‘বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করো না
উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করো না চুপচাপ বসে থাক,
বসে আঁক, বসে আঁক… ’
মাঠ রক্ষার দাবিতে কিশোর প্রীয়াংশু আর ওর মা রত্না আপাকে ধরে হাজতে ঢোকানোর পর থেকে বার বার কবীর সুমনের গাওয়া গানটির কথা মনে হচ্ছিল। বাচ্চারা যেন খেলাধুলা ও ছোটাছুটি করতে না পারে, এজন্য বড়রা কত কী করছে! আমাদের এই ঢাকা শহরটিকেই নিজেদের মতো করে সাজাচ্ছে একশ্রেণির দখলদার। এরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়।
শহরের সব মাঠ বা খোলা জায়গা, পুকুর, জলাশয়, গাছ-গাছালি, পার্ক সব কিছু তাদের কল্যাণেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কেউ জবাব চাইলেই বলছে উন্নয়নের জন্য এসব করতে হয়। এর বিরোধিতা করা মানে, রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দেয়ার শামিল।
অথচ সেই শুরু থেকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেই আসছেন একটা সুন্দর নগর গড়ে তোলার জন্য যেমন দরকার বাসস্থান, এর সঙ্গে সঙ্গে দরকার জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ এবং স্বাস্থ্যসেবা। এগুলো শুধু থাকলেই হবে না, মানুষ যেন সেই সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
যে উন্নয়নের কথা বলে সব কিছু দখল করা হচ্ছে, সেই ইস্যুতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়ন শুধু অবকাঠামেগত উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রবৃদ্ধি, উন্নতি, জনগণের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জনসংখ্যার উপাদান-বিষয়ক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে।
অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচের’ কথা। যেখানে উন্নয়নকে একটি উপায় বা পন্থা হিসেবে বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের যোগ্যতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারবেন এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক, পারিবারিক ও সর্বোপরি কাজের স্বাধীনতা লাভ করবেন। এই অ্যাপ্রোচটাই হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনডেক্সের উন্নয়ন পরিমাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আমরা কি উন্নয়নের সেই পথে এগোচ্ছি? আমাদের মাননীয় নীতি নির্ধারকদের অনেককেই দেখছি ‘উন্নয়ন’ আর ‘ট্র্যাফিক জ্যাম বা ‘যানজট’ শব্দটিকে সমার্থক মনে করছেন। ঢাকা শহরের শ্বাসরুদ্ধকর যানজটে বা মহাসড়কে দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে থাকতে থাকতে সাধারণ মানুষ যখন অস্থির হয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ করছেন, তখনই আমাদের মন্ত্রী মহোদয়দের কেউ কেউ মনে করছেন জনগণকে এই সমালোচনার যুৎসই জবাব দিতে হবে। তাই ওনারা এই ‘যানজট’কে নেতিবাচকভাবে না দেখে, সরকারের ‘সাফল্য বা উন্নয়ন’ হিসেবে দেখাচ্ছেন।
আর তাইতো একনেক সভার পর এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘৪০ বছর আগে আমি তখন চট্টগ্রামের ডিসি। রাস্তা সরু, ২টা ব্রিজ পার হতে হতো। সেখানে যেতে ঢাকা থেকে সময় লাগতো ৪ ঘণ্টা। এখন ব্রিজ নেই, চওড়া রাস্তা, তাও অনেক সময় লাগে।’ সঙ্গে এ-ও বলেছেন, ‘দেশে এত যানজট, ভিড় সবই শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের বহিঃপ্রকাশ। আপাতত এটা সহ্য করতে হবে।’
মন্ত্রী মহোদয় উন্নয়নকে যানজটের আলোকে দেখছেন বলে মনে হচ্ছে। এই ‘আপাতত’টা আদতে কতদিন, কত মাস, কত বছর? ততদিন কি ঢাকাবাসী এই নাকাল করা যানজটে পড়ে সুস্থ থাকবে? দেশের এই যানজট, এই ভিড় এগুলো উন্নয়ন সূচক হয় কীভাবে?
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় এলে উপজেলা পর্যায়েও যানজট হবে।’ এর মানে তিনিও যানজটকে উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন।
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, মন্ত্রী মহোদয়রা যদি যানজটকে উন্নয়ন বলে মনে করেন, তাহলে ওনাদের গাড়ি ট্র্যফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে না কেন, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো? এই উন্নয়নতো ওনাদেরও উপভোগ করা উচিত।
আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি জানেন যে, ঢাকা শহরের হৃদস্পন্দন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। ঢাকায় এখন একজন সুস্থ মানুষ হেঁটে গাড়ির গতির আগে যেতে পারবেন। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট ৩ এপ্রিল, ২০২২ ঢাকার মূল সড়কগুলোতে গাড়ির গতির ওপর এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে, সেদিন ঢাকায় গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪.০৮ কিলোমিটার। ২০০৫ সালে তারা দেখেছে যে ঘণ্টায় গাড়ির গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার।
এই ইন্সটিটিউটের পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন, ‘এই যে গাড়ির ঘণ্টাপ্রতির গতি বললাম, এটা একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চাইতে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষ যদি স্বাভাবিক গতিতে হাঁটেন তাহলে তিনি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বেগে হাঁটতে সক্ষম। জোরে হাঁটতে হবে না, স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলেই হবে।’ (বিবিসি)
এদিকে ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’, অন্যদিকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বেশি গাড়ি মানে বেশি লাভ, বেশি ব্যবসা, বেশি গাড়ি মানে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি। আর ধনীর সংখ্যা বাড়া মানে মানুষের হাতে পয়সা আসছে এবং সর্বোপরি দেশ ধনী হয়ে যাচ্ছে।
এই ধনী হওয়াটাই উন্নয়ন। অতএব, তাদের কাছে রাজধানী এবং মহাড়কের যানজট কোনো দুর্ভোগ নয়, বরং ইতিবাচক ব্যাপার। তাই তারা বলেই ফেলেছেন যে, উপজেলা পর্যায়েও যদি গাড়ির এমন চাপে যানজট হয়, তাহলে সেটিও হবে উন্নয়নের মানদণ্ড।
সাধারণ মানুষ জানে যন্ত্রণাদায়ক যানজট উন্নয়নের সূচক হতে পারে না। বরং ৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিপজেটের এক গবেষণা বলেছে যে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বাস করা সবচাইতে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার। এর একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ঢাকার যানজট। এখন সেই স্ট্রেস যে কতগুণ বেড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।
হ্যাঁ, জনসংখ্যা, শহরায়ন, যানচলাচল, কর্মক্ষেত্রের বিস্তার ঘটলে, যানজট সৃষ্টি হতেই পারে। এর পাশাপাশি যদি আমাদের ট্র্যাফিক সিস্টেম উন্নত হতো, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হতো, যান চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি হতো, আরও অনেক বিকল্প সড়ক গড়ে উঠত, তাহলে হয়ত এই যানজটকে আমরাও উন্নয়ন বলতে পারতাম।
সেই ৪০ বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে নদীনালা পার হয়ে আসতে যদি ৪ ঘণ্টা লাগে, তাহলে চারলেন রাস্তা করে, ব্রিজ বানিয়ে এখন কেন লাগছে ৮/৯ ঘণ্টা? এটাতো খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। ৩০ বছর আগেও বাসে ৬ ঘণ্টায় রংপুর যাওয়া যেত, এখন সেখানে লাগে ১০ ঘণ্টা। আরও আগে যখন যমুনা ব্রিজ ছিল না, রাস্তা ছিল একলেনের, ছোটখাট মিলিয়ে আরও ২/৩টি নদী পার হতে হতো, তখনও নীলফামারী যেতে সময় লাগত ১৩/১৪ ঘণ্টা, এখননও লাগে তাই।
মহাসড়কের কথা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই ঢাকা যেন এক বিভীষিকাময় শহর। একথা সত্যি যে, বিশ্বের বহু দেশে যানজট একটি বড় সমস্যা। লন্ডন, দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, টোকিও, নিউইয়র্ক, সিডনি, সিউল, ব্যাংকক নগরীও যানজটের জন্য পরিচিত। কিন্তু ঢাকার যানজট সবাইকে হার মানিয়েছে।
সেসব যানজটে বসে কেউ নাকাল হয় না। কোথাও পৌঁছানোর জন্য অনির্দিষ্টকাল বসে থাকতে হয় না। আর সবচেয়ে বড় কথা ধুলা, ধোঁয়া, হর্ন যাত্রীর আয়ু ১০ বছর কমিয়ে দেয় না। সেই সঙ্গে বাড়তি হিসেবে আছে অবিরত হর্ন, ব্রেকহীন মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বহর, নিয়ম-কানুন না মানা অদক্ষ চালক, অসচেতন পথচারী, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অভাব, ভাঙা সড়ক, ফুটপাতের দুরবস্থা, রাস্তার দুপাশে গাড়ি পার্কিং এবং সর্বোপরি অসংখ্য মানুষের চাপ।
কাজের প্রয়োজনে, ভালো চিকিৎসা, পড়াশোনা, সরকারি কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কাজে মানুষ ঢাকামুখী। স্থায়ী বাসিন্দা, অস্থায়ী জনতা মিলে ঢাকার ‘শিরে সংক্রান্তি’ অবস্থা। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা নগরীতে নানা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে অন্যতম যানজট।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সমাজ ও পরিবেশের ওপরও যানজটের ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব পড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন ঢাকার এই যানজট শিশু থেকে বুড়ো সবার রোগ-শোক বাড়িয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে মানসিক অশান্তি, বিরক্তি। মানুষ অফিস, মিটিং, ডেলিভারি, স্কুলে পৌঁছানো কোনো কাজই ঠিকমতো বা সময়মতো করতে পারছে না। অবশ্য এগুলো সব কিছুকেই আমাদের নীতিনির্ধারকরা ‘উন্নয়ন’-এর বাক্সে জমা করছেন। এই কারণে ওনারা এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধানে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
সত্যি কথা যে বহু সড়ক চারলেন, ছয়লেন হওয়ার কাজ চলছে। মেট্রোরেল প্রায় হবে হবে অবস্থা। কিন্তু আমরা কি বলতে পারি এরপরেও যানজট কমবে?
অনেকেই রাজধানী ঢাকার উপর চাপ কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। বলছেন এয়ারপোর্ট, বাণিজ্যিক এলাকা, সচিবালয় এলাকা, আবাসিক এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোনো না কোনোভাবে ভাগ করা হোক। স্কুলবাস নামানো হোক। ঢাকা থেকে সব কলকারখানা, গার্মেন্টস শহরের বাইরে নেয়া হোক।
এর কোনোটাই হয়নি এখনও। যে কারণে যখন বেতন ভাতার দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মাঠে নামেন, তখন শহরের কেন্দ্রস্থল বা মূল সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে করে মানুষের অবর্ণণীয় দুর্ভোগ একশ শতাংশ বেড়ে যায়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), নগর পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৬: ‘ট্রাফিক কনজেশসন ইন ঢাকা সিটি গভর্ন্যান্স পার্সপেক্টিভ’ প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা বিগত ৩৫ বছরে ৫ গুণ বেড়েছে।
সেই প্রতিবেদনেই বলেছে নগরীতে যানবাহনের চাহিদার তুলনায় জোগান খুব কম। একটি শহরে সুষ্ঠুভাবে জনগণের চলাচলের জন্য নগরীর আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট থাকা দরকার, আমাদের আছে মাত্র ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) এর তথ্য অনুযায়ী, নগরীর রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারশ নতুন গাড়ি নামছে। গণপরিবহনের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। সকাল এবং অফিস ছুটির সময় বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যে লম্বা লাইন থাকে যাত্রীদের, সেটা দেখলেই বোঝা যায় গণপরিবহন কত কম। লক্কর-ঝক্কর মার্কা সেসব বাসই হয়ে পড়ে দুর্লভ। রিকশা, অটোরিকশা, উবার, উবার মটো বেশি ব্যয়বহুল।
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।
তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। শহরের পরিবহনব্যবস্থাও একেবারে ভেঙে পড়েছে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী? বাংলাদেশ কীভাবে এর উন্নয়ন প্রচেষ্টার পেছনে ব্যয়িত প্রতি টাকায় সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করতে পারবে, তা খুঁজে বের করাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য।
দেখা যাক, সেই গবেষণা থেকে কী সমাধান বেরিয়ে আসে আমাদের জন্য। তবে যতদিন পর্যন্ত একটা শ্রেণির দখলদারি মনোভাব যাবে না, যতদিন পর্যন্ত নীতিনির্ধারকরা যানজটকে উন্নয়ন মাপার মানদণ্ড বলে ভাববেন এবং উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলে মনে করবেন, ততদিন আসলে কিছুতেই কিছু হবে না।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
আরও পড়ুন:একদিকে সব হারানোর বেদনা, অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকি- এমন এক অমানিশার সময়ে তিনি ফিরেছিলেন বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। মৃত্যু তার পিছু সারাক্ষণ, তারপর অবিরাম পথচলা বাংলার পথে-প্রান্তরে। বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত এখনও বাঙালির ভাগ্যবিধাতা তিনি। আজ বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছেন, যেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি শেখ হাসিনা। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আজ তার ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তারা প্রাণে বেঁচে যান।
সময়টা ১৯৮১ সালের ১৭ মে। সেদিন রাজপথে নেমেছিল জনতার ঢল। সবার চোখের দৃষ্টি কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। পথের দুই ধারে লাখো মানুষের মিছিল। রাস্তায় ট্রাক, গাড়ির সারিবদ্ধ শোভাযাত্রা। উপলক্ষ, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন পর ঢাকায় আসছেন। দিনমজুর এক রিকশাচালকের উক্তি ছিল এমন- দেইখ্যা আসেন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট, শেখের বেটির লাগি কাতারে কাতারে মানুষ জমছে সকাল থাইক্যা। শেখ মুজিবুর যেই দিন ফিরছিল যুদ্ধের পর, এমুন মানুষ সেই দিনও হয় নাই। (সূত্র: সচিত্র সন্ধানী)
সচিত্র সন্ধানীর ভাষায়: বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষমাণ জনতার কোঁচড়ে মুড়ি-চিড়ার স্পষ্ট আভাস দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকে যাত্রা করে এঁরা এসেছেন। অসুস্থ, রুগণ, কিশোর-যুবক বাদ যাননি। সবার চোখ রানওয়ের দিকে। আসমানের অবস্থা দুইদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছে। কী জানি কেমন যাবে আজকের দিন। কালো মেঘ জমছে। বিমানবন্দর ছেয়ে গেছে গাড়ি আর মানুষে। ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকার গেট, গেটের ওপর ছাদ, লোকে লোকারণ্য। মানুষের চিৎকার, কথা, ঠেলাধাক্কা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে শেখ হাসিনার আগমনবার্তা।
কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর, জনস্রোতে মিশে প্রায় তিন ঘণ্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরে পৌঁছালেন। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি জনতার ভালোবাসার কাতারে। শেরেবাংলা নগরে অপেক্ষায় লাখ লাখ মানুষ।
বিমানবন্দর থেকে সোজা মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণসংবর্ধনা মঞ্চে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন- “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদেরকে ফিরে পেতে চাই।”
গণসংবর্ধনায় ভাষণদানকালে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।” আনন্দঘন ও হৃদয়বিদারক সমাবেশে কর্মীরা মুহুর্মুহু নানা স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিল: ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ হাসিনা, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘ঝড়বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’।
শেখ হাসিনা সেদিন বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কর্মীদের চোখেও ছিল অশ্রুধারা। তখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জন্য সময়টা অনুকূলে ছিল না। পঁচাত্তরে খুনিরা তখনও তৎপর সব জায়গায়। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার পথ ধরে জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলেন বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সেদিন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী, বিশৃঙ্খল ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। শেখ হাসিনা সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অসম্প্রদায়িক চেতনায় অভিসিক্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শেখ হাসিনা স্বামী ওয়াজেদ মিয়া, বোন শেখ রেহানা, শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শিশুকন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনসহ দিল্লি পৌঁছান। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা একরকম অন্ধকারে ছিলেন। দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ পান। সেখানেই শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা জানতে পারেন। এরপর ভারতেই নির্বাসিত সময় কাটে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজখবর নিতে। এরপর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন কয়েক দফায় দিল্লিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা খবর পান, ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান। আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান।
শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করে তারা। ১৬ মে শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকালে তারা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী।
বাস্তবতা ছিল এমন- শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে যে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন একাশিতে এসে সেই বাংলাদেশ আর ফিরে পাননি। তিনি যে দেশে ফিরে আসেন, সে দেশ তখন পূর্ব পাকিস্তানের ধারায়। যেন সব হারানোর দেশ।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪১ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটি ছুঁয়ে যে কথা তিনি দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। একইভাবে সেদিন ঢাকা শহরে লাখ লাখ কর্মী যে শপথ নিয়েছিল- দেশের সব পরিস্থিতিতেই তাদের মায়ের মতো, বোনের মতো নেত্রীকে আগলে রাখবেন, সেটিই তারা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে বার বার সংকটাপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধীদের অপরাধের বিচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-এসবের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার চারবার দেশ পরিচালনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেল। স্যাটেলাইট-১-এর উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আকাশ বিজয় করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আকাশ-সমুদ্র-সীমান্ত বিজয় পূর্ণ হয়েছে। সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। রিজার্ভ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধাপে ধাপে পূরণ হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প ২০২১-এর সব কর্মসূচি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা, খাদ্য-বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে জাজ্বল্যমান পরিবর্তন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ যোগাযোগব্যবস্থায় দৃশ্যমান হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারার জন্য অর্জন করছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্ব যখন পর্যুদস্ত, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উত্তীর্ণ।
লেখক: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরঘাতকরা ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এ সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতকগোষ্ঠী। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমনই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতির পিতার কন্যার হাতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী। খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে না দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রিয় স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। দেশে ফিরে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরে বাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।
আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’
ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নীরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তখন এদেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বাস্তবায়ন করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম এবং অক্ষয় ভালোবাসাই হলো তার রাজনৈতিক শক্তি।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা-সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নেও শেখ হাসিনা জনগণের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিঃস্বার্থভাবে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জাতির অভিভাবক হিসেবে ৩১-দফা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
জনগণের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। করোনা সংকটের সময় কেউ যেন না খেয়ে থাকে সেজন্য ব্যাপক খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন। ৫০ লাখ পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশে পরপর ৩ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং ৪ বার প্রধানমন্ত্রী থাকার নজির আর কারো নেই। গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশে নিকষ অন্ধকার ছিল জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়।
পিতৃহত্যার প্রতিশোধের আগুন বুকে চেপে নির্বাসিত ফেরারি জীবনে স্বজন হারানো দুই বোনের ঠিকানা ছিল বিদেশের মাটি; দেশান্তরে উদভ্রান্ত যাত্রায় ৬টি বছর কেটে গেছে তাদের। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দলের সিদ্ধান্তে এক বজ্রকঠিন ব্রত নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন।
৪০ বছর আগে উদারনৈতিক প্রগতিশীলতার রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে, দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়ার জন্য, শেখ হাসিনা ত্যাগ করেছিলেন সন্তানদের মায়া পর্যন্ত! মাতৃসঙ্গ বঞ্চিত তার দুই সন্তান তখন বিদেশে ছোট বোন রেহানার কাছে। গণতন্ত্র আর সুবিচার নিশ্চিত করার যুদ্ধে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিকূল রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন। বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংকল্পে শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরার দিনটি ইতিহাসের এক বড় সূচনাক্ষণ নতুন অধ্যায়ের। পরতে পরতে সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুকন্যার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা ফেরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের হাতে।
দলীয় প্রধান হিসেবে ইতিহাস তার কাঁধে সমর্পণ করেছিল জাতির কাণ্ডারি হওয়ার দায়ভার। সেই থেকে দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই জাতিকে মুক্তি দিতে বিরতিহীন যাত্রা একজন শেখ হাসিনার। দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে সবার বাসোপযোগী করা প্রগতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের সেই যাত্রা রাজনৈতিক-পারিপার্শ্বিক আর প্রাকৃতিক শত প্রতিকূলতাতেও হার মানাতে পারেনি দৃঢ়চেতা এই নেত্রীকে।
প্রত্যাবর্তনের চার দশকে ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে বরাবরই দেখা গেছে কল্যাণমুখী মানসিকতায় যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে সব সামলে নেয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের জন্য সুকৌশলে তিনি যুদ্ধ করে চলেছেন প্রাকৃতিক আর মনুষ্যসৃষ্ট সব বাধা-বিপত্তির বিপরীতে। পিতৃহারা শেখ হাসিনা যখন ঢাকায় ফিরেছিলেন সে সময়টাতেও প্রকৃতি ছিল এক রুদ্র মূর্তির বাতাবরণে। কালবৈশাখীর ঝড় সামলে চলার শুরু হয়তো সেই থেকেই। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও মুখোমুখি এক অদৃশ্য ঝড়ের। নানান সূচকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে উঠতে, ঠিক তখনই বৈশ্বিক মহামারির বাধা এসে হাজির। সংক্রমণপ্রবণ এক জীবাণুর (করোনাভাইরাস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখনও পুরো জাতি। এর মধ্যেও থেমে নেই এর করাল গ্রাস থেকে উত্তরণের চেষ্টা; যার নেতৃত্বও দিচ্ছেন সেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন দেশে ক্রমে বেড়েই চলেছে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। ঠিক এর শুরু থেকেই এ যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। সংক্রমণ রোধে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে আসবে জেনেও, দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে নিরাপদ করার প্রয়াসে নির্দেশ দেন ‘ঘরে থাকার’। অর্থনীতি থেকে শুরু করে পরিবর্তিত সামাজিক বাস্তবতায় সবকিছু থমকে দেয়ার বৈশ্বিক এই দুর্যোগেও বিরতিহীন যিনি শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অচেনা এই দুর্যোগের ধাক্কা সামাল দিতে সমাজের সব শ্রেণির জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রতিনিয়তই ‘কিছু না কিছু’ বন্দোবস্তু করে চলেছেন তিনি। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে যার নেতৃত্বে, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই আজ অসহায় মানুষের ত্রাতা। তিনিই দিক-নির্দেশক, অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রযাত্রায় বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ভয়কে জয় করে সেদিন তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ এই করোনা-সংকটেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রনায়ক তিনি। তাকে ঘিরেই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন প্রিয় নেত্রী।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরিচালক, এফবিসিসিআই
আরও পড়ুন:কয়েক দিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বেশ উল্লাস প্রকাশ করছেন। তারা শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন কিছু রাজনীতিকের মতো আওয়ামী লীগের নেতাদেরও গণরোষে পড়তে হবে মর্মে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
বিএনপি নেতাদের গত কয়েক দিনের এসব মন্তব্য শুনে একজন গবেষক হিসেবে এ দেশের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল। এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করছি, কাকে আপনারা গণ-অভ্যুত্থান আর গণরোষের ভয় দেখান? আপনারা কি ভুলে গেছেন দেশের সব গণ-অভ্যুত্থান ও গণবিস্ফোরণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছিল আর আপনারাই বারবার গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গণরোষের কবলে পড়েছিলেন?
আপনারা একবার আফগানিস্তানের উদাহরণ দেন, আরেকবার পাকিস্তানের উদাহরণ দেন। আবার বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে। যখন সবাই অঙ্ক করে দেখাল, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না, তখন আবার আপনারা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন নেতাদের মতো গণরোষের শিকার হবেন।
এবার আপনাদের জন্য ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলো উপস্থাপন করি:
১. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুবের পতন হয়েছিল। বর্তমান বিএনপির আগের জেনারেশনের ক্ষমতাসীন অনেকেই তখন পালিয়েছিল। মুসলিম লীগ জেনারেশনের পরবর্তী জেনারেশন এবং তাদের সুবিধাভোগীদের নিয়েই সামরিক শাসক জিয়া বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিএনপির পূর্বসূরীরাই ঊনসত্তরে গণরোষের শিকার হয়েছিলেন।
২. ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অনেকেই গণরোষের শিকার হয়েছিলেন। ওই স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রায় সকলেই পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেন। আর জাতির পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই এ দেশের স্বাধীনতা এনেছিল। বিএনপির পূর্বসূরীরা ১৯৭১ সালেও গণরোষের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
৩. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে সামরিক শাসক এরশাদের পতন হয়েছিল। মওদুদ-শাহ মোয়াজ্জেমসহ বিএনপির অনেক নেতাই তখন স্বৈরশাসকের দোসর হিসেবে গণরোষে পড়েছিলেন।
৪. অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, চট্টগ্রামে নিহত না হলে সামরিক শাসক এরশাদের মতো জেনারেল জিয়ার পরিণতিও একই হতো। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল সামরিক শাসকের মতো গণ-অভ্যুত্থানেই অবৈধ জিয়া সরকারের পতন হতো।
৫. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে গণ-আন্দোলনে মাত্র এক মাসে খালেদা সরকারের পতন হয়েছিল। বিএনপির অনেক নেতা রাতের অন্ধকারে মন্ত্রিপাড়া থেকে পালিয়েছিলেন। গণরোষ থেকে বাঁচার জন্য অনেকে দেশ ছেড়েছিলেন। বিএনপির অনেক নেতাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেদিন মানবিক কারণে জনরোষ থেকে রক্ষা করেছিলেন। আবার কেউ কেউ গণরোষ থেকে রক্ষা পাননি।
৬. সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসন আর ভোটচুরির নানা ষড়যন্ত্রের কারণে ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতিবাজ নেতাদের জনগণ লগি-বৈঠা নিয়ে ধাওয়া করেছিল। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই পালিয়েছিলেন। অনেককেই সেদিন জনগণ পিটিয়েছিল।
৭. বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো গণ-অভ্যুত্থান কিংবা গণ-অসন্তোষ হয়নি। দেশের ইতিহাসে একমাত্র আওয়ামী লীগই সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ২০০১ সালে। আর রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশবিরোধী দুষ্কৃতকারীরা সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা নিয়েছিল। এতে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। জাতির পিতার হত্যার পর খুনি মোশতাক-জিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণপ্রতিরোধ ও গণবিক্ষোভ মোকাবিলার জন্যই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে সামরিক আইন জারি করা হয়। জরুরি অবস্থা জারি থাকা অবস্থায় খুনিরা সামরিক আইন জারি করেছিল নিজেদের সম্ভাব্য গণপ্রতিরোধ থেকে রক্ষার জন্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিএনপি-জামায়াতের নেতারাই বারবার শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর দেশের সব গণ-অভ্যুত্থান ও গণবিস্ফোরণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল। বিএনপির নেতারাই বারবার গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গণরোষের কবলে পড়েছিলেন। আপনাদের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যের কারণে সেই ছবিগুলো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। আপনাদের চোখে-মুখে তার পরও লজ্জার রেশ দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আপনাদের জন্য প্যান্ডোরার বাক্স।
ড۔ সেলিম মাহমুদ: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
আরও পড়ুন:১৪২৯ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী। তার জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দে। খ্রিস্টাব্দ ১৮৬১ সালের ৭ মে। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু বিষয়ে সামান্য আলোচনা এখানে উপস্থাপন করা হলো।
কবির জন্মের প্রায় ৫৬ বছর পর রাশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত রুশ বিপ্লব ছিল এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। দেশে দেশে এই বিপ্লবের অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ারও চার বছর পর রুশ বিপ্লব হয়। বিপ্লবের ১৩ বছর পর ১৯৩০ সালে রাশিয়া সফরে গিয়ে সে দেশে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটছে তা দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন কবি। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।
চিরকালই মানুষের সভ্যতায় এক দল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তাঁরাই বাহন; তাঁদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব-চেয়ে কম খেয়ে কম পরে কম শিখে কি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা উপোস করে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে— জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ সুবিধে, সবকিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে— উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে। …. উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না;–কেবলমাত্র জীবিকানির্বাহ করার জন্যে তো মনুষ্যত্ব নয়।
একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা। সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে। তাই ভাবতুম, যেসব মানুষ শুধু অবস্থার গতিকে নয়, শরীর-মনের গতিকে নিচের তলায় কাজ করতে বাধ্য এবং সেই কাজেরই যোগ্য, যথাসম্ভব তাতে শিক্ষাস্বাস্থ্য-সুখসুবিধার জন্যে চেষ্টা করা উচিত।
মুশকিল এই, দয়া করে কোন স্থায়ী জিনিস করা চলে না; বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে। সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয়। যাই হোক, আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাইনি— অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে তবেই সভ্যতা সমুচ্চ থাকবে এ-কথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে।
প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে-মানুষরে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে-মানুষকে মানুষ উপকার করাতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্ট চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনও বিচার করবার সময় হয়নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার সব-চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা।
এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত—ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়— মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে— সায়ন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের।”
সমাজতন্ত্র যে জাদুর কাঠি হাতে মানুষের যুগ-যুগের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাতে শুরু করেছিল, তা প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথের মানবিক মন স্বাভাবিকভাবেই আর্দ্র হয়েছিল। কিন্তু তার ছিল দেখার চোখ। তিনি তখনই আশঙ্কাও ব্যক্ত করে লিখেছেন: “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই, তা বলি নে—গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে শিক্ষা-বিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে— কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না—সজীব মনের তত্ত্বর সঙ্গে বিস্তার তত্ত্ব যদি না মেলে তাহলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।”
সত্যদ্রষ্টা কবির ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভুল হয়েছে। ছাঁচে ঢেলে যে সমতা প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। মনুষ্যত্ব টিকিয়ে মনের সজীবতা বজায় রেখে জীবনঘনিষ্ঠ কোনো তত্ত্ব আবারও নতুন দুনিয়া সৃজনে সম্ভব হয়ে উঠবে কি না, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো মনীষী আজ কোথায়?
ভারতের কমিউনিস্টদের একাংশ একসময় রবীন্দ্রবিরোধিতায় মেতে ছিল। তাতে রবীন্দ্রনাথের ক্ষতি হয়নি কিছু। কিন্তু কালক্রমে কমিউনিস্টরা হীনবল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আছেন স্বকীর্তিতে, স্বমহিমায়।
দুই.
রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিক ছিলেন না, রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন কিন্তু রাজনীতিবিদদের থেকে নয়। তার সময়ে ভারতবর্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রে যাঁরা আলো ছড়িয়েছেন, তাদের সঙ্গে কবির সখ্য ছিল, যোগাযোগ ছিল। কারো কারো প্রতি তার সমর্থন, আশীর্বাদও ছিল। তবে তিনি সব কিছু নিজের মতো করেই ভাবতেন, করতেন। গান্ধীজির প্রতিটি আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত ছিল। অনশন থেকে আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ের সূচনায় গান্ধী তার শুভেচ্ছা চেয়েছেন। তিনিও তা জানিয়েছেন নির্দ্বিধায়।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৮ বছরের ছোট। কিন্তু তাদের পরস্পরের ছিল আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্ক। তবে মতভেদ, মতবিরোধও হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পর্কে ফাটল তৈরি করেনি। গান্ধীর রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সংশয়মুক্ত ছিলেন না। গান্ধীর চরকা আন্দোলন নিয়ে কবির উচ্ছ্বাস ছিল না। তিনি চরকাকে কখনও যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে স্বীকার করেননি। যন্ত্রকে তিনি বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বলেই মনে করতেন। একই সঙ্গে যন্ত্র যেখানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেখানে তিনি সরাসরি যন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন ‘মুক্তধারা’য় বিশ্বাসী। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে কুটিরশিল্প প্রবর্তনসহ বহু পন্থা নির্দেশ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, শক্তিলাভ। কেননা শক্তিলাভ ছাড়া কোনো জাতি কিছু করে উঠতে পারে না।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেক প্রাণপুরুষ জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও কবির শুধু আত্মিক নয়, ব্যক্তিপর্যায়েও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত গান্ধীর চেয়ে নেহরু পরিবারের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল বেশি। নেহরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধী কবির সান্নিধ্য পেয়েছেন, ইন্দিরার নামের আগে ‘প্রিয়দর্শিনী’ জুড়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। শান্তিনিকেতনে কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ইন্দিরা। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবির সমর্থন ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি। সুভাষ ছিলেন কবির পুত্রতুল্য। সুভাষের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। কবির ৩৬ বছর পরে।
গত শতকের তিরিশের দশক থেকে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশকে যত লক্ষ করেছেন ততই চমৎকৃত হয়েছেন। সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক প্রত্যুষ তার কাছে হয়ত আকর্ষণীয় ছিল না কিন্তু মধ্যাহ্নকালের সুভাষচন্দ্রের তেজোদৃপ্ত সৌরকিরণ যে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল, সে কথা স্বীকার করতে তিনি এতটুকু কুণ্ঠিত হননি। তার অপ্রকাশিত ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত তাতে সংশয়ের আবিলতা আর নেই, মধ্য দিনে তোমার পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করেছে তোমার জীবন, কর্তব্যক্ষেত্রে যে পরিণত তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ।
রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের মধ্যে ‘প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ’ দেখেছেন, শুনেছেন দেশের জন্য একের পর এক অসমসাহসিকতার কাহিনি। তার আহ্বানে বৃদ্ধ বয়সে, অশক্ত শরীরে প্রকাশ্য জনসভায় সাড়া না দিয়ে পারেননি।
সুভাষচন্দ্রের ওপর পুলিশের লাঠির আঘাত, তাকে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন কবি। কারাগারে অসুস্থ সুভাষকে প্রেরণা ও উৎসাহ দেয়ার জন্য ‘সঞ্চয়িতা’ পাঠিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, শুধু গান্ধীজি, জওহরলাল নয়, বিশ্বভারতীকে সচল, সজীব রাখতে হলে সুভাষেরও সাহায্য প্রয়োজন।
সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি বিতর্কে তিনি সুভাষের হয়ে গান্ধীজিকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সুভাষ কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই পদক্ষেপ তাকে ‘দেশনায়ক’ করে দিল। তিনি লিখেছেন: “দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিঘ্নকে করেছ সোপান।”
অনিবার্য কারণ ও শারীরিক দুর্বলতার জন্য সুভাষ বসুকে সংবর্ধনা দিতে না পেরে নিজের লেখা ‘তাসের দেশ’ উৎসর্গ করে কবি লিখেছেন: “স্বদেশের চিত্তে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্য ব্রত তুমি গ্রহণ করেছ।”
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম প্রতীক। এক অর্থে তিনি আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের যে ধারাবাহিক সংগ্রাম, তাতে রবীন্দ্রনাথ প্রেরণাদাতা হিসেবে পরোক্ষে কাজ করেছেন। তার লেখা গান-কবিতা বঙ্গবন্ধুকে সাহস ও প্রত্যয় জুগিয়েছে। তার দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। রবীন্দ্রনাথের লেখা “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” এটা যে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত সেটা তো কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। প্রথমে বিশ্বসভায় বাঙালি পরিচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। তারপর বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বাঙালির নতুন স্বতন্ত্র পরিচয়। তাই সরাসরি রাজনীতির মানুষ না হয়েও রবীন্দ্রনাথ আছেন রাজনীতিতেও।
‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা নির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তার আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।”
তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করি তারই বাণী দিয়ে: “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।”
বাঙালির দুঃখজয়ের সংগ্রামের সঙ্গী হয়ে রবীন্দ্রনাথ আছেন এবং থাকবেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আরও পড়ুন:রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার দুটো কথা আছে। একটা কৃতজ্ঞতার আরেকটা আপত্তির। তার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা।
এক.
কিছুদিন আগে যক্ষ্মায় মারা গেছেন বড় মেয়ে মাধুরীলতা। এই সময়ে কিশোরী রানু তাকে লিখে বসল- ‘আপনাকে দেখতে আমার খু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-ব ইচ্ছে করে।’
সন্তানশোকে বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ স্নেহে-প্রেমে আঁকড়ে ধরলেন রাণুকে। তাদের সেই বিধি-ভাঙা অন্যরকম সম্পর্ক এগিয়ে চলল তথাকথিত সামাজিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৫৮, রানুর ১৪।
আর এদের এই অসমবয়সী প্রেমকাহিনি যখন পড়ি তখন আমার ১৮ বছর। বাঙালির ঔচিত্যবোধের মান তৈরি করা নোবেলজয়ী বিশাল এই ব্যক্তিত্বের এমন ‘পদস্খলন’ আমাকে সেই বয়সে বিরক্ত করেছিল। ভেবেছিলাম, ‘মেয়েটি না হয় আবেগী, অবুঝ, কিন্তু আপনি তো বুঝতেন, কেন সাড়া দিলেন? কেন আপনার বিরুদ্ধে প্ররোচনার দায় আনা যাবে না? রণে-প্রণয়ে সব চলে এই যুক্তি কি আপনার বেলায়ও মানতে হবে?’
এখন আমার বয়স ৫৫। এখন আর আমি রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করি না। এখন আমি জানি, ‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়।’
দুই.
আমাদের ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তার পরেও বাসার দেয়ালে ছিল রবীন্দ্রনাথের একটা পেইন্টিং। হাতে আঁকা, দাড়িওয়ালা। তার কোনো লেখা পড়ার আগেই তাকে দেখেছিলাম। ভাসা ভাসা ধারণা ছিল, তিনি কবি।
আব্বার বদলির চাকরিতে প্রতিবছর অনেক জিনিস ফেলে নতুন জায়গায় যেতে হতো। রবীন্দ্রনাথও যেতেন আমাদের সঙ্গে। নতুন বাসার দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার আর পুরোনো রবীন্দ্রনাথ ঝুলত।
তিন.
ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে মাত্র তিনটা কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তাতেই আমার যা হওয়ার তা হতে পারত।
প্রথমটা ‘দুর্লভ জন্ম’।
ক্লাস টেনে প্রথম পড়ি। তারপর যতবার পড়ি, মন্দ্র মন্ত্রের মতো আমাকে শান্ত আর বিনয়ী করে তোলে। পড়ার পর, কাচ পোকা থেকে তিমি, তৃণ থেকে মহিরুহ, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, তুচ্ছ থেকে মহৎ, সব মহার্ঘ্য বলে মনে হতে থাকে। এই যে ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে মিলে আছি, এই যে চোখের সামনে আস্ত জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সব যেন বার বার নতুন করে দেখতে পাই।
এমনকি যাকে ভালোবাসি, তার দেয়া বিরহ-বেদনাও দিনান্তে মধুর লাগে। প্রেমিকার মুখ মনে করে বলি- ‘‘একদিন তো থাকব না, একদিন তো এই ‘দেখা হয়ে যাবে শেষ’, তখন কার বুকে জ্বালবে তুমি ‘সকল দুখের প্রদীপ?’”
মৃত্যুর কথা পঁচিশেও জানতাম, কিন্তু তখন মানতাম না। পঞ্চান্নতে এসে এখন মানি যে, সত্যিই একদিন মরে যাব এবং সেদিন বেশি দূরেও নয়।
তাই কোনো কিছুই আর গ্র্যান্টেড হিসাবে নিই না। পরিবার-বন্ধু, প্রাণ-প্রকৃতি এমনকি এই যে নিঃশ্বাসটা নিলাম, এই যে এক গ্লাস পানি খেলাম এটাও, উপভোগ করি। তুচ্ছ বলে এতদিন যা চাইনি, ফুরিয়ে যাওয়ার আগে দুহাত ভরে সেসব কুড়িয়ে নিই। ভালোবাসা না পেলেও ভালোবাসি।
চার.
দ্বিতীয়টা ‘কৃপণ’।
কবে পড়েছি মনে নেই। কিন্তু এই বিদ্যা অর্জন করেছি যে, যদি ভালো কাউকে বাসতেই পারি, তাকে যেন অদেয় কিছু না থাকে। কারণ যা দেব তা সোনার কণা হয়ে ফেরত পাব। দিতে পারতাম কিন্তু দিইনি, এই ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা’ দিন শেষে নিজেরই খর্বত্ব হয়ে যেন না দাঁড়ায়। অতএব প্রেমে ও কর্তব্যে, নিজেকে শূন্য করে উজাড় করে দেব, তবেই তা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসে ভরিয়ে তুলবে আমাকে।
পাঁচ.
তৃতীয়টা ‘আবেদন’।
এই কবিতা পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আর পূজার গান এক হয়ে যায় আমার কাছে। প্রেম তো এমনই, কখনও পূজা, কখনও ভিক্ষা, কখনও আহ্লাদ, আর সবটা জুড়ে মায়া। যে ‘কর্ম কেহ চাহে নাই’ সেটাই প্রেমিকের কাজ! এই যে বিত্তবৈভব ব্যস্ততা, এর বাইরে যে স্নানঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ানো একাকীত্ব, প্রেমিক তো সেখানেই সঙ্গে মিশে থাকে।
নিবেদনে, আরাধনায়, সম্মানে সে প্রেমিকাকে মাথায় তুলে রাখবে। সে হবে ভৃত্য আর প্রেমিকা হবেন মহারানি। অথচ এই ভৃত্যই পাবেন সেই অধিকার যা জগতের আর কেউ পেতে পারে না। না হয় নাই হলো তার রাজকার্য, নাই থাকল রাজপোশাক, কিন্তু তার প্রেম পুবে-পশ্চিমে অন্তরীক্ষে নিত্য উপস্থিত থাকবে অপরিবর্তনের অর্ঘ্য হয়ে।
প্রতি প্রত্যুষে রানি আসবেন বাগানে। মালাকর ভৃত্য তখন হয়ে উঠবেন নিভৃতের রাজা। মহারানির ‘পদ্মের কলিকাসম ক্ষুদ্র মুষ্টিখানি’ নিজের হাতে ধরে ফুলের চুড়ি পরিয়ে দেবেন। আর সন্ধ্যায়, কর্মক্লান্ত রানি আবার যখন আসবেন। ভৃত্য মহারানির হৃদয়-বাগানের রাজা অশোক ফুলের রাঙা রং দিয়ে আলতা পরিয়ে দেবেন রানির পায়ে। আর, ‘দুটি অতুল পদতলে’ ফুলের রেণু যেটুকু লেগে থাকবে, ‘চুম্বনে মুছিয়া’ দেবে। আহা! এই প্রশ্রয়, এই অধিকার, এক জীবনে না পেলে সে আবার কীসের জীবন?
ছয়.
এবার আপত্তির কথাটা বলি।
‘কিছুই তো হলো না’ এই একটা গান রবীন্দ্রনাথের একবারেই লেখা উচিত হয়নি। এ গান শুনলে আমার বুক ভেঙে কান্না আসে। এক নিরন্তর হাহাকার জেগে ওঠে। কী ভীষণ আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে সব!
অথচ যাপিত জীবনের উদযাপিত কিছু অপূর্ব মুহূর্ত আর স্মৃতির সোনার ধান ছাড়া তো আর কিছুই নেই আমাদের!
লেখক: জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার
আরও পড়ুন:জন্মে যে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, আজীবন তা বহতা নদীর মতোই প্রবহমান ছিল। নশ্বর এ পৃথিবীতে অমৃত সুধা পান করে আজও তিনি অবিনশ্বর, আপন সৃষ্টিতে। সৃজনের নন্দন কাননকে রাঙা আলোয় আলোকিত করেছেন নিজের কর্ম দিয়ে। তার সৃষ্টিকর্মের পরতে পরতে যেমন উৎসারিত হয়েছে যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না; তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়েরও অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আমরা প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাই ভালোবাসা ও প্রেমের এক অবিমিশ্র উপাদান।
কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকর্ম, সংগীত প্রতিটি বিষয় দিয়েই তিনি সুনিপুণভাবে জীবনের মালা গেঁথেছেন, মানব হৃদয়কে ভালোবাসায় আর্দ্র করেছেন। হৃদয়ের গহীন গোপন কোঠরে সংবেদনশীলতার নিদারুণ এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন, যা ভাবপ্রবণ প্রতিটি বাঙালিকে পরাবাস্তব জগতের সঙ্গে অনুপম সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।
এমন সৃষ্টিশীল মানুষ আর দেখেনি বাংলা সাহিত্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যবাদের মধ্যেও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে।
১৬১ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখের এমনই এক রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাখানো মন্দমধুর দিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদা দেবীর ঘরে প্রভাতের সূর্যের মতোই আলো ছড়াতে এলেন আলোকজ্জ্বল এক রবি, যিনি একক আলোয় উদ্ভাসিত করে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে।
দেবেন্দ্র ঠাকুর ছিলেন রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক, সমাজ সংস্কারক। সেই সনাতন সময়েই জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ি ছিল সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র। চার বছর বয়স থেকেই রবির বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়, শৈশবেই উৎসারিত হতে থাকে তার মেধা ও বুদ্ধির বিচ্ছুরণ।
ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি ছিল তার মুগ্ধতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লাইনটি বাল্যকালেই তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। বয়স যখন সাত/আট তখন থেকেই তার কবিতা লেখা শুরু, ১৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই বনফুল; কলম থামেনি আর বাকি জীবনে। প্রায় আড়াই হাজার গানসহ দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করেন।
তৎকালীন হিন্দুসমাজের উঁচু-নিচু, কৌলিন্য, জাতিভেদপ্রথা তাকে ব্যথিত করত, এর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই জাতপাতের অহংবোধের নাভিমূলে প্রচণ্ডভাবে টান দিয়ে সৃষ্টি করলেন বিখ্যাত উপন্যাস গোরা।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা এখনও সাহিত্যে কোনো বাঙালির প্রথম অর্জন। আবার দেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতির পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করেন।
সামাজিক অচলায়তন ভাঙার কারিগররূপে সাহিত্যপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালির অন্তরাত্মায় বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তর। তার দর্শন আর জীবনবোধের উপলব্ধি বাঙালির রোজকার জীবনে অহর্নিশ জোগায় সীমাহীন প্রেরণা।
“অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ,
তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।”
রবীন্দ্রচর্চাই পারে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। তিনি চলে গেছেন কিন্তু উজাড় করে দিয়ে গেছেন তার অমূল্য সৃষ্টির সব কিছু যার চর্চাই কেবল মানব মন কলুষযুক্ত হতে পারে। তাই রবীন্দ্রসৃষ্টি ধারণ করে মানুষ আলোকিত হোক, অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হোক, হৃদয় সিক্ত হোক, তৃষ্ণায় ফেটে যাওয়া বুকের ছাতি মায়া-মমতা-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হোক, বিকশিত হোক চিত্ত। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
আসলে কবিগুরুর জন্মদিন বলে আলাদা কোনো দিন নেই। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ রবীন্দ্রপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে আসন পেতে বসে আছেন তিনি। জীবনে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেতে তার বিকল্প আর কে হতে পারে। তার সৃষ্টিকর্মই জীবনের চালিকাশক্তি। সুখ দুঃখের প্রতিটি মুহূর্তই তার গান, কবিতা প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে অন্তরকে; ব্যথিত করে, আলোকিত করে, স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়। কখনও আনন্দাশ্রু বয়ে যায় দু’চোখ বেয়ে, কখনওবা দুঃখের জল। নিমিষেই হালকা হয়ে আসে ভেতরটা।
“আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো-
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো–
ডুবিয়া নিবিড় গভীর শোভাতে”।
ভাবি, বাঙালি হয়ে জন্ম না হলে জীবনের এই বোধ থেকেই তো বঞ্চিত হতাম।
আজকের এই শত নৈরাশ্যের প্রাত্যহিক জীবনে একখণ্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে সাহস জোগান । তার বিশাল ভাণ্ডার থেকে যদি এক বিন্দুও ধারণ করা যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই জীবনের বোধ বদলে যাবে। তার সৃষ্টির বৈচিত্র্য আর প্রাচুর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির মূল পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব। তাই এই বোধহীন সমাজকে বিবেকবান করতে হলে তার লেখাকে পৌঁছে দিতে হবে সর্বসাধারণের কাছে, যা তিনি নিজেই সহজবোধ্য করে গিয়েছেন। সংস্কৃতঘেঁষা দুর্বোধ্য বাংলা, তার হাতেই সহজপাঠ্য, সুখপাঠ্য হিসেবে সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে; যা দেড়শ বছর পরেও ঠিক একই রকম হাসায়, কাঁদায়, অনুভূতি জোগায়।
মহাকালের এই দিনটিতে ধরার বুকে পদচিহ্ন এঁকেছিলেন তিনি। “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম;
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম।”
তুমি নীরবে নও, ১৬১ বছর পরেও তুমি আছ হৃদয়ে, খুব সাড়ম্বরে।
প্রাণ আকুল করা এই মহামানবের জন্মদিনে হৃদয়ের গভীর থেকে প্রণতি।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণ, জন্মতিথি অথবা প্রয়াণ দিবস-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি প্রণতি জানানোর সবচেয়ে বড় পন্থা বোধ করি তাকে পঠন-পাঠন। আমাদের এক জীবনের যত চাওয়া-যত না পাওয়া, যত আক্ষেপ, যত আনন্দ-যত বেদনা, যত সংকট-যত সংগ্রাম, যত প্রেম-যত ব্যাকুলতা- সবকিছু ঘিরেই আবর্তিত রবীন্দ্রসৃষ্টিসমুদ্র। এ সাগরে আবাহন মানে এক অপূর্ব, অমল আনন্দে জীবন কাটিয়ে দেয়া, এ অসীম জলে ডুব দিলে হাতে যে কত মণিমানিক্য উঠে আসে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এত বিপুল, এত ঐশ্বর্যময় তার সৃজনভুবন যে, ওখানে পরম আনন্দে কাটানো যায় দিনের পর দিন, নিজেকে চেনা যায়, নিজেকে গড়া যায়, নিজেকে ভাঙা যায়।
এ কথা বলা যায় হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সবই বৃথা। তার দর্শনের আলোয় চিত্ত না জুড়ালে এত গান, এত কবিতা, এত শব্দ-সব কিছুই করুণ লাগে। রবীন্দ্রভাবনার জ্যোতি আমাদের মানস সরোবরে যদি না ফোটাই কোনো ধ্রুপদী কুসুম তবে তো ব্যর্থ সব আয়োজন। বলি- ছবিতে নয়, মঞ্চে নয়, কথার ফুলঝুরিতেও নয়, নয় বহুরঙা আলোর ঝলকানিতে- রবি ঠাকুরকে ধারণ করতে হবে মনন ও মগজে। আমাদের কর্মে, চিন্তায় তার আর্দশ, শিক্ষা যদি প্রতিফলিত না-ই হয় তবে বাহ্যিক এসব আয়োজনে কোনো লাভ নেই।
ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যায় নীরবেও, রবীন্দ্রনাথ এমনই একজন যে, তাকে নদীর পাড়ে, বিজন বনে, নিশুতি রাতে, কোলাহলে- নির্জনে সবখানে পড়া যায়। বলা যায়- জীবনের এমন কোনো শাখা নেই, জীবনসংলগ্ন এমন কোনো গল্প নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্র অধ্যয়ন আসলে তো আমাদের নিত্য জীবন-অধ্যয়নই।
সাহিত্যের সবগুলো শাখায়ই তিনি চাষ করেছেন, ছড়িয়েছেন স্বপ্নের বীজ। জীবন-সংসারের প্রতিটি আখ্যান তিনি বিধৃত করেছেন তার নানা ধরনের সাহিত্যকর্মে। এই যে বিপুল কর্মপঞ্জিকা, তার কতটুকু অধ্যয়ন আছে আমাদের? এর পাশাপাশি, প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও তার কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে, লেখালেখি চলছে। প্রকৃতপক্ষে, তিনি এমনই এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন, এত সর্বব্যাপী তার চিন্তার প্রভাব যে, আজও তিনি আমাদের কাছে সেই প্রথম দিনগুলোর মতোই আগ্রহভরাতুর দৃষ্টির শামিয়ানায়।
কবিগুরুর সমগ্র রচনার মূলকথা একটাই- মানবের কল্যাণ, শান্তি। জগতের যা কিছু সুন্দর, কল্যাণকর, তিনি তারই গুণগান গেয়েছেন- কখনও হয়ত কবিতায়, কখনও গানে, আবার কখনও হয়তোবা কোনো গল্প, নাটক, গদ্যে।
১৯১৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা। সংঘাতের আশঙ্কায় বিদগ্ধ সমাজ, যদিও যুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ যার ইংরেজি অনুবাদ ছিল ‘Songs Offerings’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে একটি নির্মল শান্তির পৃথিবীর বার্তা ছড়িয়ে দিলেন সেটা বিশ্বজনীন হয়ে উঠল। সুইডিশ নোবেল বিজয়ী কবি ভারনার ভন হেইডেনস্টাম মন্তব্য করেছিলেন, “গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় যেন এক নির্মল স্বচ্ছ ঝরনাধারার জল পান করছি”। তিনি কবিতাগুলোকে “গভীর ও দুর্লভ আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের নিদর্শন” বলে উল্লেখ করেছিলেন। “গীতাঞ্জলি’র প্রভাব তখন এতটা লক্ষণীয় ছিল যে, যুদ্ধে নিহত তরুণ কবি উইলফ্রেন্ড আওয়েলের বুক পকেটে পাওয়া গিয়েছিল কবিগুরুর কটি পঙক্তি যেগুলোর বাংলা অনুবাদ ছিল- “যাবার বেলায় এই কথাটি বলে যেন যাই/ যা পেয়েছি, যা দেখেছি, তুলনা তার নাই”। এছাড়াও ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে ইয়েটস, এজরা পাউন্ড প্রমুখের স্তুতি বিশ্বদরবারে সবারই জানা। এরকম প্রায় প্রতিটি রচনাতেই কবিগুরু এক অপার্থিব, স্বচ্ছ, সরল আনন্দের সন্ধান করেছেন। জীবন ও প্রকৃতির সুধারস পান করেছেন অমৃত আনন্দের জন্য। বিশেষ করে তার মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, পূরবী, মহুয়া, বলাকা, শ্যামলী, চৈতালী, খেয়া ইত্যাদি গ্রন্থের কবিতাগুলো অমল আবেশে ছুঁয়ে যায় হৃদয়।
অন্যদিকে, তার ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসগুলো ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি আমাদের সমাজ ও সংসারের কত সংকট, কত বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে তা এগুলো না পড়লে উপলব্ধি করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ তার রচনা দিয়ে আমাদের যাপিতজীবনের যে নিখুঁত ছবি এঁকেছেন তা হৃদয়ঙ্গম করতে হলে শুধু পাতা উল্টিয়ে গেলেই হবে না। চোখের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ ঘটাতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। আমাদের চলমান জীবনের বাঁকে বাঁকে জমে থাকা কাহিনিগুলোকেই তিনি প্রাণ দিয়েছেন ছোট গল্পে। তার কালজয়ী হৈমন্তী, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, দেনা পাওনা, কাবুলিওয়ালা প্রভৃতি গল্পগুলো মানসলোকের একেবারে গভীরে নাড়া দেয়। আমরা যে জীবনকে দেখি সাদা চোখে, তার ভেতরের নানা কথা ফুটে উঠেছে এসব গল্পে। অন্যদিকে, তার উপন্যাসগুলো বিশেষ করে বো ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। এসবের বাইরে রবি ঠাকুরের গানের যে জগৎ তার তুলনা পাওয়া মুশকিল। সুর ও কথার যে ইন্দ্রজাল তিনি রচনা করে গেছেন, মানুষের চিত্তে তার আবেদন ফুরাবে না কোনোদিনও।
কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথকে অনুশীলন করতে হবে। আমরা যদি একটি আনন্দময় মানবিক জীবন কামনা করি, যদি চাই বিকশিত হোক আমাদের অনুভূতির কলিগুলো তাহলে রবীন্দ্রনাথপাঠ ছাড়া কোনো উপায় নেই। তার সৃষ্টির অমিয়ধারায় অবগাহন করতেই হবে। জীবনখাতার পাতাগুলোকে রঙিন করে তুলতে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যেতে হবে। প্রায়শই যখন আমাদের সংকট দেখা দেয়, তা সে সংকট ব্যক্তিগত হোক আর সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়- আমরা তখন বলি ‘সত্যিকারের মানুষ’ হতে হবে।
তা সে সত্যিকারের মানুষ বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই? অবশ্যই বিবেকবান, চিন্তাশীল, মানবিকবোধসম্পন্ন হৃদয়বান মানুষ। সেই ‘সত্যিকারের মানুষ’, সার্থক মানুষ হতে গেলে তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়তেই হবে। যে মাটির উপর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, যে বায়ু তার শরীর জুড়ায়, যে ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ তাকে পাহারা দেয়, যে জল তার তৃষ্ণা মিটায় অহর্নিশ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এসবেরই বন্দনা করেছেন। মানুষকে তাই নদী-জল-আকাশকে বুঝতে হলে রবিচর্চা করতে হবে।
যে প্রেম ছাড়া অপূর্ণ থাকে মানবসত্তা, রবীন্দ্রনাথ তো সে প্রেমেরই কবি। মোটকথা, একটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরম আশ্রয়। মানুষের জীবনকে বুঝতে হলে, মানবজীবনের ধারাপাত জানতে হলে রবীন্দ্রনাথকে অনুশীলনের বিকল্প নেই। সিলেবাসের বইগুলোর বাইরে যে বিশাল বইয়ের দুনিয়া আছে, তার ভেতর ডুব দিতে পারলে জীবন বহুগুণে অর্থময় হয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের রচনাসমগ্র, তার ভাবাদর্শ অনুশীলন ছাড়া হৃদয়ের উন্নতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত। সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানদের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
কবির কথা ধার করে নিয়ে বলি ‘‘বিদ্যুতকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাঁধিয়াছে কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে? কে জানিত সঙ্গীতকে হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মা আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে? কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে, অতলস্পর্শ কাল-সমুদ্রের উপর একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে?”
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আরও পড়ুন:
মন্তব্য