এবারের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব আমরা একসঙ্গে পালন করছি। ঐতিহাসিক এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করি। তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন।
তিনি প্রথমে নিজকে পরে আওয়ামী লীগকে তার পরে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে ১৩টি মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন।
মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের একপর্যায়ে স্বাধিকারের দাবিতে ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করলে তার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ অর্থাৎ আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ফাঁসি দেবার চেষ্টা করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। তখন বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে সর্বাত্মক গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. সামসুজ্জোহাসহ অসংখ্য শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থান্বেষী মহল কুতর্ক জারি রেখেছে। ’৭০-এর নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না, অথবা হয়তো পেতেন তবে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, ‘এলএফও’র (লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-
‘এলএফও! এই নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো এবং প্রমাণ করবো কে এই দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’
জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন-
ÔThe Legal Feamework Order irked Mujib sorely. He was particularly irritated at Sections 25 and 27 which vested powers of authentication of the future constitution in the President. It implied that Mujib would not be free to implement his six points, even if he obtained majority seats in the National Assembly (Parliament) unless his Constitution Bill received the President’s approval. It is on the issue that Mujib said, I shall tear the LFO in the pieces after the election.Õ (পৃষ্ঠা-১৬-১৭)।
এলএফও-তে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি আসন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সেজন্য এলএফও-তে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নং দু’টি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। এলএফও-তে সন্নিবেশিত দু’টি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পর পরই ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ ও ২৮৮জন এমপিএকে নিয়ে শপথ অনুষ্ঠান করে বলেছিলেন-
“এই গণভোটের মাধ্যমে ৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, ৬ দফা আজ জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।”
এভাবে তিনি ৬ দফাকে আপসহীন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু জানতেন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। এই নির্বাচনে সারা দেশ সফর করে তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার এক মোহনায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেন। নির্বাচনের পর পরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডির ৩২ নং-এ ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে-একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব থাকব, সেজন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন মুখস্থ করো। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, ‘সানি ভিলা, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা তো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম।’
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের মধ্যেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ৬ দফা। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্বাচন পেছালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। নির্বাচনের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি কয়টি আসন পাবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হবো যদি আমি দুটি আসন হারাই।’ বিস্ময়ের ব্যাপার দুটি আসনই আমরা হারিয়েছিলাম। একটিতে নুরুল আমিন অন্যটিতে রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন।
নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ’৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্রনাথ মুখার্জী, তথা পিএন মুখার্জী-যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় চেয়েছেন তিনি আক্রান্ত হবেন, কিন্তু আক্রমণকারী হবেন না। তাই তো ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যেটা সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছেন-
“When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the ‘People’s Republic of Bangladesh.’ It said, ‘This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)।
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এরকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এই ঘোষণাটিই ’৭১-এর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এমএ হান্নানের কণ্ঠে বার বার প্রচারিত হয়।
২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘প্রামাণ্যকরণ কমিটি’র চেয়ারম্যান মফিজউল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ সংকলনের ৩ নং খণ্ডে আছে, ‘জিয়াউর রহমান মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ ঘোষণা দেন।’ কিন্তু ২৬ তারিখ তো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক ইতোমধ্যে ডিফেক্ট করে যুদ্ধ শুরু করেছেন। সুতরাং, ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কথা মোটেও সত্য নয়। যারা ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণার কথা বলে, তারা অসত্য কথা বলে। বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে-এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেওয়া হবে না।’ এই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচার হয়। সামরিক শাসক কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে, আমার মতো একজন ক্ষুদ্রকর্মীকেও নিজের অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করল।
১৯৭১-এর ২০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকে মার্শাল ল কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল আমাদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আজকাল বিভিন্নজন বিভিন্নরকম দাবি করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা ছাত্রলীগের কেউ কিছু করতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতা হিসেবে যা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের অগ্রগামী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা পালন করত। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করেন। ’৭১-এর শহিদ দিবস ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এদিন মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবীকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজী নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবো। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরবো। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করবো না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দিবো না।”
ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকে গৃহীত গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“...গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ...পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সনে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৬৬ সনের আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়, ১৯৫৮ সনে দেশে সামরিক আইন জারী করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। জনাব জেড এ ভুট্টো ও পিপলস পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ...বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ...আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতিস্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সংকল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারেনি। ...আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি-যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনীতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাবো।”
এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ বংশধরদের যাতে একটি কলোনিতে তথা উপনিবেশে বসবাস করতে না হয় তার অংশ হিসেবে ‘স্বাধীন দেশের’ কথা বলছেন।
’৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বক্তব্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয় এবং স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন-
“অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।”
এরপর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরম কাঙ্ক্ষিত দিন ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রবিবার। সংগ্রামী বাংলা সেদিন অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। বঙ্গবন্ধু যখন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন জনসমুদ্র পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। সেদিন নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। দেশকে স্বাধীন করে জাতির পিতা তার জীবনের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করেছেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। সেই লক্ষ্য পূরণে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
যে বাংলাদেশকে একদিন হেনরি কিসিঞ্জারসহ পৃথিবীর অনেকেই হাস্যাস্পদ মন্তব্য করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি, বাংলাদেশ হবে দরিদ্র দেশের মডেল।’ আজ তাদের বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ ’৭৫-এ ছিল স্বল্পোন্নত আর আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দঘন ক্ষণে সর্বান্তকরণে কামনা করি, জাতির পিতার আরাধ্য স্বপ্নের বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যাবার মহতীযাত্রা অব্যাহত রাখবে।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
বাংলাদেশ আজ এমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে, যাকে সহজভাবে বলা যায়- ‘ইতিহাসের মোড়।’ জুলাই আন্দোলনের পর রাজনৈতিক অঙ্গন, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে রূপান্তর ঘটেছে, তা আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। একইসাথে, সেই সম্ভাবনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে নানা শঙ্কা। আমরা কেউই কোনো অস্থিতিশীলতা কামনা করি না। প্রশ্ন হলোÑআমরা কোন পথে হাঁটব? পরিবর্তনের পথে? নাকি অস্থিতিশীলতার পথে? গত এক সপ্তাহের সংবাদপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এই প্রশ্ন এখন কেবল রাজনীতিবিদদের নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের মনে।
জুলাই আন্দোলনকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় বাঁক বলা যায়। এটি কেবল একটি সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষ ও ক্ষোভকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। মানুষ নেমেছিল রাজপথে, দাবি ছিল ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আন্দোলনের পরপরই প্রশ্ন উঠছে- এই অর্জন কি টেকসই হবে? ইতিহাসে আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর আস্থা না ফিরলে পরিবর্তন ভেঙে পড়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার পরপর রাজনৈতিক বিভাজন এবং আস্থার সংকট দেশকে বিপর্যস্ত করে তোলে। একইভাবে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক বছরে গণতন্ত্র নিয়ে আশাবাদ থাকলেও পরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ও বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সেই আস্থাকে ক্ষয় করেছে।
আজকের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই শঙ্কা সামনে এসেছে- যদি আস্থা ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে পরিবর্তনের শক্তি আবারও দুর্বল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছেÑ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে নানা বক্তব্য। এক পক্ষ বলছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মহল সক্রিয়। অন্য পক্ষ বলছে, সরকারের ভেতরের অদৃশ্য শক্তিই স্থিতিশীলতার পথে বাঁধা। এ ধরনের পারস্পরিক সন্দেহ সমাজকে বিভক্ত করছে।
এখানে আন্তর্জাতিক উদাহরণ টানা যায়। আরব বসন্তের সময় মিসর ও লিবিয়ার জনগণ গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছিল। কিন্তু আন্দোলনের পর বিভাজন ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এতটাই বেড়ে যায় যে, কয়েক বছরের মধ্যে দেশগুলো আবারও অরাজকতার দিকে চলে যায়। মিসরে সেনাশাসন ফিরে আসে, লিবিয়া এখনো গৃহযুদ্ধ থেকে বের হতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হলো- শুধু আন্দোলন যথেষ্ট নয়, আন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বড় কাজ।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝেই এসেছে একটি সুখবরÑবাংলাদেশ জাতিসংঘের শর্ত পূরণ করে ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। স্বাধীনতার পর যে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হয়েছিল, সেই দেশ এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে উন্নয়নশীল হিসেবে।
কিন্তু একইসাথে, সাধারণ মানুষের জীবনে চাপ বাড়ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কর্মসংস্থানের সংকট তীব্র। তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বেকার। গ্র্যাজুয়েট বেকারত্ব দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলেÑঅর্থনৈতিক অর্জন তখনই স্থায়ী হয়, যখন তা মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়। ভুটান উদাহরণ হতে পারে- সেখানে জিডিপি দিয়ে নয়, বরং ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি- এসবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি শুধুমাত্র ‘LDC থেকে উত্তরণ’ কে গর্বের বিষয় বানায়, অথচ মানুষের দৈনন্দিন কষ্ট কমাতে না পারে, তবে সেই উত্তরণ অর্থহীন হয়ে পড়বে।
আজকের বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশাল প্রভাব ফেলছে। জনগণ দ্রুত খবর পাচ্ছে, কিন্তু একইসাথে গুজব ও বিভ্রান্তিও দ্রুত ছড়াচ্ছে। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি, অনেক ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে হাজারো মানুষকে প্রভাবিত করেছে। তাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব এখন আগের চেয়ে বেশি। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সত্য সংবাদ প্রচার, গুজব প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশের মাধ্যমেই আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সংলাপের অভাব। বিরোধী দল ও সরকার একসাথে বসে সমস্যার সমাধান করতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে দ্বন্দ্ব অস্থিরতায় পরিণত হয়। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল। এটি একটি ইতিবাচক নজির। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে, অস্থিরতা বেড়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে তাই সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমÑসবাইকে মিলেই একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে।
এক্ষেত্রে বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। সেগুলো হলো-১. স্বচ্ছ নির্বাচন: স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ২. ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা: অতীতের অপরাধ ও দুর্নীতির বিচার দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে করতে হবে; ৩. অর্থনৈতিক সমতা: উন্নয়ন যেন কেবল পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে ‘অস্থিতিশীলতা কাম্য নয়’ শিরোনামের এই কথাটি আজ শুধু একটি সম্পাদকীয়র সতর্কবার্তা নয়, বরং পুরো জাতির আকাঙ্ক্ষা। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেই পরিবর্তন যেন অরাজকতা, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় না গড়ায়। পরিবর্তন হোক ন্যায়নিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থিরতা বারবার আমাদের উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে। এবার আমাদের সামনে সুযোগ আছে ভিন্ন ইতিহাস লেখার। যদি আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি, এবং অর্থনীতিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি, তবে এই পরিবর্তন সত্যিই স্থিতিশীল হবে।
কারণ উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, উন্নয়ন মানে মানুষের আস্থা, ন্যায়বিচার ও শান্তি। আর সেখানেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকের বৈশ্বিক আলোচনায় একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন, কোন দেশ গণতন্ত্রের মডেল হতে পারে? একসময় ইউরোপ এবং আমেরিকা ছিল বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা সুইডেনকে দেখে অনেক দেশ ভেবেছিল- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা একসঙ্গে এগোতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হতো ‘গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা’। আর এখন কেনেথ ভোগেলের মতো বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডমোক্র্যাসি’কে বলেন ‘ডলারোক্র্যাসি’। রাতারাতি এখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কীভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে, সেটি বিশ্বেও বিভন্ন রাষ্ট্র দেখে অনুমান করা যায়। ইউরোপও আজ আর সেই শক্তি বা আত্মবিশ্বাস দেখাতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভ্যন্তরীণ বিভাজনে জর্জরিত, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে, আর রাশিয়া ও চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসন গর্বের সঙ্গে বিশ্বে বিকল্প বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তাহলে আজকের তরুণেরা গণতান্ত্রিক রোল মডেল খুঁজবে কোথায়? আশ্চর্যের বিষয়, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো রাষ্ট্র আমাদের শেখাচ্ছে যে কঠিন বাস্তবতার মাঝেও গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। জ্যাকব জুমা বা জাইর বলসোনারোর মতো নেতাদের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা সত্ত্বেও জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে আবারো সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছে। তাইওয়ান, উরুগুয়ে, মরিশাস কিংবা বতসোয়ানার মতো ছোট দেশও প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বা ভৌগোলিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী রাখা সম্ভব।
এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে? স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে পথচলা শুরু করলেও বারবার হোঁচট খেয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং মানুষ নতুন আশা নিয়ে ভোট দেয়। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ হয়নি। পরবর্তী তিন দশকেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র আস্থার জায়গায় পৌঁছায়নি। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে শত্রু হিসেবে দেখে রাজনীতিকে শূন্য-যোগের খেলায় পরিণত করেছে। নির্বাচনী অনিয়ম, সহিংসতা, প্রশাসনিক পক্ষপাত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা গণতন্ত্রের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করেছে। ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থা দেখিয়েছে, রাজনৈতিক সংকট কতটা ভয়াবহ হতে পারে। সেই সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয় এবং গণতন্ত্র সাময়িকভাবে স্থগিত হয়। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও গণতন্ত্রে ফেরা হয়, কিন্তু এরপরের কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থেকে গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যেখানে অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি, অথবা ২০১৮ সালের নির্বাচন যেখানে ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এসব ঘটনা গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়েছে।
তবুও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক দিকও আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনো মানুষের রক্তে প্রবাহিত। দেশের তরুণ প্রজন্ম গণতন্ত্র, অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আগ্রহী। সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো গণতন্ত্রের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি তরুণ প্রজন্মের জন্য গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রকে টেকসই করতে বড় কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। প্রথমত, দুর্বল প্রতিষ্ঠান: নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, দলীয় সংস্কৃতির আধিপত্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থকে জনগণের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য একদিকে ধনী শ্রেণি ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, অন্যদিকে দরিদ্র জনগণ বঞ্চিত থাকে। চতুর্থত, রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই গণতন্ত্র কেবল আইন বা নির্বাচনের মাধ্যমে সীমিত থাকে, বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে না।
বিশ্ব যখন গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণে ভুগছে, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদি বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। পাকিস্তান যেখানে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপে বিপর্যস্ত, আর শ্রীলঙ্কা যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, সেখানে বাংলাদেশ যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে, তবে এটি শুধু দেশের ভেতরে নয়, বরং গোটা অঞ্চলের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হতে পারে।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান যুগে ফেসবুক শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং আয়-উপার্জনেরও একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। অনেকেই আজ ফেসবুক ব্যবহার করে কনটেন্ট তৈরি, ব্যবসা প্রচার, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন কিংবা অনলাইন শপ পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। সত্যি বলতে কি, সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে এটি কর্মসংস্থান তৈরির একটি ভালো সুযোগ।
কিন্তু বাস্তবে ফেসবুক থেকে আয় করা কি এতই সহজ! আমার বোঝা মতে মোটেও সহজ নয়। নিয়মিত মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করা, দর্শককে আকৃষ্ট করা, ফলোয়ার বাড়ানো এবং ফেসবুকের কঠোর নীতিমালা মানা—এসবই অনেক সময় ও পরিশ্রম দাবি করে। অনেকেই দীর্ঘ সময় চেষ্টা করার পরও কাঙ্ক্ষিত ফল পান না। অ্যালগরিদম পরিবর্তন, ভুয়া অনুসারী, কিংবা মনিটাইজেশনের শর্ত পূরণে ব্যর্থতা- এসব কারণে অনেকের বহুদিরেন চেষ্টা কষ্ট পুরোই বৃথা হয়ে যায়। ফলে এটি শুধু সহজ টাকা রোজগারের রাস্তা নয়, বরং ধৈর্য, কৌশল ও পরিশ্রমের একটি ক্ষেত্র।
বেশকিছু দিন ফেসবুকের এই ইনকামের বিষয়টা মাথায় খুব ঘুর ঘুর করছে। তবে ইনকাম করার জন্য নয়, মানুষ যেভাবে ইনকাম করার জন্য হুমড়ী খেয়ে পড়েছে সেটা। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, লাইভের নেশায় ছেলে বুড়ো, নারী, শিশু, ঘরের মেয়ে-বউ, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে বিষয়টি আমার কাছে খুব অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে। আর একটা বিষয় হলো মডেলিং এবং ফ্যাশন ডিজাইন এই জিনিসগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে একেবারে মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দিতে পেরেছে। এক শ্রেনীতো একেবারে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্য নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় বিষয়গুলোকে উন্মুক্ত করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যা খুবই দৃষ্টিকটু। মুরব্বী বা বাচ্চাদের সামানে ফেসবুক ওপেন করা রীতিমত ভয়ের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো এই লেখায় মনক্ষুন্ন হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে কাউকে আঘাত করার জন্য বা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হয়ে এ লেখা নয়। আমার কাছে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের মনে হচ্ছে। আমরা যদি ধর্মীয় দিক বিবেচনা করি, তাহলে ভেবে দেখেন হয়তো আপনার স্ত্রী বা মেয়ের যে পুরুষের সাথে কোনদিন কোনভাবেই দেখা হতো না, নামই জানতো না। যার বউকে আপনি কোনদিনও চিনতেন না। তাকে আপনি প্রতিদিন দেখছেন। যেভাবে দেখা যেত না, সেভাবেও দেখছেন! আর যারা মডেলিং ও ফ্যাশনকে ঘরে নিয়ে গিয়েছে তাদের কথাতো বাদ, তারাতো নিজেকে আকর্ষণীয় এবং মোহনীয় করেই উপস্থাপন করছেন। অনেকে পাগলই হয়ে গিয়েছে, কি করছে, কি পোস্ট করছে, কি বলছে, কি লিখছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
আর ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে যদি বলি। ইনকামের আশায় অনেকেই সেটা জলাঞ্জলী দিয়েছে, তার ব্যক্তিত্বের সাথে যেটা যায় না, তাও সে সেটা করছে। একজন লোক চলনে বলনে বেশ ভুশায় সব কিছু, পুরাই ইসলামিক কিন্তু ইনকামের আশায় উনি এমন কিছু করছেন যা তার সাথে বেমানান। উনি হয়তবা সেটা বুঝতেও পারছেন না। অনেকের এই ধরনের ভিউ বাড়ানোর পোস্টের জন্য অহংকার, অহমিকা, ধনীত্ব, বড়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। এটা কি ইসলাম সমর্থন করে? আজকে কি কি খেয়েছেন- লোভনীয় সব খাবারের ছবিসহ পোস্ট করে দিলেন। ঘরে কি কি রান্না হয়েছে লোভনীয় সুন্দর সুন্দর খাবার সব পোস্ট করে দিলেন। এটাতো সারা দেশ জুড়ে অনেকেই দেখছেন, একবারও ভেবেছেন এর মধ্যে অনেকেই আছে যার কাছে খাবারটি কাঙ্খিত কিন্তু কিনতে পারছে না। এমন লোকও থাকতে পারে যে ঐদিন তার বাসায় খাবারই নেই! মচৎকার চমৎকার দামি ড্রেস পোস্ট দিলেন, অনেক বাচ্চা তার বাবার কাছে একটি নতুন ড্রেসের জন্য বায়না করে বহুদিন অপেক্ষা করছে। বাবা দিতে পারছে না, বাচ্চাও পাচ্ছে না- তারাওতো আপনার পোস্টটি দেখেছে, হয়তো সে আপনার আত্মীয়।
কি আলিশান বাড়ি করেছেন! কি চমৎকার ফ্লাট! কি সাজ সজ্জা! দামী দামী ফার্নিচার! পোস্ট করে দিলেন। একবারও ভেবেছেন অনেকের কাছেই জিনিসগুলো খুব কাঙ্খিত, কিন্তু তিনি এসব করতে পারছেন না। এমনকি অনেকেই আছেন আপনার আত্মীয় বা ফেসবুক ফ্রেন্ড তার সাথে বাড়িওয়ালা জঘণ্য ব্যবহার করেছে অল্প কয়টা টাকা বাড়ি ভাড়া বাকি আছে বিধায়। এগুলো কি অহংকার, অহমিকা, ধনীত্বর প্রচার নয়! আবার এমনও আছে সে কিসে চাকুরী করে কয় টাকা বেতন পায় সবাই জানে, কিন্তু যে বাড়ি বা ফ্লাটের পোস্ট দিচ্ছে তা তার সারা জীবনের বেতন দিয়েও কেনা সম্ভব নয়। ভাবে না যে মানুষ কি ভাববে, আমি এটা কিভাবে কিনলাম! সারা জীবন দুই নাম্বারী টাকা ইনকাম করছে, ঘুষ খেয়ে খেয়ে বাড়ি গাড়ি সবই করছে যা সর্বজন স্বীকৃত। অবসরে গিয়ে চলে গেলেন হজ্জ করতে বা ওমরা করতে। প্রতিদিন পোস্ট দেয় আজকে এই করলাম, কালকে এই করলাম। আরে পরিচিত মানুষের যখন চোখে পড়ে মানুষ তখন কি ভাবে, একবার ভেবেছেন! দোয়া করে! না বরং উল্টা গালি দেয়।
ভিউ বাড়ানোর নেশায় অনেকের দেখলাম সম্পর্কে তার ভাগনী বা খালা বা ফুফু, দেখতে সুন্দর, আকর্ষনীয় বেশ তার সাথে ছবি একটা তুলে দিয়ে দিল। এমন পোজ মনে হয় যে নায়ক নায়িকা। ভাল ব্যক্তিত্ববান লোক, সুযোগ পেয়েছে একটু খোলামেলা বা দৃষ্টিকাড়া পোশাকে কোন পরিচিত নারী বা সেলিব্রেটি, বেশ একটা ফটো তুলে দিয়ে দিল। আমাদের একটু এসব বিষয়গুলো ভাবা দরকার।
আমাদের দেশে মানুষ একেবারে ফেসবুকের ইনকামের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বিশেষ করে অনেক নারী সংসারের দায়িত্ব অবহেলা করে ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় দিচ্ছেন, যা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করছে। লজ্জাশীলতা বজায় রাখা, সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং পরিবারের দায়িত্ব পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ফেসবুকের কারণে কেউ লজ্জাহীন হয়ে পড়ে বা সংসারের প্রতি উদাসীন হয়, তবে তা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফেসবুক থেকে আয় করা সম্ভব এবং এটি নতুন প্রজন্মের জন্য সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। তবে একে সহজ মনে না করে কঠোর পরিশ্রম, সৃজনশীলতা ও ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ফেসবুক ব্যবহার যেন আদর্শ, লজ্জাশীলতা, পরিবারের দায়িত্ব এবং নৈতিকতার ক্ষতি না করে—এটা নিশ্চিত করা জরুরি। সঠিক নিয়তে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে ফেসবুক উপকারী হবে, আর ভুল পথে ব্যবহার করলে এটি দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
রাজনীতি যে শুধু আদর্শের লড়াই নয়, বরং এক জটিল অর্থনৈতিক কাঠামো, তা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। রাজনীতিকে কার্যকর রাখতে দল চালানোর খরচ, নির্বাচনী প্রচারণা, কর্মী পরিচালনা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল অর্থ আসে কোথা থেকে? এবং এর ওপর জনগণের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কতটা নজরদারি রয়েছে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস মূলত সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতার নাম। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও গণআন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে দেশে যে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে চরম মূল্য পরিশোধের ফল। কিন্তু এই কাঠামোর ভিত মজবুত হওয়ার পরিবর্তে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দিক থেকে। রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক নকশা, অনুদান আহরণের পদ্ধতি ও নেতৃত্বের আচরণগত চরিত্র। রাজনীতি আজ আর জনসেবার ব্রত নয় বরং তা এক ধরনের উচ্চ ব্যয়ের ‘পেশায়’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতা দখলই মুখ্য লক্ষ্য, আর আদর্শ, নৈতিকতা কিংবা জনস্বার্থ প্রায়শই পেছনের সারিতে ঠাঁই পায়। ফলে দল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে নানা অনিয়ন্ত্রিত উৎস, যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ব্যবসায়িক প্রভাব ও অপরাধমূলক জোট। এই বাস্তবতায় রাজনীতি এখন এমন এক প্রতিযোগিতার মঞ্চ, যেখানে নীতির চেয়ে পুঁজি, আদর্শের চেয়ে পৃষ্ঠপোষকতা, আর গণমানুষের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক অর্থায়নের বাস্তবতা-
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অর্থায়ন নিছক একটি প্রশাসনিক প্রয়োজন নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই অর্থায়ন একটি সুসংহত নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার রাজনীতি যেন আর্থিক স্বেচ্ছাচার কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর করায়ত্ত না হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার - যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনী ব্যয় ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান কেবল নির্বাচনী প্রচারণার নয়, বরং রাজনৈতিক অর্থনীতির জটিলতা ও বিস্তৃত কাঠামোর দিকেও ইঙ্গিত করে। এই বিপুল ব্যয়ের মধ্যেও একটি মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। যেখানে উন্নত বিশ্ব অর্থায়নের প্রতি তৈরি করেছে জবাবদিহিমূলক কাঠামো, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র সেখানে দাঁড়িয়ে আছে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও স্বচ্ছতার অভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ইলেকশন কমিশন (FEC), যুক্তরাজ্যে ইলেকটোরাল কমিশন এমনকি ভারতের নির্বাচন কমিশনও তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে, অনুদান গ্রহণে নির্দিষ্ট বিধিমালা নির্ধারণ করে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুদান ও তার উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে। যদিও ভারতে এ সংক্রান্ত কাঠামো থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’-এর মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুদানদাতার পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যা এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির মডেল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের হার ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অনুদান পায়। শর্ত হিসেবে দলগুলোকে বছরের শেষে পূর্ণাঙ্গ অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হয় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হয়। এই নীতিগত কাঠামো রাজনৈতিক অর্থায়নে একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই তুলনায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক অর্থের উৎস ও ব্যয়ের কাঠামোতে ব্যাপক অস্বচ্ছতা, করপোরেট প্রভাব ও পক্ষপাতমূলক সুবিধা প্রদানের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন কাঠামো একদিকে যেমন অস্বচ্ছ, তেমনি ভয়াবহভাবে অনিয়ন্ত্রিত। নির্বাচনী ব্যয়ে নির্ধারিত সীমা থাকলেও বাস্তবতায় তা কেবল কাগুজে নিয়মেই সীমাবদ্ধ। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই ঘোষিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত ব্যয় পাঁচ থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। ফলে একটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়ায়- এই অতিরিক্ত অর্থের উৎস কী? এবং কারা এর মূল সুবিধাভোগী? এই ধরনের প্রশ্নের গভীরে আমরা যে ধরনের উৎস ও সুবিধাভোগী শ্রেণি দেখি-
প্রথমত, দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি এ সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান অর্থদাতা। তাদের দেওয়া অনুদান কোনো নিছক দাতব্য কাজ নয়, বরং এটি এক ধরনের বিনিয়োগ, যার বিপরীতে তারা প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক সুবিধা। সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার, প্রকল্প বরাদ্দ, কর রেয়াত, আমদানি-রপ্তানিতে ছাড়, এমনকি নৈতিক জবাবদিহিতাহীন বাণিজ্যিক পরিবেশ, সবই এর আওতায় পড়ে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন বরাদ্দের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম করে যে অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করে, তার একটি অংশ সরাসরি রাজনৈতিক তহবিলে চলে যায়। ফলে দুর্নীতিকে শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও দলীয় কাঠামোর মধ্যেই যুক্ত করে ফেলা হয়।
সম্ভাব্য সমাধান-
রাজনৈতিক অর্থায়নের অস্বচ্ছতা ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা যদি গণতন্ত্রের এক মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে এর উত্তরণও হতে হবে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে। একক কোনো সমাধান নয়, বরং একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক উদ্যোগই পারে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে জবাবদিহিমূলক ও জনবান্ধব করতে।
১. রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য বৈধ বেতন কাঠামো প্রবর্তন: প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তাদের তৃণমূল কর্মী ও সাংগঠনিক নেতাদের জন্য নির্দিষ্ট হারে সম্মানী বা বেতন প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হবে এবং চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বা সহিংসতায় জড়ানোর প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এই উদ্দেশে দলীয় আয়-ব্যয়ের পূর্ণ স্বচ্ছতা ও বার্ষিক নিরীক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
২. অনুদানের বাধ্যতামূলক প্রকাশ ও নথিভুক্তি: যেকোনো ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ৫,০০০ টাকার অধিক অনুদান নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এতে অনুদানের উৎস ও প্রভাব উন্মুক্ত থাকবে, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গোপন লেনদেনের অবকাশ কমবে।
৩. নির্বাচনী ব্যয়ের ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও নিরীক্ষা: নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রতিটি খরচের ডিজিটাল রসিদ সংরক্ষণ ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় তা অডিটের আওতায় আনা আবশ্যক। মোবাইল অ্যাপ, ব্লকচেইনভিত্তিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা বা অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
৪. সরকার-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক অনুদান তহবিল (State Funding): উন্নত বিশ্বের অনুকরণে যদি সম্ভব হয় বাংলাদেশেও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত তহবিল চালু করা। ভোটের হার, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলো নির্ধারিত অনুদান পাবে। এর বিনিময়ে দলগুলোকে বছরে একাধিকবার আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব কমিশনে দাখিল করতে হবে এবং জনসমক্ষে তা প্রকাশ করতে হবে। এতে বেসরকারি অনুদানের নির্ভরতা কমে যাবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অবৈধ অর্থের প্রবাহ হ্রাস পাবে।
৫. নির্বাচন কমিশনের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: এই সকল পদক্ষেপ কার্যকর করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি স্বাধীন, দক্ষ ও আধুনিকায়নপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে দলীয় আর্থিক অডিট, অনুদান পর্যবেক্ষণ বা নিয়মভাঙায় শাস্তি প্রদানে কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল। কমিশনকে প্রযুক্তি-নির্ভর, আইনগত ক্ষমতাসম্পন্ন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে একটি স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে দলগুলোর আয়-ব্যয়ের ওপর নজরদারি রাখবে।
এই সমাধানগুলো কেবল কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয়; অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। বরং সময়ের দাবি হচ্ছে-রাজনীতি ও দুর্নীতির মধ্যে যে আর্থিক জোট, তা ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।
শেষ কথা-
গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির যখন নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অদৃশ্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক উৎসের হাতে; তখন গণতন্ত্র রূপ নেয় নির্বাচনের মোড়কে মোড়ানো এক বিত্তবানদের খেলায়। যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনীতি গোপন, অনিয়ন্ত্রিত ও ক্ষমতানির্ভর থাকবে, ততদিন গণতন্ত্র জনগণের নয়, বরং অর্থবানের নিয়ন্ত্রণেই আবদ্ধ থাকবে।রাজনৈতিক অর্থায়নের সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দূর করা যাবে না। একটি ন্যায্য ও কার্যকর গণতন্ত্র গঠনের জন্য দলীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা আনা জরুরি। রাজনীতি যদি একটি ‘পেশা’ হয়, তবে এর জন্য বৈধ ‘বেতন’ ও ‘অর্থের উৎস’ থাকা আবশ্যক। না হলে রাজনীতি একটি দুর্নীতির পাইপলাইনে পরিণত হবে, যার খেসারত দেবে গোটা জাতি।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
বাজারে সবজির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। অথচ আলু-পেঁপে আর মিষ্টিকুমড়ো ছাড়া ১০০ টাকার নিচে ভালো সবজি মিলছে না। সামুদ্রিক মাছের ভরা মৌসুম, অথচ মাছের দাম চড়া। ডিম-মাংস, শুকনো নিত্যপণ্যের দামও ঘুরছে বাড়া-কমার চক্রে। বাজারের এমন অস্থির পরিস্থিতিতে ক্রেতার ত্রাহি অবস্থা। নিত্যপণ্যের বাজারে এমন ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা বলছেন, বাজারে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ‘বাজার করতে হবে শুনলেই চোখে অন্ধকার আসে। একটা পণ্যের দাম কমলে পাঁচটার দাম বাড়ে। মাসের পর মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। যদি মাছ-মাংসের দাম বেশি হয়ে সবজির দাম কম থাকতো কিংবা সবজির দাম বেশি হলেও অন্য পণ্যের দাম কম থাকত, তা-ও কোনোমতে মানিয়ে নেয়া যেত। এখন যে অবস্থা, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বাজারের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলছে। আমরা মধ্য আয়ের মানুষ কেমন আছি, কীভাবে চলছি, কেউ জানতেও চায় না, কেউ ভাবেও না। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় তো বাড়েনি।’
কাঁচাবাজারে সবজির মধ্যে কাঁকরোল, ঝিঙা, পটল, ঢ্যাঁড়স, শসা, করলা প্রতিকেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বরবটি ১২০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টমেটো ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কচুরমুখী, লাউ, মূলা কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। গাজর ১৬০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৬০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৪০ টাকা, শালগম ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু মানভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর মিষ্টি কুমড়োর দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কাঁচামরিচ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, ধনেপাতা প্রতি কেজি ১৫০ টাকা আর শাকের মধ্যে কচুশাক ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া শাক ৫০ টাকা, পুঁইশাক ৪০ টাকা ও লালশাক ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের মধ্যে লইট্যা ও ফাইস্যা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, আবার মানভেদে ২২০ টাকা, পোয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, শাপলা পাতা মাছ ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, কোরাল ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, রূপচাঁদা ৩৫০ থেকে ৭০০ টাকা, আইড় ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা, চিংড়ি (বাগদা ও গলদা) আকারভেদে ৬৫০ থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকা, ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৫০০ টাকা, এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০-২০০০ টাকা এবং জাটকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতি কেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খাল-নদী ও চাষের মাছের মধ্যে রুই ও কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাবদা ছোট আকারের ৪০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, পুঁটি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, সরপুঁটি ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, নাইলোটিকা ২২০ থেকে ২৮০ টাকা, কৈ ২০০ থেকে ২২০ টাকা এবং পাঙাস, সিলভার কার্প মিলছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। ছোট চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে। বিক্রেতারা জানালেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সামুদ্রিক ও খাল-নদীর কয়েকটি মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম আবার বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। সোনালি মুরগির দাম কিছুটা কমে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, পাকিস্তানি কক ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা, দেশি মোরগ ৬৫০ টাকা এবং জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। অন্যান্য মাংসের মধ্যে গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৯৫০ টাকা, খাসি ও পাঁঠা ছাগলের মাংস ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজন প্রতি ১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দেশি মুরগির ডিম ১৮০ টাকা ও হাঁসের ডিম ২৩০ টাকা ডজন প্রতি বিক্রি হচ্ছে।
এমতাবস্তায় এখন নীতি সহায়তায় বাজারে সাপ্লাই ঠিক রাখতে হলে ডিলার ও বাজারে সবসময় পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে সক্ষম ডিলার ও বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রাখা সম্ভব হয় না। ফলে মিল থেকে পাঁচ-সাত দিন সরবরাহ কিছু কম হলেই বাজারে তার প্রভাব পড়ে। ভোগ্যপণ্যগুলো মূলত কৃষিপণ্য, এগুলোর উৎপাদন অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হয় আবার কোনো বছর উৎপাদন কম হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের অস্তিরতা তৈরি হয়। বর্তমান বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রায়ই অস্থিরতা বিরাজ করে। এ অস্থিরতা থেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে কমোডিটি মার্কেট চালু হয়েছে, যা কার্যকর করা জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে সময়ভিত্তিক নীতিসহায়তা দরকার। তাছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে। পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া অতীব জরুরি। খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক মান বজায় রেখে সরবরাহ নিশ্চিত রাখা। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাধা হলো আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা। যেমন বলা যেতে পারে বিএসটিআই নীতির সঙ্গে পিউর ফুডের অনেক নীতির মিল নেই। আবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতির সঙ্গেও সমন্বয়হীনতা আছে, যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সমন্বয়হীনতা দূর করা জরুরি। এই মুহূর্তে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দূর করা প্রথম ও প্রধান কাজ। যেমন ভোক্তা অধিদপ্তর, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, পিউর ফুড, ফুড সেইফটি অথরিটিসহ সবার উচিত একক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একক নীতির মাধ্যমে ব্যবসাকে পরিচালিত করা। দুগ্ধজাত দ্রব্য ও প্রাণিজ আমিষের (মাছ, মাংস, ডিম) দাম কমানোর সুযোগ সীমিত। এখানে দুটি মূল বিষয় হলো—প্রথমত, বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-জোগানের ওঠাপড়ার ওপর দাম নির্ভর করে। আর মৌসুমভেদে নানা রকম কারণে দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া সারাটা বছর তো আর এক রকম যায় না। বন্যা, খরাসহ নানা রকম দুর্যোগের শিকারও হতে হয়। সেজন্য আমরা ‘সারা বছরের জন্য এক পরিকল্পনা’ করতে পারি না । কেন আমরা পোলট্রির দাম নির্ধারণের জন্য সারা বছরের পরিকল্পনা করতে পারি না? শুধু এ হিসাবে না গিয়ে আমরা যদি উৎপাদনকারীদের জন্য বাজার ও মূল্যসহায়তা (মার্কেট ও প্রাইস সাপোর্ট) নিয়ে কাজ করি সেটাও বাজারে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে। উৎপাদনকারীদের ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার মতো সক্ষমতার ব্যবস্থা করা উচিত। কেননা, অনেক সময় দাম এতটা পড়ে যায় যে তার সঙ্গে মিল রেখে উৎপাদন খরচ একদমই কমেনি। বিদ্যুতের রেট কমেনি, খাদ্য-ওষুধ ও শ্রমের মজুরিও আগের মতোই আছে; তাহলে উৎপাদন খরচ না কমে বরং আগের মতো বা তার চেয়ে বেশিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে দাম কমানোর ফলে উৎপাদনকারীদের, ব্যবসায়ীদের আয় কমে যাচ্ছে। এ আয়ে তাদের খরচই উঠছে না। এছাড়া ভর্তুকি দেয়ারও একটা বিষয় আছে। ধরা যাক, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যখন বাজারে চাহিদা বেশি থাকে, ব্যবসায়ীরা অনেক আয় করেন। কিন্তু আবার বছরের যে সময়টাতে ওদের এ আয়-ইনকাম থাকবে না তখন সাবসিডি দেয়া যায় কিনা। এতে ক্রেতারাও ভালো থাকবেন আবার আমাদের ব্যবসায়ীরাও ভালো থাকবেন। কিন্তু ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলে ক্রেতাকে সুবিধা দেয়ার যে সামগ্রিক ক্ষতি; সেটা নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। একই কথা কৃষি ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বাম্পার ফলন হলে কৃষককে অতি অল্প দামে—২ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করতে হয়, সেই আলু আবার ৪০ টাকা কেজিতে ঢাকায় বিক্রি হয়। পণ্যমূল্যের ওপর কোনো নীতি প্রণয়ন করা অথবা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষিদ্রব্য যেহেতু দ্রুত পচনশীল তাই দাম নির্ধারণীতে সেটা শিল্পপণ্যের মতো কাজ করবে না। সেজন্য আমার মূল চেষ্টার জায়গাটি হলো, উৎপাদন খরচের জায়গায় কিছু কাজ করা। কেননা, এটা কমাতে পারলে কৃষিপণ্যে আর মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির দরকার হবে না। কৃষিতে যন্ত্রপাতির দাম কমানো, বাজার সুরক্ষা, ফিডসহ গবাদিপশু খাদ্যের দাম কমানো, সরকারিভাবে চারা, পোনা সরবরাহ—এগুলো করা প্রয়োজন । সিন্ডিকেট করে ফিডের দাম বাড়ানো, এমনকি দেখা যায় অনেক সময় বাজার কোম্পানি দ্বারা নয়, ডিলারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ জায়গাগুলোয় শক্তিশালী রেগুলেটরি ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ভাবে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রন সম্ভব হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
আমরা প্রতিদিন অসংখ্য প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করি। মিনারেল ওয়াটার, কোল্ড ড্রিংক, জুস কিংবা বিভিন্ন বেভারেজের জন্য এই বোতলগুলো আমাদের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আধুনিক জীবনের প্রতীক। কিন্তু এই ক্ষণিকের সুবিধার পিছনে যে ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী মূল্য আমরা দিতে চলেছি তা অনেকেই গভীরভাবে ভেবে দেখি না। প্লাস্টিকের বোতল কেবল মাত্রাবিহীন বর্জ্য নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়ংকর বিষদাঁতের মতো যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং মানব স্বাস্থ্যকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। একটি বিপজ্জনক চক্র প্লাস্টিক বোতলের জীবনচক্রটি শুরু হয় জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) থেকে। এর উৎপাদন প্রক্রিয়াই অত্যন্ত সম্পদ-নিঃশেষকারী এবং দূষণকারী।
একটি একলিটার প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে প্রায় ২৫০ মিলিলিটার তেল, ৩ লিটার পানি এবং প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন) নিঃসরণ হয় যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে। আশ্চর্যজনকভাবে একটি প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করতে যতটা পানি খরচ হয় অনেক সময় তার চেয়ে বেশি পানি বোতলটি প্যাকেজিং এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়। এটি পানির একটি চরম অপচয়। ল্যান্ডফিল, নদী ও সমুদ্রের দূষণ প্লাস্টিক বোতলের সবচেয়ে বড় এবং দৃশ্যমান সমস্যা হলো এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
অবিশ্বাস্য পরিমাণ বর্জ্য- বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৯%-এর মতো রিসাইকেল হয়। বাকি ৯১% বোতল যায় ল্যান্ডফিলে পোড়ানো হয় বা সরাসরি প্রকৃতিতে (নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র) পড়ে থাকে। প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে কখনও সম্পূর্ণভাবে পচে না। এটি শত শত বছর হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকে এবং ধীরে ধীরে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি, পানির উৎস এবং সমুদ্রে মিশে যায় যা পুরো ইকোসিস্টেমকে বিষিয়ে তোলে।
সমুদ্রের জীবন ধ্বংস: প্রতি বছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হয়। সামুদ্রিক প্রাণীরা (কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন, সামুদ্রিক পাখি) এগুলোকে খাদ্য ভেবে খেয়ে ফেলে যা তাদের পেটে আটকে থেকে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর কারণ হয় অথবা তারা দূষিত হয়।
মানব স্বাস্থ্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এই নীরব ঘাতক প্লাস্টিক বোতল, শুধু পরিবেশের জন্যই নয় আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্যও একটি বড় হুমকি। রাসায়নিক মাইগ্রেশন করে বেশিরভাগ প্লাস্টিকের বোতল PET (Polyethylene Terephthalate) বা অন্যান্য প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, যাতে শিল্প রাসয়নিক বিসফেনল BPA (Bisphenol-A) এবং Phthalates (থ্যালেটস)-এর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এই রাসায়নিকগুলো বোতলে রাখা পানিতে এবং অবশেষে আমাদের দেহে মিশে যায় বিশেষ করে যদি বোতলটি গরম পরিবেশে থাকে বা পুনরায় ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে BPA এবং Phthalates (থ্যালেটস) মানবদেহের জন্য এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর (হরমোনের ভারসাম্য নষ্টকারী)। এগুলো ক্যান্সার (বিশেষ করে ব্রেস্ট ও প্রোস্টেট ক্যান্সার), বন্ধ্যাত্ব, শিশুদের বিকাশগত সমস্যা, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জড়িত। আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষিত পানি ও খাদ্য (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, লবণ) এর মাধ্যমে সরাসরি আমাদের দেহে গ্রহণ করছি। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো আমাদের রক্তস্রোত, ফুসফুস প্লাসেন্টাতেও পাওয়া গেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। অর্থনৈতিক বোঝা- অদৃশ্য খরচ-প্লাস্টিকের বোতলের সস্তা দামটি একটি বিভ্রম। এর আসল খরচ আমরা অন্য খাতে গুনি। নদী, ড্রেন, সৈকত, এবং রাস্তাঘাট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করতে সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্লাস্টিক দূষণ ও রাসায়নিক এক্সপোজার থেকে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে একটি বিশাল চাপ তৈরি হয়। দূষিত সৈকত ও নদী পর্যটকদের আকর্ষণ হারায়, যা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ। একইভাবে প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছের মজুত কমে যাওয়া মৎস্য খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
প্লাস্টিক বোতলের অদৃশ্য বিষ- আরও গভীরে যে ক্ষতিগুলো জানা হয়নি-প্লাস্টিক বোতলের ক্ষতি শুধু যে দৃশ্যমান দূষণ সেখানেই সীমাবদ্ধ নয় এর প্রভাব আরও গভীর, সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী। আগের আলোচনায় যেসব দিক আসেনি, সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো:
বায়ু দূষণ ও বিষাক্ত নিঃসরণ: শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যেই ঝুঁকি
* পোড়ানোর সময় বিষাক্ত গ্যাস: যখন প্লাস্টিকের বোতলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় (যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ ঘটনা), তখন তা ডাইঅক্সিন (Dioxin), ফুরান (Furan) এবং অন্যান্য মারাত্মক কার্সিনোজেনিক (ক্যান্সার সৃষ্টিকারী) যৌগ নির্গত করে। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলি বায়ুতে মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসের রোগ, হরমোনের ব্যাঘাত ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
* উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দূষণ: প্লাস্টিক বোতল তৈরির কারখানা থেকে নিয়মিত ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (VOCs) এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বাতাসে মিশে। এর ফলে কারখানার আশেপাশের জনবসতিতে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যায়।
* মাটির গঠন ও উর্বরতা হ্রাস: ল্যান্ডফিলে বা প্রকৃতিতে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ধীরে ধীরে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মাটির ভৌত গঠন পরিবর্তন করে, এর জল ধারণক্ষমতা এবং বায়ু চলাচলের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এটি মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতার উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটি দূষণ ও কৃষির উপর প্রভাব ফেলে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়।
* কীটপতঙ্গ ও রোগের আবাস: পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, যা মশা (如 ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া) এবং অন্যান্য রোগের বাহক পোকামাকড়-এর প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি।
* রাসায়নিক মাটির গভীরে প্রবেশ: প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক (BPA, Phthalates (থ্যালেটস) মাটিতে শোষিত হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে দূষিত করে এমনকি ফসল তাদের শিকড় মাধ্যমে-এ প্রবেশ করে, যা অবশেষে আমাদের খাদ্য চেইনে -এ পৌঁছায়।
সামাজিক ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন: দূষণের অসম বোঝা
* পরিবেশগত বর্ণবাদ (Environmental Racism): প্লাস্টিক বোতলের ল্যান্ডফিল, পুনর্ব্যবহারকারী কারখানা এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট-গুলি সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানে হয়। এর ফলে এই কমিউনিটির মানুষ অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
* অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারী এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য বাছাইকারীগণ। তারা প্রায়ই কোনো সঠিক নিরাপত্তা গিয়ার, গ্লাভস, মাস্ক) ছাড়াই কাজ করেন। এর ফলে তারা সরাসরি ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং প্যাথোজেন-এর সংস্পর্শে আসেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি।
অর্থনীতির উপর অদৃশ্য খরচ: উত্পাদনশীলতার ক্ষতি
* কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হ্রাস: মাটি ও পানি দূষণের ফলে কৃষি ও মৎস্য খাত-এর উত্পাদনশীলতা কমে যায়। পান। এটি সরাসরি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা এবং এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষদের জীবনযাত্রা হুমকিতে ফেলে দেয়।
* স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি: প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কিত রোগ (শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হরমোনজনিত ব্যাধি)-এর চিকিৎসা করতে সরকার এবং ব্যক্তিকে -কে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা যা প্রায়শই অচেনা থেকে যায়।
* জৈব বৈচিত্র্যের উপর Cascade (ক্যাসকেড প্রভাব) খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘ্ন যখন ছোট প্রাণী বা প্লাঙ্কটন-মাইক্রোপ্লাস্টিক খায়, তখন এটি পুরো খাদ্য শৃঙ্খল অভ্যাসে পরিনথ হয়। বড় প্রাণরা যখন এই দূষিত ছোট প্রাণীগুলো খায়, তখন তাদের শরীরেও টক্সিন জমা হয়। এটি সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং বিপন্ন প্রজাতিদের বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের করণীয় –
আমরা যদি আজই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের একটি বিষাক্ত, দূষিত ও দুর্বিষহ পৃথিবী উপহার দেবো। তাদেরকে বিশুদ্ধ পানি ও বায়ুর জন্য সংগ্রাম করতে হবে, দূষণজনিত নানা রোগে ভুগতে হবে, এবং একটি বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করতে হবে। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যে আমরা তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাই। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতি রোধ করতে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি প্রত্যেককেই ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল (স্টিল, কাচ, বিপিএ মুক্ত) ব্যবহার করা এটি সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর সমাধান।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল এড়িয়ে চলুন।
বাড়িতে ও বাইরে ওয়াটার পিউরিফাই বা ফিল্টার ব্যবহার করুন।
যদি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সঠিকভাবে রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থা করুন।
সচেতনতা তৈরি করুন, পরিবার ও বন্ধুদের উদ্ধুদ্ধ করুন।
শিল্প ও সরকারি পর্যায়ে বর্ধিত উৎপাদক দায়িত্ব (ইপিআর) চালু করা অর্থাৎ উৎপাদকদেরকে তাদের পণ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বা উচ্চ কর আরোপ করা।
রিসাইক্লিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার আরও শক্তিশালী ও ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করা।
বিকল্প প্যাকেজিং বায়ো-ডিগ্রেডেবল উপাদানের গবেষণা ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করা।
একদমশেষে বলা যায়, প্লাস্টিকের বোতল আমাদের আধুনিক জীবনের একটি বিভ্রমমাত্র। এটি আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের নামে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষৎতকে গিলে খাচ্ছে। এই সুদূরপ্রসারী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আজই -এই মুহূর্তেই সচেতন হতে হবে এবং পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপই আমাদের এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে।
লেখক: মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট, ক্রিলিক-এলজিইডি।
ছায়া ভালোবাসা অর্থনীতি এমন একটি অর্থনীতি, যাকে ঘিরে আমরা তেমন চিন্তা করি না। অথচ এই অর্থনীতির আওতায় পরিবার, সমাজ তথা দেশ বলতে গেলে টিকে আছে। এই অর্থনীতির কথা মুখে বললেও চিন্তাও করি না এবং সে রকম গুরুত্বও দেই না। অনেকে অবশ্য বলে থাকেন যে, এই হিসাব এমন যে খাতায় আছে। অথচ গোয়ালে গরু নেই। কিন্তু এ কথাটি মোটেই ঠিক নয়। কেননা এর আলটিমেট সুবিধা আমরা কড়ায় গণ্ডায় পেয়ে থাকি। অবশ্য জিডিপিতে সরাসরি যোগ না হলেও, বাস্তবতার নিরীক্ষে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আর এ বিষয়টি নিয়ে অর্থনীবিদরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কম কথা বলেন না? মূলত এই অর্থনীতি হলো সহজাত প্রবৃত্তির আড়ালে বাবা অথবা মা কর্তৃক সন্তান-সন্ততি ও পরিবার আগলিয়ে রাখার প্রপঞ্চ। আর এটিকে ভিত্তি করে প্রকৃতিগত অমোঘ টানে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ ও ভালোবাসাসহ উদ্ভুত নিয়ামকের সূত্র ধরে নানা রকম কাজ পজিটিভ মিথস্ক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে এবং এর আওতায় সন্তানের যত্ন বা পরিচর্যা ও হাউজহোল্ডসহ বিবিধ কাজ স্বতস্ফূর্তভাবে আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হলো যে, এই সামগ্রিক কাজকর্ম মানি ভ্যালুর কভারে চিন্তা করি না। ভাবি, এগুলো তাদের একান্ত নিজস্ব অপরিহার্য কাজ। এর আবার মানি ভ্যালু কি? কিন্তু অবশ্যই এর মানি ভ্যালু আছে এবং জিডিপিতে পরোক্ষভাবে যোগ হয়। কিন্তু খাতা কলমে হিসাবের বাইরে থাকে। আসলে এটি ছায়ার মতো স্বকীয়তা নিয়ে অবস্থান করে থাকে।
পরিবারের ক্ষেত্রে যতই কাজ করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। আদিতে যে রক্ত সম্পর্ক ধর্মীয় বন্ধন বা সংঘবদ্ধ জীবন এবং নেতৃত্বের সৃষ্টি করেছিল, সে বিষয়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ ব্যাপারে ভালোবাসার আদলে স্বীকৃত স্নেহ, প্রেম, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, যোগাযোগ রক্ষা বা সংঘ গঠন ছাড়া মানুষের বসবাস করা সম্ভব নয়।
এ বিশ্বে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত মিলে প্রায় ২০৬টি রাষ্ট্র আছে এবং এ বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় আট শত কোটি, যার অর্ধেক হলো নারী। উন্নত বিশ্বে নারী অনেকাংশে মর্যাদা নিয়ে থাকলেও, আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকূল তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। আর জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রে পুরুষকূল যা দাবী করে, আসলে তা নয়। এদিকে সংবিধানে সমধিকারের কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করেন। তবে শহরে যারা বাস করেন, সে ক্ষেত্রে মেয়েরা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও গ্রামের বেচারী মেয়েদের কি যে হাল? তা বলে শেষ করা যাবে না। সেই যে ভোর-রাত্রি থেকে কাজ শুরু করে, যেমন- সন্তানদের পরিচর্যা, ধান সিদ্ধকরণ, উঠান ঝাড় দেয়া, পানি আনা, নাস্তা তৈরি করা, দুধ দোহন করা, গরুর ঘাস দেয়া, ধান শুকানো, ধান ভানা. শ্বশুর-শাশুড়ীর দেখাশোনা, ক্ষেতে কার্যরত স্বামীকে খাবার পাঠানো, মুরগি, গরু বা ছাগল পালন, উঠানের পাশে শাক-সবজিতে পানি দেয়া, ইত্যাদি আরও কত কি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। আর এ সব কাজ করে মধ্য রাতের আগে ঘুমানোর ফুরসৎ পায় না। অথচ বাংলাদেশের কালচারে এটি চিরাচরিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ ধরনের গৃহস্থালীর কাজ করার জন্যই নারীর জন্ম এবং যদিও তারা একান্ত নিরবে ভালোবাসার টানে তা করে থাকেন। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা এটি ছায়া ভালোবাসার অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা যে এতে অবদান রাখে, তদনুযায়ী মর্যাদা পায় না। সেহেতু জনৈক বিট্রিশ বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, They beset with so many household affairs without raising any question. Thus for fostering these phenomena put forth the voice of love of these voiceless women.
এতদ্ব্যতীত গৃহকর্তা হিসেবে সংসারকে ঘিরে বাবা যে বিভিন্ন আঙ্গিকে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বজনীনভাবে ‘মা’ ও ‘বাবা’ কে উচ্চ আসনে বসানো হয়েছে। এই দুব্যক্তির নিঃস্বার্থ, চিরন্তন ও স্বভাবজ অবদানের কথা; সব পর্যায়ে স্বীকার্য। যাহোক, অর্থনীতির দর্শন ও নরম অনুযায়ী বলা হয় যে, তাদের এ লাগাতার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড নাকি অর্থনীতির আওতায় নয় বিধায় অর্থের মূল্যে নিরূপণ করা হয় না। তবে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এ কৃষি নির্ভরশীল অর্থনীতিতে তাদের এ ভালোবাসাসুলভ কাজ যদি না হতো, তাহলে মনে হয় অর্থনীতি দুমড়ে পড়তো। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এটিকে অর্থনীতির আওতায় আনতে সচেষ্ট হয়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, দেশের ১০ বছর বয়সী বা তদোর্ধ নারীগণের গৃহস্থালী কর্মকাণ্ডের ‘সময়’ বছরে ১৬,৬৪১ কোটি শ্রম ঘন্টা, যা অর্থের হিসেবে মূল্যায়ন করলে দাঁড়ায় আনুমানিক ২৪৯,৬১৫.০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাম ও শহুরে নারীর শ্রমের অংশ যথাক্রমে ৭৯% এবং ২১%, তাই মনে করি, তাদের এই ভালবাসাসুলভ গৃহস্থালীর কর্মকাণ্ড প্রসূত অবদান জিডিপিতে অবশ্যই বিবেচনায় আনা সমীচীন। নতুবা বৃক্ষের গোড়াতে অন্ধকার থাকলে কোনোভাবেই গাছের পুরোপুরি চেহারা যেমন দেখা যায় না। তেমনি আর্থ-সামাজিক দিক-দিয়ে যে কোনো পরিকল্পনা নেয়া হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে শ্রম বিন্যাস ও বিশেষায়িত উৎপাদন নির্ণয় করা কখনো সম্ভব হবে না, সব জগাখিচুরী হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাক্কালে জিডিপিতে নারী ও পুরুষের কার কত অংশ, তা কোনক্রমেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা থাকবে না। এদিকে অধুনা বিট্রিশ এক জরীপে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা কাজের প্রতি অধিকতর আন্তরিক এবং এ সূত্র ধরে সংসার বা সমাজের মঙ্গল কামনায় তুলনামূলক তারা অবদান বেশি রাখে। মূলত মেয়েরা হিসেবী এবং নীতিনিষ্ঠ এবং সাধারণত মেয়েরা সিদ্ধান্ত নেয় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে। কিন্তু পুরুষরা ততটা না ভেবে পৌরুষোচিত আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিধায় মাঝে-মধ্যে ছন্দপতন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই আঙ্গিকে আনুপাতিক হারে মেয়েদের এ ভালোবাসাপ্রসূত কর্মকাণ্ড খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
বিগত ১০/০৯/২০২৫ইং তারিখে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশীল কাজের অবদান প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। এ সূত্র ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস) জানায় যে, রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, শিশু ও বৃদ্ধের যত্ন নেওয়া; কিংবা অসুস্থের সেবা, ইত্যাদি হিসাবের মধ্যে আনা হয়েছে। এসব অদৃশ্য শ্রমের বার্ষিক অর্থনৈতিক মূল্য দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন বা ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর এই অঙ্ক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৮ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। এর মধ্যে নারীর অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ অবদান পুরুষের, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লাখ কোটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে সাত গুণ সময় দেন অবৈতনিক কাজে। একজন নারী বছরে প্রায় ২১শ ঘন্টা সময় দেন রান্না, ঘর সামলানো এবং শিশু ও প্রবীণদের সেবা যত্নে। অন্যদিকে, একজন পুরুষ এ কাজে ব্যয় করেন গড়ে ৩০০ ঘন্টা। অর্থাৎ মূল্য নির্ধারণের বাইরের কাজে ৮৮ শতাংশই করে থাকেন নারী। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার (০৯/০৯/২০২৫ইং) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস অডিটরিয়ামের প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টে (এইচপিএসএ) এ তথ্য জানানো হয়। অবশ্য ২০২১ সালের ‘সময়’ ব্যবহার জরিপ এবং যুগপৎ ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব নির্ধারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে র) প্রতিস্থাপন খরচ পদ্ধতি ও রর) সুযোগের খরচ পদ্ধতি। এর পর কাজের ধরন বিবেচনা করে সাধারণ পদ্ধতি, বিশেষ পদ্ধতি ও হাইব্রিড পদ্ধতির সমন্বয়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্যায়ণ করা হয়। মূলত হাইব্রিড পদ্ধতিকে বিশ্বজুড়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়। আর এ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক বিবিএসের পক্ষ থেকে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা হয়েছে।
উপর্যুক্ত হিসাব অবশ্যই যুগান্তকারী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো যে দেশের জিডিপিতে প্রায়োগিকভাবে কিভাবে প্রতিফলিত করা হবে। এটিকে কি সামগ্রিকভাবে দেখানো হবে? নাকি শুধু হিসাবের জন্যই খাতা কলমে থাকবে। অবশ্য এ হিসাব যদি সামগ্রিকভাবে টানা হয়। তাহলে জিডিপির কলেবরে কি রকম চেহারা হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন থেকেই দেখতাম; অর্থনীতি নরম হিসেবে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর অবদান হিসাবে আনা হয় না। অথচ সেই কাজ যদি চাকর বা চাকরানী করে, তাহলে সসম্মানে বিবেচনায় আনা হয়। তাই আমি অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো যে, এর সামগ্রিক প্যারামিটার বিশ্লেষণপূর্বক একটি প্রতিবেদন যেন দেশবাসীর গোচরে আনা হয়। তাহলে সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক ধারণা হবে এবং হিতকরও কম হবে না?
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আর প্রতিষ্ঠানটি একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে প্রস্তুত করছে নির্বাচনী রোডম্যাপ।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরের মধ্যে মূল প্রস্তুতির কাজ সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কার, আচরণবিধিমালা জারি, ভোটার তালিকাসহ সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে। আর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ছোট-খাট সহ অন্তত ৪৪টি সংস্কার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যা শীঘ্রই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে ইসি।
এদিকে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা বাংলাদেশের মত কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক সদস্য এবং নেক্সাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিল্পপতি, আনছারিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বিজিএমইএ ফোরামের মহাসচিব ও বিজিএমইএ পরিচালক -- ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী দীর্ঘদিন ধরে মাঠে আছেন দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার কাজে। তবে গ্রুপিং দ্বন্দ্বে দিশেহারা লাকসাম-মনোহরগঞ্জের তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে আশার আলো জুগিয়েছেন দুর্দিনে দলের হাল ধরা নেতা ড. হোসাইনী।
সাবেক ডাকসু সদস্য ও যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী নিউজবাংলা২৪.কমকে একান্ত স্বাক্ষাৎকারে এলাকার উন্নয়নে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানান।
ড. হোসাইনী বলেন, আমার এলাকার শিক্ষিত,আধা শিক্ষিত এবং সব শ্রেণীর মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আর সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি এলাকায় গেলে, আমার কোন সিকিউরিটি লাগে না, আমার কোন বডিগার্ড লাগে না। আমার কাছে সাধারণ মানুষরা খুব সহজেই কাছে আসতে পারে। আর আমি এলাকার মানুষকে বেশি ভালোবাসায় তারা সহজেই আমাকে গ্রহন করে। আমি ছাত্রদল-যুবদল করে আজ বিএনপিতে এসেছি। আমি বিএনপিতে সংস্কার, আবিস্কার ও বহিষ্কার নই। আমি কখনও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। আমি যেদিন থেকে পয়সা কামানো শুরু করেছি ওই দিন থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।
অতীত আর বর্তমান নিয়ে বিএনপির এই নেতা প্রসঙ্গ ক্রমে বলেন, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কথা বলা হয়েছে। এখন যে প্রেক্ষাপট এসেছে আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি হলেও পক্ষান্তরে মানুষ কিন্তু আরও বেশি। যার কারণে প্রশাসনিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে অনেকগুলি থানা, জেলা এমনকি বিভাগও বাড়িয়েছে। এর অংশ হিসেবে লালমাই (লাকসাম) থানা হয়েছে।
যখন ১৯৯৮ সালে আমি বৃহত্তর লাকসাম-এর যুবদলের আহ্বায়ক ছিলাম, তখন লালমাই আমাদের ছিল। আজকে যারা বিএনপি করে, তারা আমার হাতেই সৃষ্টি। আমি তখন যাদের সাথে বিএনপি করেছি তাদের মধ্যে আকতার ভাই,অলিউল্লাহ,সোলায়ইমান চেয়ারম্যান সহ অনেকে এখন নাই। আর লাকসাম যারা রাজনীতি করে তার মধ্যে বহুল আলোচিত শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আবুল কালাম (চৈতী কালাম) আমরা একই ইউনিয়নের। তিনি ২০০১ সালে বিএনপিতে পদার্পণ করে। এটা উনার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে উনি সদা বলেন।
১৯৯৬ সালে বিএনপি পরাজিত হবার পর ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে লাকসামে কথা বলার লোক ছিল না।
১৯৯১ সালে আলমগীর সাহেব এমপি হওয়ার পরেও দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হন।উনি সাংগঠনিকভাবে তেমন তুখোর কোনো রাজনীতিবিদও ছিলেন না।
এ টি এম আলমগীর সাহেব এর আগে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ১৯৯১ সালে নমিনেশন দেওয়ার পর থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। তিনি বিএনপির কর্মী বা নেতা হিসেবে নমিনেশন নেয়নি। উনি তখন চাকরি করতেন । নমিনেশন কনফার্ম করার পরে চাকরি ছেড়ে দেন। দলের নেতাকর্মীদের সাথে তার সে সময় তেমন যোগাযোগ না থাকার কারণে সুসংগঠিত করতে পারেননি, যার ফলে লাকসামে নেতাকর্মী দের মাঝে একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল।আর বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাস করতে পারেনি।উপ নির্বাচন করে পাস করতে হয়েছে।
বিএনপি নেতা ড. হোসাইনী আরো বলেন, পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনে মোকসেদ আলী সাহেব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিএনপি নেতারা তার সাথে চলে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে বিএনপি’র হাল ধরার লোক ছিল না।তখন বৃহত্তর লাকসাম উপজেলার বিএনপির সভাপতি প্রয়াত নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবু নাসের ভূঁইয়া,আমি, নুরুন্নবী চৌধুরী (ছাত্রদলের দায়িত্বে ছিল), সার্বিক দায়িত্বে আরও ছিলেন সাবেক এমপি রাশেদা বেগম হীরা,কাজী আবুল বাশার (শিল্প ব্যাংক কর্মকর্তা-করমচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক), গিয়াসউদ্দিন কালু(আদমজী জুট মিলের সিবিএ, সাধারণ সম্পাদক), এ,কে,এম আতিকুর রহমান লিটন (বৃহত্তর লাকসাম উপজেলা বিএনপি সদস্য)।
আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। তৎকালীন জননেতা মির্জা আব্বাস যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জননেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র।তখন আমরা কুমিল্লার অবিসংবাদিত নেত্রী রাবেয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর ভাই,শাহ মোহাম্মদ সেলিম সবাই মিলে লাকসাম বিএনপি সুসংগঠিত করতে নানান ভাবে চেষ্টা করেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে এক করতে পারছিলাম না। এবং আমরা কাকে দিয়ে দল গোছাবো এর জন্য উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই সময়ে আমাকে যুবদলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন কেন্দ্রীয় নেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্রসহ সিনিয়র নেতাদের কথা অনুযায়ী আমি বৃহত্তর লাকসামের যুবদলের দায়িত্ব নেই। আর আমি ছাত্রদল যুবদল করার পরেই কিন্তু ওই সময় বিএনপি শুরু করি।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হোসাইনী বলেন, আমার রাজনীতির জন্ম ১৯৮৬ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির মাধ্যমে। আমি ১৯৯০ সালে নির্বাচিত ডাকসুর মেম্বার ছিলাম। ১৯৮৬ সালে সর্বকনিষ্ঠ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলাম। ১৯৯৪ সালে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। পরবর্তীতে দাদা গয়েশ্বর সভাপতি থাকাকালীন সময়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয় সম্পাদক ছিলাম। এরপরে আমি ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করি। আর তখন প্রথম ২০০৭ সালে নির্বাচিত বিজিএমইএর পরিচালক হয়েছি। এবং সে সময়েই কুমিল্লা জেলা বিএনপি কমিটির আমি সদস্য ছিলাম। সামনে পূর্নাঙ্গ কমিটি আসছে, দলের স্বার্থে আশা করি তারা অবশ্যই আমাকে রাখবে হয়তো। তাই সবার উদ্দেশ্যে বলবো দলের জন্য আমাদের ত্যাগ, দলের জন্য শ্রম, দলের জন্য আমার কমিটমেন্ট যেমন ছিল, তেমনি আছে এবং ভর্বিষৎতেও থাকবে। মনে রাখতে হবে সবার আগে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রেক্ষাপট নিয়ে ড. হোসাইনী বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারুণ্যের যে চাহিদা বিশেষ করে আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব, উনি যে ভাবে মর্যাদাপূর্ণ দেশ গড়ার লক্ষ্যে ৩১ দফা দিয়েছেন এটা দেশ গড়ার জন্য তরুণদের কাজে আসবে। একটা কথা আছে,এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। সোনার বাংলা গড়তে হলে যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।
হোসাইনী আরো বলেন, যারা সত্যিকার অর্থে এই দলের একনিষ্ঠ কর্মী, যারা ছাত্রদল করেছে, যারা যুবদল করেছে, যাদের ছাত্রদল, যুবদলের ট্যাগ রয়েছে, যারা দুঃসময়ে দল থেকে সরে যায়নি, যাদের ক্লিন ইমেজ, যাদের চরিত্রে দোষ খুঁজে পাবেন না, শিক্ষিত এবং যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, মাদকাসক্ত নয়,যাদের রাজনীতি করার ক্যাপাসিটি আছে,গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদেরকে তারেক রহমান মূল্যায়ন করবে এটা আমার বিশ্বাস। আমার প্রত্যাশা,দল যদি ভালো মনে করে আমাকে নমিনেশন দেয় আমি দল ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করব। আর যদি দল মনে করে আমার চেয়ে ভালো কেউ আছে,তাহলে আমি মাথা পেতে নেব। এক কথায় দলের সাথে আমি কোনদিন বিরোধিতা করি নাই আর কোন দিন করবো ও না। সামনে নির্বাচন, আমি চাই সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে খুঁজে পাক।
দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গ নিয়ে ড. হোসাইনী বলেন, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম তখনও আমরা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারিনি। আমরা ৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান করেছি স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে, তখনও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি, যার কারণে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছে যেটা ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট যেটাই বলি না কেন। আমি আশা করি, যারা শহীদ হয়েছে, রক্ত দিয়েছে সেই শহীদদের রক্তের সাথে কেউ বেইমানি করবেন না।
হোসাইনী আরো বলেন,একটা সত্যিকার চাঁদাবাজ মুক্ত,মাদকমুক্ত,সামাজিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, দুর্নীতিমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় কমিটমেন্ট ও তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ ও দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবো অনন্য উচ্চতায়।
তিনি বলেন, কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) বা লালমাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে নির্বাচন করার জন্য আমি প্রস্তুত আছি। আমি বাংলাদেশের কোন আসনেই ভয় পাই না। আমি মনে করি সারা বাংলাদেশ আমাদের, আমাদের প্রতীক একটাই “ধানের শীষ” আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ, আমার নেতা তারেক রহমান। আমাদের আদর্শ ৩১ দফা। তারেক রহমানের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এবং ধানের শীষের বিজয় হবে ইনশাল্লাহ।
এলাকার জনগণের উদ্দেশে ড. হোসাইনী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে চাই; তারা এখন পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নাই। তারা সবাই প্রতিবাদ মুখর। একসাথে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বো, আমরা কোন চাঁদাবাজ, দখলবাজ মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তকে প্রশ্রয় দিবো না এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাব।যারা এই অপকর্ম করবে আপনারা সাংবাদিকগন স্থানীয় জনগণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে সত্য প্রকাশ করুন। ইনশাল্লাহ সুদিন আমাদের আসবেই।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোঃ সোহেল রানা- প্রতিবেদকঃ নিউজবাংলা২৪.কম
মন্তব্য