মাসুদ রানার কি গোঁফ ছিল? মাসুদ রানার পাঠক হিসাবে আমার যোগ্যতা এত কম যে মনে করে বলতে পারব না যে তার গোঁফ কখনও আনোয়ার সাহেব (বা তার ভূতলেখকবৃন্দ) বানিয়েছিলেন কিনা। তবে এসবে সোহেল রানার সামান্যই ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে। তিনি যখন প্রযোজক মাসুদ পারভেজ হিসাবে নিজেকে মাসুদ রানা ছায়াছবির নায়ক নিয়োজিত করলেন, তখন নিজের প্রাকৃতিক গোঁফ হঠানোর কোনো কারণ খুঁজে পাননি।
এটা ঠিকই, তার চুল হঠানোর তুলনায় গোঁফ হঠানো অধিক কসরৎ ও মনোবেদনার কারণ হতে পারত। বাস্তবে তিনি পর্দা-উপস্থিতিতে কখনই দুটোর কোনোটাকে অনুপস্থিত করেননি। পর্দায় একমাত্র ‘মাসুদ রানা’ সোহেল রানার গোঁফের উপর ভর করেই হাজির হলেন। তখনও বাংলাদেশের আম-মানুষজন গোঁফওয়ালা জাতীয় নেতা হিসাবে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই চেনেন; জিয়াউর রহমানকে চিনে সারেননি। তবে কেবল গোঁফের কারণে মাসুদ রানাকে কোনোভাবে নিন্দিত হতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যতটুকু দর্শকতৃপ্তির ইতিহাস জানা যায় তাতে নিজের গোঁফ ও নাইলনের চুলসমেত সোহেল রানাই মাসুদ রানার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পর্দা-দাবিদার বলে বিবেচিত হয়েছেন।
মাসুদ রানাকে নিয়ে কিছু বলতে শুরু করার পর লোকে যদি জিজ্ঞাসা করে বসেন যে ‘কয়টা পড়ছ বই’, তাহলে খুবই বিপদে পড়ে যাব। জানা মতে, মাসুদ রানার খণ্ড শ’ চারেকের কাছে। আর স্মৃতিমতে আমার আস্ত পড়া কেবল পিশাচ দ্বীপ। সেটা কেন ও কীভাবে বাসাতে পেয়েছিলাম, তা ধারণা নাই। তবে আমার মামাদের দুজনের একজন সংগ্রাহক হতে পারেন। এর বাইরে আমি নিজে নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাতায়াত শুরু করলে মাসুদ রানার বিপুল সম্ভার আমাকে কখনও টানে নাই। কুয়াশা বা দস্যু বনহুর-ও দু’চারটা খণ্ড পড়েছি, মাসুদ রানা একেবারেই নয়। সামনে পড়ে আছে, খুলে দু’পাতা পড়লাম – এরকম কিছু পরিস্থিতি বাদে। একেকবার মনে হয়, আমার শুচিতাবাদী মনের কারণে। কিন্তু ভেবেচিন্তে সেই অনুসিদ্ধান্ত বাদ দিতেই হয়। কারণ অশুচিতাবাদী যৌনতার অনেক সাহিত্যই আমি পড়েছি। চূড়ান্ত বিচারে হয়তো চুপচাপ তীক্ষ্ণ শার্লক হোমসের প্রতি আমার অনুরাগ সাঁই সাঁই ধরনের মাসুদ রানার প্রতি বিরাগের কারণ হয়ে থাকবে।
জেমস বন্ডের ছায়ায় গড়ে উঠেছেন মাসুদ রানা। ছবি: সংগৃহীত
গোয়েন্দা বনাম স্পাই
বাংলা সাহিত্যের (আধুনিক) ইতিহাসে গোয়েন্দা অনেক। অপেক্ষাকৃত পরিচিতরা হলেন কিরীটী রায়, ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা। ঘনাদা বা স্বপন কুমার সম্ভবত ঠিক একই বর্গে পড়বেন না। কিন্তু গোয়েন্দারা গুপ্তচর নন। বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দারা কমবেশি শার্লক হোমসের বিদ্যাবুদ্ধির প্রচ্ছায়াতে গড়ে উঠেছেন। তাতে কেউ ধুতি পরতে পারেন, কেউ চুরুট খেতে পারেন, কেউ শাল গায়ে চড়াতে পারেন, কেউ সনাতনী বাংলায় দীর্ঘ কেইস-বিবরণী সবাইকে গোল করে বসিয়ে দিতে পারেন, আরেকজন ইংরাজি সঙ্গীতমুগ্ধ থাকতে পারেন। এরকম নানান ভিন্নতা সত্ত্বেও এরা সকলেই গোয়েন্দা, কিংবা ব্যোমকেশের ভাষায় সত্যান্বেষী। এসব ভিন্নতা সত্ত্বেও এরা শার্লকের উত্তরসূরী। ওদিকে গোয়েন্দা আর গুপ্তচরেই কেবল মামলা ফিনিস হয়ে যাচ্ছে না। আরো আছে অ্যাডভাঞ্চারাস কম্যুনিস্টসম ঝোড়ো চরিত্র। যেমন কিনা দস্যু বনহুর। দস্যু বনহুরকে মেলাতে হলে মেলাতে হবে রবিন হুডের সাথে। তুলনায় কুয়াশা বরাবরই কুয়াশাচ্ছন্ন। তবে যদি বলতেই হয়, মাসুদ রানার থেকে কুয়াশা অনেক বেশি গোয়েন্দা। মাসুদ রানা বরাবরই স্পাই, শুরু থেকেই। কুয়াশা খানিকটা আলাদীনের দৈত্যের মতো ভোজভাজি করে ফেলতে পারেন।
তাহলে দুই বাংলার মেলা মেলা গোয়েন্দা থাকলেও গুপ্তচর বা স্পাই আসলে ভালমতো কেবল মাসুদ রানাই। যদি গোয়েন্দাদের দল বিকশিত হয়ে থাকেন শার্লকের বুদ্ধিরূপের উপর দাঁড়িয়ে, তাহলে আমাদের স্পাই মাসুদ রানা দাঁড়িয়েছেন আরেক জগদ্বিখ্যাত স্পাই জেমস বন্ডের উপর ভর করে। এগুলো সাধারণ জানাশোনাই সকলের। তবে অতি সম্প্রতি জানতে পারলাম পশ্চিম বাংলায় মাসুদ রানা ততটা তেমন জনপ্রিয় হন নাই কখনও। জানতাম আসলে। তবে তথ্যটাতে অত গুরুত্ব দিই নাই কখনও। কিন্তু এ দফা জানার পর দুইটা বিষয় মনে হলো। একটা চিরপরিচিত। বাংলাদেশের কোনো পুস্তকই বা ইন্ডিয়ার বাংলাভাষীরা যত্ন করে গ্রহণ করেছেন! আর দ্বিতীয়টা নীতিসঙ্গত (বা রাজনীতিসঙ্গত) বিষয়। কেন বা কীভাবে ভারতের নাগরিকেরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একজন কুঁদে-বেড়ানো সামরিক কর্মকর্তার জৌলুস গ্রহণ করবেন!
পর্দায় ধাঁই-ধাঁই স্পাই
যার মনে যাই থাকুক, সোজা-সরল সত্য হলো বাংলাদেশে জেমস বন্ডের মুখ্য কনজাম্পশন হয়েছে পর্দায়, বইতে নয়। যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন বাংলাদেশে হাজারের উপরে প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সঠিক হিসাব দেবার জন্য বাংলাদেশে মহাফেজখানার হাল আরও ভাল হতে হতো। তবে সেইসব হাজার প্রেক্ষাগৃহের অনেকগুলোতেই ইংরাজি ছবি প্রদর্শিত হতো। কোনো হলই কেবল ইংরাজির জন্য তালিকাভুক্ত ছিল না। কিন্তু কিছু প্রেক্ষাগৃহে ইংরাজি অপেক্ষাকৃত বেশি হারে দেখানো হতো। এ ছাড়া মফস্বলের হলগুলোতে প্রায়শই ছুটির দিনের আগের দিন, প্রথমে শনিবার, পরে বৃহস্পতিবার, এক টিকেটে দুই ছবির এক ধরনের চর্চা ছিল। ছুটির আগের দিনে মুক্তি পাক আর না পাক, ছুটির দিনটাতে তা চলতোই। হংকং কিংবা হলিউডের নরম-পর্নোগ্রাফিগুলো এই কাতারে থাকত। এসব ছবির দর্শকেরা ‘যেন বা লুকিয়ে’ দেখে আসতেন। কিন্তু, জেমস বন্ড এই লুকোছাপা চরিত্রের ছিলেন না। তা তিনি যতই প্রেমঘন দৃশ্যে হাজির হোন না কেন। কথিত আছে যে, জেমস বন্ড বা অন্যান্য ইংরাজি ছবির প্রণয়দৃশ্যগুলো সেন্সর বোর্ড ঠিকঠাক মতো কেটে দিতেন। তবে ‘এক টিকেটে দুই ছবি’র ওই নরম-পর্নোগুলোর বেলায় সেন্সর বোর্ডের কর্তারা কী করতেন তা জানা যায় না। জেমস বন্ড বলতে বাংলাদেশে, যদি ঠিক মনে পড়ে, শ্যেন কনোরি আর রজার ম্যুর বিরাজ করতে পেরেছিলেন। মানে সেলুলয়েড জমানার কথা হচ্ছে, সাম্প্রতিক ডিজিটাল ড্যানিয়েল ক্রেইগ নয়।
জেমস বন্ড চিরকালই পিটাপিটি করেন। করতেই হয়। মাসুদ রানাও অনেক পিটাই করে থাকেন। তবে শেষের দিকের বন্ড, প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বহু হাইটেক পিটাই করে থাকেন। শেষেরটাতে তো দেখলাম বন্ড প্রায় সংসারই পেতে বসেছেন। নো টাইম টু ডাই দেখার পর সহদর্শকদের বললাম যে অপুর সংসার-এর আদলে ছায়াছবিটার নাম ‘জেমসের সংসার’ বা ‘বন্ডের বন্ধন’ হতে পারত। এদিক থেকে মাসুদ রানা গুরুতরভাবে অগ্রসর বিবাহনিরপেক্ষ মানুষ। ৪০০ খণ্ডেও তিনি খণ্ডীকৃত হয়ে বিবাহ এবং/বা বান্ধাপ্রণয়ে বান্ধা পড়েননি। বাস্তবে সিনেমার পর্দায় যে স্পাইকে ধাঁই-ধাঁই বহু লোকে দেখে উঠে সারেননি, তারাই পাতায় পাতায় শব্দে-শব্দে মনশ্চক্ষে দেখেছেন সেই স্পাইকেই, মাসুদ রানার মাধ্যমে। ‘দেশে’র জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক উর্দিহীন মিলিটারি!
নেতাদের প্রতিকৃতি বা আইকন
জাতীয় নেতা বলতে যদি রাজনীতি-জাতীয় নেতা বোঝাই তাহলে নিশ্চয়ই কোনো অন্যায্য কাজ হয় না। এখন শেরে বাংলা বা ভাসানীর যেসব ছবি প্রতিকৃতি সম্প্রচার করা হয়, কিংবা তাদের বিষয়ে যেসব বাণীমালা ভেসে বেড়ায় পাঠ্যপুস্তকে বা রাজনীতি-আলাপে, তাতে তাদেরকে ‘সিনেমাটিক হিরো’ হিসাবে গ্রহণ করা খুবই কঠিন। সিরাজ শিকদার হয়তো হতে পারতেন। তাকে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্প্রচার নাই বললেই চলে। চললেও তিনি অধিকতর দস্যু বনহুর ধাঁচের হতেন, অবশ্যই কম মাসুদ রানা ধাঁচের। রইলেন বাকি তিনজন। কিন্তু মাসুদ রানার জব ডেসক্রিপশনের দুইটা অন্তত আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার। তার মধ্যে মিলিটারিত্বই যথেষ্ট, কারণ বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রশাসকের সাথে মাসুদ রানার কিছুমাত্র বনিবনা না হবার। আর থাকে (হেটারোসেক্সুয়াল) প্রণয়োদ্ভাস। দিকে দিকে, ক্ষণে ক্ষণে, এমনকি জনে জনে। মাসুদ রানার ব্যক্তিত্বের সব থেকে আকর্ষণীয় অংশই এটা, আমার জন্য বলছি। এটাকে হিসাব মানলে স্বাধীন বাংলাদেশে নেতাদের মধ্যে এরশাদের থেকে বড় দাবিদার কেউই থাকেন না। কিন্তু এরশাদ দুর্ভাগাও বটে। তিনি মানসপটে এসে হাজির হবার বহু আগেই মাসুদ রানা প্রতিষ্ঠিত এমনকি বিদারিত (স্যাটুরেইটেড)। তা ছাড়া, কোনো এক রহস্যজনক কারণে এরশাদ একজন ড্যাশিং হিরো হিসাবে আবির্ভূত হতেই পারেন নাই – স্ট্যাটিসটিকস, এইসথেটিক্স (এবং পোয়েটিক্স) যতই তার পক্ষে থাকুক না কেন।
তাহলে জিয়াই ছিলেন মাসুদ রানার সব চেয়ে নিকটজন। মিলিটারি হিসাবে তো বটেই, তুখোড় বুদ্ধিমান হিসাবে; সর্বোপরি ‘হিরো’র প্রতিকৃতি বা আইকন হিসাবে। মাসুদ রানা ছেঁড়া গেঞ্জি না পরতে পারেন, খালও না কাটতে পারেন, কিন্তু মনশ্চক্ষে যদি কোনো রাষ্ট্রনায়ককে ‘যেন বা মাসুদ রানা’ ভাবতে চান, তাহলে অনায়াসে জিয়াকেই ভাবতে পারা ঠিক হবে। এতে জিয়ার নিজস্ব গোঁফ যদি মনশ্চক্ষে অশান্তি উৎপাদন করে, কাজী আনোয়ার হোসেনকে গোঁফওলা মাসুদ রানা পয়দা করতে বলা যেতে পারত। তা ছাড়া, জিয়া ময়দানে আসার আগেই, যেমনটা বললাম, সোহেল রানা নিজের গোঁফ মাসুদ রানাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটাকে ঠিক ফ্লপও বলা যাবে না, রীতিমত হিটই ছিল জানা যায়। যদিও এই ছবির দর্শকসংখ্যা আর মাসুদ রানার পাঠকসংখ্যার মধ্যে কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন তুলনা সম্ভব নয়।
রুচিবান-শুচিবান যারা
বাংলার সাহিত্য-গোয়েন্দাগণ সকলেই অতিশয় রুচিবান। এমনকি শুচিবান; অতিশয় শুচিবান। তাদের শুচির মাত্রা এতটাই যে পাঠকদের পক্ষে তাদের অযৌন কল্পনা করা অত্যন্ত বিবেচনাপ্রসূত হবে। এদের মধ্যে কার থেকে কার রুচি বেশি, বা কার শুচি শক্ত তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ এদের কস্ট্যুম, কাল, সঙ্গীতরুচি বেশ স্বতন্ত্র পরস্পরের থেকে। তবে ফেলুদা অপেক্ষাকৃত নবীন ও পাশ্চাত্যনিষ্ঠ হবার কারণে তিনি অধিক সম্ভাবনাময় ছিলেন শুচিগিরি ছাড়তে। এর মানে এই নয় যে, আমি পাশ্চাত্যীয় রুচিকে অশুচি বলছি। তা তো বলছিই না, উপরন্তু যৌনতাকে শুচি বা অশুচিতা দিয়ে আমি নিজে বোঝারও আগ্রহ বোধ করি না। আমার বক্তব্য এই যে, গড়ে পাশ্চাত্যের যে ইমেজ পাঠক-মনোজগতে বিরাজ করতে থাকে আর যৌনতা যেরকম অশুচিময় কাঠামোতে বন্দি, তাতে ফেলুদা অপেক্ষাকৃত যৌনমনস্ক থাকতে পারতেন; ও সেই সুবাদে ‘অশুচি’। কিন্তু তিনি এমনকি তার স্রষ্টা সত্যজিতের থেকেও কঠোর ব্রহ্মচর্য অনুশীলন করে গেছেন। ‘সচ্চরিত্র’ চরিত্র সৃষ্টিতে বাংলা অঞ্চলের লেখকেরা দুর্দান্ত অবদান রেখে গেছেন। সমরেশ বসুর জন্ম না হলে উত্তরকালের নায়ক-নায়িকাদের হয়তো চৈতন্যদেবের মতো গলায় উত্তরীয় দিয়ে নদীয়া অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হতো।
যা হোক, মাসুদ রানাকে নিয়ে বলতে গিয়ে এত লোকের কথা চলে এসেছে। মাসুদ রানা এই নিখিল বঙ্গীয় অযৌন পুরুষ অ্যাডভাঞ্চারাস ‘হিরো’দের ব্রহ্মচর্য থেকে ঐতিহাসিক মুক্তি এনে দিয়েছেন। তাতে পূর্বসূরী গোয়েন্দাদের মন ভাল হয়েছে কিনা জানার কোনো সুযোগ নাই। তবে ওটিটির একটা ছায়াছবিতে কিরীটী রায়কে একজন বান্ধবী সহযোগে সম্প্রতি দেখা গেল। মোবাইল ফোন আর বান্ধবী এই দুইটা সংযোজন ঘটেছে। অভিনয় ও চিত্রনির্মাণ নিয়ে আজকে আলাপ না করাই উত্তম, আসলে কখনই আলোচনা না করা ভাল। মাসুদ রানা যে তার পূর্বতন ভার্চুয়াস/সচ্চরিত্র নায়কদের থেকে সরতে পারলেন, এই যোগ্যতার কারণে তিনি পাঠকদের, বিশেষত পুরুষ পাঠকদের, কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছিলেন। আর প্রণয়কালে তাকে ঠিক মিলিটারির সামাজিক ইমেজসুলভ লাগেও না। চলতি ভাষায় যাকে রোমান্টিক বলা হয়ে থাকে, সেই যোগ্যতাই বরং তিনি বহন করে চলেছিলেন।
তদুপরি আমেরিকানিজম ও ইয়্যুথ
উর্দিহীন হলেও মাসুদ রানা মিলিটারি। তিনি কখনই মিলিটারিগিরির বাইরে থাকতেন না। সোহানা প্রমুখের সাথে একটু আরাম-আয়েশ করার সময়েও তার মাথা থাকত কিলবিল ইন্টেলিজেন্সের মাথা। অবশ্যই মাসুদ রানার জাতীয়তা বদলাতে হয়েছে। তিনি পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তা ছিলেন, পরে বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের চর হলেন। এই জাতীয়তা বদলের বিষয়ে তার নিজের কিছুই করার ছিল না। কারণ, তিনি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর চাকরিজীবী ছিলেন। এখন রাষ্ট্র বদলে গেলে তিনি কী করতে পারেন! কিন্তু ভাবুন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যত বুদ্ধিমান কর্মকর্তাই হোন না কেন, যিনি ধরাধামে আবির্ভূত হন ১৯৬৬ সালে, তখন কি তার জন্য ঢাকা খুব আরামদায়ক জায়গা? নিখিল বাংলাদেশ কোনো আরামদায়ক জায়গা? আবার কাজী আনোয়ার হোসেন যতই দেশপ্রেমিক হোন না কেন, মাসুদ রানার কারিগর হিসাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এক কর্মচারীকে তিনি তো আর ছয় দফা আন্দোলনের সৈনিক বানাতে পারেন না। সেটা বানাতে হলে তার দস্যু বনহুর কিসিমের কিছু লিখতে হতো। ফলে দুর্দান্ত ক্ষিপ্র সেমিবন্ড দেশিবন্ড জন্মাবধি বাংলা পাঠকের ‘জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন’তে (বা মতান্তরে জাতীয়তাবাদী স্বপ্নতে) এক বেখাপ্পা ‘হিরো’ হিসাবে থাকার কথা। বিচিত্র নয় যে, তিনি আরো আরো জনপ্রিয় হলেন ১৯৭৫-এর পরবর্তী বাংলাদেশে।
এখন কেউ যদি আমাকে প্রমাণ করতে বলেন, আমি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করব। কোনো জনপ্রিয়তার মাপনযন্ত্র আমার কাছে নাই; বাংলাদেশে নাই মহাফেজখানার কোনো চর্চা। কিন্তু এটা অনুভব করার জন্য এমনকি আমার ১৯৭৫ সালে গুরুতর বয়স্ক লোকও হতে হয় নাই। বস্তুত এটা আমার ১৯৭৫ সালের আবিষ্কার নয়। পরেরই। পঁচাত্তর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সামরিকমনস্কতার গুরুতর সব বদল ঘটতে থাকে। এটা ভোজভাজির মতো এক রাত্রিতেই হয়নি তা সত্য। কিন্তু মার্কিনিবাদ বা আমেরিকানিজম পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশে বিকশিত হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে, সর্বমোট ছয় বছরও ক্ষমতায় ছিলেন না। বস্তুত তিনি চার বছরই ছিলেন। কিন্তু সেই সময়টাতে মার্কিনবাদিতা একটা স্বপ্নবলয়ের মতো রচিত হতে থাকে, বিকশিত হতে থাকে। সর্বোপরি, জনমানসে প্রোথিত হতে থাকে। এর অবধারিত অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে নতুন কল্পিত এক যৌবন/ইয়্যুথ, যার অবধারিত অনুষঙ্গ পৌরুষ। তাহলে পৌরুষদীপ্ত এক তারুণ্যময়তা দিয়ে মার্কিনি জীবনযাপনের অধিকল্পনা (ফ্যান্টাসি) এই সময়কালের মনোজগত বুঝতে খুবই জরুরি। অন্তত আমার প্রস্তাব সেটাই। মাসুদ রানা সেখানে অধিকল্পনার মূর্ত অধীশ্বর হিসাবে পুনর্জাগরিত হয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের কোনো গোয়েন্দাই ‘দেশমাতা’র সেবক হিসাবে বিকশিত নন। তারা মাইক্রো-ইভেন্টের ‘হিরো’; মাসুদ রানা ম্যাক্রো ইভেন্টের। ঠিক এই সময়কালটাতেই যে সারা বাংলাদেশের চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত তাদের (পুরুষ) বাচ্চাদের সেনা অফিসার বানানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সেই বাস্তবতাটাকে এর সাথে মিলিয়ে পাঠ করা যায়। যায় তো বটেই! কিন্তু আজকেই তা করে ফেলতে হবে তা তো নয়। আজকে উর্দিহীন মাসুদ রানাতেই শেষ করি আমরা! উর্দিহীন, তথাপি মিলিটারি, তথাপি রাষ্ট্রের পতাকাবাহী, কাঁধে করে নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। মাসুদ রানার ‘দেশাত্ম’বোধ তাই সামরিক-সীলমোহরসম্পন্ন রাষ্ট্রচৈতন্য।
মানস চৌধুরী: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
আরও পড়ুন:বাংলাদেশ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে জর্জরিত। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহ এবং মরুকরণের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম বৃহৎ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ‘বনায়ন’ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত ৪৫ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) নেতৃত্বে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয়, যা সরকার ও অন্যান্য সকল অংশীদারদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে অনুপ্রাণিত ও সচেতন করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে ‘বনায়ন’ দেশজুড়ে লক্ষাধিক চারা বিতরণ করবে।
১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা ‘বনায়ন’ পরিবেশের সুরক্ষা ও বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত ১৩ কোটিরও অধিক ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও, গড়ে তোলা হয়েছে ১১৯টি ঔষধি গাছের বাগান। ঢাকা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, নাটোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, যশোর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও রাঙ্গামাটি সহ দেশের মোট ২৪টি জেলায় ‘বনায়ন’-এর কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এই উদ্যোগ বার্ষিক ২৫,০০০ এরও অধিক সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছেছে, যা দেশের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে এক বিশাল অবদান রাখছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এলাকাতেও বনায়নের কার্যক্রম প্রশংসনীয়। প্রায় ১১ লাখ উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়ের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় দেড় হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে পাহাড়। এই বিশাল ক্ষতির মুখে, সরকার, রিফিউজি, রিলিফ এবং রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশন (আরআরআরসি), ডব্লিউএফপি, এফএও, ব্র্যাক, কারিতাস এবং ‘বনায়ন’ প্রকল্প একসাথে কাজ করছে অত্র এলাকায় সবুজের ছোয়া ফিরিয়ে আনতে। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বনায়ন প্রকল্পের আওতায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৩.৭ হেক্টর ব্লক এলাকা ও ১৮.৭ কিলোমিটার রাস্তার পাশ জুড়ে ৩ লাখেরও বেশি চারা রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে।
জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ‘বনায়ন’ কর্মসূচি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কার, এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩, ‘এন্টারপ্রাইজ এশিয়া’ থেকে গ্রিন লিডারশিপের জন্য ‘এশিয়া রেসপনসিবল অন্ট্রাপ্রনারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ এবং এসডিজি ইনক্লুশন ক্যাটাগরিতে ‘বাংলাদেশ ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড ২০২১’।
একটি সম্ভাবনাময় আগামী নিশ্চিত করতে ‘বনায়ন’ কর্মসূচির নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সকল অংশীদারের সাথে একযোগে কাজ করার এই অঙ্গীকার বাংলাদেশকে একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবছরেও বনায়ন ৩০ লাখেরও অধিক চারা বিতরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে উজান থেকে বয়ে আসা বন্যার পানি আর অতি বৃষ্টিতে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের পদ্মার তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সুতালড়ী, আজিমনগর ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের ঘরবাড়ি ও কয়েকশ বিঘা ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এরই মধ্যে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে লেছড়াগঞ্জ ইউপির ২নং ওয়ার্ডের হরিহরদিয়া, শ্রীলমপুর গ্রামসহ আশপাশের এলাকা। অসহায় হয়ে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে আশ্রয়নের ঘরে থাকা ১৪০টি পরিবার। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে জানা যায়, গত ২৪ বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় আশ্রয়নের ঘরে থাকা বাসিন্দাদের খবর নেয়নি কেউ।
পদ্মার প্রায় ২০০ মিটার কাছে এই আশ্রয়নের ঘরে ভাঙন আতঙ্কে অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘুম নেই কারো। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে জয়পুর নতুন হাটবাজার, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ আরও হাজার পরিবার।
পদ্মার ভয়ংকর থাবায় সবকিছু হারিয়ে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু রক্ষায় স্থানীয় নেতাকর্মীসহ সরকারের সহায়তা চেয়েছেন তারা।
সরজমিনে দেখা যায়, হরিরামপুর উপজেলার তিন ইউনিয়নের মধ্যে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের হাত থেকে শেষ রক্ষা পেতে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা। কিন্ত মাথা গোজার ঠাইটুকু মিলছে না করো।
উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের হরিহরদিয়া গ্রামের আঁখি বেগম জানান, আমার স্বামী রহিজ উদ্দিন ৫ বিঘা জমিতে চাষ করে ভাল ফলন ওইছিলো। এহন চোহের পলকে চইলা গেলো। এহন আমরা কি করুম?
আশ্রয়নে থাকা মেছের জানান, ‘নদীভাঙন বাড়ির কাছে চলে আসায় ঘর সরিয়ে কোথায় নেব? ভাইবা পাইতাছি না। পাশে নটাখোলা এলাকায় এক জায়গায় ৩৮ একর, আরেক জায়গায় ৩৫ একর জায়গা হার সোসাইটি নামের এনজিওর দখলে আছে। কিভাবে তারা ৭৩ একর জায়গা তাদের দখলে আছে, জানি না, তবে সেখানে আপাতত অস্থায়ী হলেও থাকার জায়গা করে দিলে অনেক উপকার হতো। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে মনে হয় বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটেমাটিটুকুও থাকবে না।’
একই এলাকার আছিয়া বেগম বলেন, ‘এইবারের পদ্মার ভাঙনে শেষ সম্বল যাওয়ার পথে। লোকমুখে শুনছি, সাবেক সংসদ সদস্য, দানবীর মুন্নু মিয়ার সুযোগ্য কন্যা, জেলা বিএনপি আহ্বায়ক রিতা আপা কাউরে ফিরায়ে দেয় না। রিতা আপার কাছে আমগো দাবি- আমগো মাথা গোজার ঠাঁই করে দেন। আমরা পরান ভইরা আপার জন্য দোয়া করুম।
এরমধ্যে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতার নির্দেশে ভাঙন কবলিত এলাকায় পরিদর্শন করে ভাঙন আতঙ্কে থাকা পরিবারের অনত্র সরিয়ে নেয়া এবং পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
হরিরামপুর উপজেলা বিএনপি সভাপতি হান্নান মৃধা জানান, মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সংগ্রামী আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা আপার নির্দেশে আমরা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। বিএনপি সব সময় অসহায় মানুষের পাশে থাকে। তাদের সুখ দুখের ভাগিদার আমরা সবাই।
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কোহিনুর আক্তার বলেন, আমরা ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে এবার বাণিজ্যিক দুই প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে বালিয়াড়ি কেটে তৈরি হয়েছে একটি কৃত্রিম খাল। প্রাকৃতিকভাবে পানি চলাচলের স্বাভাবিক পথ বন্ধ করে একটি বাঁধ তৈরি পর কৃত্রিম খালটি খনন করা হয়েছে।
এতে অবিচ্ছিন্ন সৈকত বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি বালিয়াড়িতে তীব্র ভাঙ্গনের আশংকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সৈকত জুড়ে গর্ত ও গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়ে পর্যটকদের নিরাপদ সমুদ্রস্নানে প্রতিবন্ধকতারও আশংকা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া কৃত্রিম খাল দিয়ে হোটেল-মোটেল জোনের ময়লাযুক্ত পানি সরাসরি সাগরে মিশে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ; এমনটা মন্তব্য পরিবেশবাদীদের।
গত মঙ্গলবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্টসংলগ্ন ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পাশ দিয়েই দেখা মিলেছে কৃত্রিম খালটির। আশে পাশের পর্যটন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, হোটেল-মোটেল জোনের কিছু অংশের পানি ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পিছনের সীমানার পাশ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ছড়া দিয়ে চলাচল করত। ওই ছড়ার পানি প্যাসিফিক বিচ লাউঞ্জ ক্যাফের সামনে দিয়ে সাগরে গিয়ে মিশত। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে প্যাসিফিক বিচ লাউঞ্জ ক্যাফে মালিক পক্ষ ছড়াটি বন্ধ করে বালির বস্তা দিয়ে তৈরি করা হয় একটি বাঁধ। এতে বাঁধের কারণে ডিভাইন ইকো রিসোর্টের সামনে পানি জমে বড় ও গভীর ডোবার সৃষ্টি হয়। পরে জমে থাকা নিষ্কাষনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার কোণ ঘেঁষে বালিয়াড়ি কেটে তৈরি করা হয় একটি কৃত্রিম খাল। এতে খালটি দিয়ে জমে থাকা পানির পাশাপাশি ভারী বর্ষণে ঢলের পানি খালটি দিয়ে প্রতিনিয়ত সাগরে মিশে যাচ্ছে। আর জোয়ার-ভাটার সময় পানি যাতায়তের কারণে খালটির দিন দিন পরিধি বাড়ছে। এতে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছে অবিচ্ছিন্ন সৈকত। প্যাসিফিক বিচ লাউঞ্জ ক্যাফে ও ডিভাইন ইকো রিসোর্টের নিয়োগ করা শ্রমিকরা এই কৃত্রিম খালটি খনন করেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু জানিয়েছেন, দুইটি প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত স্বার্থে এমন বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এতে হোটেল-মোটেল জোনের ময়লাযুক্ত পানি প্রতিনিয়ত সাগরে মিশে যাওয়ার পাশাপাশি ভারী বর্ষণের খালটি বড় আকার ধারণ করছে। এ খালের কারণে পর্যটকদের নিরাপদ সমুদ্র স্নানের প্রতিবন্ধকতা তৈরি ছাড়াও প্রাণহানির আশংকা দেখা দিতে পারে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দায়িত্ব পালনকারি সী সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার সিনিয়র কর্মী মোহাম্মদ শুক্কুর জানিয়েছেন, সম্প্রতি বর্ষায় সৈকতের বিভিন্ন স্থানে গর্ত এবং গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়েছে। এতে সমুদ্র স্নানে যাওয়া ৮ জন পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট গর্ত ও গুপ্তখাল চিহ্নিত করা খুবই কষ্ঠের।
ডিভাইন ইকো রিসোর্টের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মোহাম্মদ সেলিম জানান, প্রাকৃতিকভাবে যে পথে পানি নেমে যেত যেখানে একটি বাঁধ তৈরি হয়েছে। এতে তাদের প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রচীন ভাঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন বিকল্প পথে পানি যাচ্ছে। এটি কৃত্রিমভাবে খনন করা হলেও তারা এটার সঙ্গে জড়িত নন। কারা করেছে তাও জানেন না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন জানান, বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব মূলত কক্সবাজার পৌরসভা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। তারপরও অবৈধ পন্থায় কেউ কিছু খোঁজ খবর নিয়ে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দূর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সশস্ত্র ডাকাতদল বাড়ির লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ১ভরি স্বর্ণালংকার ও ১০০ ভরি রুপা লুট করে নেয়। সোমবার (২৩ জুন) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের সিরাজনগর বেলতলীপাড়া গ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী হায়দার আলীর বাড়িতে এ দূর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, সিরাজনগর বেলতলীপাড়া গ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী হায়দার আলী পাশর্^বতী বাহিরমাদী বাজারে তার স্বর্ণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকান থেকে ব্যবসার নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়িতে যান। এসময় পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা ৩-৪ জনের একদল সশস্ত্র ডাকাত বাড়িতে প্রবেশ করে ব্যবসায়ী হায়দার আলীর মাথায় পিস্তুল ঠেকিয়ে ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্যাগভর্তি নগদ ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ১ভরি স্বর্ণালংকার ও ১০০ ভরি রুপা লুট করে নেয়। বাড়ির লোকজন চিৎকার ও কান্নাকাটি করতে গেলে ডাকাতদল তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে নির্বিগ্নে চলে যায়।
এ ঘটনায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী হায়দার আলী আজ মঙ্গলবার বিকালে দৌলতপুর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
ডাকাতির ঘটনার বিষয়ে দৌলতপুর থানার ওসি মো. নাজমুল হুদা বলেন, ডাকাতি ঠিক বলা যাবেনা, চুরির ঘটনা ঘটেছে। কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম, তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্যামনগরসহ আশপাশের এলাকায় কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এসি খ্যাত ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি দেয়াল ঘর। উপজেলা সবত্র গ্রামগুলোতে গত কয়েক বছর পুর্বেও মাটির ঘর বা দেয়াল ঘরের বাড়ি ছিল। এসব দেয়াল ঘর বা মাটির ঘরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও ঘরের ভেতরে বেশ আরামদায়ক ও শীতল আবেশ ছিল। এর বিপরিতে শীতের দিনে ঘরে গরমের পরিবেশ ছিল। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, মাটির দেয়াল ঘর এর চতুরপাশ্বের ওয়াল প্রায় দুই থেকে তিন ফুট পুরো ও বিশেষ পক্রিয়ায় মাটির দিয়ে প্রলেপ দেয়ার কারনে এসব ঘরে শীতের বাতাশ বা রুদ্রের তাপ সহজে প্রবেশ করতে না পারায় গরমে শীতল ও শীতে গরম অনুভত হওয়ায় লোকজন বেশ আরামে বসবাস করেছেন। যদিও এটি মাটি দিয়ে তৈরি তারপরও এর নির্মানশৈলী কিন্তু মোটেই সহজ নয়। প্রথমে মাটি কেটে বড় গর্তে ফেলে এটিকে দলাই-মলাইয়ের পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে পানি দিয়ে বেশ অনেকদিন কুপিয়ে কুপিয়ে মাটিকে একবারে আঠালো করে পচন পক্রিয়ায় কাচাকাছি নিয়ে অনেকটা তুলতুলে মন্ডার মত করে ঘরের নিদিষ্ট মাপের মধ্যে মাটির কয়েকফুট নিচ থেকে বসিয়ে বিরতি দিয়ে ঘর বানাতেন কারিগড়রা। পরে দেয়াল সাইজ মত কেটে প্রলেপ দিয়ে এটিকে সাজিয়ে তুলতেন। বিত্তবানরা এতে বিভিন্ন নকশা করাতেন। অনেকে মাটির দু-তলাও বানাতেন। এটি অনেক কষ্টকর কাজ ছিল, তবে ঘর বানানোর মেস্তরীর চাহিদাও ছিল ব্যাপক। এক সময় প্রায় সব শ্রেণীর লোকেরাই মাটির ঘরে বসবাস করতেন। অতি ধনাঢ্য লোকেরা টিনের ঘরে বসবাস করতেন। বর্তমানে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তি পথে মাটির তৈরি ঘর। এর স্থানে উঠছে রড় রড় দালান বাড়ি। তবে গফরগাঁও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখনো অনেক মাটির ঘর রয়েছে। এমনি ঘরে বাস করা ইমদাদুল হক টুটুল ও মর্জিনা দম্পত্তি সহ অনেকে জানান, এ ঘর অনেকটা এয়ারকন্ডিশনের মতো শীতে গরম থাকে ও গরমে ঠাণ্ডার আবেশে তারা বেশ আরামেই আছেন। প্রতি বছর মাটির সঙ্গে ধানের তুষ দিয়ে প্রলেপ দিলে এসব ঘর অনেক বছর (৪০-৫০)পর্যন্ত টিকে থাকে বলেও জানিয়েছেন। মাটির ঘর নির্মানেও বেশ খরচ হয়। বর্তমানে হোসেনপুর-গফরগাঁওসহ আশপাশের উপজেলার গ্রাম এলাকায় মাটির ঘর খুব কম দেখা যায়। এক সময় এ পেশায় অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন মানের ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, ফলে মাটির ঘরের স্থানে উঠেছে বড়-বড় ইমারত। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী প্রকৃতির এয়ারকন্ডিশনখ্যাত মাটির ঘর।
বাংলাদেশের মুদ্রার মান দেশীয়ভাবে নির্ধারিত হবে এবং কোনো অযৌক্তিক কারণে এক পয়সাও অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই। দুবাই থেকে আমাদের টাকার মান নির্ণয় হবে না বলে মন্তব্য করেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, নইলে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের সম্ভাবনা সীমাহীন, তবে তা নষ্ট করার সুযোগও সীমাহীন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত গুগল পে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন গভর্নর।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে গভর্নর জানান, ব্যাংক খাতকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে আগামী জানুয়ারি থেকে ‘রিস্ক বেজ সুপারভিশন’ চালু করা হবে। ইতোমধ্যে ২০টি ব্যাংকে সুপারভিশন পরিচালনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করেন।
তার মতে, মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসছে, তবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে আরো সময় লাগবে।
আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষার অংশ হিসেবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনার কথাও জানান গভর্নর। তিনি আশ্বস্ত করেন, আমানতকারীদের কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না। সবাই তাদের বর্তমান ব্যাংকে থেকেই সেবা নিতে পারবেন।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করল ‘গুগল পে’
অনুষ্ঠানে গুগলের ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা ‘গুগল পে’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। গুগল, মাস্টারকার্ড এবং ভিসার সহায়তায় সেবা চালু করছে ‘সিটি ব্যাংক পিএলসি’, যা দেশের প্রথম কোনো ব্যাংক হিসেবে গুগল পে-র সঙ্গে যুক্ত হলো।
প্রথম পর্যায়ে কেবল সিটি ব্যাংকের ভিসা ও মাস্টারকার্ড গ্রাহকরাই গুগল ওয়ালেটে কার্ড সংযুক্ত করে গুগল পে ব্যবহার করতে পারবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য ব্যাংক যুক্ত হলে সেবাটি আরো বিস্তৃত হবে।
গ্রাহকের হাতে আধুনিক ও নিরাপদ পেমেন্ট প্রযুক্তি
গুগল পে ব্যবহারে গ্রাহকেরা দেশে ও বিদেশে যেকোনো POS টার্মিনালে স্মার্টফোন ট্যাপ করেই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবেন, ফলে কার্ড বহনের প্রয়োজন হবে না।
গুগল পে কোনো ট্রানজেকশন ফি নেয় না। নিরাপত্তার জন্য কার্ডের পরিবর্তে ‘টোকেন’ ব্যবহার করে।
গুগল পেমেন্টসের গ্রুপ প্রোডাক্ট ম্যানেজার শাম্মী কুদ্দুস, সিটি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হোসেন খালেদ, সিইও মাসরুর আরেফিন, মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্র্যাসি জ্যাকবসন, মাস্টারকার্ড ও ভিসার দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সিটি ব্যাংকের সিইও মাসরুর আরেফিন বলেন, এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের ভবিষ্যতমুখী ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম গঠনের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। গুগল পে চালুর মাধ্যমে সিটি ব্যাংক আবারও প্রমাণ করল যে, আমরা ডিজিটাল উদ্ভাবনের অগ্রদূত।
আলু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা জয়পুরহাট। এ জেলার আলুর গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশ পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। আর এ আলু চাষ করে কৃষকরা ও আলু ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর লাভ করে অভ্যস্ত। তবে এবার পড়েছেন বড় ধরনের বিপাকে। আবার জেলার ২১টি হিমাগারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি হিমাগার অবস্থিত কালাই উপজেলায়।
একদিকে বাজারে আলুর দাম অস্থির, অন্যদিকে হিমাগারে সংরক্ষণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সংরক্ষণ মৌসুমের শুরুতে স্থানীয় প্রশাসনের চাপে ভাড়া না বাড়াতে বাধ্য হলেও পরে কিছু হিমাগারের মালিক নানা অজুহাতে প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হিমাগারগুলোতে আলু বিক্রির মৌসুম পুরোদমে শুরু না হতেই ভাড়া বাড়ানো এবং বাজার অস্থিরতায় জেলার অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দ্রুত নীতিসহায়তা ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না হলে সংকট আরও বেশি হবে বলে আশঙ্কা তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি বস্তায় ৫০ পয়সা বেশি মজুরি দেওয়া হচ্ছে। যা তাদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অথচ বিদ্যুৎ-সংকট নেই, বিদ্যুতের ভাড়াও বাড়েনি, তা সত্ত্বেও প্রতি বস্তায় ৫০-৭০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক
আলু ব্যবসায়ী মইনুল ইসলাম বলেন, এম ইসরাত হিমাগার, সালামিন ফুডস, আরবি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ ও পুনট হিমাগার থেকে প্রতিদিন তিনি ৫০০-১০০০ বস্তা আলু কেনাবেচা করেন। এসব আলু তিনি পাঠান কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে। গত দুই-তিন বছর ভালো লাভ হয়েছে। কিন্তু এবার প্রতিদিন বস্তা প্রতি গড়ে এক থেকে দেড় টাকা লোকসান গুনছি। বাজার ওঠানামা করছে। একদিন ৫০ পয়সা লাভ হলেও পরদিন ১ টাকা লোকসান হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ৬০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৮৮০-৯০০ টাকায়। অথচ সংরক্ষণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩০ টাকা। গত বছর একই ওজনের বস্তার ভাড়া ছিল ৩৫০-৩৬০ টাকা।
জেলার সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের কৃষক তোতা মিয়া বলেন, খুব কষ্টে ৬০ বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছি আরবি কোল্ড স্টোরে। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে প্রতি বস্তা ৪৩০ টাকা। অথচ মৌসুমের শুরুতে প্রশাসনের চাপে ৩৫০ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। একদিকে বাজার দর নেই, অন্যদিকে অতিরিক্ত ভাড়া এই সংকটে কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কাছে আবেদন আমাদের হিমাগার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত করুন।
কালাই পৌরসভার সড়াইল এলাকার আলু ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, জয়পুরহাটের পার্শ্ববর্তী বগুড়ার হিমাগারগুলোতে এখনো প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া ৩৫০-৩৬০ টাকা। অথচ জয়পুরহাটে তা ৪২০-৪৩০ টাকা।
কালাই উপজেলায় অবস্থিত পুনট হিমাগারের ব্যবস্থাপক বিপ্লব ঘোষ বলেন, কিছু কৃষক ঝুঁকি নিয়ে এবার বাড়িতেই আলু রেখেছেন। সেসব আলুই এখনো বিক্রি শেষ হয়নি। তাই হিমাগার থেকে আলু কম আনলোড হচ্ছে।
এম ইশরাত হিমাগার লিমিটেডের ব্যবস্থাপক রায়হান আলম বলেন, এবার হিমাগারে ২ লাখ ৩০ হাজার বস্তা আলু রাখা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র ২১০০ বস্তা আনলোড হয়েছে, যেখানে গত বছর এ সময় পর্যন্ত হয়েছিল ২০ হাজার ৯৯০ বস্তা।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামিমা আক্তার জাহান বলেন, উপজেলার ১৩টি হিমাগার মালিকদের নির্দেশনা দিয়েছি তারা যেন কৃষকের স্বার্থে কেজি নয়, বস্তা অনুযায়ী ভাড়া নেয়।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান বলেন, এবার জেলায় ২১টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত বছর হিমাগারের সংখ্যা ছিল ১৯টি।
উল্লেখ্য, এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে জয়পুরহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে স্থানীয় কৃষক ও ছাত্র-জনতা কালাইয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। আলুর ন্যায্যমূল্য ও হিমাগারের অতিরিক্ত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবিতে তারা স্মারকলিপিও দেয় উপজেলা প্রশাসনকে। ফলে, গত বছরের দরেই আলু সংরক্ষণের ভাড়া নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন হিমাগার কর্তৃপক্ষ।
মন্তব্য