মৃত্যু জীবনের এক অনিবার্য অধ্যায়। নশ্বর জীবন থেকে অবিনশ্বর জগতে আমাদের যেতেই হয়। অলঙ্ঘনীয় মৃত্যুর সত্য জেনেও মন কিছুতেই মেনে নিতে চায় না মৃত্যু। তবু চলে যেতে হয়, চলে যেতে দিতে হয়। এই নির্মম সত্য ভাবতে গেলে বিষণ্নতায় মন মেঘলা হয়ে যায়। মৃত্যু হচ্ছে চলমান জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার আরেক নাম।
কিন্তু মানব জীবনের অনিবার্য এই নিয়তির মুখোমুখি হয়ে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে যাবার পরেও কেউ কেউ মানুষের মনে বেঁচে থাকেন অনেক বছর, যদি তিনি হন চিরস্মরণীয় ব্যক্তি।
কথাগুলো মনে এলো জাতীয় অধ্যাপক, ভাষাসংগ্রামী ডক্টর রফিকুল ইসলামের প্রয়াণে। তিনি ব্যাক্তিগতভাবে আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অগণিত শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক। কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষের মনে এই জাতীয় অধ্যাপক পরম শ্রদ্ধার মানুষ। তিনি শিক্ষকদের শিক্ষক। তার চলে যাওয়া আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনসহ অগণিত সচেতন মানুষের মনে বিষাদের কালি ছড়িয়ে দিয়েছে।
বয়সের বিবেচনায় ৮৭ বছর মোটামুটি দীর্ঘায়ুই বলা যায়। তারপরও মনে হয় আহা যদি আরও কিছুদিন স্যার আমাদের মাঝে থাকতেন! এই আক্ষেপ এ কারণেই যে তিনি সাধারণ কোনো মানুষ নন। সৃজনে-মননে, পেশায় তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের বাতিঘরতুল্য এক জ্ঞানতাপস। বাংলা ভাষা সাহিত্য ছিল তার জ্ঞানের মূল বিষয়। ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে তার সুনাম দুই বাংলাতেই সমান বিস্তৃত।
ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তার একাধিক বই রয়েছে। ‘ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী’ গ্রন্থটি পড়লে এ বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতা এবং অধ্যয়নের বহুমাত্রিকতা যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন ভাষা এবং ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে। বাংলা ভাষা শুধু নয়, বিশ্বের অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীর বিবর্তন এবং বাংলার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণে কৌতূহল ছিল তার অপরিসীম। গবেষক হিসেবে তিনি অসাধারণ নিষ্ঠাবান ছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে অসামান্য স্মার্ট ছিলেন তিনি। কোনোদিন কাগজ দেখে পড়াননি। বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্কের বিষয় ছিল তার নখদর্পণে। তার আরেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান নজরুল গবেষণা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি আজীবন গবেষণার বিষয় করে রেখেছিলেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা ঐতিহাসিক।
বায়ান্নো সালের মহান ভাষা আন্দোলনের বহু মূল্যবান আলোকচিত্র ধারণ করেছেন তার নিজের ক্যামেরায়, যা একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক দলিল বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তার কাজ পথিকৃতের। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বীরের এই রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা’ এসব গ্রন্থ তারই স্বাক্ষর বহন করে। পরের বইটি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখা। ডক্টর রফিকুল ইসলাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ওপরে প্রথম গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বিষয়ে তার যে গবেষণামূলক রচনা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে যেসব লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল বিবেচিত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন, শেরেবাংলা নগর ঢাকার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। সেসব অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষক হিসেবে তার যেমন ভূমিকা উজ্জ্বল, তেমনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করেও তিনি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। ঢাকা গবেষণায়ও রয়েছে স্মরণীয় ভূমিকা। তার লেখা ‘ঢাকার কথা’ ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’ উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে।
এছাড়াও ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ এসব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আকর গ্রন্থ। ‘বাংলা ব্যাকরণ সমীক্ষা’ আরেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি একসময়। একাডেমির ব্যাকরণ, অভিধানসহ ভাষাবিষয়ক প্রায় সব কাজে যুক্ত ছিলেন রফিকুল ইসলাম। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সভাপতি হিসেবে।
আরও বহুবিধ কারণে ডক্টর রফিকুল ইসলাম স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানার জন্য তার রচিত নজরুল-জীবনী একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ‘নজরলজীবনী’ রচনার আগেও ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সাহিত্য’, ‘ছোটদের নজরুল’, ‘নজরুলনির্দেশিকা’,‘কাজী নজরুল ইসলামের গীতিসাহিত্য’ ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রন্থে নজরুলকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন করেছেন রফিকুল ইসলাম। নজরুলের গানের সুর ও রাগের ওপরে তার পড়াশোনা ছিল অগাধ।
বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ একাধিক টিভি চ্যানেলে নজরুলগীতি নিয়ে বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করেছেন তিনি। যারা সেসব অনুষ্ঠান দেখেছেন তারা সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন নজরুলের সঙ্গীতের কত বড় নিষ্ঠাবান গবেষক তিনি। ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করেছেন তিনি নজরুলের গানের বাণী ও সুর।
সরকার যখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় নজরুল ইন্সটিটিউট গড়ে তোলেন, সে সময়ও তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষক। নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান হিসেবে যেমন, ট্রাস্টি হিসেবে তেমনই এই প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে উজ্জ্বল অবদান রেখে গেছেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
পঞ্চাশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মেধাবী শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম ইমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছেন, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন, জাতীয় অধ্যাপক হয়েছেন, কিন্তু তারপরও তিনি আজীবন ছাত্র হয়েই থেকেছেন। অর্থাৎ পড়াশোনা থেকে নিজেকে কখনো দূরে সরিয়ে রাখেননি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পরেও ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে যেমন উপাচার্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষাবিস্তারে।
তার এই সাহিত্যনিষ্ঠা আর জ্ঞান পিপাসার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ‘হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য’ বইটি। এটি একটি সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থ! সহস্রাধিক পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে ডক্টর রফিকুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন। চার্জার কবি ভুসুকুপা থেকে এযুগের তরুণতম কবি পর্যন্ত, যাদের তিনি সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ মনে করেছেন, সংকলিত করেছেন এই বিশাল আকৃতির গ্রন্থে।
এটি মাত্র ১০/১২বছর আগের কাজ তার। পঁচাত্তর অতিক্রান্ত একজন পণ্ডিত গবেষক শিক্ষাবিদ কতটা সচেতন হলে এ ধরনের একটি গবেষণামূলক কাজ সম্পন্ন করতে পারেন, সহজেই অনুমান করা যায়।
২০১৯ সালে এক কাজে স্যারের বাসায় যাওয়ার পর কথায় কথায় তিনি এই বইটির কথা বললেন, জানতে চাইলেন এটি আমার সংগ্রহে আছে কি না। বললাম স্যার এই বইটির দেখেছি নজরুল ইনস্টিটিউটে একজনের কাছে, আমার কাছে নেই। সঙ্গে সঙ্গে সেলফ থেকে বের করে বইটি দিতে দিতে বললেন, এখানে তোমার বৃক্ষমঙ্গলের একটি কবিতা আমি নিয়েছি। আমি মুগ্ধ বিষয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
রফিকুল ইসলামের গবেষণায় বাংলাদেশের সাহিত্যের ঐতিহ্য সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। যে কারণে নজরুল যুগের কবি আব্দুল কাদিরের কবিতা এবং তার কবিজীবন গুরুত্ব পেয়েছে তার গবেষণায়। আব্দুল কাদির শিরোনামের ওই বইটি এ প্রজন্মের অনেকে হয়তো পড়েননি, অনেকেই দেখেনওনি। আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আব্দুল কাদির, ‘আবুল মনসুর আহমেদ রচনাবলী’ সম্পাদনাও তারই কৃতিত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘নজরুল অধ্যাপক’ রফিকুল ইসলাম ‘নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের’ও প্রথম পরিচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উৎসব চলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছুর জীবন্ত সাক্ষ্য এককালের ছাত্র ও শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সে সময় চলে গেলেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শতবর্ষের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। পথিকৃৎ কিন্তু রয়ে গেলেন রফিকুল ইসলাম। ২০০৩ সালে তিনিই প্রথম রচনা করেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮০ বছরের ইতিহাস’।
বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং নজরুল চর্চা ও গবেষণার এই মহিরুহ পণ্ডিত তার কাজের জন্য সব স্বীকৃতিই জীবদ্দশায় অর্জন করেছেন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এই ২০২১ সালেই মাতৃভাষার সংরক্ষণ পুনরুজ্জীবন বিকাশচর্চা ও প্রচার প্রসারের সার্বিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এ বছরই এই পুরস্কারটি প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় যে পুরস্কার তিনি নিয়ে গেলেন সেটি হচ্ছে অগণিত ছাত্রছাত্রীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
ছাত্র হিসেবে ক্লাস এবং টিউটোরিয়াল ক্লাসে যেমন তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযোগ হয়েছে, তেমনি দীর্ঘকাল দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে একজন লেখক এবং সাহিত্য সম্পাদকের সম্পর্কের দিক থেকেও রফিক স্যারকে দীর্ঘদিন গভীরভাবে দেখবার এবং জানবার সুযোগ হয়েছে। বাংলা আঞ্চলিক ভাষা কীভাবে বিবর্তিত হতে হতে অঞ্চলভেদে কত রূপ পেয়েছে তার স্বরূপসন্ধান তিনি দিয়েছিলেন আমাদের।
আজীবন তারুণ্যের সাধক ছিলেন তিনি। বয়স হয়েছিল এ কথা ঠিক কিন্তু বার্ধক্যকে কখনও মেনে নেননি তিনি। বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নামসর্বস্ব সভাপতি থাকেননি। প্রত্যক্ষভাবে কাজ করবার মানসিকতা তার সব সময় অটুট ছিল। যে কারণে একাডেমির প্রতিটি সভায় তিনি উপস্থিত থাকতেন।
আজীবন প্রগতিশীল আর মুক্তচিন্তার ধারক, অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রবক্তা এই শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে সমার্থক বিবেচনা করেছেন সব সময়। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’র সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রেখে যাবার জন্য জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।
কমিটির প্রধান নির্বাহী বা সদস্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী (কবি কামাল চৌধুরী) আর ডক্টর রফিকুল ইসলাম পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, বয়স তার কাজের জন্য কখনো বাধা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে তার যে তারুণ্য দেখেছি সেই তারুণ্য তিনি বহাল রেখেছিলেন অশীতিপর পর্যায়েও। শরীর দুর্বল হয়ে হয়েছিল একথা ঠিক, কিন্তু কর্মস্পৃহা আর মনের জোরে তিনি সক্রিয় থেকেছেন হাসপাতালের আইসিইউতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
সুতরাং এমন উদ্যমী মানুষের মৃত্যু হয় না, জীবনব্যাপী অবদান এর মধ্যে তারা বেঁচে থাকেন কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। রফিক স্যার বেঁচে থাকবেন তার বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞে এবং চির তারুণ্যের প্রেরণা হয়ে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক, (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।
আরও পড়ুন:স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল সংগ্রামের। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতি-সচেতন ছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অতি উৎসাহী কর্মী ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিবিরোধী তথা গণবিরোধী ভূমিকার কারণে অবস্থান পরিবর্তন করতে দেরি করেননি। তিনি ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে, জুলুমের বিরুদ্ধে। তার জীবন নিবেদিত ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নানামুখী তৎপরতায়। নিজের জীবনের সুখ-শান্তি হেলায় উপেক্ষা করেছেন। বাংলার মানুষের দুঃখ মোচনের লড়াইয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ছিলেন বলেই তিনি ১৯৬৯ সালেই হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জনরায়ে তারই হওয়ার কথা পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নেতা ইয়াহিয়া খান বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ না করে চাপিয়ে দেয় এক বর্বর যুদ্ধ।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবকে বাধ্য হয়েই যুদ্ধের মোকাবিলায় ডাক দিতে হয় জনযুদ্ধের, স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অকৃত্রিম বন্ধুর মতো বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশ পায় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি থেকেও হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। তার নামেই চলে ৯ মাসের অসম সাহসী যুদ্ধ এবং তার প্রেরণাতেই ঘটে যুদ্ধজয়। বন্দি মুজিব বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়েন। তার সাহস, মনোবল এবং মানুষের প্রতি তার দরদের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বেই।
নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির টানাপড়েনে কোন দিকে যাবে তা নিয়ে যখন অনেকের মনেই সংশয় ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে, তিনি বিশ্ব শান্তির পক্ষে। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু যারা যুদ্ধবাজ, যারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পছন্দ করে, তাদের ব্যাপারে কোনো নমনীয়তা ছিল না বঙ্গবন্ধুর।
শান্তি আন্দোলনের প্রতি শেখ মুজিব আগ্রহী ছিলেন বরাবরই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ওই বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস’। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তার কথা বলা বা মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। তার সফর অভিজ্ঞতার কথা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
১৯৫৬ সালের ৫-৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
বঙ্গবন্ধুর সরকারের দৃঢ় অবস্থান ছিল কোনো সামরিক জোটে যোগ না দেয়া। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশ্বের ১৪০ দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জুলিও কুরি হচ্ছে বিশ্ব শান্তি পরিষদের একটি সম্মানজনক পদক। ফরাসি পদার্থ বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রীর নাম ইরেন কুরি। তারা দুজনেই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। ইরিনার মা-বাবাও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী দম্পতি পিয়েরে কুরি ও মাদাম কুরি। পরে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে ‘জুলিও কুরি’।
বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’ পদক। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাই এ পুরস্কার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং।
১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ সেদিন থেকেই বাঙালি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের যে অমানবিক অবস্থান, তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসীনীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা, তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রতিক্রিয়া নিজেই দেখেছেন। সে সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ ও অনাহারীদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তার আছে। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ এটি তার প্রত্যাশাই শুধু নয়, নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এগিয়ে আসাও। তাই স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে জোর দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি এটাও বলেছিলেন, প্রয়োজনে আলেন্দের পরিণতি বরণ করব, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না।
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। তিনি জীবন দিয়েছেন কিন্তু আপসের পথে হাঁটেননি। বঙ্গবন্ধু শরীরী উপস্থিতি আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু তার আদর্শ আছে। যদিও এখন বিশ্বব্যাপী রাজনীতির ধরন এবং প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। শোষিতের পক্ষের বিশ্বশক্তি দুর্বল। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযেগিতা চলছে। শান্তির ললিত বাণী পরিহাসের মতো শোনায়। তার পরও বলতে ইচ্ছে হয়, হাল ছেড়ো না বন্ধু...
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির দিনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আরও পড়ুন:২৩ মে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, সে কথাটি আজ অনেকেরই স্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। অথচ ১৯৭৩ সালের সেই দিনটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মাননা পদক। পঞ্চাশের দশকে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক জোলিও এবং তার স্ত্রী ইরেন কুরির নাম অনুসারে ১৯৫৯ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তির জন্য প্রদেয় পদকের নামকরণ করেন এই বিজ্ঞানী দম্পতির নামে, ১৯৫৮ সালে ফ্রেডেরিক জোলিওর প্রয়াণের পর। উভয়ে যৌথভাবে নোবেল বিজয়ী এই দম্পতি শুধু বিজ্ঞান চর্চাই অবদান রাখেননি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে গোটা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন। ফ্রেডেরিকের একান্ত প্রচেষ্টায় গঠিত এই বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রথম সভাপতি তিনি নিজেই ছিলেন।
এই দম্পতি নোবেলপ্রাপ্তির সঙ্গে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা দিয়েই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তিদের পদক প্রদান শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে, যা ১৯৫৮ সালে ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পরও চলতে থাকে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব মহান ব্যক্তির হাতে এ পদক দেয়া হয় তাদের মধ্যে ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ভিয়েতনাম মুক্তির নায়ক হো চি মিন, চিলির সালভাদর আয়েন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ। এরা সবাই সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই পদকপ্রাপ্ত ৪৮তম রাষ্ট্রনায়ক। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকে এই বিরল সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলে ১৯৭৩-এর ২৩ মে ২৩তম এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে সেই পদক পরিয়ে দিয়েছিলেন সংস্থার সে সময়ের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র। অনুষ্ঠানে রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার মহানায়ক নন, তিনি সারা বিশ্বের, বিধায় বিশ্ববন্ধু।’ এভাবেই একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের পর এই পদককে দ্বিতীয় শীর্ষ আন্তর্জাতিক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর সেই বিরল সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা, ঠিক আমাদের স্বাধীনতার পর পরই, যা জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে অনেক গৌরবময় করে তুলেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে এ পদক প্রদানের জন্য শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বের কথাই বিবেচনায় নেয়া হয়নি, বিশ্ব সভাগুলোয় গোটা মানবজাতির জন্য তার ভাষণ এবং অবদানের কথাও বিবেচনায় আনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে, ১৯৭৩-এ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এবং কমনওয়েলথ সম্মেলনে তার ভাষণগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছিল শান্তি পরিষদ।
এসব আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, যথা শাসক এবং শোষিতের মধ্যে, আর তিনি শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর সেই মন্তব্য তাকে এক বিশেষ গুরুত্ববাহী দার্শনিকের পর্যায়ভুক্ত করে দিয়েছিল। তিনি শুধু কথার মধ্যেই তার প্রচেষ্টা সীমিত রাখেননি, তার নীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে ছিলেন মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর জনগণকে সমর্থন প্রদান করে। আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তিনি সে দেশের যুদ্ধরত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে ভারত বিভাগের আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সময়, যাতে বঙ্গভূমিতে কমবেশি ১০ লাখ লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, তখন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অসাধারণ, যা বহু রাজনৈতিক নেতাও করতে পারেননি। সিভিল সাপ্লাই-মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে খাদ্য আনতে। তিনি নিজ উদ্যোগে অনেক লঙ্গরখানা খুলে বহু বুভুক্ষু মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছিলেন। নিজের লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেছেন দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত মানুষের পক্ষে।
সোহরাওয়ার্দী সে সময়ের তরুণ শেখ মুজিবের ভূমিকা দেখে অবাক হয়েছিলেন। একই ধরনের বলিষ্ঠতা নিয়ে তিনি ১৯৪৫-এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে যে হত্যাযজ্ঞের উদ্ভব হয়েছিল, তা প্রতিরোধ করতে; তখনও তিনি লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাম্প্রদায়িক দস্যুদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে। তিনি এমনকি বাংলাভূমির বাইরেও বিচরণ করেছেন দাঙ্গা বন্ধের উদ্দেশ্যে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বহুদিন সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম বাংলায়ই থেকে গিয়েছিলেন, জিন্না-লিয়াকত আলি-নাজিমুদ্দিন গংয়ের ষড়যন্ত্রের ভিকটিম হয়ে। তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবও বহু সময় পাকিস্তান আসেননি। একসময় তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পাকিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দিলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার অনিচ্ছা প্রকাশ করে বরং তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে বলেছিলেন পূর্ব বাংলায় চলে গিয়ে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে ভূমিকা রাখতে। বলেছিলেন, হিন্দুরা যেন পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারতে পাড়ি না জমায় সেদিকে খেয়াল রাখতে।
ভারত বিভাগের পর তিনি অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা ভাষণ দিয়েছিলেন। এর একটি ছিল ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনাল’ আর অন্যটি ছিল ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলন। স্টকহোম সম্মেলনে সবার দৃষ্টি কেড়ে এই তরুণ নেতা বলেছিলে- ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূল নীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত এবং স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি, আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
তখন সবার মুখেই একটি বাক্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তা ছিল এই যে লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেলের পর এ ধরনের ভাষণ আর কেউ দেননি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি আমলের সিয়াটো-চুক্তি বর্জন করে জোট নিরপেক্ষ নীতির পথ ধরেছিলেন। বিশ্ব তখন একদিকে ন্যাটো, সিয়াটো, সেন্টো নামক তিনটি মার্কিন প্রভাবিত শিবির এবং অপরদিকে ওয়ারস নামক সোভিয়েত ব্লকের চুক্তিতে বিভক্ত ছিল। এদের কাজ ছিল বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রসহ আরও অধিক সমরাস্ত্র উৎপাদন করে বিশ্বে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
বঙ্গবন্ধু সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার থামিয়ে বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে, শান্তিকামী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। যে কারণে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সে সময়ের বিশ্বকাঁপানো নেতৃবৃন্দ, যথা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, নায়ারেয়ার, মার্শাল টিটো, বুমেদিন, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখের চোখের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য তার দাবি সবার কানে পৌঁছেছিল।
যে ব্যক্তি বিশ্ব মানবতার বিজয়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, জোলিও কুরি পুরস্কার তার অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। বেঁচে থাকলে তিনি নোবেলও পেতে পারতেন, অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বিরোধিতা করত।
লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
আরও পড়ুন:স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন জরুরি ছিল। তাই উন্নয়নের অনেক বেশি প্রত্যাশা অনেকেই করেনি। ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টি দীর্ঘ সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় ছিল। এসময়ে একটি পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল। বড় বড় বিলাসি বেসরকারি হাসপাতাল আর ডায়গনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সরকারি হাসপাতালের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের সমন্বয়ের কথা কোনো সরকার পক্ষই ভাবেনি।
রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাশালী মানুষ, সরকার পরিচালক ও ধনীক শ্রেণি সামান্য অসুখেও ছুটে যান থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে। এরা নিজেরাই যেখানে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থাশীল না হয়ে দেশান্তরী হন তা হলে আসল সংকটটি অনুধাবন করবেন কেমন করে! চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতিইবা হবে কীভাবে! হয়তো ভাবেন আমরা নিরাপদে থাকি পচনশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষ মরুক বা বাঁচুক তা দেখার দায় কি আমাদের!
গণশক্তি এবং জনমন তুষ্টি বিষয়টি আমলে না এনে রাজনৈতিক পান্ডাদের পেশি শক্তির ওপর নির্ভরতা যেদিন থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ জায়গা করে নিল সেদিন থেকে রাষ্ট্রের সব জায়গায় প্রশাসনের সকল রন্ধ্রে দুর্নীতির নিশ্চিন্ত আশ্রয় হলো।
দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক সরকারকে নিজেদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতায় পৌঁছার সিঁড়ি হিসেবে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়। তাই হাজার অন্যায় করলেও এদের সাতখুন মাফ হয়ে যায়। একারণে স্বাস্থ্য খাত থেকে শুরু করে দেশের সব খাতেই দুর্নীতিবাজরা সব অন্তঃসারশূন্য করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবান নেতা ও সব ধরনের প্রশাসনে দুর্নীতির ভাইরাস করোনার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় করোনাকালে এসে আমাদের অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে দুর্নীতি-আক্রান্ত স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা দেখতে হয়েছে।
এখন করোনার প্রকোপ কমে গেলেও দুর্নীতির ভাইরাস আরও শক্তিমান হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, স্বাস্থ্য খাতের নানাবিধ দুর্নীতির খবর বহুদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরও সরকারি দল ও সরকার এর তেমন কোনো প্রতিবিধানের চেষ্টা করেনি। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব জায়গায়ই দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোর জন্য বড় বড় বাজেট বরাদ্দ হয়েছে আর এর উল্লেখযোগ্য অংশই অন্ধকার ড্রেন দিয়ে দুর্নীতিবাজদের পঙ্কে জমা হয়েছে। তাই করোনাকালের সংকটে এসে একে একে খসে পড়ছিল ঝুলির কালো বিড়ালগুলো।
একটু পেছনে ফিরে তাকাই। করোনার মতো এত ভয়াবহ মাহামারির মোকাবিলার জন্য অভিজ্ঞতা এবং প্রস্তুতি আমাদের থাকার কথা ছিল না। এই বাস্তবতা অবশ্যই বুঝতে হবে। তবে করোনা আঘাত না হানলে আমরা বুঝতে পারতাম না দুর্নীতিবাজরা কতটা ঘুণপোকার মত কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফাঁপা করে ফেলেছে। ভেন্টিলেশন থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট যে এত প্রকট হবে কে বুঝেছিল! ইউরোপ-আমেরিকায় কভিড হানা দেয়ার পর সতর্ক হওয়ার জন্য বেশ কিছুটা সময় আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। দুর্নীতিবাজদের বিবেক কখনও কাজ করে না।
দেশপ্রেমের তো প্রশ্নই নেই। তাই হয়তো অপেক্ষা করেছে সংকট কখন আঘাত হানে। তখন তড়িঘড়ি অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য নিজেদের দুর্নীতির হাত প্রসারিত করার মওকা পাওয়া যাবে। কার্যকারণ সূত্রে এই কল্পনা অনেকটা যেন মিলে গিয়েছিল। এদেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা মুখে যা-ই বলুন না কেন দেশ বা জনগণ নয় দল সুরক্ষাটাই প্রধান বিবেচনা করেন। ছোট দেশ; সবাই সবাইকে চেনে। চোখের সামনের ঘটনাগুলো আড়াল করা যায় না। দেশের মানুষের শ্রমের টাকার রাজস্ব থেকে সরকার উন্নয়নের কাজ করে। কিন্তু অসহায় মানুষ দেখে অভ্যস্ত সব সরকারের আমলেই স্থানীয়পর্যায় থেকে জাতীয়পর্যায় পর্যন্ত দলীয় পান্ডারা ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সব ধরনের লাইসেন্স পেয়ে যায়।
তাই উপজেলা-জেলায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যার যার সময় দলীয় অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য ঠিকাদারির ‘ঠ’ অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারা ঠিকাদারির লাইসেন্স পেয়ে যায়। বিশেষ উপায়ে তারা টেন্ডারে জিতে কার্যাদেশও পায়। প্রায় সময় এসব কাজ বিক্রি করে দেয় সাব কন্ট্রাক্টটারদের কাছে। এভাবে কাজ শুরু হওয়ার আগে কমপক্ষে তিন জায়গায় বানরের পিঠা ভাগ হয়। ‘অফিস খরচে’ যায় একভাগ, মূল ঠিকাদার একভাগ রেখে সাব কন্ট্রাক্টকে দেয়। তিনি আবার তার ভাগ রেখে বাকি টাকায় কাজ সম্পন্ন করে।
ধরি এভাবে একটি রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করে। সেই কাজের মান কতটা রক্ষা পায় তা সহজেই অনুমেয়। তাই রাস্তার মাথা সংস্কার করে লেজের দিকে আসতে আসতে মাথা ভেঙে যায়। অর্থাৎ জনগণের টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেট ভরতেই শেষ হয়ে যায়। জনকল্যাণ হোক বা না হোক দলকল্যাণ তো হয়! করোনাকালেও তাই ঘটেছিল। আমরা কি ভুলে গেছি ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় মাস্ক কেনার কার্যাদেশ প্রায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে পেয়ে যায় সরকারি দলের নেতার প্রতিষ্ঠান। আর সরবরাহ করে ফেলে নকল মাস্ক। বিপুল টাকার ভাগবাটোয়ারা কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল তা প্রমাণ করার ক্ষমতা জনগণের নেই।
তবু ভালো শেষপর্যন্ত সংকট আড়াল না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর নজরদারি করেছেন। এতে সংকট মোকাবিলায় অনেকটা সাফল্য এসেছে।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সমুদ্র চুরির খতিয়ান তো নানা সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। মানুষ এসব খবর পায় ও ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু এ সংবাদটি পায় না যে, এসব দুর্নীতিবাজ বিচারের আওতায় এলো কি না। বরং এ তথ্য ভেসে আসে চিহ্নিত অনেক দুর্নীতিবাজ পুরস্কৃত হয় এবং নতুনভাবে দুর্নীতি করার মওকা খুঁজে নেয়। এভাবে দুর্নীতিবাজ বড় নেতা বা আমলা ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে এক সুন্দর সকালে কানাডা, সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে।
সরকারের ঘরে দুর্নীতিবাজদের বসতি থাকলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সরকার দৃঢ় নয় বলে করোনা সংকটেও বেসরকারি হাসপাতালগুলাকে জনকল্যাণে এগিয়ে আসতে বাধ্য করতে পারেনি। বাধ্য করাতে হলে সততার শক্তির প্রয়োজন হয়। এর প্রমাণতো আমরা করোনাকালে বেশ কয়েকটি নামি বেসরকারি হাসপাতালের উদ্যোগের নমুনা দেখতে পেয়েছি।
নানা অপকর্ম করা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদ ধরা পড়লেও সেসময় একে আমার কাছে বড় কোনো ঘটনা মনে হয়নি। বরঞ্চ বড় ঘটনা ৬০-এর বেশি মামলা আর একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে র্যাবের ভাষায় ভয়ংকর এই প্রতারক ঘুরে বেড়াতে পেরেছিল কেমন করে! গোয়েন্দারা কি চোখে ঠুলি পরেছিল? রাজনৈতিক নেতা আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা বুকে বুক মেলাতে থাকল। হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলল। অথচ এমন একজন চিহ্নিত অপরাধীকে চিনতেই পারল না! তাহলে প্রশাসন আর দেশ চলছে কেমন করে! আর সরকার ও সরকারি দলের কথাই বলি। সাহেদকে আটকের জন্য যত কৃতিত্বের কথাই বলেন জনক্ষোভ তৈরির আগে সে চেষ্টা কি করেছেন? তিনি আওয়ামী লীগে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে বেড়িয়েছেন তখনতো তা প্রতিবাদের বদলে উপভোগই করেছেন। ধরা পড়ার পর এই প্রতারককে না চিনতে চাইলে মানুষ কি দায়মুক্তি দেবে!
মানুষ এর একটি সরল অর্থই বুঝবে, তা হচ্ছে সবার কাছেই সম্ভবত এই প্রতারক কামধেনু ছিল। না হলে এত মামলার অভিযুক্তকে ব্যাংকগুলো কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয় কেমন করে! একাধিক চেক জালিয়াতি করে অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তার টিকিও ছোঁয় না। সহাস্যে এর সঙ্গে ছবি তোলেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা। করোনার মহাদুর্যোগে দেশে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল থাকার পরও সনদ তামাদি হয়ে যাওয়া এই প্রতারকের হাসপাতালের সঙ্গেই কোটি টাকার চুক্তি করতে হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
বিনাপয়সায় চিকিৎসা করানোর কথা বলে একদিকে সরকারের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়েছিল আবার রোগীর স্বজনদের পকেট ফতুর করে দিচ্ছিল। অথচ এসব তথ্য জানতে বড় দেরি হয়ে যায় সরকারি কর্তৃপক্ষের। যখন পারিপার্শ্বিকতার কারণে হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন মাঠে নামতে বাধ্য হন সবাই।
সাহেদ কাণ্ডের পরও কি নানা চেহারায় দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে না? আমাদের বরাবর মনে হয় রাজনৈতিক লাভালাভ আর প্রভাব থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে এবং দুদককে মুক্ত করে দিতে পারলে এসব অনাচার থেকে আমরা অনেকটা মুক্তি পাব। একই সঙ্গে করোনার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। দেশবাসী চিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক অধিকার হারাচ্ছে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত সামর্থ্য বিবেচনায় চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে ছোটেন। ঈশ্বর না করুন কভিডের মতো সংকটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে এবং একই সঙ্গে সেসব দেশে মরণ ভাইরাস আঘাত হানলে চিকিৎসার জন্য তো নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করতে হবে।
নাগরিকের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর তো করোনাকালে প্রমাণ করছে তারা কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ পেতে রেখেছে। ওখানে কিছু ফেললেই নর্দমায় চলে যাবে। তাই প্রথমত এই অঞ্চল রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ঝুড়ির তলা মেরামত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের ছায়ামুক্ত করে নতুনভাবে সব সাজাতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এদেশের চিকিৎসকগণ অকর্মণ্য, অদক্ষ আর অমেধাবী নন। মুক্ত পরিবেশে সুযোগ পেলে তাদের অনেকেই বিশ্বমানের চিকিৎসার কাঠামো গড়ে তুলতে পারবেন। সকলের চাওয়া হবে চিকিৎসার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত থাকুক মানুষের।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:কালজয়ী অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা, সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও কিংবদন্তি কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী চলে গেলেন। গত বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এই গুণী মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ আমি কখনই আমি পাইনি। সরাসরি কখনও দেখা বা কথা বলারও সুযোগ হয়নি। কিছু ভার্চুয়াল মিটিং বিশেষ করে সম্প্রীতি বাংলাদেশের জুম মিটিংয়ে কয়েকদিন কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কলাম পাঠের মধ্য দিয়ে। আমি আমার সেই ছাত্রজীবন থেকে গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম পড়ে আসছি। তার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমেই তিনি আপন হয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি যে মানের কলাম লিখেছেন তা খুব সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি উন্নত বিশ্বের নামকরা সব সংবাদমাধ্যমেও সেই মানের কলাম খুব একটা চোখে পড়ে না।
গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম মানেই তথ্যের সমাহার। এককথায় তিনি ছিলেন তথ্যভাণ্ডার। তথ্য শুধু স্মৃতিতে ধরে রাখাই বড় কথা নয়, সেই তথ্য প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহার করার মধ্যেই আছে মুনশিয়ানা। আর এই ব্যাপারে গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন যারপরনাই পারদর্শী। আমি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছি তার কলাম পাঠ করে। অনেকেই ভাবেন গাফ্ফার চৌধুরী যেহেতু ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির উত্থানপতনের প্রত্যক্ষদর্শী তাই সেই রাজনীতি ও ইতিহাসের অনেক তথ্য তিনি জানবেন এটাই স্বাভাবিক।
বিষয়টি আসলে তা নয়। সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি এবং ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ ছিল তার নখদর্পণে। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এমনকি আফ্রিকার অনেক রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং ইতিহাসের নানান ঘটনা ছিল তার দখলে এবং সেসব তথ্য তিনি খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই বিভিন্ন লেখায় ব্যবহার করে পাঠককে সমৃদ্ধ করেছেন।
লেখা অনেকেই লেখেন, কিন্তু অপ্রিয় সত্য কথা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে খুব কম মানুষই বলতে পারেন। গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সেরকম একজন ব্যক্তি যিনি উচিত কথা বলতে কোনোরকম দ্বিধা করেননি। তিনি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন অথচ সবচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন। বরং বলা যায় গাফ্ফার চৌধুরীর প্রয়াণে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার আর কেউ থাকল না।
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা বা বদনাম করা আর সমালোচনা করা এক বিষয় নয়। প্রকৃত সমালোচনা বলতে যা বোঝায় সেই সমালোচনাই গাফ্ফার চৌধুরী করেছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তিনি তার অসংখ্য লেখায় বিএনপির প্রচণ্ড সমালোচনা করেছেন কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছেন যে বিএনপির মতো একটি বড় দল তাদের রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল হিসেবে পরিচালিত হোক এবং সে ব্যাপারে তিনি অনেক মূল্যবান পরামর্শ তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন।
কলম চালানোর ক্ষেত্রে এই গুণী লেখক কখনই কোথাও নতিস্বীকার করেননি বা কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেননি। একবার একটি লেখা নিয়ে তারই এক বন্ধু এবং আমলা এনাম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং চলতে থাকে এই দুইজনের মধ্যে পালটাপালটি কলাম লেখা। এই কলাম যুদ্ধের একপর্যায়ে এনাম আহমেদ চৌধুরী সরে গেলে সেই পালটাপালটি কলাম লেখার অবসান ঘটে।
সেই কলামযুদ্ধে সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের প্রকাশ ঘটেছিল কারণ উভয়ই স্ব স্ব অবস্থান থেকে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন কিন্তু তাদের দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরেনি। এখানেই গাফ্ফার চৌধুরীর মতো লেখকের বিশেষত্ব। আমরা পাঠাকরা অবশ্য সেই কলামযুদ্ধ থেকে জানতে পেরেছিলাম অনেক কিছু।
গাফ্ফার চৌধুরী লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবে পদচারণা ছিল সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে। প্রতিসপ্তাহে ঢাকার একাধিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন নিয়মিত। অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে যখন কেউ কলম ধরতেই সাহস পায়নি, তখন তিনি সব ভয়ভীতি এবং সমালোচনার তোয়াক্কা না করে কলম চালিয়েছেন সাহসী কলমযোদ্ধার মতোই।
গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম লেখার পর অন্যরা তখন সেই বিষয়ে লেখার সাহস দেখিয়েছেন। গাফ্ফার চৌধুরীর এরকম তীক্ষ্ণ কলামের বাইরে যে বিষয়টি দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাকে জনপ্রিয় করে রেখেছে তা হচ্ছে তারই লেখা একুশের অমর কালজয়ী গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। একটি মাত্র গান লিখে যে একজন গীতিকার এত জনপ্রিয় হতে পারেন তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে গাফ্ফার চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।
একবার এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এসে বলেছিলেন যে এই গান এত জনপ্রিয় হবে তেমনটা ভেবে তিনি এটা লিখেননি। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখা সম্পূর্ণ আবেগতাড়িত হয়েই কবিতাটা রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীকালে আলতাফ মাহমুদের সুরে গানে রূপ নেয় এবং অমর একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে গ্রহণ করায় এই কালজয়ী গানটি আন্তর্জাতিকভাবেও জনপ্রিয় হয়।
গাফ্ফার চৌধুরী তার লেখনীর মাধ্যমে বাঙালি জাতির জন্য যা দিয়ে গেছেন তার মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে এবং যতদিন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ টিকে থাকবে ততদিনই তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। তারপরও তার অবদান এবং লেখাগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তার লেখা তো নিছক লেখা নয়, এসব লেখা হচ্ছে আদর্শের বাণী বিতরণ।
প্রতিটা লেখায় অনেক কিছু শেখার আছে। এসব লেখা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। সে কারণেই গাফ্ফার চৌধুরীর সমস্ত লেখা সন্নিবেশিত করে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে তা সবার জন্য পাঠের সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আর তার রচিত অমর একুশের গান যাতে গ্রিনিচ রেকর্ড বুকে স্থান পায় সেই উদ্যোগও নিতে হবে যদি সেখানে স্থান না পেয়ে থাকে। আমি যতটুকু জানি মান্না দের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’… গানটি বহুল শ্রুত হিসেবে গিনিচ রেকর্ডে স্থান পেয়েছে। সেই বিবেচনায় গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের গান সেখানে সবার আগে স্থান পাওয়ার কথা। এব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। একথা ঠিক যে অনেকেই গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে নানান পদক্ষেপ নিবেন এবং অনেক স্মৃতি সংগঠনও গড়ে উঠবে। এগুলো হতেই পারে। তার মতো কিংবদন্তি কলাম লেখকের লেখা একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ এবং প্রচারের ব্যবস্থা না করলে তথ্যের বিকৃতি হতে পারে।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরনটো, কানাডা-প্রবাসী।
আরও পড়ুন:গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গত কয়েক বছর রাজনীতি, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় ও আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই পরিচয়ে তাকে অনেকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি নিজেকে একজন ভাসানী অনুসারী দাবি করলেও তার সমর্থন ও দুর্বলতা ডান-বাম, উগ্র ডান, উগ্র বামসহ সব পন্থার ব্যক্তিদের প্রতি বাছ-বিচারহীনভাবে রয়েছে- এটি গোপনীয় নয়। তিনি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রতি যেমন আনুগত্য প্রকাশ করেন আবার বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে তিনি শ্রদ্ধা করেন বলে দাবি করেন। সামরিক শাসক এরশাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। উগ্র সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক দল সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারকে তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদায় বসান। ১৯৭৬ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে ভারতবিরোধী জিগির তোলার লক্ষ্যে আয়োজিত ফারাক্কা লং মার্চকে এবারও পুনর্জীবন ঘটিয়ে নিজেই উগ্র ডান, উগ্র বামদের নিয়ে রাজশাহীতে লং মার্চ করে এসেছেন। সেখানেও তিনি ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে নিজেকে আলোচনায় রেখেছেন। তার রাজনৈতিক দর্শন মূলতই অতি ডান, অতি বামদের মাঝামাঝি অবস্থানে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাঙালি মধ্যবিত্তের তথাকথিত শিক্ষিতজনের রাজনীতি খুব বেশি একটা দেশপ্রেম ও আদর্শভিত্তিক নয় এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। এদের রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই সংকীর্ণ কিন্তু প্রকাশভঙ্গি উচ্চমার্গীয়। দেশ ও জাতির জন্য এদের দরদ ভালোবাসা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। কিন্তু কালের স্রোতে এদের হারিয়ে যাওয়ার নজির এ দেশেই অনেক আছে। দেশ ও জাতি এদের থেকে শেষ পর্যন্ত কিছুই পায় না। এরা নিজেরা যেমন সফল হয় না, তেমনি দেশ ও জাতিকেও নানা বিভ্রান্তি ও দিকভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে রাখার বেশি কিছু অবদান রাখতে পারেনি। কারণ এদের তত্ত্বজ্ঞান অনেকটাই বায়বীয়, বাস্তবজ্ঞান একেবারেই শূন্য। ফলে এদের কাছ থেকে দেশ ও জাতি খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক দিকদর্শন পায় না। আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য এখানেই।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেক ভালো কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনের অজান্তে থাকা তার অনেক কথাই তিনি লুকাতে পারেন না। মুখ ফসকে বের হয়ে আসে। সেখানেই তার দ্বিচারিতার স্বরূপটি ধরা পড়ে যায়। তিনি নিজেকে যতই প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দেশপ্রেমিক বলে মনে করেন; কিন্তু উগ্র ডান, বাম, হঠকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মিশেল দিয়ে কেউ কখনও দেশ ও জাতিকে উদারবাদী ধারায় অগ্রসর করার কথা ভাবতে পারেন না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রবীণ নাগরিক হিসেবে যখন বক্তব্য দেন তখন অনেকেই তার প্রতি সম্মান রেখে কথা বলেন । কিন্তু তিনি সেই সম্মানের অনেক কিছুই তার বক্তব্যের নির্মোহ বিশ্লেষণে থাকার মতো অবস্থানে না থাকলেও কেউ বিষয়গুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি বা ঘাটাঘাটি করে না। এখানেই তার বিশেষ সুবিধাটি। তবে তিনি যেসব স্ববিরোধী বক্তব্য ও আচরণ করেন সেটি বোধিচিত্তের মানুষদের না বোঝার কোনো কারণ নেই।
সম্প্রতি তিনি জাতীয় সরকারের একটি তত্ত্ব গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে কে বা কারা সহযোগিতা করেন তা আমাদের জানা নেই। তবে তার বিবৃতির মিশেল চরিত্র দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি হয় জনগণের দৃষ্টিকে তার মতো করে কিংবা অন্য কারো সুদূরপ্রসারী চিন্তাকে নিয়ে মানুষকে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার পরিকল্পনা থেকে এসব তত্ত্ব হাজির করেন। তবে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এক-দুইদিন এ নিয়ে কিছু আলোচনা- সমালোচনার পর নানা বৈপরীত্য, অসংগতি এবং চিন্তার বালখিল্যপনার কারণে সেটি আপনা থেকে উবে যেতে থাকে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন সেটি যে এত সহজ সরল নয়, তা তিনি কতটা জানেন বা বোঝেন জানি না। কিন্তু যে বিষয়ে তিনি এমন একটি প্রস্তাব হাজির করেছেন সেটি কোনো পক্ষই চিন্তার খোরাকের মধ্যে বিবেচনা করেছেন এমনটিও দেখা যায়নি। তবে নেপথ্যে থেকে যদি কেউ তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে থাকেন তারা হয়তো এখন বাজার যাচাই করছেন! ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব, কার্যকারিতা, সরকার কাঠামো ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।
দুবছরের জন্য দেশে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি যেসব বক্তব্য হাজির করেছেন তা এমন: “জাতীয় সরকারের প্রথম তিন মাসের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনি আইনের কিছু ধারার সংস্কার, গণভোট এবং ‘না’ ভোটের প্রচলন, প্রশ্নবিদ্ধ সংসদকে লক্ষ ভোটারের স্বাক্ষরে প্রত্যাহার ব্যবস্থা, জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিভাগে ন্যায়পাল নিয়োগ, প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ এবং ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি পুরোপুরি কার্যকর করে, ওষুধ, শৈল্য চিকিৎসা ও রোগনিরীক্ষার দর সরকার স্থির করে দেবে। পর্যাপ্ত লাভ দিয়েও ওষুধের সর্বোচ্চ বিক্রিমূল্য অর্ধেকে নেমে আসবে। অপ্রয়োজনীয় ও প্রতারণামূলক ওষুধ বাতিল হবে। সব ওষুধ কোম্পানিসমূহকে একাধিক কাঁচামাল উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়া হবে।” তার প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করেছেন, “মানহানির মামলা করতে হলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ন্যূনতম ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা কোর্ট ফি দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির শহরে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। একই মামলা বিভিন্ন জেলার একাধিক আদালতে করা যাবে না।” প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, “পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক কর্মী ও আলেমদের জামিন নিশ্চিত করে এক বছরের মধ্যে তাদের বিচার শেষ করে রায় কার্যকর করা হবে।” প্রস্তাবে তিনি বাংলাদেশকে ১৫/১৭টি প্রদেশ বা স্টেটে বিভক্ত করার কথাও বলেছেন।
এক্ষেত্রেও তার প্রস্তাব, “প্রত্যেক প্রদেশে/স্টেটে ৬-৭ জন বিচারপতি সমন্বিত হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা এবং সুপ্রিম কোর্টে একটি সার্বক্ষণিক সাংবিধানিক বেঞ্চ সৃষ্টিসহ সুপ্রিম কোর্টে ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে-(১) ফৌজদারি, (২) দেওয়ানী, (৩) নির্বাচন ও মৌলিক অধিকার, (৪) কোম্পানি বিরোধ ও আয়কর সংক্রান্ত, (৫) সকল প্রকার দুর্নীতি বিষয়, (৬) যৌন নিপীড়ন ও নারীদের অধিকার ।” তিনি এই প্রস্তাবনায় ‘সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন, দুই কোটি মানুষের সাপ্তাহিক রেশনিং চালু করা, মাসিক ১০০ টাকায় তিন বাল্বের বিদ্যুৎ-সুবিধা এবং মাসিক ২০০ টাকার প্রিমিয়ামে ওষুধসহ সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিচর্যা, দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ, অভিযুক্তদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, ভোটার তালিকা সংশোধন, দলের নিবন্ধন সহজীকরণ, দলীয় প্রতীকে ইউপি ও উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়া, পেশাজীবী, বয়োজ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, বাজেট প্রদান, বাজেটে শুল্কমুক্ত আমদানি, এনজিওদের মাধ্যমে কৃষিতে ৫ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ, কারাগার, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর হাসপাতালগুলো বিকল্প চিকিৎসাসেবা দ্বারা পরিচালিত, বিদেশফেরতদের বিমানবন্দরে ভিআইপি-সুবিধা, মৃতদেহ বিনা অর্থে দেশে আনা, প্রবাসীদের ৫০ লাখ টাকার জীবনবীমা-সুবিধা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার ছয় মাস পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা’ ইত্যাদি তার জাতীয় সরকারের রূপকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য তিনি ৩১ ব্যক্তির নাম তাদের বিনা অনুমতিতেই প্রকাশ করেছেন। এদের কেউ কেউ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তারা আদৌ এ ধরনের সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা দেশে অনুভব করেন কি না সেটিই মস্তবড় প্রশ্ন।তাছাড়া এখানে বিভিন্ন ঘরানার কিছু ব্যক্তিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দেয়ারও প্রস্তাব তিনি করেছেন। মন্ত্রণালয়ের নামও তিনি প্রস্তাব করেছেন। সমস্ত বিষয়টি তার একান্ত কাল্পনিক, একান্ত ব্যক্তিগত নাকি কারো কারো চিন্তাপ্রসূত প্রস্তাবনা সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো তিনি দেবেন না। কিন্তু যে প্রস্তাবনা তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেছেন সেটি পড়ে কোনো সচেতন মানুষ ভাবতে পারবেন না যে, এটি ইউটোপিয়া ছাড়া বাস্তবে কোনো চিন্তা করার যোগ্যতা রাখে।
দেশে সংবিধান আছে। এটিকে স্থগিত করার অধিকার কারো নেই। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিদের ছাড়া এক মুহূর্তের জন্য পরিচালিত হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। সে ধরনের চিন্তার পরিণতি আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অতীতে (১৯৭৫, ৮১-৮২, ৯০, ৯১, ৯৬, ২০০১, ২০০৬-২০০৮) যে বিপর্যয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নেমে এসেছিল সেটি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারেন না। রাষ্ট্রক্ষমতায় নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত কেউ বসতে পারেন- সেই সুযোগ করে দেয়ার পরিণতি অনেক দেশের জন্যই বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছে।
সুতরাং জাতীয় সরকারের কথা শুনতে যত আবেগময় মনে হবে, কিন্তু বাস্তবে এর ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় জাতীয় বিপর্যয় চলছে তারপরও কেউই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের বাইরে গিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা কল্পনাও করছেন না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় সরকারের ঘাড়ে যেসব দায়িত্ব ন্যস্ত করতে চাচ্ছেন তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা, সময় কোনোটিই তাদের হবে না।
দুইবছর দেশের সংবিধান কোথায় যাবে? ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন? যদি পারতেন তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা এবং বিষয়টি যথাযথ পরিবীক্ষণের চেয়ে বেশি কিছু ভাবাটাই অবান্তর। যা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা একমাত্র জনপ্রতিনিধিরাই রাখেন তাদের বাদ দিয়ে অনির্বাচিত বহু মত, বহু পথ, বহু চিন্তা ও ভাবাদর্শের মানুষদের সমন্বিত করে ভাববার কথা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাবেন কীভাবে? রাষ্ট্র, সরকার এবং সংবিধান নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কবে এই উপলব্ধিতে ফিরে আসবেন?
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক
আরও পড়ুন:আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যিনি ভাষা দিবসের গানের গীতিকবি হিসেবে যেমন পরিচিত ছিলেন তেমনি পরিচিত ছিলেন একজন কলাম লেখক হিসেবে। একটি জীবন কাটিয়ে দিলেন- শুধুই লিখে। তার লেখার বিষয়, লেখার দর্শন বা তার লেখার বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অনেকেরই কথা থাকতে পারে। তারপরও একথা ঠিক যে, লিখে তিনি একটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন- এক শুদ্ধব্রতচারী ঋত্বিকের মতো।
গাফ্ফার চৌধুরীরর সাংবাদিক জীবনের কথা বলতে গেলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি কবিতাটার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে। ‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল/অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি/সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আসলে শুধু সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন। তিনি তার সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। তার নাম মানেই এক কলম সৈনিকের নাম। এক যোদ্ধার নাম, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের নাম। তিনি দলনিরপেক্ষ ছিলেন না, কিন্তু যে দলের সমর্থন করতেন সে দলের গঠনমূলক সমালোচনাও করতে সামান্য দ্বিধা করতেন না। তার সাংবাদিকতার মুনশিয়ানা ছিল তার ভাষা কাঠামো নির্মাণ। স্বল্প শিক্ষিত একজন মানুষও তার লেখা পড়ে মুগ্ধ হতো, আবার শিক্ষিত মানুষও। সহজ ভাষায় যুক্তি দিয়ে নিজস্ব মতকে তুলে ধরায় তার কোনো জুড়ি ছিল না। তার লেখার আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই ছিল। একজন কলাম লেখকের পক্ষ থাকে, পাঠক থাকে বিপক্ষও থাকে এটাই নিয়ম।
আমার মনে পড়ে একসময় আমরা একদল তরুণ যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তারা ‘দৈনিক সংবাদ’-এ অনিরুদ্ধর (সন্তোষ গুপ্ত) কলাম পড়তাম আবার গাছপাথরের (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) কলাম পড়ে তর্কে জড়িয়ে যেতাম। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম নিয়ে বিতর্ক করতাম। নির্মল সেনের কলাম নিয়েও বিতর্ক হতো। কিন্তু লেখকের সার্থকতা তো এখানেই। তবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বেলায় কথাটা ভিন্ন। তা হচ্ছে- একুশে ফেব্রুয়ারির গীতিকবিতা থেকে তার কলাম পড়ে মনে হয়েছে তিনি তার পাঠককে নির্বাচন করতেন লেখার আগেই।
জনগণের ভাষা, তাদের চাহিদা গাফ্ফার চৌধুরী সুদূর ব্রিটেনে বসেও বুঝতেন। যে কারণে পাঠক অপেক্ষায় থাকত কবে তার কলাম বের হবে। কবে সামনের রাজনীতির ধারণাটা পাওয়া যাবে। একজন কলাম লেখক যে কালের কথক তা অনিরুদ্ধ, গাছপাথর, নির্মল সেন ও গাফ্ফার চৌধুরীর লেখায় বোঝা যেত। আমি কোনো কলাম লেখককে খাটো করছি না, এই কজনের কথা মনে করছি মাত্র। আজ তার লেখার কাঠামো, বিন্যাসও ভাষার ব্যবহার দেখাতে একটা লেখার উদ্ধৃতি দেব-
‘‘২০০১ সালের বিএনপি সরকারের ভিশন ও মিশনের আর কত ফিরিস্তি দেব? সেই সময়ের বিএনপি সরকারের একশ’ দিনের কর্মসূচি এবং ক্ষমতায় থাকার পূর্ণ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ কেউ যদি মিলিয়ে দেখেন, তাহলে তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন, তাদের বর্তমানের ‘ভিশন-২০৩০’ এর পরিণতি কী ঘটবে! রূপকথায় আছে, এক সিংহ বৃদ্ধ বয়সে নখ-দন্ত ও শিকার ধরার ক্ষমতা হারিয়ে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং ঘোষণা দিয়েছিল, সে অহিংসা ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। সে বনের পশুপাখিদের অহিংসা ধর্মে দীক্ষা দেবে। তার ঘোষণায় বিশ্বাস করে বহু পশুপাখি অহিংসা ধর্মে দীক্ষা নিতে তার কাছে যেতে শুরু করল। সিংহ সুযোগ পেয়ে তাদের হত্যা করে খেয়ে ফেলত। তাকে আর শিকার ধরার পরিশ্রম করতে হতো না। এ সময় এক শিয়াল গেল সিংহের কাছে; কিন্তু গুহায় ঢুকল না। সিংহ বলল, ভাগ্নে এসো এসো, তোমাকে অহিংস ধর্মে দীক্ষা দেই। শিয়াল বলল, মামা, দীক্ষা নিতেই তো এসেছিলাম; কিন্তু এখন দেখছি যেসব পশুপাখি তোমার কাছে দীক্ষা নিতে এসেছে, তাদের পায়ের ছাপ সবটাই ভেতরের দিকে গেছে; কোনোটাই ফিরে আসেনি। আমি তাই এখান থেকেই বিদায় নিচ্ছি। ভেতরে এসে তোমার আজকের দিনের খোরাক হতে চাই না।
বিএনপির ভিশন-২০৩০-এর ঘোষণা শুনেও দেশের মানুষ কি বিশ্বাস করবে, দলটি সন্ত্রাস ছাড়বে, সন্ত্রাসীদের ছাড়বে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বে, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির এককালের দুর্গ হাওয়া ভবনের স্বেচ্ছানির্বাসিত অথবা পলাতক নেতার প্রভাবমুক্ত হবে? সবচেয়ে বড় কথা, অহিংস গণতন্ত্রের দীক্ষা নেবে? এই ব্যাপারে কেউ যদি সন্দেহ পোষণ করেন, তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? উপকথার সিংহ ও শিয়ালের গল্পটির নীতিকথা আমাদের কী শেখায়?” (বিএনপি কি সত্যিই অহিংস ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে? দৈনিক যুগান্তর, ১৬ মে, ২০১৭) লেখাটি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। তার লেখা কতটা সহজবোধ্য, প্রখর ও রসালো ছিল এটাতেই বোঝা যায়। লেখাকে সহজবোধ্য করতে তিনি প্রচলিত গল্পের ভাষায় রাজনীতির শক্ত বিষযগুলোর গেরো খুলে দিতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে যায়াযায়দিনে তার লেখা পড়া শুরু করেছিলাম। তার অনেক লেখা বিভিন্ন কাগজে পড়েছি। সহজ বাক্যে সুন্দর বিশ্লেষণ।
স্পষ্ট ভাষায় মুখের ওপর কথা বলতেন। একবার তার এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম চামেলীবাগে রাজনীতিক-লেখক মোনায়েম সরকারের বাসায়। যিনি মূলত সাক্ষাৎকার নেবেন তার সঙ্গে গিয়েছিলাম আমি। আমার সেই বন্ধুতো তার লেখার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আমার কোন লেখাটা পড়েছ ? এবারে আমি কথা শুরু করলাম তার লেখা নিয়ে। তিনি আমার স্মরণশক্তির তারিফ করে আমার বন্ধুকে বললেন খুব কায়দা করে। না পড়া দোষের নয়, না পড়ে বলাটা একজন সাংবাদিককে বিপদে ফেলতে পারে। আবার অন্য প্রসঙ্গে আমরা ঢুকে গেলাম। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যে গুণটার কথা এবার বলব তাহলো তার বলার শক্তি। তার বিভিন্ন বিষয়ে অনেক পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা ছিল, ছিল অবিশ্বাস্য রকমের স্মরণশক্তি। কয়েকশ মানুষের মধ্যে থাকলেও তিনি ছাড়া আর কেউ বলার সুযোগ পেতেন না। এটা তিনি জোর করে করতেন না। এটা ছিল তার জ্ঞানলব্ধ আলোচনার শক্তি। কত পাণ্ডিত্য থাকলে এ কাজটা করা যায় তা বলে শেষ করা যাবে না। এটা প্রয়াত নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদের মধ্যেও দেখেছি।
সাংবাদিকতার সেই সোনাঝরা দিন এখন আর নেই। কেউ কারো লেখার জন্য অপেক্ষা করে বলে মনে হয় না। করো লেখা পড়ার অভ্যেসটা একদম হ্রাস পেয়েছে। তবে শেষপর্যন্ত যার নাম দেখলে কলামটা পড়ত তিনি হলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার পাঠক ছিল ভুবন জোড়া। এত পাঠক বোধ করি কারো ছিল না। তার লেখার বিপক্ষের মানুষও কম নয়, তবে দুঃখজনক হলো তার লেখার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে তাকে আক্রমণ করা। এটা সাংবাদিকতার কোনো নিয়মের সঙ্গে যায় না।
দুই.
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সপরিবারে লন্ডনে চলে যান। তারপর সেখানেই বসবাস শুরু করেন। সেখানে ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। প্রায় ৩৫টি বই লিখেছেন তিনি। গাফ্ফার চৌধুরী বিদেশে অবস্থান করলেও দেশের সব খবর থাকত তার নখদর্পণে। দেশের জন্য তার টান ছিল অনেক। ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন দৈনিকে সমকালীন রাজণীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন তিনি।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তার লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি তাকে শুধু খ্যাতি নয়, অমরত্ব এনে দেয় বৈকি। প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে সুর করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এ গানে সুরারোপ করেন এবং বর্তমান সেই সুরেই গানটি গীত হয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের জরিপে এই গান সর্বকালের সেরা বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে।
এটুকুই শুধু গাফ্ফার চৌধুরী নয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশি’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটকও লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘একজন তাহমিনা’ ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ ও ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’।
তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দিতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরী একটা গীতিকবিতা লেখার পরে আর না লিখলেও তার আয়ু বাংলা ও বাঙালির সমান। তার জীবন ও সংগ্রামের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক
আরও পড়ুন:গাফ্ফার ভাই চলে গেলেন! আর কখনও তার ফোন পাব না। কোনোদিন আর ফোন করা হবে না তাকে। তিনি আর বলবেন না, ‘নজরুল, দেশের খবর কী বলো?’ তাকে ফোন করলে তিনি প্রথমেই জানতে চাইতেন দেশের খবর। সব ঠিক আছে তো? বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাদের খোঁজ নিতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ছিল তার অগাধ আস্থা। একান্ত আলাপচারিতায় বলতেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
তার সঙ্গে কত শত স্মৃতি। ২০০৪ সালে আমার জীবনের একটি বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে একদিন ফোনে বললেন, ‘এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তুমি পত্রিকার জন্য একটা প্রবন্ধ লেখ। ডাকযোগে আমার কাছে পাঠাও। আমি দেখে ঠিক করে দেব। তারপর তা তুমি পত্রিকায় পাঠাবে। ওরা ছাপাবে।’
তার কথায় আমি লিখেছিলাম। তিনি দেখে একটু যোগ-বিয়োগ করে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আমি তা ফ্রেশ করে লিখে ঢাকা ও লন্ডনের পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। ছাপা হয়। তারপর আরও পাঁচটি প্রবন্ধ তিনি দেখে দিয়েছিলেন। এরপর আর দেখে দিতে হয়নি। তার প্রেরণা ও আশীর্বাদে এখন আমি পত্রিকায় নিয়মিত লিখে যাচ্ছি। তার কাছে আমার অন্তহীন ঋণ।
দুই যুগেরও বেশি প্রায় প্রতিদিন তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। হাসপাতালে তার ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন থাকত না। তিনি নার্সের সহায়তায় ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে আমাকে প্রতিদিন ফোন করতেন। গত ১৮ মে বুধবার রাতেও তিনি আমাকে ফোন করেছেন। কথা হয়েছে। ১৯ মে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে খবর পেলাম তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন।
শৈশবে, যখন থেকে একুশের প্রভাতফেরিতে যাচ্ছি, তখন থেকেই তার নামের সঙ্গে পরিচয়। কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সেই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তার স্কুল জীবনেই। স্কুলের পাঠ নিতে নিতেই নিয়েছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির পাঠ। আধুনিকমনস্ক মানুষটি মননে ছিলেন প্রগতিশীল। তরুণবেলায়, সেই ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সমান প্রতিবাদী ছিলেন তিনি। যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তার কলম। দুই চোখজুড়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রচলিত সংবাদভাষ্য ও সাহিত্যের ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দেশের সংবাদপত্রে তার কলাম সৃষ্টি করে নতুন এক ঘরানা। সাহিত্য দিয়ে যার লেখালেখি শুরু, তিনি হয়ে ওঠেন সংবাদ-সাহিত্যের বরপুত্র।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন সৃজনশীল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী, সঙ্গীও। ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্ম। এই ইতিহাসের অনেক কিছুরই সাক্ষী তিনি। জন্মেছিলেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে, ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি প্রয়াত হাজী ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তার বাবা, মা জোহরা খাতুন। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা ও উলানিয়া করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও। ছাত্রজীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫২ সালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়িও ছাত্রজীবনেই। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন ১৯৫৬ সালে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভূমিকাও পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
বাংলাদেশে সেলিব্রিটি সাংবাদিকের সংখ্যা হাতেগোনা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেই স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিকের একজন, যার কলামের অপেক্ষায় থাকত দেশের সিংহভাগ পাঠক। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলামে যে মতপ্রকাশ করতেন, তার সঙ্গে অনেক পাঠকেরই হয়ত মতের মিল হতো না। কিন্তু তিনি কী লিখছেন, কী ভাবছেন, তা জানার আগ্রহ পাঠকদের ছিল। এমনকি তার বিরুদ্ধ-রাজনৈতিক মতবাদের মানুষও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম পড়তেন সমান আগ্রহে। সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। কলামের প্রতিটি শব্দে ছিল অসম্ভব চৌম্বক শক্তি। পাঠককে ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা এমন কজনের আছে? আইন পেশায় একটা কথা আছে, ‘ক্যারি দ্য কোর্ট’। পাঠককে টেনে রাখার অসম্ভব শক্তি ছিল তার কলমে। প্রযুক্তি এগিয়েছে; কিন্তু তিনি হাতে লিখতেন। মুক্তোর মতো স্বচ্ছ হাতের লেখা। টানা লিখে যেতেন পাতার পর পাতা। কোথাও কাটাকাটি নেই। অসামান্য দক্ষতায় নির্মেদ গদ্যে যেন সময়ের ছবি আঁকতেন সংবাদ-সাহিত্যের এক অসামান্য শিল্পী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি কলেজের ছাত্রজীবন থেকে। চিনি বলতে দূর থেকে দেখেছি। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ কিংবা সাহস হয়নি তখন। সামনাসামনি জানাশোনা আমার প্রবাস জীবনের শুরুতেই। তখন থেকেই তার সান্নিধ্য পেয়ে আসছি। তিনি লন্ডনে, আমি ভিয়েনায়। ব্রিটেন ও অস্ট্রিয়া, ইউরোপের দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব যতই থাক না কেন, দিনে দিনে নৈকট্য বেড়েছে। একুশের প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুঁচে যেতে সময় লাগেনি। একসময় যাকে খুব দূরের বলে মনে হতো, তিনি আমাকে অপত্য স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছেন। তার স্নেহ-সাহচর্যে আমি ঋদ্ধ। আজ এত বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আমাদের স্নেহে ভাই সহজ-সরল একজন মানুষ, যিনি সবাইকে আপন করে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখেন। তার সঙ্গে দেশের ভালো-মন্দ, রাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হতো, এ আমার অনেক বড় পাওয়া।
লন্ডনে গেলে তার সঙ্গে দেখা করা ছিল আমার নিত্য রুটিন। বিদেশেও অনেক জায়গাতে গিয়েছি তার সঙ্গে। ভিয়েনাতে এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন তিনি, এ আমার অনেক বড় পাওয়া। মনে আছে, ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছিল ভিয়েনায়। হল-ভর্তি দর্শক বিস্ময়-বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছিল নাটকটি। বোধহয় সেটাই ছিল লন্ডনের বাইরে পলাশী থেকে ধানমণ্ডি নাটকের প্রথম প্রদর্শনী।
দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের কাছে অতি পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রতিক্রিয়াশীলদেরও জানা ছিল এই মানুষটি যেকোনো মুহূর্তে গর্জে উঠতে পারেন। বাংলা সাহিত্যেও তার অবদান উপেক্ষা করার নয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার লেখায় পাঠককে দিতেন চিন্তার খোরাক। অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে তার মতো প্রগতিশীল মানুষকে আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আরও অনেক দিন লিখবেন, সক্রিয় থাকবে তার কলম ও চিন্তার জগৎ। আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো না। অনন্তের পথে পাড়ি জমালেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বিদায় নিলেন এক অসামান্য গল্প-কথক। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক: সভাপতি, সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ। অস্ট্রিয়া-প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
আরও পড়ুন:
মন্তব্য