ধরনের বলিষ্ঠতা নিয়ে তিনি ১৯৪৫-এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে যে হত্যাযজ্ঞের উদ্ভব হয়েছিল, তা প্রতিরোধ করতে; তখনও তিনি লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাম্প্রদায়িক দস্যুদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে। তিনি এমনকি বাংলাভূমির বাইরেও বিচরণ করেছেন দাঙ্গা বন্ধের উদ্দেশ্যে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বহুদিন সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম বাংলায়ই থেকে গিয়েছিলেন, জিন্না-লিয়াকত আলি-নাজিমুদ্দিন গংয়ের ষড়যন্ত্রের ভিকটিম হয়ে। তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবও বহু সময় পাকিস্তান আসেননি। একসময় তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পাকিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দিলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে বরং তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে বলেছিলেন পূর্ব বাংলায় চলে গিয়ে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে ভূমিকা রাখতে। বলেছিলেন, হিন্দুরা যেন পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারতে পাড়ি না জমায় সেদিকে খেয়াল রাখতে।
ভারত বিভাগের পর তিনি অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা ভাষণ দিয়েছিলেন। এর একটি ছিল ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনাল’ আর অন্যটি ছিল ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলন। স্টকহোম সম্মেলনে সবার দৃষ্টি কেড়ে এই তরুণ নেতা বলেছিলে- ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূল নীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত এবং স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি, আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
তখন সবার মুখেই একটি বাক্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তা ছিল এই যে লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেলের পর এ ধরনের ভাষণ আর কেউ দেননি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি আমলের সিয়াটো-চুক্তি বর্জন করে জোট নিরপেক্ষ নীতির পথ ধরেছিলেন। বিশ্ব তখন একদিকে ন্যাটো, সিয়াটো, সেন্টো নামক তিনটি মার্কিন প্রভাবিত শিবির এবং অপরদিকে ওয়ারস নামক সোভিয়েত ব্লকের চুক্তিতে বিভক্ত ছিল। এদের কাজ ছিল বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রসহ আরও অধিক সমরাস্ত্র উৎপাদন করে বিশ্বে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
বঙ্গবন্ধু সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার থামিয়ে বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে, শান্তিকামী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। যে কারণে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সে সময়ের বিশ্বকাঁপানো নেতৃবৃন্দ, যথা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, নায়ারেয়ার, মার্শাল টিটো, বুমেদিন, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখের চোখের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য তার দাবি সবার কানে পৌঁছেছিল।
যে ব্যক্তি বিশ্ব মানবতার বিজয়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, জোলিও কুরি পুরস্কার তার অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। বেঁচে থাকলে তিনি নোবেলও পেতে পারতেন, অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বিরোধিতা করত।
লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য