হিন্দুসংহতি নামের পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক গৌণ একটি সংগঠনের একটা পোস্টার থেকে আলাপ সামনে এলো আবারও, বাংলাদেশি ভাষাকে সনাতনী ভাষা থেকে পৃথক করবার দাবি করেছে সংগঠনটি। কেবল এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনটির কারণেই নয়, পূর্ব বাংলার ভাষা আর পশ্চিম বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য, ভালো-মন্দ, শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণামূলক অনেক আলাপও বহুকাল ধরেই হয়ে এসেছে। আমার আলাপটা তাই উপসংহার দিয়েই শুরু করি।
আজকে যেমন অনেকের কাছে পূর্ব বাংলার ভাষা মানে মুসলমানি বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষা মানে শুদ্ধতর/প্রমিততর/সনাতনী বাংলা, চিরকাল কিন্তু বিতর্কের বিবেচনাটা সম্প্রদায়ভিত্তিক ছিল না। বাংলা ভাষার ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং প্রাচীনতম কোন্দলটি ছিল বরং আঞ্চলিকতার। পূর্ববাংলার ভাষারীতিকে গৌণ কিংবা উপহাস করাটা ছিল তার বৈশিষ্ট্য, মুসলমানি ভাষা বলে তাকে খোঁটা দেয়া হয়নি। অন্যদিকে বিশ শতকের শুরুতে উপনিবেশোত্তর মুসলমানরা বাংলায় সাহিত্যচর্চা শুরু করলে, বাংলা ভাষার হিন্দু রূপ ও মুসলমান রূপ নিয়ে নতুন একটা বিতর্ক শুরু হয়।
দ্বিতীয় পর্বের এই হট্টগোলের সাথে পূর্ব-পশ্চিম আঞ্চলিকতার কোনও সম্পর্ক ছিল না বরং সেই তর্কের অন্যতম একটি চরিত্র কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বর্ধমানের লোক, অর্থাৎ ভাষার সাম্প্রদায়িক রূপ কেন্দ্রিক বিরোধটা ছিল স্থাননিরপেক্ষ। কেবলমাত্র ১৯৪৭ সালের পর ভাষারও স্থানভিত্তিক সাম্প্রায়িক চেহারা তৈরি হয়। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ভাষা অর্থে মুসলমানি বাংলা এবং বিপরীতক্রমে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা অর্থে সনাতনী/হিন্দু/প্রমিত বাংলা এই দুইটি বর্গে বিভক্ত হয়। স্থান ও সম্প্রদায়ের এই সমাপতনের জটিলতা থেকে মুক্ত করে এইখানে আপাতত আমরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ইতিহাস আলোচনা করব না বরং আঞ্চলিক বিভাজনটার ওপরই কিছুটা আলোক ফেলবার চেষ্টা করব।
জিম্মিসংকট
বছর কয়েক আগে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার এক আলাপচারিতায় দাবি করেন ‘জিম্মা’ শব্দটা বাঙলাভাষায় নেই, কারণ পশ্চিমবঙ্গে কেউ এটা ব্যবহার করেন না। ভদ্রলোককে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক: ‘...আজকের কাগজে আছে, কতজন বাঙালি বা বাংলাদেশিকে লিবিয়া জিম্মা নিয়েছে, ৪০০ বাঙালি। ‘‘জিম্মা’’ শব্দটা কেন লিখবে? ‘‘জিম্মা’’ তো বাংলা শব্দের ধারে কাছে নেই।... আত্মীকরণ দিয়ে বুঝতে চান, যে কোনো ভাষার ওপর শব্দ আসবে। যেমন, ইংরেজিতে টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট হিসেবে এসেছে। সেটা অভ্যেস হিসেবে এসেছে। পশ্চিম বাংলায় কোনো মানুষের ভাষায় জিম্মা শব্দ শুনবেন না। কবিতা পড়েন, গদ্যে পড়েন, গল্প পড়েন। কোথাও জিম্মা শব্দটা ছিল না। এগুলো কেন জানি মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে এইসব শব্দ টুকটুক করে ঢোকাচ্ছে। আমার চেয়ে আপনারা ভালো বুঝবেন (যেগুলো আকাশে ভাসে সেগুলো তাৎক্ষণিক সাহিত্য : সাখাওয়াত টিপু ও ফরিদ কবির এর সাথে কথোপকথন) !’
উদ্ধৃত অংশটুকুতে উর্দু-আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিষয়ক একটা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক গন্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে সমরেশ খুব জোর গলাতেই বলতে পারছেন যে বাংলা ভাষার শুদ্ধতার মানদণ্ড হলো পশ্চিমবঙ্গে তার প্রচলন আছে কি-না, অর্থাৎ স্থানের বিরোধটা আমরা এখানে পাচ্ছি। সেখানকার কেউ যদি জিম্মা/জিম্মি ব্যবহার না করেন, তাহলে শব্দটার আত্মীকরণের দাবি করা যাবে না।
তথ্যগত দিক দিয়ে সমরেশের দাবি যে অত্যন্ত ভুল তাতে সন্দেহ নেই। ভাষার গতিশীলতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে ভাবনার প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, তা নিতান্তই কিশোরসুলভ এবং বিপজ্জনক রকম রক্ষণশীল। ‘জিম্মা’ শব্দের পক্ষে সমরেশ মজুমদারের তুলনায় বাংলা ভাষার অনেক বড় ওজনদার, অনেক বেশি মহত্তর সাক্ষীর দোহাই দিতে পারি, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তার ‘কাব্য: স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট’ নামের রচনাটি থেকে উদ্ধৃত করা যাক: ‘‘কপালকুণ্ডলার শেষ পর্যন্ত শুনিয়া তবু যদি ছেলেমানুষের মতো জিজ্ঞাসা কর ‘‘তার পরে” তবে দামোদর বাবুর নিকটে তোমাকে জিম্মা করিয়া দিয়া হাল ছাড়িয়া দিতে হয়।’
আমাদের মতো বাঙ্গালরা সব হাফ ছেড়ে বাঁচে। ভাগ্যিস রবি ঠাকুরের বরাত দেয়া গেল। না হলে জিম্মা-জিম্মি-জিম্মাদার-এর মতো কতগুলো অতি জরুরি শব্দও ‘অনাত্মীয়’ তকমায় ভাষার ভেতর-বাড়িতে আর ঢুকতে পেত না, সমরেশীয় শুদ্ধি অভিযানে হয়তো তাদের বিদায় দিতে হতো। পশ্চিমবঙ্গে আদৌ ব্যবহৃত না হয়ে যদি থাকেও, পূর্ববঙ্গে তো কিছু পরিস্থিতির প্রকাশে ‘জিম্মি’ ব্যবহার অনিবার্য। পণবন্দী শব্দটির ব্যবহার এখানে বিরল, যদিও অজ্ঞাত নয়, জানি না জিম্মদারের বিকল্প সেখানে কী। ন্যাসরক্ষক? কিন্তু প্রশ্নটা এখানে না যে রবিঠাকুর ব্যবহার করে জিম্মাকে আত্মীয়ের স্তরে শোধন করেছেন, সংকটটা আসলে খবরদারির, একটা নির্ধারক মানসিকতার। ঐতিহাসিক নানান কারণে পূর্ববঙ্গের দিক থেকে এই খবরদারির কিংবা শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারের চেষ্টার তেমন কোনো খবর পাওয়া যাবে না। খবরদারি বা মুরুব্বিগিরি না করতে যাবার মাঝে ঔদার্য বা স্বভাবসিদ্ধ মহত্ত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তার মাঝে হয়তো পূর্বাঞ্চলের ঐতিহাসিক/সাংস্কৃতিক যে মুখাপেক্ষিতা পশ্চিমাংশের প্রতি, তারই একটা স্বাভাবিক স্বীকৃতি আছে, তবে নির্ভরশীলতামুক্ত হবার চেষ্টাও আছে। প্রবণতা হিসেবে সাধারণভাবে দেখা যাবে পূর্বাঞ্চলের প্রতিক্রিয়ায় বৈচিত্রের স্বীকৃতি প্রদানের চেষ্টা করে নিজের অবস্থানকে যুক্তিসিদ্ধ করবার চেষ্টা আছে, পশ্চিমের আছে অটল-অনড় প্রমিতের দাবি।
পশ্চিমবাংলার ঐতিহ্যগত আভিজাত্য আর প্রাধান্যের পরও, এমনকি চুম্বকের মতো অদৃশ্য শক্তিতে বহুদূর থেকেই পূর্বের মননের একটা বড় অংশকে মজিয়ে রাখলেও পূর্ববাংলার জল-কাদামাখা বুনো প্রাণশক্তিও কখনও অলক্ষে এবং কখনও প্রকাশ্যে ঠিকই আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেছে। ভাষাকে যদি আমরা একটা সামাজিক উৎপাদ বলে ধরি, পূর্ব বাংলার ভাষার এই শক্তিমত্তার রহস্যটি খুঁজতে হবে বাংলা নামের বদ্বীপের দুই অংশের প্রাকৃতিক গঠনে। এটার পশ্চিমাংশ ভূগোলবিদদের ভাষায় নিষ্ক্রিয়, অন্যদিকে বদ্বীপটির পূর্বাংশ প্রতিবেশগতভাবেই সক্রিয়। তারই ছাপ পড়েছে গত কয়েকশ বছর ধরে এর উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকাশে এবং গত একশ বছরে তার রাজনীতিতে।
বাঙ্গালের দুর্গতি, বাঙ্গালের জবাব
পূর্ব-পশ্চিমের এই ভাষারীতির বিবাদ কিন্তু স্মরণাতীত কালের। কত পুরানো সেই হদিস যে কে জানে, তা জানি না, কিন্তু কত পুরানো হতে পারে, তার একটা আন্দাজ দেয়া সম্ভব। একদা মঙ্গলকাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সমুদ্রযাত্রায় ঝড়ে সওদাগরের সর্বস্বান্ত হবার বর্ণনা। তারপর: ‘সমুদ্র ঝড়ে সর্বস্বান্ত সদাগরের করুণচিত্রের পার্শ্বে মঙ্গলকাব্যের পশ্চিমবঙ্গের কবিগণ একটি হাস্যরসের চিত্রও পরিবেষণ করিতেন, তাহা বাঙ্গাল মাঝিদের খেদ (শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য: বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস)।’ বোঝা গেল এখনকার মতো তখনও নৌচালনার মতো শ্রমসাধ্য কাজে পূর্ববঙ্গের মাঝিমাল্লারাই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু আরও যা বোঝা গেল, বাঙ্গালের ভাষা হাস্যরসের নিয়মিত নিমিত্তও ছিল।
পূর্ব বাংলার ভাষা নিয়ে উপহাসের আরও একটা নির্দোষ এবং পুরাতন উদাহরণ দেয়া যাবে, সেটা রঙ্গপ্রিয় পরমপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের। সেই পরম পাগল চৈতন্যদেব, যার প্রভাবে কবিদের আত্মম্ভর ভনিতা উধাও হয়ে আসলো ভক্তের আত্মনিবেদন, অ-জাতেরেও যিনি বিনা সংকোচে জড়িয়ে ধরতে পারতেন। বাংলা সাহিত্যের সেই সর্বশক্তিমান প্রভাবক ছিলেন খুবই আমুদে মানুষ, হাস্য-পরিহাসে ওস্তাদ। কমবেশি অন্য জেলার উচ্চারণ নিয়ে রসিকতা বাংলায় নির্দোষ পরিহাস হিসেবে সাধারণত বিবেচিত হলেও নিজের পূর্বপুরুষের বসতি সিলেটি উচ্চারণ শুনে তার আমোদ:
‘বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া
কদর্থেন সেইমত বচন বলিয়া ॥’
আর সাধারণভাবে বাঙ্গালের মুখের ভাষা নিয়ে প্রভূর পরিহাস:
‘সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
বঙ্গদেশী যেন মত আছিলের বঙ্গে ॥
বঙ্গদেশী বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙ্গালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া॥’
মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব ঐতিহ্য পাড়ি দিয়ে ঊনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণেও সেই ধারা অব্যাহতই ছিল। বাঙ্গালের দশা যে পাল্টায়নি তার সাক্ষ্য মিলবে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত একটি নাটকের সংলাপে, সেটি দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এই নাটকটিতে বাঙ্গাল বিষয়ে প্রচলিত গোটা চারেক রঙ্গব্যাঙ্গ-রসিকতা তুলে ধরা হয়েছে, একটা আপাতত এখানে উল্লেখ করা যাক। ক্রমাগত ‘বাঙ্গাল’ গাল শুনে শুনে অতিষ্ট বেঢপ মাতাল রামের পপাত ধরণীতলে যাবার ঠিক আগে আগে দেয়া প্রত্যুত্তরে একাধারে ক্রোধ, লাঞ্ছনা আর অসহায়ত্বের চিত্র ফুটে ওঠে: ‘পুঙ্গির বাই বাঙ্গাল বাঙ্গাল কর্যা মস্তক গুরাই দিচে —বাঙ্গাল কউস ক্যান্—এতো অকাদ্য কাইচি তবু ক্বলকত্বার মত হবার পারচি না? ক্বলকত্বার মত না কর্চি কি? মাগীবারী গেচি, মাগুরি চিকোন দুতি পরাইচি, গোরার বারীর বিস্কাট বক্কোন করচি, বাণ্ডিল খাইচি—এতো কর্যাও ক্বলকত্বার মত হবার পারলাম না, তবে এ পাপ দেহতে আর কাজ কি, আমি জলে জাপ দিই, আমারে হাঙ্গোরে কুম্বিরে বক্কোন করুক—’
এমনি আর একটা রসিকতা কোনো একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম (সুনীলের কি?), পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া বাঙ্গালদের প্রতি কলকাতায় বিদ্রুপের একটি আদর্শ নমুনা। সম্ভবত কোনো পুরানো গানের ব্যাঙ্গাত্মক রূপ:
‘বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা আমি ঢাকার বাঙাল নহি গো।’
বাঙ্গালের উচ্চারণ নিয়ে রসিকতা করে বানানো একটি সংস্কৃত শ্লোকের কথাও মনে পড়ছে, সেখানে পূর্বদেশ কিংবা বঙ্গদেশের মানুষের কাছ থেকে আর্শীবাদ না নেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে, কেননা তারা ‘শতায়ু’ বলতে গিয়ে ‘হতায়ু’ বলে ফেলে। তবে এটা বাঙ্গালের জন্য প্রযুক্ত হলেও হয়তো এই শ্লোকটির উৎপত্তি আসামকে নিয়ে, সেখানেও হ ও স বর্ণের স্থানান্তর ঘটে। সে যাই হোক, ভাগ্যিস আয়ুর দেবতা শুধু মুখের কথাই শোনেন না, অন্তরের ব্যাথাও ঠিকঠাক টের পান, তাই মা-বাপের দোয়াতে বাঙ্গাল বেঁচেবর্তে আছে এখনও।
এমনই অজস্র উদাহরণ প্রচলিত ছিল, কিন্তু আশা করি এই দৃষ্টান্তগুলোই পরিস্থিতি বোঝাতে যথেষ্ট হবে। ঔপনিবেশিক বাংলায় ছাপাখানা পরবর্তী যুগে এর বহুমুখী তাৎপর্য তৈরি হয়। শত কিংবা হাজারে ছাপা বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বেন সাহিত্যিক, ছড়িয়ে পড়বে মত, পথ, তত্ত্ব কিংবা রাজনীতি। ফলে ঊনিশ শতকে বিষয়টা আর কেবল ‘কদর্থ’ করা বা রঙ্গবিদ্রুপ করা নয়, এলো ঘোষণা: বাঙ্গাল ভাষা দূষিত।
পূব আর পশ্চিমের বাংলার এই রেষারেষির পূব দিক থেকে জবাব দেয়ার জন্য বাঙ্গালকে মনে হয় দীর্ঘ অপেক্ষাই করতে হয়েছে। পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বিখ্যাত পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৮৬ সংখ্যায় ‘পূর্বাঞ্চলীয় ভাষা’ নামের নিবন্ধটিতে পূর্বাঞ্চলের ভাষাকে পশ্চিম কতটা অবমাননার চোখে দেখে, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে, পূর্ববঙ্গের ভাষাকে তারা এত অশুদ্ধ মনে করেন যে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছে:
‘তাহাদিগের মতের সারমর্ম এই যে, পূর্ব্বাঞ্চলের লোকে লেখাতে এমন অনেকপ্রকার রীতির অনুসরণ করেন তাহা হিন্দুস্তানে নয়, চব্বিশ পরগনা, হুগলী, নদীয়া ও বর্দ্ধমান এই কয়েকটি জেলায় প্রচলিত হয় না। অতএব উহা তাঁহাদিগের শ্রুতিকটু হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত তাহা অশুদ্ধ। যদি পূর্ব্বাঞ্চলীয় গ্রন্থকারগণ ঐ সকল দোষ পরিত্যাগ করিয়া লেখেন, তাহা হইলে তাহাদের পুস্তকের প্রতি কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাইতে পারে।
কী ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনা! কিন্তু এতেও কি শেষ আছে!
‘সোমপ্রকাশ সম্পাদক এই দোষের নিবারণের জন্য প্রস্তাব করিয়াছেন যদি পূর্ব্বাঞ্চলীয় কোন লোকে কখন কোন পুস্তক লিখিতে প্রবৃত্ত হন তখন যেন তাঁহারা পশ্চিমাঞ্চলীয় কোন ব্যক্তি দ্বারা তাহাদিগের লেখা সংশোধন করাইয়া লন।’
‘সোমপ্রকাশ’-এর বক্তব্যটুকু আদতে কী ছিল, তা গবেষকদের খুঁজে দেখা অত্যাবশ্যক, শুধু ঢাকা প্রকাশের নালিশটাই আমার দেখা সংকলনটিতে জানতে পেরেছি। তবে ‘সোমপ্রকাশ’-এর উস্কানিটি যে নিতান্তই সামান্য ছিল না, তা বোঝা যায় জল অনেকদূর গড়ানো থেকে। এই কথিত রূঢ়তার প্রত্যুত্তরে ‘ঢাকা প্রকাশ’ ভাষার শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা প্রশ্নে বিস্তারিত যুক্তি প্রদর্শন করেন, ঘোষণা করেন যে ‘বাঙ্গলা ভাষায় অল্পদিন হইল পুস্তক রচনা হইতে আরম্ভ হইয়াছে... কোন গ্রন্থকারই এমন শক্তি প্রদর্শন করিতে সমর্থ হন নাই, যে তাহার পুস্তক চিরকাল বা বহুদিন আদরণীয় থাকিবে এবং সেই পুস্তক ভাষার আদি সম্পত্তিরূপে বিবেচিত হইবে... যখন ভাষায় এমন পুস্তক লিখিত হইবে যে, সকল লোকেই তার গুণে বশীভূত হইয়া তাহার নিকট মস্তক অবনত করিবে... তখন সেই সমুদয়পুস্তক দেখিয়া ব্যকরণ রচনা হইবে। তখন বলা যাইবে ভাষার রীতি এই...।’
এভাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’ সন্দেহাতীতভাবেই দেখিয়ে দেয় যে, বাংলা ভাষার তখনও পর্যন্ত কোনো ব্যাকরণ কিংবা সুনির্দিষ্ট লিখনশৈলী দাঁড়ায়নি, ‘সোমপ্রকাশ’সহ অনেকেই নতুন নতুন প্রণালী প্রচলিত করছেন। ঢাকা প্রকাশের প্রবন্ধকার আরও মত প্রকাশ করেন যে, ‘বিদ্যাসাগর, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি কলিকাতার প্রসিদ্ধ লেখকেরা যে হইবেক করিবেক এবং অতীত কালার্থে করেন, যান, দেন ইত্যাদি ব্যবহার করিয়াছেন, তৎপ্রতি দৃষ্টি না করিয়া যদি ইহাতে স্বীকার করা যায় যে ঐ অঞ্চলের কোন লেখকই এইরূপ শব্দব্যবহার প্রণালী অবলম্বন করেন না, তথাপি এই প্রণালীর অশুদ্ধতা কোন রূপে প্রমাণিত হয় না... এদেশ হইতে আমরা যদি আদেশ প্রচার করিয়া দি যে, অমুক অমুক শব্দ ও রীতি এদেশে প্রচলিত নাই, এদেশের গ্রন্থকাররা ব্যবহার করেন না ও এদেশের লোকের নিকট শ্রুতিকটু শুনা যায় অতএব কোনস্থানের লোকেই যেন তাহা ব্যবহার না করেন, তাহা হইলে আমাদিগের কথা যতদূর সঙ্গত ও প্রামাণ্য হইবে, অন্যস্থান হইতে ঐ প্রকার কথা বলিলেও তদরূপই হইবে সন্দেহ নাই।’
পুরো একশত তিরিশ বছর আগে ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামের পত্রিকাটি সমরেশ মজুমদারের হাল আমলে ছড়ানো বিভ্রান্তির উত্তর দিয়ে রেখেছে! তবে দ্রষ্টব্য যে এখন পর্যন্ত প্রদত্ত উদাহরণগুলোতে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ছাপ মেলেনি। সেটা শুরু হয় মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান পরবর্তীকালে এবং, যেটা আগেই বলেছি, ১৯৪৭ এর পর অঞ্চল আর সম্প্রদায়ের পরিচয় এই যুদ্ধে একাকার হতে শুরু করে। আরও খেয়াল করবার বিষয় হলো, ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তির জায়গাতে ‘ঢাকা প্রকাশ’ বরং কিছুটা রক্ষণাত্মক, ‘সোমপ্রকাশ’ আক্রমণাত্মক। এর কারণ খানিকটা আগেই ইঙ্গিত করেছি।
ভাষার বিষয় বৈচিত্রের স্বীকৃতি নিয়ে আগ্রহী থাকলেও সব ক্ষেত্রে ‘ঢাকা প্রকাশ’ কিংবা বাঙ্গাল প্রতিনিধিরা অতটা নমনীয় ছিলেন না, তারও দৃষ্টান্ত আছে। ওই ‘ঢাকা প্রকাশ’-এই পূর্বঙ্গীয়দের প্রতি এই ‘বিজাতীয় ঘৃণা’র জবাব ‘খোষ খবর’ শিরোনামায় পুরুষালী একটি উত্তরও দেয়া আছে। কেন পূর্ববঙ্গবাসীদের বাঙ্গাল বলা হয় সে নিয়ে পাঠানো এক প্রশ্নের জবাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর রায়: ‘পত্র প্রেরকের লিঙ্গজ্ঞান থাকিলে বুঝিতেন; বাঙ্গাল শব্দটি পুংলিঙ্গ, আর বাঙ্গালী শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ।’ পশ্চিমা ভাইদের নিয়ে পূব দিকে এই মশকরাটি বোধহয় বেশ জনপ্রিয় ছিল, প্রায় অর্ধশতক পর অদ্বিতীয় পরিহাসবিদ ভানুও পশ্চিমবঙ্গবাসীকে জব্দ করতে লিঙ্গভেদের এই একই পুরুষালী অস্ত্রটি শানিয়েছিলেন বাঙ্গালের তূণ থেকে।
অবসরভোগী বনাম মেহনতি
প্রত্যুত্তর শুরু করলেও বহু মানদণ্ডে পূর্ব বাংলা পিছিয়ে যে বরাবরই ছিল, তার একটা নিদর্শন পাওয়া যাবে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর একটা ঘটনা থেকে। বাংলা ১৩০৮ সালে ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর মালিকানা কেনেন ত্রিপুরার মহারাজার মন্ত্রণাদাতা রাধারমণ। কারণটা ছিল অপমানবোধ। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার অফিসে গেলে কথাপ্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ রাধারমণকে বলেন, ‘তুমি যাহাই বলো না কেন, যেখান হইতে এই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও পড়িবার যোগ্য একখানি সংবাদপত্র প্রকাশিত হইতে পারে নাই, সেখানকার শিক্ষা দীক্ষার গৌরব করা যাইতে পারে না।’
‘পড়িবার যোগ্য’ কাগজ শুধু নয়, এই ঘটনার বহু বছর পরও সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা-সাংস্কৃতিক তৎপরতায়ও যে পূর্ববঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে ছিল, এ তো সত্যি। কারণ উৎপাদনের বৃহদাংশ পূর্বের চাষীরা সম্পাদন করলেও ভোগটা প্রায় সর্বাংশে ঘটতো কলকাতা শহরে। উঁচুসাহিত্য তো অবসরজীবীদের বিলাস, শ্রমক্লান্ত পূর্ব বাংলা থেকে জমিদাররা রস অপহরণ করে কলকাতায় যে-বাংলা সংস্কৃতির গোড়ায় তা সিঞ্চন করেছেন, তারই অনিবার্য ফল এটা। এরই ফল বাঙ্গালের কলকাতায় আকর্ষণে ছুটে যেতে বাধ্য হওয়া। ‘কলকাত্তাইয়া’ হবার প্রাণপণ আকুতি, শুধু জমিদারির খাজনা ওড়ানোই নয়, শিক্ষা আর চাকরিরও সেরা সুযোগগুলো তখন কলকাতাকেন্দ্রিক, কিংবা সেখান থেকেই তা বণ্টিত হয়, এরই ফল বাঙ্গালের মুখের ভাষার অশুদ্ধ ঘোষিত হওয়া। কিন্তু এত কিছু ছাপিয়েও চাষাড়ে সুলভ গোঁয়ার্তুমির শক্তি তার ছিল। পাশাপাশি ছিল সহজ সজীব সৃজনশীলতা, বাংলাভাষা বহুবার তাতে সমৃদ্ধ হয়েছে। কলকাতা বাঙ্গালকে উদ্বাস্তু শ্রমিক কিংবা বিলাসী বাবু আকারে টেনে নিলেও আপন ছাপ সে কলকাতার ভাষাতেও ঠিকই রেখে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন। ভাষার গতিশীলতার দিকেও তার নজরটা কড়াই ছিল:
‘কলকাতা শহরের নিকটবর্তী চার দিকের ভাষা স্বভাবতই বাংলাদেশের সকল দেশী ভাষা বলে গণ্য হয়েছে। এই এক ভাষার সর্বজনীনতা বাংলাদেশের কল্যাণের বিষয় বলেই মনে করা উচিত। এই ভাষায় ক্রমে পূর্ববঙ্গেরও হাত পড়তে আরম্ভ হয়েছে, তার একটা প্রমাণ এই যে, আমরা দক্ষিণের লোকেরা ‘‘সাথে’’ শব্দটা কবিতায় ছাড়া সাহিত্যে বা মুখের আলাপে ব্যবহার করি নে। আমরা বলি ‘‘সঙ্গে’’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কানে যেমনি লাগুক, ‘‘সঙ্গে’’ কথাটা ‘‘সাথে’’র কাছে হার মেনে আসছে। আরও একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। মাত্র চারজন লোক : এমন প্রয়োগ আজকাল প্রায় শুনি। বরাবর বলে এসেছি ‘চারজন মাত্র লোক', অর্থাৎ চারজনের দ্বারা মাত্রা-পাওয়া, পরিমিত-হওয়া লোক। অবশ্য ‘মাত্র’’ শব্দ গোড়ায় বসলে কথাটাতে জোর দেবার সুবিধে হয়। ভাষা সব সময়ে যুক্তি মানে না।’
সার্বজনীন বাংলা হিসেবে কলকাতার বাংলাকে বাংলার জন্য কল্যাণকর বিবেচনাটি নিয়ে এক দফা জরুরি আলাপ হওয়া দরকার। তবে রবীন্দ্রনাথ এইখানে কলকাতা শহরের ভাষাকে ‘সকলদেশীর’, সেই হিসেবে, সর্বজনীন ঘোষণা করার পরও, তাকে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণের বিষয় হিসেবে মানদণ্ডরূপে বিবেচনা করলেও বাস্তবতার ঝাঁঝ ততদিনে বোঝা যাচ্ছে। ও-দেশীয় কানে তা যেমনটাই লাগুক, কলকাতার দোর্দণ্ড প্রতাপের যুগেই পূবের রুচি যে তাতে ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল, সেটা এই সাক্ষ্যে ভালোমতোই বোঝা যায়।
‘সঙ্গে’ কথাটার তুলনায় ‘সাথে’ এমনই অনাড়ম্বর, সরল এবং আন্তরিক, হার না মেনে সঙ্গের হয়তো উপায় ছিল না। মুখের ভাষার জন্য বারণ হলেও কবিতার জন্য যে তা জায়েজ ছিল, তার কারণ হতে পারে এটাও যে ‘সঙ্গে’ কথাটার ছন্দসঙ্গী মোটে কয়টা: রঙ্গে-ঢঙ্গে-বঙ্গে-জঙ্গে-ভঙ্গে-টঙ্গে ইত্যাদি। অন্যদিকে ‘সাথে’ শব্দটির ছন্দসাথী অজস্র। কাব্যভাষা আর মুখের ভাষার মাঝে প্রভেদ মানার শিক্ষিত অনুশীলন সর্বজনের থাকে না বলেই কলকাতাবাসীদেরও হয়তো অনেকেই সহজে ‘সাথী’ হয়েছেন, ছন্দের শক্তিতেই। কিংবা আরও একটা সম্ভাবনা হলো জনদেবতার রায়; কলকাতা তো শুধু সংস্কৃতি আর ভোগের মধুর লোভে উড়ে যাওয়া অনুপস্থিত জমিদারদের কমলালয় ছিল না, পেটের খিদায় পাটকল-চটকলের টানে ঘূর্ণিবায়ুতে বালুকণার মতো বাংলার সর্বত্র থেকে তারা জড়ো হচ্ছিল কলকাতায়। হয়তো তাদের সূত্রেও সাথী হঠিয়ে দিচ্ছিল সঙ্গীকে। সৈয়দ মুজতবা আলীও তার একটি প্রবন্ধে বাংলা ভাষার জমাখরচ হিসেব করতে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাপটে পশ্চিম বাংলার কথ্যরীতির পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন।
‘সঙ্গে’ এবং ‘সাথে’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আঞ্চলিকতার গোড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে একে গ্রহণ করবার পক্ষেই ইশারা দিয়েছিলেন বটে, পূর্ববাংলায় কিন্তু তা এখনও বেশ জোরেশোরেই সিন্দাবাদের ভূতর মতো চেপে বসে আছে, কোনো কোনো স্থলে হয়তো নিছক অভ্যাসবশতই, নিজেদের অজ্ঞাতসারেই। একটা উদাহরণ দেই। বহু বছর পর একটি দৈনিক পত্রিকায় চাকরিসূত্রে সেখানকার বানান মার্জনাকারীদের মুখে প্রথমবার শুনেছিলাম, কবিতা ছাড়া অন্য সর্বত্র ‘সাথে’ কেটে ‘সঙ্গে’ করতে হবে, সেটাই শুদ্ধ। অবাক হয়েছিলাম, কলকাতার ভরামাঠে খেলায় জিতে এসেও নিজের দেশেই ‘সাথে’ হীনম্মন্যতা সংস্কারের শিকার হয়ে আছে আজও! অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, মাহবুবুল হক, সাজ্জাদ শরীফ, অরুণ বসু ও ফরহাদ মাহমুদের মতো চার কৃতী ভাষা বিশেষজ্ঞ মিলে যে প্রথম আলো ভাষারীতিটি তৈরি করেছেন, সেখানেও ‘সাথে’ ব্যবহার না করে ‘সঙ্গে’ ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। যদিও পত্রিকাটার অন্তর্জালিক ঠিকানাতে সঙ্গে আর সাথে দুটিই ব্যবহারেরই নমুনা আছে, ছাপা পত্রিকাতে সঙ্গের সংখ্যাই বিপুল।
কিন্তু বাংলা ভাষা ঔপনিবেশিক কলকাতার ছকে চিরতরে আটকা পড়ে আছে, এমন কোনো সংস্কারে আস্থা রাখা কঠিন। ভাষা এত বেশি বাস্তব বিষয় যে একদিকে তাকে প্রতিদিন নিয়মের সাথে সংগ্রাম করতে হয়, অন্যদিকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নতুন শব্দ ও প্রয়োগ বের করে নিতে হয়। পূর্ববঙ্গে ছাপা একটি পত্রিকা হাতে পেয়ে সেখানে ‘ভাষাভাষী’ এই শব্দটি দেখে ‘হাসাহাসি’ করতে ইচ্ছা হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর, আজ সেটা প্রয়োজনীয় একটা শব্দ। একই পত্রিকায় ‘সাহিত্যিক’ শব্দটি দেখে তার মনে হয়েছিল ভাষার ওপর ‘বলাৎকার’, কেননা তা নাকি সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ব্যাকরণমতে অশুদ্ধ। অথচ আমরা আজ জানি, ‘সাহিত্যিক’ হিসেবে প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতিকে আধুনিকায়নে এবং বাংলাকে সাবলীল করার বেলায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পৃথক হয়ে একদম ভিন্ন ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করা কঠিন, যদিও সেই আশঙ্কা কিংবা আশাবাদ সুনীতিকুমারেরর মতো ভাষাতাত্ত্বিক বা কায়কোবাদের মতো কবি করেছিলেন, হিন্দু বাংলা আর মুসলমান বাংলা আকারে দুটো রূপের বিকাশের সম্ভাবনা দেখে। তবে এটা ঠিক যে আনন্দবাজার পড়তে আমাদের যেমন কিছু খটকা লাগে, বাংলাদেশের পত্রিকা বিষয়েও নিশ্চয়ই তাদেরও তেমন কিছুটা হয়। বাদানুবাদ বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রচুর দেখি, আনন্দবাজারে দেখি ‘তরজা’।
ভাষার সাথে অর্থনীতির এবং উৎপাদনশীলতার যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কটি রয়েছে, সেটা পশ্চিম বাংলাকে খানদানি অর্থে একটি সনাতন, শরিফ ভাবগাম্ভীর্য হয়তো দেয়, কিন্তু মুখের ভাষা আপন গতিতে রাস্তা কেটে এগিয়ে যায়। সেই কারণেই প্রয়োজন মাফিক পুরানো বহু কিছু সে গ্রহণ করে, প্রয়োজন মতো বর্জনও করে, জীবনের গতি ও স্ফূর্তি যেখানে জমাট, সেখানে বৈচিত্র সংগ্রহ করে শক্তিশালী হতে থাকে। ব্যাকরণে ভুল হলেও যেমনটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘“মাত্র” শব্দ গোড়ায় বসলে কথাটাতে জোর দেবার সুবিধে হয়।’ ভাষার বিকাশ গঞ্জে, ভাষার দাঁতকপাটি গোড়ামিতে।
ফিরোজ আহমেদ: লেখক, অনুবাদক ও রাজনৈতিক কর্মী
স্বাধীনতার মাসের গুরুত্ব সবার মধ্যে তুলে ধরতে এবং শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে শেরপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (এটিআই) ধান ক্ষেতে জাতীয় পতাকা এবং সবজির প্লটে মানচিত্র ও স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছেন এটিআইয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা। এতে ছাত্র, শিক্ষক ও স্থানীয়রাও অনেক খুশি।
স্বাধীনতার মাসে এটিকে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শন করার জন্য ২৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান আতিক এমপি।
এটিআইয়ের অধ্যক্ষ সাইফুল আজম খান বলেন, ‘শেরপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রায় ৪০ একর জমির বিশাল এলাকায় ধান ও সবজির প্রদর্শনী প্লট রয়েছে। স্বাধীনতার মাসের গুরুত্ব সবার মাঝে তুলে ধরতে ধান ও সবজির প্লটে সবার দৃষ্টি কাড়ে এমন এক বিশাল পতাকা, মানচিত্র ও স্মৃতিসৌধ করা হয়েছে।
‘ধান ক্ষেতের ক্যানভাসে ১৬০ ফিট দৈর্ঘ্য, ৯৬ ফুট প্রস্থ ও ৩২ ফুট বৃত্তের ব্যাসার্ধের জাতীয় পতাকা তৈরি করা হয়েছে। পতাকার সবুজ অংশ বঙ্গবন্ধু-১০০ ও হাইব্রিড এবং মাঝখানের লাল বৃত্তের অংশ দুলালি সুন্দরী ধানের চারা দিয়ে সাজানো হয়েছে। পতাকার সবুজ অংশ দিয়ে বুঝানো হয়েছে বাংলার প্রকৃতিকে আর মাঝখানে লাল বৃত্ত দিয়ে বুঝানো হয়েছে লক্ষ শহীদের রক্ত। এবং পাশেই সবজির প্লটে লাল শাক ও পাট শাকের চারা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র ও স্মৃতিসৌধ। এতে আমাদের শিক্ষক ও ছাত্রদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় যেন সকলে সহযোগিতা করতে পারে সেজন্য এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
কলেজ শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম জিহান বলেন, ‘আমাদের কলেজে এত সুন্দর একটি পতাকা, মানচিত্র ও স্মৃতিসৌধ করতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। আমাদের অধ্যক্ষ স্যারের নির্দেশনায় স্বাধীনতার মাসকে সামনে রেখে এ কাজটি করেছি। এ কাজটির ফলে আমরা স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছি।’
প্রতিষ্ঠানের সপ্তম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি বলেন, ‘আমাদের স্যারদের সহযোগিতায় এমন সুন্দর কাজটি করেছি। কৃষির মাধ্যমে দেশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সবার মাঝে। অনেকেই দেখতে আসছেন। এমন সৃজনশীল কাজ দেখে খুশি হচ্ছেন এবং আমাদের প্রশংসা করছেন।’
স্থানীয় কবি ও সাহিত্যিক আব্দুল আলীম বলেন, ‘কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা মিলে এমন একটি কাজ করেছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এখানে আমাদের দেশকে জাতির সামনে তুলে ধরেছে তারা। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবেই সকল কিছু করে দেখাতে হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য অনেক কিছু করে যাচ্ছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে জানতে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শেরপুর জেলায় এটাই ব্যতিক্রমী ও প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করায় প্রশংসা জানিয়েছেন সরকার দলীয় হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিউর রহমান আতিক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েদের সত্যিকারের ইতিহাস জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধকে জানাতে এখানে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এতে আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পেয়েছি। এবার আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মতো আরও সবাইকে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার দরকার।’
আরও পড়ুন:ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। রোজা শুরুর আগের দিন বৃহস্পতিবারও একই দামে বিক্রি হয়েছে মুরগি। বেশি দামে কিছুদিন আগে মুরগি কেনার কারণেই দাম কমাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
এদিকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা উচ্চ দরে মুরগি বিক্রি করে পকেট ভারি করছেন বলে মনে করছেন ক্রেতারা।
আনোয়ার হোসেন নামের এক মুরগি বিক্রেতা নিউজবাংলাকে জানান, গত এক মাস আগে মুরগি ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পেরেছেন। এরপর থেকেই মাসজুড়ে হু হু করে বেড়েছে দাম। পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়ে যাওয়ায় তারাও বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে পাইকারিভাবে মুরগির দাম কিছুটা কমলেও তারা বাজারে আগের দামেই বিক্রি করছেন। কারণ মুরগিগুলো বেশিরভাগ ব্যবসায়ীদের কিছুদিন আগের কেনা ছিল। তবে কিছুদিনের মধ্যে দাম কমে আসবে বলে জানান তিনি।
আমিরুল ইসলাম নামের আরেকজন বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা সিন্ডিকেট করে মুরগি বিক্রি করি না। কোনো বিক্রেতা কিছুদিন আগে মুরগি কিনেছেন আবার কেউ পরে। এজন্য একজনের সঙ্গে আরেকজনের দামটাও কিছুটা পার্থক্য হচ্ছে। যে যার মতো কিছুটা লাভ করে বিক্রি করছেন।‘
তবে ক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা মুরগি ব্যবসায়ীদের খোঁড়া যুক্তি মানতে নারাজ।
মুরগি কেনা শেষে মইনুল হোসেন নামের এক ক্রেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গোপনে বাজার মনিটরিং করতে একজন কর্মকর্তা এসেছিল। কিছুক্ষণ পর বাজারদর জানতে আরেকজন সাংবাদিক আসে। দুইজনকেই দাম কত জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা বলেছে ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ আমার কাছ থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। যদি বাজারে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা না করে তাহলে ইচ্ছেমতো দামেই বিক্রি চলবে।’
নগরীর ঐতিহ্যবাহী শম্ভুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে মুরগি। মুরগির দাম হাতের নাগালের বাইরে থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। অনেকে মুরগি থেকে মুখ ফিরিয়ে মাছ কিংবা শুঁটকির বাজারে ছুটছেন।
মুরগির দাম এতো বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে যাওয়া হয় জেলার গৌরীপুর উপজেলার ঢৌহাখলা ইউনিয়নের নন্দীগ্রামে। সেখানে কথা হয় খামারি শামসুল হকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমার খামারে ৫০০ মুরগির বাচ্চা ৬০ টাকা দরে কেনা ছিল। মুরগির বয়স এখন ২৬ দিন। ৩২ দিন হলে বাচ্চা বিক্রি করব। ৩২ দিনে প্রতি মুরগি গড়ে ১ হাজার ৭০০ গ্রাম ওজন হবে। তাহলে প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত দামে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বলেন, ‘মূলত মুরগির বাচ্চার সংকটের কারণেই ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। কোম্পানির মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাচ্চার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমাদের মতো খামারিদের কাছ থেকে ভালো ব্যবসা করতে চাইছে। এগুলোও সংশ্লিষ্টদের তদারকি করা প্রয়োজন।’
রফিক মিয়া নামের আরেকজন খামারি বলেন, ‘খুচরা বাজারে মুরগির দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়লেও আমরা (খামারিরা) বেশি লাভবান হইনি। সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে এক শ্রেণির অসাধু খুচরা বিক্রেতারাও। তারা সিন্ডিকেট করে কিছুদিনের জন্য হলেও নিজেদের পকেট ভারি করেছে।’
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের সহকারী পরিচালক নিশাত মেহের বলেন, ‘নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। মনমতো দামে মুরগিসহ কোনো পণ্য বিক্রি করার প্রমাণ মিললে জরিমানার আওতায় আনা হবে।’
আরও পড়ুন:রিতা,
তুমি বোধহয় ভালই আছ। আর থাকবে নাই বা কেন। তুমি এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছ। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা হয়ত তোমার অজানা নেই। আমাদের অবস্থা যে কতদূর চরম তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
একদিন আমাদের বাড়ীতে একদল লোক এসে আমাদের কিছু জিনিসপত্রসমেত আমাকে একটি জিপে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না। কেবল শুনতে পাচ্ছি আমাদের পেছনেও কয়েকটি গাড়ি আসছে। পথে গাড়ির মধ্যেই অমানসিক অত্যাচার শুরু হল। শিবিরে জীপ পৌঁছাল এবং আমায় শিবিরে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে দেখলাম আমার মতই আরও কয়েকজন মেয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর একদল ‘পশু’ শিবিরে এসে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। দিনের পর দিন সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যওয়া হয় এবং ভোর ৪টার সময় ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হয়। কোনরকম বাধা দিলে যে অত্যাচার শুরু হতো তা অবর্ণনীয়। রবারের চাবুক দিয়ে তারা আমাদের নির্দয়ভাবে পেটায়। এই আতঙ্কে আমরা চরম অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে বাধ্য হই।
...আমাদের চিঠি লেখার অধিকারও নেই। খাদ্য পাওয়াও কষ্টকর। রেডক্রস যদি কোন খাবার দেয় তাহলে ঐসব ‘পশুরা’ এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দিনে একবার মাত্র আমাদের খাবার দেওয়া হয়। খাবার হলো দেড় পিস রুটি আর এক গ্লাসস পানি। দিনে মাত্র তিন গ্লাস পানি দেওয়া হয়।
এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়েই আত্মহত্যা করেছে। তাদের কবর অবধি দেওয়া হয় না। এসিড দিয়ে দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে তারা সাধারণত সন্তান জন্মাবার আগেই মারা যায়। কয়েকজন আবার সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা যায়। আমিও অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? বাঙালী মেয়ে জন্মানই পাপ। এই অত্যাচার সহ্য করে আমি এখনও বেঁচে আছি। তবে আধমরা হয়ে আছি। মুজিব ভাই কি আমাদের রক্ষা করবে না? আমাদের এই চরম দুঃখ-দুর্দশার কথা বঙ্গবন্ধুর কানে তুলো।
-শীলা
পাকিস্তানি হানাদারের বন্দি শিবির থেকে লেখা এক নির্যাতিতা বাঙালির চিঠি এটি। বান্ধবী রিতার কাছে শীলা নামের এক বীরাঙ্গনার লেখা এই চিঠিতে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ দেশের নারীদের অপরিসীম ত্যাগ আর হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র। দেশ তখন মুক্ত। তবু মুক্তি মেলেনি শীলাদের। নিজের মুক্তির জন্য এই নারীও তাই পথ চেয়ে আছেন সেই মহানায়কের, যার তর্জনীতে লুকিয়ে ছিলো বাঙালির স্বাধীনতা।
১৯৭২ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত, গোলাম রব্বানী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’ প্রকাশিত হয় এ চিঠি। কেবল নাম ব্যতীত চিঠিটির প্রেরক ও প্রাপকের আর কোনো পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
প্রায় সমসাময়িক সময়ে সিলেট থেকে প্রকাশিত, আমীনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’তে প্রকাশিত হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও পাকিস্তানি বন্দিশিবিরে আটক থাকা এক ব্যক্তির চিঠি। চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ। যুগভেরীতে এই পত্র লেখকের নাম ছাপানো হয়নি।
পিতার কাছে লেখা চিঠির শেষাংশে পত্র লেখক লিখেছেন, ‘... ধুপাদিঘীর পশ্চিমপাড়ে যাহা আছে এবং সেখানে যারা থাকে, যে হালে থাকে ঠিক সেভাবেই আছি। আর কাজ হচ্ছে- ওখানে তারা যে কাজ করে সেই কাজ। অনেকে আছি। এখানে যাদেরকে রাখা হয়েছে তাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে। সবকিছু খুলিয়া লেখা সম্ভব নয়। কারণ তো বুঝতেই পারছেন। এখানে ১২০০-এর বেশী বিমান বাহিনীর লোক।’
উল্লেখ্য, পত্রে উল্লিখিত ধোপাদিঘির পশ্চিমপাড় বলতে কারাগার বুঝানো হয়েছে। এই স্থানে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার-২ অবস্থিত।
এ তো গেলো বন্দিশিবির থেকে লেখা নির্যাতিতদের চিঠি। যুদ্ধের ময়দান থেকেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র পাশে সরিয়ে কখনো কখনো হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। প্রিয়জন আর সহযোদ্ধাদের কাছে নিজের, যুদ্ধের আর দেশের অবস্থা জানিয়ে লিখেছিলেন চিঠি।
সেসব চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, সর্বগ্রাসী অভাব, দালালদের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও বীর যোদ্ধাদের সাফল্য গাঁথা ও চূড়ান্ত জয়ের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। এসব টুকরো টুকরো আশা, হতাশা, সান্ত্বনা, প্রতীজ্ঞাই হয়ে উঠেছে এখন মুক্তিযুদ্ধের দলিল।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের এক অনন্য যোদ্ধা সুলেমান হোসেন। ৪ নম্বর সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সিলেট শহরের ধুবড়ী হাওড়ের (অধুনা শাহজালাল উপশহর) কাছে প্যারাসুট দিয়ে হেলিকাপ্টার থেকে নামার পরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে ঘিরে ফেলে। এরপর দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা সম্মুখযুদ্ধ শেষে তিনি আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগ মূহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর হানাদাররা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেটের জিন্নাহ হলের নাম পাল্টে ‘শহীদ সুলেমান হল’ করা হয়। যুদ্ধচলাকালীন পরিবার-পরিজনকে বেশকিছু চিঠি লিখেছিলেন সুলেমান। চিঠিগুলোর বেশিরভাগই তার প্রবাসী বড় ভাইয়ের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে লেখা।
একাত্তরের ১৬ এপ্রিল আসাম থেকে বড় ভাইকে লেখা সুলেমানের চিঠিতে ফুটে উঠেছে আর্থিক দৈন্য আর দুর্ভোগের চিত্র। চিঠির একাংশে সুলেমান লিখেছেন, ‘... বর্তমানে আমাদের মৃত্যুর দুইটি পথ খোলা আছে। একটি হইল বুলেট, অন্যটি হইল পেট।’
২৮ নভেম্বর একই ব্যক্তিকে লেখা আরেকটি পত্রে সুলেমান লিখেছেন, ‘...আমার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কারণ টাকাপয়সা আমার কাছে ঔষধের মতই হয়েছে। ...শীতের দাপটে রাতে ডিফেন্সে থাকা যায় না। কারণ শীতের একটি কাপড়ও আমার নেই।’
এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুলেমান দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৭ জুলাই প্রবাসী বড় ভাইকে লেখা এক চিঠিতে ফুটে উঠেছে সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞারই চিত্র।
সুলেমান লিখেন, ‘... বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরাধীনতার নাগপাশকে পদদলিত করিতে বদ্ধপরিকর। এতে যদি আমার বাংলাদেশ শ্মশানে পরিণত হয় তবু আমরা কিছু ছাড়ব না। বাংলা স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হবে সত্য, তবে কবে এবং কি অবস্থায় স্বাধীন হব সেটা বলা যায় না।
... পাঞ্জাবী বেনিয়ারা এবার বুঝে নিয়েছে যে তাহারা আর এখানে থাকতে পারবে না। আমরা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া মা-বোন ও মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষা করিব।
...আমার সকল পণ প্রতিজ্ঞাকে কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। দালালদের খতম করার জন্য আমাদের গেরিলা বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে দালালদের বংশ থাকিবে না। এরাই আমারে বড় শত্রু। যাক, জয় আমাদের হবেই। আমাদের জন্য চিন্তা করিবেন না। বাঁচিয়া থাকিলে দেখা হইবে।...’
তারিখ ও ঠিকানা উল্লেখ না করে মায়ের কাছে লেখা একটি চিঠিতে সুলেমান লিখেছেন, ‘... মা, আজকে আপনার সবচেয়ে বড় গৌরব যে আপনার ছেলে সত্যিকারের দেশসেবার উপায় পেয়েছে। সত্যিকারের দেশসেবা করে যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সেটা ভাল। যাক, আমার জন্য চিন্তা করিবেন না। অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আর বেশি বাকী নয়।...’
মাকে অদূর ভবিষ্যতেই দেখা হওয়ার আশ্বাস দিলেও আর কখনোই মায়ের সাথে দেখা হয়নি শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলেমানের।
মুক্তিযুদ্ধে সাচনা বাজারে পাকিস্তানি বাংকার ধ্বংসের সময় শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম। এর আগে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের পরিবহন বহরে গেরিলা আক্রমণ চালান তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট থেকে নিজের পিতাকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন নিজের ও দেশের অবস্থা আর অবস্থানের কথা।
সিরাজুল লিখেন, ‘... দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হইবার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে আমাদের জীবনের কএনা মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম।
মৃত্যুর মুখে আছি। যেকোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাঙলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কয়েমের জন্য দোয়া কর, মীর জাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাঙলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।
ছালাম, দেশবাসী সালাম।’
সিলেট অঞ্চলের কিংবদন্তি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের শহীদ হওয়ার ঘটনা আরও বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো এ অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জগৎজ্যোতির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে তার সহযোদ্ধা সানু মিয়া আরেক মুক্তিযোদ্ধা গৌরাঙ্গ দেশীকে একটি চিঠি লেখেন। সংক্ষিপ্ত এই চিঠিতে প্রতিভাত হয়েছে জ্যোতির প্রাণের বদলা নেয়ার দৃপ্ত শপথ।
‘দাদা,
এখানে এসে জ্যোতিকে পেয়েছিলাম। চারদিন হলো, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাঁর কাজ সে শেষ করেছে, এবার আমাদের পালা। জ্যোতিকে ম্লান হতে দেবো না, রক্তের প্রতিশোধ আমরা রক্তেই নেব।
ইতি
সানু মিয়া’
রক্তের বদলা নিয়েই বীর মুক্তিসেনারা সূর্যের লালটুকু ছিনিয়ে আনেন বাঙলার সবুজ জমিনে। বাংলাদেশের পতাকা হয়ে ওঠে টিয়ে পাখির মতো লাল আর সবুজ। যুদ্ধজয় ও বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পর সিলেটের মহিলা মুক্তিফৌজ গঠনের অন্যতম উদ্যেক্তা ও নারীনেত্রী প্রীতিরানী দাশ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে জাতির পিতাকে তাঁতের তৈরি একটি বস্ত্র উপহার পাঠান। এই উপহার পেয়ে প্রীতিরানীকে চিঠি লেখেন শেখ মুজিব।
১৯৭২ সালের ২১ নভেম্বর চিঠিটি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা।
‘শ্রদ্ধেয়া প্রীতিরানী দাস
আমার আদাব গ্রহণ করবেন। তাঁতশিল্পের নিদর্শনস্বরূপ আপনার দেয়া উপহারখানা জেনারেল ওসমানী সাহেবের মারফত পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। শিল্প জগতে তাঁতশিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নতমানের তাঁতশিল্প একটি গৌরবের বিষয়। দেশের ভাঙ্গা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্নে আপনাদের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। সেহেতু আমাদের তাঁতশিল্পের ক্রমবিকাশ এবং বিশ্বের হস্তশিল্পাঙ্গনে এর সুপ্রতিষ্ঠিত স্থান আমার একমাত্র কাম্য।
সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগীতা করে যাবে। দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনাদের প্রচেষ্টাকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ইতি
শেখ মুজিব”
[এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত চিঠিগুলো সাপ্তাহিক ‘বিন্দু বিন্দু রক্ত’, সেই সময়ের সাপ্তাহিক ও বর্তমানে দৈনিক ‘যুগভেরী’ এবং গবেষক দীপংকর মোহান্ত সম্পাদিত ‘চিঠিপত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ বই থেকে সংগৃহীত।]
আরও পড়ুন:ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাব খান ওরফে আপনের বিশ্বস্ত দুই সহযোগীর ওপর নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ওই দুজন কক্সবাজারে থাকেন। তারা সম্পর্কে শ্যালক-দুলাভাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আরাব। এ সংক্রান্ত ভিডিও এখন ছড়িয়ে পড়েছে।
আরাব যে দুজনকে পরিচয়ে করিয়ে দেন তারা হলেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার বাসিন্দা শেফায়েত হোসেন জয় ও জসিম উদ্দিন নাহিদ। তাদের ওপর নজর রাখা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আরাব খান ওই দুই যুবককে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি ওই ভিডিওতে বলেন, জয় ও জসিম কক্সবাজারের মাফিয়া। জয় ‘কিলার’, নাহিদ আগামী নির্বাচনের ‘এমপি প্রার্থী’।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৮ জুলাই আরাব খানের তার ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ ভিডিওটি পোস্ট করেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন দুলালের ছেলে জয় ও তার ভগ্নিপতি নাহিদ প্রতিমাসে দুবাই আসা-যাওয়া করেন। তাদের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও হঠাৎ করে আলিশান গাড়িতে চলাফেরা, বিলাসবহুল জীবন যাপন এলাকার মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও নাহিদ কক্সবাজারের রিগ্যাল প্যালেস নামের একটি আবাসিক হোটেলে ফ্রন্ট ডেস্ক ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন। কিন্তু কয়েক বছরে তিনি রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন।
আরাব খানের সঙ্গে নাহিদ-জয়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর তাদের নিয়ে এ প্রতিবেদকের কাছে আরও তথ্য দিয়েছেন ফেনীর আবু তৈয়ব রকি নামের ব্যবসায়ী।
ট্রাভেলিং এজেন্সির ব্যবসা করা এই ব্যক্তির অভিযোগ, কাতার বিশ্বকাপ দেখে ফেরার পথে প্রবাসে থাকা পরিবারের সদস্যদের ৬০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে ফিরছিলেন ফেনীর চার বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জয় ও নাহিদ। ঢাকার বিমানন্দরে নামার পর নাহিদ ও জয় তাদের রাজধানীর বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে বিশ্রামের অজুহাতে নিয়ে যান। পরে তারা সেখান থেকে ওই স্বর্ণ নিয়ে সটকে পড়েন।
তিনি আরও জানান, যেসব বাংলাদেশি দুবাইতে স্বর্ণ কিনতে যান, নাহিদ ও জয় তাদের টার্গেট করেন। দেশে ফেরার পর সেই স্বর্ণ লুট করে তা বিক্রি করে দেন শ্যালক-দুলাভাই।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নাহিদ ও জয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা কল রিসিভ করেননি।
এ নিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘’সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযুক্ত দুজনের নানা তথ্য এসেছে। এসব বিষয়ে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। অভিযুক্ত দুজন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে।’
রেড নোটিশ
পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার পলাতক আসামি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থানরত আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল।
রেড নোটিশ পাওয়া বাংলাদেশিদের তালিকায় ছবিসহ যুক্ত করা হয়েছে তার নাম।
ইন্টারপোলের তালিকায় আরাব নামটি উল্লেখ করা হয়নি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তার পূর্ণ নাম রবিউল ইসলাম ও ডাকনাম রবিউল লেখা হয়েছে। জন্মস্থান দেখানো হয়েছে বাগেরহাট; বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫ বছর।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আরাবের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে ইন্টারপোল।
এর আগে ১৮ মার্চ পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার ফেরারি আসামি আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলকে চিঠি দেয়ার খবর জানায় বাংলাদেশ পুলিশ।
ইন্টারপোল বাংলাদেশ ডেস্কের এক কর্মকর্তা ওই দিন বিকেলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ে (আরাবকে দেশে ফেরানো) ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইন্টারপোলকে মেইল করেছি। তারা আমাদের দেয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’
আরাবকে নিয়ে আলোচনার শুরু যেখান থেকে
পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার আসামি আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলাম আলোচনায় আসেন মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গোল্ড জুয়েলারি শপ ‘আরাব জুয়েলার্স’ উদ্বোধন ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা শুরু হয়। শপটির লোগো বানানো হয় ৬০ কেজি স্বর্ণ দিয়ে।
আরাবের এই জুয়েলারি শপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, ইউটিউবার হিরো আলমসহ বেশ কয়েকজন। এ নিয়ে সাকিব আল হাসানের ভিডিও বার্তার পর বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) নজরে আসে।
ফেরারি আসামি আরাব খানের মালিকানাধীন আরাব জুয়েলার্স উদ্বোধন হয় ১৫ মার্চ রাতে। দুবাইয়ে নিউ গোল্ড সোক হিন্দ প্লাজার ৫ নম্বর ভবনের ১৬ নম্বর দোকানটি তার। সাকিবসহ অন্যরা এই আয়োজনে অংশ নেন।
ডিবি মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ পরিদর্শককে হত্যা মামলার চার্জশিট হয়েছে অনেক আগেই। রবিউল চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি। জুয়েলারি শপ উদ্বোধনের ঘোষণার পর আমরা আইডেন্টিফাই করি, যে ব্যক্তি আরাব খান নামে আইডিটি পরিচালনা করছেন, তিনি পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খাঁন হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম। তার ভারতীয় একটি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে।’
আরও পড়ুন:পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলায় ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা রবিউল ইসলাম ওরফে আরাব খান কীভাবে এত অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তার এক স্বজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
তারা জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ ইউনিয়নের আশুতিয়া গ্রামের বাসিন্দা আরাব তাদের কাছে পরিচিত সোহাগ মোল্লা হিসেবে। তার বাবার নাম মতিয়ার রহমান মোল্লা, যিনি একসময় বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। সেখানে আরাবের মামা বাড়ি।
কোটালীপাড়ার ওই দুই বাসিন্দাসহ স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, বাগেরহাটে ১৯৮৮ সালে সোহাগ মোল্লার জন্ম। ২০০৫ সালে চিতলমারী সদরের একটি স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেন। দারিদ্র্যের কারণে তিনি আর এসএসসি শেষ করতে পারেননি। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলে ২০০৮ সালে চিতলমারী থেকে ঢাকায় এসে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান মোল্লা আপন। সেখানে তিনি কাজ নেন হোটেল বয় হিসেবে।
স্থানীয়রা জানান, এলাকার মানুষ আরাবকে সোহাগ মোল্লা নামেই চেনে। গোপালগঞ্জে তেমন একটা না আসায় তাকে খুব বেশি মানুষ চিনতেন না। পাঁচ-ছয় বছর আগে নিজেকে ‘মোল্লা আপন’ পরিচয় দিয়ে কোটালীপাড়ায় পোস্টার লাগিয়েছিলেন আরাব। অনেকেই সে সময় তাকে পোস্টার সাঁটানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, তাকে এলাকার মানুষ তেমন চেনে না। তাই কোটালীপাড়া সদরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়েছেন।
কী বলছেন চাচাতো ভাই
রবিউল ইসলাম ওরফে সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাব খানের চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লা নিউজবাংলাকে বলেন, তার ভাই সোহাগ মোল্লা কীভাবে অল্প দিনে এত টাকার মালিক হয়েছেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
তিনি জানান, কিছুদিন আগে সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাব খান তার মা-বাবা ও তাদের কাছে থাকা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে, বোন, ভগ্নিপতি ও তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে দুবাই গেছেন বলে খবর পাওয়া যায়।
ফেরদৌস জানান, বাড়ির আশপাশের লোকজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে আরাব খানের মা, বাবাসহ স্বজনরা দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন।
জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের ভাষ্য
কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না সাংবাদিকদের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাব খান একই ব্যক্তি। আমার গ্রামেই তার বাড়ি। সে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পাঁচ-সাত বছর ধরে সে এলাকায় আসে না। হঠাৎ করে সে কীভাবে এত টাকার মালিক হলো, এটা আমাদের বোধগম্য না।’
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সোহাগ মোল্লা ওরফে মোল্লা আপন ওরফে রবিউল ইসলাম রবি ওরফে শেখ হৃদি ওরফে আরাব খানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৯টি ওয়ারেন্ট কোটালীপাড়া থানায় এসেছে। আমি ওয়ারেন্টগুলো তামিল করার জন্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার কোনো হদিস আমরা পাইনি।’
রেড নোটিশ
পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার পলাতক আসামি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থানরত আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল।
রেড নোটিশ পাওয়া বাংলাদেশিদের তালিকায় ছবিসহ যুক্ত করা হয়েছে তার নাম।
ইন্টারপোলের তালিকায় আরাব নামটি উল্লেখ করা হয়নি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তার পূর্ণ নাম রবিউল ইসলাম ও ডাকনাম রবিউল লেখা হয়েছে। জন্মস্থান দেখানো হয়েছে বাগেরহাট; বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫ বছর।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আরাবের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে ইন্টারপোল।
এর আগে ১৮ মার্চ পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার ফেরারি আসামি আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলকে চিঠি দেয়ার খবর জানায় বাংলাদেশ পুলিশ।
ইন্টারপোল বাংলাদেশ ডেস্কের এক কর্মকর্তা ওই দিন বিকেলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ে (আরাবকে দেশে ফেরানো) ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইন্টারপোলকে মেইল করেছি। তারা আমাদের দেয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’
আরাবকে নিয়ে আলোচনার শুরু যেখান থেকে
পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খাঁন হত্যা মামলার আসামি আরাব খান ওরফে রবিউল ইসলাম আলোচনায় আসেন মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গোল্ড জুয়েলারি শপ ‘আরাব জুয়েলার্স’ উদ্বোধন ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এ আলোচনা শুরু হয়। শপটির লোগো বানানো হয় ৬০ কেজি সোনা দিয়ে।
আরাবের এই জুয়েলারি শপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এ নিয়ে সাকিব আল হাসানের ভিডিওবার্তার পর বিষয়টি নজরে আসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি)।
সে সময় ডিবি মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘পুলিশ পরিদর্শককে হত্যা মামলার চার্জশিট হয়েছে অনেক আগেই। রবিউল চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি। জুয়েলারি শপ উদ্বোধনের ঘোষণার পর আইডেন্টিফাই করি, যে ব্যক্তি আরাব খান নামে আইডিটি পরিচালনা করছেন, তিনি পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খাঁন হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম। তার ভারতীয় একটি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে।’
রবিউলকে ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন ডিবি মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজিব আল মাসুদ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমরা তাকে অনেক দিন ধরেই খুঁজছিলাম। দুবাইতে তিনি অবস্থান করছেন, এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফলে এখন আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেব।’
আরাব খানের মালিকানাধীন আরাব জুয়েলার্স উদ্বোধন হয় ১৫ মার্চ রাতে। দুবাইয়ে নিউ গোল্ড সোক হিন্দ প্লাজার ৫ নম্বর ভবনের ১৬ নম্বর দোকানটি আরাবের।
তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি পাকিস্তানের ক্রিকেটার মোহাম্মদ আমির, আফগানিস্তানের ক্রিকেটার হযরতউল্লাহ জাজাই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার এভিন লুইস, ইংল্যান্ডের বেনি হাওয়েল, শ্রীলঙ্কার ইসুরু উদানা, বাংলাদেশি লেখক সাদাত হোসাইন, অভিনেত্রী দীঘি, আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলম, চলচ্চিত্র পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস, কণ্ঠশিল্পী নোবেল, বেলাল খানসহ অনেকে জুয়েলারি শপ উদ্বোধন উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা দেন। তাদের একটি বড় অংশ দুবাইতে গিয়ে অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
আরও পড়ুন:২০ মার্চ, ২০০৩। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন মারণাস্ত্র ধ্বংস করার নামে তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাকে হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট।
তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের দাবি ছিল, ইরাকের ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র রয়েছে। আর তা থেকে ইরাকি জনগণকে মুক্ত করতে সেনা অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন।
হামলা চালানোর আগে টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে বুশ বলেন, আমেরিকান এবং জোট বাহিনী ইরাকের জনগণকে মুক্ত করতে এবং বিশ্বকে মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা করতে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ২০ বছর পার হয়ে গেলেও ইরাকে আজ পর্যন্ত কএনা মারণাস্ত্র পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই অভিযোগেই ইরাকে হামলা চালানো হয়। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ঝুলানো হয় ফাঁসির দড়িতে।
সাদ্দামবিহীন ইরাকে জঙ্গি উত্থান হয়েছে। পড়ে গেছে দেশটির অর্থনীতিও। দেশটিতে একদিক দিয়ে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, আরেকদিকে বেড়েছে ইরানের প্রভাবও।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালানোর পর ২ লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। সেখানে আমেরিকার সেনা নিহত হয়েছে মাত্র সাড়ে চার হাজার।
এ যুদ্ধের ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। আর কেনই বা এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা নিয়েও তৈরি হয়েছে হাজারও প্রশ্ন।
ইরাকে যুদ্ধ শুরুর আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে হামলার ভিত্তি গড়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা। সাদ্দাম ১৯৯০ সালে প্রতিবেশী আরেক তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েতে আক্রমণ করে বসেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের বাবা জর্জ এইচডব্লিউ বুশ। তিনি ইরাকে স্বাধীন গণতন্ত্র চালুর পক্ষে ছিলেন। আর এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা সাদ্দামকে সরানোর জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বসেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলার আরও বেশি সুযোগ পেয়ে যায় ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর। এর জের ধরেই তারা ইরাকসহ ওই অঞ্চলে গণতন্ত্র ও স্বাধীন করার বিষয়টি বড় করে সামনে আনে। ইরাকে হামলা চালানোর যুতসই ক্ষেত্র তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সাদ্দামবিরোধীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে বুশ প্রশাসন।
ইরাকে হামলা চালিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। যুদ্ধ শুরুর ১৯ দিন পর অর্থাৎ ৯ এপ্রিল বাগদাদ দখল করে নেয় আমেরিকান জোট। নানা যুক্তি তুলে ইরাকি জনগণকে পক্ষে টেনে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে জোট বাহিনী ফিরদস স্কয়ারে থাকা সাদ্দামের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে।
এ ঘটনার এক মাস না পেরুতেই ২০০৩ সালের ১ মে বড় সেনা অভিযান শেষ করার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট।
এরপর ইরাকজুড়ে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় তখন অনেক আমেরিকান সেনা চাকরি হারান।
ওই বছরের শেষের দিকে সাদ্দামকে তার জন্মস্থান তিরকিট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। হামলাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তখন দাবি করা হয়েছিল- এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক সাদ্দাম হোসেন একটি গর্তে লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকেই তাকে পাকড়াও করা হয়েছে।
সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর হামলাকারী বাহিনীর মদদপুষ্ট আদালতে তার বিচার করা হয়। গণহত্যা ও মানবাধিকার বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার দিনে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, মারণাস্ত্র থাকার অজুহাতে ইরাকে হামলা চালানো হয়েছিল, সাদ্দামকে গ্রেপ্তারের পর সেই বক্তব্য থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র। তারা জানায়, ইরাকে কোনো মারণাস্ত্র বা পরমাণু অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কমিশন ২০০৫ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, ইরাক নিয়ে তাদের গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন ত্রুটিপূর্ণ ছিল।
সাদ্দামকে সরানোর পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথরিটি নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। যার প্রধান ছিলেন পল ব্রেমার। এ সময় ইরাকে সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা ভেঙে দেয়া হয়। এছাড়া ইরাকে বহু বছর ক্ষমতায় থাকা বাথ পার্টিকেও সরকার গঠনে অংশ নিতে বাধা দেয়া হয়। এসময় দেশটিতে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য বেকার হয়ে পড়ে এবং সরকার ও প্রশাসনে শূন্যতা তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাঝে হাজার হাজার ইরাকি প্রাণ হারান। দেশটিতে আইএস জঙ্গিবাদের উত্থান হয় এবং গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
সাদ্দামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি শিয়া ও কুর্দিদের ঘোর বিরোধী। সাদ্দাম-পরবর্তী সময়ে এই সম্প্রদায়গুলোকে ক্ষমতার অংশ বানাতে চেষ্টা চালাতে থাকে কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথরিটি।
তারা ইরাক গভর্নিং কাউন্সিলে (আইজিসি) মুহাসা বা কোটাভিত্তিক সরকার ব্যবস্থা চালুর কথা জানায়, যাতে শিয়া ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে আনুপাতিক হারে সরকারে রাখার কথা বলা হয়।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, এই ব্যবস্থাটি ২০০৩ সালের পর ইরাকের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী দলগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এটি সাম্প্রদায়িক বিভাজনগুলোকে আরও গভীর করে তোলে। যার জন্য আজও ভুগছে ইরাক ও এর পার্শ্ববর্তী দেশগুলো।
সংঘাতের মধ্যেই ২০০৫ সালে ইরাকে নির্বাচন হয়। এতে ক্ষমতায় আসে শিয়া সম্প্রদায়ের দল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নুরি আল মালিকি, যিনি একজন শিয়া মতাবলম্বী। এছাড়া স্পিকার ছিলেন সুন্নি ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন কুর্দি।
ইরান ও তার সশস্ত্র মিলিশিয়াদের সঙ্গে নুরির সুসম্পর্ক ছিল। ইরাকের সুন্নি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করতে সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতি এবং অকার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে ইরাকজুড়ে পরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এক সময়ে আনবার ও ফালুজায় সুন্নি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে শিয়া ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদরের অনুসারীরা তৎপর হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে সহিংসতা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে কড়া নিরাপত্তা আরোপ করায় তাদের মধ্যে কিছু মানুষ সে সময় আইএসকে সমর্থন করতে শুরু করে। বাড়তে থাকে আইএস-এর কলেবর।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ সালে তার সেনাদের ইরাক থেকে ফিরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আইএস জঙ্গিদের উত্থান হয়। গোষ্ঠীটি ২০১৪ সালে স্বাধীন খিলাফত ঘোষণা করে। অবশ্য এর তিন বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী আইএস-কে অনেকটাই নির্মূল করতে সক্ষম হয়।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের যৌথ হামলা ও তাদের প্রস্থানের পর দেশটিতে সবচেয়ে বড় আন্দোলন দেখা দেয় ২০১৯ সালে। ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইরাক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। আন্দোলনকারীরা দেশটির সংসদকে একটি নতুন নির্বাচনী আইন গ্রহণ করতে বাধ্য করে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় ছয় শতাধিক বিক্ষোভকারী।
ইরাকে ২০২০ সালে ওই আন্দোলন স্থিমিত হয়ে আসে। নেপথ্যের কারণ ছিল করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ।
যাহোক, আজকের ইরাক একটি জোট সরকার দিয়ে চলছে। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে এই সরকারের অবস্থান যথেষ্টই দুর্বল। কেননা ক্ষমতাসীনরা ১৫ শতাংশেরও কম ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছে। বিক্ষোভে যোগ দেয়া অনেক ইরাকি নেতৃত্বহীন রাজনৈতিক দলের অংশ হয়েছেন, কেউ বা আবার সশস্ত্র উপায়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এতে জনসাধারণের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক ইরাকি শিয়া নেতা আল সদরকে সমর্থন দিচ্ছেন। কারণ সদরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
গত বছরের আগস্টে সদরের সমর্থক ও শিয়াবিরোধীদের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষে ৩০ জন নিহত হন। এ থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধের দুই দশক পরও অস্থিরতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে ইরাক।
আরও পড়ুন:সারা দেশের মহাসড়কে রয়েছে ৮৮৩টি বিপজ্জনক বাঁক। তাতে এসব পয়েন্টে তৈরি হয়েছে মরণফাঁদ। এসব বাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। হতাহত হচ্ছে বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রী ও পথচারী।
মহাসড়কে বিগত ১০ বছরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এসব বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ। বাঁকগুলোতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে মহাসড়কের ওই অংশ সোজা করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে।
তথ্যমতে, ৮৮৩টি বাঁকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৪টি বাঁক রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের মাদারীপুর রিজিওনে। এই রিজিওনের আওতায় রয়েছে মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর ও নড়াইল।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে বগুড়া রিজিওনে। এই রিজিওনের আওতাধীন বগুড়া, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধার মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে ২৪৮টি।
এর বাইরে কুমিল্লা রিজিওনে ১৮১টি ও সিলেট রিজিওনে ১২৬টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। এই মরণফাঁদ সবচেয়ে কম রয়েছে গাজীপুর রিজিওনে। এখানকার মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁকের সংখ্যা ৬৪টি।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দীন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঝুঁকি বিবেচনায় মহাসড়কের বাঁকগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছি। সে অনুযায়ী কাজও হচ্ছে। এসব বাঁকে যে রেগুলার দুর্ঘটনা ঘটছে এমনটা নয়। তবে এই স্পটগুলোতে বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। কোনোটাতে কম ঝুঁকি, কোনোটাতে বেশি।
তিনি জানান, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কিছু সড়কে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ হয়েছে। আরিচা মহাসড়কে কাজ হয়েছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে রোড প্রশস্ত করা এবং সার্ভিস লেন করার মাধ্যমে কাজ হয়েছে। এভাবে ঝুঁকি কমানোর কাজ চলছে।
তিনি বলেন, ‘সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পথচারী ও যানবাহনের চালকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সচেতনতার পাশাপাশি মহাসড়ককে বাঁকমুক্ত করতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে অভিমত গবেষকদের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘মহাসড়কের এসব বাঁক বছরের পর বছর ধরে আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাঁক সোজা করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ বাঁকই আগের মতোই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়ে গেছে। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ছে।
‘পাশাপাশি অনেক যানবাহনের ফিটনেস না থাকার পরও তারা মহাসড়কে বেপরোয়া। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই তদন্তে ফিটনেস ফেইলের তথ্য বেরিয়ে আসে।’
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, বরিশাল থেকে মহাসড়ক ধরে গৌরনদী পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে একজন চালককে অতিক্রম করতে হয় চারটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এসব বাঁকে বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহনের অবস্থান চিহ্নিত করা যায় না। চালক যখন বুঝতে পারেন ততক্ষণে ঘটে যায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। সারাদেশে এ ধরনের ৮৮৩টি বাঁক রয়েছে।
মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দুর্ঘটনাপ্রবণ বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করার কাজটিও করে থাকে হাইওয়ে পুলিশ।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, বরিশাল থেকে ভুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে অন্তত দুই ডজন। এর মধ্যে কাশিপুরের বন বিভাগ ও সমবায় ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তা, গড়িয়ারপাড়ের জননী পেট্রোল পাম্প ও কলাডেমা, ক্যাডেট কলেজ, রহমতপুর সেতুর ঢাল, বিমানবন্দর মোড়, দোয়ারিকা ব্রিজের ঢাল, জয়শ্রী, গৌরনদীর প্রবেশপথ, বামরাইল স্কুল সংলগ্ন, বাটাজোড়, আশুকাঠি, টরকি বাজার, কটকস্থল, বার্থি ও ভুরঘাটা সেতুর আগে বিপজ্জনক এসব বাঁক রয়েছে।
বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে অবৈধ যানবাহন। এসব যানবাহন মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলেও মনে করে হাইওয়ে পুলিশ। গত এক বছরে সড়কে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সবচেয়ে বেশি জরিমানা আদায় হয়েছে মাদারীপুর রিজিওনে। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও বগুড়া রিজিওন।
মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (এইচ আর অ্যান্ড মিডিয়া) মো. শামসুল আলম।
তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। বাঁকগুলো সম্পর্কে আশপাশ এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। পাশাপাশি মহাসড়কে চলাচল করা যানবাহনের চালকদের নিয়েও সভা করা হয়েছে। সচেতনতামূলক কর্মসূচি এখনও পালন করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য