সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন দেশের সাংবাদিকরা, তথা পুরো গণমাধ্যম। সমালোচনার তিরবিদ্ধ করছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত এই খাতকে। যে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, তাদের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। যে গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় ও অনিয়ম অনুসন্ধান করে বের করে আনেন, তাদের কর্মকাণ্ডই এখন প্রশ্নের মুখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে মনে হবে, রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষই বুঝি এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। আসলে কি তাই? সাংবাদিকরা কি সবার প্রতিপক্ষ?
ঘটনার সূত্রপাত দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ‘বান্ধবী’র মৃত্যু নিয়ে। বলা হচ্ছে, এটি আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু সমালোচনার সূত্রপাত এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার নিয়ে।
সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠেই বলা আছে যে, ভিকটিমের ছবি প্রকাশ করা যাবে না। প্রয়োজন হলে ছবি ব্লার বা ঝাপসা করে দিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা গেল উলটো কাণ্ড। দেশের দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিকটিম তরুণীর ছবিটা স্পষ্ট থাকলেও অভিযুক্তর ছবিটা ব্লার। যা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পুরো সাংবাদিকতাকে। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাকে। এরপর শুরু হয় ওই এমডির বান্ধবীর বিরুদ্ধে কথিত অসুন্ধানী সাংবাদিকতা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ চ্যানেলের অনলাইনের কয়েকটি শিরোনাম এরকম: ১. মুনিয়ার চার প্রেমিক! ২. লাখ টাকার ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তরুণী, ৩. অভিনেতা বাপ্পীর সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল মুনিয়ার, ৪. মুনিয়ার ডায়েরিতে কী আছে? ৫. উনি আমাকে ভোগ করেছেন, বিয়ে করবেন না, ৬. মুনিয়ার মৃত্যু, অডিও ক্লিপ ভাইরাল। কদিন পরে এই দৌড়ে নামে কয়েকটি সংবাদপত্রও— যার মধ্যে দুয়েকটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রও রয়েছে।
গণমাধ্যমের একরকম আচরণের তীব্র সমালোচনা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। শুধু অ্যাকাডেমিক সমালোচনা নয়, অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং সামগ্রিকভাবে পুরো সাংবাদিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। সাংবাদিকদের প্রতি যারা নানা কারণে বিরূপ, তারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষোদ্গারের এই সুযোগটি কাজে লাগান।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা কতটা জিম্মি— এই ঘটনায় সেটি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এটা বোঝানো সম্ভব নয় যে, সাংবাদিকদের কতগুলো পক্ষের সঙ্গে আপস বা লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। এসব পক্ষের মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক, বিজ্ঞাপনদাতা বড় বড় প্রতিষ্ঠান, সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, উগ্রবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত সাংবাদিকদেরই বিভিন্ন সংগঠন। ফলে যখনই কোনো একটি সংবাদ কোনো গোষ্ঠীর বিপক্ষে যায়, তারাই গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করে এবং ব্যবস্থা নিতে উদ্যত হয়।
সেটি কখনও বিজ্ঞাপন বন্ধ করে; কখনও সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে; কখনও রিপোর্টারকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে; কখনও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে দিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে; কখনও মোটা অংকের পয়সা দিয়ে সাংবাদিকদের কিনে নিয়ে; এমনকি কখনও নিবন্ধন বাতিল বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে।
পৃথিবীর আর কোনো পেশার মানুষকে এতগুলো পক্ষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় না। অথচ এই পক্ষগুলোই গণমাধ্যমের মূল অংশীজন বা স্টেকহোল্ডার। কিন্তু অনেক সময়ই এসব অংশীজন প্রতিপক্ষে পরিণত হয় এবং গণমাধ্যমকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। তার ওপর সাংবাদিকদের বিরাট অংশেরই চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পেশাদারত্ব গড়ে ওঠেনি। সুতরাং, এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় যে গোষ্ঠীকে, তাদের কাছ থেকে সব সময় নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা কতটুকু সমীচীন—তাও ভেবে দেখা দরকার।
এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যম সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই পরিবেশন করবে, মানুষের এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু গণমাধ্যম সব সময় সেটি পারে না। আবার সব সংবাদেরই যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষ আছে, ফলে একটি খবর যখন কারও পক্ষে যায়, সেটি কারও বিপক্ষেও যেতে পারে। যখনই কারও বিপক্ষে যায়, তখনই তিনি গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিও মুহূর্তেই গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবা শুরু করতে পারেন, যদি তার স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ পরিবেশিত হয়।
ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে নারায়ণগঞ্জের মৌচাক, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় বেশ কজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন। টেলিভিশনের গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, একজন রিপোর্টারের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে ‘কলেমা’ পাঠ করানো হয়েছে বলেও গণমাধ্যমের খবর বেরিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের দাবি, গণমাধ্যম ‘সঠিক সংবাদ’ প্রচার করে না, তাই এই আক্রমণ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত সাংবাদিকরা বলেছেন, ‘ছবি তুলবি না’ বলেই তাদের ওপর হামলা করা হয়। তবে শুধু হেফাজতে ইসলামই নয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও। তার মানে হলো, কোনো একটি পক্ষ যখন সাংবাদিকদের কারণে নিজেদের অন্যায় কাজটি অবাধে করতে পারে না বা করলেও সেটি সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তখনই তারা সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ ভাবে। এখানে লড়াইটা তখন আর সাংবাদিক বনাম হামলাকারী নয়- বরং লড়াইটা যখন সাদা-কালোর, লড়াইটা তখন শুভ-অশুভর।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালে সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে বেশ কজন সাংবাদিক নির্মম মারধরের শিকার হন। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় হেলমেটপরা একদল লোক। তাদের কারো কারো পরিচয়ও তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ, ধানমন্ডি ২ নম্বর ও জিগাতলা এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। কারো কারো ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। হুমকি-ধমকি দিয়ে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার পাশাপাশি ছবি তুললে পেটানো হবে বলে শাসানো হয়।
সবশেষ নোয়াখালীতে এক সাংবাদিক খুন হয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কাদের মির্জার ‘মিথ্যাচারের’ প্রতিবাদে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি বিকেল পাঁচটায় বাজারসংলগ্ন তার বাড়ি থেকে বের হয়ে চাপরাশিরহাট মধ্যম বাজারে গেলে কাদের মির্জার অনুসারীরা মিছিলে হামলা চালায়। এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলি চলাকালে কর্তব্যরত দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার নোয়াখালী প্রতিনিধি বুরহান উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। পরের দিন রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এখানে সাংবাদিক কারও প্রতিপক্ষ ছিলেন না। কিন্তু দুপক্ষের রেষারেষিতে প্রাণ গেছে। অর্থাৎ সাংবাদিকরা একদিকে নানা গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ, অন্যদিকে বিবদমান গোষ্ঠীর ক্রসফায়ারেও পড়েন। কিন্তু এ যাবত যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তার বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।
যে সাংবাদিকরা সব অন্যায়ের বিচারের কথা লেখেন, সেই সাংবাদিকদের নিহত হওয়া বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও তাদের পাশে কেউ থাকে না। বরং সুযোগ পেলেই গালাগালি আর বিষোদ্গারের ডালি খুলে বসে। যে সাংবাদিকরা পোশাক ও পরিবহন শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষের বেতন বৈষম্য ও মানবাধিকারের কথা লেখেন, প্রচার করেন, সেই সাংবাদিকদের নিজেদের বেতনের দাবিতেই রাজপথে দাঁড়াতে হয়। তাদের পাশে অন্য পেশার মানুষ এসে দাঁড়ায় না। যার সবশেষ উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ। নিয়মিত বিরতিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সবশেষ মাসের বেতনও অনেকে পান না। কিন্তু এসব বঞ্চনার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়।
সাংবাদিকরা যুগে যুগেই ক্ষমতাসীন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের প্রতিপক্ষ হিসেবে আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটা সময় পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সর্বহারা পার্টির লোকদের বড় টার্গেট ছিলেন সাংবাদিকরা। সেই আতঙ্ক কেটে গেলেও এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবে অন্যান্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, যেমন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিকরা মাঝেমধ্যেই আন্দোলনে নামেন।
সাংবাদিকরা তাদের সেই আন্দোলনের খবর দেন। টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। পাটশ্রমিকদের প্রতি সাংবাদিকরা বরাবরই সংবেদনশীল। অথচ এই শ্রমিকরাই সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন বলে অভিযোগ আছে। অপরদিকে শ্রমিকদের অভিযোগ, সাংবাদিকরা তাদের খবর যথাযথভাবে পরিবেশন করেন না। বাস্তবতা হলো, শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় বন্ধু এই সাংবাদিকরাই। কিন্তু শ্রমিকরা তাদেরকেই প্রতিপক্ষ ভাবেন। পরিবহন শ্রমিকরাও মাঝেমধ্যে নানা দাবিতে রাস্তায় নামেন। সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সেই খবর প্রকাশ ও প্রচার করলেও সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে পরিবহন শ্রমিকদের হামলার শিকার হন।
কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে? উত্তর সহজ, যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করেন, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ফলে তিনি অন্যায়টি প্রকাশ ও প্রচার করবেন। অপরাধীদের ভয় এখানেই।
এটা ওপেন সিক্রেট যে, পুলিশ বা অন্য যেকোনো পেশার অসৎ লোকেরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না বা তোয়াজ করে না। ফলে সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়। ক্ষমতাবানরা জানে, তাদের অন্যায় কাজগুলো দেশের মানুষ শুধু এই সাংবাদিকদের কারণেই জানতে পারে। না হলে দেশ বহু আগেই লুটপাট করে খেয়ে ফেলত তারা। কিন্তু যেহেতু তারা এই অবাধ লুটপাট করতে পারে না শুধু গণমাধ্যমের ভয়ে, তাই গণমাধ্যমই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ; শত্রু।
নির্মম বাস্তবতা হলো, একজন রাজনৈতিক নেতা যখন বিপদে পড়েন, তিনি প্রথম ফোনটা করেন তার ঘনিষ্ঠ কোনো সাংবাদিককে। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী- প্রত্যেকেই বিপদে পড়লে প্রথম ফোনটা সাংবাদিককে করেন। তাদের ধারণা বা বিশ্বাস, সাংবাদিকরা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে না পারলেও অন্তত উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন। অথচ এই লোকগুলোই সুযোগ পেলে সকাল-সন্ধ্যায় সাংবাদিকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। কিন্তু সাংবাদিক যখন রাস্তায় মার খান, সাংবাদিককে যখন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা পেটায়, সাংবাদিককে যখন পুলিশ পেটায়, সাংবাদিককে যখন আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনবিরোধীরা পেটায়—তখন সাংবাদিক কাকে ফোন করবে? সাংবাদিক কার কাছে বিচার চাইবে?
মুদ্রার অন্যপিঠও আছে। সাংবাদিকতার নামে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া, করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ভুইফোঁড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা, কথিত অনলাইন টিভি ইত্যাদি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সাংবাদিকতার নামে নানারকম ধান্দাবাজির কারণে পুরো গণমাধ্যমই এখন প্রশ্নের মুখে। যে কারণে যখনই গণমাধ্যমের নেতিবাচক কোনো খবর গণমাধ্যমে আসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়, মানুষের রাগ-ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। যে গণমাধ্যম তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, সেবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়। অনেকে সাংবাদিকদের প্রতি অতীতের কোনো ঘটনায় ক্ষুব্ধ বা ঈর্ষান্বিত থাকলে তিনিও সেই বিষোদ্গার ও গালাগালির মিছিলে শামিল হন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করবেন না যে, এই সীমিত স্বাধীনতা ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমই দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কারণ চারপাশে এত বেশি খারাপ লোকের আধিপত্য যে, তারা কেবল ক্যামেরাগুলোকেই ভয় পায়। না হলে বহু আগেই সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে যেত। যেহেতু সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে হজম করার পথে প্রধান অন্তরায় গণমাধ্যম, অতএব তারাই শত্রু, তারাই প্রতিপক্ষ।
রাষ্ট্রও জানে তার সব কার্যক্রমে নজর রাখে গণমাধ্যম। ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের মতো গণমাধ্যমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে বা মামলা দিয়ে শায়েস্তা করা না গেলেও রাষ্ট্র এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখতে চায়, যাতে গণমাধ্যম নিজেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে এবং সেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে গিয়ে অন্যদিকে নজর দেয়ার সুযোগ না পায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ইলিশের টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং তদনুযায়ী সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (প্রায় ১২%) এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে। শুধু তাই নয়; উপকূলীয় জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এবং উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৬ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালীন এ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বাদুপানির উজানকে। এ সময় ইলিশ দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। প্রজননের উদ্দেশে ইলিশ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উজানে পাড়ি দিতে সক্ষম। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের।
ইলিশ মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুমে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ বছর প্রতি বছরের মতো এবারও বৈশাখের শুরু অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায়, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১২ জুন থেকে সাগরে আবার মাছ আহরণ শুরু করেন জেলেরা, যে সময়টিকে ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বসাধারণ, বিশেষ করে জেলে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও ইলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, আড়তদার, বরফকল মালিক, দাদনদার, ভোক্তাসহ সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। ২০২৫ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে অভিযানে ৩৮টি জেলার ১৭৮টি উপজেলাকে নির্ধারণ করা হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। এর আগে, ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এক হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধুমাত্র ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া। কিন্তু এরপরও ইলিশের দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রপ্তানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রপ্তানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতি বছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ জুন থেকে প্রায় দেড়মাস চাহিদা অনুযায়ী সাগরে ইলিশ ধরা পড়েনি। আবহাওয়াজনিত কারণে সাগর উত্তাল থাকছে প্রায়ই। ফলে মাছ ধরার নৌযানগুলো গভীর সাগরে যেতে পারছে না। কিংবা গেলেও আহরণ কম ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে এসে এ চিত্র পাল্টে গেছে। সপ্তাহজুড়ে নৌকাপ্রতি ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই। বর্তমানে
এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে ১৩৭৫ টাকায়, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আহরণকারীর নৌকা থেকে ইলিশ পৌঁছে আড়তে।, আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১৪০০-১৪৫০ টাকা, ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আড়ত থেকে ইলিশ যায় বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখানে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা ‘অদৃশ্য’ সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই ‘চার হাতের চক্রের’ মধ্যে ঘুরতে থাকে।আবার কিছু কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী ইলিশের বিক্রির নামে প্রতারনার ফাঁদ পেতেছে যা অত্যন্ত দুক্ষ্য জনক ।
একসময় মধ্যবিত্তের নিত্যবাজারে তালিকায় থাকলেও বর্তমানে উপলক্ষের মাছ হয়ে উঠেছে। সময়ের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তের নিত্যখাদ্য অনুষঙ্গ। আর নিম্নবিত্তের কাছে ইলিশ দীর্ঘশ্বাসের অপর নাম, যাদের বছরে একটি উৎসবেও হয়তো খেয়ে দেখা হয় না এক টুকরো ইলিশ। রুপালি ইলিশের কেজিপ্রতি দাম যখন ২৮শ থেকে ৩২শ টাকা, তখন বাঙালি যেন চোখ মেলে প্রশ্ন করে, ইলিশ আসলে কার?, পাবনার তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শহরের কালাচাঁদপাড়ায় নিজ বাড়ির আঙিনায় তিনি আয়োজন করেন ‘গরিবের ইলিশ উৎসব’। এক দিনের এই উৎসবে শতাধিক দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে পরিবেশন করা হয় ইলিশ। এই আয়োজনে শুধু পেট ভরে না; ভরে ইলিশপ্রেমী নিম্নবিত্তের মন। বর্তমান বাস্তবতায় এমন আয়োজন নিছক উৎসব; অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ। এই উদ্যোগ দেখিয়ে দেয়– দায় শুধু রাষ্ট্র বা নীতিনির্ধারকদের নয়; সমাজের সচেতন নাগরিকদেরও।
সরকার প্রতি বছর মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান চালায়; আইন করে জাটকা ধরা বন্ধ রাখে। শূন্য রেখায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে। এর ফলে কিছু বছর ভালো ফলও এসেছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা নেই। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সচেতনতা কম, বিকল্প ব্যবস্থা দুর্বল। দিনে দিনে কমছে ইলিশের উৎপাদন। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে এই ইলিশকে ঢুকিয়ে রাখছে হিমাগারে। বাজারে হাহাকার ফেলে, সিন্ডিকেটের বেড়াজালে বাড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ইলিশের দাম। নদীভিত্তিক জীবিকা চলে যাচ্ছে, আর মানুষ দোষ দিচ্ছে প্রকৃতিকে। এ অঞ্চলে মাছের অর্থনীতি, রাজনীতি এতটাই গভীর যে, একসময় ভারত সরকার যখন বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটাকে কূটনৈতিক মাইলফলক বলে মনে করা হয়। আবার নির্বাচনের আগে বিশেষ রকম সুবিধা পেতে ইলিশ সরবরাহ নিয়েও গুঞ্জন ওঠে রাজনৈতিক মহলে। মাছ যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, সে আর মাছ নেই। আর গরিবের ইলিশ কেবল স্বপ্নেই রয়ে গেল।
লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক
সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন, এখন বাউল শাহ আবদুল করিমের হাতে সোয়া ৩ লাখ টাকার চেক তুলে দেয়া হবে। অনুষ্ঠানের এক পাশে শাহ আবদুল করিম বসে আছেন। ঘোষণা শুনতেই তিনি তার পাশে থাকা ছেলে শাহ নূর জালাল বাবুলকে বললেন- ‘সোয়া ৩ হাজার টাকা! এত টাকা দিয়া আমি কি করমু! এত টাকা আমার লাগবে না।’ পাশ থেকে বলা হলো সোয়া ৩ হাজার টাকা না, সোয়া ৩ লাখ টাকা। শাহ আবদুল করিম এবার টাকার অংক শুনে বলেই ফেললেন, ‘এত টাকা দিয়া আমার কাজ কী? মানুষ আমারে ভালোবাসে এটাই বড়। এই টাকা আমার লাগবো না। এই বাবুল চল, বাড়িত যাই।’ এই নির্লোভ বাউলকে কোনো একদিন দোহারের শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করেছিলেন-‘মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলেন না। এসবে আপনার খারাপ লাগে না? ‘শাহ্ আবদুল করিম জবাবে বললেন- ‘কথা বোঝা গেলেই হইল, আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।’ কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ভীষণ অবাক হলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না!এটা কোন কথা, এটার কোন অর্থ আছে!’ শাহ আবদুল করিম বললেন- ‘তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একজন মানুষ বসে আছে। তুমি কি গান গাইতে পারবে?’ কালীপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন- ‘না, তা আমি পারব না।’ শাহ আবদুল করীম হেসে বললেন- ‘আমি পারব, কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক। কিন্তু সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই, সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি! ‘কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য কৌতুহল বেড়ে গেলো,তিনি জানতে চাইলেন, ‘সেই আদর্শটা কি? বাউল বললেন’ একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে, এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে।’ এই বিখ্যাত মানুষটি যে কতটা নির্লোভী ছিলেন তা এই বাক্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশ হয়েছে। ছিলেন কৃষকের সন্তান, মাঠে ঘাটে রাখাল হিসেব গরু চরাতেন, সেই রাখাল বালক থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাউল সম্রাট। অথচ এত খ্যাতির পরও আজীবন তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। তার মন-ধ্যান, চিন্তা-চেতনায় আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এমনও হয়েছে তার ঘরে খাবার নেই, কিন্তু দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন মেহমান। নিজে না খেয়ে তিনি অতিথি অ্যাপায়নে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। শাহ আব্দুল করিমই বাংলার বাউল সংগীতকে এক অনন্য উচ্চাতায় নিয়ে গেছেন। তার গানে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার পাশাপাশি উঠে এসেছে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিশুদ্ধতার সুর। এই শিল্পী গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। তিনি বাউল গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর মতো গুণিদের কাছ থেকে। কেবল বাউল গান না; শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ সংগীতের বহুরূপ সৃষ্টি হয়েছে তার হাত ধরেই। তার রচিত প্রায় ৫শতাধিক গানের সম্ভারের ২০টির মতো গান ইংরেজি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। এই গুণি মানুষটি হতে পারে আমাদের অহংকারী সমাজের দৃষ্টান্তের প্রতীক, আদর্শের মিনার।
বাংলাদেশের অতি সাম্প্রতিককালের একটি বহুল আলোচিত ও ব্যাপক বিস্তৃত অনুষঙ্গ হচ্ছে মব (mob) বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। মানুষ সারাক্ষণই এ মবের ভয়ে এই ভেবে আতঙ্কে থাকে যে, কখন না কার উপর এটি ভর করে বসে। আর এ ভীতির মাত্রা ইদানীংকালে আরো বিস্তার লাভ করেছে এ কারণে যে, মবের পেছনে আগে কোনো সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও এখন তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সৃষ্টি করা হচ্ছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘চাপ’। তো এই মবের মতো সমান গতিতে বা তারচেয়েও অধিক শক্তিতে চারদিকে এখন দ্রুত বিস্তার লাভ করছে ধর্ষণ। এবং সে ধর্ষণের ঘটনা ইদানীং এতটাই বেড়ে গেছে যে, বিষয়টি এখন আর কেবল উদ্বেগের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই-- উদ্বেগের মাত্রা ছাড়িয়ে তা এরইমধ্যে এক ধরনের আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাসগৃহ থেকে শুরু করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, জনপথ, পর্যটন কেন্দ্র সর্বত্রই এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে উল্লিখিত ধর্ষণের যত সংখ্যক ঘটনার কথা সাধারণ মানুষ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে জানতে পারছে, এক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা তারচেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ এ ভয়াবহতার প্রকৃত মাত্রা দৃশ্যমান বাহ্যিক অবস্থার চেয়েও অনেক বেশি নিষ্ঠুর। বর্তমান অবস্থায় ধর্ষণের যেসব ঘটনার কথা গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে, বস্তুত সেগুলোর ধরন, বৈশিষ্ট্য ও সংখ্যা দেখেই মানুষ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু তারাই জানলে আরো বিস্মিত হবেন যে, এ উভয় মাধ্যমের বিস্তার ও পরিধির বাইরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক জনপদগুলোতে এ জাতীয় বা এরচেয়েও জঘন্য ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিনই আরো অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটে চলছে। কিন্তু লোকলজ্জা, ধর্ষকের সামাজিক প্রভাব, যোগাযোগ অবকাঠামোর পশ্চাৎপদতা ও অন্য নানাবিধ কারণে সেসব জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে না।
উল্লিখিত পরিস্থিতিতে জনসমক্ষে প্রকাশ পাওয়া ও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অর্থাৎ জনসমক্ষে প্রকাশ না পাওয়া-- এ উভয়বিধ ধর্ষণের বিস্তার, এসবের প্রকৃতি ও সম্ভাব্য কারণ নিয়ে এখানে অতি সংক্ষেপে খানিকটা আলোচনা করা হলো। আশা করব, সমস্যাটির ভয়াবহতা বিবেচনায় এবং এর বিস্তার রোধ ও প্রতিহতকরণের উদ্দেশে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে অন্যেরাও এ ধরনের আলোচনায় যুক্ত হবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে হঠাৎ করেই ধর্ষণের ঘটনা এভাবে এতোটা বেড়ে গেল কেন? এর কারণ একাধিক। তবে মূল কারণ অবশ্যই সমাজ ও রাষ্ট্রে বিচার, ন্যায়ের শাসন, রাজনৈতিক স্থিরতা এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতি না থাকা। তদুপরি রয়েছে অর্থনীতির নানা নেতিবাচক অনুষঙ্গ যার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেকারত্ব, প্রয়োজনের তুলনায় আয়ের ঘাটতি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য ইত্যাদি। আর উল্লিখিত এই উভয় শ্রেণির সমস্যা সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার এবং সব বয়নি ও লিঙ্গের মানুষকে স্পর্শ করলেও তা সর্বাধিক সংখ্যায় করছে তরুণদেরকে। আর এই তরুণদের মধ্যে অভাব, বেকারত্ব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতির সমস্যা এতটাই প্রকট যে, সেসব থেকে তাদের ভেতরে যেসব কষ্ট, ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জিভূত আকারে জমা হয়েছে, সেটাই ক্রমান্বয়ে নানা হিংস্রতাপূর্ণ পাশবিক প্রবণতার দিকে ধাবিত হতে হতে বর্তমানের ধর্ষণ বা গণধর্ষণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর তারই এক ধরনের আদিম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অতিদ্রুত হারে বেড়ে চলা ধর্ষণের ঘটনাগুলো।
এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ধর্ষকের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও একটি বড় কারণ। এক্ষেত্রে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ষক বা ধর্ষণকারীরা কোনো না রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এরূপ জড়িত থাকার উদাহরণ হচ্ছে: মুরাদনগরে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকা, টাংগাইলে বাসে শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে, নোয়াখালীর গ্রামে স্থানীয় সমিতির সঙ্গে ইত্যাদি। মোটকথা ধর্ষক ধরেই নিচ্ছে যে, তাকে রক্ষা করার জন্য তার পেছনে সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন যথেষ্টই রয়েছে। অন্যদিকে ধর্ষকের সামাজিক অবস্থানও তার একটি বড় রক্ষাকবচ। সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় জড়িত হয়েও চারপাশের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। আর তাদেরকে ধর্ষণের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ থেকে মুক্তিদানের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্বচ্ছ আচরণ, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উদ্যমহীন দায়িত্বহীনতা, বিচারব্যবস্থার নির্লিপ্ততা ও গাফিলতি ইত্যাদি এতোটাই দায়ী যে, এটিকে শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি ও দুর্বলতা বললে খুবই সামান্য বলা হয়। আসলে এগুলো হচ্ছে অসহায় ধর্ষিতাদের প্রতি রাষ্ট্রের একধরনের শোষণ ও উপেক্ষামূলক বর্বর দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ।
তবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটা ও ঘটার পর ধর্ষককে সে অভিযোগ থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রের রাজনীতি। দেশে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকছে, তখন সে দলের অনুসারীরা পুরো দেশ ও দেশের সমুদয় সম্পদকেই তাদের নিজেদের জন্য ‘মালে গণিমত’ ভাবতে শুরু করে, যে গণিমতের আওতায় তারা হয়তো ওই অসহায় ধর্ষিতা নারীকেও গণ্য করে বৈকি! কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যে রাজনৈতিক নেতারা এসব অপকর্মকে প্রশ্রয় দেন, তারা যখন জনগণের কাছে ভোট চাইতে যান, তখন সে ভোটারদের কেউই তাকে প্রশ্ন করেন না যে, বিভিন্ন সময়ে ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে ইতোমধ্যে তিনি তার ভোট চাওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে ফেলেছেন কিনা। আশা করা হচ্ছে, সামনেই নির্বাচন। ধর্ষণের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ওই নির্বাচনের ভোটপ্রার্থীদের কাছে ভোটাররা কি দয়া করে এর কারণ জানতে চাইবেন? আর তাদের কাছে এটাও জানতে চাওয়া যেতে পারে যে: তুলনামূলকভাবে দরিদ্র, সংখ্যালঘু এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়েপড়া নারীরাই কেন অধিক হারে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন? রাজনীতিকদের কাছে এ প্রশ্নও রাখছি যে, ধর্ষককে প্রশ্রয় দিয়ে ও তাকে নিজ দলের কর্মী-কাম-লাঠিয়াল বানিয়ে এ দেশের জন্য কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা তার গড়ে তুলবেন?
ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আরো কিছু নতুন কারণ সমাজে সৃষ্টি হয়েছে, যেসবের বেশিরভাগই আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে: উপার্জনের প্রয়োজনে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর এক বিরাট সংখ্যক মানুষ বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে, যে ক্ষেত্রে তার পরিবারের নারী সদস্যদেরকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই দেশে বসবাস করতে হচ্ছে। কিছু বছর আগ পর্যন্তও বাংলাদেশের গ্রামগুলোর দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যিক সংহতির কারণে এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এসব পরিবারের জন্য যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে। দেশে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বহাল থাকলে এ দেখভালের কাজটি খুব সহজেই তারা করতে পারত। একইভাবে যেসব গ্রামীণ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বর্তমানে পরিবার-পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে রেখে শহরে যেয়ে কাজ করছেন, সেসব পরিবারের নারী সদস্যদের জন্যও নিরাপত্তাহীনতার অনুরূপ ঝুঁকি দিন দিনই বেড়ে চলেছে। আর পোশাক শিল্পের দরিদ্র অসহায় দুঃখী মেয়েরাতো এখন ধর্ষণের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য (target)। তথ্য পর্যালোনা করলে দেখা যাবে যে, সারাদেশে গত পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে এই পোশাককর্মীর সংখ্যাই সর্বাধিক।
ধর্ষণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ নিয়ে উপরে যে আলোচনা করা হলো, তার বাইরে যেয়ে এসবের মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, এসব ঘটনায় ধর্ষকের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার চেয়েও অধিক হারে কাজ করে এক ধরনের রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ ও হতাশা, যার কিছুটা নিজের প্রতি হলেও বেশির ভাগটাই চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি। ওই যে দেশের তরুণেরা এখন বন্যার স্রোতের মতো বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে, সেটি যেমন বহুলাংশে রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ ও হতাশা থেকে, এই ধর্ষকদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মোটামটি একই। ধর্ষণের মতো পাশবিক অমানবিকতা প্রকাশের মাধ্যমে সে বস্তুত রাষ্ট্রের প্রতিই এক ধরনের ঘৃণা প্রকাশ করতে চায়, যদিচ সে ঘৃণা প্রকাশের জন্য এটি কোনো গ্রহণযোগ্য পথ নয়। এমতাবস্থায় ধর্ষণ প্রতিরোধে আশু ও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় গ্রহণের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে ঐসব ব্যবস্থাদিও গ্রহণ করতে হবে, যার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রতি ধর্ষকের ঘৃণা, ক্ষোভ ও হতাশাগুলোও দূরীভূত হশ।
শিরীন আমজাদ: সাবেক অধ্যক্ষ, মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ, ঢাকা।
ষড়যন্ত্র হলো কিছু মানুষের গোপন পরিকল্পনা, যা সাধারণত অনৈতিক বা ক্ষতিকর উদ্দেশে করা হয়। এটি একটি গোপন চুক্তি, যা কোনো অন্যায় বা ক্ষতি করার জন্য করা হয়। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলতে বোঝায় কোনো ঘটনার পেছনে কিছু মানুষের তৈরি করা জটিল ও গোপন পরিকল্পনা, যা অস্পষ্ট ও বিতর্কিত হয়ে থাকে। ষড়যন্ত্র বহু ধরনের। সাধারণত নিম্নোক্ত ধরনের আওতাভুক্ত হতে পারে, যেমন: (১) পারিবারিক ষড়যন্ত্র; (২) সামাজিক ষড়যন্ত্র; (৩) সংগঠনগত ষড়যন্ত্র; (৪) অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র; (৫) রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র; (৬) প্রাসাদ ষড়যন্ত্র; (৭) ইত্যাদি। ষড়যন্ত্রের মূল বিষয় ইতিবাচক নয়; সবই নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্বক। উল্লেখ্য যে, ইসলামে অন্যের ক্ষতি করার জন্য বা অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে যারা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাদের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আখিরাতে তার কঠিন প্রতিফল ভোগ করতে হবে। মূলত প্রতিহিংসাপরায়ন কতিপয় হীন মনের মানুষ কর্তৃক কর্তৃত্ব, লোভ, লালসা, জিঘাংসা, জিদ, আধিপত্য ইত্যাদির জন্য সংঘটিত হয়ে থাকে। এরা এতটাই জঘন্য মনের মানুষ যে শুধু ব্যক্তি বিশেষ নয়, সমাজ ও দেশের ক্ষতি হলেও তাদের কিছু আসে যায় না। ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে ইংরেজিতে সুন্দর একটি কথা আছে, যা হলো ‘Dirty man with dirty mind in negative phenomena’।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এই বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা থেকে ষড়যন্ত্র চলে আসছে। অবশ্য এ সব ষড়যন্ত্রের প্রকারভেদ আছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, নবী-রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে কম ষড়যন্ত্র হয়নি? এর স্বপক্ষে একটি জলন্ত উদহারণ হলো আমাদের প্রানপ্রিয় নবীজি (সা.) এর বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান একটি ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, মক্কার মুশরিকরা যখন কোনোভাবেই সাহাবিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারল না এবং বুঝতে পারল নবীজি (সা.) মদিনায় গিয়ে পৌঁছালে কোনোভাবেই ইসলামের উত্থান তারা ঠেকাতে পারবে না, তখন তারা নবীজি (সা.)-কে প্রতিহত করতে মক্কার ‘পরামর্শ কেন্দ্রে’ একত্র হলো। বৈঠকে উমাইয়া বিন খালফ, আবু জাহাল, নদর বিন হারিসসহ মক্কার শীর্ষ স্থানীয় সাত ব্যক্তি ছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় শয়তানও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। বৈঠকে আবু জাহাল নবীজি (সা.)-কে হত্যার পরামর্শ দেয়। নাউজুবিল্লাহ! সে বলে প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবক হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। সিদ্ধান্ত হয় রাতের আঁধারে তারা একযোগে নবীজির ওপর হামলা করবে। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮৫; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮)। এদিকে পবিত্র কোরআনে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা ষড়যন্ত্র করে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩০)। রাতের বেলা নীলনকশা বাস্তবায়নে আবু জাহাল, হাকাম ইবনে আস, উকবা ইবনে আবি মুয়িত, নদর ইবনে হারিস, উমাইয়া ইবনে খালফসহ ১১ ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করে। অন্যদিকে মহানবী (সা.) নিজের বিছানায় আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে শুইয়ে দেন। এরপর তিনি হাতে এক মুঠ মাটি নিয়ে কাফিরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন এবং সুরা ইয়াসিনের প্রথম থেকে ৯ আয়াত তিলাওয়াত করেন। নিক্ষিপ্ত ধুলা প্রত্যেক দুর্বৃত্তের মাথায় গিয়ে পড়ল এবং তারা কার্যত অন্ধ হয়ে গেল। নবীজি (সা.) তাদের সামনে দিয়ে নিরাপদে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর একজন আগন্তুক তাদের বলল, তোমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যখন ঘরে উঁকি দিয়ে মহানবী (সা.)-এর বিছানায় অন্য কাউকে শোয়া দেখল, তখন তারা আগন্তুককে তিরস্কার করল। অথচ সকালে যখন আলী (রা.)-কে শয্যা ত্যাগ করতে দেখলেন তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। (সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা ৪৭; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৪৫৬। এদিকে আবু সিরমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য কারো ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহ তাআলা তা দিয়েই তার ক্ষতিসাধন করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ধরনের লোক কিয়ামতের দিন দেউলিয়া হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা পূর্ব থেকেই অনেকেই কম বেশি অবহিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একজন সৎ ও দক্ষ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে হত্যা করা, যা কেউ এতটুকু বিশ্বাস করতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিষ্ঠাবান ও সৎ ছিলেন। তিনি দেশের জন্য কাজের মাধ্যমে এমনভাবে বাংলাদেশীদের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন যে তার জানাজায় লাখ লাখ লোক শরিক হয়েছিল, স্মরণকালে এমন নাকি হয়নি। যাহোক, এই রকম অনেক ষড়যন্ত্র পৃথিবী ব্যাপী সংঘটিত হয়েছে, যা প্রবন্ধের কলেবরের স্বার্থে সন্নিবেশন করা সম্ভব হলো না। এদিকে বর্তমান বাধা বিঘ্নের মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যকাল ইতিমধ্যে এক বছর শেষ হয়ে গেছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। শুধু দেশে নয়। দেশের বাইরে থেকেও ষড়যন্ত্র চলছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হব।
যে কারণে ষড়যন্ত্রের উপর লিখতে হাতে কাগজ কলম তুলে নিয়েছি। তা হলো একটি বয়সি ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষের সমবায় সমিতির মধ্যে ষড়যন্ত্র। ওই সমবায় সমিতির সঙ্গে প্রথম থেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ২০১০ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্যোগী কার্যক্রমের সুবাদে ২০১৫ সালে এটি সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়। আর এর ৪ বছরের মাথার অর্থাৎ ২০১৯ সালে সফলতার মুখ দেখে এবং ৫ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে চলে ২০২৫ সালে সমিতির মধ্যে কিছু নেতিবাচক সদস্য মাথা চারা দিয়ে উঠে। তৎপর থেকে বলতে গেলে, সমিতির মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে। শুধু তাই নয়, তারা নানা বাহানার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আর সমিতিকে ধ্বংস করার জন্যে ভেতর বাইরে গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত আক্রমন করে কথা বলছে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে সমবায় অধিদপ্তরসহ সাধারণ সদস্যগণের মধ্যে অনেকেই আশংকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। শেয়ার মূলধন হিসেবে এককালীন টাকা উঠিয়ে নেয়ার জন্য অনেকেই প্রায়ই সমিতির অফিসে ধর্ণা দিচ্ছেন। আর এটি সমিতির জন্য মোটেই ভাল লক্ষন নয়। এদিকে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মূল ষড়যন্ত্রকারীরা সংখায় খুব একটা বেশি নয়। বড় জোর ৩/৪ জন হবে। এরাই রাত দিন ষড়যন্ত্র করে চলছে। আমার এই মর্মে বাস্তবভিত্তিক ধারণা যে, এইভাবে ষড়যন্ত্র চললে, হয়তো এই সমিতি বেশি দিন টিকবে না।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে ষড়যন্ত্র আছে, ছিল এবং আগামীতে বিভিন্ন আঙ্গিকে আসবে। তাই জীবন চলার পথে ষড়যন্ত্রকারী থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং সদা চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কেননা অনেক ক্ষেত্রে ইবলিসও এদের কাছে হার মানে। এটি চিরন্তন সত্য যে ষড়যন্ত্রকারী বা আপাতত ভাল অবস্থানে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত টিকে না এবং জনরোষে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। হয়তো আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, বাস্তব জীবন থেকে নিংড়ানো তিন ঘন্টার সব সিনেমায় ভিলেন দোর্দন্ড প্রতাপে প্রথম দিকে ভাল অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয় করুণ পরিনতি। এক্ষেত্রে ‘যার শেষ ভালো তার সব ভালো’ দর্শনের আওতায় নায়ক মাথা উঁচু করে থাকে। আর এই ভিলেন তথা ষড়যন্ত্রকারীদের কি অবস্থা হয়, তা কম বেশি সবারই জানা। এদিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এই ষড়যন্ত্রকারীরা নায়কের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলে তাকে যেমন প্রকারান্তরে উপরে উঠায়। তেমন ষড়যন্ত্রকারীরা নিচের দিকে যেয়ে নিজেরাই নিজেদের কবর রচনা করে থাকে।
বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
আল্লাহপাক মানুষকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন (সুরা আর রাহমান, আয়াত-২)। কোরআন গবেষণার জন্য আমাদের তাগিদ দিয়েছেন । সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করত: আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে জীবন যাপন করতে মানবসমাজকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-…‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর কিভাবে তিনি সৃষ্টি শুরু করেছেন? অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহতো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান’। (আন কাবুত, আয়াত ২০)। ‘এতে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য এক সুস্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছি’ (আন কাবুত, আয়াত-৩৫)। ‘আর এটাই আপনার রব নির্দেশিত সরল পথ। যারা উপদেশ গ্রহণ করে আমরা তাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি’ (সুরা আনআম, আয়াত-১২৬)। ‘তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সব কিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন’ (সুরা যাসিয়া আয়াত-১৩)’। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় সম্পূর্ণ কোরআনের বিভিন্ন অংশে অসংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে যে, এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। অর্থাৎ কোরআন নিয়ে গবেষণার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় এমন কিছু অজানা তথ্য আমরা জানতে পেরেছি যা প্রায় পনরশত বছর আগে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে, আমাদের মুসলিম চিন্তাবিদ কতটুকু গবেষণা করেছেন সে বিষয় নিয়ে উদাহরণসহ কয়েকটা আলোচনা করতে চাই :
১) বিগব্যাং থিওরি: ১৯২৭ সালে প্রথম বিগব্যাং থিওরি ধারণা দেয়া হয় যা ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞান গবেষণা করে প্রমাণ পায় যে প্রথমে আকাশ ও পৃথিবী একত্রে ছিল, পরে একটা বিস্ফোরণ এর ফলে তারা পৃথক হয়ে গেছে। এই বক্তব্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে-‘যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখেনা যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবেনা?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০।
২) পানি চক্র: ১৮৬১ সালে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে পানি চক্র। কোরআনে বর্নিত আছে- ‘তুমি কি দেখনা যে, আল্লাহ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন; অতঃপর ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং তদ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর ওটা শুকিয়ে যায় এবং তোমরা ওটা পীত বর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তিনি ওটা খড়কুটায় পরিণত করেন? এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্নদের জন্য’। (যুমার, আয়াত-২১।
৩) ভ্রুণতত্ব: ১৯৫০ সালে আল্ট্রাসাউন্ড আবিষ্কার এর পর বিজ্ঞান জানতে পারে। অথচ কোরআন পনরশত বছর আগেই উল্লেখ করেছে যে, ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিণ্ড হতে’। (সুরা আলাক, আয়াত-২)।’ পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, অতঃপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে এবং মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জিরে; অতঃপর অস্থিপিঞ্জিরকে ঢেকে দিই মাংস দ্বারা; অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টি রূপে; অতএব নিপুণতম স্রষ্টা আল্লাহ কত কল্যাণময়’। (সুরা মুমিনুন, আয়াত-১৪।
৪) সম্প্রসারণবাদ: এডউইন হাবল ১৯২৪ সালে প্রমাণ করেন বিশ্বজগৎ ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই তথ্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে- ‘আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৪৭)।
৫) রোজার বাধ্যবাধকতা : প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন এর সুরা বাকারা ১৮৩ নম্বর আয়াত-’ হে মুমিনরা, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ এই আয়াতে প্রধান দুটি বিষয় আছে, রোজা মুসলিমদের উপর ফরজ, এবং রোজার পালনের মাধ্যমে মুত্তাকি হতে পারি। এর মধ্যে স্বাস্থ্যের উপকারিতার কথা সরাসরি না থাক্লেও আমরা সবাই জানি রোজা পালন শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু কোন মুসলিম কি কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন কিভাবে শরীরের জন্য উপকারী, বা পবিত্র কোরআনের এই বক্তব্যের বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য কোন থিয়োরি প্রদান করেছেন? কেননা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত যদি না হয় তো কোন অমুসলিম কেন ওই তথ্যের উপর সরল বিশ্বাস করবে?
৬) একটি নোবেল প্রাইজ : ২০১৬ সালে YOSHINORI OHSUMI, একজন জাপানি বিজ্ঞানীকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় ফিজিওলজি ও মেডিসিন ক্যাটেগরিতে। তিনি আবিষ্কার করেন ‘AUTOPHAGY’ নামের ফর্মুলা। অর্থ্যাৎ তিনি দেখতে পান মানব দেহে যদি ১২ ঘণ্টার অধিক কোন খাদ্য বা পানীয় পাকস্থলীতে না যায় তবে দেহের সুস্থ ও কার্যকরী কোষগুলো অসুস্থ মরা কোষগুলোকে খেয়ে ফেলে। এভাবে শরীর দূষণমুক্ত হয়। এই পদ্ধতির নাম অটোফেজি। ওই ঘটনার পর আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে যে সব মৌলভি ওয়াজ করেন, তারা জোরে সোরে বলতে শুরু করেন যে ১৫০০ বছর আগে পবিত্র কোরআনের বাণী বিজ্ঞানের আবিষ্কারে প্রমাণিত। আমার কাছে তাদের আত্মতৃপ্তিটা হাস্যকর মনে হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম কুরআনের বাণী সত্য। কিন্তু কোনো মুসলিম কেন আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ নিতে পারলেন না । আর যে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ পেলেন তিনি তো পরীক্ষা করার জন্য গবেষণা করে চলেছেন। তিনি কোরআনের বাণী সত্য প্রমাণ করেছেন। তার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন ছিল মানব দেহের কোষগুলো কিভাবে কাজ করে সেটা জানতে চেষ্টা করেছেন। আমরা মুসলিম হিসেবে নন মুসলিমের সার্টিফিকেটের উপরে কেন নির্ভর করব কোরআনের নির্দেশনা প্রমাণ করতে? আমরা কেন ওই তথ্য আবিষ্কার করতে পারি না?
৭) সত্যমিথ্যা : আজকাল ন্যায় বিচার কায়েম করার জন্য কতই না প্রচেষ্টা করতে হয়। গত ৫৪ বছরে দেখলাম শুধুই আন্দোলন, সরকারের বিরুদ্ধে দাবী আদায়ের আন্দোলন। ৯৫% মুসলিমের দেশ, চিন্তা করতেই অবাক হই যে, ইমানদার অথচ অন্যায়ের বিপক্ষে বেশিরভাগই নেই। অথচ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ করেছেন- ‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড। যাতে তোমরা সিমালংঘন না কর তুলাদণ্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না’। (সুরা রহমান, আয়াত : ৭-৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দিই না’। (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫২)। পরিমাপে ও ওজনে কম দেওয়ার ফলে আল্লাহ তাআলা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন ও দুর্ভিক্ষ দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে ওজন করে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়’। (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কর না’। (সুরা বাকারা, আয়াত-৪২)।
৮) সর্বশেষ: আমার মূল বক্তব্য কোরআনে বর্ণিত জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা, অর্থাৎ চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য প্রদত্ত পরামর্শ আমরা যারা সিভিল সার্ভিসে কর্মরত বিশেষ করে মুসলিম অফিসার, তাদের জন্যই প্রযোজ্য। তাদের কাছেই প্রশ্ন, আমরা সবকিছু জেনেশুনে কিভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারি। আমাদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বিভক্তি আছে, তেমনি আছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিভক্তি। সাধারণ মানুষ সহজেই একটা দলভুক্ত হতে পারে। তাদের মধ্যে গোঁড়ামি অত্যন্ত কাজ করে। কিন্তু সিভিল সার্ভেন্ট অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ, দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত ও বিবেকবান কর্মকর্তা, কোরআনের বর্ননা মতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে যেমন প্রফেশনালিজম থাকবে, তেমনি থাকবে ন্যায় পরায়নতা। তাতে থাকবে যুক্তি, এবং অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। ওজনে কম দিয়ো না অর্থ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা কর, বিচারে পক্ষপাতিত্ব কর না। অন্য আয়াতে আছে-‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কর না। এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনেশুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশে শাসন কতৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না’। (সুরা বাকারা:১৮৮)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-‘যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে ভালো কথা ও ক্ষমা উত্তম। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, পরম সহনশীল’। (সুরা বাকারা ২:২৬৩)। ‘যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদিগকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী’। (সুরা নিসা ৪:৫৮)। ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও ভয়ানক’। (সুরা বাকারা-১৯১)। ‘তোমরা আল্লার রুজ্জুকে শক্তভাবে সবাই আঁকড়ে ধর দলাদলি করো না’। (সুরা ইমরান -১০৩)। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে’। (সুরা নিসা-৫৮)। আমরা যারা মুসলিম, আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে স্বীকার করতেই হবে। আর কোরআনের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। কিন্তু একজন মুসলিম, বিশেষ করে আলেমদের মধ্যে এই সীমাবদ্ধতা কতটুকু রয়েছে সে প্রশ্ন করাই যায়। প্রায় পনরশত বছর আগে পবিত্র কোরআনে অনুরূপ অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা এসেছে যা এখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, কোরআন একদিকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনা প্রদান করে অন্যদিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করত: যুক্তি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদ প্রদান করেছে যা মহান সৃস্টিকর্তার প্রকৃতিতে বিরাজমান বিভিন্ন নমুনা ও তার অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে উৎসাহ যোগায়। সুতরাং কোরআনের সব অজানা তথ্য যে সঠিক তা মহান আল্লাহ পাকের কৃপায় আমরা সময়মতো আবিষ্কার করতে পারবো ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কোরআনের কথা বিজ্ঞানের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। সিভিল সার্ভিসের একটা অন্যতম কাজ জনসেবা নিশ্চিত করা। জনগণের কাজকে সহজ করে তোলা। পার্লামেন্টে আইন পাস হয় কিন্তু তারপর প্রয়োগ হয় সিভিল সার্ভেন্টের মাধ্যমে। সেজন্য একজন সিভিল সার্ভেন্টের মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি আইনের ভাষা, শর্ত, শাস্তি বা পুরস্কার, আইন অমান্যের কারণ, অপরাধী সনাক্তকরণ এইসব যাবতীয় বিষয় একই আইনের বইয়ে লেখা থাকে। কিন্তু নির্ম আদালত যে রায় দেয় উচ্চ আদালতে যেয়ে দেখা যায় আদেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানে যুক্ত হিসেবে দেখা যায় উচ্চ আদালতের বিচারকের মনোভাব। তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছেন তার উপর নির্ভর করে একজন অপরাধী অপরাধের মাত্রা, অথবা তার নিরপরাধের যৌক্তিকতা, ইত্যাদি নির্ণয় করা।
মো. জহিরুল হক, সরকারি কর্মকর্তা
তারকাদের বিচ্ছেদ মানেই কোটি কোটি টাকার মামলা। আর সেই তারকা যদি হন হৃতিক রোশন, তাহলে তো কথাই নেই। হৃতিক রোশন ও সুজান খানের বিয়ে যেমন আলোচিত হয়েছিল, তেমনই তাদের বিচ্ছেদ নিয়েও হয়েছে বিস্তর আলোচনা। জানেন কি, এটিই বলিউডের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিচ্ছেদ।
হৃতিক (নির্মাতা রাকেশ রোশনের ছেলে) ও সুজান (অভিনেতা সঞ্জয় খানের মেয়ে) শৈশবের বন্ধু। ‘কাহো না পেয়ার হ্যায়’ (২০০০) দিয়ে হৃতিক যখন বলিউডে অভিষেকের অপেক্ষায়, তখনই সুজানের সঙ্গে তার প্রেম চলছিল। চার বছর প্রেমের পর ২০০০ সালের ২০ ডিসেম্বর তারা বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে হৃহান (২০০৬) ও হৃদান (২০০৯)।
২০১০ সালের ‘কাইটস’ ছবির শুটিং চলাকালে হৃতিক ও সুজানের সম্পর্কে ফাটল ধরার গুঞ্জন শোনা যায়। ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছেদ হয়; শেষ হয় ১৪ বছরের দাম্পত্য জীবন। তবে বিচ্ছেদের পরও তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন; দুই সন্তানের যৌথ অভিভাবকত্ব পালন করছেন। প্রায়ই তাদের সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়।
বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচ্ছেদ নিষ্পত্তিতে সুজান ৩৮০ কোটি রুপি (প্রায় ৫২৭ কোটি টাকা) পান। নগদ অর্থ, সম্পত্তি, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো সম্পদ- কোন পথে এই অঙ্ক তাকে দেওয়া হয়েছিল, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবু এটি বলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিচ্ছেদ হিসেবে রেকর্ড গড়ে।
বর্তমানে হৃতিক প্রেম করছেন অভিনেত্রী সাবা আজাদের সঙ্গে, আর সুজান সম্পর্কে আছেন আর্সলান গোনির সঙ্গে। হৃতিককে শিগগিরই দেখা যাবে ‘ওয়ার ২’ ছবিতে, যা মুক্তি পাচ্ছে ১৪ আগস্ট।
সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমি। আমরা নতুন প্রজন্ম প্রাকৃতিক এই মহামূল্যবান সম্পদ ধরে রাখতে পারলাম না। কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতার কারণে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা আজ মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে এই অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক সম্পদকে। তথাকথিত সভ্য সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে এমন আচরণ করেছে, যেন প্রকৃতি কেবল ভোগের বস্তু।
নিজ দেশের সৌন্দর্য রক্ষা ও উন্নয়নে নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে তবেই আমরা আমাদের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারব।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত সিলেট একটি ভূখণ্ড, যা প্রকৃতির উদার দান, পাহাড়-নদী-ঝর্ণার অপার মেলবন্ধন, চা-বাগানের সবুজ সমারোহ, সীমান্তের পাহাড়ি বাতাস আর মানুষের আন্তরিক আতিথেয়তা মিলিয়ে একটি অনন্য সৌন্দর্যের আঁধার। এই সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ছিল এমনই এক প্রাকৃতিক রত্নভাণ্ডার, যেখানে ধলাই নদীর স্বচ্ছ জল, সাদা পাথরের স্তূপ আর মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারার মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপরূপ দৃশ্যপট। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি ছিল যেন এক ভূ-স্বর্গীয় গন্তব্য।
কিন্তু আজ, সেই ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়। একসময়ের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন ধূলিধূসর মরুভূমির মতো। নদীর বুক ফাঁকা, পাথরের স্তূপ নেই, স্বচ্ছ জল ঘোলা, তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া আগের ও বর্তমান ছবির তুলনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা নিজেরাই প্রকৃতির গলা টিপে হত্যা করছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য ভিডিও যেন প্রমাণ দিচ্ছে সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর এখন আর প্রকৃতির অলঙ্কার নয়, লুটেরাদের লোভের শিকার। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, জিরো পয়েন্টে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তোলা হচ্ছে নির্বিচারে। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে লুটেরাদের মধ্যে হাতাহাতি এমনকি মারামারির ঘটনাও ঘটছে প্রকাশ্যে।
ধলাই নদীতে দিনের আলো কিংবা গভীর রাত সময় যেন কোনো বাধা নয়। প্রভাবশালী একটি চক্র শত শত বারকি নৌকা ভরে তুলছে পাথর। এমন প্রভাব যে, স্থানীয় মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান; প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডকে আরও বেগবান করে তুলেছে। মাসের পর মাস ধরে চলা এই অবৈধ উত্তোলনে নদীর তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্ত, ব্যাহত হয়েছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, আর পাথরশূন্য তীরে ভোলাগঞ্জ হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক রূপ।
গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই সাদা পাথরে লুটপাটের সূত্রপাত, তবে গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে চলছে এই লুটপাট; তবে অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও নেপথ্যে রয়েছে। সরকার পতনের পর চিত্রটি হয়েছে আরও ভয়াবহ। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটে চলছে প্রতিযোগিতা, বাদ যাচ্ছে না ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও। লুটেরাদের তালিকায় রাজনৈতিক রঙের ভেদাভেদ নেই চাঁদাবাজির ধরন বদলে গিয়ে সব পক্ষ মিলে ভাগ বসাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে।
গত দুই-তিন মাসে দিন-রাত মিলিয়ে অন্তত হাজারের বেশি বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয় যেন তারা শুধু দর্শকের আসনে।
শ্রমিকদের কার্যক্রমও ভয়াবহ চিত্র আঁকে। দিনরাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল ও টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও আশপাশের এলাকা থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। পরে বারকি নৌকায় করে সেই পাথর মিল মালিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেশিনে পাথর ভেঙে ছোট করা হয় এবং ট্রাক-পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয় যেন এই ধ্বংসযজ্ঞের কোনো শেষ নেই।
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংসের এই লুটযজ্ঞ কেবল সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়; এটি এক গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত সংকটের জন্ম দিচ্ছে। নদী, পাহাড়, জলজ প্রাণী এবং মানুষের জীবন সবই এই বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।
প্রথমত, নদীর তলদেশে গভীর গর্ত তৈরি হওয়ায় ধলাই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানির গতি ও দিক পরিবর্তনের ফলে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত স্রোতে তীর ভাঙন ও বসতভিটা হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা ও বসবাসের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। নদীর পাথরশয্যা মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের প্রজনন ও আশ্রয়ের জন্য অপরিহার্য। পাথর হারিয়ে যাওয়ায় তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল বিলীন হচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব নদীর সম্পূর্ণ খাদ্যচক্রে পড়ছে যা শেষ পর্যন্ত মানুষের খাদ্য ও অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে।
তৃতীয়ত, ধলাই নদীর স্বচ্ছতা হারিয়ে জলদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাথর উত্তোলনের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি, বালি ও কাদা উঠে এসে পানিকে ঘোলা করে তোলে। এর ফলে পানির মান নষ্ট হয়, নদী ব্যবস্থার প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়, আর পানি ব্যবহারের যোগ্যতা কমে যায়।
চতুর্থত, পর্যটনশিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করছে। একসময় যেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় থাকত, এখন সেখানে হতাশা ও বিমুখতা। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, নৌকা ভাড়া, স্থানীয় গাইড, হস্তশিল্প বিক্রেতা সবাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। শতাধিক পরিবার, যারা পুরোপুরি এই পর্যটন নির্ভর জীবিকার সঙ্গে জড়িত, তারা এখন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজ সবক্ষেত্রের সমন্বিত বিপর্যয়। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানকে ধ্বংস করে যে উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা এই উদাহরণ আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও এই অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। প্রশ্ন ওঠে প্রশাসন কি অসহায়, নাকি প্রভাবশালীদের চাপে নীরব?
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল একটি পর্যটন স্পট নয়; এটি একটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ ধ্বংস করা মানে জাতীয় ঐতিহ্যের অপচয়। টেকসই সমাধানের প্রয়োজন
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার - ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয় এটি সিলেটের জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অথচ অবৈধ উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে এই অনন্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে। এখনই কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চল হারিয়ে যাবে আমাদের চোখের সামনে।
ভোলাগঞ্জ ও এর আশপাশের অঞ্চলকে ‘সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুমতি ছাড়া পাথর উত্তোলন, ভূমি খনন বা পরিবেশ বিনষ্টমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না।
প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ শুধু অভিযান চালানো নয়, বরং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ একই অপরাধ করার সাহস না পায়।
পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত হাজারো শ্রমজীবী মানুষ হঠাৎ বেকার হয়ে পড়লে সামাজিক সংকট সৃষ্টি হবে। তাই তাদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ, যেমন ইকো-ট্যুরিজম, হস্তশিল্প, বা কৃষিভিত্তিক প্রকল্প চালু করতে হবে।
ভোলাগঞ্জকে একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে।
প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষকেই অভিভাবক হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। তারা যদি সরাসরি পর্যটন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হয়, তাহলে নিজেদের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসবে।
পর্যটন কেবল বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়; এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। সিলেটের পর্যটন খাত বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে সক্ষম, যদি প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ।
বিদেশি পর্যটকরা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আসেন না তারা নিরাপত্তা, অবকাঠামো, পরিবেশের স্থায়িত্ব, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণকেও মূল্যায়ন করেন। যদি এই অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য হারিয়ে যায়, তবে সিলেটের পর্যটন আয় ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধাক্কা লাগবে। প্রায় হাজার হাজার মানুষ, যারা পর্যটন নির্ভর হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নৌকা সেবা, গাইডিং এবং হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভোলাগঞ্জ হারিয়ে গেলে শুধু সিলেট নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয় সে আমাদের জীবনদাতা, আশ্রয়দাতা, এবং সংস্কৃতির ধারক। আমরা যদি প্রকৃতিকে রক্ষা না করি, তবে একদিন প্রকৃতিও আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ধ্বংস হওয়া মানে কেবল একটি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক স্থান হারানো নয় এটি আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক অমার্জনীয় অপরাধ।
এখনই সময় কঠোর আইন প্রয়োগ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং টেকসই পর্যটন নীতি বাস্তবায়নের। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর শুধু পুরনো ছবিতে, গল্পে, আর আক্ষেপে বেঁচে থাকবে যেখানে আমরা গর্বের পরিবর্তে অপরাধবোধ অনুভব করব।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
মন্তব্য