১০ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ৪০৩টি আসনের জন্য নির্বাচনের প্রথম দফায় ৫৮টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়ে গেল। সামগ্রিকভাবে ভারতের রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের সব থেকে বড় এবং জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৮০টি আসন এই রাজ্যে। স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির মসনদ কার দখলে থাকবে, তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হিন্দি বলয়ের এ রাজ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে। অর্থাৎ আগামী দুই বছরে যে রাজ্যগুলোয় বিধানসভা নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনগুলোকে আগামী সাধারণ নির্বাচনের সেমিফাইনাল হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দেশের এবং উত্তরপ্রদেশের মসনদে বর্তমানে বিজেপির দখল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আদর করে বলেন, ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’। তিনি গত বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনি প্রচারেও ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তত্ত্ব খাড়া করে ভোটারদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই সরকার থাকলে উন্নয়নে গতি সঞ্চার হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা অবশ্য মোদির এই তত্ত্বকে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করে খারিজ করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনি প্রচারেও নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহরা ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ তত্ত্বের আধারে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাইছেন।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনি আচরণবিধি চালু হওয়ার আগে তিন মাস ধরে উত্তরপ্রদেশে নরেন্দ্র মোদি ও আদিত্যনাথ মহাসড়ক, নতুন বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের শিলান্যাস, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকারের’ যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এর জবাবে বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব বলেছেন, ‘যদি বহুমাত্রিক সূচক সম্পর্কিত ১২টি সূচকের ভিত্তিতে বলা হয়, তবে উত্তরপ্রদেশের মানবসম্পদ ভারতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার।’ উত্তরপ্রদেশের একটি বৃহৎ জনসংখ্যা সেই মৌলিক সুযোগ-সুবিধা এবং চাহিদা থেকে দূরে, যা অর্জন করতে পারলে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙার ক্ষমতা পাওয়া যায়। এর অর্থ, উত্তরপ্রদেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ এতটাই দরিদ্র যে তাদের পাশে সরকার না থাকলে তারা তাদের দারিদ্র্য ভাঙতে পারে না।
এমন দারিদ্র্যের মধ্যে লেখাপড়া শেখানো অনেকের পক্ষেই কঠিন। শিক্ষার অবস্থা খারাপ। নীতি আয়োগের ‘দ্য সাকসেস অফ আওয়ার স্কুল কোয়ালিটি ইনডেক্স’-এর রিপোর্ট অনুসারে, উত্তরপ্রদেশ ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্য। এটি সর্বনিম্ন স্তরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুসারে, সামগ্রিক পারফরম্যান্স স্কোর ছিল কেরলের জন্য ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং উত্তরপ্রদেশের জন্য ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ শিক্ষার অবস্থার উন্নতির জন্য উত্তরপ্রদেশকে এখনও মাটি ও আকাশের সমান দূরত্ব পেরোতে হবে।
দরিদ্র শিশুদের মিড-ডে মিলের বাজেট থেকে বড় হোর্ডিং লাগানোর ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। ক্ষুধায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যায় উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। করোনার সময় ওষুধের কালোবাজারিতে এক নম্বরে। বেসামরিক নাগরিকদের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে এক নম্বরে। গঙ্গা নদীর তীরে পুঁতে রাখা মরদেহ থেকে কাফন সরানোর ক্ষেত্রে এক নম্বরে। এই কঠিন বাস্তবের কোনো ব্যাখ্যা নেই বিজেপির কাছে। আর তাই প্রায় এক দশক আগের মুজাফফরনগর দাঙ্গার সত্য-মিথ্যা কাহিনি এর সব শীর্ষ নেতা তুলে ধরেছেন এবং বিরোধীদের ভোট দিলে ‘মুজাফ্ফরনগর আবার জ্বলবে’ এমন কথা বলে অমিত শাহ জনগণকে ভয় দেখাচ্ছেন। বিজেপির তারকা প্রচারকরা এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশান্তর, হয়রানির বিষয়টি জোরেশোরে তুলেছেন। বলা হচ্ছে, ২০১৭ সালে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলার বিস্তর উন্নতি হয়েছে।
বাস্তবটা কী? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ২০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ৫৬ হাজার নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যেখানে ২০১৮ সালে ৫৯ হাজার ৪৪৫টি কেস নথিভুক্ত হয়। বছরের পর বছর ধরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশে অপহরণের ২১ হাজার ৭১১টি, দাঙ্গার ৮ হাজার ৯০৮টি এবং ডাকাতির ৩ হাজার ২১৮টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সহিংস অপরাধের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের মতো শিশুদের বিরুদ্ধেও অপরাধ গত কয়েক বছরে বেড়েছে। ২০১৮ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের ১৯ হাজার ৯৩৬টি, ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১৪৫টি এবং ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৯টি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
এসব তথ্য তুলে ধরেই ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্বকে তুলোধোনা করছে সমাজবাদী পার্টি জোট, কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। এবার উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রেস একাই লড়ছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেই কংগ্রেসের আসনসংখ্যা তলানিতে ঠেকেছিল। সেবার জয়ী হওয়া দলের সাত বিধায়কের মধ্যে পাঁচজন গত পাঁচ বছরে দফায় দফায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে লড়ছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তাদুল মুসলিমিন বা মিম ভোটযুদ্ধে অংশ নিলেও কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোট কেটে তারা বিজেপি প্রার্থীকে সুবিধা পাইয়ে দিতে পারে।
মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে সমাজবাদী পার্টি নেতৃত্বাধীন জোটের। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জোটের প্রধান সঙ্গী রাষ্ট্রীয় লোকদল। জাঠ কৃষক ও মুসলমান অধ্যুষিত এই অঞ্চলের দিকে এবার বিশেষ নজর রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের। কারণ গত জানুয়ারিতে শেষ হওয়া ১৩ মাসের কৃষক আন্দোলন। ধর্মীয় বিভাজন ভুলে ওই আন্দোলনের শরিক ছিলেন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা, বিশেষ করে আখচাষিরা।
মনে রাখা প্রয়োজন, ২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০১৭-এর বিধানসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলে ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিয়ে বাজিমাত করেছিল বিজেপি। কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে গড়ে ওঠা গ্রামীণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক জোট কি বিজেপিকে হারাতে ভোট দেবে বিরোধীদের?
আজকের দিনের কোটি টাকার প্রশ্ন এটিই। কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাকেশ টিকাইত নির্বাচনে বিজেপিকে শাস্তি দেয়ার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ হিন্দু-মুসলমানের ম্যাচের স্টেডিয়াম নয়।’ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা রাজ্যজুড়ে ‘বিজেপিকে শাস্তি দাও’ প্রচার অব্যাহত রেখেছে। কৃষক নেতারা যখন সাংবাদিক সম্মেলন করে কৃষকদের শহীদ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তখন মোদি-যোগী-শাহের ক্ষমতার সবচেয়ে বর্বর, নিষ্ঠুর প্রতীক হিসেবে সেই চিত্র ফুটে উঠছে।
মোদি-শাহ-যোগী ত্রয়ী প্রতিনিয়ত মেরুকরণের এজেন্ডাকে তীক্ষ্ণ করতে তৎপর। যোগী উত্তরপ্রদেশের জনগণকে সতর্ক করে বলেছেন, তারা ভোট না দিলে উত্তরপ্রদেশ কাশ্মীর, কেরালা এবং বাংলায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।
বিজেপির নির্বাচনি ইশতেহারে বলা হয়েছে ,‘লাভ জিহাদের শাস্তি ন্যূনতম ১০ বছর এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা বৃদ্ধি করা হবে।’ উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিধানে বা ভারতীয় ফৌজদারি আইনে ‘লাভ জিহাদের’ কোনো সংজ্ঞা বা উল্লেখ নেই। ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘আমরা দেওবন্দে সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডো সেন্টার নির্মাণ সম্পূর্ণ করব। মিরাট, রামপুর, আজমগড়, কানপুর, বাহরাইচে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডো কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।’
পুরো ইশতেহারে সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় স্পষ্ট। জনগণের ইস্যুতে প্রথম দফায় যে অ-মেরুকরণ নির্বাচনের ধারা শুরু হয়েছে, তা দ্বিতীয় দফার মাধ্যমে পুরো নির্বাচনই চলবে বলে অনুমান করা যায়। নির্বাচন হবে সাত দফায়। তবে বিরোধী দলগুলোকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ যাতে একই রকম থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে ঝড় তোলা ‘খেলা হবে’ স্লোগান উত্তরপ্রদেশেও ঝড় তুলেছে ‘খেদা হৈবে’ রূপান্তরে। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, ভোটযুদ্ধ যতই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে, ততই পরিবর্তনের হাওয়া বৈশাখী ঝড়ে পরিণত হবে। বাস্তবেই তা হবে কি না জানা যাবে ১০ মার্চ।
আশিস গুপ্ত: সাংবাদিক, নয়াদিল্লি
আরও পড়ুন:যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসারাট নিউজে নিবন্ধ লিখেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে গত বছর বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। এতে প্রফেসর ইউনূস জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। আর নির্বাচন শেষেই তিনি রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে সেটির কোনো পদেই থাকবেন না বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ড. ইউনূস লিখেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করেছি : জাতীয় নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে। এরপর যে সরকার আসবে সেখানে নির্বাচিত বা নিযুক্ত করা কোনো পদে আমি থাকব না।’
তিনি বলেছেন, ‘আমার সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সঙ্গে তাদের পরিকল্পনাগুলো বলতে পারবে। আমাদের মিশন হলো, সব বৈধ ভোটার যেন তাদের ভোট দিতে পারে, যারা প্রবাসে আছেন তারাও। এটি একটি বড় কাজ। কিন্তু আমরা কাজটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
প্রফেসর ইউনূসের নিবন্ধটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
এক বছর আগে, এই মাসেই বাংলাদেশের হাজার হাজার সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থী, যাদের পেছনে ছিল সমাজের সব স্তরের অগণিত মানুষের সমর্থন, আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যা শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল, তার মাধ্যমেই তারা একজন স্বৈরাচারকে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।
এরপর যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ছাত্রনেতারা আমাকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানায়। এই সরকারের দায়িত্ব ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরি করা। শুরুতে আমি রাজি হইনি। কিন্তু যখন তারা জোর করল, তখন আমি তরুণদের জীবন উৎস্বর্গের কথা ভাবলাম, আমি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা পরিষেদের সঙ্গে আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করি।
এই গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা থেকে। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এই বিপ্লব তরুণদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে, যা দেখায় কীভাবে তারা মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো—যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্য—মোকাবিলার জন্য এগিয়ে আসতে পারে।
আমরা ভাগ্যবান যে তারা ‘তাদের পালা আসার জন্য’ অপেক্ষা করেনি। যখন সভ্যতা অনেক দিক থেকে ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে আমাদের উত্তরণের একটি স্পষ্ট প্রমাণ ছিল যখন দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকী বাংলাদেশকে তাদের ‘২০২৪ সালের সেরা দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আমরা তখন অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং চুরি যাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ উদ্ধারে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমরা তখনো বুঝতে পারিনি বিশ্ব আমাদের এই অগ্রগতিকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করছে। ডেসারেট নিউজ আমাদের এই যাত্রার চমৎকার কাভারেজ দিয়েছে, যা আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি।
আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল গণঅভ্যুত্থানে যারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল এবং যারা গুরুতর আহত হয়েছিল—সেই হাজার হাজার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এরসঙ্গে আমরা বিগত সরকার ও তার সহযোগীদের লুট করা অর্থ উদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যখন আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন অব্যবস্থার মাত্রা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছিল।
সরকারি কর্মচারীরা, যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য না দেখানোর কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তারা ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন।
ধীরে ধীরে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। যেসব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারের প্রতিরোধ করেছিল, তাদের পাশাপাশি নতুন গঠিত দলগুলোও নতুন ধারণা, শক্তি এবং কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালাতে দেয়নি, তারা তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে।
আমি এটি স্পষ্ট করে দিয়েছি: আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি এরপরের সরকারের কোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত পদে থাকব না।
আমাদের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকসহ সব যোগ্য নাগরিককে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি বিশাল কাজ। কিন্তু আমরা এটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন এনেছি। যেন আমাদের প্রতিবেশী এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক জোরদার করা যায়।
বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির একটি মূল কেন্দ্র হতে পারে এবং হওয়া উচিতও। আমরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ।
রুবিওরে সঙ্গে সম্প্রতি আমার একটি ফলপ্রসূ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে, যা আমাদের উভয় দেশের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক ছিল।
যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী এবং জাতিসংঘও আমাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমরা এই পথে একা নই।
নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের নিয়ে একটি ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছি। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সাংবিধানিক সংশোধনী আনা। যা এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যাতে বাংলাদেশ আর কখনো স্বৈরাচারী শাসনে ফিরে না যায়।
বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত এমন একটি দেশে পরিণত হয় যেখানে দেশের সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। তবে তা হবে লাখ লাখ বাংলাদেশির দৃঢ়তা, কল্পনা এবং সাহসের ফল।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে যারা আছেন তাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে। তারাই আমাদের সর্বোত্তম আশা—এবং সম্ভবত আমাদের শেষ আশা।
দেশে ‘একাত্তরকে ভুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্মানে মতবিনিময় অনুষ্ঠান এই আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের কথা বারবার স্মরণ করতে চাই। এজন্য চাই যে, ১৯৭১ সাল আমাকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছিল, ভূ-খণ্ড দিয়েছিল, আমাকে একটা স্বাধীন সত্ত্বা দিয়েছিল এবং সেজন্য আজকে আমার অস্তিত্ব আছে, আমি টিকে আছি। আমি স্মরণ করতে চাই, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের শহীদদের। কারণ তারা আমাদের একটা গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এই দুইটা জিনিসই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আজকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা আছে, একাত্তরকে ভুলিয়ে দেওয়ার। এটার বিরুদ্ধে দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ২৪’এর জুলাই-আগস্ট যেভাবে সত্য, ঠিক একইভাবে সত্য কিন্তু একাত্তরের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন কে? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা।’
তিনি বলেন, ‘আজকে নতুন করে একটা কথা উঠছে, ষড়যন্ত্র চলছে যে, আপনার বাংলাদেশে এখানে এক ধরনের উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এই উগ্রবাদকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের বাংলাদেশের যে আত্মা সেই অস্তিত্ব আমাদের রক্ষা পাবে না। এই কথাটা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমি কথাটা আজকে এজন্য আরও বেশি করে বলছি যে, এইখানে বিভক্তি বিভাজনের রাজনীতি কেউ করবেন না, অতীতে যা হয়েছে হয়েছে। এখন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য, বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য, বাংলাদেশকে সামনে নেওয়ার জন্য, বাংলাদেশকে আরও উন্নত করার জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর যারা আমাদের ভুল বুঝিয়ে আমাদের ভোট নিয়ে দেশ শাসন করেছে তারা ১৫ বছর আমাদের বন্ধু হিসেবে মনে করেননি। তারা মনে করেছেন প্রজা হিসেবে। আমাদের ওপর অত্যাচার করেছেন, নির্যাতন করেছেন, আমাদের দেশের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে গিয়েছিলাম। ব্যাংককে গিয়ে আমি আমার বন্ধুদের কাছে শুনলাম যে, এখন ব্যাংককে সবচাইতে যেগুলো অভিজাত এলাকা সেই এলাকাগুলোতে বাড়ি ভাড়ার ধুম পড়ে গেছে। সেই বাড়িগুলো ভাড়া করছেন আওয়ামী লীগের বিতাড়িত নেতারা। তারা যে গাড়ি কিনছেন সেই গাড়িগুলো কোনটাই ২ কোটি, ৩ কোটি টাকার কম নয়। এসব টাকা কোত্থেকে গেল? এই দেশের সম্পদকে তারা পাচার করেছেন।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, নতুন করে কিছু বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক যে কাঠামো সে কাঠামো ভেঙে ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এ দেশের সম্পদকে লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। প্রায় ৮৮ লাখ কোটি টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছে। আমাদের সম্পদ বলতে আর কিছু নেই, সব পাচার হয়ে গেছে। আমাকে একজন অর্থনীতিবিদ জিজ্ঞেস করছিলেন, দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে যে, এর পর তোমরাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে। জনগণ তোমাদের ওপরে আস্থা রাখবে। তো তোমরা দেশ চালাবে কোত্থেকে? কারণ টাকা তো সব পাচার হয়ে গেছে অর্থাৎ আমাদের দেশের অর্থনীতির অবস্থা কী করুণ করেছে সেই জিনিসটাই শুধু আমি আপনাদের বললাম।’
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি) পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য উপযোগী নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও আলোচনা সভায় তারেক রহমান এ কথাগুলো বলেন। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আয়োজিত এই সভায় যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে তারেক রহমান বলেন, ‘কাকে কিংবা কোন ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানো হচ্ছে, অবশ্যই সেটি জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত যে পিআর পদ্ধতি, এই পিআর পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা হচ্ছে, জনগণের সেটি জানার পরিষ্কার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি জাতীয় সংসদে বা সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে অবশ্যই তাদের জনগণের মুখোমুখি হয়ে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে জনগণের রায় অর্জন করা জরুরি।’
পিআর পদ্ধতি এবং আরও দুয়েকটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ভিন্নমত রয়েছে, প্রতিটি বিষয়ই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘যারা আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছেন, এর মাধ্যমে আপনারা হয়তো নিজেদের অজান্তেই গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছেন। একই সঙ্গে পতিত পরাজিত পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের পুনর্বাসনের পথও হয়তো সুগম হচ্ছে।’
আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বক্তব্য বা নিত্যনতুন শর্ত জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে, এই ভয়ে পলাতক স্বৈরাচার ‘বিএনপির বিজয় ঠেকাও’– এর মতো অপরাজনীতি চালু করেছিল। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সহযোদ্ধা কিছু ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আচরণেও সেই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যারা বিএনপির বিজয় ঠেকানোর জন্য নানা অপকৌশল বা শর্তের বেড়াজালের আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করুন। জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রাখুন। বিএনপির বিজয় যদি জনগণ দিয়েই থাকে, সেই বিজয় ঠেকাতে গিয়ে জনগণের রায় প্রদানের পথ রুদ্ধ করবেন না।’
তারেক রহমান বলেন, প্রতিটি বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হতে হবে, এমন নয়। তবে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো বা দেশকে তাবেদারমুক্ত রাখার জন্য স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে অবশ্যই ঐকমত্য ও ঐক্যবদ্ধ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আমাদের সামনে একটি বিশাল বড় সুযোগ। সারা দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই ও বোনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আগামী নির্বাচনে বিএনপি আপনাদের সমর্থন এবং আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা চায়।’
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব হামলার পেছনে ছিল অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা অবৈধ লোভ। ধর্মীয় কারণে এসব হামলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘কোনো কারণেই যেন কারও ওপর হামলা বা অবিচার না হয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব।’
বিএনপির আয়োজনে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সারাদেশ থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন।
সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী প্রমুখ।
সরকারি এবং কূটনীতিক পাসপোর্টে পারস্পারিক ভিসা অব্যাহতি সুবিধা পেতে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।
প্রেস সচিব বলেন, ‘পাকিস্তানের মতো এ রকম চুক্তি আমরা আরও ৩১টি দেশের সঙ্গে করেছি। এই চুক্তি পাঁচ বছরের জন্য করা হবে । এর ফলে যারা অফিসিয়াল পাসপোর্ট এবং কূটনীতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন, তারা এখন বিনা ভিসায় পাকিস্তান সফর করতে পারবেন। একইভাবে পাকিস্তানের যারা অফিসিয়াল এবং কূটনীতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন— তারাও বাংলাদেশে সফর করতে পারবেন কোন ভিসা ছাড়াই। এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস।’
উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের সম্মতি পাওয়া গেছে।
রাজধানীর রমনা থানা এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলায় মির্জা ফখরুলসহ ৬৫ জনকে অব্যাহতি দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতি প্রদান করেন।
অব্যাহতিপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্যরা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, বরকত উল্লাহ বুলু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন ও বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম প্রমুখ।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপি’র পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রমনা থানা এলাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলটির নেতাকর্মীরা আসেন। এ সময় তারা যানবাহনে ক্ষতিসাধন ও পুলিশের কাজে বাধা প্রদান করেন।
এ ঘটনায় একই বছরের ৩১ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে রমনা থানার এসআই আউয়াল এই মামলা করেন।
২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মামুন হাসান আদালতে পৃথক দুটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে মির্জা ফখরুলসহ ৬৫ জনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুজ্জামান চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে তাদের অব্যাহতি দেন। একই সঙ্গে বিস্ফোরণ আইনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের আজ বিকেলে যোগদান করেছেন।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের ১৯৯৪ সালে সহকারী কমিশনার পদে চাকরিতে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস ও থাইল্যান্ডে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, চীন, ভিয়েতনাম, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি কাজে ভ্রমণ করেছেন।
নতুন সচিব হিসেবে যোগদানের পর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এবং কুশল বিনিময় করেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (গ্রেড-১) হিসেবে দায়িত্ব পালনরত আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরকে ২০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদায়ন করা হয়।
আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের ব্যবস্থা (UNFPA,UN Women, ILO, UNDP, UNESCO) আজ একটি ইয়ুথ ভয়েস মেকানিজম (YVM) এর ডিজাইন ফেইজ চালু করেছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মাহবুব-উল-আলমের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য নীতি উন্নয়ন এবং শাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের তরুণদের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরদার করা, দেশের ভবিষ্যত গঠনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। উক্ত অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ ব্যবস্থার (UNFPA, UN Women, ILO, UNDP, UNESCO) প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম বলেন "ইয়ুথ ভয়েস মেকানিজমকে সফল করার জন্য আমরা জাতিসংঘ ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের তরুণদের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ" ।"এই উদ্যোগ আমাদের তরুণদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এবং নিশ্চিত করবে যে তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের নীতি ও কর্মসূচিতে প্রতিফলিত হয়।"
সচিব বলেন, এই প্রজন্ম আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং গতিশীল একটি শক্তিশালী শক্তি যা আমাদের সমৃদ্ধির দিকে চালিত করে। বাংলাদেশী তরুণরা অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা এবং নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছে। আনুষ্ঠানিক শাসন কাঠামোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব সীমিত রয়ে গেছে, বিশেষ করে তরুণী এবং প্রান্তিক, আদিবাসী, গ্রামীণ এবং জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য। তিনি আরও বলেন, ইয়ুথ ভয়েস মেকানিজমের লক্ষ্য এই পরিবর্তন আনা। জাতিসংঘের সহায়তায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে, এটি যুব সম্পৃক্ততার জন্য একটি কাঠামোগত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এটি জরিপ, কর্মশালা, ফোকাস গ্রুপ এবং একটি যুব-নেতৃত্বাধীন স্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে তরুণদের দ্বারা সহ-পরিকল্পিত।
“বাংলাদেশ যখন একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে প্রবেশ করছে, তখন যুব কণ্ঠস্বর ব্যবস্থা তরুণদের ন্যায়বিচার, সমতার জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপনের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যাতে তারা আজ এবং ভবিষ্যতে তাদের প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলিতে তাদের মতামত ভাগ করে নিতে পারে। গত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সময় প্রধান উপদেষ্টা ড। মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে এই ব্যবস্থাটি সাড়া দেয়," বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, "শান্তিপূর্ণ এবং কাঠামোগত উপায়ে অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, আমরা তরুণদের তাদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে অবদান রাখতে এবং তাদের দেশের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ভবিষ্যত গঠনের ক্ষমতায়ন করছি।"
উল্লেখ্য, YVM তরুণদের, বিশেষ করে প্রান্তিক, গ্রামীণ এবং অবহেলিত সম্প্রদায়ের, সরকারি অংশীদারদের সাথে সম্পৃক্ত হতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদান রাখার জন্য একটি টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চ্যানেল তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিক্রিয়ায় এই উদ্যোগটি এসেছে এবং বাংলাদেশ জুড়ে অগ্রগতি এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃতি দেয়।
নকশা পর্বে একটি মিশ্র-পদ্ধতিগত অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, যার মধ্যে বিভাগীয় কর্মশালা, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার এবং জাতীয় যুব জরিপ অন্তর্ভুক্ত থাকবে যাতে একটি যুব কণ্ঠস্বর ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করতে পারে তা ডিজাইন করা যায়। এই পদ্ধতিগুলি নিশ্চিত করবে যে এই ব্যবস্থাটি সারা দেশের তরুণদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা এবং ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
YVM একটি বহুমুখী পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করবে যা ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংলাপ এবং পরামর্শের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্থাপন, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সংগ্রহের জন্য আঞ্চলিক কর্মশালা আয়োজন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে এই কার্যক্রমগুলির সমন্বয় করবে, সহযোগিতা সহজতর করার জন্য এবং YVM-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যুব সংগঠন, সরকারি সংস্থা এবং জাতিসংঘের অংশীদারদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
মন্তব্য