× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য শিল্প ইভেন্ট উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট কী-কেন স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও যৌনতা-প্রজনন মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য উদ্ভাবন প্রবাসী আফ্রিকা ক্রিকেট শারীরিক স্বাস্থ্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়া সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ ইউরোপ ব্লকচেইন ভাষান্তর অন্যান্য ফুটবল অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বিশ্লেষণ
Begum Mujib Unique bright woman of history
google_news print-icon

বেগম মুজিব: ইতিহাসের অনন্য উজ্জ্বল নারী

বেগম-মুজিব-ইতিহাসের-অনন্য-উজ্জ্বল-নারী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গৃহবন্দিত্ব বরণ করে বেগম মুজিব তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো উৎসর্গ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালিদের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য। বেগম মুজিব পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সকলকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি তার উদ্বেগ বা হতাশা প্রকাশ না করে বরং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলীয় সমস্যার সময়ে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিনি যেভাবে বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন তার মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহায়তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতার পর শেখ ফজিলাতুন নেছা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হওয়ার পথে এই পুণ্যবান নারী আজীবন পাশে থেকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু, পরামর্শক, সমর্থক এবং সহায়ক। বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এমন বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালি জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবন্দি থাকার সময়ে কিংবা জাতির সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এমনকি দলের নেতা না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তখন তিনি সাহসী ও বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব হতো, যদি বেগম মুজিব তার সঙ্গে না থাকতেন। বেগম মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই তিনি তার পিতামাতাকে হারান এবং তার দাদার ভাইয়ের সংসারে ভবিষ্যৎ-শাশুড়ির কাছে পালিত হন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আব্বার বয়স যখন দশ বছর তখন তার বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর (শেখ মুজিব আমার পিতা,পৃ.২৭) । বঙ্গবন্ধুর ভাষায়-

“...যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছিল ছোট বেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২১)। ৩৩ বছর বিবাহিত জীবনে প্রায় ১৩ বছর বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। মুক্ত দাম্পত্য জীবন মাত্র ২০ বছরের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের সেই বন্ধন অটুট ছিল।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে উইনি ম্যান্ডেলার (১৯৩৬-২০১৮) রাজনৈতিক কার্যধারার তুলনা করলে কয়েকটি বিষয়ে মিল পরিলক্ষিত হবে। উভয়ই ছিলেন বিশ্বের কিংবদন্তি দুই রাজনৈতিক নেতার যোগ্য জীবনসঙ্গী। উইনি ম্যান্ডেলা ছিলেন সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ, ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ তাকে ‘জাতির মাতা’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তৎকালীন শেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জেল খাটা, একের পর এক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়ার সময় নেলসন ম্যান্ডেলার পাশে ছিলেন উইনি। নেলসন ম্যান্ডেলার দাম্পত্য জীবনের (১৯৫৭-১৯৯৬) ১৯৬২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল দুর্ভোগ ও দুর্দশাময়। বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের কারণে ১৯৬২ সালে নাশকতার অভিযোগ তুলে নেলসন ম্যান্ডেলাকে পুরে দেয়া হয় কারাগারে, একটানা ২৭ বছরের কারাবাস ছিল যন্ত্রণার। অর্থাৎ নেলসন ম্যান্ডেলাকে বিয়ের পর ৩৮ বছরব্যাপী বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাদের আলাদা থাকতে হয়েছে। দুঃসময়ে উইনি একাই তাদের দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন।

অপরদিকে সরকারের অত্যাচার ও দমন-পীড়নের মধ্যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নেলসন ম্যান্ডেলার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে বের হন। স্বামী কারাবন্দি থাকার সময় স্পষ্টবাদী উইনি কঠোর পরিশ্রম করে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন-

“সব ধরনের পরিস্থিতিতেই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।” বেগম মুজিব নিজের আত্মজীবনী লিখে যাননি। লিখলে সেটা হতো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য দলিল। তবে জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস, তা পেয়েছি কিন্তু বেগম মুজিবের কারণেই। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“... আমার সহধর্মিনী এক দিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনী। ... আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু। আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেল গেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম”।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর নেলসন ম্যান্ডেলার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে স্ত্রী উইনিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং সরকারি বাহিনী উইনির ওপর নির্যাতন চালাত। তাকে আটক রাখত কিংবা নির্বাসনে পাঠানো হতো। স্বামীর সঙ্গে কদাচিৎ সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন তিনি। মুষড়ে না পড়ে বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনে উইনি সবসময়ই সামনে থেকে লড়াই করে গেছেন। ১৯৭৬ সালে সোয়েতো অভ্যুত্থানের সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হন। এমনকি আশির দশকের শেষে শ্বেতাঙ্গ সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। উইনি সম্পর্কে ডেসমন্ড টুটু তার সাক্ষ্যে বলেছিলেন-

“তিনি আমাদের সংগ্রামের এক অসাধারণ সাহস এবং মুক্তিযুদ্ধের মূর্তি।”

উইনি ম্যান্ডেলা যেমন নেলসনের সাহচর্যে এসে জনগণের দাবিকে নিজের করে নিয়েছিলেন ভালোবেসে, তেমনি জাতির প্রতি বেগম মুজিবের ব্যক্তিগত অবদান এবং তার বঙ্গমাতা হয়ে ওঠা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি ভালোবাসার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। জাতির প্রতি তার জীবন উৎসর্গটি এত গৌরবময় ছিল যে, ‘বঙ্গমাতা’ তার জন্য উপযুক্ত উপাধি। সরল-সাধারণ জীবন যাপন, ধৈর্য, রাজনীতির প্রতি কৌতূহল আর সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি তা কেবল একজন গৃহিণী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, বরং জাতির জন্য তার ত্যাগের বিষয়টি বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবের জীবনসঙ্গী হিসেবে ছিল তাৎপর্যময়। তিনি আদর্শ মাতা ছিলেন এবং একজন রাজনৈতিক নেতার পাশে ছিলেন সকল সংকট মোকাবিলার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ফজিলাতুন নেছা মুজিব ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর লাখ লাখ সমর্থকের ‘ভাবি’ হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ৩০৫৩ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছিল, এই কারণে প্রতিদিনের রাজনৈতিক কর্মধারা পরিচালনার দায়িত্ব তার কাঁধে পড়েছিল এবং তিনি একজন যোগ্য কর্মী হিসেবে সবচেয়ে সফলতার সঙ্গে সেই কাজটি করেছিলেন। তিনি কখনও মিছিল করার জন্য বাসা থেকে বের হননি বা প্রকাশ্যস্থানে নিজেকে জনতার সামনে তুলে ধরেননি। বরং তিনি তার দেশের নিপীড়িত জনতার একজন হয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার একটি অনানুষ্ঠানিক গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন, এমনকি ব্যক্তিগত সমস্যা হলেও নেতাকর্মীদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দিতেন।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ, রাজধানীর আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু এভাবে-

“আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবারে আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তাঁর দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।”

স্ত্রী হিসেবে বেগম মুজিব বঞ্চিত ছিলেন। তা নিয়ে কখনও অভিযোগ করতে কেউ শোনেনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তার স্বামী দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করছে। বেগম মুজিবের নামে প্রচুর পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। সম্পত্তি থেকে যা আয় আসত তার অংশটুকু নিজের হাতে আসলেও পুরোটাই স্বামীর হাতে তুলে দিতেন। এখানে আমেরিকার প্রথম ফার্স্ট লেডি (১৭৮৯-১৭৯৭) মারাথা ওয়াশিংটন (১৭৩১-১৮০২),-এর কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। চার সন্তানের জন্ম দিলেও জীবিত দুই সন্তান নিয়ে পঁচিশ বছর বয়সে বিধবা হন মারাথা। প্রচুর সম্পত্তি এবং ৮৪ জন কৃতদাস নিয়েই জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নতুন সংসারে তাদের কোনো সন্তান হয়নি। তার আগের সংসারের দুই সন্তান এবং দুই বর্ধিত পরিবারের সবাইকেই উভয়ে দেখাশোনা করেছেন। বিয়ের সময় মারাথার বয়স ছিল ২৭ আর ওয়াশিংটনের বয়স ছিল ২৬। বিপ্লবের আগে ঘরকুণে থাকলেও বিল্পবের সময় স্বামীর সঙ্গে হাজার হাজার মাইল সঙ্গ দিয়েছিলেন। বিল্পবের সময় টানা দশ দিন পথ চলে ফিলাডেলফিয়ায় পৌঁছেছিলেন জেনারেল ওয়াশিংটনকে অনুপ্রেরণা জোগাতে। এভাবেই দেশের কাজে সহযোগিতা শুরু করেন।

রাজনীতির কারণে পারিবারিক জীবনে একটার পর একটা আঘাত এসেছে। কিন্তু বেগম মুজিব কখনো ভেঙে পড়েননি বা মুজিবকে বলেননি “তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও।” সংসারটা বেগম মুজিব একাই চালাতেন। টাকা, শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি কোনো কিছুর জন্যই কখনও বঙ্গবন্ধুকে বিরক্ত করেননি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে যখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন তখন মন্ত্রিত্বের সব সুযোগ-সুবিধা ছাড়তে হয়েছিল। পরিবারের এই সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার ঘটনাটাও বেগম মুজিব হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। এখনকার দিনে কোনো মন্ত্রীর পক্ষে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কেবল দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিলে নিশ্চিত করে বলা যায়, ভাবিরা হালকা হলেও ঝগড়াঝাটি করবেন। কিন্তু বেগম মুজিব এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা (এমনকি আওয়ামী লীগেও) তাদের স্ত্রীদের জন্য রাজনৈতিক পদপদবি হাতিয়ে নেন। মূল দলের মহিলা ফ্রন্টের উচ্চপদ অথবা সংরক্ষিত আসনে এমপি অথবা দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পদে স্ত্রীকে বসাচ্ছেন অথবা স্ত্রীর পদের জন্য বাহানা ধরছেন। এমনটি বেগম মুজিব কখনও চিন্তা করেননি। এটা যে কেবল ইদানিং হচ্ছে বা কেবল আমাদের দেশে হচ্ছে এমনটি নয়।

বার্মার জাতীয়তাবাদী নেতা অং সানের স্ত্রী khin kyi (মিয়ানমারের বর্তমান নেত্রী অং সান সুচি’র মা, যিনি পেশায় একজন নার্স ছিলেন এবং ১৯৪২ সালে অং সান বার্মা ক্যাম্পেইনের সময় আহত হয়ে রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে যার সঙ্গে পরিচয় হয়) বার্মার স্বাধীনতা উত্তর পার্লামেন্টে (১৯৪৭-১৯৪৮) স্বামীর ছেড়ে দেয়া রেঙ্গুনের Lanmadaw এলাকার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৫৩ সালে বার্মার প্রথম সমাজকল্যাণমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে তাকে নয়া দিল্লিতে বার্মার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া যেকোনো একটি আসনে বেগম মুজিব অনায়াসেই এমপি হতে পারতেন। কিন্তু বেগম মুজিব এমন পদপদবির কথা কখনও চিন্তাই করেননি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গভবন বা গণভবনের বিশাল পরিসরে থাকার সুযোগ সত্ত্বেও ৩২ নং বাড়ির ছোট্ট পরিসরেই থেকে গিয়েছিলেন, নিজের পরিবারে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন চিন্তাও তার মাথায় আসেনি। সাড়ে তিন বছরের ক্ষমতাকালে এ বাড়িতে কোনো জমকালো পার্টিও আয়োজন করেননি। যেমনটি করতেন আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের স্ত্রী Latife Hanim। কামাল আতাতুর্ক ৪২ বছর বয়সে ২৪ বছর বয়সী Latife Hanim-কে বিয়ে করলেও মাত্র দুই বছর (১৯২৩-১৯২৫) স্থায়ী হয়েছিল তাদের বিবাহিত জীবন। এই অল্পসময়ের মধ্যেই আঙ্কারার `Cankaya Manson’-এ ব্যাপক সাজসজ্জা করেন Latife Hanim, অসংখ্য জমকালো সংবর্ধনা ও পার্টির আয়োজন করেন।

এসময়ে তিনি আতাতুর্কের সকল সফরসঙ্গী হতেন এবং বক্তৃতা দিতেন। যা বেগম মুজিব কখনও চিন্তাও করেননি। এমনকি তৎকালীন পাকিস্তানের বড় একটি দলের নেতা বা মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে তিনি কোনোদিন পাকিস্তানেও যাননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ঘুরে ফিরে এসেছে বেগম মুজিবের কথা। শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক হওয়ার অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। বেগম মুজিব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। স্থানীয় মিশনারী স্কুলে (জিটি স্কুল) কিছু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তবে সত্যিকার অর্থে আলোকিত ছিলেন। দলীয় কর্মীদের পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা এবং তাদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি এতটাই সঠিক ছিল যে কারাগারের বাইরে এসেও বঙ্গবন্ধু তার প্রজ্ঞামণ্ডিত সিদ্ধান্তসমূহ স্বীকার করে নিতেন। তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন, ছিলেন অস্বাভাবিক প্রত্যুৎপন্নমতি এবং বুদ্ধিমতি নারী। কখনও কখনও তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যা সহজেই একজনকে হতাশার মধ্যে আনন্দিত করে তুলত। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন এবং খুব ধৈর্য সহকারে অন্যের কথা শুনতেন। পরিবারে সন্তানদের প্রতিও তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি সত্যিই অনেকের মা এবং শেষ পর্যন্ত জাতির মা হয়ে উঠেছিলেন। গরিবের প্রতি তার বিশেষ সহানুভূতি ছিল। তিনি প্রয়োজনে তাদের সহায়তা করতেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত কর্মীদের অর্থ সহায়তা করতেন। এছাড়াও তিনি নানান উৎসবে দরিদ্রদের মাঝে দান এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অর্থ প্রদান করতেন। নেতাকর্মীদের অসুখ হলে তাদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করতেন। কারাবন্দি নেতাকর্মীদের পরিবারের জন্য সাহায্য পাঠাতেন। বাসার একমাত্র ফ্রিজটি বিক্রি করে অসহায় কর্মীদের সাহায্য করেছেন। নিজের বাসায় বাজার না করে সন্তানদের খিচুড়ি রান্না করে আচার দিয়ে খেতে দিয়েছেন। এমন অবস্থাতেও কর্মীরা বিপদে পড়লে তাদের সাহায্য করেছেন।

দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থাকা রাজনৈতিক কর্মীদের পরিবারকে দেখাশোনা করতে হয়েছিল বেগম মুজিবকে। তিনি দুঃসময়ে কর্মীদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ দিতেন। কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাদের পরিচালনা করতেন। এমনকি তিনি অলংকার বিক্রি করে সংগ্রহ করা তহবিল দলের কাজে সরবরাহ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সংকটের সময়ে তিনি জনতা ও নেতাদের নির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার লেখায় আরও স্পষ্ট হয়েছে বিষয়টি-

“জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা আম্মা নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিতেন। আব্বা কারাবন্দী থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা যোগাড় করতেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।”

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে সেসময় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে খুব সক্রিয় দেখা গিয়েছে। তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং প্রতিটি স্তরের আন্দোলনের সময় তাদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বেগম মুজিবের পরামর্শে ছাত্র- আন্দোলনের অনেক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এমনকি তিনি কীভাবে আন্দোলন পরিচালনা করবেন তা তাদের পরামর্শ দিতেন। প্রায় সব ছাত্রনেতার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি ছিলেন কান্ডারি। এভাবে তিনি কার্যত ছায়ানেতা হয়ে ওঠেন।

এ ক্ষেত্রে কমলা নেহেরুর (১৮৭৭-১৯৩৬) সাদৃশ্য টানা যৌক্তিক হবে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কমলা। তিনি নেহেরুর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। স্বামীর অবর্তমানে ( জেলে থাকা অবস্থায়) অথবা রাজবৈরী বক্তৃতা দেয়া যখন নিষিদ্ধ হতো কমলা তখন জনসভায় সেটা পড়ে শোনাতেন। এভাবে কমলা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন এবং দুবার কারাবরণ করেন। তিনি গান্ধী আশ্রমেও কিছুদিন কাটান এবং সরোজিনী নাইডু এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী জয় প্রকাশ নারায়ণের স্ত্রী প্রভাবতী দেবীর সংস্পর্শে আসেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গৃহবন্দিত্ব বরণ করে বেগম মুজিব তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো উৎসর্গ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালিদের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য। বেগম মুজিব পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সকলকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি তার উদ্বেগ বা হতাশা প্রকাশ না করে বরং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলীয় সমস্যার সময়ে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিনি যেভাবে বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন তার মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহায়তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন।

স্বাধীনতার পর শেখ ফজিলাতুন নেছা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। এতদ্ব্যতীত, বিভিন্ন বিশ্বনেতা যখন বাংলাদেশ সফর করতেন তখন তাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গমাতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশের কাজ করে গেছেন। তিনি পাকিস্তানি দখলদার সেনার দ্বারা নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদেরকে সমাজে পুনর্বাসিত করেছিলেন এবং দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

সবসময় সবকাজে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক ছিলেন। কখনও ভিন্ন কিছু ভাবেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতবিরোধের কথা কখনও শোনা যায়নি। এক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তরবা গান্ধীর (১৮৬৯-১৯৪৫) বিপরীতমুখী অবস্থানে দেখা যায় বেগম মুজিবকে। কস্তরবা স্বামীর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিট্রিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বটে, কিন্তু বহু বিষয়েই স্বামী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন। ১৮৮৩ সালে ১৪ বছর বয়সী কস্তরবার সঙ্গে ১৩ বছর বয়সী গান্ধীর বিয়ে হয়। ১৯০৬ সালে গান্ধী ব্রহ্মচারী বনে যান। সন্তানদের চিকিৎসার ব্যাপারেও মতবিরোধ দেখা দেয় গান্ধী এবং কস্তরবার মধ্যে। গান্ধী চাইতেন আশ্রমেই সন্তানদের চিকিৎসা করাতে, কস্তরবা এটাকে সন্তানদের প্রতি গান্ধীর অবহেলা হিসেবে দেখতেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই রাজনৈতিক কারণে জেলখাটা কস্তরবা গান্ধীর সঙ্গে সত্যাগ্রহ আন্দোলন পর্যন্ত একমত পোষণ করলেও ১৯৩০ সালে গান্ধীর বিখ্যাত ‘সল্ট মার্চে’ অংশগ্রহণ করেননি বরং আইন অমান্য আন্দোলন করে জেলে গেছেন।

কয়েকটি ঘটনা স্মরণ করলে বেগম মুজিবের অবদান আরও স্পষ্ট হবে। বেগম মুজিবের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তিনি সবই মনে রাখতে পারতেন। একারণে বঙ্গবন্ধু তাকে ‘সারাজীবনের জীবন্ত ডায়েরি’ বলেছেন।

১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বেগম মুজিব নিজে অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও স্বামীকে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় যেতে বারণ করেননি। সেই সময় বেগম মুজিব স্বামীকে চিঠিতে লিখেছেন-

“আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্তমনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন।”

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বেগম মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্ষুর আড়ালে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। সংগঠনের অবস্থা অবহিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে দলের নেতাকর্মীদের কাছে তা হুবহু পৌঁছানোর অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন বেগম মুজিব। বেগম মুজিবের দুটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল, প্রথমটি হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে পাক সামরিক সরকার আটকে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে, তখন বেগম মুজিব মামলার আরও ৩৩ আসামিকে রেখে বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে রাজি না হতে বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দেন। কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতালও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়।

বেগম মুজিবের আরেকটি সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধু তার দলের সদস্যদেরও কাছ থেকে কী বলবেন এবং কী বলবেন না, সে সম্পর্কে বিভিন্ন পরামর্শ ও মতামত পেয়েছিলেন। এগুলো তার মনে একধরনের বিভ্রান্তি ও চাপ সৃষ্টি করেছিল। তবে, বেগম মুজিব তাকে অন্য কারো চেয়ে বেশি বুঝতেন, তাই স্বামীকে স্নেহ দিয়ে বলেছিলেন:

“আপনার মনে যা আছে তাই বলুন। আপনার কথা হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আপনি যা বলতে চান, নিজের মন থেকে বলুন।”

যা কার্যত ইডডিআই বা বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগকে এড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য একটি জাদু হিসেবে কাজ করেছিল। এমনটি না করলে অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশকে সাম্প্রতিককালের কাতালোনিয়ার ভাগ্যবরণ করার সম্ভাবনা ছিল।

স্বামী-সংসার ভালোভাবে আগলে রেখেও এই বাঙালি নারী শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গমাতা তার বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং রাজনীতি সম্পর্কে বাস্তবচিত মূল্যায়ন এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের কারণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করেছেন-

“তিনি বাবাকে শত দুঃখ-কষ্টেব মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে মা’র ইতিবাচক সমর্থন ছিল।” (আমার মা ফজিলাতুন নেছা, শেখ রেহানা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনা: ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বৈশাখী প্রকাশনী, ১৯৯৮,পৃ. ২৪)

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়-

“জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকরা আমার বাবাকে হত্যা করল, তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।” এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন।” (আমার মা: বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, ৮ আগস্ট, ২০১৬, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মা’কে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ)

লেখক: সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন:
বেগম মুজিব: নিভৃতচারিণী মহীয়সী নারীর প্রতিকৃতি
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে…
করোনার থাবা ও অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ঝুঁকি
আমাজনপ্রধানের মহাকাশভ্রমণ ও বিপন্ন মানবতা
বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বিশ্লেষণ
Sheikh Hasinas visionary leadership Bangladesh among the worlds best in mega projects

শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব: মেগা প্রকল্পে বিশ্ব সেরার তালিকায় বাংলাদেশ

শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব: মেগা প্রকল্পে বিশ্ব সেরার তালিকায় বাংলাদেশ 
সাংবাদিক খায়রুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
সদ্য চালু হওয়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও হতে যাচ্ছে ঠিক তেমনই। চাঙ্গি বিমানবন্দরের মতো সব মান নিশ্চিত করেই তৈরি করা হচ্ছে শাহজালাল বিমানন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এটির নকশাও করেছেন চাঙ্গি বিমানবন্দরের স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরের নকশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রোহানির প্রণীত নকশার থার্ড টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে বিশ্বের প্রথম সারির বিমানবন্দরের তালিকায় উঠে আসবে বাংলাদেশের নাম।

একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের মত মোড়লদের বিরোধিতার পরও পদ্মা সেতু তৈরি, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রেরেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে পারমানবিক শক্তিধর দেশের তালিকায়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু মেগা প্রকল্পই নয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে পারমাণবিক দেশের মর্যাদায় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে।

চালু হয়েছে দেশের আরেকটি মেগা প্রকল্প শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। যা বিশ্বের বুকে আরেকটি গর্বের স্থাপনা। আর এসব সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্ঠায়। তবে তিনি জাতিকে আরেকটি স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আর তা হলো অচিরেই চাঁদে যাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়নে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বর্তমান বিশ্বে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও সর্বোচ্চ মানসম্মত বিমানবন্দর সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি।

বিমানবন্দরটির ২০২৩ সালের রেটিং স্কোর ৯০ দশমিক ১২। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর। রেটিং স্কোর ৮৭ দশমিক ৬২। মানের শীর্ষে আরও রয়েছে যুক্তরাজ্যের হিথ্রো, সুইজারল্যান্ডের জুরিখসহ বিভিন্ন দেশের আরও অনেক বিমানবন্দর।

এগুলোয় রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। পাশাপাশি যাত্রীদের যাতে কোনো রকম ভোগান্তি না হয়, তাও নিশ্চিত করা হয়েছে । একজন যাত্রী সহজেই বিমানবন্দরের সব ধাপ অতিক্রম করে উড়োজাহাজে আরোহণ করতে পারেন। একইভাবে বিমান থেকে নেমে আরামদায়ক প্রস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে।

সদ্য চালু হওয়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও হতে যাচ্ছে ঠিক তেমনই। চাঙ্গি বিমানবন্দরের মতো সব মান নিশ্চিত করেই তৈরি করা হচ্ছে শাহজালাল বিমানন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এটির নকশাও করেছেন চাঙ্গি বিমানবন্দরের স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরের নকশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রোহানির প্রণীত নকশার থার্ড টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে বিশ্বের প্রথম সারির বিমানবন্দরের তালিকায় উঠে আসবে বাংলাদেশের নাম।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই টার্মিনাল ভবনটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। ভবনটির ভেতরের সৌন্দর্যও নান্দনিক। দিনের বেলায় সূর্যের আলোর পরিপূর্ণ ব্যবহার করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ভবনটিতে। প্রতিদিন ৩৩ হাজার যাত্রী টার্মিনালটি ব্যবহার করতে পারবেন। যা বছরে প্রায় বছরে ১ কোটি ২০ লাখ। বহুতল কার পার্কিংয়ে গাড়ি রাখা যাবে ১ হাজার ২৩০টি। বিদ্যমান টার্মিনাল ১ ও ২-এ বর্তমানে বছরে ৮০ লাখ যাত্রীসেবার ব্যবস্থা রয়েছে।

টার্মিনাল ১ ও ২-এ বর্তমানে ৮০০টি গাড়ি পার্ক করা যায়। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের তৃতীয় টার্মিনালে (ভবন ছাড়া) একসঙ্গে ৩৭টি বিমান পার্ক করে রাখার জায়গা (অ্যাপ্রোন) রয়েছে। বোর্ডিং ব্রিজ আছে ২৬টি।

এ ছাড়াও এখানে ২ লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটারের একটি আধুনিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন থাকবে। স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন, বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন বিমানবন্দরে প্রবেশ করে যাত্রীরা সাধারণত চেক-ইন কাউন্টারে গিয়ে তার টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস নেন এবং ব্যাগেজ বুকিং দেন। তবে এ টার্মিনাল ভবনে থাকবে ১০টি সেলফ চেক-ইন মেশিন (কিয়স্ক)

এগুলোতে নিজের পাসপোর্ট এবং টিকিটের তথ্য প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বোর্ডিং পাস ও আসন নম্বর। এর পর নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী তাঁর লাগেজ রাখবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাগেজগুলো এয়ারক্রাফটের নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে।

তবে নির্ধারিত ৩০ কেজির বেশি ওজনের লাগেজ এবং সাধারণ যাত্রীদের চেক-ইন ও লাগেজ বুকিংয়ের জন্য থাকবে আরও ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার। টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেট থাকবে। এসব ই-গেট দিয়ে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি না হয়ে সরাসরি নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। তবে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও থাকবে।

সেখানে ইমিগ্রেশন করবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। বিদেশি যাত্রীদের জন্য থাকবে ৫টি ই-গেট। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার। ই-গেট সবাই ব্যবহার করতে পারবেন না। ই-পাসপোর্টধারীরাই শুধু এ গেটের মাধ্যমে পার হতে পারবেন। ই-পাসপোর্টধারীরা ই-গেটের কাছে গিয়ে ই-পাসপোর্ট রাখার সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে যাবে। নির্দিষ্ট নিয়মে গেটের নিচে দাঁড়ানোর পর স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে।

এর পর সব ঠিক থাকলে ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যেই যাত্রী ইমিগ্রেশন শেষ করতে পারবেন। কেউ ভুল করলে ই-গেটে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। তখন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা যাত্রীকে সঠিকভাবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারে সহযোগিতা করবেন।

এক কথায়, সম্পূর্ণ অটোমেটেড সুবিধা থাকবে এই টার্মিনালে। স্ট্রেইট এস্কেলেটর তৃতীয় টার্মিনালে থাকবে ৩৫টি এস্কেলেটর, যা বাংলাদেশে প্রথম। যারা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরের দীর্ঘ পথ হাঁটতে অক্ষম, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে বেশি যাত্রীসমাগমের জায়গায় এ ধরনের এস্কেলেটর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

ব্যাগেজ বেল্ট যাত্রীদের ব্যাগের জন্য তিনটি আলাদা স্টোরেজ এলাকা করা হয়েছে। রেগুলার ব্যাগেজ স্টোরেজ, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এবং অড সাইজ (অতিরিক্ত ওজন) ব্যাগেজ স্টোরেজ। যাত্রীদের স্বাভাবিক ওজনের ব্যাগেজের জন্য চাঙ্গি ও ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মতো অত্যাধুনিক এবং একই রকমের ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট থাকবে।

অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে আরও চারটি পৃথক বেল্ট। এ ছাড়া ব্যাগেজ এলাকাসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ব্যাগেজগুলোর জন্য থাকবে আলাদা লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ব্যাগেজ এরিয়া। শিশুদের খেলার জায়গা টার্মিনালের প্রতিটি ওয়াশরুমের সামনে থাকবে একটি বেবিকেয়ার লাউঞ্জ। এ লাউঞ্জের ভেতর মায়েদের জন্য থাকবে ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম।

এ ছাড়া বাচ্চাদের স্পিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন খেলার এলাকাও থাকবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য থাকবে সার্বক্ষণিক দক্ষ চিকিৎসকসহ হেলথ ইন্সপেকশন সুবিধা, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, করোনাসহ নানা রোগ পরীক্ষার কেন্দ্র ও আইসোলেশন সেন্টার। মুভি লাউঞ্জ, ফুডকোর্ট বিমানের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় যাতে একঘেয়েমি না লাগে সে জন্য থাকবে মুভি লাউঞ্জ, এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডে-রুম।

এ ছাড়াও ঘোরাফেরা ও কেনাকাটার জন্য থাকবে ১৪টি স্পটে ডিউটি ফ্রি শপ। টার্মিনালের বাইরে ও ভেতরে থাকবে ফুডকোর্ট, ফুড গ্যালারি, ওয়াই-ফাই এবং মোবাইল চার্জিং সুবিধা। নারী ও পুরুষের জন্য থাকবে পৃথক নামাজের ব্যবস্থা। যাত্রীদের স্বাগত বা বিদায় জানাতে যাওয়া দর্শনার্থীদের জন্য মিটার্স অ্যান্ড গ্রিটার্স প্লাজাও থাকবে টার্মিনালে।

আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নতুন এই টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকবে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানার মেশিন, ১১টি বডি স্ক্যানার। টার্মিনালে প্রবেশ করা একজন যাত্রীকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তল্লাশি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রীকে বডি স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দু’হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। এর ফলে যাত্রী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সময় বাঁচবে। স্ক্য্যানিংও হবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ।

এদিকে বিমানবন্দরের ভেতরে থাকবে একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশন। সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন একজন পৃথক ফায়ার স্টেশন ম্যানেজার। থাকবে আগুন নেভানো ও জরুরি উদ্ধারকাজ পরিচালনার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে। আসবে নতুন নতুন এয়ারলাইন্স টার্মিনাল ১ ও ২-এ সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার কারণে অতীতে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট গুটিয়ে নিয়েছে।

নতুন টার্মিনালে সেসব এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন টার্মিনালটি মাঝারি ও বড় সাইজের (ওয়াইড বডি জেট) এয়ারক্রাফট ব্যবহার করবে। ১ ও ২ নম্বর টার্মিনাল দুটি ছোট আকারের বিমানগুলো ব্যবহার করবে।

বাড়বে কার্গো সুবিধা বর্তমানে বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানির জন্য একটি কার্গো ভিলেজ থাকলেও থার্ড টার্মিনালের উত্তর পাশে একটি পৃথক আমদানি-রপ্তানি কার্গো ভিলেজ ভবন থাকবে। এটির আয়তন ৬৩ হাজার বর্গমিটার। এটিও হবে উন্নত বিশ্বের মতো সর্বাধুনিক সুবিধা-সংবলিত। বিমানবন্দরের বর্তমান কার্গো ভিলেজের ধারণক্ষমতা ২ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন। তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো ভিলেজের ধারণক্ষমতা হবে প্রায় দ্বিগুণ বা ৪ মিলিয়ন টন। এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের আয়তন আড়াইগুণ বৃদ্ধি পাবে। বছরে যাত্রী পরিবহন ক্যাপাসিটি আরও ১২ মিলিয়ন বাড়বে। অর্থাৎ বর্তমানে আট মিলিয়নের সঙ্গে ১২ মিলিয়ন যুক্ত হয়ে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বেড়ে ২০ মিলিয়নে দাঁড়াবে।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই রপ্তানির একটি বড় অংশ হয় বিমানবন্দর দিয়ে। সমুদ্রপথের তুলনায় আকাশপথে রপ্তানি ব্যয়বহুল হলেও লিড টাইম মোকাবিলায় আকাশপথে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠাতে হয় অনেক সময়। তবে এতে ঝক্কি-ঝামেলাও পোহাতে হয় অনেক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে তাদের ভোগান্তি লাঘব হবে অনেকাংশে। থার্ড টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে রপ্তানিতে বইতে পারে সুবাতাস। বিশেষ করে প্রপার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং তদারকি সম্ভব হলে সুফল মিলবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমাত্রিক ও গতিশীল নেতৃত্বে জাতির পিতার হাতে যাত্রা শুরু করা দেশের এভিয়েশন খাত উন্নীত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাড়ছে দেশের আকাশ পথের সংযোগের পরিধি। শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা অনুসারে সারাদেশে বিমান পরিবহন অবকাঠামোর যুগোপযোগী উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, কারিগরি ও জনদক্ষতা উন্নয়ন এবং নিরাপদ ও সুষ্ঠ বিমান চলাচল নিশ্চিতে কাজ অব্যাহত রয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল তারই প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের এভিয়েশন শিল্পকে স্মার্ট এভিয়েশন শিল্পে রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম এভিয়েশন হাবে পরিণত হবে।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাতে বঙ্গবন্ধুর সকল স্বপ্ন আর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়িত হচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অবকাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে যা এরইমধ্যে দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠা হয়েছে দেশজুড়ে প্রসারিত ডিজিটাল সিস্টেম, যা সেবাসমূহকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে অভিষ্ঠ লক্ষমাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক, যুগ্ম সম্পাদক , ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The man of right words left

‘হককথা’র মানুষটি চলে গেলেন

‘হককথা’র মানুষটি চলে গেলেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান। ছবি: সংগৃহীত
নানা কারণে সাংবাদিকতা পেশায় থাকব কি থাকব না, তা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে দোটানায় থাকতাম। সব ভুলে স্যারের নিষ্ঠুর সত্য ‘হককথা’র প্রেমে পড়ে গেলাম। সাক্ষাৎকার নিতে বেশ কয়েকবার স্যারের বাসায় গিয়েছি। কতদিন যে স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি গুনে শেষ করা যাবে না। যখনই কোনো জটিল বিষয় বুঝতে সমস্যা হয়েছে, স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছি।

চলে গেলেন ডাকসাইটে আমলা, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারাল একজন সত্যভাষী ও সাহসী মানুষকে, যিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন আকবর আলি খান। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানি জান্তা তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।

এই মানুষটিকে হারিয়ে দেশের মানুষ যে শোকাহত, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের অনেক ক্ষতি হলো, সেটাও সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো সাংবাদিকদের।

সোজাসাপ্টা বললে রিপোর্টারদের ক্ষতি হলো সবচেয়ে বেশি। এই মানুষটার কাছ থেকে আর কোনো ‘সাহসী’ ও ‘নিরপেক্ষ’ বক্তব্য পাবেন না প্রিন্ট, অনলাইন, টেলিভিশনের রিপোর্টাররা। ফলাও করে সেই বক্তব্য দেশবাসীকে জানাতে পারবেন না। আর নতুন যারা সাংবাদিকতা পেশায় আসবেন, তারা একজন ভালো শিক্ষক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন।

আর তাই তো আকবর আলি খানের মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট-বড় সব সাংবাদিকের ফেসবুক ওয়ালে শোকের ছায়া নেমে আসে। সাংবাদিকদের কাছে এই মানুষটি যে কতটা প্রিয় ছিলেন তার প্রমাণও মেলে।

আকবর আলি খানের নাম শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন তিনি সচিব পদে পদোন্নতি পান। ১৯৯৩ সালে সরকারের সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অর্থসচিব হন। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হয়েছিলেন।

সে সময় আমি খুবই ছোট সাংবাদিক। সচিবালয়ে ঢোকার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পাইনি। তাই মহান এই মানুষটির সঙ্গে খুব একটা দেখাও হয়নি। ২০০১ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক (অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর) পদে যোগদান করেন। বিশ্বব্যাংকে তিনি ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।

২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। পরে সেই সময় রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নে তিনিসহ চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন।

ততদিনে আমি স্টাফ রিপোর্টার থেকে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হয়েছি; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ করি। তখনই আকবর আলি খান স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে কাছে টেনে নেন। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতেন স্যার।

দেশের বাস্তবতার নিরিখে সুন্দর সুন্দর ঝাঁঝালো, চমৎকার কথা বলতেন স্যার। দ্রুত তা লিখে অথবা মোবাইলে অফিসে পাঠাতাম। সহকর্মীরা তা আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তুলে দিতেন। অন্য রকম তৃপ্তি পেতাম। স্যারের অন্ধভক্ত হয়ে গেলাম।

নানা কারণে সাংবাদিকতা পেশায় থাকব কি থাকব না, তা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে দোটানায় থাকতাম। সব ভুলে স্যারের নিষ্ঠুর সত্য ‘হককথা’র প্রেমে পড়ে গেলাম। সাক্ষাৎকার নিতে বেশ কয়েকবার স্যারের বাসায় গিয়েছি। কতদিন যে স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি গুনে শেষ করা যাবে না। যখনই কোনো জটিল বিষয় বুঝতে সমস্যা হয়েছে, স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছি।

শুধু আমি নই, সব সাংবাদিককেই সহায়তা করতেন; সবার ফোন ধরতেন। কে বড় পত্রিকার সাংবাদিক, কে ছোট পত্রিকার, বাছবিচার করতেন না।

এরই মধ্যে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো। দুই নেত্রীকে জেলে পাঠানো হলো। সর্বত্র ভয়-আতঙ্ক; থমথমে অবস্থা। সবাই চুপ…! শুধু একজন ছাড়া।

তিনি আকবর আলি খান। ২০০৭ থেকে ২০০৮। দুই বছর সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি; প্রায় প্রতিদিনই করেছেন।

এই মানুষটিকেই হারাল বাংলাদেশ। এমন ‘হককথা’র মানুষ দেশে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। আর আসবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

তাই তো আকবর আলি স্যারের মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর আকবর আলি খানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানাই। তার সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশের সুধী সমাজকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিল। বিদায় আকবর ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চার বছরের সিনিয়র ইতিহাস বিভাগের প্রবাদতুল্য মেধাবী ছাত্র। একাধারে দক্ষ নীতিবান সরকারি কর্মকর্তা, ইতিহাস ও অর্থনীতির গবেষক, রাজনীতির নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, সুলেখক, শিক্ষক, নাগরিক সংগঠক ও সমাজচিন্তক।’

ওপারে ভালো থাকবেন স্যার। যে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে আপনার অনন্য অবদান, সেই দেশের মানুষ আপনাকে মনে রাখবে চিরকাল।

আরও পড়ুন:
আকবর আলি খানের প্রয়াণ

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The history of the budget and the countrys 22 23 fiscal year

বাজেটের ইতিবৃত্ত ও  দেশের ’২২-২৩ অর্থবছরে আলোকপাত

বাজেটের ইতিবৃত্ত ও  দেশের ’২২-২৩ অর্থবছরে আলোকপাত
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ও স্বাধীনতার ৫১তম বাজেটের মধ্যে টাকার অঙ্ক ও সময়ের অনেক ব্যবধান থাকলেও দুটি বাজেটের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন অর্থাৎ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি এটাই কামনা উচিত।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় জুনে, এক বছরের জন্য, যা বছরের পয়লা জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ কার্যকর থাকে। মূলত সরকারের নির্দিষ্ট সময়ের (জুলাই ১ থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন ) দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু চিত্র প্রতিফিলত হয় বাজেটের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বাজেট শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবছর জুনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল আকারে পেশ করেন। এবারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে গতকাল।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাত সফলভাবে মোকাবিলা করে চলমান উন্নয়ন বজায় রাখা ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’। অর্থাৎ এবারের বাজেটে মহামারি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১.৫ শতাংশ যার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪.৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬.৬ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে অনুযায়ী এবারে বাজেটে মোট প্রাক্কলিত আয়ের পরিমাণ বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)তে এ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।

বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ইউক্রেন-রাশিয়ার কারণে বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণসহ উৎপাদন সরবরাহ ঠিক রাখা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বাজেট হচ্ছে দেশের ৫১তম বাজেট। স্বাধীনতা পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার দেশের প্রথম বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন জাতীয় নেতা ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম বাজেট যা ছিল বিদেশি অনুদান ও ঋণনির্ভর যেটাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘উন্নয়ন এবং পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট’। আর এবার ঘোষিত বাজেট হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের প্রায় ৮৬০ গুণ যার শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ও স্বাধীনতার ৫১তম বাজেটের মধ্যে টাকার অঙ্ক ও সময়ের অনেক ব্যবধান থাকলেও দুটি বাজেটের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন অর্থাৎ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি এটাই কামনা উচিত।

একটি দেশের বাজেট ঘোষণার পর সেটি নিয়ে যেভাবে আলোচনা ও সমালোচনা হয়, বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ততটা সহজ নয়। কেননা প্রতিটি দেশের জন্য প্রণীত বাজেটের কাঠামো ও আইনি ভিত্তিও বহুমাত্রিক। প্রতিবছর সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন সেই ‘বাজেট’ শব্দের উৎপত্তি নিয়েই রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কেননা ‘বাজেট’ ইংরেজি শব্দ। সাবেক অর্থসচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তার রচিত ‘বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন- মধ্যযুগের ইংরেজি ‘বুজেট’ (Bougette) থেকে বাজেট শব্দের উৎপত্তি। বুজেট শব্দের অর্থ মানিব্যাগ বা টাকার থলি। বাংলায় থলির সমার্থক বোচকা-পোটলা। তবে, বুজেট এর পরিভাষা এখনও রচিত হয়নি।

বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে উল্লেখ রয়েছে বাংলায় বাজেট শব্দটি ১৯০২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাজেটের উৎপত্তি হয়েছে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ বছর আগে। ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত রবার্ট ওয়ালপুল যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারা বছরই কর কমানো বা কর বাতিলের দাবি পেতেন।

এসব তিনি একটি ‘বুজেটে’ বা মানিব্যাগে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষদিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হতো, তখন তিনি কাগজগুলোর ভিত্তিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাঁড় করাতেন। মানে বাজেট প্রণয়ন করতেন। সেই থেকে ‘টাকার থলি বা বাজেট’ হয়ে গেছে সরকারের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের প্রতিশব্দ। সুতারং ইতিহাস বলে, বাজেট-ব্যবস্থার উৎপত্তি মানিব্যাগ থেকে। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনীতি অনেক বড় হয়। ফলে বাজেট-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাড়তে থাকে। এত বেশি দাবি আসে যে, এসব প্রস্তাব শুধু একটি মানিব্যাগে সংকুলান সম্ভব হয় না। ফলে মানিব্যাগের জায়গায় আসে ব্রিফকেস। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সংসদের বাজেট অধিবেশনে ব্রিফকেস নিয়ে যান এবং ব্রিফকেসের ভেতর থাকে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার কপি।

বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।

মহান জাতীয় সংসদে প্রতিবছর জুনে অর্থমন্ত্রী বিল আকারে যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার আইনি ভিত্তি হচ্ছে মূলত বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের ৮৭ (১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- “প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি (এই ভাগে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ বা Annual Financial Statement নামে অভিহিত)।” অর্থাৎ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বাজেট শব্দটি উল্লেখ নেই আছে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’। মূলত এই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিই ‘বাজেট’ নামে অভিহিত। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আওতায় ৮১ থেকে ৯৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনার ভিত্তি বর্ণিত আছে। তাছাড়া সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “অর্থ-বৎসর” অর্থাৎ জুলাই মাসের প্রথম দিবসে অর্থ বৎসরের আরম্ভ।

বাংলাদেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার রীতি বর্ণিত আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি’তে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ষোড়শ অধ্যায়ে “আর্থিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত কার্যপদ্ধতি” শিরোনামে বাজেট, মঞ্জুরি-দাবি, নির্দিষ্টকরণ বিল, সম্পূরক ও অতিরিক্ত মঞ্জুরি এবং ঋণের ওপর ভোট, ছাঁটাই প্রস্তাব, প্রস্তাবের ওপর আলোচনা, আলোচনার জন্য স্পিকার বরাদ্দকৃত সময় ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১১১(১) বিধিতে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে ‘বাজেট’ নামে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১১১(২) বিধিতে বলা হয়েছে, “এই ব্যাপারে সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করিবেন।”

১৯৭২ সাল থেকে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হলেও ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। যার ফলে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হতো মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণীত বিধির মাধ্যমে। ২০০৯ সালে সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে বাংলাদেশে প্রণীত হয় ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়: ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’; সচিবালয় নির্দেশমালা-২০১৪; রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬; জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলস ইত্যাদির বিধি-বিধান মোতাবেক। সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপতির সুপারিশ’ নিয়ে ‘সংসদে উত্থাপন করা’ হয় অর্থ বিভাগ হতে প্রণীত প্রস্তাবিত বাজেট। অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট বিল আকারে উপস্থাপনের পর উত্থাপিত বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়, সংসদে তর্ক হয় ও বিতর্ক হয়।

সংসদে উত্থাপিত অর্থবিল সংসদ সদস্যদের অনুমোদনের পর এটি আইনে পরিণত হয় এবং তা পরবর্তী অর্থবছরের জন্য কার্যকর হয়। বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের অংশ থাকে মূলত তিনটি: যার প্রথম ভাগে থাকে আয়ের হিসাব। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের সরকারের সম্ভাব্য আয়ের হিসাব থাকে। সরকারের সম্ভাব্য আয়ের উৎস আবার তিনটি। যথা- জনগণ প্রদেয় কর (এনবিআর ও অন্যান্য সংস্থার আদায়কৃত কর); কর বহির্ভূত আয় (ফি, লভ্যাংশ, অর্থদণ্ড, জরিমানা ইত্যাদি) এবং বৈদেশিক অনুদান।

বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের দ্বিতীয় ভাগে থাকে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব। বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয় চারটি ভিন্ন খাতে বিভক্ত করা হয়: পরিচালন ব্যয়; খাদ্য হিসাবে ক্রয়; ঋণ ও অগ্রিমবাবদ পরিশোধ এবং উন্নয়ন ব্যয়। বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দরকার আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব। ড. আকবর আলি খান তার ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ উল্লেখ করেছেন ‘‘আমরা যেমন দেখি, ‘যদি সঠিক আয়ের হিসাবে বাজেটের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে’।

বাজেটের তৃতীয় ভাগে থাকে সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে বাজেটকে বলা হয় ‘ঘাটতি বাজেট’। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সব বাজেটই ছিল ‘ঘাটতি বাজেট’। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো কেননা এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে এবং অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এবারে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি যা ছিল জিডিপির ৬.২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট মেনে নেয়া হয়। বাজেট-ঘাটতি দুভাবে পূরণ করা হয়। যেমন, বৈদেশিক উৎস; এটি মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদ হার কম এবং পরিশোধ করতে অনেক সময় পাওয়া যায়। তবে শর্ত থাকে বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস সরকার দুভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ‘ঘাটতি বাজেট’ নেতিবাচক শোনালেও এটা বরং উন্নয়ন সহায়ক।

আইএমএফের তথ্যমতে, কাতার, লুক্সেমবার্গ, উজবেকিস্তান ইত্যাদি পেট্রো-ডলারে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘ঘাটতি বাজেট’ দেয়া হয়।

দেশে দেশে বাজেট উপস্থাপনের নানা ঐতিহ্য রয়েছে। সব দেশেই অর্থমন্ত্রীদের ব্রিফকেস সঙ্গে নিয়ে সংসদে বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ দেখা যায়। তবে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন তার প্রথম বাজেটটি ঘোষণার সময় ব্রিফকেসের পরিবর্তে লালসালুতে মোড়া বাজেট ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে সংসদে ঢুকেছিলেন। দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহ্যের লাল শাড়ির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ওই বছরের বাজেট ডকুমেন্ট সাজিয়েছিলেন তিনি। কানাডায় ১৯৫০ সাল থেকে সে দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের আগের দিন নতুন জুতা কেনেন। সেই নতুন জুতা পায়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে যান, বাজেট পেশ করেন।

কানাডার ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এ বছর জুতা কিনেছেন মোড়ের দোকান থেকে। করোনা আক্রান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার প্রতীক হিসেবে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বাজেটের প্রতীক হলো ‘ব্রিফকেস’। আর এই ব্রিফকেসটি কেনা হয় অর্থ বিভাগের সেবা শাখার মাধ্যমে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৭.০৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৮৬০ কোটি টাকা বা ২৯.৬২ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ৮৬ হাজার ৭৯৮ কোটি; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৭৯ হাজার ২৬ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২২.৫৯ শতাংশ।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয়বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭.৮৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ-বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৮৫ শতাংশ; নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১.০৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ এবং বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করা হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু যা দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশের বেশি অবদান রাখবে মর্মে অর্থনীতিবিদেরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতারং আমরা আশাবাদী যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার ধারা অব্যাহতসহ আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করার পদক্ষেপের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব প্রস্তাবিত বাজেটের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যেমে।

লেখক: উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রজেক্ট, ঢাকা

আরও পড়ুন:
বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী
মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়: সিপিডি
প্রস্তাবিত বাজেট বিনিয়োগবান্ধব: চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি
পাচার টাকা দেশে আনার উদ্যোগ অনৈতিক: সিপিডি
প্রস্তাবিত বাজেট ‘জনগণের জীবনমান পরিবর্তনমুখী’

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Flood and drinking water of Sylhet

সিলেটের বন্যা ও সুপেয় পানি

সিলেটের বন্যা ও সুপেয় পানি
দেশের যেকোনো সংকটময় সময়ে নানা মতের মানুষ এগিয়ে আসেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বন্যার্ত সিলেটবাসীর পাশে দাঁড়ানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি না। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও এগিয়ে আসতে পারে। পানি বিশুদ্ধকরণে এসব ধাপ অনুসরণ করে একে একে নলকূপগুলো থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার উপায় তো নিশ্চিত করতে পারে।

সিলেটের বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সুরমা, কুশিয়ারা, ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি কমতে শুরু করায় ধীরে ধীরে বন্যার পানিও কমছে। আকস্মিক বন্যায় জেলার প্রায় পনেরোটি উপজেলা প্লাবিত হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দশ থেকে বারো লাখ মানুষ ছিল পানিবন্দি।

বন্যায় পানিবন্দি মানুষের অস্থায়ী দুর্ভোগ পোহাতে হয় দুই সময়। যখন বন্যায় পানিবন্দি থাকতে হয়, তখন এক ধরনের দুর্ভোগ। পানিবন্দি অবস্থায় অনেকের ঘরের ভিতর পানি ঢুকে পড়েছিল। হাঁটুপানি, কোমরপানি, গলা সমান পানি। কোনো কোনো জায়গায় ঘরবাড়ি ডুবে যায় পুরোপুরি। মানুষ অস্থায়ী মাচা বানিয়ে কিংবা বাড়ির ছাদে কোনো রকমে দুঃসহ সময় কাটিয়েছেন। ওদিকে তখন আবার বৃষ্টিও হয় কয়েকদিন। দুর্ভোগের ওপর আরও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বন্যার্তরা। তার ওপর ছিল ছিঁচকে চোর-ছিনতাইকারীর উপদ্রব।

সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ সেই অসহায় অবস্থা পেরিয়ে এসেছেন। এতদিনে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। কিছু জায়গায় পুরোপুরি নেমেও গিয়েছে।

বন্যার পানি নামার পর শুরু হয় দুর্ভোগের দ্বিতীয়পর্যায়। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। সঙ্গে আছে খাবার সংকট, ঘরবাড়ি মেরামত সংকট, সেনিটেশন সংকট। যে কারণে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরেও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ঘরে থাকা খাবারের মজুদ অনেক আগেই অনেকের ফুরিয়ে গিয়েছে। এ সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং তা সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা জরুরি। তারচেয়েও জরুরি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা।

যদিও চারধারে কেবল পানি আর পানি। বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘দ্য রাইম অব দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতার মতো- ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়ার অ্যান্ড নট আ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক।

বন্যার্তদের চারপাশে কেবল পানি আর পানি। কিন্তু এক ফোঁটাও পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানি নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে যেকোনো সময়।

বন্যার পর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু ভেঙে পড়ার আগেই যদি হাল ধরা না যায়, তবে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এমনকি বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

সিলেটের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সুপেয় পানির উৎস্য প্রধানত দুটো। গভীর নলকূপ এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা খাবার পানি। কিন্তু এই বন্যায় প্রায় ১২ হাজার নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জকিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সাড়ে ছয় হাজার মিটার পানি সরবরাহের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ৭৮ হাজার শৌচাগারও ক্ষতিগ্রস্ত। সিলেটের জনস্বাস্ব্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মতে, সবমিলিয়ে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।

বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছে সিলেটের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। মোবাইল ওটায়ার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। জেলার কানাইঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ কাজ চলছে। ট্রিটমেন্ট প্লান্টে ঘণ্টায় ৬০০ লিটার পানি পরিশোধন করে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পানি বিতরণ করা হচ্ছে।

এর বাইরে জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় ছয় লাখ ৬৩ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও দশ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এক হাজার ৪০০টি পানির জার ও ৯০০ বালতিও বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করেছে বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

এদিকে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বন্যার পানি থেকে জেগে ওঠা নলকূপ জীবাণুমুক্ত করার জন্য একটি পরামর্শ দিয়েছে। আটটি ধাপের এ পরামর্শ হচ্ছে- ধাপ ১: ১২ থেকে ১৫ লিটার পানি একটি বালতিতে নিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ভালোভাবে মেশাতে হবে।

ধাপ ২: একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মিশ্রণ ছেঁকে নিতে হবে। অথবা মিশ্রণটি স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ধাপ ৩: নলকূপের পাম্পের হাতল ও প্লাঞ্জার রড পাম্প থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে।

ধাপ ৪: মিশ্রণের অর্ধেক পানি পাম্পের ভিতর ঢালতে হবে।

ধাপ ৫: হাতল ও প্লাঞ্জার রড ভালোভাবে পরিষ্কার করে ময়লা ও কাদা সরিয়ে ফেলতে হবে।

ধাপ ৬: হাতল ও প্লাঞ্জার রড আবার স্থাপন করতে হবে। এবং ঘোলা পানি দূর না হওয়া পর্যন্ত পাম্প করে যেতে হবে।

ধাপ ৭: পাম্প করে পর্যাপ্ত পানি পাওয়ার পর অবশিষ্ট মিশ্রণ পাম্পের ভিতর ঢালতে হবে এবং ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরিনের গন্ধ থাকা পর্যন্ত পাম্প করতে হবে।

ধাপ ৮: নলকূপের আশেপাশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

কথা হলো, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সব মানুষের পক্ষে কি এসব ধাপ অনুসরণ করে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব? বিভিন্ন কারণে এটা সবসময় সম্ভব হয় না। আর সে কারণেই শুধু ধাপের উল্লেখ করে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সব এলাকায় পানি বিশুদ্ধ করার জন্য এসব উপকরণ সহজলভ্য না-ও হতে পারে।

দেশের যেকোনো সংকটময় সময়ে নানা মতের মানুষ এগিয়ে আসেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বন্যার্ত সিলেটবাসীর পাশে দাঁড়ানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি না। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও এগিয়ে আসতে পারে। পানি বিশুদ্ধকরণে এসব ধাপ অনুসরণ করে একে একে নলকূপগুলো থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার উপায় তো নিশ্চিত করতে পারে। তাতেও বন্যার্ত সিলেটবাসী উপকৃত হবে। অন্তত খাবার পানির সংকট তো কাটবে!

লেখক: শিশু সাহিত্যিক, কলাম লেখক।

আরও পড়ুন:
বন্যায় বেশি ক্ষতি সড়ক-কৃষি-মাছের
বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়ার নির্দেশ অধ্যক্ষের!
সিলেটে কমছে পানি, বাড়ছে রোগ
পানি কমছে, বাড়ছে ডায়রিয়া ও চর্মরোগ
সিলেটের নতুন দুর্ভোগ পানির দুর্গন্ধ

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Can people go out on the streets?

‘মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে’...?

‘মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে’...?
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি এবং ছাত্রদলকে চলতে হবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এঁকে দেয়া ‘শান্তিসীমানার’ মধ্যে। এটা কি সম্ভব? বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এ দলের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতার কারণে ক্ষমতার বাইরেও আছে বহু বছর ধরে। বিএনপির এখন অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে বিদ্বেষ-বিরূপতা কমবে বলে কেউ কেউ আশা করছিলেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক এটা যদি আওয়ামী লীগ চায়, তাহলে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ওপর হামলা-মামলা কম হওয়াটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে ঘটছে তার বিপরীত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়ার কথা বলেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ছাত্রদলকে যেভাবে হামলার মুখে রেখেছে ছাত্রলীগ তাতে মনে হচ্ছে সরকার বিএনপির প্রতি নমনীয় অবস্থানে আসেনি! এর কারণ কী?

কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি নেতারা সরকার পতনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগও তাদের খুব ছাড় দেবে না। আর বিএনপি নেতারা উস্কানিমূলক কথা কম বললে পরীক্ষামূলকভাবে দলটিকে ছোট ছোট সভা-সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিতে চায়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে কোনো পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা বা কর্মসূচিকে সহজভাবে নেবে না ক্ষমতাসীন দল।

বিএনপি ও ছাত্রদলের ওপর সাম্প্রতিক হামলার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এবং উন্নয়নবিরোধী যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সুতরাং বিএনপি শান্তিপূর্ণ থাকলে আওয়ামী লীগ অশান্তি সৃষ্টি করতে যাবে কেন?

অপরদিকে, ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছেন, ইদানীং ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাঙচুর থেকে শুরু করে অছাত্র-বহিরাগতদের নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার অপকৌশল নিয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্রদলকে প্রতিহত করেছে। এখন থেকে সহিংসতার উদ্দেশ্যে ছাত্রদল যখনই ক্যাম্পাসে আসবে, তখনই তাদের প্রতিহত করা হবে।

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি ও ছাত্রদলকে চলতে হবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এঁকে দেয়া ‘শান্তিসীমানার’ মধ্যে। এটা কি সম্ভব? বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এ দলের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতার কারণে ক্ষমতার বাইরেও আছে বহু বছর ধরে। বিএনপির এখন অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা। তারা এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় দুটো। হয় নির্বাচনে জিততে হবে অথবা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি জিততে পারবে বলে মনে করে না।

তাদের ধারণা মানুষ ভোট দিলেও তাদের হারিয়ে দেয়া হবে কারসাজি করে। তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হঠানোর চেষ্টা কি বিএনপির সামনে? কিন্তু বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চাঙা করতে পারছে না। এই অবস্থায় কী করবে বিএনপি? কেউ কেউ মনে করেন, দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তাতে বিএনপির উচিত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য কিছু সময়ের জন্য হলেও সরকারের নিয়ন্ত্রিত পথেই হাঁটা। বড় বড় হুংকার না দিয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে সংগঠিত করা, তাদের আস্থায় আনা। কিন্তু বিএনপি সেটা সন্মানজনক বলে মনে করছে না। তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নীতিতে নয়, সংঘাতের নীতিতেই আগাতে চায়।

এক সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদল ও বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা ও বাধা এসেছে। লক্ষণীয় এটাই যে, এসব কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্যবস্তু করে বা খালেদা জিয়াকে নিয়ে তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের প্রতিবাদে। আবার একই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠন কিছু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পেরেছে, উগ্র বক্তব্য পরিহার করায়।

আওয়ামী লীগ যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব খর্ব হতে দিতে চায় না। আবার সম্প্রতি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়েছে। তারাও কিছুটা নিজেদের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিরও মেয়াদ শেষ, সম্মেলন আসন্ন। তাদের মধ্যেও নেতৃত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে তৎক্ষণাৎ কড়া জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

হঠাৎ বিএনপি উত্তেজিত হয়ে উঠলো কেন, তার কারণ অনুসন্ধানে এটা সামনে আসে যে, ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অতীতে দেয়া বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে একপর্যায়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে।

সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসাচ্ছে, এগুলো তার কাছে ছিল জোড়াতালি দেয়া। বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে কিছু দোসরেরাও…তাদেরকে এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেয়া উচিত।’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিএনপিকে উত্তেজিত করেছে। এটাকে তারা খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি হিসেবে দেখে এর প্রতিবাদ করতে থাকে। ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রদল প্রতিবাদ সমাবেশ করে খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে। সেখানে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় টিএসসিতে ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

ছাত্রদল তাদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই দিন সকালে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি যাওয়ার পথে শহীদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়। এই হামলার প্রতিবাদে ছাত্রদল গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়। সেদিন তারা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে আবারও ছাত্রলীগ হামলা করে। একপর্যায়ে ছাত্রদলের একাংশ সুপ্রিম কোর্ট ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লে সেখানেও তাদের পেটানো হয়।

একই দিন ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি’র প্রতিবাদে খুলনা মহানগর ও পটুয়াখালী জেলা বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা হয়। পটুয়াখালীতে হামলা করে ছাত্রলীগ আর খুলনায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এরপর বরিশালে পুলিশি বাধায় ছাত্রদলের মিছিল পণ্ড হলেও ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যুবদল সমাবেশ করেছে। তাদের কোনো বাধা দেয়া হয়নি।

নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। এই লক্ষ্যে রাজপথের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরিতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু করেছে। এই সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনায় মাঠে তৎপরতা বেড়েছে তাদের।

বিএনপি মনে করছে, যেভাবেই হোক দীর্ঘদিন পরে তাদের চলমান আন্দোলনে গতি এসেছে, জনসমর্থনও বেড়েছে। আন্দোলনের এই গতিকে তারা ধরে রাখবে। এখান থেকেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য: সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপরদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন দামসহ নানা কারণে দেশের মানুষও অতিষ্ঠ। এই প্রেক্ষাপটে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বর্তমানে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা হয়েছে। মামলা-হামলা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন দমানো যাবে না বলে তাদের বিশ্বাস।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং এটা চলবে। সমমনা দলগুলো বিএনপির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন ইতোমধ্যে সমমনা দলগুলো ছাত্রদলের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিএনপি বড় দল হিসেবে চেষ্টা করছে, আন্দোলন যে গতি পেয়েছে, সেটাকে অব্যাহত রাখতে। ধরপাকড়, মামলা-মোকদ্দমায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নেতাকর্মীরা এ নিয়ে আর কিছু মনে করে না।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘এত দিন সরকার নানাভাবে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। খালেদা জিয়াকে কটূক্তি করার প্রতিবাদে ছাত্রদল মিছিল করেছে। এরপর যে ঘটনা সরকার ঘটিয়েছে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, কোনো পূর্ব প্রস্তুতির প্রশ্নই ওঠে না। সরকারের ভীতির জায়গা থেকে এই ঘটনা ঘটেছে।’

বিএনপির নেতা চলমান সংঘাতকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনে করছেন। সারা দেশের মানুষ এখন নানা কারণে নিষ্পেষিত, দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেই অস্থিরতার জায়গা থেকে যেকোনো সময় মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে। আন্দোলন চলমান রয়েছে এবং সেখানে প্রধান দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা থাকবেই।

‘মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে’ বলে বিএনপি নেতাদের যে আশা তার বাস্তব লক্ষণ এখন পর্যন্ত কোথাও দেখা যায়নি। আর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও কোনো নতুন চিন্তার কথা শোনা যায় না। তাই এখন শুধু দেখার পালা, কে কীভাবে সামনে আগায়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
খুলনায় ছাত্রলীগ-বিএনপি সংঘর্ষ: গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি
ছাত্রদল ক্ষমা চাইলে ক্যাম্পাসে আসতে পারবে: ছাত্রলীগ
আজও ঢাবিতে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান ছাত্রলীগের
পুলিশের বাধায় পণ্ড ছাত্রদল-যুবদলের বিক্ষোভ মিছিল
ঢাবিতে সংঘর্ষ: ছাত্রদলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
May victory be fearless

জয় হোক অভয়ের

জয় হোক অভয়ের
আদর্শিক বিরোধের কারণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নির্মূল চেষ্টার এমন পাশবিক ঘটনা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। শেখ হাসিনা বারবার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা এক বহ্নিশিখা। তিনি মানবতার জননী।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, সেটাই বার বার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। সেই ’৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই ঘাতকের নিশানায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। নানা সময়ে নানাস্থানে তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কখনও সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কখনও বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং তাদের অনুসারীদের মদদে কখনওবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধনে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। প্রতিটি ষড়যন্ত্রের পর রাজনৈতিক যোগসূত্র মিলে যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি দলগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে। কোনো কোনো হত্যাচেষ্টায় আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘শত্রুর শত্রু, সে আমার মিত্র’ এই আদর্শে ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নানা সময়ে এই পর্যন্ত ২১ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড-বোমা ও গুলির হামলা হয়েছে।

হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রকাশ্যে দুবার, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারবার, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারবার, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে চারবার, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার ও আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক সময়ে চারবার হত্যাচেষ্টার কথা জানা যায়। খোদ, ঢাকাতেই শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয় কয়েকবার। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরেও তাকে একাধিকবার হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে। ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এখনও তাড়া করে ফিরছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। প্রতিটি হামলায় হত্যাকারীদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বার বার বুলেট-বোমা তাড়া করে বেড়ায় তাকে? কেন বার বার হত্যাকারীদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা? এসব হামলার ঘটনায় ৬৬ দলীয় নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। পঙ্গুত্ববরণ করেছে শত শত নেতা-কর্মী।

প্রথমবার হামলা হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। এই হামলায় ২৮ নেতাকর্মী প্রাণ হারান। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার জীবন বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করে ৯ নেতাকর্মী আত্মাহুতি দেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি নীলনকশা আর জঙ্গিবাদ উত্থানের ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন; নিহত হন আওয়ামী মহিলা লীগের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। মহান সৃষ্টিকর্তার পরম কৃপায় এই হত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো ব্যর্থ হয়।

২০০১ সালের ৩০ মে তেমনি একটি দিন। সেদিন খুলনার রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ঘাতকচক্র সেখানে একটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। পরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হরকাতুল জিহাদ। অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদীতে দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল ৩০ মের অনুষ্ঠান। গোয়েন্দা তৎপরতায় ঘাতকের সেই মিশনও সফল হয়নি। ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নেয়। গ্রেপ্তারকৃতদের ভাষ্যে- কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ।

একই সময় গ্রেপ্তার হওয়া অপর জঙ্গি কুতুবউদ্দিন ওরফে বাবুর বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার কেষ্টপুরে। ২১ আগস্ট হামলা মামলার সে দুই নম্বর আসামি এবং হুজির আঞ্চলিক নেতা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়েরের ঘনিষ্ঠজন। উল্লেখ্য, এর আগে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। একই বছর সিলেটেও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী। সাজাপ্রাপ্ত হুজির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি হান্নান স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কোটালিপাড়া, খুলনা ও সিলেটে হামলা।

খুলনার রূপসা সেতুর ঘটনার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক, বুট ও বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারদের ভাষ্য ও এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনাকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ও অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার পরিকল্পনা জঙ্গিদের হলেও তাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় ছিল সরকারবিরোধী স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু নেতাকর্মী।

বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে কেউ কেউ স্বীকার করেছে, তারা শেখ হাসিনাকে ইসলামের শত্রু মনে করে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামের অনেক ক্ষতি করেছে, তাই হুজির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

এরকম বাস্তবতায় তথা ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র ও জঙ্গিবাদ আশঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের নাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি-সন্ত্রাস-জটিলতার মধ্যেও পাল্টে যাচ্ছে দেশের চিত্র। কোনো চক্রান্ত্রই থামাতে পারছে না শেখ হাসিনার উন্নয়নরথ। তার হাত ধরে নির্মিত হচ্ছে আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজ- ইজ অ্যা মিরাকল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়- ‘উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। কোনো কোনো সূচকে ভারত থেকেও এগিয়ে।’

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা জাতিকে ঐতিহাসিক দায়মুক্তি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন করে জাতির কলঙ্কমোচন করেছেন। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব, চারলেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রাজধানীর চারপাশে স্যুয়ারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা-জ্বালানি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন।

সহজ করে বললে, বঙ্গবন্ধু ভৌগোলিক মুক্তি দিয়ে গেলেও এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি শেখ হাসিনার হাত ধরেই হচ্ছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে, হচ্ছে শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন বলেই। কোনো ষড়যন্ত্রই দমাতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে।

একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও ওঁৎপেতে আছে প্রতিশোধের। পঁচাত্তরের ঘাতকবাহিনী, যারা হত্যা করেছে পিতা-মাতা-ভাইসহ স্বজনদের, তারা চায় শেখ হাসিনার বিনাশ। তাকে নির্মূল করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানি ধারায় দেশ ফিরিয়ে নিতে চায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দেশটাকে তারা পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সেখান থেকে আজকের রূপে এনেছে স্বাধীনতার স্বপ্নবাহী পথে। সেই পথ অনেক চড়াই-উৎরাই। সেসব পথ মাড়িয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন।

আদর্শিক বিরোধের কারণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নির্মূল চেষ্টার এমন পাশবিক ঘটনা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। শেখ হাসিনা বারবার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা এক বহ্নিশিখা। তিনি মানবতার জননী। বাঙালির আশার বাতিঘর। তিনি তার জীবনকে বাংলার মেহনতি দুঃখী মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব মানবতার দিকে দুর্বার গতিতে। গণমানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির মূল দর্শন।

১৯৮১ সালের শুরুতে দলের দায়িত্ব নিয়ে দলকে তিনি শুধু চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ই আনেননি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে যেমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এখন তিনি। তার হাতে বাঙালি রাষ্ট্র ও বাঙালির সংস্কৃতি নিরাপদ।

জঙ্গিবাদকে নির্মূল ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আর এ কারণেই তার নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে ঘাতকচক্র। কিন্তু জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত তিনি অপ্রতিরোধ্য অদম্য বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন। কোনো ভয়-ভীতি তাকে কাবু করতে পারে না। জাতিকে তিনি অভয়মাঝে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। জয় হোক অভয়ের।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
তিনি ফিরলেন সব হারানোর দেশে
শেখ হাসিনা ফিরেছিলেন বলেই দেশ এগিয়েছে
শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরার দিন আজ
প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনা সভা সোমবার
এ দিন বিশ্ববাসীর সামনে প্রথম পিতা হত্যার বিচারের দাবি তোলেন শেখ রেহানা

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The security of citizens in the United States is declining

যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকের নিরাপত্তা কমছে

যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকের নিরাপত্তা কমছে
যে অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‍্যাবের কয়েক সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেই অবস্থা এখন তার দেশে অতি বেশি মাত্রায় বিরাজমান। তাই তাদের উচিত এই নিষেধাজ্ঞা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া। তাদের বোঝা উচিত এবং বুঝতেও পারছে যে, মানবাধিকার শুধু যারা মানুষ এবং মানবিক তাদের জন্য। সমস্যা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কখনই তার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে না। এই অবস্থা আমরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দেখেছি এবং পঞ্চাশ বছর পরে এসে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও দেখছি।

এক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম- নিজের ঘরের সামনে বরফ জমে থাকলেও কোনো খবর থাকে না, অথচ অন্যের ঘরের সামনের কাদা পরিষ্কার নিয়ে যত মাথাব্যথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর বর্তমানে যে অবস্থা তা দেখে আমার সেই বিখ্যাত লেখকের উক্তিটিই মনে পড়ে গেল। সম্প্রতি টেক্সাসের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বন্দুকধারী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৯ শিশুসহ মোট ২১ জনকে হত্যা করেছে। এরকম হৃদয়বিদারক ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড আফ্রিকার কিছু গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছাড়া বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসেবে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছে তা এ ঘটনায় প্রকাশ পেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম গণগোলাগুলি (ম্যাস শুটিং) বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এরকম ঘটনা এখানে মাঝেমধ্যেই, বলা যায় নিয়মিত বিরতি দিয়ে ঘটে। এই স্কুল শুটিংয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক রাজ্যের বাফেলো শহরের একটি শপিং মলে গণগোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানেও দশজন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হন। শুধু তাই নয়, এরকম ভয়াবহ গণ গোলাগুলি ছাড়াও এই সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং বেশ কয়েকজন মারাও গেছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলে এরকম গণগোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল এবং সেখানেও বিশ ছাত্র নিহত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে এরকম বন্দুক নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখানে এমন কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেদিন বন্দুকধারীর গুলিতে কেউ নিহত বা আহত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যেভাবে প্রতিদিন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং বন্দুকধারীর গুলিতে মানুষ মারা যায় তেমনটা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটে কি না আমার জানা নেই।

এসব ভয়াবহ বিশেষকরে ম্যাস শুটিং ঘটনার নেপথ্যের সঠিক কারণ কখনই সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘাতকদের গুলি করে মেরে ফেলে, যাকে আমাদের দেশের ভাষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এই টেক্সাসের স্কুল শুটিং যে বালক ঘটিয়েছে তাকেও পুলিশ আটক না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গুলি করে মেরে ফেলেছে। নভাস্কশিয়ার সেই হত্যাকারী ১৭ বছরের বালককেও পুলিশ আটক না করে গুলি করে মেরে ফেলে। হত্যাকারীকে আটক না করে এভাবে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটে। এছাড়া উপায়ও নেই। কারণ পুলিশ ভালো করেই জানে যে তাদের আটক করে জেলে ভরলে তারা জামিনে বেরিয়ে এসে একই কাণ্ড ঘটাবে।

সবচেয়ে বড় কথা এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো সমালোচনা বা আন্দোলন সংগ্রামও নেই। এক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে কী ভয়ানক আন্দোলন শুরু হয়েছিল কারণ তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আসন্ন ছিল এবং এর পিছনে কিছু ভোটের হিসাবনিকাশ ছিল। এখন ১৯ জন শিশু সন্তানকে এভাবে প্রাণ হারানোর পরেও কোনো আন্দোলন নেই। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা মন্ত্রী বা কোন জনপ্রতিনিধির পদত্যাগের দাবিও নেই। এমনকি এসব লোমহর্ষক গণগোলগুলির পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা নীতিনির্ধারকদের এতটুকু সৎসাহস হয়নি যে এই মুহূর্তে ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য বন্দুক ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। আমাদের দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোর আলোচকরা কী বলবেন জানি না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণগোলাগুলিসহ প্রতিদিনই শুটিংয়ের ঘটনা ঘটছে এবং এসব গোলাগুলির ঘটনায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এসব ঘটনা বন্ধ করতে পারছে না এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে পারছে না তাই তাদের এখন অন্য কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনোরকম মন্তব্য করা শোভা পায় না। যে অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‍্যাবের কয়েক সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেই অবস্থা এখন তার দেশে অতি বেশি মাত্রায় বিরাজমান। তাই তাদের উচিত এই নিষেধাজ্ঞা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া। তাদের বোঝা উচিত এবং বুঝতেও পারছে যে, মানবাধিকার শুধু যারা মানুষ এবং মানবিক তাদের জন্য।

সমস্যা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কখনই তার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে না। এই অবস্থা আমরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দেখেছি এবং পঞ্চাশ বছর পরে এসে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও দেখছি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আমাদের পক্ষে থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং নীতিনির্ধারক আমাদের বিপক্ষে গণহত্যা সংঘটনকারী পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি বন্দুক নিয়ন্ত্রণ (গান কন্ট্রোল) করা অর্থাৎ খেলনা পিস্তলের মতো এভাবে খোলাবাজারে কেনাবেচা এবং সাধারণ মানুষের হাতে বন্দুক রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। মোটকথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ব্যাতিরেকে কোনো সাধারণ নাগরিক বন্দুক কিনতে বা রাখতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশে কেন সাধারণ নাগরিকের ব্যাক্তিগতভাবে বন্দুক রাখার সুযোগ থাকবে?

লেখক: ব্যাংকার-কলাম লেখক। টরনটো, কানাডা-প্রবাসী

[email protected]

আরও পড়ুন:
র‍্যাবকে মারধর: এখনও অস্বাভাবিক সেই বাজার
র‌্যাবকে মারধর: ৩ দিন পর ৩ মামলা
চাঁদাবাজ-ছিনতাই: চক্রের ২৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার র‌্যাবের
র‍্যাবের ওপর হামলায় আটক ১৩
র‍্যাবের ওপর হামলায় হয়নি মামলা

মন্তব্য

p
উপরে