বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রার গৌরবময় অধ্যায় পার করছে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ’ নির্বাচনি ইশতেহারটি যে এত স্বল্প সময়ে দেদীপ্যমান বাস্তবতা হয়ে ধরা দেবে তা কে-ইবা ভেবেছিল।
বাংলাদেশ তার ইতিহাসে একের পর এক উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছে নানামুখী উন্নয়ন কৌশল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক নেতৃত্বে একদিকে অর্থনৈতিক ও শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে দ্রুত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
গত এক যুগে বাংলাদেশ একদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, অন্যদিকে উন্নয়ন এজেন্ডায় জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শূন্য রিজার্ভ নিয়ে পথচলা শুরু করে ৭১৯ কোটি টাকার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছেন। আর আজ তাঁর কন্যার হাত ধরে সে বাজেট এখন ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.১৫ শতাংশ, যা এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ। কোভিড-পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি।
একদিকে সরকার অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের লক্ষ্যে গ্রহণ করছে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বৃহৎ উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি একযোগে পরিচালিত হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুস্থ, অসহায় এবং ছিন্নমূল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী কর্মসূচি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ভাবনার অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহায়ণের সঙ্গে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, শিক্ষা, পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে। একটি গৃহ কীভাবে সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণে এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প।
যুগলবন্দি: বৃহত্তম জাতীয় প্রকল্প এবং গ্রামীণ উন্নয়ন
উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অবকাঠামো খাতের ইতিবাচক ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে সরকার দেশের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে।
বর্তমানে ৪৭.৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের সব মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার আওতায় ইতোমধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে।
একই সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প, ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প, রামপালে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট, মাতারবাড়িতে ২×৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। এ ছাড়াও ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এলএনজি টার্মিনাল ও গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ কার্যক্রম চলমান।
দ্রুতগতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এ ছাড়া সমগ্র দেশে একযোগে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের একটি অনন্য সাধারণ কর্মসূচি। বর্তমান সরকারের বিগত ১০ বৎসরে (২০০৯-১০ হতে ২০২০-২১) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই একই সময়ে সেতু বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। বিগত ১০ বছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় বরাদ্দ ছিল ২ লাখ কোটি টাকার বেশি।
বর্তমান সরকার বিগত ১২ বছরে (২০০৯-২০২১) দেশে মোট ৬৩,৭৪৭ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এ সময়ে ৩,২১,৩২২ মিটার নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্চালন, দ্রুত বিকাশ, ক্ষুদ্র অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গ্রামীণ জনগণের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে সরকার দরিদ্র, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রেখেছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা (২০২১-২২), যা বাজেটের ১৭.৮৩ শতাংশ এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি। জাতির পিতার দেখানো পথ ধরেই ১৯৯৭-৯৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বয়স্ক ভাতা এবং ১৯৯৮ সালে বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য ভাতাসহ নানামুখী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা হয়।
২০১০-১১ অর্থবছরে ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কর্মসূচি এবং ২০১৩-২০১৪ সাল থেকে সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রদান করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা যা ১২ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। সবশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, দেশের ৫ কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় চলে এসেছে। আমাদের দেশে ৪৪ লাখ ব্যক্তি বয়স্ক ভাতার আওতাধীন, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, দুস্থ মহিলা ভাতার আওতায় ১৭ লাখ এবং অসচ্ছল, প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ১৫ লাখ ৪৫ হাজার জন। প্রতিবছর ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য রয়েছে ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ ভাতা।
এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অনগ্রসর উপকারভোগীর সংখ্যা ৭১,৩২০ জন। শুধু এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্রান্ট দেয়া হয় ৯৭,০৮৩ জনকে (২০২০-এর হিসাব)। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চলাকালীন (জুলাই ২০২০ হতে জুন ২০২৫) দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশ ও চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৪০ ও ২৫.১ শতাংশ, কিন্তু বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের ফলে এ হার বর্তমানে ২০.৫ ও ১০.৫। বর্তমান কোভিডকালে দুই কিস্তিতে ৭০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে (২৫০০ টাকা হারে) মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে নগদ অর্থসহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
কেউ পিছিয়ে থাকবে না
বাংলাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অন্যতম উদ্ভাবন হচ্ছে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। একটি ঘর একটি ছিন্নমূল পরিবারের দারিদ্র্য হ্রাসসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এটি এখন প্রমাণিত। প্রতিটি নিরাপদ গৃহ পরিবারের সবাইকে করে তোলে আস্থাবান, প্রত্যয়ী এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী।
১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রথম ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প চালু করে গৃহহীন, ছিন্নমূল এবং অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তাদের জীবনমান উন্নয়নে ঋণদান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ আয়বর্ধক কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ত করেন। তাঁর দেখানো পথেই ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে ৩৮৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২,৯৮,২৪৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কিন্তু মুজিববর্ষে এসে দ্রুততম সময়ে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে গৃহ প্রদানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূচিত গৃহায়ণ কর্মসূচিকে তিনি নতুনরূপে উপস্থাপন করেন।
জাতির সামনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পকে অধিকতর যুগোপযোগী ও টেকসই করার লক্ষ্যে তিনি নতুন ডিজাইনের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্যারাক নির্মাণ কর্মসূচির পাশাপাশি প্রতিটি দুস্থ পরিবারের জন্য ২ শতক জমি প্রদানসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট গৃহ, প্রশস্ত বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ২৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে তিনি প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারের মালিকানা স্বত্বসহ গৃহ প্রদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন, ২০২১ সালে ৫৩ হাজারের অধিক পরিবারকে অনুরূপভাবে গৃহ প্রদান করা হয়।
একই সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক পরিবারকে গৃহ প্রদানের ঘটনা পৃথিবীতে আর কোনো দেশে সম্ভব হয়নি। সমগ্র বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে এসব গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা খাস জমি চিহ্নিতকরণ ও অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধার করে গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করছে। এ কাজে কখনওবা তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে জমি উদ্ধার করেছে।
প্রকল্পের বিশেষত্ব
১. ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্ত ও ছিন্নমূল পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির ও গৃহের মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবার যেন ভবিষ্যতে মালিকানাসংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জমির মালিকানা স্বত্বের রেজিস্টার্ড দলিল/কবুলিয়ত, নামজারি সনদ ও দাখিলাসহ সরেজমিনে দখল হস্তান্তর করা হয়।
২. পুনর্বাসিত পরিবারকে ৩ মাস (মেয়াদ) ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়।
৩. সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, সামাজিক সুবিধা কর্মসূচির আওতায় মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি অগ্রাধিকারসহ বিবেচনা করা হয়।
৪. পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য ব্যবহারিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
৫. সরকারি বিভিন্ন সংস্থা (যেমন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায়, মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর, সমাজসেবা বিভাগ) থেকে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক সংস্থা ও এনজিওকেও এসব কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়।
৬. পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয় এবং প্রকল্প স্থানে নিরাপদ পানির জন্য টিউবওয়েলের সংস্থান করা হচ্ছে।
৭. পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য কমিউনিটি সেন্টার, প্রার্থনাঘর ও কবরস্থানসহ পুকুর খনন ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
৮. প্রকল্প এলাকায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করা হচ্ছে এবং কৃষি কাজে গৃহহীনদের উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয়স্থল
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। তার দেখানো পথেই বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ নেতার দান করা জমিতেই শুরু হয় পুনর্বাসন কার্যক্রম। আর ১৯৯৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র দেশে শুরু করেন আশ্রয়ণ প্রকল্প।
সবশেষ অগ্রগতিসহ ব্যারাক ও একক গৃহে এ পর্যন্ত ৪,৪২,৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীভুক্ত ৪,৮৩২টি পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত ৮,১০৬টি পরিবারকেও গৃহ প্রদান করা হয়েছে। তাদের পেশা উপযোগী প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রকল্প স্থান বাছাইসহ ভূমি উন্নয়ন ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে উপকারভোগী নির্বাচন এ কার্যক্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য ২০টি ভবনে ৬৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখানে আরও ৩,৭৬৯টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১১৯টি ভবন নির্মাণের কার্যক্রম চলমান। এটিই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম আবাসন।
এসডিজি (টেকসই অভীষ্ট) অর্জনে গৃহ নির্মাণের ভূমিকা
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাতিসংঘের Sustainable Goals এর লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে গৃহায়ন কার্যক্রমের বিশেষ সংযোগ রয়েছে। শুধু গৃহ নির্মাণের ফলে মানুষের জীবনের টেকসই উন্নয়নের নানামুখী লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গৃহায়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রাপ্তি যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রসমূহেও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১.৪
২০৩০ সালের মধ্যে সব নারী ও পুরুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও অরক্ষিত (সংস্থাপন) জনগোষ্ঠীর অনুকূলে অর্থনৈতিক সম্পদ ও মৌলিক সেবা-সুবিধা, জমি ও অপরাপর সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণসহ আর্থিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে।
মন্তব্য: আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা রেজিস্ট্রি দানপত্রমূলে সরকার কর্তৃক প্রদান করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীন প্রতিবন্ধী, দুস্থ, বিধবা, স্বামী নির্যাতিতা, বয়স্ক নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১.৫
দারিদ্র্য ও অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর অভিঘাতসহনশীলতা বিনির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ঝুঁকি কমিয়ে আনা।
মন্তব্য: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবজনিত কারণে গৃহহারা ৪,৪০৯টি দরিদ্র পরিবারের জন্য কক্সবাজারে খুরুশকুলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এখানে তাদের পুনর্বাসনের জন্য ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। ইতোপূর্বে ২০টি ভবনের কাজ সম্পন্নপূর্বক ৬৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও ৫০টি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২.৩
ভূমি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদ ও উপকরণে নিরাপদ ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে খাদ্য উৎপাদনকারী বিশেষ করে নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, পারিবারিক কৃষক, পশুপালনকারী ও অন্যান্যের আয় ও কৃষিজ উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা। এটি অর্জনের জন্য সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে।
মন্তব্য: যেসব উপাদান দারিদ্র্য জিইয়ে রাখে, পুষ্টিহীনতা তার মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের পুষ্টিমান অনেকটাই নির্ভর করে পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতার গুণগত মানের ওপর। পুনর্বাসিত পরিবারসমূহ নতুন ঘরে যেমনি পানি, পয়োনিষ্কাশন সুবিধা পাচ্ছে, তেমনি গৃহ আঙিনায় কৃষিজ উৎপাদন কর্মে নিযুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া হাঁস-মুরগি চাষ ও পশুপালন কর্মেও তারা যুক্ত আছে। এ জন্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণসহায়তা দেয়া হচ্ছে। সমবায় ভিত্তিতে প্রকল্প এলাকার পুকুরে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের জন্যও প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৩
সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ।
মন্তব্য: পুনর্বাসিত পরিবারসমূহ ইতোপূর্বে যারা ভাসমান জীবনযাপন করতেন, তারা নানা রকম সংক্রামক ব্যাধি যেমন- ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতেন। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রজননসংক্রান্ত, মাতৃত্বজনিত, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক অসুস্থতার কারণে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতেন।
গৃহায়ণের ফলে তারা বিরূপ এবং প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেন। একইভাবে তারা গুরুত্ব না দেয়া কিছু উষ্ণমণ্ডলীয় রোগ বা neglected tropical diseases (NTD) থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছেন সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হওয়ার কারণে। ঘরে অবস্থানের কারণে শিশুদের টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সেবা প্রদান সহজলভ্য হয়েছে।
নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক গৃহ ভিজিট করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীসহ অন্যান্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন।
একই সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে নারী ও শিশুরা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আশ্রয়ণ এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সময়মতো স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করাও অনেক সহজ হবে। আশা করা যায় যে, এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুও হ্রাস পাবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৫.ক
অর্থনৈতিক সম্পদ এবং ভূমিসহ সব ধরনের সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সেবা, উত্তরাধিকার এবং প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পাদন।
মন্তব্য: এ প্রকল্পে উপকারভোগী প্রতিটি ভূমিহীন পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে জমির মালিকানা রেজিস্ট্রি দলিলমূলে প্রদান করা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে যৌথ নামে নামপত্তন, খতিয়ান ও দাখিলা প্রদান করা হয়ে থাকে। ফলে প্রথাসিদ্ধ আইনি কাঠামোর বাইরে উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের সন্তানদেরও সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৬.২
পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক স্যানিটেশন স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনরীতির অভিগম্যতা নিশ্চিত করা এবং নারী ও বালিকাসহ অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে খোলা জায়গায় মলত্যাগের অবসান ঘটানো।
মন্তব্য: দিনমজুর, ভবঘুরে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পূর্বে মলত্যাগের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান ছিল না। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেকে খোলা স্থানেও মলত্যাগ করত। বর্তমান প্রকল্পে প্রতিটি গৃহের সংলগ্ন ৪ ফুট দৈর্ঘ্য × ৪ ফুট প্রস্থ টয়লেট আছে এবং গৃহসংলগ্ন টিউবওয়েল থেকে প্রাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ফলে আশ্রয়ণের সুবিধাভোগীরা নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় স্যানটিশেন সেবা পাবে। সরকারি সংস্থা ও এনজিওর মাধ্যমে গৃহীদের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১০.২
বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা, জাতিসত্তা, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, উৎস (জন্মস্থান) ধর্ম অথবা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য অবস্থা নির্বিশেষে সবার ক্ষমতায়ন এবং এদের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রবর্তন।
মন্তব্য: ভূমিহীন এবং গৃহহীন যেকোনো বয়সের মানুষই এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। তবে প্রবীণ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও স্বামী পরিত্যক্তাদের অসহায়ত্বের বিষয়টি বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সমতল ছাড়াও পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগণকেও এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত রাখা হয়েছে।
এ পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় এথনিকদের জন্য ৮১০৬টি গৃহ ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৪৮৩২টি গৃহ বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুকুর খননকৃত এলাকায় সমবায় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সরকারি সহায়তায় বিভিন্ন পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ ব্যবসা বা কৃষি কাজের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বান্দাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প, হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সিরাজগঞ্জ জেলায় উল্লাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় কয়লাখনি শ্রমিক, বরগুনা তালতলি এলাকায় রাখাইন পরিবারের জন্য বিশেষ টংঘর ও নীলফামারীর সদর উপজেলায় হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১১.৫
দরিদ্র ও অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে পানি সম্পৃক্ত দুর্যোগসহ অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা।
মন্তব্য: বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে দৃশ্যমান সম্পদ যেমন- ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, গবাদিপশুসহ অন্যান্য অবকাঠামো। সেটা বিবেচনা করে প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি গৃহ তুলনামূলক উঁচু স্থানে নির্মিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন বা অতিবৃষ্টির কারণে যাতে গৃহের ক্ষতি না হয় বা জনগণের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আওতায় মাটি ভরাটের জন্যও বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে যাতে আবাসস্থলসমূহ দুর্যোগ সহনীয় হয়ে ওঠে।
অস্পৃশ্যতার দেয়াল ভেঙে
কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প: বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর এলাকায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক। পরিবার পরিত্যক্ত এসব কুষ্ঠ রোগীর বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিল ভিক্ষাবৃত্তি। নিজ এলাকায় মানুষ কাছে আসতে চাইত না বলে ঠিকমতো ভিক্ষাও পেত না কুষ্ঠ প্রতিবন্ধীরা, ফলে তারা পাড়ি জমায় ঢাকা শহরে।
মৌলিক অধিকার বঞ্চিত কুষ্ঠ রোগীরা ঢাকা এসে কমলাপুর রেলস্টেশন, আগারগাঁও এলাকার পঙ্গু হাসপাতালসংলগ্ন বস্তি এলাকায় শরীরের খসে পড়া অংশ দেখিয়ে ভিক্ষা করত। ১৯৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কুষ্ঠ রোগ নির্মূলে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০০০ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে ভাওয়ালের গজারি বনে ঘেরা কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় কুষ্ঠ প্রতিবন্ধী পরিবারসমূহ। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি হয়ে ওঠে তাদের বেঁচে থাকার নতুন আশ্রয়।
প্রকল্পটিতে ৭টি ব্যারাকে ৭০টি গৃহহীন কুষ্ঠ রোগী পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়। পুর্নবাসনের পর তাদের কর্মসংস্থানের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর একদিকে যেমন তাদের কুষ্ঠ রোগ ভালো হয়েছে, অন্যদিকে তারা অসম্মানজনক ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সরে এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে। অনেকেই সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন।
হিজড়া সম্প্রদায় পুর্নবাসন: সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় বাস্তবায়িত হাটিকুমরুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি অন্যান্য প্রকল্প হতে একটু ভিন্ন। হাটিকুমরুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর হিজড়া জনগোষ্ঠীকে। প্রকল্পটিতে ৪টি সেমিপাকা ব্যারাকে ২০টি তৃতীয় লিঙ্গের পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়েছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে উদ্বোধন করেছেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নে দেয়া হয়েছে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ এবং সেলাই মেশিন। গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার। তাছাড়া হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন ও শাকসবজি উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের গৃহ নির্মাণ: আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার ১৭৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারকে বিশেষ ডিজাইনের গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ৩৬৬টি বিশেষ ডিজাইনের গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য সর্বমোট ৫৮০টি বিশেষ ডিজাইনের গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মুজিববর্ষে রাঙ্গামাটি জেলায় ৭৩৬টি, বান্দরবান জেলায় ২,১৩৪টি এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ৯৬৮টি গৃহহীন পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় কয়লাখনির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পুনর্বাসন: দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ৩১৮টি পরিবারের পুনর্বাসনের নিমিত্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাক্রমে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দক্ষিণ পলাশবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬৪টি পাকা ব্যারাক নির্মাণ করে ৩১৮টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (রাখাইন) পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের টং ঘর নির্মাণ: বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায় অসহায় রাখাইন সম্প্রদায়ের পরিবারের জন্য এ পর্যন্ত ২০টি টং ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
ভিক্ষুক পুনর্বাসন: ভিক্ষুক পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার ভিক্ষুকদের জন্য ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৬৯১টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
তাছাড়া নড়াইল জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণার অংশ হিসেবে নড়াইল জেলার তিন উপজেলায় ইতোপূর্বে (২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর) ৩১১টি ভিক্ষুক পরিবারকে এবং মুজিববর্ষে আরও ২২টি ভিক্ষুক পরিবারকে অর্থাৎ মোট ৩৩৩টি ভিক্ষুক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
হরিজন সম্প্রদায় পুনর্বাসন: নীলফামারী জেলার সদর উপজেলায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১২টি ৫ ইউনিটবিশিষ্ট সিআই সিট ব্যারাক নির্মাণ করে ৬০টি হরিজন সম্প্রদায়ের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প: মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে কক্সবাজার জেলার খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত ৫তলা বিশিষ্ট ২০টি বহুতল ভবনে প্রথম পর্যায়ে ৬০০টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে ৪০৬.০৭ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট একটি করে ফ্ল্যাট উপহার দেয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ৫ তলাবিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার পুনর্বাসন করা হবে। খুরুশকুল প্রকল্পটি বিশ্বের একক বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৩ জুলাই ২০২০ খ্রি. তারিখে উদ্বোধন করেন। অবশিষ্ট ১১৯টি বহুতল ভবন ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ কর্তৃক পৃথক ডিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা অর্জনে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
উপসংহার
এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সমন্বিত নীতিকাঠামো প্রণয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রধান কারণ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে এসডিজিকে সমন্বিত করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) সঙ্গে যা উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সমাজের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে একীভূত করেছে।
মুজিববর্ষে বিশেষ উদ্যোগে সমাজের ছিন্নমূল মানুষকে জমি ও গৃহ প্রদানের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ‘যে আছে সবার পিছনে, পৌঁছাতে হবে তার কাছে আগে’- অগ্রাধিকার নীতি হিসেবে এটি গ্রহণের ফলে সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্যের (শতকরা ১০. ৫ ভাগ) আওতাভুক্ত জনগণই গৃহায়ণ কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী। ফলে, স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচনে এ প্রকল্প অনন্য সাধারণ। দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকা এ কার্যক্রমের সুবিধা পাচ্ছে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চা শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী, পরিবেশগত শরণার্থী, প্রতিবন্ধী, খনি শ্রমিক, কুষ্ঠ রোগী এবং অতি দরিদ্র নারীরা এ কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী।
এসব পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য উপার্জন ও উৎপাদনশীল সম্পদে তাদের প্রাপ্যতা বাড়াতে এবং ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির সংস্থান এ কর্মসূচির মাধ্যমে অর্জিত হওয়া সম্ভব। এসডিজি ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নের ফলে অসমতা কমানো, বিভিন্ন সেবায় প্রবেশগম্যতা, বিদ্যুৎ ও নিরাপদ পানি প্রাপ্তি এবং নাগরিক মর্যাদাকেন্দ্রিক বাধা-বিপত্তির অবসান হবে। একই সঙ্গে জেন্ডার ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অসমতাগুলো দূরীভূত হবে। শুধু গৃহায়ণের ফলেই কর্মসংস্থান ও উপার্জনের সুযোগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গুচ্ছভিত্তিক আবাসনের ফলে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একই স্থান থেকে দেয়া হবে। ফলে, পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং স্বাস্থ্যসেবা সহকারীরা গ্রামীণ এলাকায় নিয়মিত উপকারভোগীদের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সেবা দিতে পারবেন।
স্থানীয় পর্যায়ে নির্মাণসামগ্রী সরাসরি গ্রামীণ বাজার থেকে সংগ্রহের ফলে নির্মাণ ব্যয় তুলনামূলক কম হচ্ছে এবং একই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। এই একটি প্রকল্পের মাধমেই পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নব দিগন্ত সূচনা হয়েছে বাংলাদেশের আকাশে।
মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
আব্দুল হান্নান মাসউদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পুরো জুলাই মাস তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন। আর আন্দোলনকে একটি সামগ্রিক রূপ দিতে কখনো ফেসবুক লাইভ, কখনো বা সাংবাদিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন ইস্যুতে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তার কথার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সে সময়ের অনেক অজানা কথা। হান্নান মাসউদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। যার ফলে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন তাকে হল ছাড়তে বাধ্য করে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তার রাজনীতির শুরুটা হয় ছাত্র অধিকার পরিষদ দিয়ে। ন্যায় ও নীতির ব্যাপারে আপস না করে পরিষদের রাজনীতি থেকেও সরে আসেন তিনি। হান্নান মাসউদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী।
আপনার রাজনীতির যাত্রাটা কবে থেকে শুরু হয়েছে, কী চিন্তা থেকে রাজনীতিতে আসেন আপনি?
হান্নান মাসউদ: আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস কেবল জুন থেকে শুরু হয়নি। আমার রাজনীতির শুরুটা ২০২২ সাল থেকে। তখন হল ছেড়ে দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনীতিতে যোগ দেই। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়ভাবে যে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে অত্যাচার চলছিল সেগুলোর প্রতিবাদ করা। আমার চিন্তা ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ কাউকে না কাউকে করতে হবে। একটি অংশকে অবশ্যই জেগে উঠতে হবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। যারা সত্য তুলে ধরবে তারা সংখ্যায় যত কমই হোক এক সময় মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে। এমন চিন্তা থেকে আমার রাজনীতিতে আসা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে আপনি কোন প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছেন?
হান্নান মাসউদ: আমি তখন মোহাম্মদপুরে থাকি। টিউশন থেকে আসার পর আমরা যারা একসাথে রাজনীতি করতাম তাদের মধ্যে অনলাইনে একটি মিটিং হয়। মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ জুন সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করি। আমরা ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীদের ভালো সাড়াও আমরা পাই। সেদিনের প্রোগ্রাম থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, ক্রাউড ফান্ডিং করে আমরা আন্দোলন পরিচালনা করবো। ওইভাবেই আমরা আন্দোলনের সকল খরচ বহন করতাম শুরুর দিকে। জুনের ১২ তারিখ পর্যন্ত আমরা বিক্ষোভ মিছিল চালু রাখি।
১২ জুন আমাদের একদল প্রতিনিধি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে স্মারকলিপি দিতে হাইকোর্টে যায়। তিনি সেদিন আমাদের সাথে দেখা না করলেও আমরা তার অফিসে তা জমা দিয়ে আসি। সেখানে আমরা এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশের মুখোমুখি হই। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের জেরা করেন।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটি কীভাবে আসে?
হান্নান মাসউদ: ১২ জুন অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেওয়ার পর আমরা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেই। ১ জুলাই থেকে আবারও বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করি। ৪ জুলাই কোটা নিয়ে হাইকোর্টের শুনানি ছিল। আমাদের চিন্তা ছিল, সেদিন যদি রায় স্থগিত না করা হয় তবে আমরা এই আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড় করাবো। এরপর আমাদের মধ্যে আলোচনায় আমি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটি প্রস্তাব করি। সেখান থেকে সর্বসম্মতিক্রমে এই নামটি উঠে আসে।
১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ‘রাজাকার’ বলার প্রতিবাদে ‘ তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার ’ স্লোগান দিয়ে হল থেকে বের শিক্ষার্থীরা। ওই দিনের রাতের ঘটনা নিয়ে কিছু বলেন।
হান্নান মাসউদ: শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলেন। তারা জানায়, মন্ত্রী পর্যায়ের কয়েকজন আমাদের সাথে বসতে চায়। আমি সেখানে খুব জোরালোভাবে বলি যে, দেখেন আমাদের দাবিগুলো খুব পরিষ্কার। আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার নিশ্চয়তা দিলে আমরা তাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বিবেচনা করতে পারি। একই সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এমন নিশ্চয়তা যদি দেয় তবে আমরা বসবো। আমরা সেখানে সিদ্ধান্ত শুনতে যেতে পারি। বড় কোনো আলোচনা করার জন্য আমরা যাব না। এই আলোচনার মধ্যেই আমরা সেখান থেকে চলে আসি। এরপর সেদিন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দেয় যে, আন্দোলনের কারণে জনভোগান্তি হলে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা ভাবছিলাম যে, হয়তো এসব হুমকির কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হবে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল। ১৪ তারিখ বিকেলে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করেন। সেদিন রাতেই শিক্ষার্থীরা সকল হল থেকে একযোগে মিছিল নিয়ে বের হয়ে শেখ হাসিনার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে। এর আগে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় মতিয়া চৌধুরী কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করে। এর প্রতিবাদে তখন মিছিল করা হয়। ২০১৮ সালের ঘটনা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। সকল ভয়, রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারী শিক্ষার্থীরা সেদিন গভীর রাতে হল থেকে থালা, বাটি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন রাতের ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সারাদেশের সকল ক্যাম্পাস থেকে অস্তিত্ব হারানো শুরু করে। সেদিনের ঘটনায় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। অনেক ছাত্রলীগ নেতা সেদিন পদত্যাগ করে।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার সূত্রপাত হয় কীভাবে? পরবর্তী অন্যান্য ছাত্রসংগঠন আপনাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছিল তখন?
হান্নান মাসউদ : ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি ছিল। রিফাত, হাসিবসহ কয়েকজন ক্যাম্পাসে মাইকিং করতে হলপাড়ায় যায়। সেখানে একাত্তর হল ছাত্রলীগের কয়েকজন তাদের হামলা করে। এ খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে হল পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। তখন মধুর ক্যান্টিনে সাদ্দাম, ইনান, সৈকত ও শয়নের অনুসারীরা লাঠি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল। শিক্ষার্থীদের ওইদিকে গেলেই তারা সেখানে হামলা শুরু করে। এসময় তাদের সাথে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিল। নারী শিক্ষার্থীরাও তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। হামলার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, বিক্ষোভ মিছিল করবো। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, শিবিরের কাছে বিক্ষোভ মিছিল করার ব্যাপারে সহযোগিতা চাই। তাদের তেমন কোন সাড়া না পেয়ে আমরা ১৫-২০ জন মিলে মিছিল করার জন্য হাঁটা দেই। পুলিশ আমাদের দোয়েল চত্বর আটকায়। সেখান থেকে আমাদের আর সামনে যেতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই আমরা পরদিন রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভের ঘোষণা দেই।
১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে হলছাড়া করার প্রক্রিয়ায় ছাত্রদল, শিবির ও অন্যান্য সংগঠনের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়েছে আপনাদের?
হান্নান মাসউদ : ১৫ তারিখ সন্ধ্যার পর আমরা আর সেভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি। পরদিন আমরা ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করি। সেখানেও পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আমার দুই পায়ে রাবার বুলেট লাগে। আমি তখন পায়ে ব্যথা নিয়ে বসে পড়ি। সূর্যসেন হলের দিকে ছিল পুলিশ আর বঙ্গবন্ধু হলের দিকে ছিল ছাত্রলীগ। তখন সাংবাদিকরা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেদিন সন্ধ্যার পরে আসিফ ভাই কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা দেন।
আন্দোলনের এই পর্যায়ে সংকটপূর্ণ একটা সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। ১৭ জুলাই সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেন।
হান্নান মাসউদ : আন্দোলনের এই সময়টাতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিল আমার টিউশনের ফ্যামিলি। স্টুডেন্টের বাবা-মা আমাকে খুব যত্ন করতেন। ওই সময়ে আমাকে তারা নিজেদের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। পুরো আন্দোলনে আমার জন্য অনেক করেছেন তারা। আন্দোলনের সময় আন্টি নিজের হাতে রান্না করে শিক্ষার্থীদের খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তায় নিয়ে যেতেন । ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস থেকে চলে যাওয়ার পর ওনার বাসায় আমি ১৯ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। ১৮ তারিখ দুপুরের দিকে আংকেল আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, শেখ হাসিনা তো পালাবে মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সবকিছু ঘেরাও করে রেখেছে। টিভি স্ক্রিনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ যখন দেখছিলাম, আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মনে হয় সফল হতে যাচ্ছি।
১৯ তারিখ রাতে ৯ দফা ঘোষণা করা হয়। আর সেদিন রাতেই নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতেই তিন সমন্বয়ক মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেন। সেদিন আপনার সাথে কী হয়েছিল?
হান্নান মাসউদ: সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে ডিবি থেকে ফোন দেয়। সেখানে থাকা তিন সমন্বয়কের একজন আমাকে খুব জোরাজুরি করেন ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য। আমাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। আমাকে ওই সমন্বয়ক বলেছিলেন, নাহিদ ও আসিফ জামাত-শিবিরের টাকা খেয়ে আন্দোলন করছে। নানাভাবে প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন তখন। আমি একবারে স্পষ্ট করে বলেছি আমি যাব না। এক পর্যায়ে আমাকে বলেছিলেন, এই যে এত এত লাশ পড়ছে এটার শেষ কোথায়? আমি বলেছি, হয় শেখ হাসিনার পতন ঘটবে না হয় আমাকে মেরে ফেলবে। তবেই এটার শেষ হবে। সেই একই ফোনে ডিবির সাথেও আমার কথা হয়। তারাও নানাভাবে হুমকি দিয়েছে আমাকে। এই ঘটনার পর আংকেলের বাইকে করে আমি মোহাম্মদপুর গিয়ে আমার আরেক স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকি। পরদিন আমার এক মামার বাসায় চলে যাই।
নাহিদ ইসলাম যেদিন গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যায় সেদিন আপনারা সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেদিন আপনাদের সাথে কী কথা হয়েছিল সেখানে?
হান্নান মাসউদ: সেদিন মামার বাসা থেকে আমি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার আগে আমাদের দুইজন সমন্বয়কের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, তার কাছে কারফিউ পাস আছে, গাড়ি আছে। সে আমাকে তার সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। আমি সরাসরি না করি। এর আগে কয়েকবার গাড়ি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি সরাসরি না করে দিয়েছি। আমি নিজেই সিএনজি করে গণস্বাস্থ্যে যাই। সেখানে যাওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারো সাথেই আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকে আবার প্রথমদিন যে স্টুডেন্টের বাসায় ছিলাম, তাদের কাছে ফিরে যাই। সে বাসায় যাওয়ার পর জানতে পারি আমার এলাকার এক বড় ভাই আমাকে খুঁজতে এসেছিলেন।
ওই সময়ে আপনারা যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন।
হান্নান মাসউদ: সেদিন গণস্বাস্থ্যের সামনে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করি। সংবাদ সম্মেলন শেষে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমার এলাকার ওই বড় ভাই (গাফফার) সেদিন গণস্বাস্থ্যে ছিলেন। সাংবাদিকদের সহযোগিতায় তিনি সেদিন অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে কলাবাগানের একটা বাসায় নিয়ে রাখেন। সেদিন রাতেই সেখান থেকে বোরকা পরিয়ে তিনি রামপুরায় একটা বাসায় নিয়ে যান আমাকে। সেখান থেকে ২৩ তারিখ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ভাইয়ের চেম্বারে আসি। উনি যাত্রাবাড়ীতে উনার ভাইয়ের কাছে আমাকে রাখেন। সেখান থেকে ২৫ তারিখ বের হয়ে মোহাম্মদপুর আসি। এর মাঝে নাহিদ ভাই ফোন দিয়ে আহতদের খোঁজ খবর নিতে বলেন। পাশাপাশি আইনজীবীদের নিয়ে একটি লিগ্যাল সেল তৈরি করার পরামর্শ দেন। তিনি একটা মেডিকেল টিম তৈরি করার কথাও বলেন। হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ নেয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সেদিন আহতদের সাথে দেখা করতে উত্তরায় বাংলাদেশ হাসপাতালে যাই । সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, পুরো হাসপাতালে আহতদের কোন রেকর্ড নেই। তারা আমাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করছিলেন না। তারপরও আমরা একজন আহতের খোঁজ পেয়ে জোর করে তার সাথে দেখা করতে যাই।
সেদিন মাঠপর্যায়ে আর কোনো কার্যক্রম ছিল আপনাদের?
হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা আটকা পড়ি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের হাতে। তখন গাফফার ভাইকে কল করে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করি। মাহিন ভাইকে অসুস্থ বানিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে। বের হওয়ার সাথে সাথে কয়েকটা বাইক, মাইক্রো আমাদের ফলো করতে থাকে। ড্রাইভার একরকম রেইস করে মার্কিন দূতাবাসের সামনে নিয়ে যান। দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও তারা আমাদের সেখানে আশ্রয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তারা অন্য একটা ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সেখানে একরাতের জন্য আমরা ছিলাম।
ওই সময়ে ভিডিও বার্তা ও কর্মসূচি দিতেন কোথা থেকে?
হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে শহীদুল আলম ভাইয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। উনি গুলশানের একটা স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন আমাদের। সেখান থেকে আমরা কর্মসূচিগুলো দিচ্ছিলাম। সেখানে আমরা তিনদিন ছিলাম। গাফফার ভাইও আমাদের সাথে ছিলেন তখন। উনি আমাদের সেখানে রান্না করে খাওয়াতেন। আমাদের দেখাশুনা উনিই করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে আরেকটি মাধ্যমে আমরা বিহারি ক্যাম্পে চলে আসি। সেখানেও খুব একটা সুবিধাজনক মনে হয়নি। সাথে সাথে বের হয়ে এক ব্যবসায়ীর অফিসে গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকার পর সদরঘাট এলাকায় চলে যাই। সেখানেও সেইফ ফিল না হওয়ায় সাথে সাথে বের হয়ে যাই। সেদিন জুলকারনাইন সায়ের ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি মিরপুরে ওনার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। উনার অফিসে গিয়ে আমরা উঠি। সেখানে ২ তারিখ পর্যন্ত আমরা ছিলাম।
২ তারিখ আপনি একটি লাইভ করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন।
হান্নান মাসউদ: সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমাকে কল করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কল করে স্বপরিবারে সাক্ষাৎ করার জন্য অফার করা হয়। আমাদের ভবিষ্যতে কোন কিছুর অভাব হবে না। দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেয়ার লোভ দেখানো হয়। আমি বলি, আপনার প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমার ভাইদের রক্ত লেগে আছে। উনাকে বলেন, আমার ভাইদের রক্ত পরিষ্কার করতে। ওই দিনই মিডিয়ায় দেখি ৩০-৪০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটা দেখার পর আমি ফেসবুকে লাইভ করি। সেখানে বলি, প্রধানমন্ত্রী আপনার দরজা খোলা রাখার দরকার নেই। আপনি বের হয়ে আসেন। জনগণের টাকা খরচ করে গণভবনে থাকার অধিকার আপনার নেই। আপনার অবশ্যই গণভবন ছাড়তে হবে। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেই আমি। সেদিন এক মহিলা সাংবাদিক এক দফার ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এক পর্যায়ে উনি আমাকে বললেন, এক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নাও। আর যদি সিদ্ধান্ত না নিতে পারো তবে আমরা তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমি তখন বলি, আপনি যা ইচ্ছে করেন। মেরে ফেললে মেরে ফেলেন। আমরা এটা দিতে পারবো না। কালকে মাঠ থেকে নাহিদ ভাই এক দফার ঘোষণা দিবেন। তখন নাহিদ ভাইয়ের পরামর্শ ছিল, তোমরা সর্বোচ্চটা ধরে রাখ। না পারলে ঘোষণা দিয়ে দিও। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা বনানী চলে যাই। সেখানে একদিন থাকার পর ৩ ও ৪ তারিখ থাকি বারিধারায়।
মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন একদিন এগিয়ে ৪ তারিখ করেছিলেন?
হান্নান মাসউদ: সেদিন আসিফ ভাইকে আমি ফোন দিয়ে মার্চ টু ঢাকা একদিন এগিয়ে আনার পরামর্শ দেই। নাহিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে একদিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেই। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ থেকে শিবিরের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। ছাত্রদলের রাকিব ভাইয়ের সাথেও আমাদের যোগাযোগ হয়। ভিডিও করার জন্য তিনি আমাদের ফোন কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা নেই নি। এক্ষেত্রে আমরা ৫০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করি এবং শিবিরের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমরা এই টাকা দিয়ে দুইটা ফোন ক্রয় করি। আমরা সংগঠন হিসেবে শিবিরের সাথে যোগাযোগ করি। কোন ব্যক্তির সাথে নয়।
৫ তারিখ হাসিনার পতন হয়। এ সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
হান্নান মাসউদ: সেদিন খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবন, গণভবনে আসি। কিন্তু সংসদ ভবনে ঢুকিনি। আমার চিন্তা ছিল, যদি কখনো ঢুকি সংসদ সদস্য হয়েই এখানে যাবো। তখন চারদিকে এত এত শুভাকাঙ্ক্ষী.. একেকজন একেক দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরকে আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় নাই। চ্যানেল ২৪-এ আমাদের সেদিন যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু নিয়ে যাওয়া হইছে। তখন আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে এই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ অন্যরকম হত।
হাসনাত আবদুল্লাহ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক। এই তরুণ সংগঠক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায় এবং যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে লড়াকু হয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলেনে একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সবসময় ছিলেন অগ্রগামী।
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেন। সেই আন্দোলন থেকেই তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্রে পরিণত হন তিনি। এই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের হাতে বন্দি থেকে ট্রমার মধ্য দিয়েও দিনযাপন করতে হয়। দেশের জন্য শহীদি মৃত্যু বরণ করতেও রাজি ছিলেন এই দুঃসাহসী তরুণ। তবুও স্বৈরাচারের কাছে মাথানত করেননি।
ছাত্রজীবনে একজন চৌকস বিতার্কিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন হাসনাত। যে কোনো বিতর্কে তিনি খুরধার যুক্তি ও চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরতেন। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই তরুণ নেতার স্বপ্ন একটি ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
সম্প্রতি বাসস'কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘আমরা ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে একটা কর্মসূচি দেই, যেটি ঢাকাসহ সারাদেশের ছাত্র জনতা ও সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে এ কর্মসূচি। পরবর্তী দুই দিন আমাদের ব্লকেড কার্যক্রম চলে। ‘বাংলা ব্লকেড’ কার্যক্রমের পরে আমরা একদিন বিরতি দেই। সেদিন আমরা আমাদের সমন্বয়ক টিমকে ভাগ করে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই, যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা ভালো মতো সমন্বয় করতে পারি। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি কুমিল্লাতে যাই।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলি। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেখানে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সেই স্থানগুলো পরিদর্শন করি এবং ছাত্রদের নির্দেশনা দেই। একই সাথে আমরা সমন্বয়করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ওই সময় আমাদের সমন্বয়করা ছাত্রলীগ ও পুলিশের তাণ্ডবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তারাও আন্দোলনকে সমন্বয় করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে থাকে। পরবর্তীতে যেটি হয়, আন্দোলন দৃঢ় ও ইস্পাত-কঠিন হতে থাকে। সারা দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে থাকা শিক্ষার্থীরা সুসংগঠিত হতে থাকে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বয়ক নির্বাচিত করি, যাতে করে বিগত দিনের মতো অন্য শিক্ষার্থীদের ওপরেও দায় চাপিয়ে আন্দোলন বেহাত হওয়ার যে ঘটনা ঘটে, তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। পরবর্তীতে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।’
তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচিবালয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যাই। ১৪ জুলাই আমরা স্মারকলিপি দিয়ে হলে ফিরি, ওইদিন গণভবনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার একটা প্রেস কনফারেন্স ছিলো। আমরা দেখি যে সেই প্রেস কনফারেন্সে তিনি (শেখ হাসিনা) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার এমন আপত্তিকর বক্তব্যের পর ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।’
হাসনাত বলেন, ‘১৪ জুলাই রাতে সবাই যখন যার যার হল থেকে রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখন আমি একটি টিভি টকশোতে ছিলাম। টকশো শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা হই। এর মধ্যে দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণে রাতের ঢাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। তখন আমরা অমর একুশে হল ও সায়েন্স ফ্যাকাল্টির প্রত্যেকটা হল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে আসি। খেয়াল করলে দেখবেন যে, সেদিন রাতে একটা আইকনিক মিছিল ঢাকাসহ সারাদেশ প্রকম্পিত করেছিল একটি শ্লোগান দিয়ে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ আমরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসি। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল থেকে মেয়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল থেকেও শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ স্লোগান দিয়ে নেমে আসে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৫ জুলাই দুপুর বারোটায় আমরা রাজু ভাস্কর্যে একটি কর্মসূচি দেই। ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি দেয়। তবুও আমরা আমাদের কর্মসূচি পরিবর্তন করিনি। রাজু ভাস্কর্য থেকে আমরা যখন হলের দিকে প্রতিদিনকার মতো মিছিল নিয়ে আসতে থাকি, তখনই বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ নৃশংসভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এই সময়ে আমরা দেখি যে তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলন দমন করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করে। তারা নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করে। আমিও এই আক্রমণের শিকার হই। ওরা আমাকেও বেধড়ক পিটায়। রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শাকিরুল ইসলাম শাকিল আমাকে বাজেভাবে পিটিয়ে আহত করে। আমার বাঁ পায়ে জখম হয়। সেদিন আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করা হয়। নারী শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার এই ফুটেজ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে।’
তিনি বলেন, এখানে বলে রাখি, ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আগে সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আমরা তখন শাহবাগে ছিলাম। শাহবাগে আন্দোলন চলাকালীন আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের সাথে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ছিলো। তখন টিএসসিতে ওই কর্মকর্তা আমাদের সাথে কথা বলেন। শাহবাগ থানার পুলিশসহ অন্যান্য জোনের পুলিশও ছিলো সেখানে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের মোটিভ কী? আমরা বারবার বলেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা নিরসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। পুলিশ থেকে আমাদের ওপর প্রেশার দিতে থাকে আমরা যেন আন্দোলন তুলে নিই। কিন্তু আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের পক্ষে আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব নয়।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ছাত্রলীগ মনে করেছিল ১৫ জুলাইয়ে হামলা করেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু ১৬ জুলাই আরও বেশি শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সবাই একত্রিত হওয়ার পর আমরা একটা বিক্ষোভ মিছিল করি।’
১৬ জুলাই দুপুরে আমরা একটি অনলাইন মিটিং করছিলাম। মিটিংয়ে আমি, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, বাকের, হাসিব থেকে শুরু করে অন্যরাও উপস্থিত ছিল। এসময় খবর পাই যে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমরা ওই মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নিই আর কোনো সংলাপ হবে না। ‘রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়’।
তিনি বলেন, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসি চত্বরে একটি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শিক্ষার্থী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সবাই উপস্থিত হন। হাসনাত বলেন, ‘আমার মনে আছে, গায়েবানা জানাজা চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে কনস্ট্যান্টলি ফোর্স করতে থাকে যেন আমরা গায়েবানা জানাজা না করি। কিন্তু সকল প্রেশার উপেক্ষা করে আমরা গায়েবানা জানাজা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিই। গায়েবানা জানাজা শেষ করে আমরা যখন কফিন কাঁধে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাই, তখনই আমাদেরকে দুই দিক থেকে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। আমাদের ওপর টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলেও আমরা সেটি প্রতিহত করি।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন আপনারা দেখেছেন যে পুলিশকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় এবং বিকাল পাঁচটার মধ্যে হলগুলো খালি করার ক্ষেত্রে প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি গণভবনের প্রেসক্রিপশনে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেন। বিশেষ করে ভিসি এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি আমাদেরকে বারবার ফোর্স করেন আমরা যেন আন্দোলনকে প্রত্যাহার করে নিই। আন্দোলন প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে আমরা বারবার বলি যে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট লাগবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার করতে হবে। আমরা বলি যে, এখন আর এই আন্দোলন থেকে ফেরার পথ নেই। আমরা ভিসির কাছে দাবি জানাই, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
‘হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা কীভাবে কী করব তা নিয়ে সন্দিহান অবস্থায় থাকি। তখন আমি সায়েন্স ল্যাবে আমার মামার বাসায় চলে যাই। তখন আমরা সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। তখন আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারজিস আলমও আমার মামার বাসায় চলে আসে। তখন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এরমধ্যে আমাদেরকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) সংলাপের প্রস্তাব দেন।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সাইন্সল্যাবে আমাদের বাসার নিচে আসে এবং আমাদেরকে বলে, মিটিং করার জন্য একটা জায়গায় আমাদেরকে যেতে হবে। তখন আমরা অনীহা প্রকাশ করে বলি, কোনোভাবেই আমরা এই মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমাদের সবার সমন্বিত সিদ্ধান্ত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা কোনো মিটিং করা সম্ভব না। তখন তারা আমাদেরকে বলে, হয় মিটিংয়ে যাবেন, না হয় বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তারা আমাদেরকে নিয়ে পদ্মাতে যায়।’
‘আমাদেরকে পদ্মাতে নিয়ে যাওয়ার পরপরই সেখানে তিন মন্ত্রী প্রবেশ করেন। তারা হলেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তারা প্রবেশ করার পরেই আমাদেরকে বলেন, আমরা যেন তাদের সাথে মিটিং করি। তখন আমরা প্রত্যাখ্যান করি যে, ওনাদের সাথে আমাদের মিটিং করা সম্ভব না। বারবার আমাদেরকে পুশ করা হয় আমরা যেন ওনাদের সাথে বসি। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ওনাদের সাথে মিটিং করতে রাজি হইনি। চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর তিন মন্ত্রী আমাদের সামনেই বের হয়ে চলে যান। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদেরকে সাইন্সল্যাবে না নিয়ে একটি সেইফ হোমে নিয়ে রাখে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, রাত। পরের দিন শুক্রবার। আমাদেরকে জুমার নামাজ পড়তে দেওয়া হয় নাই। তিন মন্ত্রীর সাথে দেখা না করায় আমাদেরকে সারারাত ইন্ডিভিজুয়ালি (পৃথকভাবে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাকে একবার, সারজিসকে একবার, এভাবে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তারা আমাকে বলে, সারজিস রাজি হয়ে গেছে। সারজিসকে বলে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলা হয়, যেহেতু আমার বাবা একসময় বিদেশে থাকতেন। নানানভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো টেনে এনে আমাকে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাকে কিচেন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন বুঝতে পারি আমি কাকরাইল মসজিদ থেকে বেশি দূরে না। কারণ ওইদিন জুমার নামাজের পরপরই কাকরাইল মসজিদ থেকে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন এই মিছিলটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এই মিছিলটা সম্ভবত বায়তুল মোকাররমের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। জুমার নামাজের পরে আরেকটা টিম আমাদের কাছে আসে এবং তারা আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়। আন্দোলনের সময়ে তখন সর্বপ্রথম আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রথম লাঞ্ছনার শিকার হই। আমাকে কিচেনে একপর্যায়ে থাপ্পড় দেওয়া হয়। আমাকে বলে যে আমার পরিবার তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। যেন নাহিদসহ আরও যারা আন্দোলনকারী আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা যেন মিটিং করি।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে প্রেস কনফারেন্সের দিনও প্রেশার দেওয়া হয় এটা বলার জন্য যে, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তখন আমরা দেখতে পাই, আমাদের সামনে সাংবাদিকের চেয়েও বেশি আছে এজেন্সির লোকজন। তারা সবাই মোবাইল ও ক্যামেরা হাতে ছিল। আরেকটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিল যে ক্যাম্পাসের শ্যাডোতে, মল চত্বরে, কলা ভবনের সামনে, লাইব্রেরির সামনে আমরা যাদেরকে দেখে ভাবতাম হলের কর্মচারী বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করে, আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা খেয়াল করি যে, ওরা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার (ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির) ফিল্ড স্টাফ।’
তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আমাদেরকে প্রেশার দেয়, আমরা যেন মিটিং করি। তারপর থেকে আমি আমার স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেই। একটা বাটন ফোন ব্যবহার করা শুরু করি। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির প্রেস কনফারেন্সের পরে আমি মামার বাসায় না গিয়ে কাঁটাবনে আমার বন্ধুর সাথে থাকি। ওইদিন রাতেই আমি আবার মামার বাসায় চলে আসি। সারজিসকেও সেখানে আসতে বলি। নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা এসে সাইন্সল্যাবের বাসা থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর তারা আমাদেরকে গাড়িতে সারা ঢাকা ঘোরায়। তারপর আমাদেরকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’
হাসনাত বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসের প্যাটার্ন ছিল এই টাইপের একটা জায়গায় ত্রিশ জনের মতো অফিস করে। বাথরুম হচ্ছে একটা। সারাদিন আমাদেরকে বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। বসার জায়গা নাই, শোয়ার জায়গা নাই, কমপ্লিটলি ওই অফিসে পেপার-পত্রিকা সব বন্ধ, মোবাইল বন্ধ, টিভি বন্ধ। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য আমার সাথে খুবই রূঢ় আচরণ করে। সে খাবারে সমস্যা করেছে এবং সারারাত বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। নিরাপত্তা হেফাজত থেকে একদিন আমাদের গার্ডিয়ানদের আসতে বলা হয়। আমার এক ভগ্নিপতি আসেন আমাকে নেওয়ার জন্য। ওনাকে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বলেন, আপনি চলে যান। কোনো ডিসিশন হয় নাই।’
হাসনাত জানান, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নিয়োজিত ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই আমাকে কল দিয়ে বলেন, ‘কালকে তোরা সামনে থাকিস না। দুইটা শার্ট নিয়ে বের হইস। কারণ আমাদের কাছে নির্দেশ আছে আমাদেরকে গুলি চালাতে হবে’। উনি এই কথাটা বলে অঝোরে কান্না করা শুরু করেন। আমি তখন খুব ইমোশনাল হয়ে যাই। তাকে বলি, ভাই আমরা আসলে পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে আছি। ৫ আগস্ট ফজরের সময় আমাকে তিনি বলছিলেন, আমরা যেন ফার্স্ট লাইনে না থাকি।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট সকালে বৃষ্টি হয়। সারজিস আলমকে মহাখালী থেকে পিক করার কথা ছিল আমার। আসিফ মাহমুদ পুরান ঢাকার ওইদিকে থাকেন। আমি সারজিসকে বলেছিলাম যদি বৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো শেখ হাসিনা বেঁচে যাবে। কারণ এটা সংশয় ছিল যে, বৃষ্টি হলে রাস্তায় মানুষ নামবে না। এটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে এবং পুরো আন্দোলন চলাকালীন এই সময়টায় আমি খুব ডিসহার্টেনড (হতাশ) হই। তখন আমি সাকিবকে ফোন দেই। ওরা একেবারে ছোট ছোট। থার্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র। ওরা ২ আগস্ট থেকেই ক্যাম্পাসে এসে শেখ হাসিনার পতনের স্লোগান দেয়। তখন সাকিব আমাকে বলে, ভাই আপনি আসেন। আমরা বের হবো। বৃষ্টি হোক আর যাই হোক, আমরা বের হবো। তখন সাকিব, রিয়াদ, জামিল আসে। আমিও বের হই। আমি আর আগাতে পারি না। গাড়ি নিয়ে আমরা অনেক ঘুরে বিজয় সরণির ওদিকে যাই। ঢাকায় একদম সুনসান নীরবতা। ওই এলাকায় একটা মানুষও ছিল না। মহাখালী ব্রিজটার ওদিকে এসে আবার আমরা টার্ন নেই। কারণ আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না যে পেছনে যাব। কারণ কেউই নাই। তখন আমরা এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়া শুরু করি। মহাখালী থেকে তিতুমীরের দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ ছিল। তখন গাড়ি টার্ন নিতে পারে নাই। আমরা সোজা গিয়ে বনানী থেকে টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সেটিও বন্ধ ছিল। তখন নেভির ওদিকে একটা রাস্তা আছে সেটি দিয়ে মহাখালীর দিকে আসতে আসতে ওখানে দাঁড়াই অনেকক্ষণ।’
তিনি বলেন, ‘তখন দুই ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। তখন আমি ভাবি যে ‘উই আর ডান’। কিন্তু একটু পর আবার যখন ইন্টারনেট কাজ করা শুরু করে তখন আমরা নিউজ পেলাম সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবেন। তখন সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে মানুষ বের হওয়া শুরু করল। এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী পর্যন্ত জনস্রোতটা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়েছে। সব দিক থেকে মানুষ আসা শুরু করছে। তখন আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। আর তখন তো মানুষ আর মানুষ। এরপর আমরা গণভবনের দিকে আসলাম। খবর ছড়িয়ে পড়ল স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সারা বাংলায় বিজয়ের মিছিল শুরু হলো। দেশ মুক্ত হলো দেড় দশকের নিপীড়ন নির্যাতন গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারের হাত থেকে। এভাবেই সৃষ্টি হলো নতুন এক বাংলাদেশের, ছাত্র-জনতার বিজয়ের গৌরবগাথা...’
বিশ্বের অন্যতম পরিচিত মেগাসিটি আমাদের রাজধানী ঢাকা। এক সময় সবুজ গাছপালা আর খোলামেলা পরিবেশের জন্য নাম ছিল এই ঢাকার। তবে আধুনিক হয়ে উঠতে গিয়ে শহরটি হারিয়েছে সেই প্রাকৃতিক জৌলুস।
আজ ঢাকার যেদিকেই তাকানো হবে, দেখা যাবে সুউচ্চ সব ভবন, কতশত কারখানা; সবমিলিয়ে একদম আধুনিকতায় মোড়ানো ব্যস্ততম এক মহানগরী। তবে বিনিময়ে হারিয়েছে সেই সবুজ পরিবেশ, বাসযোগ্যতা ও বায়ুমান নিয়ে তৈরি হয়েছে গুরুতর উদ্বেগ।
একদিকে গাছপালার প্রাকৃতিক বাতাসের পরিবর্তে ঢাকার ঘরবাড়ি ও অফিসগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। অন্যদিকে, আশঙ্কাজনকহারে কমে আসছে সবুজ বনভূমির পরিমাণ।
মহানগরী ঢাকা একসময় পরিচিত ছিল ‘বাগানের শহর’ নামে। তবে ১৯৮১ সাল থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর সম্প্রসারণ হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রাজধানীর সবুজের পরিমাণ, বিশেষত গাছপালা আশঙ্কাজনকভাবে বিলীন হয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে হাজার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে এসে অতিরিক্ত গরম, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা।
১৯৮১ সালের নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ১৯ শতাংশ ভূমি সবুজে আচ্ছাদিত ছিল।
আশির দশকের উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এমনকি ধানমণ্ডি, মিরপুর ও উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোর সড়কের পাশে ও বাড়ির আঙিনায় প্রচুর গাছ ছিল।
সংখ্যায় বলতে গেলে সে সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় (তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চলে) আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ পূর্ণবয়স্ক গাছ ছিল।
ঢাকায় গাছ কাটার হার আধুনিকায়নের গতিকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন ভবন, রাস্তা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পার্ক ও খোলামেলা জায়গা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ফলে নগর উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছেন তারা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেহানা করিম বলেন, ‘ঢাকায় অবকাঠামো বাড়ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হচ্ছে পরিবেশের বিনিময়ে। উচ্চ ভবন ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে শুরু করেছে এই সবুজের অভাব।’
শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, ঢাকার গাছপালা আশঙ্কাজনভাবে কমার কারণে শহরটির বসবাসকারীরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মিরপুরের বাসিন্দা তারেক রহমান বলেন, ‘এখন সব জায়গায় এসি লাগানো হচ্ছে, কিন্তু প্রাকৃতিক ছায়ার যে আরাম ও স্বাস্থ্য উপকারিতা তা এসিতে নেই। যেসব উপাদান এই শহরটিকে বাসযোগ্য করে তুলেছিল, আমরা সেগুলোই হারিয়ে ফেলছি।’
অতিরিক্ত উত্তপ্ত শহর ঢাকা
১৯৮১ সালের হিসাব তো আগেই দেখানো হয়েছে, এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ বিভাগ জানিয়েছে, তাদের হিসাবে ২০২৫ সালে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে থাকা পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। আশির দশকের ১৯ শতাংশ বনভূমি এসে এখন ঠেকেছে ৬ শতাংশেরও নিচে।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সবুজ জায়গা মাত্র ০ দশমিক ৪২ বর্গমিটার, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী যেটি হওয়া উচিত ৯ বর্গমিটার।
এতে শহরের তাপমাত্রায় এক লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। ১৯৮১ সালের পর থেকে গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, ধুলাবালি কণার (পিএম ২.৫) মাত্রায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি শহরের তালিকায় নিয়মিত থাকতে দেখা যায় ঢাকাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গাছের বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব।
অনেকদির ধরেই সরকারের কাছে নগর পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক সবুজ এলাকা ও বৃক্ষরোপণের কড়া নীতি গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা তীব্র তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ বৃ্দ্ধি ও জনস্বাস্থ্যের অবনতির মতো মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলেও সতর্ক করেছে তারা।
দশকের পর দশক ধরে বন উজাড়ে
আধুনিকতার পথে অগ্রগতির সঙ্গে টেকসই পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে ঢাকা আজ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে—প্রাকৃতিক পরিবেশের বলি না দিয়ে আধুনিক হতে পারবে ঢাকা?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঢাকার ক্রমবর্ধমাণ জনসংখ্যা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৮১ সালে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ, ২০২৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
এতে ১৯৮১-১৯৯১ পর্যন্ত এই দশ বছরে দ্রুত নগরায়নের প্রাথমিক লক্ষণস্বরূপ সড়ক সম্প্রসারণ ও প্লট উন্নয়নের কারণে ১০ থেকে ১৫ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। পরের ১০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্ত বাজার নীতির পর নির্মাণ প্রবৃদ্ধির সময় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গাছ নিধন করা হয়েছে।
এর পরের দশকে মহাখালী ও খিলগাঁও উড়ালসড়কসহ বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কারণে কাটা হয়েছে আরও অন্তত ৪০ হাজার গাছ।
তবে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত উত্তরা, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে।
এরপর ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে ৫ থেকে ৮ হাজার গাছ কমেছে ঢাকার। বনায়ন নীতি থাকলেও নির্মাণ চলমান থাকায় গাছের পরিমাণ কমেই চলেছে।
এসিতে কেউ পাচ্ছেন ঠান্ডা হাওয়া, কেউ পুড়ছেন গরমে
একসময় কেবল ধনী মানুষের বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হত এসি। কিন্তু এখন ঢাকার তীব্র গরমে এটি একপ্রকার প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে এসির ব্যবহার বাড়ছে, এতে যে শুধু তাপমাত্রাই বাড়ছে না, এটি বিদ্যুৎতের চাপ, বায়ুদূষণ ও সামাজিক বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ টেকসই জ্বালানি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকায় এসির সংখ্যা গত ১৫ বছরে চারগুণ বেড়েছে। ২০১০ সালের দেড় লাখ ইউনিট থেকে এটি ২০২৪ সালে সাড়ে ৭ লাখে পৌঁছেছে।
আরও পরিষ্কারভাবে বলা হলে, রাজধানীর প্রায় তিনটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে একটি এখন এসির মালিক। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকায় গ্রীষ্মকালে আবাসিক বিদ্যুতের প্রায় ৪০ শতাংশ এসি ব্যবহারেই ব্যয় হয়। ফলে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ বাড়ে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
নগর অধিকারকর্মী ফারুক হোসেন বলেন, ‘ধনীরা এসি চালিয়ে স্বস্তিতে থাকেন, অথচ দরিদ্ররা লোডশেডিং আর অসহনীয় গরমে কষ্ট করে।’ বিশেষ করে বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরনো মডেলের এসিগুলো হাইড্রোফ্লোরোকার্বন গ্যাস ছাড়ে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ঢাকার এই শীতলকরণ প্রবণতা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো (কিগালি সংশোধনী ও প্যারিস চুক্তি) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যবিদ শিরিন কবির বলেন, ‘ঢাকা যদি তার গাছ, পার্ক ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের পথ সংরক্ষণ করত, তাহলে এত বেশি কৃত্রিম শীতলকরণের প্রয়োজন হতো না। আমরা এমন শহর তৈরি করছি, যেটিকে বাসযোগ্য রাখতে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’
বেঁচে থাকার জন্য বনায়ন
ঢাকার পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বনায়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি ইউএনবিকে বলেন, ‘তীব্র গরম, বায়ুদূষণ ও দ্রুত সবুজ হারানো প্রতিরোধে ঢাকার জন্য পুনরায় বনায়ন অপরিহার্য। ঢাকায় বনায়ন এখন শুধু পরিবেশগত চাহিদা নয়, এটি টিকে থাকার কৌশল। শহরটি দ্রুত তার সবুজ আচ্ছাদন হারাচ্ছে, আর সঙ্গে হারাচ্ছে পরিষ্কার বাতাস, ছায়া ও জীববৈচিত্র্য।’
এ কারণে তিনি মিশন গ্রিন বাংলাদেশের মাধ্যমে গ্রিন ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম শুরু করেছেন বলে জানান। সেখানে তরুণদের সরাসরি শহরকে সবুজ করায় যুক্ত করার আশাও প্রকাশ করেন তিনি।
এই তরুণ পরিবেশকর্মী আরও জানান, তারা গাছ লাগানোর অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, সচেতনতা কার্যক্রম চালান এবং ছোট শহুরে বনও তৈরি করে থাকেন। যেমন: ৫৫টি কদমগাছ নিয়ে গড়া ‘কদমতলা ইনিশিয়েটিভ’।
তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য পরিবেশগত কাজকে সহজলভ্য, হাতে-কলমে ও সমাজভিত্তিক করে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, আজ আমরা যে গাছ লাগাচ্ছি, তা আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকার প্রতিশ্রুতি।’
সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর সৌজন্যেও একাধিক বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এক লাখের বেশি চারা রোপণ করা হয়েছে এই শহরে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভাঙচুর, অবহেলা বা অনুপযুক্ত (বিদেশি বা দুর্বল মূলবিশিষ্ট) প্রজাতির গাছের চারা ব্যবহারের কারণে এগুলোর অন্তত ৩০ শতাংশ প্রথম বছরেই মারা গেছে।
ভূমিকা: সমুদ্র বলছে – আমরা কি শুনছি?
ভারতের মহাসাগরের নীল জলরাশির নিচে চলছে এমন এক সংকট যা কোনো একটি দেশের একার নয়—এটি বৈশ্বিক। প্রবাল প্রাচীরগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, দুর্লভ সামুদ্রিক প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির পথে, কিন্তু এই সমুদ্রের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মানুষের শোরগোলে। এমন এক সংকটময় সময়েই আমি সুযোগ পেয়েছি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার, তাও সম্পূর্ণভাবে অর্থায়িত প্রতিনিধি হিসেবে, মালদ্বীপের মাফুশি দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সাল ইয়ুথ লিডারশিপ সামিট (UYLS) ২০২৫-এ।
এই সামিটের আয়োজন করে ইউনিভার্সাল ইয়ুথ মুভমেন্ট (UYM), যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ নেতৃত্ব একত্রিত হয়েছিল—উদ্দেশ্য ছিল আমাদের গ্রহের প্রধান সংকটগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর সমাধান বের করা। আমাদের দলের প্রেজেন্টেশন ছিল:
‘আমাদের সাগর বাঁচান: বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী’।
এটি কেবল একটি সম্মেলন ছিল না—এটি ছিল এক জাগরণ, একটি বার্তা, যেখানে পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের নেতৃত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। আমার জন্য, এটি ছিল জীবনের অন্যতম গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।
সংকট: বিপন্নতার মুখে সাগরের অভিভাবক–সামুদ্রিক কচ্ছপ: সাগরের অতল গহ্বরে, প্রাগৈতিহাসিক এক প্রাণী—সামুদ্রিক কচ্ছপ, যেটি গত দশ লক্ষ বছর ধরে টিকে রয়েছে, আজ মানুষের লোভ ও দায়িত্বহীনতার কারণে বিলুপ্তির পথে। আমাদের কল্পিত দেশের প্রকৃত অবস্থা বর্তমান পৃথিবীর বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমরা দেখেছি কীভাবে পাচার ও বেআইনি শিকারের ফলে কচ্ছপের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, নির্মাণ কাজ ও পর্যটনের চাপে ধ্বংস হচ্ছে কচ্ছপের ডিম পাড়ার উপকূল ,প্লাস্টিক দূষণ ও সামুদ্রিক বর্জ্যতে মৃত্যু ঘটছে প্রজাতিগুলোর, বাণিজ্যিক জাল ব্যবহারে কচ্ছপেরা হয়ে যাচ্ছে অনিচ্ছাকৃত শিকার। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম—এটি কেবল একটি দলীয় অ্যাসাইনমেন্ট নয়, বরং বাস্তব জীবনের সংকট যার সমাধান আজ জরুরি।
আমাদের ভূমিকা: একটি জাতিসংঘ ভিত্তিক প্রেস কনফারেন্সের রূপে উপস্থাপনা: আমাদের দল একটি জাতিসংঘভিত্তিক সংবাদ সম্মেলনের আদলে উপস্থাপন করেছিল। আমি অভিনয় করেছিলাম সরকারের পরিবেশ সংক্রান্ত আইন উপদেষ্টা হিসেবে। আমাদের দলে ছিল: সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, পরিবেশ NGO-র প্রতিনিধি, মিডিয়া সাংবাদিক, পরিবেশমন্ত্রী, স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি । আমরা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম এবং তুলে ধরেছিলাম বহুমাত্রিক সমাধান।
স্বল্পমেয়াদি সমাধান: প্লাস্টিক বর্জ্য নিষিদ্ধকরণ, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা চিহ্নিতকরণ, উপকূলীয় উন্নয়ন স্থগিত রাখা ডিম পাড়ার মৌসুমে, কচ্ছপ উদ্ধার হেল্পলাইন চালু করা, জেলেদের সচেতনতা বাড়ানো ও বিকল্প টেকনোলজি দেওয়া।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন, পাঠ্যসূচিতে সমুদ্র শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কচ্ছপ পর্যবেক্ষণ, ইকো-ট্যুরিজম প্রচার, আন্তঃদেশীয় চুক্তি ও সমুদ্র সংরক্ষণ সহযোগিতা।
আমার আইনজীবী পরিচয় আমাকে সাহায্য করেছিল বাস্তব সম্মত ও কার্যকর নীতিমালা উপস্থাপন করতে। আমরা বুঝাতে পেরেছিলাম—পরিবেশ সংরক্ষণ কোনো স্বপ্ন নয়, এটি বাস্তবায়নযোগ্য একটি নৈতিক দায়িত্ব।
মালদ্বীপের শিক্ষা: স্বর্গপৃথিবীও ঝুঁকিতে: সামিটের ভেন্যু মালদ্বীপ ছিল এক জীবন্ত শিক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশটি ইতোমধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংস, সমুদ্রদূষণ, এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন—সব মিলিয়ে এখানকার সামুদ্রিক প্রাণীরা আজ বিপন্ন।সাগরপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল—এই দ্বীপ কি একদিন কেবল মানচিত্রে বেঁচে থাকবে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আমাদের সাগরের গল্পও কি আলাদা?
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরও একই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমরা যেমন ভোগ করছি প্লাস্টিক দূষণ, তেল নিঃসরণ, বর্জ্য ব্যবস্থার অভাব, তেমনি ভোগ করছি অজ্ঞতা ও দায়িত্বহীনতার খেসারত। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী মানুষরাও জানে না তারা কী হারাতে বসেছে। আমার লক্ষ্য এখন এই শিখন কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সচেতনতামূলক প্রকল্প শুরু করা, যেখানে স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমুদ্র সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করব।
ভবিষ্যতের রূপরেখা: আইন, শিক্ষা এবং সচেতনতার মিলনস্থল
একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে শক্তিশালী আইন এবং স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা মিলেই হতে পারে স্থায়ী সমাধানের চাবিকাঠি। আমি একটি প্রকল্প চালু করতে চাই—‘কমিউনিটি ওশান স্কুল’, যেখানে মোবাইল ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে: সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষা, প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা, মাছ ধরার নিরাপদ পদ্ধতি, পরিবেশ-সম্পর্কিত আইনি অধিকার । এই স্কুল হবে সচেতনতা তৈরির কেন্দ্র, আইনগত সহায়তার সেতুবন্ধন, এবং সমাজের একটি জাগরণ কেন্দ্র।
সমাপ্তি: আমরা না বাঁচালে, কে বাঁচাবে?
আজকের তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান—আমাদের কণ্ঠই হোক প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষাকবচ। সমুদ্রের গভীরতা যতই গভীর হোক না কেন, আমাদের দায়বদ্ধতা যেন হয় ততটাই অটল। আমরা যেন সেই প্রজন্ম না হই যারা কেবল বিবৃতি দিয়েছে—কিন্তু কিছু করেনি। আমরা যেন হই সেই প্রজন্ম যারা গর্জে উঠেছে, দাঁড়িয়েছে, এবং প্রভাব ফেলেছে।
লেখক: যুব নেতৃত্ব প্রশিক্ষক ও অ্যাডভোকেট
ঢাকার বায়ুদূষণ, কার্বন নিঃসরণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: টেকসই উন্নয়নের পথে অদৃশ্য বাধা
ঢাকার একটি ব্যস্ত সকাল। হাজারো মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছে, বাস-রিকশা-প্রাইভেটকার-ট্রাক- সব চলছে নিজের ছন্দে। কিন্তু সেই ছন্দের মাঝেই বাতাসে মিশছে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর ভার। রাস্তায় দাঁড়ানো মাত্র চোখে জ্বালা, গলায় খুসখুসে কাশি, আর মনে হয় যেন ফুসফুসে ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে। আমরা যত উন্নয়নের গল্প শুনি, ঢাকার বাতাস ঠিক ততটাই নীরবে বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এই শহরের রাস্তার কালো ধোঁয়া, ধুলাবালি, অতিরিক্ত কার্বন ইমিশন এখন কেবল পরিবেশগত ইস্যু নয়—এটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম বড় বাধা।
Bangladesh Air Quality Index(AQI) ২০২৪-এর তথ্য বলছে, ঢাকার বাতাসে PM2.5 এর গড় মাত্রা ৭৮ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার—যা WHO গাইডলাইনের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ৫ µg/m³ কে নিরাপদ বললেও ঢাকার বাস্তবতা এর বহু গুণ বেশি। যানবাহনের ইঞ্জিন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস। এগুলো শুধু বায়ু দূষণই নয়, বরং মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দূষিত বাতাস এখন সারা বিশ্বের মানুষের জন্য চতুর্থ প্রধান মৃত্যুঝুঁকির কারণ। আর ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এ ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। শিশুদের মধ্যে হাঁপানি, বয়স্কদের হৃদরোগ এবং কর্মজীবী মানুষের প্রোডাক্টিভিটি হ্রাস—সবকিছু এই দূষণের ফল।
Air Quality Life Index অনুযায়ী, শুধু বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৬.৮ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রিপোর্ট বলছে, বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে বাংলাদেশের GDP প্রতিবছর ৩.৯–৪.৪% পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়।এই তথ্যগুলো কেবল সংখ্যাই নয়—এর মানে হলো, দূষণের কারণে আমাদের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে, মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুদূষণের মূল উৎস হলো: পুরনো ডিজেলচালিত যানবাহন, ট্রাফিক জ্যাম, নির্মাণসাইটের খোলা ধুলাবালি এবং দুর্বল নগর ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ১৫% হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিলেও, রাজধানী প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কার্বন ইমিশন করছে।
আমাদের সমাধান অবশ্যই সম্ভব। প্রথমত, পরিবহন খাতে সংস্কার আনতে হবে। পুরনো ডিজেলচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ করতে হবে। সিএনজি ও ইলেকট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং গণপরিবহনকে জনবান্ধব করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ কার্যক্রমে পরিবেশগত নিয়ম মানা নিশ্চিত করতে হবে। খোলা বালি ও সিমেন্ট ঢেকে রাখা, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, এবং নির্মাণসাইট বেষ্টনীর ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তৃতীয়ত, নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে গাড়ি ব্যবহারে সংযম, মাস্ক পরা এবং গাছ লাগানোর মতো ছোট ছোট অভ্যাসগুলো পরিবেশ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। সরকারের পক্ষ থেকে Air Pollution Control Rules 2022 কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং ফিটনেস পরীক্ষার কঠোরতা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি।
এই শহরের বাতাস আমাদের সন্তানদের ফুসফুসে যাচ্ছে—এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন সেই উন্নয়নের ভেতরেই থাকবে মানুষ, স্বাস্থ্য, এবং পরিবেশের ভারসাম্য। আর শুদ্ধ বাতাসের চেয়ে বড় কোনো মৌলিক অধিকার হতে পারে না। ঢাকার রাস্তায় গাড়ির কালো ধোঁয়া, ধুলাবালি আর কার্বন ইমিশনের ছায়া থেকে শহরকে বাঁচাতে হলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই । ঢাকা বাঁচলে আমরা বাঁচব। বাতাস বিশুদ্ধ হলে, ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল।
লেখক: পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
সাংবাদিকতা এক সময় ছিল সমাজ বদলের একটি মহৎ হাতিয়ার। কলম ছিল প্রতিবাদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই ছিল সাংবাদিকতা- ভয়ডরহীন, অনুসন্ধানী, দায়িত্বশীল। অথচ আজকের বাস্তবতা এতটাই ভিন্ন, যেন আমরা এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি। কলমের কালি মুছে গিয়ে, জায়গা করে নিয়েছে ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার, টিকটক ফলোয়ার আর লাইভ ভিডিওর নাটক।
আজকাল সাংবাদিকতার চেহারা অনেকটা পলিথিনে মোড়ানো আমের শরবতের মতো- দেখতে চকচকে; কিন্তু গন্ধেই ধরা পড়ে আসল নকল। সাংবাদিকের সংজ্ঞা যেন কেউ আর বুঝতেই চায় না। যার হাতে ক্যামেরা, যার গলায় কার্ড- সে-ই সাংবাদিক! কেউ যদি বলে, ‘আমি মিডিয়া’- তাহলেই তার বিশেষাধিকার! পুলিশ থেমে যায়, ট্রাফিক হ্যান্ডস্যালুট দেয়, আর গ্রামের মানুষ তাকে ভক্তিভরে ‘স্যার’ ডাকে।
আজকাল একজন মানুষ সকালে জুতা বিক্রি করে, বিকালে বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে গলা ফাটিয়ে বলে, ‘লাইভ চলছে’! আর রাতে ‘জেলা প্রতিনিধি’ নাম দিয়ে ফেসবুকে নিউজ শেয়ার করে। যিনি কাল পর্যন্ত চায়ের দোকানে কাজ করতেন, আজ তার পকেটে ঝুলছে একটি রঙিন প্রেস কার্ড। কে বানাল? কীভাবে পেল? প্রশ্ন তোলার সাহস কই? সাংবাদিকতার নামে এই মঞ্চে আজ অনেকেই অভিনয় করছেন এমন এক চরিত্রে, যার পেছনে আছে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং, দলীয় প্রভাব, আর অপসংস্কৃতির বীজ।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রাজশাহী থেকে রাঙামাটি- যেদিকে তাকাই, সেদিকেই তথাকথিত ‘মিডিয়া অফিস’। চায়ের দোকান, বিউটি পার্লার, মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের পাশেই ঝোলানো ব্যানার- ‘অফিস অব দি ক্রাইম রিপোর্টার, জেলা প্রতিনিধি: জনাব নিজাম সাহেব’! কে তাকে নিয়োগ দিল? সে কোন পত্রিকায় কাজ করে? এগুলোর জবাব নেই, প্রয়োজনও নেই। দরকার শুধু কার্ড, ক্যামেরা আর গলা ফাটানো কিছু সংলাপ।
আর এসব কার্ডের উৎস? এক শ্রেণির তথাকথিত ‘মিডিয়া মালিক’। যাদের কাছে সাংবাদিকতা ব্যবসা, সম্মান নয়। তারা প্রেস কার্ড বিক্রি করেন ঈদের অফারের মতো- ‘প্যাকেজ নিন, পদ পান!’ টাকা যত বেশি, পদ তত বড়- ইনভেস্টিগেটিভ চিফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, চিফ এডিটর, এমনকি প্রেসিডেন্ট অব নিউজ। বানান ভুল থাকলেও চলে, কারণ কার্ড দেখে কেউ বানান মিলিয়ে দেখে না!
এই কার্ডযুদ্ধের ফলে অনেক প্রকৃত সাংবাদিক আজ বিব্রত। যারা জীবন উৎসর্গ করেন ফ্যাক্ট চেকিং, তথ্য সংগ্রহ, রাতজাগা রিপোর্ট তৈরিতে, তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে কিছু ‘স্মার্ট ফোন হিরো’। তারা বড় বড় অফিসারদের হুমকি দিয়ে, ভিডিও করে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এক দুঃখজনক ঘটনা মনে পড়ে- এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেক সাংবাদিকদের ‘চাঁদাবাজি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, উল্টো তার বিরুদ্ধেই বানোয়াট নিউজ ছড়িয়ে পড়ল। প্রশ্ন একটাই, এদের রুখবে কে?
এটা শুধু কিছু ছদ্ম সাংবাদিকের সমস্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং সর্বোপরি পাঠকের নীরবতা। একজন সাংবাদিকের প্রধান শক্তি হওয়া উচিত নৈতিকতা, তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং জনস্বার্থে কাজ করার সংকল্প। অথচ এখন সাংবাদিকতা যেন এক খোলা বাজার- যেখানে মরিচা ধরা বিবেক আর মিথ্যার চকচকে মোড়কেই মিডিয়া বলা হয়।
অপরাধীরাও এখন সাংবাদিকের খোলস পরে। একজন খুনের আসামি কীভাবে চিফ রিপোর্টার হয়ে যায়? একজন চাঁদাবাজ রাতারাতি ফেসবুকে ‘ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার’ হয়ে কীভাবে থানায় ঢুকে যায়? কিছু মিডিয়ার মালিকরা এসব জানেন, দেখেন, তবু চুপ থাকেন, কারণ তারাও তো ভাগীদার!
আর আসল সাংবাদিকরা? যারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চান, তাদের চাকরি নেই, স্যালারি নেই, সামাজিক স্বীকৃতি নেই। বরং এসব ভুয়া ‘কার্ডবাজদের’ কারণে তারা হন সন্দেহের চোখে দেখা একজন। পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কারণ সাংবাদিক মানেই এখন ‘মিডিয়া’ নয়, অনেকের চোখে চাঁদাবাজ, রাজনৈতিক দালাল কিংবা ভিডিও ভ্লগার।
সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। এই দর্পণ তৈরি করেন সাংবাদিকরা। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সরকার এবং সব দলের পথনির্দেশনা তৈরি করে দেয় সংবাদপত্র। এর কারিগর হলো সাংবাদিক সমাজ। সাংবাদিক সমাজ আজ দ্বিধা বিভক্ত। অপসাংবাদিকদের ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদার আজ ধুলায় ভুলুণ্ঠিত। কেন এমন হচ্ছে?
একজন সাংবাদিক দেশে ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হবেন; সাংবাদিকতায় এটি স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু কী হচ্ছে দেশে? মহান পেশার আদর্শ উদ্দেশ্য উল্টে ফেলা হচ্ছে; সৎ সাংবাদিকদের বিতর্কিত করা হচ্ছে; নানা স্বার্থে সংবাদপত্রকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কারা করছে এসব? আজ কেন সাংবাদিকতা বাণিজ্যের ভিড়ে সংবাদপত্র এবং প্রকৃত সাংবাদিকরা অপসৃয়মাণ? কেন মর্যাদাসম্পন্ন পেশা, মর্যাদা হারাচ্ছে।
কেন শুদ্ধতার মাঝে ঢুকে পড়েছে নাম সর্বস্ব অপসাংবাদিকতা। দুর্নীতি ঢুকে গেছে এ পেশায়। পেশা নয় অসুস্থ ব্যবসা। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতরা অর্থের বিনিময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি; আর সরলতার সুযোগ নিয়ে হরদম প্রতারণা করছে। যা সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
যারা হলুদ সাংবাদিকতা করেন কিংবা ৫০০ টাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ড এনে দাপট দেখান তারা আমার এ লেখার কোথাও কোথাও বেশ মজা পেয়েছে তাই না? এ বিষয়গুলো আপনাদের জন্য নয়। ভুয়া আর হলুদ সাংবাদিকে ভরে গেছে দেশ। এরা সাংবাদিক নয়, সমাজের কীট। এরা মানুষকে ব্লাকমেইলিং করে টুপাইস কামাচ্ছেন বেশ।
এদের কাছ থেকে সবাইকে সাবধান হতে হবে। এদের কারণে, সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা বিষয়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, প্রতারক, ব্লাকমেইলার ও ভীতিকর ব্যক্তি এমন ধারণাই পোষণ করে দেশের গরিষ্ঠ মানুষ।
প্রকৃত সাংবাদিকরা এর কোনোটাই নন। সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। এটা কেবল পেশা নয়, একজন সাংবাদিক এ সেবায় থেকে মানুষকে সেবা দিতে পারেন। দেশের কিছু অসৎ সম্পাদক, সাংবাদিক অর্থের বিনিময়ে সারা দেশে নানা অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র দিয়ে এ পেশার সম্মানহানি করছে। এরা সাংবাদিক নন। সাংবাদিক নামধারী। সমস্যাটা এখানেই। দেশে হরেদরে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহারের সুযোগ আছে। এই সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ আরোপে প্রকৃত সাংবাদিকদের সাহসী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে সাংবাদিক হতে কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না।
হুট করেই সাংবাদিক হয়ে যেতে পারে যে কেউ। না, এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কোনো বিষয় নয়! সুশিক্ষিত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ দেশে অনেকেই আছেন, যারা তাদের ক্ষুরধার ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী দ্বারা সমাজের অনেক অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে আমাদের সমাজ সচেতন করে তোলেন প্রায়ই।
সেই গুটিকয়েক নমস্য সাংবাদিকের সঙ্গে মিশে গেছে সাংবাদিক নামধারী (লেবাসধারী) কিছু নর্দমার কীট; আসলে এরাই বর্তমানে সংখ্যায় বেশি। এসব অপসাংবাদিকতা ইদানীং সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। অপ-সাংবাদিক সৃষ্টি এক ধরনের সাংবাদিকতা নির্যাতন। আমরা চাই, সাংবাদিকতা পেশা যেন আগের সৎ ও নির্ভীক চেহারায় ফিরে আসে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যারা এসব অপসাংবাদিক তৈরি করছে তারা সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যেই তা করছে। এটা কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রও হতে পারে। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রতিহত করতে হবে। নইলে বড্ড বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে এ মহান পেশায়।
সাংবাদিক নামধারী অপসাংবাদিকদের বিষয়ে কিছু না বলে পারছি না। সাংবাদিকতা একটি স্পর্শকাতর পেশা। যে কারও হাতে যেভাবে ছুরি-কাঁচি তুলে দিয়ে অপারেশনের সার্জন বানিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য হয় না, একইভাবে যে কারও হাতে পরিচয়পত্র, কলম-ক্যামেরা-বুম তুলে দিয়ে তাকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের দায়িত্ব দেওয়াটাও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়।
আজকাল মাঠপর্যায়ে গিয়ে এ পেশা সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য অনেকের কাছে শুনতে হয়। আজকের এ নিবন্ধ ধান্দাবাজ, হলুদ সাংবাদিক এবং অপসাংবাদিককে ঘিরে, যারা সাম্প্রতিক কালে এ মহান পেশাকে কলুষিত করে রেখেছেন, অপেশাদার মনোভাব তৈরি করে সাংবাদিকতা-বাণিজ্য চালু করেছেন। এদের রাহুগ্রাস থেকে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের বেরিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। এভাবে চলতে পারে না। চলতে দেওয়া যায় না।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন একটাই: কে ফিরিয়ে আনবে সত্যিকারের সাংবাদিকতা? তথ্য মন্ত্রণালয়? প্রেস কাউন্সিল? নাকি সেই পাঠক, যিনি মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু হৃদয়ে এখনো সত্য আর মর্যাদার জন্য অপেক্ষা করেন? সময় এসেছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা পুনর্গঠনের। সময় এসেছে বলার: সাংবাদিকতা কার্ডে নয়, চরিত্রে। মিডিয়া অফিসে নয়, মানুষের আস্থায়।
আসুন, আমরা সেই সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াই, যারা আজও নীরবে সত্যের পক্ষে কলম চালান। যাদের হাতে আজও অন্ধকারে আলো জ্বালানোর সাহস আছে। না হলে খুব শিগগিরই হয়তো হেডলাইন হবে:
‘প্রেস কার্ডসহ ডাকাত গ্রেপ্তার!’
মীর আব্দুল আলীম
সমাজ গবেষক
মহাসচিব – কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের জন্য ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেন। তিনি আরও ঘোষণা দিলেন সংস্কার শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণকে গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দেবেন। জাতি আশাবাদী হয়ে দিন গুনছিল সংস্কারে পরিশুদ্ধ একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখার; কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক প্রতিটি রাজনৈতিক দল- যারা জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বলে নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখে এবং দল নিরপেক্ষ জনগণ যারা একটি নিরপক্ষে, সুন্দর নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছিল তাদের মধ্যে সংস্কার আর নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ভিন্নমত মাথাচাড়া দেওয়ায় বহুবছর ধরে ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত সাধারণ জনগণ এখন হতাশ। কেন এমনটি হলো?
একজন রাজনীতি বিশ্লেষক হিসেবে নয়, একজন দল নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আমার একটা উত্তর এখানে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম। আমরা যদি দলীয় ভাবাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপক্ষেভাবে চিন্তা করি তাহলে আমার মতামতের সঙ্গে অনেকের বিবেকের ভাবনাটা মিলেও যেতে পারে।
জুলাই আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে যারা এখন সরব বা নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন তারাই মূলত সংস্কার ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান অন্তরায়। তারা দল তৈরি, দল পুনর্গঠন ও নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে এতই ব্যস্ততায় নিমজ্জিত আছেন, বাস্তবতার দিকে নজর রাখার সময় কিংবা আগ্রহ তাদের নেই। জুলাই চেতনার পক্ষধারী একপক্ষ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে অনড় কিন্তু প্রার্থিতা নিয়ে এখনো মাাঠে নামেননি পক্ষান্তরে আরেক পক্ষ সংস্কার ও শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন নয় বলে মাঠ কাঁপালেও প্রকাশ্যেই তারা সারা দেশে প্রার্থিতা ঘোষণা করছেন এবং তলে তলে বিভিন্ন জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই হচ্ছে গণতন্ত্রের পথে আমাদের যাত্রার বর্তমান বাস্তবতা।
জনগণ কি এই বাস্তবতা দেখার জন্য জুলাই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল? এক বাক্যে যদি বলি তা হলে সবাই বলবেন না। জুলাই আন্দোলনের পটভূমি যাই হোক শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের মুখে সেটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীদের ও মাস্টারমাইন্ডদের মনে হলো এই রাষ্ট্রযন্ত্রেও এ ধারা ও নিয়মকানুন প্রচলিত থাকলে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিস্ট বারবার পয়দা হবে। তাই তারা প্রতিটি স্তরে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন এবং সংস্কার দাবি করলেন। সমগ্র জাতি ভালো করে জানে বিরোধী দলগুলো ১৬ বছরেও আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কাজেই হাসিনার অপকর্ম বা অপশাসনের দায় তাদের ওপরও বর্তায়। বিষয়টি তারা ভালোভাবেই জানেন এবং বোঝেন বলেই অতিদ্রুত এবং সুকৌশলে তারা সরকার পতনের বিজয় মিছিলে ঢুকে যায় এবং নানার রকম সমর্থন আর যুক্তি দাঁড় করিয়ে এই আন্দোলনের ফসল নিজ নিজ ঘরে তোলার অপ্রিয় খেলায় মেতে ওঠে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সমন্বককারীদের মাথায় তুলে নেয় এবং সংস্কারের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করে। এই পর্যন্ত জুলাই চেতনা বিশ্বাসীদের ঐক্যে কোনো ফাটল ছিল না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ চিরায়ত কায়দায় জড়িয়ে গিয়ে ক্ষমতার স্বাদকে চিরস্থায়ী করতে রাজনৈতিক দল গঠন করে পুরোনো কায়দায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন। এই প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের প্রধান শক্তিরা অপরাপর রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল চিরায়ত মতবিরোধ- কখনো আদর্শগত, কখনো ক্ষমতার। সরকার পতনের পর জাতির ভেতর যে মিলনের সুর বেজে উঠেছিল তার রেশ শেষ হতে আর বেশি সময় লাগল না। আশাহত হলো সাধারণ জনগণ। যাদের একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছিল।
তাহলে গণতন্ত্রের পথে আমাদের নতুন অভিযাত্রা কি থেমে যাবে? না, কোনো সুযোগ নেই। কারোর ভুলের জন্য এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা হবে আত্মঘাতী। এমতাবস্থায় সরকার, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণকে ভেদাভেদ ও দলীয় সংকীর্ণতা উপেক্ষা করে আজকের অনৈক্য ও বিবদমান পরিস্থিতির গভীর পর্যালোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সঠিক সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। আমার বিবেচনায় সমস্যাগুলো দেশকেন্দ্রিক না হয়ে সংস্কার, নির্বাচন বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যা অনেক রক্তের বিনিময়ে তৈরি হওয়া জাতীয় ঐক্যকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে।
আগেই বলেছি জুলাই বিপ্লব শুধু ক্ষমতার হাতবদলের জন্য সংঘটিত হয়নি। ক্ষমতার পালাবদলের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু যে নির্বাচনী ব্যবস্থা বা সরকারি বিধিমালা একটা সরকারকে স্বৈরাচারী বা বিপথগামী করতে বাধ্য করে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তার আমূল পরিবর্তন বা সংস্কার। ছাত্র-জনতার চাওয়া এবং সরকারের সদিচ্ছা তেমনি ছিল দেখে জনগণ আশান্বিত হয়েছিল; কিন্তু অন্য একটি বড় রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকরা সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে ইস্যু তৈরির সুযোগ নিয়ে মাঠ গরম করা শুরু করলেন। তাদের বক্তব্য ও মতামতের যথেষ্ট যুক্তি আছে। তারা বলছেন বা আমরা বিশ্বাস করি সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। সময় ও চাহিদার আলোকে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। অতএব, নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের সরলরেখা টানাটা জরুরি নয়। তবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে, জনগণকে স্বাধীনভাবে, প্রভাবমুক্ত পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রেও যে জায়গাগুলো ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন বা বিজয়ী দলগুলো অনিয়ম আর দুর্নীতির আশ্রয় নেয় সেই জায়গাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পক্ষে বিশ্লেষকরা মনে করে থাকেন।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেই মাঠ-ঘাট-বাজার-জমি দখল ও চাদাঁবাজির দৌরাত্ম্যে কোনো পরিবর্তন জনগণ দেখছে না। নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত নতুন রাজনৈতিক দলের নেতারা চিরায়ত ভঙ্গিমায় মোটরসাইকেল ও গাড়ি বহর নিয়ে এলাকায় শোডাউন করছে। ধর্ষণ, খুন, ছিনতাই বুদ্ধির পাশাপাশি বাজার সিন্ডিকেট পুরোনো ধারায় বেশ সক্রিয়।
উপরোক্ত বিষয়গুলো আমজনতার সামনে এবং জুলাই চেতনাধারী সব ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সামনে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হওয়ায় সরকারের সঙ্গে একটা দূরত্ব ও দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যর সুর ক্রমশ বাড়ছে। আমরা মনে করি নির্বাচন বা সংস্কার যেটাই হউক সবার আগে সরকার ও তার সমর্থক সব দলের মধ্যে চিন্তায়, কার্যকলাপ ও আচরণের মধ্যে পতিত মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আগে যা ঘটেছে তা যদি জনস্বার্থবিরোধী হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ওই কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না। সোজা বাংলায় জনগণ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অতীতের ঠিক উল্টোটা দেখতে চায়। পুরোনো ধারায় যে অনিয়মগুলো এখনো দৃশ্যমান তা থেকে জনগণকে যদি মুক্তি দেওয়া যায় তাহলে সরকারের প্রতি এবং নতুন বন্দোবস্তের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। আর তখনি নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে- এ বিতর্কের এবং এ ইস্যুতে ঐক্যের জায়গাটাও তৈরি হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স ৮ মাস অতিক্রম হয়েছে; কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ও দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে যদি সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা করে তাহলে ব্যাপক জনসমর্থন তাকে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে দ্বিধাহীন শক্তি জোগাবে। তাই নির্বাচন ও সংস্কার দুটোকেই মাথায় রেখে সবাইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে জনগণের মৌলিক প্রত্যাশার দিকে। বহুবছর ধরে একটা সঠিক গণতন্ত্রহীন পরিবেশ থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়াটা যেমন সর্বাগ্রে প্রয়োজন, তেমনি উপড়ানো দরকার সরকারের সব কালাকানুন এবং পতিত মানসিকতার চর্চা। জাতি উন্মুখ হয়ে আছে একটি গণমুখী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও গণতন্ত্রের সুবাতাস আশ্বাদনের জন্য। আমাদের কাদা ছোড়াছুড়িতে রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লবের আশা-আকাঙ্ক্ষার যেন অপমৃত্যু না হয় সেদিকে সচেতন ও সতর্ক থাকার দায়িত্ব সবার। সুশাসন আর গণতন্ত্রের পথে আমাদের অভিযাত্রা সংকটমুক্ত হোক- জাতির প্রত্যাশা এখন সেটাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য