× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য ইভেন্ট শিল্প উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ কী-কেন ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও ক্রিকেট প্রবাসী দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকা ইউরোপ সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ শারীরিক স্বাস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য যৌনতা-প্রজনন অন্যান্য উদ্ভাবন আফ্রিকা ফুটবল ভাষান্তর অন্যান্য ব্লকচেইন অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

google_news print-icon

বাঙ্গাল ভাষার লড়াই

বাঙ্গাল-ভাষার-লড়াই
আজকে যেমন অনেকের কাছে পূর্ব বাংলার ভাষা মানে মুসলমানি বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষা মানে শুদ্ধতর/প্রমিততর/সনাতনী বাংলা, চিরকাল কিন্তু বিতর্কের বিবেচনাটা সম্প্রদায়ভিত্তিক ছিল না। বাংলা ভাষার ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং প্রাচীনতম কোন্দলটি ছিল বরং আঞ্চলিকতার। পূর্ববাংলার ভাষারীতিকে গৌণ কিংবা উপহাস করাটা ছিল তার বৈশিষ্ট্য, মুসলমানি ভাষা বলে তাকে খোঁটা দেয়া হয়নি। অন্যদিকে বিশ শতকের শুরুতে উপনিবেশোত্তর মুসলমানরা বাংলায় সাহিত্যচর্চা শুরু করলে, বাংলা ভাষার হিন্দু রূপ ও মুসলমান রূপ নিয়ে নতুন একটা বিতর্ক শুরু হয়।

হিন্দুসংহতি নামের পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক গৌণ একটি সংগঠনের একটা পোস্টার থেকে আলাপ সামনে এলো আবারও, বাংলাদেশি ভাষাকে সনাতনী ভাষা থেকে পৃথক করবার দাবি করেছে সংগঠনটি। কেবল এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনটির কারণেই নয়, পূর্ব বাংলার ভাষা আর পশ্চিম বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য, ভালো-মন্দ, শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণামূলক অনেক আলাপও বহুকাল ধরেই হয়ে এসেছে। আমার আলাপটা তাই উপসংহার দিয়েই শুরু করি।

আজকে যেমন অনেকের কাছে পূর্ব বাংলার ভাষা মানে মুসলমানি বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষা মানে শুদ্ধতর/প্রমিততর/সনাতনী বাংলা, চিরকাল কিন্তু বিতর্কের বিবেচনাটা সম্প্রদায়ভিত্তিক ছিল না। বাংলা ভাষার ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং প্রাচীনতম কোন্দলটি ছিল বরং আঞ্চলিকতার। পূর্ববাংলার ভাষারীতিকে গৌণ কিংবা উপহাস করাটা ছিল তার বৈশিষ্ট্য, মুসলমানি ভাষা বলে তাকে খোঁটা দেয়া হয়নি। অন্যদিকে বিশ শতকের শুরুতে উপনিবেশোত্তর মুসলমানরা বাংলায় সাহিত্যচর্চা শুরু করলে, বাংলা ভাষার হিন্দু রূপ ও মুসলমান রূপ নিয়ে নতুন একটা বিতর্ক শুরু হয়।

দ্বিতীয় পর্বের এই হট্টগোলের সাথে পূর্ব-পশ্চিম আঞ্চলিকতার কোনও সম্পর্ক ছিল না বরং সেই তর্কের অন্যতম একটি চরিত্র কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বর্ধমানের লোক, অর্থাৎ ভাষার সাম্প্রদায়িক রূপ কেন্দ্রিক বিরোধটা ছিল স্থাননিরপেক্ষ। কেবলমাত্র ১৯৪৭ সালের পর ভাষারও স্থানভিত্তিক সাম্প্রায়িক চেহারা তৈরি হয়। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ভাষা অর্থে মুসলমানি বাংলা এবং বিপরীতক্রমে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা অর্থে সনাতনী/হিন্দু/প্রমিত বাংলা এই দুইটি বর্গে বিভক্ত হয়। স্থান ও সম্প্রদায়ের এই সমাপতনের জটিলতা থেকে মুক্ত করে এইখানে আপাতত আমরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ইতিহাস আলোচনা করব না বরং আঞ্চলিক বিভাজনটার ওপরই কিছুটা আলোক ফেলবার চেষ্টা করব।

জিম্মিসংকট

বছর কয়েক আগে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার এক আলাপচারিতায় দাবি করেন ‘জিম্মা’ শব্দটা বাঙলাভাষায় নেই, কারণ পশ্চিমবঙ্গে কেউ এটা ব্যবহার করেন না। ভদ্রলোককে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক: ‘...আজকের কাগজে আছে, কতজন বাঙালি বা বাংলাদেশিকে লিবিয়া জিম্মা নিয়েছে, ৪০০ বাঙালি। ‘‘জিম্মা’’ শব্দটা কেন লিখবে? ‘‘জিম্মা’’ তো বাংলা শব্দের ধারে কাছে নেই।... আত্মীকরণ দিয়ে বুঝতে চান, যে কোনো ভাষার ওপর শব্দ আসবে। যেমন, ইংরেজিতে টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট হিসেবে এসেছে। সেটা অভ্যেস হিসেবে এসেছে। পশ্চিম বাংলায় কোনো মানুষের ভাষায় জিম্মা শব্দ শুনবেন না। কবিতা পড়েন, গদ্যে পড়েন, গল্প পড়েন। কোথাও জিম্মা শব্দটা ছিল না। এগুলো কেন জানি মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে এইসব শব্দ টুকটুক করে ঢোকাচ্ছে। আমার চেয়ে আপনারা ভালো বুঝবেন (যেগুলো আকাশে ভাসে সেগুলো তাৎক্ষণিক সাহিত্য : সাখাওয়াত টিপু ও ফরিদ কবির এর সাথে কথোপকথন) !’

উদ্ধৃত অংশটুকুতে উর্দু-আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিষয়ক একটা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক গন্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে সমরেশ খুব জোর গলাতেই বলতে পারছেন যে বাংলা ভাষার শুদ্ধতার মানদণ্ড হলো পশ্চিমবঙ্গে তার প্রচলন আছে কি-না, অর্থাৎ স্থানের বিরোধটা আমরা এখানে পাচ্ছি। সেখানকার কেউ যদি জিম্মা/জিম্মি ব্যবহার না করেন, তাহলে শব্দটার আত্মীকরণের দাবি করা যাবে না।

তথ্যগত দিক দিয়ে সমরেশের দাবি যে অত্যন্ত ভুল তাতে সন্দেহ নেই। ভাষার গতিশীলতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে ভাবনার প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, তা নিতান্তই কিশোরসুলভ এবং বিপজ্জনক রকম রক্ষণশীল। ‘জিম্মা’ শব্দের পক্ষে সমরেশ মজুমদারের তুলনায় বাংলা ভাষার অনেক বড় ওজনদার, অনেক বেশি মহত্তর সাক্ষীর দোহাই দিতে পারি, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তার ‘কাব্য: স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট’ নামের রচনাটি থেকে উদ্ধৃত করা যাক: ‘‘কপালকুণ্ডলার শেষ পর্যন্ত শুনিয়া তবু যদি ছেলেমানুষের মতো জিজ্ঞাসা কর ‘‘তার পরে” তবে দামোদর বাবুর নিকটে তোমাকে জিম্মা করিয়া দিয়া হাল ছাড়িয়া দিতে হয়।’

আমাদের মতো বাঙ্গালরা সব হাফ ছেড়ে বাঁচে। ভাগ্যিস রবি ঠাকুরের বরাত দেয়া গেল। না হলে জিম্মা-জিম্মি-জিম্মাদার-এর মতো কতগুলো অতি জরুরি শব্দও ‘অনাত্মীয়’ তকমায় ভাষার ভেতর-বাড়িতে আর ঢুকতে পেত না, সমরেশীয় শুদ্ধি অভিযানে হয়তো তাদের বিদায় দিতে হতো। পশ্চিমবঙ্গে আদৌ ব্যবহৃত না হয়ে যদি থাকেও, পূর্ববঙ্গে তো কিছু পরিস্থিতির প্রকাশে ‘জিম্মি’ ব্যবহার অনিবার্য। পণবন্দী শব্দটির ব্যবহার এখানে বিরল, যদিও অজ্ঞাত নয়, জানি না জিম্মদারের বিকল্প সেখানে কী। ন্যাসরক্ষক? কিন্তু প্রশ্নটা এখানে না যে রবিঠাকুর ব্যবহার করে জিম্মাকে আত্মীয়ের স্তরে শোধন করেছেন, সংকটটা আসলে খবরদারির, একটা নির্ধারক মানসিকতার। ঐতিহাসিক নানান কারণে পূর্ববঙ্গের দিক থেকে এই খবরদারির কিংবা শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারের চেষ্টার তেমন কোনো খবর পাওয়া যাবে না। খবরদারি বা মুরুব্বিগিরি না করতে যাবার মাঝে ঔদার্য বা স্বভাবসিদ্ধ মহত্ত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তার মাঝে হয়তো পূর্বাঞ্চলের ঐতিহাসিক/সাংস্কৃতিক যে মুখাপেক্ষিতা পশ্চিমাংশের প্রতি, তারই একটা স্বাভাবিক স্বীকৃতি আছে, তবে নির্ভরশীলতামুক্ত হবার চেষ্টাও আছে। প্রবণতা হিসেবে সাধারণভাবে দেখা যাবে পূর্বাঞ্চলের প্রতিক্রিয়ায় বৈচিত্রের স্বীকৃতি প্রদানের চেষ্টা করে নিজের অবস্থানকে যুক্তিসিদ্ধ করবার চেষ্টা আছে, পশ্চিমের আছে অটল-অনড় প্রমিতের দাবি।

পশ্চিমবাংলার ঐতিহ্যগত আভিজাত্য আর প্রাধান্যের পরও, এমনকি চুম্বকের মতো অদৃশ্য শক্তিতে বহুদূর থেকেই পূর্বের মননের একটা বড় অংশকে মজিয়ে রাখলেও পূর্ববাংলার জল-কাদামাখা বুনো প্রাণশক্তিও কখনও অলক্ষে এবং কখনও প্রকাশ্যে ঠিকই আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেছে। ভাষাকে যদি আমরা একটা সামাজিক উৎপাদ বলে ধরি, পূর্ব বাংলার ভাষার এই শক্তিমত্তার রহস্যটি খুঁজতে হবে বাংলা নামের বদ্বীপের দুই অংশের প্রাকৃতিক গঠনে। এটার পশ্চিমাংশ ভূগোলবিদদের ভাষায় নিষ্ক্রিয়, অন্যদিকে বদ্বীপটির পূর্বাংশ প্রতিবেশগতভাবেই সক্রিয়। তারই ছাপ পড়েছে গত কয়েকশ বছর ধরে এর উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকাশে এবং গত একশ বছরে তার রাজনীতিতে।

বাঙ্গালের দুর্গতি, বাঙ্গালের জবাব

পূর্ব-পশ্চিমের এই ভাষারীতির বিবাদ কিন্তু স্মরণাতীত কালের। কত পুরানো সেই হদিস যে কে জানে, তা জানি না, কিন্তু কত পুরানো হতে পারে, তার একটা আন্দাজ দেয়া সম্ভব। একদা মঙ্গলকাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সমুদ্রযাত্রায় ঝড়ে সওদাগরের সর্বস্বান্ত হবার বর্ণনা। তারপর: ‘সমুদ্র ঝড়ে সর্বস্বান্ত সদাগরের করুণচিত্রের পার্শ্বে মঙ্গলকাব্যের পশ্চিমবঙ্গের কবিগণ একটি হাস্যরসের চিত্রও পরিবেষণ করিতেন, তাহা বাঙ্গাল মাঝিদের খেদ (শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য: বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস)।’ বোঝা গেল এখনকার মতো তখনও নৌচালনার মতো শ্রমসাধ্য কাজে পূর্ববঙ্গের মাঝিমাল্লারাই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু আরও যা বোঝা গেল, বাঙ্গালের ভাষা হাস্যরসের নিয়মিত নিমিত্তও ছিল।

পূর্ব বাংলার ভাষা নিয়ে উপহাসের আরও একটা নির্দোষ এবং পুরাতন উদাহরণ দেয়া যাবে, সেটা রঙ্গপ্রিয় পরমপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের। সেই পরম পাগল চৈতন্যদেব, যার প্রভাবে কবিদের আত্মম্ভর ভনিতা উধাও হয়ে আসলো ভক্তের আত্মনিবেদন, অ-জাতেরেও যিনি বিনা সংকোচে জড়িয়ে ধরতে পারতেন। বাংলা সাহিত্যের সেই সর্বশক্তিমান প্রভাবক ছিলেন খুবই আমুদে মানুষ, হাস্য-পরিহাসে ওস্তাদ। কমবেশি অন্য জেলার উচ্চারণ নিয়ে রসিকতা বাংলায় নির্দোষ পরিহাস হিসেবে সাধারণত বিবেচিত হলেও নিজের পূর্বপুরুষের বসতি সিলেটি উচ্চারণ শুনে তার আমোদ:

‘বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া
কদর্থেন সেইমত বচন বলিয়া ॥’
আর সাধারণভাবে বাঙ্গালের মুখের ভাষা নিয়ে প্রভূর পরিহাস:
‘সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
বঙ্গদেশী যেন মত আছিলের বঙ্গে ॥
বঙ্গদেশী বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙ্গালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া॥’

মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব ঐতিহ্য পাড়ি দিয়ে ঊনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণেও সেই ধারা অব্যাহতই ছিল। বাঙ্গালের দশা যে পাল্টায়নি তার সাক্ষ্য মিলবে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত একটি নাটকের সংলাপে, সেটি দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এই নাটকটিতে বাঙ্গাল বিষয়ে প্রচলিত গোটা চারেক রঙ্গব্যাঙ্গ-রসিকতা তুলে ধরা হয়েছে, একটা আপাতত এখানে উল্লেখ করা যাক। ক্রমাগত ‘বাঙ্গাল’ গাল শুনে শুনে অতিষ্ট বেঢপ মাতাল রামের পপাত ধরণীতলে যাবার ঠিক আগে আগে দেয়া প্রত্যুত্তরে একাধারে ক্রোধ, লাঞ্ছনা আর অসহায়ত্বের চিত্র ফুটে ওঠে: ‘পুঙ্গির বাই বাঙ্গাল বাঙ্গাল কর‍্যা মস্তক গুরাই দিচে —বাঙ্গাল কউস ক্যান্—এতো অকাদ্য কাইচি তবু ক্বলকত্বার মত হবার পারচি না? ক্বলকত্বার মত না কর্‌চি কি? মাগীবারী গেচি, মাগুরি চিকোন দুতি পরাইচি, গোরার বারীর বিস্‌কাট বক্কোন করচি, বাণ্ডিল খাইচি—এতো কর‍্যাও ক্বলকত্বার মত হবার পারলাম না, তবে এ পাপ দেহতে আর কাজ কি, আমি জলে জাপ দিই, আমারে হাঙ্গোরে কুম্বিরে বক্কোন করুক—’

এমনি আর একটা রসিকতা কোনো একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম (সুনীলের কি?), পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া বাঙ্গালদের প্রতি কলকাতায় বিদ্রুপের একটি আদর্শ নমুনা। সম্ভবত কোনো পুরানো গানের ব্যাঙ্গাত্মক রূপ:
‘বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা আমি ঢাকার বাঙাল নহি গো।’

বাঙ্গালের উচ্চারণ নিয়ে রসিকতা করে বানানো একটি সংস্কৃত শ্লোকের কথাও মনে পড়ছে, সেখানে পূর্বদেশ কিংবা বঙ্গদেশের মানুষের কাছ থেকে আর্শীবাদ না নেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে, কেননা তারা ‘শতায়ু’ বলতে গিয়ে ‘হতায়ু’ বলে ফেলে। তবে এটা বাঙ্গালের জন্য প্রযুক্ত হলেও হয়তো এই শ্লোকটির উৎপত্তি আসামকে নিয়ে, সেখানেও হ ও স বর্ণের স্থানান্তর ঘটে। সে যাই হোক, ভাগ্যিস আয়ুর দেবতা শুধু মুখের কথাই শোনেন না, অন্তরের ব্যাথাও ঠিকঠাক টের পান, তাই মা-বাপের দোয়াতে বাঙ্গাল বেঁচেবর্তে আছে এখনও।

এমনই অজস্র উদাহরণ প্রচলিত ছিল, কিন্তু আশা করি এই দৃষ্টান্তগুলোই পরিস্থিতি বোঝাতে যথেষ্ট হবে। ঔপনিবেশিক বাংলায় ছাপাখানা পরবর্তী যুগে এর বহুমুখী তাৎপর্য তৈরি হয়। শত কিংবা হাজারে ছাপা বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বেন সাহিত্যিক, ছড়িয়ে পড়বে মত, পথ, তত্ত্ব কিংবা রাজনীতি। ফলে ঊনিশ শতকে বিষয়টা আর কেবল ‘কদর্থ’ করা বা রঙ্গবিদ্রুপ করা নয়, এলো ঘোষণা: বাঙ্গাল ভাষা দূষিত।

পূব আর পশ্চিমের বাংলার এই রেষারেষির পূব দিক থেকে জবাব দেয়ার জন্য বাঙ্গালকে মনে হয় দীর্ঘ অপেক্ষাই করতে হয়েছে। পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বিখ্যাত পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৮৬ সংখ্যায় ‘পূর্বাঞ্চলীয় ভাষা’ নামের নিবন্ধটিতে পূর্বাঞ্চলের ভাষাকে পশ্চিম কতটা অবমাননার চোখে দেখে, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে, পূর্ববঙ্গের ভাষাকে তারা এত অশুদ্ধ মনে করেন যে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছে:

‘তাহাদিগের মতের সারমর্ম এই যে, পূর্ব্বাঞ্চলের লোকে লেখাতে এমন অনেকপ্রকার রীতির অনুসরণ করেন তাহা হিন্দুস্তানে নয়, চব্বিশ পরগনা, হুগলী, নদীয়া ও বর্দ্ধমান এই কয়েকটি জেলায় প্রচলিত হয় না। অতএব উহা তাঁহাদিগের শ্রুতিকটু হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত তাহা অশুদ্ধ। যদি পূর্ব্বাঞ্চলীয় গ্রন্থকারগণ ঐ সকল দোষ পরিত্যাগ করিয়া লেখেন, তাহা হইলে তাহাদের পুস্তকের প্রতি কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাইতে পারে।

‌কী ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনা! কিন্তু এতেও কি শেষ আছে!

‘সোমপ্রকাশ সম্পাদক এই দোষের নিবারণের জন্য প্রস্তাব করিয়াছেন যদি পূর্ব্বাঞ্চলীয় কোন লোকে কখন কোন পুস্তক লিখিতে প্রবৃত্ত হন তখন যেন তাঁহারা পশ্চিমাঞ্চলীয় কোন ব্যক্তি দ্বারা তাহাদিগের লেখা সংশোধন করাইয়া লন।’

‘সোমপ্রকাশ’-এর বক্তব্যটুকু আদতে কী ছিল, তা গবেষকদের খুঁজে দেখা অত্যাবশ্যক, শুধু ঢাকা প্রকাশের নালিশটাই আমার দেখা সংকলনটিতে জানতে পেরেছি। তবে ‘সোমপ্রকাশ’-এর উস্কানিটি যে নিতান্তই সামান্য ছিল না, তা বোঝা যায় জল অনেকদূর গড়ানো থেকে। এই কথিত রূঢ়তার প্রত্যুত্তরে ‘ঢাকা প্রকাশ’ ভাষার শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা প্রশ্নে বিস্তারিত যুক্তি প্রদর্শন করেন, ঘোষণা করেন যে ‘বাঙ্গলা ভাষায় অল্পদিন হইল পুস্তক রচনা হইতে আরম্ভ হইয়াছে... কোন গ্রন্থকারই এমন শক্তি প্রদর্শন করিতে সমর্থ হন নাই, যে তাহার পুস্তক চিরকাল বা বহুদিন আদরণীয় থাকিবে এবং সেই পুস্তক ভাষার আদি সম্পত্তিরূপে বিবেচিত হইবে... যখন ভাষায় এমন পুস্তক লিখিত হইবে যে, সকল লোকেই তার গুণে বশীভূত হইয়া তাহার নিকট মস্তক অবনত করিবে... তখন সেই সমুদয়পুস্তক দেখিয়া ব্যকরণ রচনা হইবে। তখন বলা যাইবে ভাষার রীতি এই...।’

এভাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’ সন্দেহাতীতভাবেই দেখিয়ে দেয় যে, বাংলা ভাষার তখনও পর্যন্ত কোনো ব্যাকরণ কিংবা সুনির্দিষ্ট লিখনশৈলী দাঁড়ায়নি, ‘সোমপ্রকাশ’সহ অনেকেই নতুন নতুন প্রণালী প্রচলিত করছেন। ঢাকা প্রকাশের প্রবন্ধকার আরও মত প্রকাশ করেন যে, ‘বিদ্যাসাগর, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি কলিকাতার প্রসিদ্ধ লেখকেরা যে হইবেক করিবেক এবং অতীত কালার্থে করেন, যান, দেন ইত্যাদি ব্যবহার করিয়াছেন, তৎপ্রতি দৃষ্টি না করিয়া যদি ইহাতে স্বীকার করা যায় যে ঐ অঞ্চলের কোন লেখকই এইরূপ শব্দব্যবহার প্রণালী অবলম্বন করেন না, তথাপি এই প্রণালীর অশুদ্ধতা কোন রূপে প্রমাণিত হয় না... এদেশ হইতে আমরা যদি আদেশ প্রচার করিয়া দি যে, অমুক অমুক শব্দ ও রীতি এদেশে প্রচলিত নাই, এদেশের গ্রন্থকাররা ব্যবহার করেন না ও এদেশের লোকের নিকট শ্রুতিকটু শুনা যায় অতএব কোনস্থানের লোকেই যেন তাহা ব্যবহার না করেন, তাহা হইলে আমাদিগের কথা যতদূর সঙ্গত ও প্রামাণ্য হইবে, অন্যস্থান হইতে ঐ প্রকার কথা বলিলেও তদরূপই হইবে সন্দেহ নাই।’

পুরো একশত তিরিশ বছর আগে ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামের পত্রিকাটি সমরেশ মজুমদারের হাল আমলে ছড়ানো বিভ্রান্তির উত্তর দিয়ে রেখেছে! তবে দ্রষ্টব্য যে এখন পর্যন্ত প্রদত্ত উদাহরণগুলোতে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ছাপ মেলেনি। সেটা শুরু হয় মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান পরবর্তীকালে এবং, যেটা আগেই বলেছি, ১৯৪৭ এর পর অঞ্চল আর সম্প্রদায়ের পরিচয় এই যুদ্ধে একাকার হতে শুরু করে। আরও খেয়াল করবার বিষয় হলো, ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তির জায়গাতে ‘ঢাকা প্রকাশ’ বরং কিছুটা রক্ষণাত্মক, ‘সোমপ্রকাশ’ আক্রমণাত্মক। এর কারণ খানিকটা আগেই ইঙ্গিত করেছি।

ভাষার বিষয় বৈচিত্রের স্বীকৃতি নিয়ে আগ্রহী থাকলেও সব ক্ষেত্রে ‘ঢাকা প্রকাশ’ কিংবা বাঙ্গাল প্রতিনিধিরা অতটা নমনীয় ছিলেন না, তারও দৃষ্টান্ত আছে। ওই ‘ঢাকা প্রকাশ’-এই পূর্বঙ্গীয়দের প্রতি এই ‘বিজাতীয় ঘৃণা’র জবাব ‘খোষ খবর’ শিরোনামায় পুরুষালী একটি উত্তরও দেয়া আছে। কেন পূর্ববঙ্গবাসীদের বাঙ্গাল বলা হয় সে নিয়ে পাঠানো এক প্রশ্নের জবাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর রায়: ‘পত্র প্রেরকের লিঙ্গজ্ঞান থাকিলে বুঝিতেন; বাঙ্গাল শব্দটি পুংলিঙ্গ, আর বাঙ্গালী শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ।’ পশ্চিমা ভাইদের নিয়ে পূব দিকে এই মশকরাটি বোধহয় বেশ জনপ্রিয় ছিল, প্রায় অর্ধশতক পর অদ্বিতীয় পরিহাসবিদ ভানুও পশ্চিমবঙ্গবাসীকে জব্দ করতে লিঙ্গভেদের এই একই পুরুষালী অস্ত্রটি শানিয়েছিলেন বাঙ্গালের তূণ থেকে।

অবসরভোগী বনাম মেহনতি

প্রত্যুত্তর শুরু করলেও বহু মানদণ্ডে পূর্ব বাংলা পিছিয়ে যে বরাবরই ছিল, তার একটা নিদর্শন পাওয়া যাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর একটা ঘটনা থেকে। বাংলা ১৩০৮ সালে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর মালিকানা কেনেন ত্রিপুরার মহারাজার মন্ত্রণাদাতা রাধারমণ। কারণটা ছিল অপমানবোধ। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার অফিসে গেলে কথাপ্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ রাধারমণকে বলেন, ‘তুমি যাহাই বলো না কেন, যেখান হইতে এই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও পড়িবার যোগ্য একখানি সংবাদপত্র প্রকাশিত হইতে পারে নাই, সেখানকার শিক্ষা দীক্ষার গৌরব করা যাইতে পারে না।’

‘পড়িবার যোগ্য’ কাগজ শুধু নয়, এই ঘটনার বহু বছর পরও সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা-সাংস্কৃতিক তৎপরতায়ও যে পূর্ববঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে ছিল, এ তো সত্যি। কারণ উৎপাদনের বৃহদাংশ পূর্বের চাষীরা সম্পাদন করলেও ভোগটা প্রায় সর্বাংশে ঘটতো কলকাতা শহরে। উঁচুসাহিত্য তো অবসরজীবীদের বিলাস, শ্রমক্লান্ত পূর্ব বাংলা থেকে জমিদাররা রস অপহরণ করে কলকাতায় যে-বাংলা সংস্কৃতির গোড়ায় তা সিঞ্চন করেছেন, তারই অনিবার্য ফল এটা। এরই ফল বাঙ্গালের কলকাতায় আকর্ষণে ছুটে যেতে বাধ্য হওয়া। ‘কলকাত্তাইয়া’ হবার প্রাণপণ আকুতি, শুধু জমিদারির খাজনা ওড়ানোই নয়, শিক্ষা আর চাকরিরও সেরা সুযোগগুলো তখন কলকাতাকেন্দ্রিক, কিংবা সেখান থেকেই তা বণ্টিত হয়, এরই ফল বাঙ্গালের মুখের ভাষার অশুদ্ধ ঘোষিত হওয়া। কিন্তু এত কিছু ছাপিয়েও চাষাড়ে সুলভ গোঁয়ার্তুমির শক্তি তার ছিল। পাশাপাশি ছিল সহজ সজীব সৃজনশীলতা, বাংলাভাষা বহুবার তাতে সমৃদ্ধ হয়েছে। কলকাতা বাঙ্গালকে উদ্বাস্তু শ্রমিক কিংবা বিলাসী বাবু আকারে টেনে নিলেও আপন ছাপ সে কলকাতার ভাষাতেও ঠিকই রেখে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন। ভাষার গতিশীলতার দিকেও তার নজরটা কড়াই ছিল:

‘কলকাতা শহরের নিকটবর্তী চার দিকের ভাষা স্বভাবতই বাংলাদেশের সকল দেশী ভাষা বলে গণ্য হয়েছে। এই এক ভাষার সর্বজনীনতা বাংলাদেশের কল্যাণের বিষয় বলেই মনে করা উচিত। এই ভাষায় ক্রমে পূর্ববঙ্গেরও হাত পড়তে আরম্ভ হয়েছে, তার একটা প্রমাণ এই যে, আমরা দক্ষিণের লোকেরা ‘‘সাথে’’ শব্দটা কবিতায় ছাড়া সাহিত্যে বা মুখের আলাপে ব্যবহার করি নে। আমরা বলি ‘‘সঙ্গে’’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কানে যেমনি লাগুক, ‘‘সঙ্গে’’ কথাটা ‘‘সাথে’’র কাছে হার মেনে আসছে। আরও একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। মাত্র চারজন লোক : এমন প্রয়োগ আজকাল প্রায় শুনি। বরাবর বলে এসেছি ‘চারজন মাত্র লোক', অর্থাৎ চারজনের দ্বারা মাত্রা-পাওয়া, পরিমিত-হওয়া লোক। অবশ্য ‘মাত্র’’ শব্দ গোড়ায় বসলে কথাটাতে জোর দেবার সুবিধে হয়। ভাষা সব সময়ে যুক্তি মানে না।’

সার্বজনীন বাংলা হিসেবে কলকাতার বাংলাকে বাংলার জন্য কল্যাণকর বিবেচনাটি নিয়ে এক দফা জরুরি আলাপ হওয়া দরকার। তবে রবীন্দ্রনাথ এইখানে কলকাতা শহরের ভাষাকে ‘সকলদেশীর’, সেই হিসেবে, সর্বজনীন ঘোষণা করার পরও, তাকে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণের বিষয় হিসেবে মানদণ্ডরূপে বিবেচনা করলেও বাস্তবতার ঝাঁঝ ততদিনে বোঝা যাচ্ছে। ও-দেশীয় কানে তা যেমনটাই লাগুক, কলকাতার দোর্দণ্ড প্রতাপের যুগেই পূবের রুচি যে তাতে ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল, সেটা এই সাক্ষ্যে ভালোমতোই বোঝা যায়।

‘সঙ্গে’ কথাটার তুলনায় ‘সাথে’ এমনই অনাড়ম্বর, সরল এবং আন্তরিক, হার না মেনে সঙ্গের হয়তো উপায় ছিল না। মুখের ভাষার জন্য বারণ হলেও কবিতার জন্য যে তা জায়েজ ছিল, তার কারণ হতে পারে এটাও যে ‘সঙ্গে’ কথাটার ছন্দসঙ্গী মোটে কয়টা: রঙ্গে-ঢঙ্গে-বঙ্গে-জঙ্গে-ভঙ্গে-টঙ্গে ইত্যাদি। অন্যদিকে ‘সাথে’ শব্দটির ছন্দসাথী অজস্র। কাব্যভাষা আর মুখের ভাষার মাঝে প্রভেদ মানার শিক্ষিত অনুশীলন সর্বজনের থাকে না বলেই কলকাতাবাসীদেরও হয়তো অনেকেই সহজে ‘সাথী’ হয়েছেন, ছন্দের শক্তিতেই। কিংবা আরও একটা সম্ভাবনা হলো জনদেবতার রায়; কলকাতা তো শুধু সংস্কৃতি আর ভোগের মধুর লোভে উড়ে যাওয়া অনুপস্থিত জমিদারদের কমলালয় ছিল না, পেটের খিদায় পাটকল-চটকলের টানে ঘূর্ণিবায়ুতে বালুকণার মতো বাংলার সর্বত্র থেকে তারা জড়ো হচ্ছিল কলকাতায়। হয়তো তাদের সূত্রেও সাথী হঠিয়ে দিচ্ছিল সঙ্গীকে। সৈয়দ মুজতবা আলীও তার একটি প্রবন্ধে বাংলা ভাষার জমাখরচ হিসেব করতে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাপটে পশ্চিম বাংলার কথ্যরীতির পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন।

‘সঙ্গে’ এবং ‘সাথে’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আঞ্চলিকতার গোড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে একে গ্রহণ করবার পক্ষেই ইশারা দিয়েছিলেন বটে, পূর্ববাংলায় কিন্তু তা এখনও বেশ জোরেশোরেই সিন্দাবাদের ভূতর মতো চেপে বসে আছে, কোনো কোনো স্থলে হয়তো নিছক অভ্যাসবশতই, নিজেদের অজ্ঞাতসারেই। একটা উদাহরণ দেই। বহু বছর পর একটি দৈনিক পত্রিকায় চাকরিসূত্রে সেখানকার বানান মার্জনাকারীদের মুখে প্রথমবার শুনেছিলাম, কবিতা ছাড়া অন্য সর্বত্র ‘সাথে’ কেটে ‘সঙ্গে’ করতে হবে, সেটাই শুদ্ধ। অবাক হয়েছিলাম, কলকাতার ভরামাঠে খেলায় জিতে এসেও নিজের দেশেই ‘সাথে’ হীনম্মন্যতা সংস্কারের শিকার হয়ে আছে আজও! অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, মাহবুবুল হক, সাজ্জাদ শরীফ, অরুণ বসু ও ফরহাদ মাহমুদের মতো চার কৃতী ভাষা বিশেষজ্ঞ মিলে যে প্রথম আলো ভাষারীতিটি তৈরি করেছেন, সেখানেও ‘সাথে’ ব্যবহার না করে ‘সঙ্গে’ ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। যদিও পত্রিকাটার অন্তর্জালিক ঠিকানাতে সঙ্গে আর সাথে দুটিই ব্যবহারেরই নমুনা আছে, ছাপা পত্রিকাতে সঙ্গের সংখ্যাই বিপুল।

কিন্তু বাংলা ভাষা ঔপনিবেশিক কলকাতার ছকে চিরতরে আটকা পড়ে আছে, এমন কোনো সংস্কারে আস্থা রাখা কঠিন। ভাষা এত বেশি বাস্তব বিষয় যে একদিকে তাকে প্রতিদিন নিয়মের সাথে সংগ্রাম করতে হয়, অন্যদিকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নতুন শব্দ ও প্রয়োগ বের করে নিতে হয়। পূর্ববঙ্গে ছাপা একটি পত্রিকা হাতে পেয়ে সেখানে ‘ভাষাভাষী’ এই শব্দটি দেখে ‘হাসাহাসি’ করতে ইচ্ছা হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর, আজ সেটা প্রয়োজনীয় একটা শব্দ। একই পত্রিকায় ‘সাহিত্যিক’ শব্দটি দেখে তার মনে হয়েছিল ভাষার ওপর ‘বলাৎকার’, কেননা তা নাকি সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ব্যাকরণমতে অশুদ্ধ। অথচ আমরা আজ জানি, ‘সাহিত্যিক’ হিসেবে প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতিকে আধুনিকায়নে এবং বাংলাকে সাবলীল করার বেলায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পৃথক হয়ে একদম ভিন্ন ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করা কঠিন, যদিও সেই আশঙ্কা কিংবা আশাবাদ সুনীতিকুমারেরর মতো ভাষাতাত্ত্বিক বা কায়কোবাদের মতো কবি করেছিলেন, হিন্দু বাংলা আর মুসলমান বাংলা আকারে দুটো রূপের বিকাশের সম্ভাবনা দেখে। তবে এটা ঠিক যে আনন্দবাজার পড়তে আমাদের যেমন কিছু খটকা লাগে, বাংলাদেশের পত্রিকা বিষয়েও নিশ্চয়ই তাদেরও তেমন কিছুটা হয়। বাদানুবাদ বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রচুর দেখি, আনন্দবাজারে দেখি ‘তরজা’।

ভাষার সাথে অর্থনীতির এবং উৎপাদনশীলতার যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কটি রয়েছে, সেটা পশ্চিম বাংলাকে খানদানি অর্থে একটি সনাতন, শরিফ ভাবগাম্ভীর্য হয়তো দেয়, কিন্তু মুখের ভাষা আপন গতিতে রাস্তা কেটে এগিয়ে যায়। সেই কারণেই প্রয়োজন মাফিক পুরানো বহু কিছু সে গ্রহণ করে, প্রয়োজন মতো বর্জনও করে, জীবনের গতি ও স্ফূর্তি যেখানে জমাট, সেখানে বৈচিত্র সংগ্রহ করে শক্তিশালী হতে থাকে। ব্যাকরণে ভুল হলেও যেমনটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘“মাত্র” শব্দ গোড়ায় বসলে কথাটাতে জোর দেবার সুবিধে হয়।’ ভাষার বিকাশ গঞ্জে, ভাষার দাঁতকপাটি গোড়ামিতে।

ফিরোজ আহমেদ: লেখক, অনুবাদক ও রাজনৈতিক কর্মী

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ
Water is not rising in the tubewell in Meherpur amid the fire

দাবদাহের মধ্যে টিউবওয়েলে পানি উঠছে না মেহেরপুরে

দাবদাহের মধ্যে টিউবওয়েলে পানি উঠছে না মেহেরপুরে ১৫ থেকে ১৬ বার টিউবওয়েল চাপার পরেও মিলছে না এক গ্লাস পানি। ছবি: নিউজবাংলা
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।

ছিয়াত্তর বছর বয়সী আবদুর রহিম স্ত্রীকে হারিয়েছেন দেড় যুগ আগে। পরিবারের সদস্য বলতে এক ছেলে, তাও থাকেন প্রবাসে। ছেলে প্রবাসে যাওয়ার পর অন্য ঘরে চলে গেছেন ছেলের বৌও। তাই রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হয় নিজেকে।

জীবন যুদ্ধে তিনি কখনও দমে যাননি, তবে এবার হার মেনেছেন টিউবওয়েলের পানির কাছে। ১৫ থেকে ১৬ বার টিউবওয়েল চাপার পরেও মিলছে না এক গ্লাস পানি। তাই পানি সংকটের কারণে গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজ হচ্ছে ব্যাহত।

তাই অধিকাংশ সময় বাড়ির পাশে থাকা মসজিদে গিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করছেন আবদুর রহিম।

এদিকে গৃহবধূ ছানোয়ারা খাতুন গৃহস্থালির সব কাজ করেন একাই। বাড়িতে রয়েছে তিনটি গাভি ও চারটি ছাগল। এর মধ্যেই আজ সপ্তাহ দুয়েক ধরে টিউবওয়েলে উঠছে না পানি। খাওয়া থেকে ওজু, গোসল সব কিছুতেই বেগ পেতে হচ্ছে পানি সংকটের কারণে।

ছানোয়ারা খাতুন জানান, তীব্র তাপদাহের মধ্যে আজ সপ্তাহখানেক ধরে বাড়িতে থাকা গরুর গোসল করাতে পারেননি তিনি, তবে নিজে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে গোসল করে আসেন।

মেহেরপুরের গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ফলে এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট এখন চরমে পৌঁছেছে। একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তারা সুপেয় পানির সংকটের কথা জানান। বিশেষ করে মুজিবনগর উপজেলার, জয়পুর, আমদহ, তারানগর, বিশ্বনাথপুর; সদর উপজেলার শালিকা, আশরাফপুর, আমদাহ, বুড়িপোতা, আলমপুর এবং গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের আমতৈল, মানিকদিয়া, কেশবনগর, শিমুলতলা, রইয়েরকান্দি, সহড়াবাড়িয়া, মিনাপাড়া, ভোলাডাঙ্গা, কুমারীডাঙ্গা কাথুলি ইউনিয়নের গাঁড়াবাড়িয়া, ধলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি শুষ্ক মৌসুম শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা, এবং পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। আগামীতে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলেও জানান তারা।

গ্রামবাসীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হস্তচালিত অনেক টিউবওয়েল। যেখানে আগে ভূগর্ভের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীরতা থেকেই পাওয়া যেত সুপেয় পানি। গত এক দশকে ক্রমেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

জেলায় গভীর-অগভীর মিলিয়ে ৯ হাজার ৯১৩টি নলকূপ আছে। এর মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ২ হাজার ২৩৯টি।

গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামের পল্লি চিকিৎসক মতিন বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা দিয়ে বেড়াই। আজ ১০ দিন ধরে আমার বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না। রোদের মধ‍্যে সারা দিন গ্রাম গ্রাম ঘুরে বাড়ি এসে যদি পানি না পাই তাহলে কেমন লাগে? আমি তাই মসজিদের নলকূপে গিয়ে গোসল সেরে আসি।’

একই এলাকার দিনমজুর সিরাজ বলেন, ‘আমি সারা দিন মাঠে কাজ করি। বাড়িতে দুটি গরুও পালন করি অথচ গরু দুটি আজ কয়দিন গা ধোয়াতে পারিনি। আবার মাঠে এক বিঘা ধানের আবাদ আছে, তাতে সেচ দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হচ্ছে। যেখানে দুই ঘণ্টা মেশিনে পানি দিলে হয়ে যেতো। সেখানে এখন চারটা ঘণ্টা পানি দিয়েও হচ্ছে না।’

এ অঞ্চলের আবহাওয়া নির্ণয়কারী চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই চুয়াডাঙ্গাসহ এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এখানে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অঞ্চলে আপাতত আজকে বৃষ্টির সম্ভবনা নেই।’

মেহেরপুরের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন জানান, সুপেয় পানির সমস্যা নিরূপণে যেসব এলাকায় সংকট সেখানে ১০টি বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি ৯০০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এসব এলাকায় ৫০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে, তবে অতিবৃষ্টি ও পানির অপচয় রোধ করা না গেলে পানি সংকটের সমাধান মিলবে না।

আরও পড়ুন:
লিচুর গায়ে তাপের ক্ষত
তীব্র তাপদাহে নওগাঁয় আমের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা
তীব্র তাপদাহে ইউরোপ
নলকূপে পানি নেই, বরিশাল নগরীতে হাহাকার
রানী পেলেন নলকূপ

মন্তব্য

বাংলাদেশ
21 children who lost their parents in the Rana Plaza collapse are growing up in Orca Homes
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

বাবা-মাহারা ২১ শিশু বেড়ে উঠছে ‘অরকা হোমসে’

বাবা-মাহারা ২১ শিশু বেড়ে উঠছে ‘অরকা হোমসে’ গাইবান্ধার ‘অরকা হোমস’-এ বেড়ে উঠছে শিশুরা। ছবি: নিউজবাংলা
দুর্ভাগা ২১ শিশু, কিশোর-কিশোরী মমতার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে গাইবান্ধার ‘অরকা হোমস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। কেউ হারিয়েছে বাবাকে, কেউ বা মাকে। কেউ কেউ আবার বাবা-মা উভয়কে হারিয়ে একেবারেই হয়েছে নিঃস্ব। কারও কারও বাবা-মা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আজীবনের জন্যও।

ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটেছিল বাংলাদেশ তথা এশিয়ার অন্যতম বড় এই শিল্প দুর্ঘটনা।

সেদিন অত্যন্ত ব্যস্ততম সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামে একটি ৯ তলা ভবন ধসে মারা যান ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক, আহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচেও যেন মরে গেছেন।

লোমহর্ষক এই ট্রাজেডির সাথে সাথে আল আমিন মিয়া, জিয়াদ হোসেন, তাহমিনা আক্তার ও বীথিসহ অনেক শিশু, কিশোরের জীবনেও নেমে আসে ট্রাজেডি। সেদিনের হতাহতের অনেকের সন্তানই এখন নিঃসঙ্গতা আর অর্থাভাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে।

এমন দুর্ভাগা ২১ শিশু, কিশোর-কিশোরী মমতার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে গাইবান্ধার ‘অরকা হোমস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। কেউ হারিয়েছে বাবাকে, কেউ বা মাকে। কেউ কেউ আবার বাবা-মা উভয়কে হারিয়ে একেবারেই হয়েছে নিঃস্ব। কারও কারও বাবা-মা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আজীবনের জন্যও। এ ছাড়াও আরও ৩১ জন এতিম-অসহায় শিশু-কিশোর-কিশোরীর ঠিকানা হয়েছে অরকা হোমসে।

বাবা-মা হারানো দেশের বিভিন্ন জেলার এসব শিশুর লেখাপড়া, খেলাধুলা ও বিনোদনসহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন (অরকা)।

২০১৪ সালে অরকা হোমসের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায়। রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই একই বছরের ২২ ডিসেম্বর গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অরকা-হোমস প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন তলাবিশিষ্ট দুটি এবং পরবর্তীতে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চার তলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। যেখানে ৫২ জন এতিম অসহায় শিশু, কিশোর-কিশোরী বসবাস করছে।

এর মধ্যে ২১ জন মেয়ে ও ৩১ জন ছেলে রয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমানে ২১ জন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিশু-কিশোর-কিশোরী রয়েছে। সেখানে তারা থেকে-খেয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৯ জন মেয়ে, ১২ জন ছেলে। এই ২১ জন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানকার ৩১ জন শিশু-কিশোরের কেউ মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে, কেউ কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে আবার কারও কর্ম-সংস্থান হওয়ায় অরকা হোমস ছেড়ে চলেও গেছেন।

কেবল মা হারাদের মধ্যে ওই সময়ে (২০১৪) আসা সব থেকে কম বয়সী শিশু ছিল সৌরভ। সৌরভের বাড়ি জামালপুর জেলার সদর উপজেলার বলমুই পাড়া গ্রামে। সৌরভ যখন অরকা হোমসে তখন বয়স মাত্র ছয় বছর। সৌরভের বয়স এখন ১৭। সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছয় বছর বয়সে আসা শিশু সৌরভের তখনকার কোনো কিছুই মনে পড়ে না। তবে, বড় হওয়ার সাথে সাথে সবই জেনে গেছে সৌরভ। প্রতিবছরই পড়ে পত্রিকার পাতায়, দেখে টেলিভিশনে। হতে হয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি। মনে না থাকলেও যেন আজকের এই দিনে সৌরভকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দেন গণমাধ্যমকর্মীরাই।

একান্ত সাক্ষাৎকারে নিউজবাংলার গাইবান্ধার এই প্রতিবেদককে সৌরভ জানায়, তারা বাবা বাদশা মিয়া কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় তার মা কল্পনা বেগম সাভাবের একটি পোশাক শ্রমিকের কাজ নেয়। তার মা ওই ভবনের তিন তলায় পোশাক কারখানার অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান তিনি। এরপর এতিম সৌরভের জায়গা হয় গাইবান্ধার অরকা হোমসে।

বাবা-মাহারা ২১ শিশু বেড়ে উঠছে ‘অরকা হোমসে’
জীবনের গল্প শোনাচ্ছে শিশু সৌরভ। ছবি: নিউজবাংলা

সৌরভ বলে, ‘শুনেছি আমার যখন ছয় বছর; তখন মা রানা প্লাজায় মারা যায়। ধ্বংসযজ্ঞের ১৬ দিন পর মাকে খুঁজে পায় বাবা-ভাই ও আমার স্বজনরা। তখন নাকি মায়ের দেহ গলে পঁচে গেছিলো, কিন্তু তার গলায় থাকা পোশাক কারখানার আইডি কার্ড দেখে বাবা-মাকে চিনে নেয়।’

সৌরভ বলে, ‘মায়ের আয় করা টাকায় আমাদের পরিবার চলত। মা চলে যাওয়ার পর আমাদের ভালো চলছিল না। পরে এখানে রেখে যায় বাবা। একমাত্র বড় ভাই বিয়ে করে সংসার করছে। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। এখন খোঁজ-খবর রাখছে বয়স্ক (বৃদ্ধ) দাদা। এখানে আমি ভাল আছি।’

মাকে মনে পড়ে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ বলে, ‘সব সয়ে গেছে। ছয় বছরের শিশু থাকতেই আমি মাকে হারিয়েছি তো, এখন খুব একটা কষ্ট হয় না! তবে, প্রতিবছর এই দিনটি আসলে সাংবাদিক এবং বিভিন্নভাবে মায়ের কথা মনে পড়ে।’

কোনো স্বপ্ন আছে- এমন প্রশ্নে সৌরভ বলে, বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। আর শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে আমার মা জীবন দিয়েছেন। একটা মা হারা শিশুর আশ্রয় হয়েছে অরকা হোমসে। আমিও এরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখি। যেখানে অসহায়-এতিম ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও আমাদের মতো গরীব ঘরের সন্তানেরা বিনা টাকায় খেয়ে- থেকে পড়া লেখা করতে পারেব। তারাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে। এভাবেই দেশটি একদিন সহযোগিতার হাতেই পূর্ণ হবে। হয়তো তখন কেনো মাকে শ্রমিকের কাজে গিয়ে জীবন দিতে হবে না।

প্রতিষ্ঠানটির সহকারি ম্যানেজার মিল্লাত মন্ডল। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় (২০১৪) থেকেই অরকা হোমসে আছেন। পরে সৌরভকে নিয়ে কথা হয় তার সাথে।

সৌরভের সম্পর্কে জানতে চাইলে স্মৃতিচারণ করে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, ২০১৪ সালে সৌরভ যখন এখানে আসে তখন ওর বয়স ছয় বছর। তখন এটি এতো প্রসারিত ছিল না, ছিল না জনবলও। ও এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে আসার পর টানা এক মাসেরর বেশি সময় ধরে সৌরভ প্রায় সার্বক্ষণিক মায়ের জন্য, বাড়ির জন্য কেঁদেছে। ওকে আমরা সবাই অনেক স্নেহে মানুষ করেছি। কারণ, সব থেকে ছোট এবং কম বয়সের ছিল সেদিনের মা হারা শিশু এই সৌরভ।

তিনি আরও বলেন, মা হারা সৌরভ অনেক ভদ্র এবং নম্র। সৌরভ প্রচণ্ড মেধাবী। এখানে আসার পর পড়া-লেখা শুরু হয় সৌরভের। সৌরভ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসেই প্রথম (এক রোল)। আর এবার নবম শ্রেণিতে উঠেছে সৌরভ। সৌরভ জীবনে অনেক বড় হোক।

শুধু সৌরভই নয়, আল আমিন মিয়া, জিয়াদ হোসেন, তাহমিনা আক্তার, বীথিসহ হোমসে আশ্রয় হওয়া সবারই আছে প্রায় একই রকম শোকগাথা ইতিহাস। তবে, এতিম-অসহায় এই শিশুদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করেই চলেছেন অরকা হোমস।

ক্যাম্পাসটি ঘুরে দেখা যায়, প্রকৃতির ছাঁয়াঘেরা অরকা হোমসের পুরো ক্যাম্পাস। এক ক্যাম্পাসের ভেতরেই সকল ভবন। চারতলা ভবনটিতে থাকে ছেলেরা। আর মেয়েরা থাকে তিন তলার দুটি ভবনের একটিতে। এখানে থাকা শিশু-কিশোরের সবাই পড়াশোনা করছে পাশের মুসলিম একাডেমিতে।

এখানে আছে খেলার মাঠ, লাইব্রেরি ও বিনোদনের ব্যবস্থা। এছাড়া তাদের দেখভালের জন্য রয়েছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক, একজন ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, নারী কেয়ারটেকারসহ আটজন। তাদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকজন গৃহশিক্ষকও। রয়েছেন শরীরচর্চার শিক্ষক। ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। নামাজের জন্য ক্যাম্পাসের ভিতরের রয়েছে সুন্দর পাকা মসজিদ।

গাইবান্ধা অরকা হোমসের তত্বাবধায়ক মো. জাহিদুল হক নিউজবাংলকে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধ্বসের পর ২০১৪ সালে মাত্র ৮টি বাচ্চা নিয়ে গাইবান্ধায় অরকা হোমসের যাত্রা শুরু হয়। এখন এখানে বাচ্চা রয়েছে ৫২টি। তার মধ্যে ২১ টি বাচ্চা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বাবা-মা হারানো; বাকিরা এতিম অসহায়। তাদের পড়াশোনা থেকে সবকিছুই আমরা দিচ্ছি। এছাড়া তাদের কর্মসংস্থান এবং মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাও আমাদেরি দায়িত্ব।’

তিনি বলেন, ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন অরকার দেশ-বিদেশে থাকা সদস্যদের আর্থিক সহায়তায়ই মূলত হোমসের ব্যয় মেটানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিজিএমইএ প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক অনুদান দিয়ে আসছে।’

তবে, সম্প্রতি তারা (বিজিএমইএ) সেই সহযোগিতা করতে গরিমসি করছেন বলে অভিযোগ ছিল তত্ত্বাবধায়কের।

মন্তব্য

বাংলাদেশ
35 crore bridge is not working due to lack of connecting roads
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা

সংযোগ সড়কের অভাবে কাজে আসছে না ৩৫ কোটির সেতু

সংযোগ সড়কের অভাবে কাজে আসছে না ৩৫ কোটির সেতু সেতুর দুই পাশে সংযোগ সড়কের অভাবে দুই বছর ধরে কালীগঙ্গায় ঠাঁই দাড়িয়ে আছে সেতুটি। ছবি: নিউজবাংলা
কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ দেখে ভাবছিলাম, আমাদের দীর্ঘ দিনের কষ্ট দূর হবে, কিন্তু ব্রিজের দুই পাশে রাস্তা না থাকায় আমরা কেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারি না। আগের মতো নৌকায় করেই খেতের ফসল আনতে হচ্ছে। আমাগো মনের আশা মনেই রইল। তাহলে সরকার এত টাকা দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করল কেন?’

প্রান্তিক জনগণের যাতায়াত সুবিধা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর ওপর ৩৬৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়। তবে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে আসছে না সরকারের ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি। সেতুর দুই পাশে সংযোগ সড়কের অভাবে দুই বছর ধরে কালীগঙ্গায় ঠাঁই দাড়িয়ে আছে সেটি।

উপজেলা এলজিইডি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঘিওরের সিংজুরী ইউনিয়নের বৈকুণ্ঠপুর কালীগঙ্গা নদীর ওপর ৩৬৫ মিটার দৈর্ঘের সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডারস এবং মেসার্স কহিনুর এন্টাইপ্রাইজ। সংযোগ সড়ক ছাড়াই ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।

এরপর সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত। প্রথমার্ধে সেতু নির্মাণের ব্যয় ৩০ কোটি থাকলেও পরবর্তীতে সংযোগ সড়ক ও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের আরও পাঁচ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এরপর সেতু ও সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় উন্নয়নকাজের ব্যয় ধরা হয় ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ৪৫৪ হাজার টাকা। তবে সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় বাড়ানো হলেও নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যবহারোপযোগী হয়নি সেতুটি।

স্থানীয় মির্জাপুর এলাকার কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণ দেখে ভাবছিলাম, আমাদের দীর্ঘ দিনের কষ্ট দূর হবে, কিন্তু ব্রিজের দুই পাশে রাস্তা না থাকায় আমরা কেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারি না। আগের মতো নৌকায় করেই খেতের ফসল আনতে হচ্ছে। আমাগো মনের আশা মনেই রইল। তাহলে সরকার এত টাকা দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করল কেন?’

আরেক কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সেতুর পাশে আমার দেড় শতাংশ কৃষিজমি আছে। সেতুর রাস্তার জন্য আমার জমি নিতে চাইছে। এলাকার মানুষের ভালোর জন্য আমার জমি দিতে চাইছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে খালি শুনতেছি, আমাগো জমি অধিগ্রহণ করা হবে, কিন্তু জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় জমিতে আগের মতো ইরি ধানের আবাদ করছি।’

স্থানীয় বালিয়াবাধা এলাকার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণের পর একদিনের জন্যও কেউ সেতুটি ব্যবহার করতে পারে নাই। সেতুটি ব্যবহার করতে পারলে সেতুর আশপাশের অন্তত ৫০টি গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো।

‘সেতুটি ব্যবহারের উপযোগী না হওয়ায় আমাদের ও আশপাশের এলাকার মানুষকে ১৫ কিলোমিটার ঘুরে জেলা শহরে যেতে হচ্ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেতুটি ব্যবহারের উপযোগী করবে সরকার।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মাসুদ মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণের পর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার জমির মালিকদের বাধার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ করতে হয়েছে। এখন সংযোগ সড়কের জায়গা বুঝে পেলেই আমরা কাজ শুরু করব। আর সংযোগ সড়কের কাজ করতে আমাদের সময় লাগবে ৪-৫ মাস। আমরা যত দ্রুত পারব, তত দ্রুত কাজ শুরু করব।’

এ বিষয়ে ঘিওর উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।

তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই ভূমি জটিলতা কেটে যাবে এবং সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজন সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য খোঁজ খবর নিচ্ছে।’

ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে মানিকগঞ্জ ডেপুটি রেভিনিউ কালেক্টর এল এ শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মামুনুর রশিদ বলেন, ‘সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ৪.৯৬ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। ইতোমধ্যে ভূমি মালিকদের ৭ ধারা নোটিশ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে খুব দ্রুত ভূমির মালিকদের তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।’

আরও পড়ুন:
ভাঙা সেতুতে ভোগান্তি ৪০ গ্রামের মানুষের
বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা না করেই সেতু নির্মাণ, ভোগান্তিতে স্থানীয়রা
খালের এক কিলোমিটারে ৪৬ সেতু
সরকারি খালে পারিবারিক সেতু
সেতুর সংযোগ সড়কে ধস, জনদুর্ভোগ

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Teenager chained for three years to prevent theft

চুরি ঠেকাতে তিন বছর ধরে শেকলবন্দি কিশোর

চুরি ঠেকাতে তিন বছর ধরে শেকলবন্দি কিশোর নিজ ঘরে রিয়াজকে শেকলবন্দি করে রেখেছেন মা-বাবা। ছবি: নিউজবাংলা
লিটন হোসেন বলেন, ‘রিয়াজ সুযোগ পেলেই চুরি করে। চুরি করাটা যেন ওর নেশা। উপায় না পেয়ে বাবা হয়েও তিন বছর ধরে সন্তানকে গলায় শেকল পরিয়ে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছি। কী করব বলেন! যেখানে যায় সেখান থেকেই চুরি করে।’

অন্ধকার ঘরে চৌকির ওপর বসে আছে ১৫ বছর বয়সী রিয়াজ। গলায় শেকল পরিয়ে ঝুলানো বড় তালা। শেকলের অন্য প্রাপ্ত চৌকির সঙ্গে প্যাঁচানো। কোনোভাবে যেন শেকল খুলে বা চৌকি ভেঙে বাইরে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করেছে পরিবারের সদস্যরা।

দীর্ঘ তিন বছর ধরে এভাবেই শেকলবন্দি রিয়াজ। মাঝে-মধ্যে বাবা ও মায়ের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার সুযোগ মিললেও ছাড়া মেলে না এই কিশোরের।

ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে মা নার্গিস খাতুন ও বাবা লিটন হোসেনের সঙ্গে এভাবেই দিন কাটছে ছেলেটির।

পরিবারের সদস্যরা জানান, সাত বছর আগে শহরের আরাপপুর এলাকায় থাকা অবস্থায় কিছু বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে চুরি করা শুরু করে রিয়াজ। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই চুরি করে সে। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে শহরসহ আশপাশের জেলাতে গিয়েও সে চুরি করেছে।

চুরি করা অনেকটা নেশার মতো রিয়াজের কাছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ ওকে বাড়িতে দিয়ে গেলেও তার চুরি বন্ধ হয়নি। নানা স্থান থেকে একের পর এক অভিযোগ পেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন বাবা-মা। উপায়ান্তর না পেয়ে সন্তানকে শেকলে তালাবদ্ধ করে রাখা শুরু করেন তারা। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ তিনটি বছর। তারপরও সুযোগ পেলেই পালিয়ে যায় রিয়াজ। আবারও জড়িয়ে পড়ে চুরি ঘটনায়।

লিটন হোসেন বলেন, ‘রিয়াজ সুযোগ পেলেই চুরি করে। চুরি করাটা যেন ওর নেশা। উপায় না পেয়ে বাবা হয়েও তিন বছর ধরে সন্তানকে গলায় শেকল পরিয়ে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছি। কী করব বলেন! যেখানে যায় সেখান থেকেই চুরি করে।

‘আমরা উপায় না পেয়ে বেঁধে রেখেছি। কতবার পুলিশ এসে বাড়িতে দিয়ে গেছে। কত ডাক্তার দেখিয়েছি, কোনো সমাধান হচ্ছে না।’

মা নার্গিস খাতুন বলেন, ‘আমার দুটি সন্তান। বড় সন্তান মেয়ে। ছেলেকে এভাবে রাখতে আমার খুব খুবই কষ্ট। আমি কিচ্ছু চাই না। শুধু চাই ও পড়াশোনা করুক। অন্য ছেলেদের মতো খেলা করুক, ঘুরে বেড়াক।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক কোনো সমস্যার কারণে রিয়াজ এমন কাজ বার বার করছে। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা দিলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘কয়েকটি কারণে শিশু রিয়াজ একই কাজ বার বার করছে। পরিবারে যদি এমন কেউ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকত তাহলে এমনটা হতে পারে।

‘ওর মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেও এমনটা হতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি মোটিভেশন দিলে ছেলেটির এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।’

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Hotel resorts in Ruma and Thanchi are empty due to lack of tourists

পর্যটক-শূন্যতায় রুমা ও থানচির হোটেল রিসোর্ট ফাঁকা

পর্যটক-শূন্যতায় রুমা ও থানচির হোটেল রিসোর্ট ফাঁকা বান্দরবানের থানচি উপজেলার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট তমা তুঙ্গী। ফাইল ছবি
বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে পর্যটন খাতে কালো ছায়া পড়েছে। ভয়ে-আতঙ্কে পর্যটকরা বুকিং বাতিল করছেন। ফলে ভরা মৌসুমেও লোকসানের মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসা-সংশ্লিষ্টরা।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রতি বছর ঈদ, পহেলা বৈশাখ ও সাংগ্রাই উৎসব ঘিরে ব্যাপক পর্যটকের সমাগম হয়। বছর ঘুরে এসব উৎসব এলেও এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। বিশেষত জেলার রুমা ও থানচিতে পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। হোটেল-রিসোট পড়ে থাকছে ফাঁকা। দেখা মিলছে না দেশি-বিদেশি পর্যটকের।

সম্প্রতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর পর্যটন খাতে কালো ছায়া পড়েছে। ভয়ে ও আতঙ্কে পর্যটকরা আগে থেকে করে রাখা বুকিং বাতিল করছেন। ফলে ভরা মৌসুমেও লোকসানের মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসা-সংশ্লিষ্টরা।

পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম বান্দরবান। জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ। ইতোমধ্যে এসব স্পটের খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থানচির অবস্থান। আর রোয়াংছড়ি ২০ কিলোমিটার ও রুমার দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার।

বান্দরবান-থানচি সড়কের মাঝামাঝি জীবননগর নামক স্থানে রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট নীলগিরি। নীল দিগন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ম্রো অধ্যুষিত।

থানচি-আলিকদম সংযোগ সড়কে থানচি সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ক্রাউডং (মারমা) ডিম পাহাড় (বাংলা)। নৌপথে সাংগু নদী বেয়ে তিন্দু ইউনিয়নে রয়েছে রাজা পাথর (বাংলা)।

এরপর রয়েছে রেমাক্রী খাল। জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের রোয়াংছড়ি উপজেলার শীলবাঁধা পাড়ায় দেবতাখুমের অবস্থান। এছাড়াও রয়েছে অনেক পর্যটন স্পট।

বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত প্রাকৃতিক হ্রদ হলো বগা লেক। রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে তিন হাজার সাতশ’ ফুট উচুঁতে এর অবস্থান। লেকটি পাহাড় চূড়ায় ১৫ হাজার একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।

বগা লেক নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হল বিজয় (তাজিং ডং)। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ৫শ’ ফুট। রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে এর অবস্থান।

রুমা উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। শীত মৌসুমে এই পর্বত দেখতে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে।

এছাড়াও রয়েছে কেওকারাডং, জলপ্রপাতের পানি ঝিরসহ অনেক পর্যটন স্পট। আবার জেলার থানচিতে পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে নাফাখুম ঝরনা, আমিয়াখুং ঝরনা, ভেলাখুং ঝরনা, সাত ভাই খুং ঝরনা, লাংলুক ঝরনা, লৈক্ষ্যং ঝরনা, চিংড়িৎ ঝরনা।

প্রকৃতি এতোসব সম্ভার সাজিয়ে বসে আছে। কিন্তু তা দেখার জন্য পর্যটকের আগমন ঘটছে না। সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভয় আর আতঙ্কে তারা পার্বত্য এসব পর্যটন স্পট এড়িয়ে চলছেন।

পর্যটন-সংশ্লিষ্টরা জানান, বান্দরবান জেলায় পর্যটকদের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায়। বিরাজমান পরিস্থিতিতে এই তিন উপজেলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। ফলে এসব দর্শনীয় স্থানে যাতায়াত করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন পর্যটকরা। অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ। যানবাহন চলাচলও সীমিত। সন্ধ্যার আগেই লোকজন ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে।

রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ চলে গেল। এসব উৎসবের ছুটিতে এখানে হোটেল-মোটেলের শতভাগ রুম বুকিং হওয়ার কথা। কিন্তু এবার সেসবের কিছুই হয়নি।

হঠাৎ করে ২ এপ্রিল রাতে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরদিন দুপুরে থানচি সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে অস্থির হয়ে পড়েছে বান্দরবান।

কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। আর এই খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে ভয়-আতঙ্কে মুখ ফিরিয়ে নেয় পর্যটকরা। অথচ এই সময়টাতে থানচি রেমাক্রীতে হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম হওয়ার কথা ছিল।

পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, পর্যটক না আসার কারণে এই ঈদ মৌসুমে তাদেরকে লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনতে হবে।

নৌকার এক মাঝি জানান, থানচিতে পর্যটকের ছুটে চলার একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। এখানে নৌকার সংখ্যা রয়েছে পাঁচ শতাধিক। আর এসব নৌকা চালানোর জন্য সমসংখ্যক মাঝি রয়েছেন। তাদের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটক। নৌকা চালাতে পারলে সংসারের চাকা ঘুরবে, অন্যথায় উপোস থাকতে হবে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারা দিনশেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন।

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন বলেন, ‘সরকারিভাবে পর্যটকদের এই এলাকা ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। তবে এমন পরিস্থিতি শোনার পর আর কেউ এখানে ঘুরতে আসবে বলে মনেও হয় না। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিটরা অনেক কষ্ট ও লোকসানে পড়বে বোঝা যাচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কেএনএফ-এর শতাধিক অস্ত্রধারী ২ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুমা উপজেলার ইউএনও অফিস সংলগ্ন মসজিদ ও ব্যাংক ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকের টাকাসহ ডিউটিরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা যাওয়ার সময় রুমা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকেও অপহরণ করে। পরদিন থানচি উপজেলা শহরের সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয়।

যৌথ অভিযান চালিয়ে সোনালী ব্যাংকের অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। এরপর কেএনএফের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

এসব ঘটনায় আটটি মামলা করে পুলিশ। ঘটনার পরপরই জড়িতদের ধরতে এবং সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ৬ এপ্রিল যৌথ বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। দুদিনের অভিযানে ১৮ নারীসহ ৫৬ জনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। বাকি সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন:
পাহাড়ের পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কম্বিং অপারেশন চলবে: সেনাপ্রধান
বান্দরবানের ঘটনার প্রভাব পড়বে না পর্যটনে: টুরিস্ট পুলিশ
ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় বিদেশি মদদ নেই: কাদের
বান্দরবানে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
‘কেএনএফের হুমকি’: বান্দরবানের দুই উপজেলায় বন্ধ গণপরিবহন

মন্তব্য

বাংলাদেশ
Expats and rich people are the target of fraud traps with women

নারী দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ, টার্গেট প্রবাসী ও ধনাঢ্যরা

নারী দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ, টার্গেট প্রবাসী ও ধনাঢ্যরা এই গজারী বাগানে ডেকে নিয়েই ফাঁদে ফেলা হয় বলে অভিযোগ নাজমুলের। ছবি: নিউজবাংলা
প্রস্তাবিত স্থানে আগে থেকেই তৈরি থাকেন চক্রের সদস্যরা। ওই ব্যক্তি পৌঁছানোমাত্র তাকে আটকে রেখে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেলে মারপিটসহ জোরপূর্বক নকল বিয়ে দেন কাজী ডেকে। দেনমোহর ধার্য করেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। পরে ডিভোর্সের নামে সেই দেনমোহরের টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

প্রথমে প্রবাস ফেরত ও টাকাওয়ালা ব্যক্তিদের টার্গেট, পরে তাদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে নারী দিয়ে প্রেমের ফাঁদ পেতে ডেকে আনেন ডেটিংয়ের জন্য। প্রস্তাবিত স্থানে আগে থেকেই তৈরি থাকেন চক্রের সদস্যরা। ওই ব্যক্তি পৌঁছানোমাত্র তাকে আটকে রেখে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দাবি করেন।

চাঁদা না পেলে মারপিটসহ জোরপূর্বক নকল বিয়ে দেন কাজী ডেকে। দেনমোহর ধার্য করেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। পরে ডিভোর্সের নামে সেই দেনমোহরের টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এমনই প্রতারক চক্রের সন্ধান মিলেছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে চাম্বলতলা গ্রামে।

গত ২১ মার্চ এই চক্রের সদস্যদের কাছে প্রতারণার শিকার হন ঘাটাইল উপজেলার রহমতখাঁর বাইদ গ্রামের দুলাল মন্ডলের প্রবাস ফেরত ছেলে নাজমুল ইসলাম। এরপর বিচার চেয়ে তিনি টাঙ্গাইল আদালতে কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন।

আসামিরা হলেন- মো. জাহিদুল হাসান জাহিদ, সৌরভ তালুকদার, হুমায়ুন সিকদার রানা, বাবুল হোসেন, মো. জুয়েল, রিজান, সুজন, রায়হান, কাজী মো. তাহেরুল ইসলাম তাহের ও রাশেদা বেগম।

মামলার বিবরণে জানা যায়, পাঁচ মাস আগে দেশে ফেরেন নাজমুল ইসলাম। গত ২১ মার্চ চাম্বলতলা গ্রামের আবু তালুকদারের বাড়িতে তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে যান তিনি। সেখানে খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ৯টার দিকে সৌরভ তালুকদারের মাধ্যমে নাজমুলকে ডেকে নিয়ে নাজিম উদ্দিনের বাড়ির উত্তর পাশের গজারী বাগানে নিয়ে যান জাহিদুল। সেখানে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তারা। চাঁদা না দিলে নাজিম উদ্দিনের নাবালিকা মেয়ে সুমাইয়ার সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়।

সে সময় টাকা দিতে অস্বীকার করায় ব্যাপক মারধরের শিকার হন নাজমুল। পরে তারা কয়েকটি কার্টিজ পেপারে খুনের ভয় দেখিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তার স্বাক্ষর নেন এবং সুমাইয়াকে কাবিন ছাড়াই বিবাহের নামে নাজমুলের বাড়িতে জোরপূর্বক তুলে দেন। এমনকি পরবর্তীতে ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করলে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়।

তবে মুক্তি পেয়ে আদালতে মামলা করেন বলে নিউজবাংলাকে জানান নাজমুল।

ঘটনার বিষয়ে সুমাইয়া জানায়, সে নাজমুলকে চিনত না। জাহিদুল তার দুঃসম্পর্কের মামা হয়। জাহিদুলের কথায় সে এমনটি করেছে। প্রথমে সে রাজি না হওয়ায় তাকে মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ তার।

স্থানীয়দের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রটি এমন প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা নারীদের ব্যবহার করছে। আর স্থানীয় কাজীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।

এদিকে জানতে চাইলে ওই বিয়ে পড়ানোর কথা অস্বীকার করেন কাজী তাহেরুল ইসলাম তাহের। জানান, এ ধরনের বিয়ে তিনি পড়াননি। তবে তাকে ডেকে নেয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে ঘাটাইল থানার ওসি আব্দুস ছালাম মিয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও পড়ুন:
সিআইডি কর্মকর্তা পরিচয়ে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা
হাইকোর্টের রায় জালিয়াতি, প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার
ভুয়া এনআইডি তৈরি করে ৩০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ
ভুয়া নিয়োগপত্রে চাকরি, প্রতারক চক্রের হোতসহ আটক ২
মাদ্রাসা সুপার ও সভাপতির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ

মন্তব্য

বাংলাদেশ
The Facebook video returned the sister who was lost 30 years ago

ফেসবুকের ভিডিও ফিরিয়ে দিল ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বোনকে

ফেসবুকের ভিডিও ফিরিয়ে দিল ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বোনকে রাজধানীর মহাখালীতে আর জে কিবরিয়ার ফেসবুক শো ‘আপন ঠিকানা’র স্টুডিওতে সোমবার হাস্যোজ্জ্বল রাশিদা (বাঁয়ে) ও রহিমা। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করতে এসে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩০ বছর আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যান রাশিদা। পরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে বাসে চেপে বসেন। কিন্তু সেই বাস তাকে নিয়ে যায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার এনায়েতপুরে। এরপরের গল্প অনেক দীর্ঘ।

এ যেন রূপকথার কল্পকাহিনী। ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়া একটি ভিডিও’র সূত্র ধরে তিন দশক পর দেখা হলো দুই বোনের। অঝোরে কাঁদলেন ওরা। এই কান্না হারানো স্বজনকে ফিরে পাওয়ার। এই কান্না আনন্দের।

হারিয়ে যাওয়া বড় বোনের নাম রাশিদা। তার বর্তমান ঠিকানা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে সোনার বাংলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৫ নম্বর ঘর। আর তাকে খুঁজে পাওয়া ছোট বোনের নাম রহিমা খাতুন।

রহিমার ঠিকানা ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইকবাল রোডের একটি বাড়ি। এখানে গৃহকর্মী হিসেবে থাকেন তিনি। তার মায়ের বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে। সেখানে থাকেন তার মা মোছাম্মৎ বেগম ও ছোট ভাই ইউনুস।

সন্তানদের ছোট রেখেই মারা যান তাদের বাবা আকুব্বর। এরপর ওদের মা পুনরায় বিয়ে করেন। সেই বাবাও মারা গেছেন সাত বছর আগে।

রাশিদা তার পরিবারের খোঁজ না জানলেও তার অবস্থানস্থলের সঙ্গে মা ও ভাইবোনের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। এক পাশে কুষ্টিয়া, অন্য পাশে সিরাজগঞ্জ। মাঝখানে শুধু পাবনা জেলা।

গুগলের ম্যাপের তথ্যমতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার এনায়েতপুর গ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার। গাড়িতে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগে মাত্র ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট। অথচ এই পথটুকুর দূরত্ব ঘুচতে লেগে গেছে দীর্ঘ ৩০টি বছর।

ঘটনাটা শুরু করা যাক ৩০ বছর আগের এনায়েতপুর গ্রাম থেকে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার এই গ্রামে ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকত চার সদস্যের একটি পরিবার। মা মোছাম্মাদ বেগম, দুই বোন সাত বছর বয়সী রাশিদা ও চার বছর বয়সী রহিমা এবং দুই বছর বয়সী একমাত্র ভাই ইউনুস।

পরিবারটিতে অভাব-অনটন ছিলো নিত্যদিনের মোছাম্মৎ বেগম সে সময় পরিবারের সদস্যদের দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে বড় মেয়ে রাশিদাকে কাজে পাঠান কুমারখালীর লতিফ নামের এক ব্যক্তির ঢাকার বাসায়।

এরপর হঠাৎ একদিন গৃহকর্তা লতিফের কাছ থেকে খবর আসে যে রাশিদা তার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মা আত্মীয়-স্বজনসহ আশপাশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মেয়ের খোঁজ পাননি। নিজের নামে থাকা স্যামান্য জমিটুকু বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে রাশিদাকে খুজতে থাকেন মা। এক পর্যায়ে সেই টাকাও শেষ হয়ে যায়। আর নিখোঁজই থেকে যান রাশিদা। এই পর্যায়ে নিজ বাড়িতে বসে মেয়ের ফিরে আশায় পথ চেয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না মায়ের।

ছোট দুই ভাই-বোন রহিমা ও ইউনুস বোড় বোন রাশিদা হারিয়ে যাওয়ার মর্ম না বুঝলেও মায়ের প্রতিটি দিন কাটতে থাকে বড় মেয়ের আশায় পথ চেয়ে থেকে। এভাবেই রাশিদার পথ চেয়ে মায়ের কেটে যায় ৩০টি বছর।

এনায়েতপুর গ্রামের ছোট্ট বাড়িটিতে এখন একাই থাকেন রাশিদার মা বেগম। সাত বছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে দিন কাটে তার। একমাত্র ছেলে ইউনুস থাকে কুষ্টিয়া শহরে। আর ছোট বোন রহিমা কাজ করে ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের একটি বাসায়।

ফেসবুকের ভিডিও ফিরিয়ে দিল ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বোনকে
দীর্ঘ ৩০ বছর পর পরস্পরকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা দুই বোন। ছবি: নিউজবাংলা

যেভাবে রাশিদার খোঁজ পান রহিমা

চলতি এপ্রিল মাসে ১৬ তারিখ, রাত সাড়ে ১১টা। কুমারখালী থেকে রহিমার ফোনে আসা একটা কল সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। যেন আকাশ থেকে পড়েন রহিমা। নিউজবাংলাকে সে সময়ের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেন তিনি।

রহিমা বলেন, ‘আমি ঢাকায় যে বাসায় কাজ করি তাদের দেশের বাড়ি ঝিনাইদ শহরের আদর্শপাড়ায়। ঈদের ছুটিতে তারা ঝিনাইদহে যান। আর আমি চলে যাই কুমারখালীতে। ১৭ এপ্রিল আমাদের ঢাকায় চলে আসার কথা। তাই ১৬ তারিখেই কুমারখালী থেকে ঝিনাইদহে গিয়ে আমার গৃহকর্তার বাসায় অবস্থান করি।’

তিনি বলেন, “১৬ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টার সময় হঠাৎ আমাদের গ্রাম থেকে এক চাচা ফোনে জানান যে ফেসবুকে আর জে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা, পর্ব-৫৭৫’ নামের এক অনুষ্ঠানে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ে আমাদের গ্রামের নাম বলে নাকি আমার বোন দাবি করছে। সে সময় চাচা আমাকে ওই ‘আপন ঠিকানা’ নামের অনুষ্ঠান দেখতে বলেন।”

রহিমা বলেন, ‘এরপর আমি বাসার লোকজনে সহযোগিতায় ফেসবুকের ওই অনুষ্ঠানের ভিডিওটা দেখি। ভিডিওর ওই মেয়েকে প্রথম দেখায়ই আমার বুকের মধ্যে একটা বাড়ি মারে! সব কিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। আমার গা তখন কাঁপছিলো! মুখ দিয়ে কোন কথা আসছিলো না।

‘তবে প্রথম দেখায়ই আমি চিনে ফেলি যে এটা আমারই বড় বোন রাশিদা। চিনবো না? আমার রক্ত, আমি এক দেখায়ই চিনবো। একদম আমার মতো দেখতে। তাছাড়া ভিডিওতে সে বলছে তার ছোট বোনের নাম রহিমা, ভাইয়ের নাম ইউনুস, মায়ের নাম বেগম। সবই মিলে যায়।’

রহিমা বলতে থাকেন, ‘তখন সব কিছুই আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। আমি কল্পনাও করিনি আমি আমার বড় বোনকে আর খুঁজে পাবো!’

‘তখন শুধুই ভাবছিলাম- হারিয়ে যাওয়ার পর আমার বোনের কত কষ্টই না হয়েছে। কত আপদ-বিপদই না তার পার করতে হয়েছে। তখন থেকেই মনের মধ্যে দুমড়ে-মুছড়ে যাচ্ছে, কখন আমি আমার বোনকে সামনা-সামনি দেখতে পাবো? কখন বোনকে একটু জড়িয়ে ধরবো? বলেন রহিমা।

রহিমা আরও বলেন, “ওই রাতেই আমাদের বাসা থেকে ফেসবুকের ওই ‘আপন ঠিকানা’ নামের অনুষ্ঠান যারা করেন তাদের মধ্যে তানভীর ও আরিফ নামের দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখন তারা বলে- ‘আপনারা ঢাকায় আসেন। আমরা রাশিদাকেও ঢাকায় এনে একদিন সময় করে আপনাদের একসঙ্গে মিলিয়ে দেব।’ এরপর আমি কুমারখালীতে মাকে ফোন করে ঘটনা জানাই। মা মনে হয় এখন বোনকে দেখার আশায় ঘুমাতে পারছে না। শুধু কান্নাকাটি করছে।”

দু’বোনের দেখা হয় যেভাবে

আর জে কিবরিয়ার ফেসবুক শো ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠান থেকে তানভীর ও আরিফ নামের দুজন রহিমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ২২ এপ্রিল (সোমবার) বিকেলে মহাখালীতে অবস্থিত তাদের স্টুডিওতে যেতে। সেখানেই তাদের ক্যামেরার সামনে হারিয়ে যাওয়ার পর দুই বোনের প্রথম দেখা হবে।

মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে সময় হাতে রেখেই রওনা দেন রহিমা। এরপর বিকেল ৫টায় রহিমার জীবনে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আপন ঠিকানা অনুষ্ঠানের স্টুডিওতে দেখা হয় ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বড় বোন রাশিদার সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই দুই বোন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এ সময় কুষ্টিয়ার কুমারখালীর এনায়েতপুর গ্রামে থাকা রহিমার মা বেগমের সঙ্গেও ভিডিও কলে দেখা ও কথা হয় রাশিদার। সে সময় মা-মেয়ে দু’জনই অঝোরে কাঁদতে থাকেন। ফিরে পাওয়া মেয়েকে উদ্দেশ করে মা বলতে থাকেন- ‘তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। আমি তোকে ছুঁয়ে দেখবো।’

রাশিদা স্টুডিও থেকে বের হয়ে রহিমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তোর তো নাকফুল ছিলো না, এখন তোর নাকে নাকফুল। তুই কত বড় হয়ে গেছিস। আমার ছোট ভাইটাও মনে হয় অনেক বড় হয়ে গেছে। মাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে খুব মন চাচ্ছে।’

এই পর্যায়ে দুই বোনের কান্নায় আর সব কথা হারিয়ে যায়।

ফেসবুকের ভিডিও ফিরিয়ে দিল ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বোনকে
বাঁ থেকে- রাশিদা, রহিমা, রহিমার বড় ছেলে রাহুল ও রাশিদার বড় ছেলে শাকিল। ছবি: নিউজবাংলা

রাশিদার জীবনের গল্প

৩০ বছর আগে রাশিদার হারিয়ে যাওয়ার গল্প জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ছোট বেলায় মা যে বাড়িতে আমাকে কাজ করতে পাঠিয়েছিলো সেখানে বাসার লোকজন আমাকে খুব মারতো। একদিন মেরে তারা আমার মাথা দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। সেদিনই রাগ করে ওই বাসা থেকে পালিয়ে একটা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার গাড়িতে উঠে বসি।

‘ওই বাসে ওঠার বিশেষ কারণও ছিল। বাসের লোকজন বলছিলো যে উল্লাপাড়ায় একটা এনায়েতপুর আছে। সে সময় আমার মনে ছিলো যে আমার বাড়িও এনায়েতপুরে। কিন্তু আমার জেলা কুষ্টিয়া, থানা কুমারখালী সেটা তখন মনে ছিলো না।’

রাশিদা বলেন, উল্লাপাড়ার এনায়েতপুরে গিয়ে দেখি এটা আমার বাড়ির এনায়েতপুর না। তখন ওই এনায়েতপুরের এক মহিলা তাদের বাড়িতে থাকতে দেয়। তাদেরও কোনো মেয়ে সন্তান ছিল না। এর কিছুদিন পর তারা আমাকে তাদের পারিচিত একজনের ঢাকার শ্যামলীর বাসায় কাজ করতে পাঠায়। সেখানে আমি অনেক বছর থাকি।’

রাশিদা জানান, শ্যামলীর ওই বাসার লোকজন তাকে একসময় বিয়ে দিয়ে দেন। তার স্বামীর বাড়িও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি উল্লাপাড়ায় চলে যান। তখন থেকে তিনি এখানেই ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারীর সময় আমার স্বামী করোনায় মারা যায়। তারপর সরকার আমার থাকার জন্য এনায়েতপুরের এক আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটা বাড়ি বরাদ্দ দেয়। এখন আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে টিউবওয়েল বসানোর কাজ করে এবং মেঝো ছেলে এতিমখানায় থাকে। আর ছোট সন্তান মেয়েটা আমার সাথেই থাকে। আমি মানুষের বাসায় কাজ করি।’

ফেসবুক শো ‘আপন ঠিকানা’র খোঁজ পেলেন কীভাবে জানতে চাইলে রাশিদা বলেন, ‘আমি যে বাড়িতে কাজ করি ওই বাড়ির মেয়ে আমাকে এই অনুষ্ঠানের খোঁজ দেয়। সেই আমাকে এখানে নিয়ে আসে।’

রাশিদা বলেন, ‘এখন আমার একটাই চাওয়া আমার ভিটেয় (বাড়ি) যাওয়া। আমি আজ সিরাজগঞ্জ চলে যাব। তবে দুই-একদিনের মধ্যেই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কুষ্টিয়ায় মায়ের কাছে যাব। মায়েরে ছুঁয়ে দেখব।’

সবশেষে তিনি বলেন, ‘সামান্য জেলা আর থানার নাম মনে না থাকায় আজ ৩০ বছর আমি আমার পরিবার থেকে আলাদা। আমার শুধু মনে ছিলো এনায়েতপুর গ্রামের কথা। কুমারখালীর এনায়েতপুরের খোঁজে বের হয়ে আমি এখনও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আরেক এনায়েতপুরের বাসিন্দা হয়ে আছি।’

মন্তব্য

p
উপরে