তিনি কারাগারে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবে, মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে নন্দিত হয়ে- হ্যাঁ, এভাবেই বলা যায়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে গভীর রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসা থেকে। তিনি দুপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে ছিলেন ৬ দফার সমর্থনে আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ প্রদানের জন্য। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের এক সভার আয়োজন হয়েছিল।
উপস্থিত বেশিরভাগ নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের। শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকদিন আগে বন্দি হয়েছিলেন। তবে জামিনে মুক্তি পান। তার কাছে বন্দিজীবন নতুন নয়। বার বার তাকে আটক করা হয়। তিনি যেন বিরোধী নেতাদের সভায় যোগদানের জন্য লাহোর যান, সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা চেয়েছেন। তারা জানতেন যে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলে আওয়ামী লীগকে দরকার, শেখ মুজিবুর রহমানকে দরকার। জনগণ তাকে মানে।
শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর গেলেন, পকেটে তার স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা কর্মসূচি।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবি বার বার সামনে এনেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বন্দি। তাকে আটক করা হয়েছিল ২৬ মাস আগে ১৯৫০ সালের প্রথম দিনে। বন্দি হওয়ার আগে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সংগঠিত করার জন্য লাহোর এবং অন্যান্য নগরীতে। ফেরার পরেই বন্দি।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির লাহোর যাত্রা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে ৬ দফার কারণে। এর আগেও তিনি এবং আরও অনেক নেতা স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২১ দফার ১৯ নম্বর দফা ছিল স্বায়ত্তশাসন। তবে এতে কেন্দ্রের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ রাখার কথা ছিল।
৬ দফায় বলা হয় অর্থ থাকবে প্রদেশের হাতে। শুল্ক-কর ধার্য করবে প্রদেশ এবং আদায়ও করবে তারাই। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার জন্য তা থেকে একটি অংশ দেয়া হবে। পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য থাকবে দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হবে এবং তা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নৌবাহিনীর সদর দপ্তর নিয়ে আসতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে।
পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব নেতা লাহোরে সভা ডেকেছিলেন, তাদের ইচ্ছে ছিল একটি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হবে- সর্বজনীন ভোটাধিকার। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের এজেন্ডাও থাকতে হবে আন্দোলনের কর্মসূচিতে। আর এই স্বায়ত্তশাসন হতে হবে ৬ দফার ভিত্তিতে।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় কোনো নেতাই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা খর্ব করার এ কর্মসূচি গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। কেউ কেউ তো বলেই দিলেন- এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পরিণত হবে শিথিল ফেডারেশনে। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর যাত্রার আগে ঢাকায় তার বাসায় ৬ দফা দেখিয়ে বলেছিলেন- ‘শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেই। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আইয়ুব খানকে বিব্রত না করার নীতি নিয়ে চলছেন। এখন আপনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা। লাহোরের সভায় আপনিই স্বায়ত্তশাসনের এই দাবি উপস্থাপন করলে ভালো হবে।’
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং এইচএম এরশাদের আমলে মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর বোনের ছেলে) আমাকে বলেছেন, ‘আতাউর রহমান খানকে ৬ দফা উত্থাপনের অনুরোধ করা হলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন- এটা করা হলে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। আমি এটা করব না। আপনিও করবেন না।’
লাহোরে বিরোধী নেতাদের বৈঠকে ৬ দফা নিয়ে আলোচনা করতে অন্য নেতারা রাজি না হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠক বর্জন করেন। পরের কয়েকটি দিন তিনি লাহোরে সংবাদকর্মী এবং আইনজীবীদের কাছে এ কর্মসূচি তুলে ধরেন। আইয়ুব খান এবং তার মন্ত্রীরা এ কর্মসূচির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে মুহূর্ত দেরি করেননি। তাকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন শোনা যেতে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন, ঢাকায় গেলে গ্রেপ্তার করা হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফেরেন ১১ ফেব্রুয়ারি। বিমানবন্দরেই সংবাদকর্মীরা দলে দলে হাজির হন। পর দিন ৬ দফা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ব্যাপক প্রচার পায়। তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বান করেন। কেউ কেউ বলেন, আগে কেন কমিটিতে এ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়নি? কেউবা বলেন, এ তো পাকিস্তান ভাঙার কর্মসূচি। শেরে বাংলা ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য লাহোর গিয়েছিলেন। আর আপনি সেই নগরীতেই এমন প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, যা বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান থাকবে না।
মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ৬ দফা অনুমোদন পায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কর্মসূচি মানতে সম্মত হননি। কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান বের হয়ে পড়েন জেলা ও মহকুমা সফরে।
সর্বত্র বিপুল সাড়া। পাশাপাশি চলে গ্রেপ্তার অভিযান। কয়েকটি জেলায় তাকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পান। মুক্ত হয়েই আবার জনসভা। কিন্তু ৮ মে (১৯৬৬) নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া মাঠে জনসভার পর রাতে যে গ্রেপ্তার হলেন, মুক্তি পেলেন প্রায় তিন বছর পর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তাকে মুক্ত করার জন্য ছাত্র-জনতা রাজপথে নামে। ১১ দফা কর্মসূচি প্রণীত হয়, যাতে ৬ দফা পুরোপুরি স্থান পায়। আরেকটি দাবি ছিল সব রাজবন্দির মুক্তি। হরতাল-অবরোধ-ঘেরাওয়ে উত্তাল ছিল সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান।
৮ মে গভীর রাতে গ্রেপ্তারের পর তিনি বন্দি থাকেন বিনাবিচারে। পুরোনো মামলায় জেলও হয়। একপর্যায়ে করা হয় সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার অভিযোগে মামলা। কিন্তু তিনি নির্ভীক। তাকে ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
কোথায় তাকে নেয়া হয়েছে, সেটা কেউ জানতে পারেনি, এমনকি পরিবারের সদস্যরাও। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ছয় মাস পর জুনে পরিবারের সদস্যরা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়েরের কথা জানতে পারে। ফজিলাতুন নেছা মুজিব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে তাকে দেখতে পান। শুরু করেন মামলা মোকাবিলার নতুন পর্যায়ের সংগ্রাম। পাশাপাশি গড়ে তোলেন আন্দোলন। এর পরিণতিতেই ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বন্দি মুক্তি পান। একইসঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে আটক সব রাজবন্দি মুক্তিলাভ করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রজনতার বিশাল সমাবেশে তাকে বরণ করে নেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। তিনি অঙ্গীকার করেন- ‘বাঙালির মুক্তি আনবই। এ জন্য আবার যদি কারাগারে যেতে হয়, এমনকি জীবন দিতে হয় আমি প্রস্তুত।’ তিনি কথা রেখেছেন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক-কলাম লেখক, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।
আরও পড়ুন:বাজারে স্থিতিশীলতা নেই। বাজারে যাওয়ার আগে কোন জিনিসের দাম কত তা ঠিক করে বসানো যাবে না। আমরা শৈশবে দেখেছি আমাদের বাবা-কাকারা আমাদের মা-কাকিদের কাছে কী আছে, কী নেই সব শুনে তালিকা তৈরি করতেন। কারণ তখন বাজার এত হাতের কাছে ছিল না। তাই হাটবারে গিয়ে এক সপ্তাহের বাজার করে আসত। তালিকা করার সময় গুণে গুণে হিসাব করত কী আছে কী নেই। দাম তাদের মুখস্থ ছিল। তাই পণ্যের সামনে দাম বসিয়ে হয় টাকা অথবা ওই পরিমাণ মূল্যের সবজি বা পাট (তখনকার স্বর্ণসূত্র) নিয়ে বাজারে বিক্রি করে সপ্তাহের সাত-সদাই কিনে আনত। এখন আর সেদিন নেই। বাজারে কবে কোন জিনিসের মূল্য কত হবে সেটা বাজারে না গিয়ে বলার উপায় নেই।
করোনায় অর্থনীতির ক্ষত শুকিয়ে উঠতে না উঠতেই রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্যের বাজার চড়া হতে শুরু করল। সরকার বলেছিল, বাজারে কেউ বেশি দাম রাখতে পারবে না, টাস্কফোর্স নিয়োগ করা হবে। চল্লিশটি পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেকথা শোনেনি। রোজা রেখে মানুষ সাধ্যাতীত দামে পণ্য কিনেছে। অর্থাৎ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং সারা বিশ্বের সয়াবিন মূল্য টপকিয়ে একদিনে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে জনগণের কথা না ভেবেই। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ছে সেই এক বুলি দিয়ে সয়াবিনের অতিরিক্ত মূল্যকে জায়েজ করা হলেও দেখা গেল বাজারে সয়াবিন নেই। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশের মানুষকে জিম্মি করেছে। সরকার পরে মজুত তেল বের করল।
বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। কিন্তু তারপরও তেলের বাজার অস্থিতিশীলই রইল। ভুলের মাশুল কীভাবে পূরণ হলো আমরা বুঝলাম না। বাজারে এখন এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না, যার দাম স্থিতিশীল বা কমেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। এর মধ্যে আমদানি করা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মসলা পণ্য, মাছ-মাংস, ডিম, শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ, চিনি এমনকি লবণের দামও বেড়েছে।
পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের পণ্যের দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি এমন- সপ্তাহ ও মাসের ব্যবধানে এই তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে পণ্য কিনতে ভোক্তার অবস্থা নাভিশ্বাস। এতে বেশি ভোগান্তিতে আছে নিম্ন আয়ের ও খেটে খাওয়া মানুষ। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে এক শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে। সারা বিশ্বের মতো দেশের বাজারেও প্রভাব পড়ছে, এটাই স্বাভাবিক। এসব কথা বলেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন জাগে বিশ্ববাজার থেকে যেসব পণ্য আনা হয় তার নয় দাম বাড়ল। কিন্তু তবে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, তার দাম কেন বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে? আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এখন বাড়লে এই দামের এলসি করা পণ্য দেশে আসতে আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। কিন্তু বিক্রেতারা তো আকাশের দিকে তাকিয়ে দাম বাড়ায়, যার কোনো ভিত্তি নেই। সেটার সুরাহা হবে কীসে?
এমনকি তদারকি সংস্থা এ বিষয়টি সামনে রেখে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায়ও আনেনি। ফলে বিক্রেতারা কারসাজি করতে সাহস পাচ্ছে। তাই বাজার তদারকি আরও জোরদার না করায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমাদের সবজিতে, চালে বিশ্ববাজারের কত প্রভাব পড়েছে? দাম কি সে অনুপাতে আছে? বাজারের দাম কমাতে আইন প্রযোগ করার কোনো লক্ষণ নেই। ১ হাজার লিটার তেল মজুত করার শাস্তি যদি হয় একলাখ টাকা তাহলে মজুতদারি বন্ধ হবে কি?
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে পণ্য নিয়ে কারসাজি রোধে বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এবার অসাধু পন্থায় পণ্যের দাম বাড়ালে জরিমানার সঙ্গে জেলে দেয়া হবে। জেলে কি আসলেই দেয়া হবে না এ শুধু কথার কথা এ নিয়ে ভিন্ন ভাবনা আছে।
দুই.
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম। গোপালগঞ্জ যেতে ফরিদপুর অতিক্রম করলেই চোখে পড়ে রাস্তার দুপাশে পাকা ধান সোনালি বরন হয়ে আছে। চোখ জুড়ানো মন ভুলানো সে দৃশ্য। গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়া যাওয়ার পথে চোখে দৃশ্যমান হলো বিলভরা ধান। কিন্তু কাটার লোক নেই। মাঝে মধ্যে ২/৪ জন কৃষকের দেখা মেলে যারা ধান কেটে নিজে ও ছোট বাচ্চাদেরে দিয়ে ধান বাড়িতে নেয়ার চেষ্টা করছে। কথা বলে জানা গেল এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ৫০/৬০ মণ ধান হয়েছে। প্রতি বিঘার ধান কাটতে ১০ হাজার টাকা বললেও কেউ কাটতে আসছে না। আগের মতো দক্ষিণাঞ্চল থেকেও ধান কাটতে কেউ আসে না। কারণ সড়ক উন্নয়ন ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। ধান কেটে যে টাকা পাওয়া যায়, তার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশায় আয় বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তারা কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
আগে সব ফসল ফলালেও দাম পেত না। ফলে ফসল চাষ করতে গিয়ে একদিকে এনজিওর লোন নিতে হতো। আর সেই কিস্তি শোধ করতে মহাজনের কাছ থেকে সুদও আনতে হতো। তারা পড়তো শাখের করাতের মধ্যে। কৃষিঋণ কৃষকের হাতে সরাসরি দেয় না। দালাল লাগে। দালাল ও ব্যাংকে টাকা দিয়ে ঋণের সমুদয় টাকা আর ঘরে যায় না। কিন্তু সুদ ৫ হাজারের। সবদিকে সংকট। এরপর পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়। ঋণখেলাপিদের বাঁধে না বাঁধে কৃষকদের। তাছাড়া অন্যের জমিতে কাজ করলে কিছু বাজে কথা শুনতেই হতো। মন খারাপ হতো। সঠিক মজুরি পাওয়া যেত না। এখন গাড়ি চালাই, সম্মান আছে সুখও আছে।
কৃষকই জানে ফসল ফলানোর নিয়ম। তাই কৃষকদের সমিতি করে ছোট কোনো পরিবহন কিনে দিলে এরা বাজারজাত করলে সঠিক মূল্য পেলে কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এমনটা হলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার অর্জনটা রক্ষা পাবে। যে দেশে ধান ছিটালে ফসল ফলে থাকে সেদেশে খাদ্য আমদানির কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না।
শুধু কৃষি খাতের দিকে নজর দিলে এবং এখনও যে প্রজন্ম কৃষিকাজ জানে তাদের কাজে লাগালে ফসল ফলবে। আবার দেশ হবে প্রকৃত অর্থে কৃষিপ্রধান। কৃষক তার ফসল নিজে বাজারে নিলে বাজার অস্থিতিশীল হবে না। বাকিটা সামলাতে সরকারের বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে জোরদার করতে হবে। সবাই দেশপ্রেম মাথায় নিয়ে কাজ করলে আমাদের দেশে সার্বিকভাবে সংকট হওয়ার কথা নয়।
এখন চলছে বোরো মৌসুম। এসময়ে চালের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু কিছু মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার বড় কিছু কোম্পানিও ধান মজুত করছে। যে কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাড়ছে না শুধু আয়। চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংস সব পণ্যের দাম বাড়তি। সাবান-ডিটারজেন্টসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ছেই। এই বাড়তি মূল্য কেন? কারা বাড়ায় এই দাম। সাধারণ মানুষ সবই জানা ও বোঝার কথা। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক তৈরি না হলে এই সংকট নিরসন সম্ভব না।
তিন.
গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেক জায়গায় এখন মানুষের একবেলা খেতেই কষ্ট হচ্ছে এবং সারা বিশ্বেই এই অবস্থা বিরাজমান। তারপরও তার সরকার এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হলেও আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই। কারণ উৎপাদন যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি শিপমেন্ট ব্যয় বেড়ে গেছে। যে কারণে দেশের ভেতর একটু মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে এটুকু অনুরোধ করব যদি একটু সাশ্রয়ী হন, মিতব্যয়ী হন বা সব ব্যবহারে যদি একটু সতর্ক হন তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ কিন্তু কথা হলো আমাদের দেশের যে শ্রেণিটা হঠাৎ করে বিত্তবান হয়ে গেছে, পিকে হালদার, ডেসটিনির রফিকুল আমিনদের গোত্রের লোক বা সিন্ডিকেটের লোকজন ছাড়া এখন কারো এমন সাধ্য নেই যে অমিতব্যয়ী হবে। বরং এই মুহূর্তে ট্রাক সেল বন্ধের সিদ্ধান্ত তুলে নেয়া হলে বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কিছু থাকবে না। পক্ষান্তরে মধ্যবিত্তরাই দেশের প্রাণ, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। করোনায়ও এরা প্রণোদনা পায়নি। বঞ্চনায় এই শ্রেণিটি ধুঁকছে। সব কিছু ভেবে ব্যবস্থা নিলে আমাদের সংকট নিরসনযোগ্য বলে মনে হয়।
লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
আরও পড়ুন:অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপটা ব্যাগ থেকে বের করে মনিটরটা সোজা করে টেবিলে রাখলেন। ল্যাপটপটা নীরবে বসে থাকল টেবিলের উপর। শাটডাউন। খোলা শুধু টপ কভারটা। আপনি জামাকাপড় বদলালেন। এরপর বাথরুমে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বসলেন বিছানায়। বন্ধ ঘরে কেউ নেই। কেউ দেখছে না আপনার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো। কিন্তু ল্যাপটপের মনিটর প্যানেলের ঠিক মাঝখানের ছোট্ট লেন্সটা? আপনি জানেন না। ওটা কাজ করে যাচ্ছে। লাগাতার। কানেকশন? দরকার নেই। লেন্সটা খোলা থাকলেই যথেষ্ট। ক্যামেরা চলছে, কেউ না কেউ ওপার থেকে দেখছে আপনার ঘর, আপনাকে, আপনার পরিবারকে।
এক পরিচিতজনের সঙ্গে আলাপ করছেন। ফ্ল্যাট কিনতে চান। তার আগে প্রয়োজনীয় কিছু আলোচনা। কোন এলাকায় কিনলে ভালো হয়, কোথায় কত দাম চলছে, লোন নিতে গেলে কী কী করতে হবে। প্রায় বিশ মিনিটের আলোচনা। মোবাইল ফোনটা পাশে রাখা। ইন্টারনেট, জিপিএস— সব বন্ধ। আলাপ-আলোচনা সেরে ফোনের নেট অন করলেন। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে জমে থাকা মেসেজ চেক করেই গেলেন ফেসবুকে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে কয়েকটা পোস্টের পরই এল একটা বিজ্ঞাপন, ফ্ল্যাটের। খান কয়েক পোস্টের পর আবার। ফোন বন্ধ থাকলেইবা কী! মাইক্রোফোন চলছে। কেউ না কেউ শুনছে। বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে। দেখছেও, ক্যামেরা দিয়ে।
বারো বছর আগে ইউরোপে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে কথাটা বলেছিলেন ব্রুস স্নেইয়ার— আমরাই ফেসবুকের প্রোডাক্ট, পণ্য, যার সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া! সহজ-সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করলে ‘যা বিক্রি হয়’ সেটাই প্রোডাক্ট। অর্থাৎ চাল-ডাল, ফোন-বাড়ি, গাড়ি, এই সবেরই প্রোডাক্ট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা, মানে আম জনতা কেন খামাখা প্রোডাক্ট হয়ে গেলাম? গোড়ায় যাওয়া যাক। অ্যাপ ইনস্টল করলেন। প্রথমেই অ্যাপটি কী প্রশ্ন করবে? আমি কি আপনার ফোনের ক্যামেরা, কনট্যাক্ট, মেসেজ ইত্যাদি ‘ইউজ’ করতে পারি? আপনি সম্মতি দিলে সেই অ্যাপ চালু হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সে ঢুকে পড়বে আপনার ব্যক্তিগত জগতে। বোঝার চেষ্টা করবে, আপনার চাহিদাটা ঠিক কী। এটাই আজকের বাজার অর্থনীতির ভিত! রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিসার্স করার প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে। সেই জায়গা নিয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)।
ফেসবুকে একটার পর একটা পোস্ট পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন আপনি। হঠাৎ ভালো লাগল একটি। দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখলেন সেটি। ‘লাইক’ বোতামে টিপলেন। আপনি জানতেও পারলেন না যে, সেটা ট্র্যাক হয়ে গিয়েছে। কেউ মেপে নিয়েছে, কত সময় আপনি সেই পোস্টের জন্য খরচ করেছেন। কোন ধরনের পোস্টে আপনার লাইক বেশি পড়ছে। এরপর থেকে সেই ধরনের পোস্টই কিন্তু আপনার কাছে বেশি আসবে। ধীরে ধীরে ওই ‘ভালোলাগা’য় আপনি আসক্ত হয়ে পড়বেন। ঠিক এমনটাই ‘ওরা’ চায়, যারা টাকা ছড়াচ্ছে। ইন্টারনেট-ভাষায় রেকমেন্ডেশন। নিজের অজান্তেই আপনি ঢুকে পড়বেন অদ্ভুত এক বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। কার নজরে আপনি? কোনো ব্যক্তি নয়। নিছক সার্ভার, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। যা ট্র্যাক করে আপনাকে। লাগাতার। আপনার কনট্যাক্ট লিস্ট, ই-মেল, ব্যাঙ্ক ডিটেইলস, ছবির গ্যালারি, মেসেজ, সব কিছু। একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেসমেন্ট, একটি দ্বীপ, যেখানে শত শত একর এলাকায় ইনস্টল করা রয়েছে সেই সব সার্ভার। একটির সঙ্গে আর একটি যুক্ত। ইন্টার কানেকটেড। প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল।
সবটাই হচ্ছে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। আপনার আসক্তিকে এদের ভাষায় বলা হচ্ছে এনগেজমেন্ট। সেটা বাড়লে গ্রোথ। আর সেখান থেকেই হচ্ছে উপার্জন। আপনার নয়। আপনার জানাশোনার বাইরে বহু লোকের। টাকা লুকিয়ে রয়েছে এখানেই। আপনার-আমার ডেটার মধ্যে। আপনি ভাবছেন, সবটাই তো ফ্রি। কিন্তু না। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামকে টাকা দিচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতারা। বদলে তারা কী চাইছে? নিশ্চয়তা। আপনাকে সম্মোহিত করার। সেটাও বিলক্ষণ সম্ভব। তার জন্য আপনার সব ডেটা থাকতে হবে। যা সোশ্যাল মাধ্যম, গুগল, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার, এদের সবার কাছে আছে। তথ্যই এখন উপার্জনের খনি। যার কাছে যত বেশি ডেটা, সে তত ধনী। আপনার-আমার তথ্য সে বিক্রি করবে। যার দর বেশি, তাকে।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু শেষদিকে সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। রিপাবলিকান ট্রাম্প স্যুইং স্টেটগুলোর উপর নির্ভর করে বাজিমাত করেছেন। সবাই অবাক হলো। ভাবল, ট্রাম্পের সেই স্লোগান ‘লেটস মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’ই তাহলে পাশা উল্টে দিল? বিষয়টা অতটাও সহজ না। কারণ, ধীরে ধীরে বাজারে এল একটা নাম—কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। আর ছোট্ট দুই কামরার একটি অফিস। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচার কার্যালয়। যেখান থেকে ট্রাম্পের প্রচারের জন্য দিনে ফেসবুক-বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ হতো ১০ লাখ মার্কিন ডলার। তাহলে গোটা প্রচারপর্বে কত খরচ হয়েছে? হাতের কর গুণে ঠাহর করা মুশকিল।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হয়ে যিনি পুরো বিষয়টিকে রূপ দিয়েছিলেন, তার নাম ব্রিটনি কাইজার। ফেসবুক তাকে বা তার কোম্পানিকে দিয়েছিল ৩ কোটি মার্কিন নাগরিকের তথ্য। ইনফোগ্রুপ দিয়েছিল ৬ কোটি ই-মেল। পাশাপাশি আরও কিছু সমীক্ষা রিপোর্ট এবং ডেটাট্রাস্টের মতো সংস্থার তথ্যভাণ্ডার তো ছিলই। এই তথ্য কীভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল? প্রথম ছিল প্রোফাইল খতিয়ে দেখা। কোন ভোটারের কী দুর্বলতা। ঠিক সেই মতো মেসেজ, ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়ে দিতে হবে তার অ্যাকাউন্টে। তিনি সেটা দেখবেন। প্রভাবিত হবেন। যার ফলটা পাওয়া যাবে ভোটের দিন। সোজা কথায় প্রোপাগান্ডা। সঠিক জায়গায় আঘাত করতে হবে। যা খুঁজে দেবে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। একই ঘটনা ঘটেছিল ব্রিটেনেও।
ব্রেক্সিট ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে কে ছিলেন? ব্রিটনি কাইজার। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে পালা বদলের নেপথ্য ভূমিকা কার ছিল? ব্রিটনি কাইজার। স্লোগান তুলেছিলেন ‘ডু সো’। টার্গেট ছিল নতুন ভোটার। যুব সম্প্রদায়। অ্যাফ্রো-আমেরিকান বা যে ভারতীয়রা ওই দেশে থাকেন, তাদের বুঁদ করে দিয়েছিল ‘ডু সো’ স্লোগান, মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত, একটি রাখা অপরটির উপর— ভোট দেব না। মাস্টার প্ল্যান, ওতেই কাজ হলো। একটা অংশ ভোট দিল না। আর কুর্সিও বদলে গেল।
কিন্তু পারলেন না ব্রিটনি। বেরিয়ে এলেন সব ছেড়ে। ফাঁস করে দিলেন। কাঠগড়ায় দাঁড়াল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। মার্কিন কংগ্রেসে জবাবদিহি করতে হলো মার্ক জুকারবার্গকে। ইলিনয়ের ডেমোক্র্যাট সিনেটর রিচার্ড ডাবরিন ফেসবুকের হর্তা-কর্তা-বিধাতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাতে আপনি কোন হোটেলে ছিলেন? আর একটা বিষয় প্লিজ একটু বলবেন... গত সপ্তাহে আপনি কাকে কাকে মেসেজ করেছেন?’
—‘না, জনসমক্ষে এসব আমি জানাতে পারব না’।
—‘এটাই মোদ্দা কথা। ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার। একদিকে দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের কথা বলছেন (কানেকটিং পিপল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড), আর অন্যদিকে দেখুন, আধুনিক আমেরিকাকে কোন খাদে আপনি ঠেলে দিয়েছেন।’ বারবার রুমাল দিয়ে ঘাম মুছলেন জুকারবার্গ। কিন্তু বলতে পারলেন না, তথ্য আসলে ব্যক্তি-সম্পত্তি। যা অন্য কাউকে বিক্রি করার অধিকার তার নেই। থমকে গেলেন তিনি।
কিন্তু আতঙ্ক তার বহর বাড়িয়ে গেল নিঃশব্দে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল, মাদক নিলে নাকি করোনা ভাইরাস সেরে যায়। কেউ বলল, আমরা কেউ রোগী নই, সরকার এমন কিছু একটা করছে, যা আমাদের দেখতে দিতে চায় না। খবরের থেকেও দ্রুত ছড়ায় এই ফেক নিউজ। সৌজন্যে? সোশ্যাল মিডিয়া। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলবে না কোনটা ভুয়ো খবর, আর কোনটা নয়। কোনটা প্রোপাগান্ডা, আর কোনটা সত্যি। আমরা সেটাই বিশ্বাস করব। স্রোতে ভাসব, আন্দোলন করব, আগুন লাগাব।
সফোক্লিস বলেছিলেন, ‘মরণশীল জীবনে বড় কিছু এলে অভিশাপ সঙ্গে নিয়ে আসে।’ ডিজিটাল-মাধ্যম যদি ভূতের রাজার বর হয়, অভিশাপ হলো তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের উপর খোদকারি করা। এটাই মানতে পারেননি ব্রিটনি। মানতে পারেননি এডওয়ার্ড স্নোডেন। সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির হয়ে কাজ করতেন। দেখেছিলেন, দেশের স্বার্থে যা তিনি বানাচ্ছেন, সেটা কীভাবে যেন মারণাস্ত্রে বদলে যাচ্ছে। পালিয়ে এলেন স্নোডেন। দুনিয়াকে দেখালেন, কীভাবে ‘সরকার’ প্রত্যেক নাগরিকের উপর নজরদারি চালাচ্ছে। কীভাবে ঢুকে পড়ছে অন্দরমহলে। কীভাবে সব ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি চলে যাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে দেশদ্রোহী বলল। বারাক ওবামা বললেন, ও একটা ক্ষতিকর হ্যাকার মাত্র। সত্যিই কি তাই?
স্নোডেন না থাকলে আমরা জানতে পারতাম না নজরদারির আতঙ্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। জানতাম না যে, ব্যক্তিগত জীবন বলতে আমাদের আর কিছু নেই। আর তা আজ থেকে নয়, অন্তত
গত দু’দশক ধরে। ওই দেশদ্রোহী হ্যাকার শিখিয়েছেন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের গুরুত্ব। মোবাইল ফোন তার ভিতর রেখে স্রেফ দরজাটা বন্ধ করে দিলে আর ট্র্যাক করা সম্ভব নয়। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন কিচ্ছু না। স্নোডেনই শিখিয়েছেন, মোবাইল বা ল্যাপটপের ক্যামেরাটা ঢেকে রাখতে। প্রয়োজনে খুলে নেবেন। সামান্য একটা হ্যাকার, না একজন সত্যিকারের হিরো!
আসলে আমাদের জীবনের ডিজিটালাইজেশন হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে আমরা বের হতে পারব না। এই আসক্তি, এই অভিশাপ নিয়েই বাঁচতে হবে। আর একটা আতঙ্ক, কেউ না কেউ দেখছে। সব সময়। আজ আমরা যন্ত্র চালনা করছি। কাল যন্ত্র চালাবে আমাদের, মানব সমাজকে।
ডিজিটাল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের হাতে আমরা অজান্তেই বন্দি হয়ে গেছি!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রাবন্ধিক।
আরও পড়ুন:শ্রমের মূল্য বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে পড়েনি আর সামাজিক আলোচনা শোনেনি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। শ্রমশক্তি যখন থেকে পণ্য হয়েছে তখন থেকে শুধু মূল্য নয়, শ্রমের দাম আলোচনায় এসেছে এবং শ্রমশক্তির দাম অর্থাৎ মজুরি পাওয়া ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে। মে দিবস এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। ১৮৮৬ সালের ১ মে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার আগে ১৮৫৭ সালে আমেরিকার সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের কর্মঘণ্টা, মজুরি বৈষম্য, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে রাজপথে নামে। পুলিশি নিষ্ঠুর আক্রমণে গুড়িয়ে দেয়া হয় সেই প্রতিবাদ ও দাবির আন্দোলনকে। কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়নি, বরং নতুন রূপ নিয়েছে, নতুন দাবি সংযোজিত হয়েছে। তেমনি এক দাবি গৃহকর্মের স্বীকৃতি ও নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের দাবি।
পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যার ফলাফল নেই। কাজ সেটা ছোট হোক বা বড় হোক তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যে কাজের ফলাফল ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে। মানুষের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে কিন্তু সে কাজ হলো এমন ধরনের কাজ যার কোনো স্বীকৃতি নেই, যে কাজের মর্যাদা নেই এমনকি যে কাজকে তাচ্ছিল্য করা হয় সবসময় আর যারা এই কাজ করেন তাদের কোনো পারিশ্রমিক নেই। এই স্বীকৃতিবিহীন, মর্যাদাহীন, মজুরিবিহীন কাজের নাম গৃহস্থালি কাজ। এসব কাজের ৮০ ভাগের বেশি করেন নারী। উদয়াস্ত ক্লান্তিকর এই গৃহস্থালি কাজ ছাড়া সমাজ ও পরিবার টিকে থাকা অসম্ভব।
নারীর কাজ শুনলেই মনের চোখে ভেসে ওঠে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছবি। কিন্তু ইট ভাঙা, মাটি কাটা, কৃষিকাজ করা, শিল্প কারখানায় কাজ করা, শিক্ষকতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, গবেষক, পাইলট, ড্রাইভার, চা দোকানদার থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারী, পুলিশ-আর্মি এমন বহু পেশায় নারী আসছেন এগিয়ে। কিন্তু সব পেশায় থেকেও বা কোনো পেশায় না থেকেও যে কাজ তারা নীরবে করে যান তা হলো গৃহস্থালি কাজ। জীবন নিংড়ে নেয়া এ কাজে না আছে স্বীকৃতি আর না আছে সম্মান।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ দিনে ৬.৪৬ ঘণ্টা বেশি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর টাইম ইউজড সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১.৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩.৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬.২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১.২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এর পরের রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও নিশ্চয়ই এর খুব একটা তারতম্য হবে না।
যেকোনো শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার বাবা কী করেন? সে হয়তো বলবে, কৃষিকাজ করেন, ব্যবসা বা চাকরি করেন ইত্যাদি। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার মা কী করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হবে- কিছু করে না, ঘরের কাজ করেন।
শিশুরা এটা শিখেছে আর বড়রা এসব শিখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বহুদিন ধরে একটা চিন্তা সমাজে থাকলেই তা সত্যি হয়ে যায় না। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে এবং উত্তর খোঁজা হচ্ছে, নারীরা ঘরে যে কাজ করে তা কি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না? যদি জাতীয় উৎপাদনে এর প্রভাব থাকে তবে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই কেন? এর আর্থিক মূল্য কি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়?
নারীর কাজের অর্থনৈতিক অবদান প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, মজুরির বিনিময়ে কাজ এবং টাকা উপার্জনের জন্য স্বনিয়োজিত কাজ, যা জিডিপির হিসাবে যুক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, নারীর মজুরিবিহীন কিছু পারিবারিক কাজ যেমন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে বিক্রি করা ইত্যাদি। এর আর্থিক মূল্য জিডিপিতে যুক্ত হয়। তৃতীয়ত, নারীর গৃহস্থালি কাজ, যার বাজারমূল্য বা বিনিময়মূল্য নেই, যা বাজারজাত করা যায় না তা জিডিপিতে যুক্ত হয় না এমনকি শ্রমশক্তির হিসাবেও গণ্য হয় না। এসব অবৈতনিক কাজের মূল্যের একটা ছায়া হিসাব করেছিল গবেষণা সংস্থা সানেম। তাদের তথ্য অনুযায়ী যদি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায় তাহলে তা দাঁড়াবে নারীর ক্ষেত্রে জিডিপির ৩৯.৫৫ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ।
সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারীর কাজের ৭৮-৮৭ শতাংশই অর্থনৈতিক হিসাবে আসে না। যেমন, কাপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যদি। ঘরে-বাইরে নারী যে কাজ করে তার পুরোটা হিসাবে আনলে এবং আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে জিডিপিতে নারী-পুরুষের অবদান সমান হবে। তখন আর কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা কোনো কাজ করে না।
আমরা যখন আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সবসময় ডিজিটালাইজেশনের কথা বলি তখন অর্থনৈতিক সব কিছুরই তো হিসাব করা সম্ভব। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, নৈতিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে তো বটেই সামাজিক ন্যায্যতার কারণেও নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত ‘কেয়ার ওয়ার্ক অ্যান্ড কেয়ার জবস ফর দ্য ফিউচার ডিসেন্ট ওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীরা পুরুষের তুলনায় চার গুণের বেশি সময় গৃহস্থালি ও বেতনবিহীন কাজে ব্যয় করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে পুরুষ জনসংখ্যা ৮৭শতাংশ আয়মূলক কাজে জড়িত। কিন্তু অর্থ উপার্জনকারী কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৬ শতাংশ। গৃহস্থালির কাজে বাকি যে ৬৪ শতাংশ নিয়োজিত নারীর শ্রমশক্তি তাকে হিসাবে ধরা হয় না। নারীর শ্রমে সংসারে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার মূল্য না ধরায় জিডিপিতেও উঠে আসছে না নারীর অবদানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। জিডিপিতে এ কাজ অন্তর্ভুক্তির কোনো গ্রহণযোগ্যপদ্ধতি না থাকায় শ্রমের অবদান আছে, তার ফল ভোগ করছে সমাজ ও পরিবার কিন্তু নেই কোনো স্বীকৃতি।
সারা বিশ্বে বর্তমানে নারীর মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। ভারত, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেপালসহ বেশ কিছু দেশ এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে আছে। তারা হিসাববিহীন নারীর শ্রমকে কীভাবে অর্থনৈতিক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেটার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়ই মজুরিবিহীন কাজে নিয়োজিত থাকলেও এ কাজ সবচেয়ে বেশি করছেন নারীরা। এসব কাজ হিসাবে আনা হলে মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) বাড়ত প্রায় ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
নারীর মজুরিবিহীন এই গৃহস্থালি কাজের আর্থিকমূল্য নিরূপণের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বের করা দরকার তা না হলে নারীর ঘরের কাজ থাকবে উপেক্ষিত, পাবে না স্বীকৃতি ও মর্যাদা।
পাশাপাশি দেশের শ্রমশক্তি গড়ে তোলা, ঘর ও সমাজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা মানুষেরা যখন বয়স্ক হয়ে অসহায় হয়ে পড়ে তখন সেই বয়স্ক নারীদের জন্য দুঃস্থ ভাতা নয়, তাদের পুনর্বাসনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
বাজেট ক্রমাগত বড় হচ্ছে, বাড়ছে ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ। জিডিপির আকার বড় হচ্ছে আর বাড়ছে মাথাপিছু আয়। এই বাজেট বড় হওয়া আর জিডিপি বাড়ার পিছনে যাদের অবদান তারা কি আড়ালেই থাকবে? মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা কি বাড়বে না? বিশাল বাজেটের পাশে ক্ষুদ্র পারিবারিক বাজেট হয়তো চোখে পড়বে না কিন্তু এই বাজেট ছাড়া জীবন তো চলে না। ফলে বাজেট প্রণয়নের সময় নারীর হারিয়ে যাওয়া শ্রম ও সময়কে যেন বিবেচনায় রাখা হয়।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আরও পড়ুন:বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য স্থিতিশীলতা। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থিতিশীলতায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সবাই। দেশের আর সবক্ষেত্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দারুণ স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কোনো মারামারি নেই, সেশনজট নেই। সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা খুশি, অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট। কিন্তু সারা দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও এই স্থিতিশীলতার রহস্য কী? আসলে তেমন রহস্য নেই। রাজনীতির মাঠ থেকে একটি পক্ষকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ছলেবলেকৌশলে, মানে মামলা-হামলায় একটি পক্ষকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ব্যস, চারদিক শান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। স্বাধীনতার আগে-পরে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তাই ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ মানেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। আওয়ামী লীগের গত এক যুগের শাসনামলে কোটা সংস্কার আন্দোলন বাদ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ক্ষমতাসীনদের একক নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ মানে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একক নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ৯০-এর গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এরশাদ আমল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই কোনো ক্ষমতাসীনদের দখলে ছিল না। বরং ক্ষমতাসীনরা ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পারত না। স্বৈরাচার এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল জাতীয় ছাত্রসমাজ। কিন্তু এরশাদের ৯ বছরের প্রবল প্রতাপশালী শাসনামলেও ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেনি। বরং ছাত্রসংগঠনগুলোর ইস্পাতকঠিন ঐক্যেই রোপিত হয়েছিল এরশাদের পতনের বীজ। এরশাদ আমলে ছাত্রসমাজ আর ছাত্রশিবির ছাড়া আর সব ছাত্র সংগঠনেরই অবাধ বিচরণ ছিল ক্যাম্পাসে।
তখন আমরা জানতাম, ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়া ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাড়া ছাত্রলীগের। তখন কৌতুক ছিল, ছাত্রদলের মূল সংগঠন বিএনপি যেহেতু উত্তরপাড়ায় গঠিত, তাই ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়াই তাদের পছন্দ। আর ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়া মানে মহসিন হল, সূর্যসেন হল, জসিমউদ্দিন হল, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়া হল। এই হলগুলোতে ছাত্রদলের আধিপত্য ছিল। আর দক্ষিণপাড়া মানে জহুরুল হক হল, এসএম হল, জগন্নাথ হল, শহীদুল্লাহ হল ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এভাবেই স্বৈরাচারী আমলে ক্যাম্পাসে অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল। মাঝেমধ্যে খুটখাট লাগত বটে, তবে উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া মিলে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতিই বহাল ছিল।
স্বৈরাচারের পতনের পর অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়। ৯০-এর আগে যেখানে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদের ঢোকাই মুশকিল ছিল, ৯০-এর পর থেকে সেখানে ক্ষমতাসীনদের একক নিয়ন্ত্রণ। যখন যে দল ক্ষমতায়, তাদের ছাত্র সংগঠনের দখলেই গোটা ক্যাম্পাস, উত্তরপাড়া-দক্ষিণপাড়া, পুবপাড়া-পশ্চিমপাড়া সব। আজ যে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে উপর্যুপরি মার খাচ্ছে, সেই ছাত্রদলের হাতেই এই একক আধিপত্যের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির’ যাত্রা শুরু হয়।
’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলকে সরিয়ে ছাত্রলীগ একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এভাবেই চলে আসছে। ব্যাপারটি এতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে বাংলাদেশে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আগের ক্ষমতায় থাকা দলের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়। নতুন ক্ষমতায় আসা দলের ছাত্র সংগঠনকে দখল কায়েম করতে কোনো লড়াইও করতে হয় না। নিজ থেকেই দখল ছেড়ে চলে যান।
আমাদের ছাত্রজীবনে দেখতাম নতুন ছাত্রদের দলে টানার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। নিজেদের আদর্শ বোঝানো, নবীনবরণের আয়োজন। এখন সেসবের বালাই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানেই অটো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের মুখ বনে যাওয়া। হলে সিট পেতে হলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাতেই হবে। এখন যেমন ছাত্রলীগ, একসময় সেটা ছিল ছাত্রদল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একযুগ ধরে স্থিতিশীল। কোনো মারামারি নেই, কোনো সেশনজট নেই। সব শান্ত। আপনাদের যেমনই লাগুক, এই শান্তি আমার ভালো লাগে না। কবরের নিস্তব্ধতাকে স্থিতিশীলতা বলে না। গণতন্ত্র মানে বহু দল, বহু মত, বহু পথ। কোনো সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণ মানে আর যা-ই হোক স্থিতিশীলতা নয়, গণতন্ত্র তো নয়ই। এই একযুগে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কতটা কাছে যেতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাব হলো, কোনো কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ছাত্রলীগের ক্যাম্পাস ছাড়া হতে এক মিনিট সময় লাগবে।
একযুগ ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্রদল নানাভাবে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করছে। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন ছিল। সংবাদ সম্মেলনটি করতে পারলে সেটি পত্রিকায় ভেতরের পাতার সংবাদ হতো। কিন্তু ছাত্রলীগ সেটি হতে দেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার আগেই ছাত্রদলকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। তাতে অবশ্য ছাত্রদলের লাভই হয়েছে। ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।
একদিনের বিরতিতে আরেকদফা চেষ্টা করেও মার খেয়ে বিতাড়িত হতে হয়েছে ছাত্রদলকে। সবার চোখের সামনে চর দখলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে রেখেছে ছাত্রলীগ। মূল প্রতিপক্ষ ছাত্রদলকে ঢুকতেই দিচ্ছে না। কিন্তু তাতে কারোই কিছু যাচ্ছে আসছে না। যেন সাধারণ মারামারির ঘটনা। অনেকে আগ বাড়িয়ে বলছেন, ছাত্রদল গেল বলেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হলো। ছাত্রদল না গেলেই পারত। যেন ছাত্রদলের যাওয়াটাই অপরাধ। তাদের ওপর হামলা চালানোটা অপরাধ নয়।
আসলেই দেশে এখন গণতান্ত্রিক ধারণাটাই উঠে গেছে। সংবিধানে দেয়া সংগঠন ও সমাবেশ করার অধিকার নেই কারো। হামলাকারীদের ছবি ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের তাতে কিছুই যায় আসে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে; এর নাম আর যা-ই হোক গণতন্ত্র নয়।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
আরও পড়ুন:ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মাঠের অভাব আর মোবাইল ফোনে বুঁদ নগর জীবন কীভাবে শিশুদের ভবিষ্যৎকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে- সেই কথা প্রকাশ করেছেন ভাষণে।
‘...প্রতিটা এলাকায় খেলার মাঠ থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন’ একথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের শিশুরা এখন তো সব ফ্ল্যাটে বাস করে এবং ফ্ল্যাটে বাস করে সেগুলো ফার্মের মুরগির মতোই হয়ে যাচ্ছে। তবে ঢাকা শহরে খেলাধুলার জায়গা যে কম, সে কথা তুলে ধরে বিষয়টিকে ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সরকারপ্রধান।
বক্তব্যে আশার কথাও শুনিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে খালি জায়গা পাচ্ছি খেলার মাঠ করে দিচ্ছি। শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দেশের প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ রাখার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজধানীর কলাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠে থানা নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ১২ঘণ্টার বেশি সময় থানা হাজতে থাকতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে। এ ঘটনায় রীতিমেতো দেশজুড়ে তোলাপাড় সৃষ্টি হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী মাঠে থানা নির্মাণ না করার ঘোষণা দেন, সেইসঙ্গে জমির মালিক পুলিশ বিভাগ হলেও জায়গাটি উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এমন একটি ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল দেশবাসী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তখন প্রধানমন্ত্রী ভুল করেননি। সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার বাহবা কুড়িয়েছেন।
খেলার মাঠে থানা নির্মাণ না করার ঘোষণায় শুধু যে ধানমন্ডি এলাকার মানুষ খুশি হয়েছে তা নয়। গোটা দেশের মানুষ এই ভেবে খুশি হয়েছে যে- প্রধানমন্ত্রী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত জায়গা দরকার এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুভব করেছেন।
রাষ্ট্রের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সবার কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে খেলার মাঠের মতো ছোট খাট বিষয় নিয়েও শেষ পর্যন্ত তাকেই ভেবেচিন্তে ঘোষণা দিতে হয়েছে বলেই, সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় তিনি আরও বেশি স্থান করে নিয়েছেন।
গত ১১ মে এক অনুষ্ঠানে শিশুদের নাগরিক দুঃসহ জীবনের কথা ভেবে খেলার মাঠের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি সারা দেশের মানুষকে আরও বেশি আশান্বিত করে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে তিনি যেহেতু বিষয়টি অনুভব করতে পেরেছেন, সেক্ষেত্রে আশা করা যেতে পারে এ ব্যাপারে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাবে। আমরা নতুন খেলার মাঠ পাব। যা নতুন প্রজন্মের জন্য সুখবরই বটে!
একটি পরিকল্পিত নগরীর জন্যও তো উন্মুক্ত জায়গার দরকার হয়। বয়স্ক নাগরিকরা নানা ধরনের অসুস্থতায় ভোগেন। হাঁটাহাঁটির মাধ্য দিয়ে সুস্থতার প্রয়োজনে তাদেরও মাঠের দরকার। নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সব মিলিয়ে নানা দিক থেকে মাঠের কোনো বিকল্প নেই।
রাজধানীতে লোকসংখ্যা বর্তমান প্রায় দুই কোটি। বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের অন্যতম এই মেগাসিটি। নগর পরিকল্পনাবিদরা গড়ে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য অন্তত তিন একর আয়তনের একটি খেলার মাঠ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে হিসাবে রাজধানীতে প্রায় এক হাজার ৬০০টি খেলার মাঠ প্রয়োজন!
আদতে মাঠ আছে মাত্র ২৫৬টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মাঠের আয়তনই তিন একরের কম। তবুও আছে তো?
কষ্টের বিষয় হলো দুই সিটি করপোরেশনের এমন ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে কোনো খেলার মাঠ নেই। ৩৫টি ওয়ার্ডে মাঠ কিংবা পার্কও নেই। অথচ দুই থেকে তিন দশক আগেও রাজধানীতে খেলার মাঠের জন্য এতটা হাহাকার ছিল না। কেন ঢাকায় হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ? এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সরকার ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মাঠ উধাও হয়ে যাচ্ছে। মাঠ যে নাগরিক জীবনে অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো বিষয়, কেউই তা আমলে নেয়নি। হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর এখন সবাই মাঠের প্রয়োজনীয়তা টের পাচ্ছে। যদিও মাঠ নিয়ে ঢাকা শহরে কথা চলছে প্রায় দুই যুগের বেশি। কিন্তু যাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবার কথা তাদের কানে পানি গেছে অনেক পর। এটা ঠিক হয়নি। আরও আগেই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল সব পক্ষের।
চোখের সামনে মাঠ গেল, সবুজ ঢাকা ফাঁকা হয়ে ভরে ওঠল ভবনে, ফাঁকা সড়ক গাড়িতে ভরল, খালগুলো ভরাট হয়ে গেল, পুকুর গেল, দূষণ আর দখলে নষ্ট হলো; নদী-জল হলো বিবর্ণ, উজার হলো অন্য জলাশয়, মানুষে মানুষে সয়লাব হলো শহর অথচ সবাই মিলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালাম!
এটা উন্নত দেশে তো চিন্তাই করা যায় না। স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ে তোলা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। তাইতো কারো কোনো জবাবদিহি নেই। থাকলে, যাদের দায়িত্ব ছিল এসব বিষয় দেখভাল করার তাদের জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো। তাহলে এ ধরনের বিপর্যয় আসত না। ‘মাঠ চাই-মাঠ চাই’, ‘শিশুদের মুক্ত বাতাস দাও’, ‘খেলাধুলার নিশ্চয়তা দাও’ বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবার চিৎকার করতে হতো না।
বেদনাদায়ক হলো, যখন ঢাকা মহানগরীরর পত্তন শুরু হয়, তখন পাড়া-মহল্লাভিত্তিক খালি জায়গা ও খেলার মাঠ ছিল। শহর যখন বড় হতে শুরু করে, তখন মাঠের জন্য জায়গা দান কিংবা অধিগ্রহণ কোনোটাই কেউ করেনি। সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যেও কখনও খেলার মাঠ বা পার্ক ছিল না। এখন যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে তখনও আড়ালে-আবডালে খেলার মাঠের নকশায় যুক্ত হচ্ছে ভবন।
নগরবিদরা বলছেন, রাজধানীতে জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা প্রয়োজন। আছে মাত্র ৯০ শতাংশের এক শতাংশ। আর ১৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে থাকা উচিত একটি করে খেলার মাঠ। নাগরিক সুবিধা দেয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ করতে গণপূর্ত, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাগুলোর সহযোগিতা তারা পায় না।
সংশোধিত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের আগে রাজউকের জরিপে দেখা যায়, দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে এক হাজার ১৩৭ একর জায়গায় পার্ক থাকার কথা। সেখানে আছে মাত্র ২৭১ একরে। খেলার মাঠ থাকার কথা এক হাজার ৮৭৬ একর জায়গায়। আছে মাত্র ২৯৪ একরে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠে মার্কেট তৈরি করে আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া দেয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষাঙ্গনে মাঠ থাকলেও ক্লাস শেষে ফটক বন্ধ করে দেয়ায় শিশু-কিশোররা বিকেলে সেখানে খেলতে পারে না।
এটা অনস্বীকার্য যে, দেশে সামাজিক অপরাধ বেড়েছে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সমাজ। অন্যায়-অনাচার, অপরাধ দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খেলার মাঠের বিকল্প নেই। মাঠের মুক্ত বিনোদন না পেয়ে মোবাইল ফোন, নেশা, অপরাধ থেকে শুরু করে নানা রকম আসক্তির দিকে ঝুঁকছে শিশুরা। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার অনিশ্চয়তা বেশি।
বর্তমানে ঢাকা শহরে কতসংখ্যক শিশু ও কিশোরের বসবাস? সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ একটি এলাকায় আড়াই থেকে তিন হাজার বাসিন্দা থাকলেই একটি বড় খেলার মাঠ বা হাঁটাচলার জন্য উন্মুক্ত খোলা স্থান থাকা দরকার এলাকাবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য।
মাঠ না থাকার কারণে অনেক শিশু-কিশোর বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় এমনিতেই ভুগছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। কিন্তু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈষম্যের, অসমতার কারণে এবং নষ্ট রাজনীতির জন্য তারা এই স্বদেশে সুনাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার অধিকারবঞ্চিত নতুন প্রজন্ম।
গৃহবন্দি জীবনের কারণে অনেক শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে- এই তথ্য মনোচিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন। সুস্থ শরীর সুস্থ মন গঠনে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। সবার আগে বেদখল হয়ে যাওয়া মাঠ দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। খাস জমিতে নতুন মাঠ চাই। যেখানে শহরের পরিধি বাড়ছে সেখানে যেন পরিকল্পিতভাবে সব কিছু হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:দেশে দিনে দিনে বাড়ছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। সয়াবিন তেল এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়লেও লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার। নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও অধিক দামে কিনতে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি। এরই মধ্যে বেড়েছে চাল, আটাসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম। শুধু কি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে? আসলে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে সমান তালে। যেমন আগে যেখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১০০ বা ১২০ টাকায় যেত এখন সেখানে গুণতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
একইভাবে ২০ টাকার রিকশা ভাড়া ৩০ টাকায় ঠেকেছে। মূল্যবৃদ্ধির এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ মূল্যবৃদ্ধির এই গতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির এই দৌড় খুব সহজেই থামছে না। জীবন বাঁচানোর ওষুধপত্র ও মেডিক্যাল সামগ্রীরও দাম বেড়েছে। এই অস্থিতিশীল অবস্থা কি শুধু বাংলাদেশে?
পৃথিবীজুড়েই এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খোদ আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে গত মার্চে ছিল ৮.৫ শতাংশ। এপ্রিলে একটু হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৮.৩ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে এই হার এখনও কম। মার্চে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২২ শতাংশ। যদিও এটা ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এই হিসাব বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে দাবি করেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
গত ১৬ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।’ আর পাকিস্তানে গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩.২২ শতাংশ। অবশ্য এটা হ্রাস পেয়ে গত এপ্রিলে দাঁড়ায় ১২.৭ শতাংশ।
রয়টার্সের জরিপ অনুযায়ী এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ ভারতে এই হার গত এপ্রিলে ছিল ৭.৫ শতাংশ; মার্চে ছিল তা ৬.৯৫ শতাংশ। আর্জেন্টিনায় অস্বাভাবিক হারে মূল্যস্ফীতির কারণে চলছে বিক্ষোভ। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের আরও অনেক দেশে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিক্ষোভ চলছে। ইউরোপে গত ২৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি। আড়াই কোটিরও কম জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কায় সরকার পতন হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার কথা জানিয়ে তারা দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের।
আশঙ্কার বিষয় হলো- বৈশ্বিক ঝুঁকি ও কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রাফট ১৩২টি দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গত ১১ মে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে আগামী ৬ মাসের নাগরিক অস্থিরতা সূচক (সিভিল আনরেস্ট ইনডেক্স) প্রকাশ করে। রিপোর্টে তারা বলেছে, জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের সব দেশেই চাপ বাড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে মধ্য আয়ের দেশগুলো।
এরমধ্যে চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নিম্নমধ্যম বা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। রিপোর্টে শ্রীলঙ্কা ও কাজাখস্তানের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ম্যাপলক্রাফট বলেছে, এ বছর এ রকম ঝুঁকির শঙ্কায় থাকা ১০টি দেশ আলাদাভাবে নজরে থাকছে। এই ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। অন্য দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মিসর, তিউনিসিয়া, লেবানন, সেনেগাল, কেনিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বব্যাপী খারাপ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে গত ১৭ মে এনইসি সভায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলে আমরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। যদি অন্য কেউ ক্ষমতায় থাকত এতদিনে রাস্তায় রাস্তায় মারামারি লেগে যেত। কিন্তু সেটা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার সেই জায়গা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে পেরেছে।’
একই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্ব একটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। টাকা খরচের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। অহেতুক সম্পদের ব্যয় না করি। যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না; এটা আমি বিশ্বাস করি।’
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। কিন্তু একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে। বিগত দিনের সংকটকালের প্রধান সমস্যাগুলো যেন নতুন করে সৃষ্টি হতে না পারে। ১৯৭৩ সালে বগুড়ায় ভাষণে দেয়া বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ উক্তি- ‘চোরের দল বাংলার মাটিতে খতম না হলে কিছুই করা যাবে না। আমি যা আনব এই চোরের দল খায়ে শেষ করে দেবে। এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।’
ভুলে গেলে চলবে না। চোরবাটপার, মজুতদার, পাচারকারিদের এবং প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলের মধ্যে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দুর্নীতির টাকায় প্রভাব বিস্তার করা ছদ্মবেশী রাজনীতিবিদের শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে অবস্থা ভয়াবহ হতে বাধ্য।
আমাদের প্রত্যাশা কৃষিখাতকে সরকার আরও বেশি গুরুত্ব দিবে। যদিও বাংলাদেশ ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়। একই সঙ্গে আলু উৎপাদনে আমরা ষষ্ঠ। আত্মতৃপ্তির ঢেকুর না তুলে শস্য উৎপাদন বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যাবে না এই হিসেবে সংকটকালীন বিকল্প পরিকল্পনা থাকলে সমস্যা ভালোভাবেই সামাল দেয়া যাবে।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের অবস্থা না হওয়ায় আরও অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রতিমাসেই বাড়ছে। প্রবাসী আয়ের গতিও প্রত্যাশার কাছাকাছি। বিদেশি বিনিয়োগেও অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। এ বছর ফসল উৎপাদনেও ঘাটতি নেই। রিজার্ভও বেশ ভালো। তবে করোনাকালীন আমদানি ব্যয় পরিশোধ অনেকটা বাকি থাকায় তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তাই স্বাভাবিকের তুলনায় দেশে ডলারের রিজার্ভে কিছুটা চাপ পড়েছে। তবে এটা সাময়িক। একই সঙ্গে আবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া আমদানিতে কড়াকড়ির পরিকল্পনা এবং কিছু পণ্য আমদানি সরকার বন্ধ করে দেয়ায় বাণিজ্যঘাটতিও অনেকটা কমে আসার প্রত্যাশা রয়েছে। পণ্যমূল্যের দাম বাড়লেও খেটে খাওয়া দিনমজুরদেরও পারিশ্রমিক অনেকটা বেড়েছে।
এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়। শ্রীলঙ্কা যেভাবে ঋণের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ তার আশেপাশেও নেই। গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট ঋণ জিডিপির ৩৮ শতাংশ ছিল। এর ৩৭ শতাংশ বিদেশি ঋণ। বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটা জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। ২ কোটি ২০ লাখের মতো জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কায় আইএমএফের তথ্যানুযায়ী ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা। তাদের মোট ঋণ জিডিপির ১১৯ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ পরিষেবা খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এই খাতে শ্রীলঙ্কার বরাদ্দ বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ।
একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার- বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ নিয়ে একটি কথা সাধারণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছে। আসলে এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা আরও প্রায় পাঁচ বছর পরে। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২০২৭ সালের মার্চে। পরিমাণটা হবে ৫৫৬ মিলিয়ন ডলার। তাই এখনই আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার মতো কিছু নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক
আরও পড়ুন:দিনে দিনে শুধু ‘মুসলমান’, দিনে দিনে শুধু ‘হিন্দু’ হয়ে ওঠা এই আঁধার নামা সময়ে আবার পড়ি নজরুলের সেই পঙ্ক্তিগুলো- “কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।” (‘বিংশতাব্দী’/‘প্রলয়-শিখা’)। সব কালে সব ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া নজরুলের সেই ‘মানুষ’ আজ কোথায়! যেদিকে চোখ রাখি, কেবল হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। অথচ সেই ‘মহীয়ান মানুষ’-এর দেখা নেই। কোথায় হারিয়ে গেল তার দেখা “সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।”
ঊর্ধ্বাকাশে স্যাটেলাইট উড়লেও বাংলাদেশের হৃদয়ে নানাবিধ ক্ষত লেগে আছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আছে, উন্নয়নের ডামাডোল আছে। কিন্তু বাঙালির মানসজগতের বিকাশ নেই আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। চারপাশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, এখনও বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি।
বিভেদের অনলে পুড়ছে আমাদের হৃদয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে ক্রমশ পচে গলে যাচ্ছে সমাজ। একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুল আজ দুই দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বিংশ থেকে একবিংশ- কতটুকু এগোলাম আমরা... আছে কারো হিম্মত, বলবেন- ‘বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’
আমরা পিছনে হাঁটছি কেন, কেউ কি ভাবছি এ সংকট থেকে উত্তোরণের! অক্টোপাসের মতো ঘিরে থাকা সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির মোকাবিলায় অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তৎপরতা কী? কেবলই পদ-পদবি, গোলটেবিল, টক শো, বড় বড় কলাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের সেমিনার! সারা দিন মাইক্রোফোনে অসাম্প্রদায়িকতার ঝড় তুলে এসে নিজের সন্তানকে বলে দেয়া ‘হিন্দু/মুসলিম বাচ্চাদের সাথে মিশো না’।
আমাদের স্কুলগুলো থেকে, আমাদের পাড়া-মহল্লা থেকে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উধাও হলো কেন, কীভাবে ইভেন্ট, প্রজেক্ট আর শুধুই চাকরি বাঁচানোর আয়োজন হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল! করপোরেট দুনিয়া খুবলে খাছে মননচর্চার সবুজ বাগিচা আর কিছু স্বার্থান্বেষী, আত্মপ্রতারক, মুখোশধারী মানুষ। যারা নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছেন, ম্লান করে দিচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির অমিয় আভা। বিনিময়ে আমরা এগোচ্ছি অসার, আনন্দহীন, বিষণ্ন এক ভবিষ্যতের দিকে।
নজরুল যে মূঢ়তা, যে কূপমণ্ডূকতার মুণ্ডুপাত করতে চেয়েছিলেন দীর্ঘকাল আগে, দীর্ঘকাল পরে আজ আমরা কোথায় আছি! এখনও পান থেকে চুন খসলেই ‘ধর্ম অবমাননার’ অজুহাত তুলে চলে দুর্বলের ওপর নিপীড়ন। ধর্মের নামে উগ্রতার করাল গ্রাসে বন্দি তরুণ সমাজ। ধর্মকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
বাঙালির মানস সরোবরে নজরুল বপন করে দিয়েছিলেন যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বীজ, আজ তা বৃক্ষ, ফলে-ফুলে শোভিত হওয়ার পরিবর্তে জন্ম দিয়েছে এক শুষ্ক, রুগ্ণ, পত্রপল্লবহীন উদ্যানে। তিনি সাম্যের গান গেয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে যে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, এই কাতারটিই হলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির মূল মন্ত্রই মানুষ। মানুষই সে সংস্কৃতির প্রথম ও শেষ কথা, অন্য কিছু নয়-“এক সে আকাশ মায়ের কোলে, যেন রবি-শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।”
‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন- “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ- প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।”
অথচ আজ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মতো অসাম্প্রদায়িক বার্তাবাহী স্লোগান নিয়েও বিকৃত প্রচার। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুদের কবি আর নজরুলকে মুসলমানের কবি বানানোর প্রতিযোগিতায় খুব সুকৌশলে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। উল্টোদিকে, প্রগতির ঝান্ডাধারীরা ব্যস্ত নিজেদের ফায়দা হাসিলে। আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাদের মধ্যে নজরুলের জীবনাদর্শ তুলে ধরার কোনো তাগিদ কোথাও আছে?আছে স্কুলে, বিদ্যায়তনে কোনো আয়োজন কেবল নামকাওয়াস্তে । এ প্লাস ব্যাধির এ বিরূপ সময়ে নজরুলের কবিতার মর্মার্থ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরার জন্য কোনো শিক্ষক কি এগিয়ে আসেন ক্লাস রুমে? নজরুলের নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন আর বাগাড়ম্বর ছাড়া কি উপহার দেয় জন্ম, মৃত্যু দিবসে?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী কর্মসূচি থাকে এসব দিনে? প্রশ্নগুলোর গভীরে গেলে আজকের বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র সম্পর্কে কিছুটা উত্তর মিলবে। যে জাতির জাতীয় কবি নজরুল, সে জাতি আজও কীভাবে পোশাকে ধর্ম খোঁজে, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে মেতে ওঠে হানাহানিতে। কে বোঝাবে ওদের! কবি নিজেই বলে গেছেন- …“মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”…
এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, নজরুল বড় প্রাসঙ্গিক আজ। তার ভাবদর্শনচর্চা বড় প্রয়োজন এখন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে নজরুল আমাদের নিত্য অনুপ্রেরণার নাম। তাকে পঠন-পাঠন ছাড়া হৃদয়ে ধারণ সম্ভব না। তাই শুরুটা করতে হবে তাকে অধ্যয়নের মাধ্যমেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আরও পড়ুন:
মন্তব্য