৩ মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলমের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, আরেকটি ‘বদর যুদ্ধের’ ডাক দিয়েছিল হেফাজত। রমজান মাসে বদরের যুদ্ধ হয়েছিল। তাই গত ২৬ মার্চ শুরু হওয়া হেফাজতের সহিংসতা রমজান পর্যন্ত টেনে আনার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানান তিনি। রমজানে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ছিল হেফাজতের। কাগজে-কলমে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতের কজন নেতা ছিলেন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী। হেফাজত ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন তারা। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর পাশাপাশি সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন হেফাজত নেতারা এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তাণ্ডব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ভয়ংকর সহিংসতায় এর ইঙ্গিত মেলে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে দেশের বাইরে থেকে কোটি কোটি টাকাও সংগ্রহ করা হয়। পরিকল্পনা এখানেই থেমে ছিল না। ক্ষমতা দখলের কৌশল রপ্ত করতে কেউ কেউ পাকিস্তানে দীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের উগ্র রাজনৈতিক সংগঠন তেহরিক-ই লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)-কে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দীক্ষা নেন তারা। হেফাজতের খিলাফত প্রতিষ্ঠার অভিলাষে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সম্পৃক্ততার তথ্যও মিলেছে।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর আদেশ-নির্দেশ ও বিধান প্রতিষ্ঠায় কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধাচরণ করার কথা নয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ও মডেল অনুসরণ করে হেফাজতে ইসলাম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা ইসলামসম্মত কি? রাসুল (সাঃ) শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। আরবে তখন জাহিলিয়াতের সময় তথা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ ছিল। তাগুতের তথা পথভ্রষ্টদের শাসন ছিল। তিনি কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইসলাম প্রাতিষ্ঠা করেছিলেন? বদর যুদ্ধ হয়েছিলে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে। হেফাজতের আরেকটি ‘বদর যুদ্ধে’ কাফের প্রতিপক্ষ কে? বদর যুদ্ধ তো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যুদ্ধ ছিল না। মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আবু সুফিয়ান ও তার দল শাম থেকে অস্ত্র নিয়ে মক্কা ফিরছিল।
মুসলমানরা কাফেরদের ভবিষ্যৎ আক্রমণের কথা ভেবে আত্মরক্ষার্থে আবু সুফিয়ানকে আটকিয়ে অস্ত্র জব্দ করতে চেয়েছিল। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠান। মক্কায় প্রচার হয় মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এখানেই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে এটি বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ যা মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরিতে সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের সোনালি দিনের সূচনা করেন। বদরের যুদ্ধ ছিল সত্য মিথ্যা তথা হক্ক ও বাতিলের মধ্যে যুদ্ধ। আরেকটি বদর যুদ্ধে কে হক্ক আর কে বাতিলপন্থি? রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার ওপর ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন-
“তোমরা নির্দেশ পালন কর আল্লাহ, রাসুল ও তোমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবানদের।” (সুরা নিসা: ৪৯)।
রাষ্ট্রে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন-
“পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না”। (সুরা কাসাস: ৭৭)।
ইসলাম শাসকশ্রেণির আনুগত্যের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিলেও অন্ধভাবে সব অন্যায়কে মাথা পেতে নিতে নির্দেশ করে না। ইসলাম বিভিন্ন অন্যায় কাজে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অবকাশ রেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অনুমতি দেয় না। রাসুল (সা.) বলেছেন-
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো, অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলা।” (তিরমিজি, ২১৭৪)। তবে স্মরণ রাখতে হবে, শাসকের অবাধ্যতা কেবল ধর্ম ও আল্লাহর নাফরমানির কারণেই বৈধ। অন্য ক্ষেত্রে নয়। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন-
“মনে রেখো, যে ব্যক্তি কোনো শাসককে আল্লাহর নাফরমানিমূলক কাজ করতে দেখে, সে ওই কাজকে মন্দ বলবে। তবুও তার আনুগত্য ত্যাগ করা যাবে না।” (বোখারি, ৪৭৬৮)।
রাসুল (সাঃ) অন্য এক হাদিসে বলেছেন-
“রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত অপরিহার্য, যতক্ষণ সে আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ না করে।” (বোখারি, ২৯৫৫)
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) আরও বলেন-
“আমার পরে এমন শাসক আসবে, যে আমার দিকনির্দেশনার ওপর চলবে না। আমার আদর্শ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করবে না। তাদের মধ্যে এমন লোকও হবে, যাদের অন্তর হবে শয়তানের অন্তর। তখনও শাসকের কথা শুনবে, মানবে। যদিও সে তোমাকে প্রহার করে, তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়। তখনও তার আনুগত্য করবে। বিদ্রোহ করবে না।” (মুসলিম, ৪৭৪৮)
প্রশ্ন হলো, কতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারবে না? রাসুল (সা.) বলেন-
“নিশ্চয়ই তোমাদের ওপর এমন শাসক নিযুক্ত করা হবে, যার কিছু কাজকে তোমরা ভালো বলবে, কিছু কাজকে মন্দ বলবে। যে ব্যক্তি অন্যায়কে অপছন্দ করবে, সে (গুনাহ থেকে) দায়মুক্ত থাকবে। তবে যে অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থেকে তাকে অনুসরণ করবে সে গুনাহগার হবে। সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামাজ পড়ে’। (মুসলিম, ৪৭৬৪)
হজরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুসলমানদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তাতে সাহাবায়ে কেরাম কেউ কেউ নিজ ইজতেহাদ অনুসারে কোনো একপক্ষে যোগ দিলেও অন্যরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করেননি। হজরত উসামা (রা.) হজরত আলী (রা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি যদি কোনো বাঘের উদ্ধত থাবার সম্মুখেও হতেন, আমি আপনার সঙ্গ দিতাম। কিন্তু গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকে আমি বৈধ মনে করি না’। (বোখারি, ৭১১৩)।
ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করা ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, সামনে অনেক মন্দ বিষয়াবলি ঘটবে। কাজেই যে ব্যক্তি জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় অনৈক্য সৃষ্টি করবে, তরবারি দ্বারা তার মাথা উড়িয়ে দাও। সে যেই হোক না কেন।” (মুসলিম, ৪৭৫৯)
নাগরিকের দায়িত্ব হলো, ভালো কাজে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা ও মন্দ কাজে বাধা দেয়া। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“তোমরা শুভ কাজ ও খোদাভীরুতার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা কর, আর পাপ ও খোদাদ্র্রোহিতার কাজে সহযোগিতা করবে না”। (সুরা মায়েদা: ২)
মন্দ কাজে বাধা দেয়া মানে রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নয়। রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য করার জন্য ইসলাম যেমন আদেশ দিয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করার জন্য এবং রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি না করার জন্য কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কুরআন, হাদিসের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ‘আরেকটি বদর যুদ্ধের’ ডাক দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে ভয়ংকর ফিতনা সৃষ্টি কি হক্কপন্থির কাজ হবে? হেফাজত যে পাকিস্তানকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছেন সে পাকিস্তান তো প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রসমূহের কাতারে। পাকিস্তান খেলাফতের মডেল হতে পারে না। ‘পাকিস্তান খেলাফত’কে অস্বীকার করে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেলুচিস্তান ও সিন্ধু পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে বহু বছর ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করছে। অর্থনৈতিকভাবে ও উগ্রবাদে ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংসদে।
এই প্রস্তাবটির পক্ষে ৬৮১ এবং বিপক্ষে মাত্র ৬টি ভোট পড়ে। ইইউর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে দেয়া বিশেষ ব্যবসায়িক অধিকার (জিএসপি স্ট্যাটাস) অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাতিল করা হবে। এর কারণ হিসেবে পাকিস্তানে মৌলবাদীদের আধিপত্য ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে কঠোর আইন ব্যবহারের অভিযোগকে তুলে ধরা হয়েছে। এমনিতেই পাকিস্তানের অর্থনীতির ভয়ংকর রকম খারাপ অবস্থা, এর মধ্যে ইইউর এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরপরও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে কেন পাকিস্তানি দীক্ষা?
হেফাজতের কিছু নেতা পাকিস্তানের যে দলকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেই তেহরিক-ই লাব্বাইক পাকিস্তান তথা টিএলপিকে উগ্রপন্থি আচরণের দায়ে পাকিস্তান সরকার দুই সপ্তাহ আগে নিষিদ্ধ করেছে। ফ্রান্সে মহানবী (সাঃ)-এর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের ঘটনার জেরে পাকিস্তানে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামে টিএলপি। টিএলপি-প্রধান সাদ রিজভীকে গ্রেপ্তার করে সরকার। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশটির প্রধান প্রধান শহরে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করে টিএলপি কর্মী-সমর্থকরা। টিএলপির সন্ত্রাসী হামলায় দুজন পুলিশ নিহত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও ৩৪০ সদস্য গুরুতর আহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা এবং জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি করার অভিযোগে পাকিস্তান টিএলপিকে নিষিদ্ধ করেছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া পাকিস্তান যদি টিএলপিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়, তাহলে হেফাজত কেন পাকিস্তান থেকে টিএলপি মডেল আমদানি করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়? হেফাজতে ইসলাম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে যুদ্ধ শুরু করলে প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে বসে থাকবে না। কেউ রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে উঠলে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পালটা জবাব দেবে এটাই স্বাভাবিক। শুরু হবে গৃহযুদ্ধ, যুক্ত হবে নানা পক্ষ। এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলাফল আমাদের চোখের সামনে।
এরপরও হেফাজত বাংলাদেশকে কেন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া বানাতে চায়? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই হেফাজত খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলো, টিকিয়ে রাখতে পারবে কি? কাদের সমর্থন নিয়ে খেলাফত চালাবে হেফাজত? মুসলিম উম্মাহর চোখের সামনে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র কেড়ে নিলো ইহুদিরা। চার দশক ধরে মিয়ানমারের মুসলমানরা গণহত্যা, ধর্ষণ, রাষ্ট্র থেকে বিতাড়নসহ নানা জুলুমের শিকার হলো মুসলিম উম্মাহ কতটুকু কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে? আর উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ তো মুখে কুলুপ এটেছে। হেফাজতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল জরুরি কেন? হেফাজতের বিবেচনায় বাংলাদেশে তাগুতের শাসন পরিচালিত হচ্ছে।
যদি ধরে নিই তাদের বক্তব্য সত্য, তাহলে প্রশ্ন হলো রাসুল (সাঃ) যখন পৃথিবীতে আসেন তখন জাহেলি তথা অন্ধকারের যুগ ছিল, তাগুতের শাসন ছিল। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কি তাগুতের শাসন পরিবর্তনের জন্য জোর করে, নেতিবাচক পন্থায়, নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করেছিলেন? রাসুল (সাঃ) তার সাহাবিদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে উগ্র বক্তব্য দিতেন, না সুন্দর ব্যবহার, উত্তম চরিত্র, আল্লাহর পথে আহ্বান, আত্মগঠন ও সমাজ-সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন? আপনারা তাহলে কার অনুসরণ করছেন? আল্লাহর আইন বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হলে তা শুধু আল্লাহর কুরআন ও রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথেই করতে হবে। ইসলামের নামে কোনো শায়খের খামখেয়ালিপনা কিংবা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শবিরোধী পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন-
“হে নবী, লোকদের বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অসীম দয়াবান। তাদের বলুন আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। এরপর বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না”। (সুরা আল ইমরান:৩১-৩২)।
কুরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন-
“নিঃসন্দেহে রাসুলের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। অবশ্য তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের ও পরকালীন মুক্তির ব্যাপারে আশা রাখে এবং যারা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে”। (সুরা আহযাব: ২১)
জিহাদের আহ্বান কে করতে পারে? যদি যে কেউ জিহাদের আহ্বান ও নেতৃত্ব দিতে পারত, তাহলে মুসলমানরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে জিহাদের ডাক দিত, আর সেক্ষেত্রে নিশ্চিত বিশৃঙ্খলা, নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যেত। ইসলামে বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয় সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়কে কুরআনে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামে একমাত্র মনোনীত নেতাই জিহাদের আহ্বান ও নেতৃত্ব দিতে পারেন। রাসুল (সাঃ) বলেন-
“রাষ্ট্রপ্রধান হলেন ঢাল, যাকে সামনে রেখে কিতাল বা যুদ্ধ পরিচালিত হবে।” (বুখারী, ৫৫৩, ১০২৬; মুসলিম ১৪৭১)
সাহাবীগণ কখনই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে যুদ্ধ বা কিতালে লিপ্ত হননি। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ইসলামি জ্ঞান শিক্ষার কথা বলে ভর্তি করে তাদেরকে ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে, জিহাদের ভুল মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, অরাজকতার জন্য রাস্তায় নামিয়ে দেয়া, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকের শিকারে পরিণত করা শিক্ষার্থীদের আভিভাবকের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার বরখেলাপ নয় কি? ধর্মের জন্য যদি সন্ত্রাস হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হেদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে (সীমালঙ্ঘনকারী, আল্লাহদ্রোহী, বিপথগামী) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হওয়ার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সুরা বাকারা:২৫৬)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আরও বলেছেন-
“আর যদি আপনার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী সব মানুষকেই একসঙ্গে বিশ্বাসী বানিয়ে ফেলতে পারতেন। সুতরাং (হে মুহাম্মদ) আপনি কি তাহলে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য লোকদের জবরদস্তি করতে চান?” (সুরা ইউনুস : ৯৯)।
ইসলামে জিহাদ বা কিতাল তথা যুদ্ধের বৈধতার সর্বপ্রথম শর্ত হলো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। কিতাল বা জিহাদ কখনই ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়।
ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম দাওয়াত বা প্রচার। কিতাল বা যুদ্ধ হলো প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সংরক্ষণ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তার মাধ্যম। রাসুল (সাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দাওয়াতের ভিত্তিতে মদিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামি জীবনব্যবস্থা মেনে নেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করেন। যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিতাল বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক শর্ত আরোপ করেছে। সেগুলোর অন্যতম হলো- রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি, রাষ্ট্র বা মুসলিমদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, সন্ধি ও শান্তির সুযোগকে প্রাধান্য দেয়া ও কেবলমাত্র যোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা। অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল কখনই ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ বা কিতাল নয়। তাই আরেকটি বদর যুদ্ধের ডাক কোনোভাবেই ইসলামসম্মত নয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রয়োগ এখন রমরমা সারা বিশ্বে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গিয়ে একজন এআই মানবীকে মন্ত্রী করে ফেলল আলবেনিয়া। রক্ত-মাংসের মানুষ নন, এআই মন্ত্রী পৃথিবীতে এটাই প্রথম। বিশ্বের এই প্রথম এআই মন্ত্রীর নাম ‘ডায়েলা’। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং সাধারণ মানুষের জন্য সরাসরি ব্যয়ে স্বচ্ছতা রক্ষা করা তার প্রধান দায়িত্ব। আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা এমন একটি নিয়োগে উদ্যোগ নিয়েছেন। এআই মানবী ‘ডায়েলা’ তৈরি করে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এআই মানবীর কাজে একেবারে মুগ্ধ আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তার বিশ্বাস, ডায়েলার নজরদারিতে প্রতিটি সরকারি দরপত্র ১০০ ভাগ স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হবে।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর মানুষের উন্নতির যাত্রাপথে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক দিবস। সেদিন ‘চ্যাটজিপিটি’ নামে একটি শক্তিশালী চ্যাটবট-এর আবির্ভাব ঘটেছিল। চ্যাটজিপিটিতে ‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, যা শুধু টেক্সট বা ভাষা নয়Ñ বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, এমনকি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যায়। চ্যাটজিপিটির জয়যাত্রা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ‘ভার্সন ৪.৫’ টিউরিং টেস্টেও পাস করেছে। এর অর্থ, মানুষের কাছ থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন হচ্ছে। ‘ডিপ লার্নিং’ কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে। এরপর তারা বিষয়গুলো শিখে নেয় অনেকটা মানুষের মতোই। শুধু মানুষের সঙ্গে পার্থক্যÑ এআই-এর বুদ্ধিমত্তা ও অসীম ক্ষমতা। প্রায় মানুষের মতো সহজাত বুদ্ধি; কিন্তু সেইসঙ্গে বিপুল তথ্যভাণ্ডার। ফলশ্রুতিতে এআই সৃষ্টি করেন যে স্রষ্টারা, এআই-এর সিদ্ধান্ত সেই স্রষ্টারাও বুঝতে সক্ষম হন না। অদূর ভবিষ্যতে অতি শক্তিশালী কোনো কম্পিউটারকে বিশেষ কোনো নির্দেশ দেওয়া হলে সে চাইবে, যেকোনো মূল্যে নির্দেশটি পালন করতে; সেজন্য সমাজ-পৃথিবী-পরিবেশ ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে গেলেও তার কিছু যাবে-আসবে না। স্রষ্টার ইচ্ছেপূরণ তাতে হয়তো হবে, তবে বড় কঠিন মূল্যে। ‘কম্পিউটেশনাল থিওরি অব মাইন্ড’-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের মন ও চেতনাকে সম্পূর্ণভাবে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে পুরোপুরি ধরা সম্ভব। তবে আজ সিলিকনের মস্তিষ্কে চেতনার সঞ্চার সম্ভব না হলেও, কে জানে আগামীকাল তা-ও হয়তো সম্ভব হয়ে যাবে! আমরা চাই বা না-চাই, এই নতুন প্রযুক্তিকে নিয়েই আগামী দিনে চলতে হবে আমাদের। সারা বিশ্বের দুরারোগ্য রোগ সারানো, নতুন শক্তির উৎস সন্ধান, শিল্পক্ষেত্রে বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং পরিবহণসহ হাজারও মানব কল্যানের দিকগুলো খুলে যাবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ক্ষমতার হাত ধরেÑ এমনটা আজ আশাবাদ নয়, বাস্তবতার দিক নিদর্শন।
এআই সক্ষমতার শত্রু এআই নিজেই। এর অগ্রগতি যেমন বৈপ্লবিক, আবার ক্ষতিকারক সম্ভাবনাও বৈপ্লবিক। এআই অগ্রগতির দূত হলেও নৈতিক দায়িত্ব পালনে কি সমর্থ? এ প্রশ্নের উত্তরটি আরও জটিল হয়েছে, যখন আধুনিক এআই-এর গডফাদার জেফ্রি হিন্টন নিজেই নৈতিক দায়িত্বের কথা বলে গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই প্রযুক্তির ক্ষমতা ও স¤পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত করে আর্থ-সামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে বিপুল কর্মহানি ঘটাতে সক্ষম। ফাইন্যান্স এবং ব্যাংকিং, ই-কমার্স, হেলথকেয়ার, টেলিযোগাযোগ, পরিবহন, ভ্রমণ থেকে সমাজমাধ্যম, বিনোদন, শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান গবেষণাÑ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭০ শতাংশ। কিন্তু তারপরও এআই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এআই কি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? এক কথায় এর উত্তর ‘না’। অন্তত মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে পারে, সেভাবে কখনোই নয়। মানুষের ‘কমন সেন্স’ একটি স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা; কিন্তু এআই-এর ‘কমন সেন্স’ অর্জন অসম্ভব। এআই-এর না-থাকার তালিকায় আরও অনেক কিছুই আছে। যেমন নান্দনিক বোধ, প্রেরণা, দরদ বা অনুভূতি।
প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান অভিজাত গবেষণাগার থেকে ধীরে ধীরে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়, শহরে-গ্রামে-পাড়ায়। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, একটি বেসরকারি সংস্থা ভারত এবং তানজানিয়ায় প্রায় আট হাজার মানুষের ওপর ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংগ্রহ করেছে। এ পরীক্ষায় তারা ওই মানুষদের মনস্তাত্বিক অবস্থা, ঘুম, মনোযোগ, স্মৃতি বা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরেছে। এ পরীক্ষা তারা ব্যয়বহুল প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত কর্মী কিংবা নির্দিষ্ট গবেষণাগার ইত্যাদি ছাড়াই একটি সাশ্রয়ী যন্ত্র দিয়ে এবং স্বল্প প্রশিক্ষণের পরেই মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী হয়েছে। এই গবেষণা গর্বের সঙ্গে প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান এখন সবার জন্য, সবার মধ্যে এবং সবার দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। বিজ্ঞান আজ শুধু মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ বিশ্লেষণই করে না, মানুষের অভ্যন্তরের স্বরকেও শুনতে চায়। এত কম খরচে এবং এত বৃহৎ পরিসরে এমন নিউরোসায়েন্স প্রকল্প চালিয়ে ভারতের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে বিশাল মাইলফলকের দাবিদার।
প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান আজ যেখানে পৌঁছেছে, তা একবাক্যে বৈপ্লবিক। তাকে স্বাগত না জানিয়ে অন্য কোনো উপায় নেই। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কথা থেকে যায়, কারণ এআই-এর গড ফাদার জেফ্রি হিন্টন নৈতিক দায়িত্বের কথা বলে পদত্যাগ করেছেন। কথা থেকে যায় ডিপ লার্নিং নিয়েও। ডিপ লার্নিং কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে। মডেলগুলোকে বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। তারপর আর স্রষ্টার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তথ্যগুলো বিচার করে নিজস্ব নকশা খুঁজে বের করে মডেলরাইÑ ঠিক মানুষের মতোই। ডিপ লার্নিং-এর সিদ্ধান্তের ওপর আর স্রষ্টার কোনো নিয়ন্ত্রণ কাজ করে না। এই মডেলগুলোর বুদ্ধিমত্তা ও অসীম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আর কোনো সুযোগ থাকে না; এআই হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণহীন শক্তিময় তথ্যভাণ্ডার, যা তারপর তার পথেই চলতে থাকে। এর পাশাপাশি এটাও বলার সুযোগ রয়েছে যে, প্রযুক্তির ক্ষমতা ও সম্পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আর্থ-সামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে দিতে পারে। এ কারণেই নতুন প্রযুক্তি বিস্ময়ের সঙ্গে বিতর্কের পথেও হেঁটেছে। বিতর্ক এজন্য যে, ডিপ লার্নিং কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে; কিন্তু সেই মানুষ কোনো না-কোনোভাবে, কারো না-কারো দ্বারা প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা থাকলেও এআই-এর ডিপ লার্নিংকে প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রশিক্ষিত করা পর্যন্ত তাকে নিয়ন্ত্রিত করা গেলেও প্রশিক্ষার পর তাকে আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সৃষ্টি তখন স্রষ্টার থেকেও অধিক শক্তিশালী হয়ে পড়ে।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ক্রমশ আরও সহজ, স্বচ্ছ ও গতিশীল করে তুলেছে। তবু, নাগরিক জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক আজও জটিলতার কাছে পরাস্ত পরিচয় প্রমাণের ক্ষেত্রে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নাগরিককে বারবার একই ধরনের কাগজপত্র, ফর্ম ও তথ্য জমা দিতে হয়। জন্ম নিবন্ধনের জন্য আলাদা ফর্ম, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ভিন্ন, শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির জন্য আলাদা আলাদা তথ্য, ভোটার তালিকায় নাম উঠাতে ও জমি রেজিস্ট্রি করতে আরেকটি, পাসপোর্ট কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সে আরও আলাদা কিছু। সরকারি-বেসরকারি, প্রতিষ্ঠান-সংগঠন প্রতিটি জায়গায় বারবার নিজের পরিচয় প্রমাণের কঠিন ঝামেলা।
এই বিশৃঙ্খল তথ্য ব্যবস্থায় সত্য ও গোপনীয়তা হীন তথ্য, ভুল তথ্য এবং ভুয়া তথ্যের প্রবেশ বাধা দিতে পারে না কেউ। ফলে নাগরিকের পরিচয় হয় অস্পষ্ট, তথ্য হয় বিচ্ছিন্ন, এবং প্রশাসনের দক্ষতা ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেও তার বংশ, ঐতিহ্য, জীবনী সঠিকভাবে বহন করতে পারেন না।
তাই প্রশ্ন হলো সব তথ্য যদি একটি মাত্র একক, সার্বজনীন, আজীবন ব্যবহারযোগ্য নাগরিক পরিচয় নম্বর (একক পরিচয় নম্বর) এর সঙ্গে যুক্ত করা যেত, যা জন্ম থেকে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকত, তবে কি নাগরিক জীবনের এই বহুবিধ জটিলতা দূর হয়ে যেত; কীভাবে এটি আমাদের পরিচয় ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর, নির্ভুল করে তুলতে পারত?
এই প্রশ্নের উত্তরে, একক পরিচয় নম্বর -ই এক যুগান্তকারী ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি শুধু নাগরিকের জীবনকে সহজ করবে না, রাষ্ট্রের সেবা প্রক্রিয়াকেও করবে দ্রুত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে কীভাবেএকক পরিচয় নম্বর আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হতে পারে।
জীবনচক্র, ধরা যাক রাজধানীর একটি হাসপাতালে এক নারী সন্তান প্রসব করতে এলেন। তিনি যদি পূর্বেই একটি ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর পান, এবং সেটি রাষ্ট্রীয় তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে, তাহলে সেই নম্বর ব্যবহার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহজেই জানতে পারবে তার স্বাস্থ্য ইতিহাস, রক্তের গ্রুপ, অ্যালার্জি, অপারেশনের বিবরণ, এমনকি গর্ভকালীন চিকিৎসা সম্পর্কেও। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এবং জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আর দ্বিধা করতে হবে না।
শিশুটি যখন জন্ম নেবে, তখনই তার জন্য একটি একক পরিচয় নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেট হবে। এই নম্বরে থাকবে - তার জন্মের স্থান ও সময়, পিতামাতার নাম ও পরিচয় নম্বর, জন্মের সময় তার শারীরিক চিহ্ন বা বায়োমেট্রিক তথ্য, প্রসবসংক্রান্ত মেডিকেল ইতিহাস (জন্ম পরিচয়)
এখানেই শেষ নয় এই নম্বরের মাধ্যমেই শিশুটির টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। যতবারই সে টিকা নেবে, সেই রেকর্ড তার একক পরিচয় নম্বরের সাথে যুক্ত হবে। এতে চিকিৎসকরা ভবিষ্যতে সহজেই জানতে পারবেন, সে কোন কোন ভ্যাকসিন নিয়েছে, আদৌ সময়মতো নিয়েছে কিনা, তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ইত্যাদি।
শিক্ষাক্ষেত্রে, শিশুটি যখন প্রথম বা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হবে, তখন আর বাবা-মাকে আলাদা করে জন্মসনদ, মেডিকেল সার্টিফিকেট, ঠিকানা প্রমাণ ইত্যাদি জমা দিতে হবে না। শুধুমাত্র তার একক শিক্ষা-নম্বর প্রদান করলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জানতে পারবে শিশুটি কে, তার পিতা-মাতা কারা, তার কোনো স্বাস্থ্যগত বা মানসিক বিশেষ চাহিদা রয়েছে কিনা, সে পূর্বে কোনো শিশু বিকাশ কেন্দ্রে পড়েছে কিনা এবং তার শেখার অগ্রগতি কেমন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক, তারপর উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরেই এই একক নম্বর শিক্ষার্থীর জীবনপঞ্জির মতো কাজ করবে। তার ফলাফল, উপস্থিতি, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, আচরণ মূল্যায়ন এমনকি পছন্দের বিষয়সমূহও এই নম্বরের সাথে যুক্ত থাকবে।
এই তথ্য সর্বক্ষেত্রে থাকার অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটি আগেই জানতে পারবে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও মনোভাব। তার মেধা মূল্যায়ন করা যাবে সামগ্রিকভাবে। কোনো ভুয়া সনদ তৈরি বা জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, দেশে কিংবা বিদেশে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হবে না।
মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বাছাই করাও সহজ হবে। সরকার, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি কোনো সংগঠন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের যে কোনো প্রান্তের প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে পারবে এবং তাকে যথাযথভাবে প্রণোদনা বা বৃত্তি দিতে পারবে। এর জন্য আর আলাদাভাবে কোনো সুপারিশ বা মধ্যস্থতার প্রয়োজন হবে না।
একজন শিক্ষার্থী তার পূর্ববর্তী সকল শিক্ষা জীবনের তথ্য অনায়াসে জানাতে পারবে। কারণ তার অতীতের শিক্ষা-ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জন সম্ভব হবে।
কর্মক্ষেত্রে , কর্মজীবনে প্রবেশ করতে গেলে একজন চাকরিপ্রার্থীকে নানা ধরনের জটিলতা ও বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে সিভি জমা দেওয়া, একই তথ্য বারবার সরবরাহ করা, পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের প্রতিটি ধাপে নিজের পরিচয় ও যোগ্যতা নতুন করে প্রমাণ করা এ যেন একটি দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, নিয়োগদাতাদের ক্ষেত্রেও সঠিক প্রার্থী বাছাই করা, তার অতীত অভিজ্ঞতা যাচাই, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বোঝা কিংবা তার আগের বেতন ও দক্ষতার ভিত্তিতে ন্যায্য মূল্যায়ন করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময়ই স্বচ্ছ ও কার্যকর হয় না, যা প্রার্থী ও নিয়োগকর্তা উভয়ের জন্যই সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় ঘটায়।
এই প্রেক্ষাপটে একটি একক পরিচয় নম্বর চালু করা হলে দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই নম্বর ব্যবহার করে একজন নাগরিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, বেতন কাঠামো, দক্ষতা ও সাফল্যের সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ করা গেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। নিয়োগকর্তারা সহজেই একক পরিচয় নম্বরের মাধ্যমে প্রার্থীর প্রোফাইল যাচাই করতে পারবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে স্বল্প সময়ে খুদেবার্তা বা অন্য যে কোনো মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব দিতে পারবেন। প্রার্থীরও আর বারবার দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না।
অন্যদিকে, জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আজও নানা ধরনের জালিয়াতি ও অসচ্ছতার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের যদি নির্দিষ্ট একক পরিচয় নম্বর থাকে, তাহলে জমির মালিকানা নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই, মামলার অবস্থান জানা এবং কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। এছাড়াও, দুরগত এলাকায় বসবাসরত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হবে, যা সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এই আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় তথ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে একদিকে নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা এবং অন্যদিকে পরিবার ও সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই একক পরিচয় নম্বর ভিত্তিক এই ব্যবস্থা কার্যকর করলে দেশের উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া হবে আরও সুশৃঙ্খল, স্বচ্ছ ও দ্রুততর।
পরিকল্পনায় , বর্তমান তথ্যভিত্তিক যুগে উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণের সফলতা মূলত নির্ভর করে সঠিক, সময়োপযোগী ও ব্যাপক তথ্যের উপস্থিতির ওপর। বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একক পরিচয় নম্বর চালু হলে সরকারের জন্য দেশের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দিক যেমন শিক্ষার্থী সংখ্যা, কর্মক্ষম জনগণ, স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা, নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি, মৃত্যুহার এবং শিক্ষার হার সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত সহজ ও কার্যকর হবে।
এই তথ্যসমূহের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণীরা বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করবে। ফলে সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং সমাজের বিভিন্ন দুর্বল ক্ষেত্রে কার্যকর হস্তক্ষেপ সম্ভবপর হবে। তাই একক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে, যা তথ্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে।
নিরাপত্তা , রাষ্ট্র বা সরকারের সামনে আজকের ডিজিটাল যুগে নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো অন্যতম জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, তথ্যের অবৈধ ব্যবহার রোধ, এবং প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইবার হামলা প্রতিরোধ করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়েছে। সফল ও নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ডেটা এনক্রিপশন এবং গোপনীয়তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণ কার্যকর, নাগরিকের সম্মতি ছাড়া তাদের তথ্য ব্যবহার সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ বজায় রয়েছে, এবং হ্যাকিং কিংবা ডেটা চুরির মতো সাইবার ঝুঁকিগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পাশাপাশি, এই ব্যবস্থাগুলোর জন্য যথাযথ ও আধুনিক প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। নাগরিকদের আস্থা অর্জন ও তাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে ডিজিটাল পরিবর্তনের সুফল সমগ্র সমাজে নিরাপদে পৌঁছাতে পারে।
রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের আস্থা অর্জন করা এবং প্রয়োজনীয় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমাদের আহ্বান ,সরকার যেন দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে, পাইলট প্রকল্প চালু করে এবং নাগরিকদের জন্য এই একক, সার্বজনীন ও আজীবন নাগরিক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন শুরু করে।
সেলিম রানা : গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রথমবারের মতো সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এই সাক্ষাৎকার শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তার কণ্ঠে শোনা গেছে আত্মবিশ্বাস, সহিষ্ণুতা ও পরিবর্তনের অঙ্গীকার, যা অনেকের কাছে নতুন বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে উঠেছে।
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান প্রথমেই বলেন, তিনি খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তবে দেশে ফেরার পথে কিছু ‘সংগত কারণ’ রয়েছে, যা তিনি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেননি। দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থানরত এই নেতা জানান, সময় এসেছে বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার। তার ভাষায়, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই এমন এক সময়ে, যখন মানুষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারবে, যখন ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে ওঠে এক ধরনের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস, যা বিগত দেড় দশকের মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বে তেমনভাবে দেখা যায়নি।
তারেক রহমানের ভাষায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রতিহিংসা ও দমননীতি রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচার হবে আইন অনুযায়ী, কিন্তু প্রতিশোধের রাজনীতি আমরা করব না।’ এই বক্তব্যে তার রাজনৈতিক পরিণতিবোধের পরিচয় মেলে। একসময়ের তরুণ রাজনৈতিক উত্তরসূরি এখন নিজেকে এক ধীরস্থির, প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরছেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশই প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক। আমরা সংবাদমাধ্যমকে ভয় পাই না, বরং তার স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করি।’ এক সময় বিএনপির শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। এবার তিনি সেই ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রবাহে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে, যদিও অনেকে বলছেন—কথায় নয়, কার্যকর পদক্ষেপেই দেখা যাবে এর বাস্তব রূপ।
বিচারব্যবস্থা নিয়েও তিনি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ‘আমরা কাউকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিতে চাই না, কিন্তু অপরাধ করলে বিচার হবেই। আইন সবার জন্য সমান হতে হবে।’ এই বক্তব্য বিএনপির অতীত রাজনীতি থেকে এক ধরণের নীতিগত বিচ্ছিন্নতা নির্দেশ করে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারেক রহমান যদি ভবিষ্যতে এ দিকটি প্রাধান্য দেন, তবে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
রাজনীতিতে তার এই নতুন ভাষা, সংলাপ, সহনশীলতা ও পুনর্গঠন, একটি ইতিবাচক সুর তৈরি করেছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার এই বক্তব্য নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তরুণ লিখেছেন, ‘এটাই সেই ভাষা যা রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা না করে তিনি বরং সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বিরোধিতা থাকতেই পারে, কিন্তু আমরা চাই সব দলই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিক। যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, সেটিই হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার।’
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি নরম রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছেন। এমন এক সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত, তখন তার সংযত ভাষা এবং আক্রমণাত্মক না হয়ে সমঝোতামূলক অবস্থান বিএনপির ভাবমূর্তি বদলাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে এই সাক্ষাৎকারে কিছু বিষয় রয়ে গেছে। তিনি এখনো দেশে ফেরা প্রসঙ্গে বলেছেন ‘সংগত কারণ’। যার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু সংগত কারণ রয়েছে। সেই কারণগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা বক্তব্য রয়েছে। অনেকের মতে, এটি নিরাপত্তাজনিত বা আইনি জটিলতার ইঙ্গিত। আবার অনেকে বলছেন, এটি একটি কৌশলগত অপেক্ষা, যাতে বিএনপির সংগঠন আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে তার প্রত্যাবর্তনের আগে।
তবে এই প্রশ্নের বাইরেও যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত, তা হলো তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর। ২০০৬–০৭ সালের তরুণ তারেক রহমানের সঙ্গে আজকের সাক্ষাৎকার দেওয়া তারেক রহমানের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। তখন তিনি ছিলেন সংগঠনমুখী। এখন তিনি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, ‘রাজনীতি মানে সেবা, শাসন নয়। আমি চাই জনগণই রাষ্ট্রের মালিক হোক।’ এই কথার মধ্যেই নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শন নিহিত আছে। তারেক রহমানের ভাষায় এটি এমন একটি একটি অংশগ্রহণমূলক, দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে নাগরিকই হবে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্র।
অর্থনৈতিক বিষয়েও তার বক্তব্যে এসেছে সুগভীর চিন্তার ছাপ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শুধু প্রবৃদ্ধির কথা বলব না, বলব ন্যায্যতার কথা। ধনী আরও ধনী হবে, আর গরিব আরও গরিব—এই চক্র ভাঙতে হবে।’ বাংলাদেশের বর্তমান বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে এটি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত করে, বিএনপি আগামীর অর্থনৈতিক নীতিতে সামাজিক ন্যায্যতা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সাক্ষাৎকারের পর বিএনপির অভ্যন্তরে একধরনের নীতি–পুনর্বিন্যাস ঘটছে। অনেকেই মনে করছেন, তারেক রহমান আসন্ন নির্বাচনের আগেই দেশে ফিরতে পারেন এবং ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের যে স্বপ্ন তিনি ব্যক্ত করেছেন, সেটির রূপরেখা ধীরে ধীরে সামনে আনবেন। তার লক্ষ্য কেবল ক্ষমতায় ফেরা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামোগত পুনর্গঠন।
তবে সামনে বাধাও কম নয়। আইনি জটিলতা, সংগঠনের দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা। সব কিছুই তার পথে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার হবে সুসংগঠিত কর্মপরিকল্পনা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা।
এই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অনেকেই একে ‘পরিবর্তনের শুরু’ বলে অভিহিত করছেন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে যে সহিংসতা, প্রতিহিংসা ও বিভাজনের সংস্কৃতি চলেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যে সংলাপ, সহমর্মিতা ও সংস্কারের পথে হাঁটতে পারে। তারেক রহমান সেই সম্ভাবনা জাগিয়েছেন।
তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকারের পর রাজনৈতিক বোদ্ধা, বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, সমাজ বিশ্লেষকেরা তার এই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে নতুন এবং ইতিবাচক ধারার প্রবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছেন। রাজনৈতিক মহলে এটি একটি মিডিয়া ইন্টারভিউ হিসেবে দেখা হচ্ছে না, বরং একজন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রজ্ঞার পরিচয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সাক্ষাৎকার ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে, যার প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।
আন্তর্জাতিক ও প্রভাবশালী মিডিয়া হিসেবে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়াটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয়; বিশেষ করে, যখন প্রতিটি শব্দ দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকে প্রভাবিত করে। বিষয়টি নিশ্চয় তারেক রহমানের অজানা নয়।
তিনি সাক্ষাৎকারের সময় অত্যন্ত স্থির, আত্মবিশ্বাসী এবং পরিমিতভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তার প্রতিটি উত্তর হিসেবি ও কৌশলগত; তাতে আবেগপ্রবণতা বা হঠকারিতা নেই। একজন জাতীয় নেতা হিসেবে এই স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস ও পরিমিত প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় তারেক রহমানকে এই প্রজন্মের কাছে নতুন ও আলাদা করে উপস্থাপন করেছে।
এ বিষয়ে এক কলামে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাইজুস সালেহীন এক কলামে লিখেছেন, ‘বিবিসির সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার বাস্তবিক অর্থেই অনন্যতার দাবি করতে পারে। সাক্ষাৎকারের প্রায় পুরোটাই শুনেছি এবং টেক্সটও পড়েছি। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবের মধ্যে পরিমিতিবোধ, সংযম ও দূরদর্শিতার অপূর্ব মেলবন্ধন ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। একজন পরিণত নেতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে। বিবিসি সাংবাদিকের প্রশ্নগুলোও ছিল বাংলাদেশের জনগণের ভাবনার সমান্তরাল। অর্থাৎ মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, মোটামুটি সেগুলোই জিজ্ঞাসিত হয়েছেন তারেক রহমান। তার উত্তরের মধ্যে না ছিল আমিত্বের বড়াই, না ছিল অন্য কোনো পক্ষকে ছোট করার প্রবণতা।’
মওদুদ আলমগীরের এক কলামে লেখেন, ‘পুরোটা দেখে মনে হয়েছে, উত্তর দেওয়ার সময় তার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি অন্তর দিয়ে যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেছেন নির্দ্বিধায়। কথা বলার সময় তিনি যতটা না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলেন তার কথোপকথনে জাতীয় ঐক্যের সুরটা যেন আরও বেশি বলিষ্ঠ শোনা যায়।
তাঁর বক্তব্যের এ ধারা দেশের রাজনৈতিক সুস্থতার জন্য অনেক প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে অনাবশ্যক আক্রমণের সুযোগ যেমন নেননি, তেমনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এক সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রোচিত অস্বস্তিতে ছিলেন, যেন তার কোনো কথাতেই আত্মম্ভরিতা বা অহংকার প্রকাশিত না হয়। শ্রোতা–দর্শকের কাছে তার এ অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই নজর এড়াবে না।’
গণমাধ্যমে তারেক রহমানের এই ভাষা, ইতিবাচক চিন্তা ও জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়িত হবে কি না—তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু স্পষ্ট, এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি বিএনপির রাজনীতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নিয়েছেন। তার বক্তব্যে যে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন ফুটে উঠেছে, সেটি কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং একটি ন্যায্য, স্বাধীন ও সুশাসিত রাষ্ট্র গড়ার আহ্বান। এই আহ্বান যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে হয়তো বহুদিন পর বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও নতুন আশার আলো দেখতে পাবে।
রাজু আলীম : কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
খেলনা রপ্তানি আগামী পাঁচ বছরে আট গুণের বেশি বাড়তে পারে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে বিশ্বের ৮৮টি দেশে খেলনা রপ্তানি হয়েছে সাড়ে সাত কোটি ডলারের বেশি। ২০৩০ সালে এই রপ্তানির আকার বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪৭ কোটি ডলার। ফলে বৈশ্বিক খেলনা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৮তম। ২০২৩–২৪ র্অথবছরে ২৭ কোটি ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে এই খাতে প্রচ্ছন্ন রপ্তানি হয়েছে ১২০ কোটি ডলার। প্লাস্টিক শিল্পের দেশীয় বাজারের আকার এখন ৪০ হাজার কোটি টাকা। খাতটি সরকারকে বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব দিয়েছে। দেশে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার, যার অদিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই)। এর মধ্য খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৫০। বাংলাদশেরে খেলনাশিল্পে সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গবষেণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগের ঘাটতি আছে। এর সঙ্গে
খেলনাশিল্পে ছাঁচ ও নকশা উন্নয়নের অভাব আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশকে কঠিন করছে। এর আগে রপ্তানিশিল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ২০৩২ সালের মধ্যে বিশ্বের খেলনা বাজারের আকার দাঁড়াবে ১৫০ বলিয়িন ডলার। র্বতমানে বিশ্বের খেলনা বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। তবে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে নিম্নমানের খেলনা উৎপাদন থেকেও সরে আসছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন সুযোগ। র্বতমানে দেশে এই খাতে বিনিয়োগ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগ দ্বিগুণ হতে পারে। খেলনা রপ্তানরি জন্য আমাদের আলাদা বাজার চহ্নিতি করতে হবে। দেশে তৈরি কিছু পণ্য কম মানের হলেও বিক্রি করা যায়। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মান র্সবোচ্চ রাখতে হব। খেলনা রপ্তানিতে ব্র্যান্ড ইমিজ তৈরি করতে হবে। ছাঁচ ও নকশার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে । স্থানীয় ছাঁচ যেভাবে তৈরি হচ্ছে, তা মানসম্পন্ন করছে না। স্বত্ব ও মধ্যস্বত্বের বিষয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেশি দেখা যায়। স্বত্ব ও ট্রেডমার্ক ব্যবস্থা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করবে। এর ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক নতুন বাজারে দেশের প্রতিষ্ঠানের সুযোগ পাবে। সরকার কিছু নীতিগত সহায়তা দেবে। তবে মান, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন শিল্পউদ্যোক্তাদের নিজেদের করতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। সরকার জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়েও আলোচনা করছে। রপ্তানিমুখী খেলনাশিল্পকে এসব বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই শিল্প রপ্তানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রয়োজন।
রপ্তানিমুখী খাত হলেও প্লাস্টিক শিল্পকে উচ্চহারে করপোরেট কর দিতে হয়। এটা কমানো প্রয়োজন। সম্ভাবনাময় এ খাত আরও একটু সহযোগিতা পেলে দ্রুত এগিয়ে যাবে। প্লাস্টিক খাতের উপখাত খেলনায়ও বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে। দেশে খেলনার ব্যবহার বেড়েছে। এখন প্রায় আমদানি করতে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে, এমন পণ্য বানাতে হবে। খেলনাশিল্পের কোয়ালিটি বাড়ানোর পাশাপাশি দামও কমাতে হবে। উদ্যোক্তারা প্রতিটি খেলনায় ভিন্নতা ও নতুনত্ব নিয়ে আসায় অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা বেশ ভালো। খেলনা শিল্প উন্নয়নে বিকাশের জন্য সরকারের সব রকমের সহযোগিতা লাগবে। যেহেতু প্লাস্টিক খাত একটি শ্রম নির্ভর এবং প্রচুর পরিমাণে মহিলা শ্রমিকের কাজের সুযোগ আছে তাই এই সেক্টর একদিন গার্মেন্টস এর মতো রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা আছে। আজ থেকে ১ দশক আগেও ৯০% খেলনা আমদানি নির্ভর ছিল। বর্তমানে ১০% আমদানি হয়, ৯০% দেশে তৈরি হয়। দেশের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ঝুড়িতে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে প্লাস্টিকের খেলনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ভূমিকা রাখবে প্লাস্টিকের খেলনাসামগ্রী। সে জন্য এই খাতের ওপর থেকে করপোরেট ট্যাক্স তথা কর কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন রপ্তানিমুখী প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরা। আমাদের এখানে কয়েক বছর আগেও কম মূল্যের প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানি নির্ভর। কিন্ত গত কয়েক বছরে অবস্থা অনেকটা বদলেছে। বর্তমানে এসব খেলনার বিরাট একটি অংশই তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। আরও আগে থেকেই পুরান ঢাকা এবং আশেপাশের কিছু এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে খেলনা তৈরির বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠছে । মূলত: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম খেলনার বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে। বেশ কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসত চীন ও তাইওয়ান থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ভালো একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা সামগ্রী। দেশে বিভিন্ন ধরনের খেলনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে এ শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমান। বাংলাদেশে ছোটদের জন্য খেলনা তৈরির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। খেলনা প্রস্তুতকারী দেশীয় বিভিন্ন কারখানা এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে এই শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়ে বিরাট অবদান রাখতে পারে দেশীয় অর্থনীতিতে। একসময়ে বাংলাদেশে খেলনা সামগ্রী হিসেবে অনেক নিম্নমানের পন্য তৈরি হতো। যা ক্রেতাদের তেমনভাবে আকৃষ্ট করতো না। ফলে বিদেশ থেকে খেলনা আমদানি করা হতো, যার বেশিরভাগই আমদানি হতো চীন থেকে। তবে বর্তমানে চীন থেকে আমদানিকৃত খেলনার সমমানের অনেক খেলনা আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশে উন্নত কারিগরী প্রযুক্তির অভাব থাকায় খেলনা শিল্প তেমন এগিয়ে যেতে পারছেনা, বার বার হোঁচট খাচ্ছে। দেশীয় লেদ কারখানা থেকে ম্যানুয়ালি মোল্ড তৈরি করতে হচ্ছে। অথচ বিদেশে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এ ধরনের মোল্ড তৈরি করা হয় অত্যন্ত নিখুঁত এবং সুন্দরভাবে। আজকাল অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা চীন ও তাইওয়ান থেকে মোল্ড বা ডাইস করে নিয়ে আসছেন। ডাইস তৈরির কম্পিউটারাইজড মেশিন দেশে থাকলে বাংলাদেশেই অনেক সুন্দর, উন্নত এবং আধুনিক মানের খেলনা তৈরি সম্ভব। এতে করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো ভালো খেলনা সামগ্রী তৈরি করে বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে। সুলভে ডাইস তৈরি করা গেলে চীনা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে তৈরি খেলনা আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন ভালো ডাইস ডিজাইনার। দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ডিজাইনারেরও অভাব রয়েছে এখানে। শুধুমাত্র ডাইস দিয়ে খেলনা তৈরী করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, এর সঙ্গে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে। এই শিল্প যদি দিনে দিনে উন্নতি লাভ করে তাহলে আরো অনেকেই আগ্রহী হবেন এ ব্যাপারে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় কারিগরী সহযোগিতা পেলে আন্তর্জাতিক মানের খেলনা সামগ্রী এদেশেই তৈরি সম্ভব। তখন খেলনা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যাবে। খেলনা শিল্পটিকে এসএমই খাতের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে নানমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করছেন। এ জন্য প্রনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমদানিকৃত খেলনার সঙ্গে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই দেশীয় খেলনা শিল্পের প্রসার এবং সুরক্ষার জন্য খেলনা তৈরিতে ব্যবহার্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমদানিতে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক এবং সমুদয় মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খেলনা শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা। আমাদের প্রত্যাশা, খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তা, প্রস্তুতকারীদের প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট।
একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুসমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, যেমন অপরিহার্য একটি সার্থক সংগীত নির্মাণে গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী ও বাদক যন্ত্রীদের সমন্বিত ও আন্তরিক প্রয়াস। অর্থ বিভাগ জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করে ঠিকই কিন্তু সেই বাজেটের আয় ব্যয়ের চাহিদা প্রাক্কলন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই আসে এবং বাজেট বরাদ্দের পর তা ব্যয়ন, বাস্তবায়ন ওই সব মন্ত্রণালয়গুলোই করে থাকে। সুতরাং বাজেট ব্যবস্থাপনায় অর্থ বিভাগের দায়িত্ব একক নয় এবং এর সাফল্য ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই সকলের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের আমদানি রপ্তানির নীতি নির্ধারণ করে মাত্র। কিন্তু আমদানি রপ্তানির সার্বিক পারঙ্গমতা বেসরকারি খাতের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি খাতের উপায় উপকরণ থেকে শুরু করে চাষাবাদসহ যাবতীয় বিষয় আশয়ের নীতি নিয়মকানুন ভালমন্দ তদারকি করে থাকলেও কৃষি কাজে নিয়োজিত দেশের শতকরা ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীই কৃষি উৎপাদন বিপনন এর সফলতা ব্যর্থতার ভাগিদার।
পুজিবাজারের উন্নয়নের প্রশ্নেও একই কথা খাটে। সাধারণ অসাধারণ বিনিয়োগকারী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকার, সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন, এক্সচেঞ্জসমূহ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকার্সবৃন্দ সকলের সক্রিয় ও দায়িত্বশীল আচার আচরণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুঁজি বাজারের মতো স্পর্শকাতর অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাতে কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হতে পারে। আমাদের জাতীয় বাজেটের সর্বমোট ব্যয়ের গড়ে ৭০ ভাগ অর্থায়ন হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা যার আহরণের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড নিজে ব্যবসা বাণিজ্য, বিনিয়োগ করে না, সম্পদ সৃষ্টিতে এর সরাসরি কোনো ভূমিকা থাকে না। সুতরাং যারা আয় করেন, যাদের উপর আয়কর আরোপিত হওয়ার বিষয়, যারা ভোগ করেন, যাদের উপর ভ্যাট প্রযোজ্য এবং যারা আমদানি করেন, যাদের উপর আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য তাদের কৃত কর্মের উপর কর আহরনের গতি প্রকৃতি নির্ভরশীল। আবার ব্যক্তি বা কোম্পানীর আয় শুধু ব্যক্তি বা কোম্পানীর দক্ষতা অদক্ষতার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল নয়। যে পরিবেশে বা যে ব্যবসায় বা যে কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে ব্যক্তি বা কোম্পানী আয় উপার্জন করে সে পরিবেশ, সে লোকবল, সে ব্যবসা বা সে কর্মকাণ্ড নিরাপদ সঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। একই অবস্থা ভোক্তা ও আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের বেলায়ও প্রযোজ্য। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতা সর্বত্র পরিব্যপ্ত।
দেখা যাচ্ছে কার্যকারণ এর সাথে ফলাফলের আন্ত:যোগাযোগ বা আন্ত:সম্পর্ক পরস্পর প্রযুক্ত ও নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। যে কোনো পর্যায়কে তাই বিছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই, দীর্ঘমেয়াদে অর্জিত সাফল্যকে একটি সীমাবদ্ধ সময়ের অবয়বে শুধু নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখার, প্রচারের ও প্রগলভতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সামষ্টিকতার সামষ্টিকতাই থাকেনা যদি কজ আর ইফেক্টের মধ্যেকার পরস্পর প্রযুক্ততার বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে নৈবক্তিক বিশ্লেষনে যাওয়া না হয় , যদি শুধু খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখা হয় একটি সম্পূর্ণ বিষয়কে। অর্থনীতির ক্ষতিকর যে কোনো অপপ্রয়াস এর সামনের ও নেপথ্যের উভয় কারণ এর প্রতি দৃষ্টিদান সমাধান প্রত্যাশা ও প্রয়াসকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারে। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভব হয় না। শুধমাত্র উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা উপস্থাপিত ফলাফলকে সমালোচনার কাঠগড়ায় না এনে একই সাথে কি কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব কিংবা এই ফলাফলের উপলক্ষকেও বিচার বিশ্লেষণের আর্জিতে আনার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ হলেই যে কোনো ফলাফলকে নানান অবয়বে উপস্থাপন ও সমালোচনা চলে। তার দাবি, প্রয়োজন ও চাহিদামত পুষ্টিকর খাবার না পেলে কোন শিশু ক্ষুধায় কাঁদলে, হাত পা ছুড়ে একাকার করতে থাকলে তাকে ‘কাঁদুনে শিশু’ বলে অপবাদ দেয়ার অপপ্রয়াস নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেমন এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের বা কর্তৃত্বের হতে পারে না, তেমনি পুঁজি বাজারও। আর পুঁজিবাজার এর সাথে সরকারি -বেসরকারি খাত বা ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু পুজিবাজারের রেগুলেটর ( এস ই সি) এককভাবে এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ বা কবজাকরণের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট অন্য সবাই দায়িত্বশলিতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কিনা, কোনো অনিয়মের দ্বারা পুঁজিবাজারের বস্তগত স্বার্থহানি ঘটাচ্ছে কিনা, ঘটাতে পারে কিনা, তার ওয়াচ ডগ হিসেবে, হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে, মার্কেট মেকার ও প্লেয়ারকে রেগুলেট করবে, ভালো কোম্পানি যাতে পুঁজিবাজারেও আসতে পারে তার নিয়ামক তৈরি করবে এবং জবাবদিহি পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ঠুনকো কারণে কে বড় কারণ এবং বড় কারণে ঠুনকো সাব্যস্ত করবে না। নিজেকে সর্বোতভাবে নিরপেক্ষ না রাখতে পারলে, পরিপোষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের অকার্যকারিতাই প্রতিপন্ন হবে।’ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, এক্সচেঞ্জসমূহের কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সিকিউরিটিজ ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলি নিশ্চিত করিবার জন্য’ ২০১৩ সালে এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন ( ২০১৩ সালের ১৫ নং আইন) পাস করা হয় এবং তার আলোকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়লাইজড হয়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্য এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রূপি ঘটনা বা পরিবর্তন। এর সুত্র ধরে ডিরাইভেটিভস, এফ টি এ প্রভূতি সংস্কার সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। সেগুলোর অগ্রগতির সালতামামী বা মূল্যায়ন হলে সে সবের প্রভাবক ভূমিকা যেমন জানা যাবে তেমনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নের হাল হকিকত আরো উপলব্ধির আওতায় আসতে পারে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সংঘবদ্ধ অথচ স্ব স্ব দায়িত্ব কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীলতাকে মানতেই হবে সুতরাং সামগ্রিক অবয়বে দেখেই বিচার করতে হবে সব ফলাফলকে। সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতায় প্রধান সীমাবদ্ধতা এখানে যে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অবস্থান করেই দ্বীপপুঞ্জের সাফল্য ও কল্যাণ কামনা করা হয়। সকলের সাফল্য শুধু নিজের বলে জাহির আবার নিজের ব্যর্থতাকে অন্যের ওপর চাপানোর মানসিকতা সকল সমন্বয় ও সাযুজ্যকরনকে বাধাগ্র¯ত করে। পরস্পরের দোষারোপের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ চেতনা বিকাশ লাভ করে না, সকলের প্রয়াস এক সুরে বাধা যায় না, হয় না। উন্নয়নের তানপুরায় বার বার ধুলি জমে আর সেখানে ঐকমত্যের সুর সাধা বেসুরো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সঞ্চয় বিনিয়োগের প্রধানতম পূর্বশর্ত। জনগণের মাথাপিছু আয়ের মৌল স্তর বৃদ্ধি ব্যতিরেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৃদ্ধির চিন্তাচেতনা বাস্তবসম্মত নয়। সামাজিক কল্যাণ খাতে উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সঞ্চয় বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ক্যালোরি ইনটেক বাড়িয়ে, বিশুদ্ধ পানি ও মৌল স্বাস্থ্য সেবার আওতায় (জনস্বাস্থ্য) সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমিয়ে জন্মহারকে সুষম নিয়ন্ত্রণ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সংক্রান্ত মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মৌলিক আয়ের স্তর বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের মাত্রা কমিয়েও সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সঞ্চয়কে উৎসাহিত করতে ব্যাংকিং সৃবিধা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বিদেশি সাহায্য ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে সঞ্চয় প্রত্যাশা করা বাতুলতা মাত্র বিধায় জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় দেশজ সম্পদ উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনা নিজস্ব উপায়ে বাস্তবায়ন সক্ষমতার সমাহার আবশ্যক। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হার এখনো নিম্নে। বিনিয়োগ হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকরী ও সহনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। দেখা গেছে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে ১৯৭৩ সালে শিল্পনীতিতে ঘোষিত সংরক্ষণবাদী বিধানাবলি ১৯৮২ সালে অপসারিত হলেও ১৯৯১ এর আগে বেসরকারি খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ হয়নি। আবার, ১৯৭৬, ১৯৮২, ১৯৮৬’র শিল্পনীতিতে গার্মেন্টস শিল্প খাতে উন্নয়নবিষয়ক কোনো পরিকল্পনার আভাস-ইঙ্গিত ততটা না থাকলেও এখাতে বিনিয়োগ হয়েছে অভাবিতপূর্ব। শিল্পনীতিতে আবকাঠামো, খাদ্য কৃষি ও ক্ষদ্র শিল্প খাতে উন্নয়নের কথা বেশি বেশি করে বলা হলেও এসব খাতের উন্নয়নে যথাযথ সহায়তা ও প্রযত্ন প্রদানের পর্যাপ্ত ক্ষক্ষমতা রাখা হয়নি পোষক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। প্রদত্ত সীমিত ক্ষক্ষমতা প্রয়োগের উদ্যোগও লক্ষণীয় হয়ে উঠেনি। দপ্তর সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে রয়ে গেছে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ডিমিউচ্যুয়ালাইজড চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রথম চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কৃষিতে অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মাটির অবক্ষয়, জলাশয়ের দূষণসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকরা প্রায়শই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। এ প্রেক্ষাপটে কৃষিতে সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি। এজন্য অযাচিত কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, জৈব প্রযুক্তি ও বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহারের প্রসার, কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন, নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাই হতে পারে একটি কার্যকর রূপরেখা। নিম্নে সরকারের কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো :
কৃষিতে অযাচিত বালাইনাশক ব্যবহার কমানো : বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে কীটনাশকের ভূমিকা থাকলেও অযাচিত ও অতিরিক্ত ব্যবহার বর্তমানে এক বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। অনেক কৃষক পরামর্শ ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন, যার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, পানিদূষণ ঘটে এবং মানুষের খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। এটি কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বরং পরিবেশের জন্যও হুমকি। তাই কৃষিতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) গ্রহণ করা জরুরি। কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে তারা সঠিক সময়ে ও পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে শিখেন। এছাড়া সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বিকল্প পদ্ধতি যেমন জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ বা জৈব সার ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতে হবে। এই উদ্যোগগুলো কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাবে, খাদ্য নিরাপদ রাখবে এবং পরিবেশ রক্ষা করবে।
মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা: মাটি কৃষির প্রাণ। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় মাটির জৈব উপাদান ও উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। মাটির এই অবক্ষয়ের কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং কৃষকরা আগের মতো ফলন পাচ্ছেন না। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জৈব সার, সবুজ সার ও কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। মাটির পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করা জরুরি। সরকার ইতিমধ্যে ‘মাটি পরীক্ষা কার্ড’ বিতরণ শুরু করেছে, যা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষকরা যদি মাটির স্বাস্থ্য বুঝে চাষাবাদ করেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ফসলের উৎপাদন বাড়বে, জমি উর্বর থাকবে এবং পরিবেশও সুরক্ষিত হবে। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে মাটির প্রতি যত্নশীল হওয়াই হবে সর্বপ্রথম শর্ত।
অর্গানিক বা জৈব (বায়ো পেস্টিসাইড) বালাইনাশক ব্যবহার বাড়ানো: অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে এখন জৈব বা বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব বাড়ছে। বায়ো পেস্টিসাইড প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়, যেমন নিমের নির্যাস, ট্রাইকোডার্মা, ব্যাসিলাস বা অন্যান্য অণুজীবভিত্তিক সমাধান। এগুলো পরিবেশের জন্য নিরাপদ, মাটির উর্বরতা রক্ষা করে এবং খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ রাখে না। বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে, তবে এখনও এটি পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সরকারকে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখাতে হবে যে বায়ো পেস্টিসাইড শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং খরচও তুলনামূলক কম। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে সুনাম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাস্থ্যকর জীবন দিতে হলে জৈব কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকে কৃষকের ভর্তুকি কমানো: বাংলাদেশে কৃষি খাতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে সরকারের ভর্তুকি কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়েছে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। সস্তায় পাওয়া যাওয়ায় কৃষকরা অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন, যা মাটি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষকদের টেকসই বিকল্পে উৎসাহিত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জৈব সার উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া, কম্পোস্টিং প্রযুক্তি সহজলভ্য করা এবং বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারে সহায়তা প্রদান। পাশাপাশি কৃষকদের ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তুকি নীতি সংস্কার করলে শুধু পরিবেশই রক্ষা হবে না, বরং কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থাও দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল হবে।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি: ডিজিটাল প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিকে আধুনিক ও টেকসই পথে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ড্রোন, সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), আইওটি (IoT), ও মোবাইল অ্যাপস এখন কৃষিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের রোগ-পোকার অবস্থা শনাক্ত করা যায়, সেন্সর দিয়ে মাটির আদ্র্যতা ও পুষ্টি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, আর কৃষকরা মোবাইল অ্যাপে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বাজারদর জানতে পারেন। এসব প্রযুক্তি কৃষকদের খরচ কমায়, উৎপাদন বাড়ায় এবং ফসলের গুণগতমান উন্নত করে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে কৃষি ডিজিটালাইজেশনের গতি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ছোট কৃষকদের কাছে এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে তুলতে হবে। স্মার্ট কৃষি কেবল উৎপাদনশীলতাই বাড়াবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে কৃষিতে বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।
‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ: মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধানে একটি যুগান্তকারী ডিজিটাল সিস্টেম ‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা জমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার থেকে মুক্তি পাবে এবং তাদের ব্যয় সাশ্রয় হবে! পাশাপাশি পরিবেশ ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের কৃষিতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই খামারী এই অ্যাপস এর মাধ্যমে ফসল অনুযায়ী কৃষকরা তাদের জমির লোকেশন এবং ক্রোপজনিং বেইজ সার ব্যবহার করতে পারেন।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা: বাংলাদেশের কৃষকরা বছরের পর বছর কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন, কিন্তু অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকেরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। এর ফলে তারা কৃষিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। কৃষকের অধিকার রক্ষায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য সরকারকে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কৃষিপণ্য সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও কৃষি গুদামজাতকরণ উন্নয়ন করতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হবেন, উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হবেন এবং দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য শুধু কৃষকের প্রাপ্যই নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কৃষিতে নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ: বাংলাদেশের কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য উচ্চফলনশীল, জলবায়ু সহনশীল ও রোগবালাই প্রতিরোধী নতুন জাত আবিষ্কার এবং এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল জাতীয় ফসলে নতুন জাত উদ্ভাবন করছে। এসব জাত কম পানি, কম সার ব্যবহার করেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম। একইসাথে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইড্রোপনিকস, ভার্টিক্যাল ফার্মিং, স্মার্ট সেচ ও যান্ত্রিক কৃষিকাজকে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষকদের এসব নতুন জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও কৃষক, তিন পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই কৃষি খাতকে আধুনিক ও উৎপাদনশীল করা সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি সংস্কার শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ, এবং কৃষকদের সঠিক মূল্যের নিশ্চয়তা প্রদান করলে কৃষি হবে টেকসই ও লাভজনক। বাংলাদেশ যদি পরিকল্পিতভাবে কৃষি সংস্কারের এই ধাপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে একদিকে কৃষক হবে স্বাবলম্বী, অন্যদিকে দেশও অগ্রসর হবে একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার দিকে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কৃষিতে অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মাটির অবক্ষয়, জলাশয়ের দূষণসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকরা প্রায়শই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। এ প্রেক্ষাপটে কৃষিতে সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি। এজন্য অযাচিত কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, জৈব প্রযুক্তি ও বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহারের প্রসার, কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন, নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাই হতে পারে একটি কার্যকর রূপরেখা। নিম্নে সরকারের কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো :
কৃষিতে অযাচিত বালাইনাশক ব্যবহার কমানো : বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে কীটনাশকের ভূমিকা থাকলেও অযাচিত ও অতিরিক্ত ব্যবহার বর্তমানে এক বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। অনেক কৃষক পরামর্শ ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন, যার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, পানিদূষণ ঘটে এবং মানুষের খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। এটি কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বরং পরিবেশের জন্যও হুমকি। তাই কৃষিতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) গ্রহণ করা জরুরি। কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে তারা সঠিক সময়ে ও পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে শিখেন। এছাড়া সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বিকল্প পদ্ধতি যেমন জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ বা জৈব সার ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতে হবে। এই উদ্যোগগুলো কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাবে, খাদ্য নিরাপদ রাখবে এবং পরিবেশ রক্ষা করবে।
মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা: মাটি কৃষির প্রাণ। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় মাটির জৈব উপাদান ও উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। মাটির এই অবক্ষয়ের কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং কৃষকরা আগের মতো ফলন পাচ্ছেন না। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জৈব সার, সবুজ সার ও কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। মাটির পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করা জরুরি। সরকার ইতিমধ্যে ‘মাটি পরীক্ষা কার্ড’ বিতরণ শুরু করেছে, যা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষকরা যদি মাটির স্বাস্থ্য বুঝে চাষাবাদ করেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ফসলের উৎপাদন বাড়বে, জমি উর্বর থাকবে এবং পরিবেশও সুরক্ষিত হবে। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে মাটির প্রতি যত্নশীল হওয়াই হবে সর্বপ্রথম শর্ত।
অর্গানিক বা জৈব (বায়ো পেস্টিসাইড) বালাইনাশক ব্যবহার বাড়ানো: অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে এখন জৈব বা বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব বাড়ছে। বায়ো পেস্টিসাইড প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়, যেমন নিমের নির্যাস, ট্রাইকোডার্মা, ব্যাসিলাস বা অন্যান্য অণুজীবভিত্তিক সমাধান। এগুলো পরিবেশের জন্য নিরাপদ, মাটির উর্বরতা রক্ষা করে এবং খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ রাখে না। বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে, তবে এখনও এটি পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সরকারকে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখাতে হবে যে বায়ো পেস্টিসাইড শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং খরচও তুলনামূলক কম। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে সুনাম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাস্থ্যকর জীবন দিতে হলে জৈব কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকে কৃষকের ভর্তুকি কমানো: বাংলাদেশে কৃষি খাতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে সরকারের ভর্তুকি কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়েছে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। সস্তায় পাওয়া যাওয়ায় কৃষকরা অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন, যা মাটি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষকদের টেকসই বিকল্পে উৎসাহিত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জৈব সার উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া, কম্পোস্টিং প্রযুক্তি সহজলভ্য করা এবং বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহারে সহায়তা প্রদান। পাশাপাশি কৃষকদের ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তুকি নীতি সংস্কার করলে শুধু পরিবেশই রক্ষা হবে না, বরং কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থাও দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল হবে।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি: ডিজিটাল প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিকে আধুনিক ও টেকসই পথে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ড্রোন, সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), আইওটি (IoT), ও মোবাইল অ্যাপস এখন কৃষিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের রোগ-পোকার অবস্থা শনাক্ত করা যায়, সেন্সর দিয়ে মাটির আদ্র্যতা ও পুষ্টি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, আর কৃষকরা মোবাইল অ্যাপে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বাজারদর জানতে পারেন। এসব প্রযুক্তি কৃষকদের খরচ কমায়, উৎপাদন বাড়ায় এবং ফসলের গুণগতমান উন্নত করে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে কৃষি ডিজিটালাইজেশনের গতি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ছোট কৃষকদের কাছে এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে তুলতে হবে। স্মার্ট কৃষি কেবল উৎপাদনশীলতাই বাড়াবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে কৃষিতে বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।
‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ: মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধানে একটি যুগান্তকারী ডিজিটাল সিস্টেম ‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবন করেছেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা জমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার থেকে মুক্তি পাবে এবং তাদের ব্যয় সাশ্রয় হবে! পাশাপাশি পরিবেশ ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের কৃষিতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই খামারী এই অ্যাপস এর মাধ্যমে ফসল অনুযায়ী কৃষকরা তাদের জমির লোকেশন এবং ক্রোপজনিং বেইজ সার ব্যবহার করতে পারেন।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা: বাংলাদেশের কৃষকরা বছরের পর বছর কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন, কিন্তু অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকেরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। এর ফলে তারা কৃষিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। কৃষকের অধিকার রক্ষায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য সরকারকে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কৃষিপণ্য সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও কৃষি গুদামজাতকরণ উন্নয়ন করতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হবেন, উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হবেন এবং দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য শুধু কৃষকের প্রাপ্যই নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
কৃষিতে নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ: বাংলাদেশের কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য উচ্চফলনশীল, জলবায়ু সহনশীল ও রোগবালাই প্রতিরোধী নতুন জাত আবিষ্কার এবং এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল জাতীয় ফসলে নতুন জাত উদ্ভাবন করছে। এসব জাত কম পানি, কম সার ব্যবহার করেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম। একইসাথে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইড্রোপনিকস, ভার্টিক্যাল ফার্মিং, স্মার্ট সেচ ও যান্ত্রিক কৃষিকাজকে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষকদের এসব নতুন জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও কৃষক, তিন পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই কৃষি খাতকে আধুনিক ও উৎপাদনশীল করা সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি সংস্কার শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ, এবং কৃষকদের সঠিক মূল্যের নিশ্চয়তা প্রদান করলে কৃষি হবে টেকসই ও লাভজনক। বাংলাদেশ যদি পরিকল্পিতভাবে কৃষি সংস্কারের এই ধাপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে একদিকে কৃষক হবে স্বাবলম্বী, অন্যদিকে দেশও অগ্রসর হবে একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার দিকে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।
মন্তব্য