নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নারী এগিয়ে যাচ্ছে এটি যেমন সত্য, আবার নারী নির্যাতন বেড়েছে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। করোনাকালে গত দুই বছরে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্যই উঠে এসেছে।
২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বিদ্যমান আইন সংশোধন করার দাবি ওঠে। নারী নির্যাতন তথা নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনও পাস হয়। আর মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২১ সালকে বলেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর।
আমাদের দেশে কোনো অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটলে বা এ নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলে আইন প্রণয়ন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। বিষয়টি যেন এ রকম যে আইনের অভাবেই এত দিন অপরাধটি হয়ে আসছিল বা আইন না থাকার ফলেই অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছিল না। তবে বাস্তবে দেখা যায়, প্রায় সব বিষয়েই আমাদের আইন রয়েছে। যুগের প্রয়োজনে কিছু কিছু নতুন আইন করা প্রয়োজন হলেও নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের জন্য নতুন করে আইনের প্রয়োজন নেই।
ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের জন্য ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালেই দেশে আইন করে গেছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন অপরাধ বিজ্ঞানের একটি অভিধান। অনেক অপরাধের মৌলিক নীতিই এখানে উল্লেখ আছে। প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে নতুন নতুন আইন করতে হয়েছে। যেমন- দ্রুত বিচার আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইন ইত্যাদি। এ আইনগুলো মূলত মূল অপরাধের ক্ষেত্রটিকে আরও প্রসারিত করেছে, যাতে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করা যায় অথবা বিচারপ্রক্রিয়া আরও দ্রুত করা যায়।
আসল কথা হচ্ছে, শুধু আইন করে অপরাধ দমন করা যায় না। যদি তা-ই হতো তবে দ্রুত বিচার আইন বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো কঠিন আইন হওয়ার পরে এ দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন হতো না। আইন করে বা কঠিন দণ্ড আরোপ করা হলেই অপরাধ দমন হয় না। আইন সহজ হতে পারে, দণ্ডও লঘু হতে পারে-মূল কথা হলো আইনের প্রয়োগ ও সব অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করা।
একই অপরাধে এক আসামির ফাঁসি আরেক আসামির খালাস ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। আইনে যদিও বলা হয় হাজার অপরাধী মুক্তি পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন সাজা না পায়। সেটি ন্যায়বিচারের একটি মৌলিক নীতিও বটে। এর মানে এই নয় যে হাজার অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে দু-একজনকে ফাঁসি দিতে হবে। এই নীতির মানে হলো, স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে সব অপরাধীকেই আইনের আওতায় আনা হবে এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে না। কিন্তু আমাদের দেশে একদিকে যেমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিচার হয় আবার অনেক অপরাধীও ছাড়া পায়।
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ও সামাজিক চাপের মুখে অনেক নারীই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। আর আইনের ফাঁক-ফোকর তো আছেই। কিন্তু আবার উল্টো চিত্রও দেখা যায়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, পারিবারিক চাপে বা প্রতিশোধ নিতে অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলাও করা হয়। আইনের অপব্যবহার করে অনেকেই মিথ্যা মামলা করেন। ফলে আসামিপক্ষ সাজা এড়াতে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় মামলার বাদীরা টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেন। আইনে মিথ্যা মামলার জন্য সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও ভুক্তভোগীরা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ (১) ধারা]। এটি হচ্ছে আইনের অপব্যবহার।
আইনের এই অপব্যবহার রোধে মিথ্যা মামলাবাজ নারী বা বাদী বা পরিবারকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এক দিকে অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে আসে, যার ফলে নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন আবার অন্যদিকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধকেও ফাঁসানো হয়।
এ রকম নানা অবিচার ও অনিয়মের বেড়াজালে হারিয়ে যায় এ দেশের অনেক নির্যাতনের কাহিনি। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না, মামলাও হয় না। বিভিন্ন কারণে অনেক ভুক্তভোগী মামলাও করতে পারেন না। মামলা করার সাহসও থাকে না। মামলার খরচ মেটানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। উকিলের খরচ, যাতায়াতের খরচ আরও কত কী। এ ছাড়া আইনের জটিল প্রক্রিয়া তো আছেই।
অপরাধীদের শাস্তি না হলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। পাঁচ বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশুরাও এখানে নিরাপদ নয়। ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েও নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়। কন্যাশিশুরা ঘরের বাইরে গেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এ এক ভয়াবহ অবস্থা।
আসকের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী ও ১১ পুরুষসহ খুনও হয়েছেন মোট ১৪ জন।
এ ছাড়া, পারিবারিক নির্যাতনে মারা যান ৩৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়ে হত্যার শিকার হন ৮৯ নারী এবং আত্মহত্যা করেন ১৮ নারী।
আসক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১ হাজার ৩২১ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনজন নারীসহ আটজন খুন হয়েছেন। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৩৭২ জন। শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যাসহ মোট ৫৯৬ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।
উপরোক্ত দুটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ানে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট। নারী ও শিশুদের জন্য পরিবার, দেশ ও সমাজ কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। নারী নির্যাতনের তালিকা আরও দীর্ঘ। এখানে শুধু কয়েকটি বড় অপরাধের হিসাব তুলে ধরা হলো।
অনেক সময় স্থানীয়ভাবে নারী নির্যাতনের বিশেষ করে নারী ধর্ষণ হলে সালিশ মীমাংসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে নারীকেই অপরাধী বা দুশ্চরিত্রা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। এসব সালিশের মাধ্যমে প্রতিকারের নামে নারীকে মূলত দ্বিতীয়বারের মতো নির্যাতন করা হয়। তাই ধর্ষণের অপরাধে সালিশি করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর আসক-এর পক্ষ থেকে একটি রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রুলও জারি করেছেন। এই রুলের বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
তবে ভুক্তভোগীদের প্রতিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আইনজীবীরা অনেক সময় প্রতিকার বা সমাধান দেয়ার চেয়ে মামলা করাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেক সময় নারী অভিযোগকারী পুরুষ আইনজীবীর কাছে সব কথা খুলে বলতে পারেন না। প্রতিকার না পাওয়ার এটিও একটি কারণ। এ ক্ষেত্রে নারী আইনজীবীরা এগিয়ে এলে নারীর প্রতিকার যুদ্ধ আরও সহজ হতো।
দেশে নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১২ দফা সুপারিশ করেছে। এই ১২ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সব থানায় একজন করে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান, স্কুল-কলেজ এলাকায় এবং ছাত্রীদের চলাচলের পথে বখাটের উৎপাত বন্ধে সিসিটিভি স্থাপন ও পুলিশের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং ৯৯৯ নম্বরকে আরো বিস্তৃত ও গতিশীল করা। স্থায়ী কমিটির এ নির্দেশনাগুলো সময়োপযোগী। এগুলো বাস্তবায়ন করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বন্ধে আদালত বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছে। হাইকোর্ট নারী নির্যাতন বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এ ছাড়া ২০২০ সালের ২১ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্ষণ মামলার বিচার বিষয়ে ৬টি নির্দেশনা দেন। বিচারকাজ দ্রুদ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এই নির্দেশনাগুলো দেয়া হয়েছিল। এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে সরকার ও নিম্ন আদালতকে এগিয়ে আসতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। আদালতের স্বল্পতা থাকলে তাও দূর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এদিন প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বেতার বার্তার মাধ্যমে এদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ওই বার্তায় তিনি স্পষ্টভাবেই বলেন, “From today Bangladesh is independent”। অর্থাৎ আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
অবশ্য আনুষ্ঠানিক বা স্পষ্ট ঘোষণা ওইদিন হলেও তার ১৯ দিন আগেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণেই তিনি পরোক্ষ ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেদিন তিনি সমবেত লাখো মানুষের সামনে বাঙালি জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
তবে ৭ মার্চের ওই পরোক্ষ ও ২৬ মার্চের প্রত্যক্ষ ঘোষণা আকস্মিক কিছু ছিল না। এর ছিল এক দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। বিষয়টি এমন নয় যে, বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ আবির্ভূত হয়ে মঞ্চে উঠে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন আর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর জন্য তাকে দীর্ঘকাল এদেশের গণমানুষের কাতারে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তাদের আস্থা অর্জন করে শেখ মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠতে হয়েছিল।
আমাদের স্বাধীনতার বীজ মূলত রোপিত হয়েছিল দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানার উদ্যোগ গ্রহণকালে এদেশের স্বাধীনচেতা মানুষের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষা শহীদদের রক্তে ভিজে সে বীজ অঙ্কুরিত হয়। তারপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে সে অঙ্কুর দিনে দিনে ডালপালা গজিয়ে বড় হয়ে ফলবতী হয়ে ওঠে।
আমাদের স্বাধীনতার সেই বীজের অঙ্কুরোদগম থেকে শুরু করে ফলবতী হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় ও সফল ভূমিকা। আর সে প্রেক্ষাপটেই আসে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এদেশের আপামর জনসাধারণ। ৩০ লাখ মানুষের জীবনহানি ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মেরুকরণ আমাদের অনুকূলে থাকা- সব মিলিয়ে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বলতে গেলে ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে শুরু হয় আমাদের পথচলা। তার ওপর যোগ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা আর দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্যোগ কাটিয়ে দেশ আস্তে আস্তে স্থিতিশীল হয়ে সামনে এগুচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে রাজধানী ঢাকাসহ এদেশের বিভিন্ন শহরে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা করে গণহত্যা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ওই রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ওই রাতে হানাদার বাহিনী দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও The People পত্রিকার অফিস ভষ্মীভূত করে। ফলে ২৫ মার্চের পর ওই মাসে বাংলাদেশে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ হয়নি। তবে ২৭ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘The Times’ ও ‘The Financial Times’, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘New York Times’, ব্যাংকক থেকে প্রকাশিত ‘The Bankok Post’ ও বোম্বে থেকে প্রকাশিত ‘The Times of India’সহ বিশ্বের দেশ থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়।
‘Heavy Fighting as Shaikh Mujibur declares E Pakistan independent’ শিরোনামে ‘The Times’ লেখে- ‘Civil war raged in the eastern region of Pakistan after the provincial leader Sheikh Mujibur Rahman, had proclaimed the region an independent republic’.
‘The Financial Times’ লেখে- ‘Civil war broke out in East Pakistan yesterday after Sheikh Mujibur Rahman declared an Independent Peoples Republic of Bangla Desh.’
‘New York Times’-এ লেখা হয়- ‘Sheikh Mujibur Rahman arrested after a broadcast proclaiming region’s independence.’
‘The Times of India’-তে শিরোনাম করা হয়, ‘Mujib proclaims free Bangladesh.’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সরকারিভাবে লিপিবদ্ধ ও প্রকাশের উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পের আওতায় ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিল-পত্র’ শিরোনামে ১৫ খণ্ডে ওই ইতিহাস প্রথম প্রকাশ করা হয়। এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মর্মে যথারীতি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওইরূপ বাস্তবতা সত্ত্বেও ১৯৮০-র দশকে একটি বিশেষ মহল বঙ্গবন্ধুর স্থলে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি উত্থাপন ও প্রচার শুরু করে। এখানে উল্লেখ্য, মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় কখনও ওইরূপ দাবি উত্থাপন করেননি।
জিয়াউর রহমানের ইন্তেকালের পর মহলবিশেষ দ্বারা ওই দাবি উত্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকার উপরে বর্ণিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিল-পত্র’ পুনঃমুদ্রণের নামে পুনঃসংস্করণ করে। এর তৃতীয় খণ্ডের ১ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর স্থলে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। তদনুসারে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করে পুনঃসংস্করণ প্রকাশ করা হয়।
এভাবে ইতিহাস বিকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি অবশেষে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। জনৈক ড. এম এ সালাম বিষয়টি সম্পর্কে হাইকোর্ট বিভাগে ২৫৭৭/২০০৯ নং রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট বিভাগ ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকারনামীয় ওই রিট মামলায় ২০০৯ সালের ২১ জুন রায় দেয়।
রায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে একাত্তরের ২৫ থেকে ২৭ মার্চ উল্লিখিত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তদানীন্তন মেজর জিয়ার সঙ্গে কর্মরত মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরী, লে. শমসের মুবিন চৌধুরী প্রমুখ সামরিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার, ২৬ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার প্রশ্নে বিভিন্ন পুস্তকে প্রকাশিত জেনারেল টিক্কা খানের জবাব, ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও স্পিকারের ভাষণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংধিানের তফসিলে লিপিবদ্ধ ‘The Proclamation of Independence’ সহ আনুষঙ্গিক ডকুমেন্ট ও তথ্যাদি বিশ্লেষণপূর্বক নিম্নবর্ণিত সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়- “আমরা ঐতিহাসিক নই এবং ইতিহাস লিখন আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে উপরে বর্ণিত ঘটনাবলীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সামরিক সরকারের সামরিক অভিযান আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অয়্যারলেস, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন মারফৎ সমগ্র বাংলাদেশে তাহার স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রেরণ করেন। গভীর রাত্রে ইহা চট্টগ্রামে গৃহীত হয়।
“২৬শে মার্চের প্রত্যুষ হইতে মাইক দ্বারা চট্টগ্রাম শহরে এই ঘোষণা প্রচারিত হইতে থাকে এবং এই ঘোষণার সাইক্লোস্টাইলকৃত কপি সর্বত্র বিতরণ করা হইতে থাকে যে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছেন। দুপুর ২-২.৩০ মিনিটের সময় আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামস্থ জেনারেল সেক্রেটারি এম. এ. হান্নান কালুরঘাটের বেতার ট্রান্সমিটার চালু করতঃ সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা নিজের নাম উল্লেখপূর্বক পাঠ করেন। তবে ইহা একটি অনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল।
“৯ নং প্রতিবাদী বেলাল মোহাম্মদ স্বাধীনতার এই ঘোষণা বেতারে নিয়মিত অনুষ্ঠান হিসাবে প্রচার করিবার প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেন। তিনি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত প্রচার কেন্দ্র হইতে ইহা প্রচার করিতে ব্যর্থ হইয়া তাহার কয়েকজন সহকর্মীর সহায়তায় কালুরঘাটে অবস্থিত বেতার ট্রান্সমিটারটি পুনরায় চালু করেন। অতঃপর, সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটের সময় নাম প্রকাশ ব্যতিরেকে আবুল কাশেম সন্দীপ অনুষ্ঠান ঘোষণা করেন। ইহা একটি গুপ্ত বেতার কেন্দ্র ছিল বিধায় নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলেই নাম প্রকাশ ব্যতিরেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা বার বার প্রচার করিতে থাকেন। এই সময় এম এ হান্নান উপস্থিত হন এবং নিজের নাম ঘোষণ ব্যতিরেকেই শেখ মুজিবের ঘোষণার আলোকে লিখিত বক্তব্য প্রচার করেন। প্রতীয়মান হয় যে, সেইদিন সন্ধ্যায় উক্ত বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত প্রায় সকলেই বেতারে বক্তব্য রাখেন।
“বেতার কেন্দ্রে কর্মীগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেছিলেন। এই কারণে বেলাল মোহাম্মদ পরদিন ২৭শে মার্চ তারিখে পটিয়া থানায় গমন করতঃ মেজর জিয়াউর রহমানকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে লইয়া আসেন। সন্ধ্যায় তাহার প্রস্তাব অনুসারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে একটি ঘোষণা পাঠ করেন (১৯৮২ সনের দলিলপত্র: তৃতীয় খণ্ড, পৃ.২)।
“২৫-২৭ শে মার্চ সময়ে যে সমস্ত সামরিক অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের সহিত কর্মরত ছিলেন তাহাদের মধ্যে তদানীন্তন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধূরী, লেঃ শমসের মুবিন চৌধূরী প্রমুখ সাক্ষাৎকার প্রদান করিয়াছিলেন (দলিলপত্র: নবম খণ্ড)। কিন্তু তাহারা কেহই মেজর জিয়াউর রহমান যে ২৭শে মার্চ বা ২৬শে মার্চ তারিখে নিজেকে 'Provisional President and Commander-in-Chief দাবি করিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহা তাহাদের সাক্ষাৎকারে বলেন নাই। এমনকি জিয়াউর রহমান তাহার জীবদ্দশায় কখনও এইরূপ করেন নাই।”
ওই রায়ের আদেশ অংশে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ও তিনিই প্রথম এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মর্মে উক্ত দলিল-পত্রের ৩য় খণ্ডের ২০০৪ সালে পুনঃমুদ্রণের ১ম পৃষ্ঠার বর্ণনা ‘The Proclamation of Independence’-এর পরিপন্থী তথা সংবিধান পরিপন্থী বিধায় অবৈধ ঘোষণা করেন এবং উক্ত খণ্ডসহ একইরূপ বক্তব্য যেসব বই-পত্রে মুদ্রিত বা বিবৃত হয়েছে তা অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি ওই বিষয়ে সব ধরনের বিকৃতি দূর করে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতেও সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়।
ওই নির্দেশ অনুসারে সরকার ২০০৯ সালে ওই দলিলপত্র সংশোধন করে পুনঃমুদ্রণ করে। এভাবে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটেছে এবং এর মাধ্যমে মিথ্যা পরাভূত হয়েছে ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। বি এল টি বিশেষ সংখ্যা-২০১০
২। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিল-পত্র (৩য় ও ৯ম খণ্ড)
৪। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের টেপ রেকর্ড
লেখক: মহানগর দায়রা জজ, ঢাকা
বাংলাদেশের নির্বাচনে সন্ত্রাস, কারচুপি ও জালিয়াতির প্রবর্তন ঘটান জেনারেল জিয়াউর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে উদ্দেশ করে যথার্থই বলেছেন, ‘ভোট চুরির অপবাদ আওয়ামী লীগকে দেবেন না। ভোট চুরির মহারাজা বিএনপি।’
জন্মলগ্নে শুরু করা ভোট-সন্ত্রাসের ঐতিহ্য থেকে বিএনপি আজও বের হতে পারেনি। তাই তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনেও অশান্তি সৃষ্টি করে।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে কাদের বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে এক নেতা ব্যালট চুরি করতে গেছেন। ব্যালট চুরি করে নির্বাচনে জিতবে- এ জন্য তারা সকালে আদালতে হামলা করেছে। ভোটগ্রহণ পণ্ড করতে বার বার আদালতে হামলা করছে। ফখরুল সাহেব, আপনারা ধরা পড়ে গেছেন।’
আসলে জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের শত্রু। তারা অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়। জিয়া নিজেই তার স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মানুষের ভোটদানের অধিকার। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের হ্যাঁ/না ভোটের মডেল চুরি করে জিয়াউর রহমানও করেছিলেন হ্যাঁ/না ভোট।
পক্ষান্তরে জন্মলগ্ন থেকেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি।’
আওয়ামী লীগ প্রধানের পরিষ্কার বার্তা, ‘আমি কখনোই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সবাই গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে লড়াই করেছেন। দেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ইতিহাসে একটু নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
স্বাধীনতার পর দেশে ১১ বার জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ৫ বার, বিএনপি ৪ বার ও জাতীয় পার্টি ২ বার সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে ৫ বার নির্বাচিত দল পূর্ণ মেয়াদ সরকার চালাতে পারেনি।
সবশেষ ২০০৮ সালে মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গোটা দেশ এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। তবে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে শুরু হয় অস্থিরতা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান জাসদ, গণবাহিনী এবং পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র গোপন জোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।
নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। পরে অবশ্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বসিয়ে নিজে উপ-প্রধান হন। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে শপথ নেন। প্রায় দেড় বছর স্বৈরশাসন কায়েমের পর ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল সামরিক শাসনকে বেসামরিক শাসনের চেহারা দিতে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন জিয়া। গণভোট বা আস্থা ভোটের নামে প্রহসন চলে দেশজুড়ে।
দেশবাসী সে আস্থা ভোট প্রত্যাখ্যান করেন। মাত্র ২ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে হাজির হন। প্রায় সব বুথই ছিল জনশূন্য। কিন্তু দেখানো হয় ভোট পড়েছে ৮৮ শতাংশ! আর প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে জিয়া নিজেই পান ৯৮ শতাংশ!
সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভোটকর্মীরাও ব্যাপক হারে ছাপ্পা ভোট মারেন। শুধু তাই নয়, সেনা আইন লঙ্ঘন করে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশ নেন জিয়া। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ভোটে কারচুপির মাধ্যমে নিজেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেন।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় একনায়কতন্ত্র। জিয়া একাই দখলে রাখেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পদ।
সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকেই ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন জিয়া। সরকারি প্রচার যন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবহার করেন ভোটে। বিরোধীদের কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি ভোটের প্রচারের। হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষপাতকে হাতিয়ার করে ভোটকে করে তোলেন প্রহসন।
এরপর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মুক্তি ঘোষণা করেন জিয়া। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ করে দেন তিনি। আইন সংশোধন করে দালালদের ভোটার হওয়ারও সুযোগ দেন।
জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রী জিয়ার অপরাধের কোনো সীমা নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকেও তিনি মদদ জুগিয়েছেন। ঘাতক-দালালরা তার আমলে পেয়েছে সরকারি মর্যাদা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে নিষিদ্ধ মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নিজাম-ই-ইসলামের মতো দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন জিয়া।
শুধু তাই নয়, জিয়ার শাসনামলে শুরু হয় আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন। গণতন্ত্রের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না তার। তাই জিয়া ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ফরমান জারি করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।
এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। সেই নির্বাচনে তিনি দালাল ও স্বাধীনতা বিরোধীদের মনোনয়ন দিয়ে তাদের জয় নিশ্চিত করেন। বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর হামলার পাশাপাশি পথভ্রষ্ট সেনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে লুন্ঠিত হয় মানুষের ভোটাধিকার। এ সময়েই ভোট-সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছিলেন জিয়া। বিএনপি সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া নিহত হওয়ার পর এইচএম এরশাদ সামরিক ক্ষমতা দখল করে সেই ধারাই চালু রেখেছিলেন। ভোটের নামে জাতীয় পার্টিও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠন করেছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর গণতন্ত্র পুনরুত্থানের আন্দোলন বেগবান হয়। বাংলাদেশ ফিরে পায় গণতন্ত্র।
একইভাবে জিয়ার উত্তরসূরি তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমানও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিজেদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাদের সেই অপচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৯৫-৯৬ সালে জোর করে ক্ষমতা দখলের পর মাত্র ৩ মাস ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
২০০১ সালেও নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া ভোটারদের কল্যাণে ক্ষমতায় আসে চারদলীয় ঐক্য জোট। যেখানে জোটে বিএনপির সঙ্গী জিয়াউর রহমানের মতোই যুদ্ধাপরাধীরা।
২০০৬-০৭ সালেও একই উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন জিয়াউর রহমানের ছেলে এবং বাংলাদেশের আদালতে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়া। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দিন শেষে বাংলাদেশের মানুষের ভোটে, বাংলাদেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আবারও গণতন্ত্রের ধারা চালু করে আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আগলে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের মূল চালিকাশক্তি এ দেশের জনগণ। এ দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে বিদেশীদের দ্বারস্থ হয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সাল ১৯৭১, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণের মৌলিক অধিকারের বিস্তর ফারাক ও চাওয়া-পাওয়ার বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জাতি হিসেবে বাঙালির স্বীকৃতি আর স্বাধীনতার স্বাদ সবেমাত্র পেয়েছিলাম আমরা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের খুঁটিগুলোকে সবেমাত্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেয়া বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরলোক গমনের সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা এদেশের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে শুরু হয় অন্য এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বাহানায় সেখানে সৃষ্টি হয় একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ‘শান্তিবাহিনী’। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমেই অশান্ত হয়ে পড়ে। দিন-দুপুরে শান্তিবাহিনীর হাতে খুন হতে থাকে নিরীহ পাহাড়ি ও বাঙালিরা। চাঁদাবাজি, খুন, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ছিলো সেখানকার নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। এক কথায় কয়েক হাজার নিরীহ জনসাধারণ প্রাণ হারায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে।
এই সময়টাতে অরক্ষিত সীমান্তসহ ভূখণ্ড রক্ষা ও শান্তি ফেরাতে সেখানে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এরপর সেনা-বিজিবি-পুলিশ ও আনসার মিলে দিনের বেলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও রাতের বেলা গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে বিলীন করে গণহত্যা চালাতে থাকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা।
এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাহাড়ের সমস্যার আর সমাধান হয় না। এভাবে কেটে যায় প্রায় দুই যুগ।
১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য জেলাগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে দফায় দফায় বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু করে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশের বিধিবিধান ও আইন যথাযথ অনুসরণ করে কোনো তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়।
দুই যুগের কালো অধ্যায় শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে আলো ফেরে পাহাড়ে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ। পাল্টাতে থাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিত্র। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারের ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নানা সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের কারণে পর্যটনেও ভূমিকা রাখতে শুরু করে পাহাড়।
বর্তমান সরকার বিগত পঁচিশ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। শান্তিচুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি ওই এলাকায় অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।
চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করেছে এবং স্থানীয় সরকার পরিষদকে জেলা পরিষদে রূপ দিয়ে পাহাড়ের অভূতপূর্ব উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ‘তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন।
প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে ও শরণার্থী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা এবং ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর ২ হাজার ৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই এবং এর মধ্যে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে।
একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন দফতরে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের একজন সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিক পর্যায়েও অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভূমিবিষয়ক আইন ও বিধিমালা ছিল না। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে, যা চলমান।
শান্তিচুক্তির আগে এডিপিভুক্ত প্রকল্প ছিল একটি। এখন সেখানে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন বাজেট দেয়া হয় ৯১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা আগে (১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে) ছিল ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ঢাকার বেইলি রোডে ১ দশমিক ৯৪ একর জমির ওপর ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স।
চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে। আগে পার্বত্য অঞ্চলে কোনো মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল না। ট্রাইবাল স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চলমান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিস্তারে সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। চুক্তির আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল খুবই কম। চুক্তির পর দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪শ’ উপজাতি ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
এক সময় পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার জন্য নানা প্রতিকূলতা জয় করে সমতলে আসতে হতো। তাদের শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। ওই এলাকায় দুর্গম হিসেবে পরিচিত বসতিতেও উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পাড়াকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা পড়ছে নিজের মাতৃভাষায়।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলায় ৮৭৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন জেলায় এ পর্যন্ত ৫৬০ কিলোমিটার (৩৩ কেভি), ৯৮৪ কিলোমিটার (১১ কেভি) ও ১৩৫৫ কিলোমিটার (৪ কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এরকম লক্ষাধিক পরিবারকে ধাপে ধাপে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত ছিল না। চুক্তির সুফল হিসেবে রাতের আঁধারেও দুর্গম পাহাড়ের কুঁড়েঘরগুলোতে জ্বলছে সোলার বাতি।
চুক্তির আগে পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। বান্দরবানের রুমা ও ধানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর ওপর কোনো সেতু ছিল না। এখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাস্তা ও বিভিন্ন আকারের সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করছে।
চুক্তির পর ১ হাজার ৫৩২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান এবং আরও প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
পাহাড়ি সড়কে যানবাহন চলাচলে একটা সময় ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী ‘বেইলি সেতু’ ছিল একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়াটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। মানুষের শঙ্কা ও দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্রও। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাগড়াছড়ির অধিকাংশ পাটাতনের বেইলি সেতু সরিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্থায়ী সেতু। অতিসম্প্রতি কেবল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়ই ৪২টি স্থায়ী সেতু নির্মাণ হচ্ছে। এতে পরিবর্তন আসছে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগে। ইতোমধ্যে সেতুগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
শান্তিুচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে। চুক্তির আগে তা ছিল না বললেই চলে। ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নয়নে মোবাইল অপারেটরগুলোর পাশাপাশি পাহাড়ে ব্রডব্যান্ড ওয়াইফাই-এর বিস্তার ঘটেছে। এছাড়া নেটওয়ার্কের জটিলতা নিরসন করে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ দিয়েছে সরকারি টেলিকম কোম্পানি টেলিটক।
পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম এবং চাষী পর্যায়ে উন্নতমানের ধান-গম ও পাট বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম চলছে। কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে পাহাড়ে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে মধু, কফি, আম, কমলাসহ নানা অর্থকরী ফসল আবাদ হচ্ছে। সেসব প্রতিবছর সমতলে সরবরাহ এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সাল থেকে উপজাতিদের নিজস্ব পাঠ্যপুস্তকের আওতায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়িদের ভাষা সংরক্ষণে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে সাতটি শব্দকোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখণ্ড বরাবরই বড় সম্ভাবনা ক্ষেত্র। উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। গড়ে উঠছে পর্যটনের অবকাঠামো।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর বর্তমান সরকারের আহ্বানে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্প ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছে। পার্বত্য জেলা শহর, নদী, সর্পিল রাস্তা, পাহাড় ও সবুজে ঘেরা সারি সারি গাছ, পাহাড়ের গুহা, ঝর্ণা, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি, জীবনধারা ও বিনোদনের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সড়কপথ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধন করছেন। তারা সাহসী ভূমিকা নিয়ে বৈরী পরিবেশে কাজ করে চলেছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং দুর্গম পাহাড়ি পথে সড়ক নির্মাণ করে উল্লেখযোগ্য স্থানে পর্যটন শিল্প উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাত যাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় এখন সৌন্দর্য পিপাসু হাজারো মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে।
জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে স্বতন্ত্র কোভিড ইউনিটে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, ফ্লু কর্নার, আরটিপিসিআর ল্যাব, বেড সাইড সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ, বহির্বিভাগ সেবা, শিশুবিকাশ কেন্দ্র (অটিজম রোগীদের সেবাসহ), অন্তর্বিভাগ সেবা, জরুরি বিভাগ সেবা, সার্জারি, নবজাতকের জন্য শেখ রাসেল স্কেন্যু সেবা, মাতৃ স্বাস্থ্য সেবা, প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী সেবা, নরমাল ডেলিভারি (২৪ ঘণ্টা), সিজারিয়ান সেকশনে (২৪ ঘণ্টা) সেবা দেয়া হচ্ছে।
এর পাশাপাশি রোগ নির্ণয়, প্যাথলজি বিভাগ, এক্স-রে বিভাগ, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, জরায়ু ক্যান্সার শনাক্তকরণ (ভিআইএ), নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রম, পুষ্টি সেবা (আইএমসিআই), সমাজ সেবার রোগী কল্যাণ কার্যক্রম, ওসিসি (সারভাইবলদের সহায়তা) প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
এর বাইরে দুর্গম এলাকাগুলোতে নিয়মিত চক্ষু সেবা ক্যাম্প, মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনসহ নানাভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। সব ছাড়িয়ে করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রমে নিজেদের হেলিকপ্টার ব্যবহার করে পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় পাহাড়িদের টিকা দিয়ে অভাবনীয় প্রশংসা কুড়িয়েছে সেনাবাহিনী।
শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে সরকার ও সেখানকার আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কমে এসেছে চাঁদাবাজি। বেড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি। আগে যেখানে দিন-দুপরে গাড়ি থামিয়ে, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে, অপহরণ করে বিরাট অঙ্কের চাঁদাবাজি হতো সেখানে তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। একটা সময় ছিলো, পাহাড়ি সড়কে বিকেল ৩টার পর কোনো যানবাহন চলাচল করতো না সন্ত্রাসীদের ভয়ে। সেখানে আজ ২৪ ঘণ্টাই বিলাসবহুল গাড়ি চলাচল করছে, যা শান্তিচুক্তির অভাবনীয় সাফল্য।
শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে এসে কী পরিবর্তন হলো পাহাড়ের? জানতে চেয়েছিলাম কয়েকজনের কাছে। কেউ বলছেন বান্দরবান এলাকায় নির্মিত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ৭২ কিলোমিটার সড়কের কথা। কেউ বলছেন, মেডিক্যাল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রত্যাশা পূরণ করেছে। তবে সাধারণ মানুষ বলতে চাইছেন, পার্বত্য ভূখণ্ডে এমন অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখানে পাকা সড়ক নির্মাণ কখনও হবে এমনটি ভাবনায় আসত না। এখন তা বাস্তব। মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত নির্মিত সীমান্ত সড়কের কথাও বলছেন অনেকে।
কেউ বলেন বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার কথা। কারও বিবেচনায় সরকার তো রেলপথ নির্মাণের কথাও ভাবছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিপাশ্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা শুনতে পাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, এটা অনেকের ভাবনায় না এলেও চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে এসে আজ তা এক বাস্তবতা।
চুক্তি এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে শুরুতে উপকারভোগীদের মধ্যে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ চুক্তির কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি জাতীয় মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে উন্নয়ন-অবকাঠামো দিন দিন বিকশিত হচ্ছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টায় শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সবাই একযোগে কাজ করতে পারলে শান্তির পথ সুগম হবে।
সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয় তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার মাত্র এক বছরের মাথায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি মূলত তার লক্ষ্যের প্রথম ধাপ অর্জন করেছিলেন।
একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি একদিকে যেমন চুক্তির কিছু ধারা দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন, তেমনি টেকসই পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রেখে কিছু ধারা বাস্তবায়নের জন্য ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সীমান্তবর্তী নানা অপতৎপরতা, দেশের অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদীদের নীরব উৎপাত এবং বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অপরাধপ্রবণতা- এসব কিছুই পাহাড়ের শান্তি ও সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি হতে পারে বাধাগ্রস্ত। ভুলে গেলে চলবে না, শান্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই এই বাস্তবতাকে স্মরণে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ২৫ বছরের অর্জনকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে যে কোনো মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে পাহাড়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
আজকের এই দিনে আমি গভীরভাবে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি বিমা পেশায় ছিলেন বলেই আজকের এই দিনটি বিমা পেশাজীবিরা পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ তার সাহসী নেতৃত্বে দিবসটিকে ‘খ’ শ্রেণি থেকে ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নীত করায়।
বিমা দিবসের শপথ হোক দ্রুত বিমা দাবি পরিশোধ করব আমরা। বিমা দিবস সব বিমা পেশাজীবীদের একটি আনন্দের দিন। ঈদ ও পূজার দিনের মতো আজ প্রতিটি মোবাইলে বিমার গুরুত্বের এসএমএস পাওয়া যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিবসটি উদ্বোধনের পর প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে র্যালি ও আলোচনা সভা হবে। এই কাজটি সব বিমা কোম্পানি মিলে ১০০ কোটি টাকা খরচ করলেও করা যেত না, যা সরকারের একটি নির্বাহী আদেশে হয়েছে। বিমা দিবসের ফলে জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের হচ্ছে। টিভিতে টকশো হচ্ছে ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচার হচ্ছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে জাতি বিমার সুফল পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বিমা সব বিমা কোম্পানিকে বিক্রি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যে কোম্পানি যত দ্রুত দাবি পরিশোধ করবে সে কোম্পানি আগামী দিনে বীমা খাতের নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশে গ্রুপ বিমার অপার সম্ভবনা রয়েছে।
বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার গ্রুপ বিমাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা সম্ভব। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিমার জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বর্তমানে দেশ স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রিমিয়াম আদায় করা সম্ভব হচ্ছে। একই সঙ্গে বিমা গ্রাহকরা ঘরে বসে ব্যাংকের পাশাপাশি বিইএফটিএন ও মোবাইল ব্যাংকিং যেমন: বিকাশ, রকেট ও নগদে দ্রুত ও সহজে সুবিধা পাওয়ায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিকট দিন দিন গ্রাহক পর্যায়ে অভিযোগ হ্রাস পাচ্ছে।
আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড শুরু থেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে বিমা দাবি পরিশোধ করে আসছে। জেনিথ ইসলামী লাইফ প্রায় ১৬ কোটি টাকারও অধিক বিমা দাবি ইতোমধ্যে পরিশোধ করেছে।
আমরা গ্রুপ বিমাসহ অনলাইনে ইআরপি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ৭ কর্মদিবসে দাবি পরিশোধ করে থাকি। বিমার আস্থা ফিরে আসার জন্য বিমা দাবি পরিশোধের বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিমার সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য পঞ্চম শ্রেণি হতে পাঠ্যসূচিতে বিমা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
লেখক: জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল
আরও পড়ুন:পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে জাতির ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মের পর থেকে পিতা-মাতার আদরের ‘খোকা’ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন শেখ সাহেব, পরে বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা- সময় পরম্পরায় নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। সে হিসাবে পার হয়ে গেছে অর্ধশত বছর
ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ তখন চরমে। পূর্ব পাকিস্তানের স্থানে স্থানে চলে বিভিন্ন কর্মসূচি। পূর্ব পাকিস্তানে কথিত স্বাধীনতার নামে নতুন পরাধীনতা-শোষণের মুখে বাংলা, বাংলার মানুষ। মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার পাঁয়তারা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দিশেহারা।
এরই মধ্যে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অরক্ষিত বাংলার চিত্র। বিশ্ব দরবারের নজর কাড়তে বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান।
পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা সভায় যোগ দিতে পাকিস্তানে যান শেখ মুজিবুর রহমান। লাহোরেই তিনি ঘোষণা করেন বাংলার অঘোষিত স্বাধীনতার সনদ ছয় দফা। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। নড়েচড়ে বসে আইয়ুব খানের স্বৈরচারী শাসন ব্যবস্থা।
স্বাধিকার আন্দোলন দমাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের নামে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৬ সালে ৮ মে গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি দেয়ার অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন।
এই ঘটনার পর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলা। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পেশ করা হয় ১১ দফা। শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। সেই আন্দোলনে শহীদ হন আসাদ, মতিউর, মকবুল, ক্যান্টনমেন্টে রুস্তম ও সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা।
বিশ্লেষকদের মতে, ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রস্তাব থেকে শুরু করে ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং এরপর সত্তরের নির্বাচন- এসব রাজনৈতিক পরিক্রমার ভেতর দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা।
ওই সময়ে মাত্র পাঁচ বছরে রাজনৈতিক দৃশ্যপট ব্যাপকভাবে বদলে যায়। তখনকার সময় আরও সুপরিচিত রাজনীতিবিদরা থাকলেও তাদের ছাপিয়ে সামনের কাতারে চলে আসেন শেখ মুজিব। এদিকে ১৯৬২ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বেশ দ্রুত মাত্র আট বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন এই অঞ্চলের একচ্ছত্র রাজনৈতিক নেতা।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি উত্থাপন শেখ মুজিবকে একবারে সামনের কাতারে নিয়ে আসে। ছয় দফার মূল বিষয় ছিল পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করা, যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে। ছয় দফার মাধ্যমে শেখ মুজিব গ্রাম ও শহরের মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি। এর কয়েক মাস পরই মে মাসে তাকে আটক করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। অভিযোগ ছিল- তিনি ছয় দফার মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। সেই থেকে প্রায় তিন বছর কারাগারেই কেটেছে শেখ মুজিবের।
কারাবন্দিত্ব শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এ সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ মিলে গঠন করা হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
সেখানে তুলে ধরা হয় ১১ দফা দাবি, যার মধ্যে শেখ মুজিব উত্থাপিত ছয় দফা দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি প্রাধান্য পায়। ৩৩ মাস পর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি মেলে শেখ মুজিবের।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেয়ার। দিন ঠিক করা হয় ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। স্থান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ সেদিনই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।
শোষিত ও বঞ্চিত জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে যে নেতা মৃত্যুকে বার বার তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন, তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে আপন করে নিয়েছিলো বাঙালি জাতি। সেদিনের সমাবেশে উপস্থিত লাখো মানুষ দু’হাত তুলে তোফায়েল আহমেদের সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন। সেই থেকে জাতির জনক শেখ মুজিবের নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি।
ওই সময়ের কারাগারের দিনগুলো ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ থাকায় স্থান পেয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে। বিশেষত তার গ্রেপ্তারের পর তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পত্র-পত্রিকার অবস্থা, শাসকদের নির্যাতন, ৬ দফা বাদ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার শাসকদের চেষ্টা ইত্যাদি বিষয় বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন।
বঙ্গবন্ধু আজীবন মানুষের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন, যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন। বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বার বার তার ৬ দফাকেন্দ্রিক লেখায় ফুটে উঠেছে। এতো আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি বলে মন্তব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
ধাপে ধাপে মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত ও উজ্জীবিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা ছিল মুক্তির সনদ, সংগ্রামের পথ বেয়ে যা এক দফায় পরিণত হয়েছিল। সেই এক দফা স্বাধীনতা। সে সময় অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিকল্পনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সামরিক শাসকগোষ্ঠী হয়তো কিছুটা ধারণা করেছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়। ছয় দফাকে বাদ দিয়ে কয়েকটি ধারার দল জোট বেঁধে ৮ দফা দাবিসহ আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে কাহিনিও কারাগারের রোজনামচায় পাওয়া যায়।
একেবারেই বিনা বিচারে শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন একাকী একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল- তিনি বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। তার শরীর মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তো। বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে উন্নত জীবন প্রদানের স্বপ্ন ছিল তার।
আন্দোলন ও হরতালকে কেন্দ্র করে কারাগারে ধরে আনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। দলের প্রতিটি সদস্যকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন, তাদের কল্যাণে কতটা চিন্তিত থাকতেন সে কথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে কারাগারের রোজনামচায়।
ছাত্রজীবন থেকেই মাটি আর মানুষের জন্য নিবেদিত ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার দুরন্ত কিশোর খোকা। কর্মজীবী বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও গৃহিণী মা সায়েরা খাতুনের আদরের এই সন্তান সময় পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন কোটি বাঙালির প্রিয় মুজিব ভাই।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হকসহ বরেণ্য সব নেতার সান্নিধ্যে শেখ মুজিব ছাত্রনেতা থেকে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ।
প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে আওয়ামী লীগ- দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়েন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বপন করেন বাঙালির মুক্তির স্বপ্নবীজ। বাঙালির শোষণ মুক্তির এই স্বপ্নদ্রষ্টা অধিকার আর দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শাসকদের রোষানলে পড়েছেন, কারাগারেই কাটিয়েছেন প্রায় ১৪ বছর।
দীর্ঘ এই সংগ্রামী জীবনে ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ যেমন আছে তেমনি আছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো ঘটনাও। যে মামলায় কারাগারে নেয়া হয়েছিল শেখ মুজিবকে। প্রতিবাদে ন্যায় আর ন্যায্যতার পক্ষে গর্জে উঠেছিলো পুরো বাংলা।
শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শ্রমিক, কৃষক, সর্বস্তরের জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। শেষ পর্যন্ত তার মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।
পাকিস্তানি জান্তার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পান বাঙালির আবেগ, আকাঙ্ক্ষা আর মুক্তির সংগ্রামকে এক সুতোয় গাঁথা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবকে দেয়া বঙ্গবন্ধু উপাধি এক সময় তার মূল নামকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা ঐতিহাসিক দলিলেও তার নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় উপাধিটি। অর্ধশত বছর পর এসে আজও জ্বালাময়ী স্লোগানে সমস্বরে উচ্চারিত হয়- ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’।
লেখক: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মানুষের নজর কাড়ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসব উন্নয়ন-সাফল্যের খবর ব্যাপকভাবে প্রচারের নির্দেশনাও রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই। ইতোমধ্যে সেই ভোটের হাওয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে বইতে শুরু করেছে। সরকারের এসব উন্নয়ন-সাফল্যের খবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে একটা বাড়তি রাজনৈতিক সুবিধা দেবে নিঃসন্দেহে।
এমন বাস্তবতায় সরকারের এসব উন্নয়ন-সাফল্য বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের মতানুসারী সুশীলদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে।
করোনা মহামারি এবং পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে নেই।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে।
দারিদ্র্য নিরসন, আয়-বৈষম্য হ্রাস, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি খাত বহুমুখীকরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে কাজ চলছে।
কিন্তু বিএনপি সরকারের এসব পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না। দলটি ভাবনা, সামনে ভোটের লড়াইয়ে সরকারের এসব উন্নয়ন জনগণের মাঝে তাদের অবস্থান আরও দুর্বল করে দিতে পারে। যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার তাদের যে চেষ্টা তাতে এই উন্নয়ন বড় বাধা হিসেবে দেখছে দলটি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে। বাংলাভাই, হরকাতুল জেহাদসহ আফগানিস্তান ফেরত জঙ্গিদের হুঙ্কার এবং একযোগে সারাদেশে বোমা হামলায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নেকা মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো হয়েছে। রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে বসানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে।
চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়া, দেশের মাটিতে বিদেশি সন্ত্রাসীদের লালনপালন ও অস্ত্র সরবরাহ, তারেক রহমানের হাওয়া ভবন থেকে বিকল্প প্রশাসন পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় নানা কাজে কমিশন নেয়ার অভিযোগও কম আলোচিত হয়নি।
জোট সরকারের সময়ে সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ সংকট ছিল বরাবরের চিত্র। দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বের এক নম্বর দেশ হওয়ার তকমাও জুটেছে।
দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতায় থাকাকালে এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বিএনপিকে ভাবাচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালানোর মাধ্যমে জনগণের কাছে নিজেদের অতীতটা আড়াল করার একটা চেষ্টা দলটির রয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট ভেঙে যাওয়ার প্রকাশ্য প্রচারও সেই চেষ্টারই অংশ। যদিও ভেতরগতভাবে দুই দলের মধ্যে সেই গাঁটছড়াটা রয়েই গেছে।
পক্ষান্তরে টানা তিন দফা ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের নানামুখী সংকট দূরীকরণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যর্থতা থাকলেও সাফল্যের তুলনায় তা নিতান্তই গৌণ।
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ উৎপাদনের সক্ষমতা দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়ায় সেসব প্রচারও হচ্ছে। বাংলাদেশের মৌলবাদ-জঙ্গি দমনের সফলতা নিয়ে এখন বিভিন্ন দেশেই আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে। গভীর সমূদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, এয়ারপোর্ট, মেট্রো রেল, পাতালরেল- এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও আলোচনায় আসছে।
সরকারের এতো সব উন্নয়নের বিপরীতে নিজেদের দুর্বল অবস্থানটা বুঝতে পেরে বিএনপি এখন দেশ-বিদেশে সরকারবিরোধী প্রচারণায় মরিয়া। তা করতে গিয়ে দলটি দেশবিরোধী অবস্থান নিতেও দ্বিধা করছে না।
দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি থামাতে এখন তারা বিদেশিদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে গোপন চিঠি দিচ্ছে। তাদের সেসব অপচেষ্টা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মিডিয়াও তাদের দিক থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় তারা ভর করেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
রাজনৈতিক প্রচারে বিএনপির নেতারা দেশে গণতন্ত্রের কথা বলতে শুরু করেছেন। অথচ তারা স্বৈরশাসনের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল। তাদের দলের মধ্যেও গণতন্ত্র নেই। বিএনপির গঠনতন্ত্রেই দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।
নেতাদের মিথ্যাচার ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির ইমেজ আজ ধ্বংসের পথে। এ অবস্থায় দলটি এদেশের মুসলিম লীগ ও জাসদ-বাসদের মতো অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েছে।
এমন বাস্তবতায় বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মতানুসারী সুশীলরা সরকারের বিরুদ্ধে নানামুখী প্রচার চালিয়ে নিজেদের দুর্বলতা আড়ালের চেষ্টা করছেন। সরকারের উন্নয়ন-সাফল্য থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে তারা মনগড়া দুর্নীতির নানা অভিযোগ তুলছেন।
আপাতদৃষ্টিতে তাদের সেই চেষ্টা ফলদায়ক হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক
‘সু-স্বাস্থ্যের মূলনীতি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিধি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি দিবসটি উপলক্ষে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও।
দিবসটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে সবার মাঝে সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিগত ৫ বছর ধরে ঘটা করে দিনটি পালনের মধ্যেই আমাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে কী না। মানুষ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে কতটা সচেতন হয়েছে সে প্রশ্নও অবান্তর নয়।
সুষম ও নিরাপদ খাবার মানুষকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তেমনি আবার অনিরাপদ খাদ্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত যে খাবার খাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পেট ভরা।
নিরাপদ খাদ্য হলো মানসম্মত, ভেজালমুক্ত ও সঠিক গুণাগুণসমৃদ্ধ খাবার। অথচ আমাদের এখানে যেনতেনভাবে পেট ভরলেই তাকে খাবার হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। গড়পড়তা মানুষ মনে করে খাবার খেলেই হলো। পুষ্টি কী আর নিরাপদ খাদ্য কী- এসব বিষয় নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। খাদ্যের গুণাগুণ তো দূরের কথা, সেটি কতটা নিরাপদ তা নিয়েও বেশির ভাগেরই কোনো ভাবনা নেই।
আবার অনেকে মনে করেন, নামিদামি খাবার মানেই তা পুষ্টিকর। কম দামের খাবারও যে অনেক নামিদামি খাবারের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর হতে পারে সে বিষয়টি আমাদের অনেকেরই অজানা। খাবার কেনা বা গ্রহণ করার সময় দাম যাচাই না করে সেটির গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করাটা অপরিহার্য।
নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে আমরা এখনও উদাসীন। আমরা অনেকেই সময় বাঁচাতে সহজলভ্য, আকর্ষণীয় ও রেডিমেড খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ছি। গরমে বাইরে বের হলে প্রবল তৃষ্ণায় অনেকেই ভিড় জমান রাস্তার পাশের লেবুর শরবত, ফলের জ্যুস, রং-বেরঙের পানীয় শরবতের দোকানের সামনে। অথচ সেগুলোতে ব্যবহৃত বরফের বেশিরভাগই জীবাণুযুক্ত সরবরাহ লাইনের পানি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। আবার মিষ্টি স্বাদ আনতে ক্ষতিকর স্যাকারিন এবং আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় টেক্সটাইলের বিভিন্ন রং ও কেমিক্যাল।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরগুলোর অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভাজা-পোড়া খাবারের দোকান। পিছিয়ে নেই টক-ঝাল মেশানো চটপটির পসরাও। এসব খাবার দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, লোভনীয়। কিন্তু এই খাবারগুলোর বেশিরভাগই তৈরি করা হয় পচা-বাসি সামগ্রী ব্যবহার করে। ভাজার ক্ষেত্রে একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়, যেখানে তৈরি হয় ট্র্যান্স ফ্যাট।
অনিরাপদ দূষিত পানিতে নানা উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হয় টক পানি। অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে ফাস্টফুডের দোকান, ছোট ছোট ফুডকোর্ট। এগুলো ফুটপাতের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। সেসব দোকানে চলছে কম দামে নানা ফাস্টফুড জাতীয় খাবারের রমরমা বেচাকেনা।
খাবার সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় করে তুলতে এসবে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বাদ বর্ধক নানা উপাদান- টেস্টিং সল্ট, নানা ধরনের সস ও ক্যাচাপ। বর্তমানে খাবারের স্বাদ বাড়াতে মাত্রাতিরিক্ত হারে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করা হচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকের বাসায় সকালে কিংবা বিকেলের নাস্তার টেবিলে থাকছে পাউরুটি ও নানা ধরনের বেকারি আইটেম। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খাদ্যপণ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পটাশিয়াম ব্রোমাইড ও ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি থাকে।
আমরা পুষ্টিবিদেরা সব সময়ই খাদ্য তালিকায় দেশীয় মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে বলি। নির্দিষ্ট মৌসুমের ফলমূল ও শাকসবজিতে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে। তবে নির্দিষ্ট মৌসুম ছাড়া এবং দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা নামি-দামি বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন জাতীয় বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকর।
খাবারে উপরোক্ত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান ও দূষিত পদার্থ মেশানোর ফলে খাবার অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীরে সহজে বার্ধক্য আসছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে, কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এভাবে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
অনিরাপদ খাদ্য রোগের জন্ম দেয়, অপুষ্টিকর খাদ্যে স্বাস্থ্যহানি ঘটে। একইসঙ্গে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে, অসুস্থ ও দুর্বল সন্তানের জন্ম দেয়। শিশু বয়স থেকে এসব ভেজাল ও অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
দুর্বল স্বাস্থ্যের জনগোষ্ঠী দিয়ে সুস্থ, সবল ও কর্মঠ জাতি গঠন সম্ভব হয় না। দেশে অনিরাপদ ও অপুষ্টিকর খাদ্যের রমরমা বাণিজ্যে এক কথায় দেশ ও জাতি হুমকির মুখে পড়ছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি দশজনের মধ্যে একজন খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত। নিরাপদ খাদ্য যেমন সুস্বাস্থ্যের উৎস, তেমনই অনিরাপদ খাদ্য অনেক রোগের কারণ। সেজন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে রোগমুক্ত বা রোগের জটিলতামুক্ত থাকতে হবে। আর সেজন্য খাদ্য নিবার্চনের আগে সেটা কতটুকু নিরাপদ ও পুষ্টিকর তা অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে।
লেখক: পুষ্টিবিদ, ফরাজী হাসপাতাল বারিধারা ও লা মানো ডার্মা অ্যান্ড লেজার মেডিক্যাল।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য