প্রবাস বলতে বোঝায় নিজ দেশের বাইরে অন্য কোথাও বসবাস। দূর এবং অপরের দেশে বসবাস বলেই এর আরেক অর্থ ‘নির্বাসন’। পাণ্ডব জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, অপ্রবাসী ও অঋণী হয়ে দিনশেষে যে শাকান্ন ভক্ষণ করতে পারে সেই সুখী। যুধিষ্ঠিরের সংজ্ঞায় পৃথিবীতে আর যেখানেই হোক প্রবাসে সুখ নেই, আছে কেবল দুঃখ, বেদনা, হাহাকার।
প্রবাসে সুখ নেই, তবু লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যায়। চাঁদপুরের আবু সুফিয়ান (কল্পনাম) হাড়কাঁপানো ঠান্ডা উপেক্ষা করে পার হয় ইউরোপের গহিন অরণ্য, জীবনের মায়া তুচ্ছ করে পাড়ি দেয় দুস্তর পারাবার কিংবা কিশোরগঞ্জের সুফিয়া (কল্পনাম) ঘরবাড়ি সহায়সম্বল বেচে উড়াল দেয় মধ্যপ্রাচ্যে।
অর্থনীতিবিদেরা হয়তো যুধিষ্ঠিরের উল্টোটাই বলবেন। বলবেন, জীবন মানের উন্নয়ন, বেশি আয়, সুখ-স্বাছন্দ্যপূর্ণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন তাদের টেনে নিয়ে যায় দূর কোনো পরবাসে। তবে সুখের লাগিই হোক আর নাই হোক, সীমানা পাড়ি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশি হয়ে যায় বিদেশি, গায়ে লেগে যায় ‘প্রবাসী’ তকমা। স্বদেশি-প্রবাসী ইত্যাদি ভাগাভাগিতে সামনে দাঁড়িয়ে যায় বিভাজনের দেয়াল।
তুলনামূলক আলোচনায় দেশি বাংলাদেশি অনেকটাই ‘খাঁটি’ বাংলাদেশি, প্রবাসীরা যেন একটু ‘কম দেশি’, তাদের দেশপ্রেমও একটু ‘কম কম’; তাই তারা দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বসবাস করতে যায়।
দেশপ্রেম প্রমাণের জোরাল একটি শর্ত হলো, দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থান করা। এই সরলরৈখিক ভাবনায় দেশকে ভালোবাসা এবং দেশে থাকা মোটামুটিভাবে সমার্থক। ফলে বিদেশি বিদ্যা ও কর্ম সম্পাদনের পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে মহিমান্বিত করতে দেখা যায় অহরহ। এবং যারা প্রবাসে বসবাসের সুযোগ ও কাজের মোহ ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে পারে তারা নির্লোভ দেশপ্রেমিক, এই ভাবনাটিও সর্বজনসিদ্ধ।
প্রবাসী এক অর্থে তাই লোভী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ফলে প্রবাসে থেকে দেশের ইস্যু নিয়ে ভালো-মন্দ যাই বলুন হা রে রে করে তেড়ে আসবেন আপনার চেনাপরিচিতরা। যেমন: আপনি বললেন ঢাকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছে, মানুষ কীভাবে যে বাঁচে! অমনি আপনার ঠোঁটকাটা বন্ধু বলে উঠবে, ‘নিরাপদ দূরত্বে থেকে এসব বলাই যায়।’
আপনি বললেন, আহা একদিনে সড়কে এত মৃত্যু! কেউ তো একটু নিয়মকানুন মেনে চলে না। আর রাস্তাঘাটও যে বেহাল। তখনই আপনাকে হকচকিত করে দিয়ে আপনারই বন্ধু বলে উঠবে, ‘অন্যের দেশে থেকে সুন্দর সুন্দর রাস্তায় গাড়ি চালাও, ঘুরে বেড়াও তাই দেশকে নিয়ে এভাবে বলতে পার। কাঁচা হোক তবু ভাই নিজের রাস্তা।’
আপনি প্রবাসে থাকেন তাই আপনার দেশপ্রেম মুহুর্মুহু সন্দেহ বাতিকতার শিকার হবে। ফলে প্রবাসীর ‘কমদেশি’ দোষমুক্ত থাকার জন্য শব্দচয়নেও অনেক সাবধানি হতে হয়, কেননা পান থেকে চুন খসলেই কবি আব্দুল হাকিমের পরবর্তী প্রজন্ম এসে শোনাতে থাকে:
যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহারো জন্ম নির্ণয় ন জানি ।।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
কবি যেন রীতিমতো হুমকি দিলেন, ‘থাক তোমরা বিদেশেই, তোমাদের জন্য বিদেশই ভালো।’ অথচ একই মন্তব্য আপনি বাংলাদেশে বসে করবেন তাতে আপনার দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
প্রবাসীর জন্য চারদিকে আছে ‘সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা।’ বাচ্চা ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে কেন? বাচ্চা ভাত না খেয়ে বার্গার পছন্দ করে কেন? তুমি সালোয়ার-কামিজ পর না কেন? পরলে কেউ কি মানা করবে? সাদাদের সঙ্গে মিশতে যেও না যেন! সাদাদের সঙ্গে বাচ্চাকে মিশতে দিও না। বড়জোর অন্য এশিয়ানদের সঙ্গে মিশতে দিও। সাদাদের সঙ্গে মিশতে দিলে সব শেষ। ধর্মকর্ম কিছুই হবে না, আর বাবা-মাকে ফিরেও দেখবে না। এমনভাবে আপনার দিকে এসব মন্তব্য আসতে থাকবে যেন বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহ ধার্মিক সন্তান-সন্ততিতে পূর্ণ এবং তারা পিতামাতার একান্ত বাধ্য ও অনুগত।
উপরিউক্ত মন্তব্যের পেছনে যে ধারণা কাজ করে তা হলো, ‘বাংলাদেশি সংস্কৃতি ধরে রাখা।’
প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশি সংস্কৃতি আসলে কী? অখণ্ড কোনো সংস্কৃতি কি বাংলাদেশে আছে? কেউ কি তা দাবি করতে পারে?
অখণ্ড ‘বাংলাদেশিত্ব’ বলে কোনো কিছু না থাকলেও প্রবাসীকে নিতে হয় নানাবিধ চাপ। প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয়ের নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কেননা, আপনার হৃদয়, মগজ, আচরণ, অভ্যাস, জীবণাচরণজুড়ে একদিকে আছে জন্মভূমির প্রভাব, আবার অন্যদিকে আছে আপনার অর্জিত বৈশ্বিক জ্ঞান, সংস্কৃতি ও বোঝাপড়া। প্রবাসী পরিচয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া খুব সহজসরল বিষয় নয় বরং জটিল।
আত্মপরিচয়ের সংকট প্রবাসীর বহুবিধ। আপনাকে একনজর দেখেই (গায়ের রং) লোকে বলে দেবে আপনি ভারতীয়। তারা একই সঙ্গে বর্ণ ও জাতীয়তা- এ দুটো বিষয় নির্ধারণ করে। আপনি মাথা নেড়ে জানালেন যে আপনি আসলে বাংলাদেশি, ভারতীয় নন। বাংলাদেশে আগে ভ্রমণ করেছে এমন কারও সঙ্গে যদি কথা হয় তাহলে তাদের কাছে আপনার পরিচিতি হবে আপনি একটি গরিব দেশ থেকে প্রবাসী হয়েছেন।
কেউ কেউ বৈশ্বিক বিভাজনের লেন্স লাগিয়ে আপনাকে দেখবে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে। অন্যদিকে, আপনার বন্ধু মেসেঞ্জারে লিখে বসবে, ‘কী খবর প্রথম বিশ্বে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক?’ অথচ আপনি তখন বিশ্ব বাজারে আপনার অবস্থান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। দুই-চারজন এই বাহাসে তাল ঠুকবে, ‘প্রবাসেই শান্তি। রাজনৈতিক হানাহানি নেই। রাস্তায় বের হলে মরে পড়ে থাকার আশঙ্কা নেই। নিজের বাড়ি রাত পোহালে বেহাত হবার ভয় নেই।’
বন্ধুরা এসব বলেই খালাস অথচ আপনি মাঝবয়সে বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে অর্জিত একটা চাকরি ও সামাজিক অবস্থান ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রবাসে এক একটি দিন পার করছেন আর ভাবছেন ‘কতদূর আর কতদূর…?’
চেনাপরিচিতদের দেশের প্রতি মায়া-মমতা-প্রেম নিয়ে বরং টানাপোড়েন হয় আমার। এই দেশপ্রেমিকেরা ‘প্রথম বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক’ বলে প্রবাসে বসবাসকারীদের গায়ে রং চাপান ঠিকই, কিন্তু নিজ দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তৃতীয়, চতুর্থ অথবা শ্রেণিগোত্রহীন নাগরিক হয়ে পড়ার ব্যাপারে কোনো খোঁজখবরই রাখেন না কিংবা খোঁজখবর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।
বাংলাদেশে শ্রেণি ক্রমোচ্চতার যে চিন্তা ও চর্চা পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে গভীরভাবে প্রোথিত সেসব নিয়েও তারা কখনও কোথাও প্রশ্ন তোলেন না। সবার সম্মিলিত উন্নাসিকতা ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণি-গোত্র-জাতিকে অদৃশ্য করে দিচ্ছে, ‘উপজাতি’ করে তুলছে এবং বাদপড়াদের কাতারে ফেলে দিচ্ছে, কিন্তু সেসব নিয়েও তাদের ভাববার অবকাশ হয় না।
কিছুদিন আগে এক নারী চিকিৎসক যখন একজন নরসুন্দরকে বিয়ে করলেন তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এক কর্তা বলে দিলেন, ‘এ হতে পারে না।’
কেন হতে পারে না, কারণ সামাজিক অবস্থানের পাল্লায় এ দুই ব্যক্তি অসম। তবে কী হতে পারে? দিনদুপুরে ধর্ষণ, সেটির ভিডিও ধারণ, সেই ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেয়া এবং এসবের অভিঘাতে কোনো নারীর আত্মহত্যা?
অল্প কিছুদিন আগে ভাড়া না থাকার কারণে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারীকে বাস থেকে ফেলে দেন চালক ও হেলপার। বাসাবাড়িতে, স্কুল-কলেজে, মাদ্রাসায় শিশুদের মারধর-খুন-ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা। আদিবাসী নারী অপহরণ, ধর্ষণ অথবা তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ অনাদিকালের চর্চা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
অল্প কিছু চেনাপরিচিত ছাড়া কাউকেই প্রশ্ন রাখতে দেখি না কেন আমার দেশের নারী, শিশু, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ নিজ রাষ্ট্রে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে না? কেন আমাদের রাষ্ট্র সবার বসবাসের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে না? অথচ রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানেরই একমাত্র সামর্থ্য ও এখতিয়ার আছে সবার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে সংঘবদ্ধ রাখার। তা কি হচ্ছে? যে দেশে বিদ্যাধারী বঙ্গ পণ্ডিতেরা দলবাজি ও দুর্নীতির অনন্য নজির রেখে চলেছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক মতপ্রকাশের দায়ে রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়ে জীবন হারাচ্ছেন, সেই দেশে প্রতিদিন কত মানুষ নিজভূমে পরবাসী হয় তা দৃষ্টিগোচর না হলেও অননুমেয় নয়।
দেশ ও প্রবাস নিয়ে যে ভাগাভাগি তা মূলত ইনসাইডার ও আউটসাইডার- এই দ্বৈত বিভাজনকে ধারণ করে। এটি সাধারণভাবে স্থান ও পরিসরকেন্দ্রিক হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সূক্ষ্ম অথচ গভীর কিছু বিষয়। বিভাজন/বিভাজিতের বৈশ্বিক সম্পর্ক। উত্তর-দক্ষিণ, উন্নত-অনুন্নত-উন্নয়নশীল প্রভৃতি বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত থাকে সীমানা, ভূমি, নিরাপত্তার ধারণা, প্রবেশের অনুমোদন ইত্যাদি গুঢ় কিছু বিষয়।
আমাদের ইনসাইডার চোখ বিদেশি, প্রবাসীকে মাপতে শুরু করে নানান গজ-ফিতায়, আর নিভৃতে বুনতে থাকে বিভাজনের দেয়াল। এই ভাবনায় এক পাশে থাকে ‘ক্ষমতাধর’ রাষ্ট্র, যারা তাদের নাগরিকদের ‘নিরাপত্তা’ দিতে সচেষ্ট এবং অন্য পাশে থাকে ‘ক্ষমতাহীন’ রাষ্ট্র, যাদের নাগরিকের নিরাপত্তা অনেকটাই নাজুক।
তবে এসব অদৃশ্য ভাগাভাগি একই সঙ্গে বহুবিধ, অন্তঃপ্রবিষ্ট ও সংযুক্ত। সীমানা, বৈশ্বিক রাজনীতি, (ভাষা, জাতীয়তা, গায়ের রং এর ভিত্তিতে), জ্ঞান, ক্ষমতা প্রভৃতি প্রবাস ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একে ‘দুষ্প্রাপ্য’ ও ‘অমূল্য’ করে তোলে। যেখানে প্রবাস একইসঙ্গে অথরিটেটিভ ও পরাক্রমশালী। এখানে প্রবেশ, বসবাস, ও অনুপ্রবেশ সবই কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত।
দেশ বনাম প্রবাস এ রকম বিভাজন করতে চাওয়া বৈশ্বিক সংযুক্ততার এই সময়ে খানিকটা বরং বিড়ম্বনারও। কেননা, আবু সুফিয়ান যখন পশ্চিমে বসে কোনো এক বরফঢাকা সকালে চা খেতে খেতে চাঁদপুরে পদ্মার ভাঙন দেখেন, আপনি হয়তো তখন বন্ধুদের নিয়ে ঘুরছেন সাজেকের পাহাড়ে। যখনকার ঘটনা তখনই জানুন সংবাদ ও মিডিয়া সেকেন্ডে সেকেন্ডে উপস্থাপন করছে খবরের নানা দিক। ধুন্ধুমার ফলো ও সাবক্রিপশনের এই সময়ে আপনার আগেই প্রবাসী সুফিয়ান জেনে যেতে পারেন তার জন্মভূমিতে কী ঘটে চলেছে। সুফিয়ান হয়তো বন্ধুবান্ধবের কাছে থেকে কিছু অর্থকড়ি জোগাড় করে দেশে পাঠিয়েও দিলেন, কিন্তু আপনি দেশের আরও দশটি নদীভাঙনের মতো একে নিয়মিত ঘটনা হিসাবে দেখে একে পাশ কাটিয়ে সাজেক থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেন।
এ-বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন দেশ-বিদেশ সবই অন্তঃপ্রবিষ্ট নয় কি? বিভাজনের দেয়াল ঠেলে যত দূরে ঠেলতে চান, দেয়াল আরও শক্তিধর হয়ে উঠবে শুধু। কেননা, কেবল পরিসরের বিভাজন হিসেবে দেশ ও প্রবাসকে দেখলে আর চলে না। অন্যতার বোধ, রাজনীতি ও মতাদর্শ প্রভৃতি বিষয়-আশয় এর সঙ্গে ভীষণভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং দেশ, বিদেশ, প্রবাস ধারণাকে সম্পর্কিত ও আকৃতি দান করে।
এ-বিশ্ব সব মানবের। এর যে কোনো স্থানেই তো আমার-আপনার বসবাসের অধিকার থাকার কথা। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, জাতীয়তাবোধ আমাদের সেই অধিকারকে বরং হরণ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস বদলে গেছে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনাকে পুঁজি করে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দেশ, সীমানা, পরিচিতি। ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে অখণ্ড ভূমি, আকাশ, জল হয়েছে বিভাজিত। ‘আমার সোনার বাংলা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন বাংলার রূপ বুকে ধারণ করে লিখলেন? অখণ্ড উপমহাদেশের, নাকি জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত বাংলার? অথচ পৃথিবীর যেকোনো কোণে বসে সবাই গেয়ে উঠি ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’
এ বিশ্বের সব সত্তা একে অপরের পরিপূরক। দেশের গুরুত্ব বিদেশের চেয়ে কম নয়, নারীর গুরুত্ব পুরুষের চেয়ে কম নয়। আদিবাসীর গুরুত্ব সমতলের বাসিন্দার চেয়ে কম নয়। কি দেশি, কি প্রবাসী সবাই যার যার মতো করে জীবন পরিচালনায় নিয়োজিত।
বিভাজনের দৃষ্টি সরিয়ে আসুন বরং জীবন দেখি। সাদা-কালো, নীল-বেগুনি, সস্তা-দামি, আসল-নকল, অমূল্য সব জীবন। দেশ কিংবা প্রবাস সেই নানান রঙের জীবনের এক একটি রংমাত্র। যে রং আপনার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে একটু একটু করে আরও সমৃদ্ধ করবে। সন্দেহ নেই।
নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক
আরও পড়ুন:সফলভাবে সম্পন্ন হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা অর্জনের সাথে সাথে প্রবাসীদের সমৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধি, কনটেন্ট ক্রিয়েটরস, ব্যবসায়ী এবং মিডিয়া প্রফেশনালসদের এর সমন্বয়ে এক জমকালো আয়োজন। প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় সোস্যাল কমিউনিটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা বাংলানেক্সট এর বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে আয়োজনটি ছিল ‘মাটির টানে রঙের বৈশাখ’।
পহেলা বৈশাখ সন্ধ্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে ‘সেভেন সিস’ পাঁচ তারকা হোটেলে এক অনাড়ম্বর আয়োজনে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আরাব খান, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো. আলী আকবর আশা, প্রতিষ্ঠাতা কার্যনির্বাহী সদস্যগণ, আগত বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষজন ও গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে ৫০০ ও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির অংশগ্রহণ করেন।
ইভেন্টে বৈশাখী খাবার, আন্তর্জাতিক বুফে, লোকনৃত্য ও সংগীত, সম্মাননা প্রদান, সরাসরি আলাপচারিতা, মিডিয়া সংযোগসহ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিলো এক উৎসবমুখর পরিবেশে অনবদ্য পারফরম্যান্স এবং পরে উপস্থিত গণ্যমান্য সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। কমিউনিটির পক্ষে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ ও গণ্যমান্য সকলের উপস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই কমিটিতে সভাপতি আরব খান, সহ-সভাপতি শেখ রায়হান আব্দুল্লাহ, সহ-সভাপতি বাঁধন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মো. আলী একবার আশা, সহ- সাধারণ সম্পাদক মামুন ইসলাম, কোষাদক্ষ রাসেল রেজা, সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল আকন্দ, সি. সহ-সভাপতি ও প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শরীফুজ্জামান, নারী বিষয়ক সম্পাদক ফারহানা আফরিন ঐশী, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শুভ চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল ইসলাম শাওন।
প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের ভোগান্তি নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই অসংখ্য স্বপ্ন ঝরে পড়ে শুধু সময়মতো বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে। তবে বর্তমানে ঘরে বসেই কোনো প্রকার ভ্রমণ ও বাড়তি খরচ ছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রবাসীরা নিতে পারবেন এই বহির্গমন ছাড়পত্র।
২০২৩ সাল থেকে এমন সেবাই দিয়ে আসছে বিশ্বের একমাত্র ওয়ান স্টপ অভিবাসন সেবা প্রদানকারী অ্যাপ ‘আমি প্রবাসী’। চলুন জেনে নিই, কীভাবে বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্রের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন ঘরে বসেই।
ক্লিয়ারেন্সের আবেদন করার জন্য প্রথমে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন ও প্রাক বহির্গমন ওরিয়েন্টেশন (পিডিও) কোর্স সম্পন্ন করতে হবে আগ্রহী প্রার্থীকে। এরপর তিনি ‘আমি প্রবাসী অ্যাপ থেকে সরাসরি বহির্গমন ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন। আর রিক্রুটিং এজেন্সির (RA) মাধ্যমে আবেদন করলে তারা নিজস্ব পোর্টাল থেকে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করবে।
বহির্গমন ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে হলে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, প্রাক বহির্গমন সার্টিফিকেট বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, পাসপোর্ট, ভিসা, ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে করা চুক্তিপত্র, নারীদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট দেশে গমনের ক্ষেত্রে স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতিপত্র (স্ট্যাম্প পেপারে), ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র, ওয়ান স্টপ ফরম (শুধু ওয়ান স্টপ সেবা গ্রহণকারী প্রার্থীদের জন্য), মেডিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট, নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত কিছু নথিপত্র এবং চাকরির চুক্তিপত্র (শুধু রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য প্রযোজ্য) জমা দিতে হবে।
ঘরে বসে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাইলে প্রথমেই প্রার্থীদের আবেদন ফি বাবদ ৫০ টাকা দিতে হয়। এরপর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে ইন্টারভিউর জন্য বিএমইটি অফিসে উপস্থিত হতে হয়। আবেদন জমা দেওয়ার পর এটি বিএমইটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে পর্যায়ক্রমে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
ওয়ান স্টপ সেবা গ্রহণকারী বা নিজ উদ্যোগে আবেদন করা প্রার্থীদের আবেদন চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে সরকারি ফি ও আবেদন চার্জ পরিশোধ করতে হয় তাদের। পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর ব্যক্তি কিংবা রিক্রুটিং এজেন্সি উভয়েই বিএমইটি স্মার্ট বহির্গমন ছাড়পত্র কার্ড ডাউনলোড করতে পারেন।
আরও পড়ুন:বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পাশাপাশি আরও বাংলাদেশি কর্মী নিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আমিরাতের দুবাইয়ে দুই দিনব্যাপী ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিটে অংশগ্রহণের পাশাপাশি দেশটির বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ আহ্বান জানান।
বৈঠকগুলোতে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়, বাণিজ্য ও ব্যবসার সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে আমিরাতি বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ক্রীড়া ও শিক্ষা খাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
তিনি জানান, আমিরাতি কোম্পানিগুলোকে তাদের কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তরের আমন্ত্রণ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জেয়ৌদি এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলে ড. ইউনূস আমিরাতি ব্যবসার জন্য বিশেষ শিল্প পার্ক স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান আমিরাতের বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে একটি ‘হালাল পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, যেখানে কম খরচে শ্রম সুবিধা পাওয়া যাবে।
এরপর আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফর করতে চান বলে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান আমিরাতের বাণিজ্যমন্ত্রী।
প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী ও জ্যেষ্ঠ সচিব লামিয়া মোরশেদ।
ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিটে অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস।
দুবাই বিমানবন্দরে শুক্রবার তাকে বিদায় জানান সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রীড়ামন্ত্রী ড. আহমদ বেলহৌল আল ফালাসি।
আরও পড়ুন:প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে শ্রম ও অভিবাসন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও জোরদার করা হবে।
ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ড. আসিফ নজরুল সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ড. আবদুল্লাহ আবুথনাইন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ড. নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদের সঙ্গে রিয়াদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উল্লিখিত কথা বলেন।
বৈঠকগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা, শ্রম বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মীদের অধিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
ড. আসিফ নজরুল সৌদি আরবে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে সুযোগ দেওয়ার জন্য সৌদি সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি সৌদি কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং কিছু নির্দিষ্ট কেন্দ্রকে (টিটিসি) দক্ষতা স্বীকৃতি দিতে বিবেচনার আহ্বান জানান।
সৌদি পক্ষ এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং সম্ভাব্য টিটিসি মূল্যায়নের সম্মতি জানায়।
বৈঠকে মূলত উচ্চ ইকামা নবায়ন ফি এবং এর ফলে কর্মীদের চাকরিহীন হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।
সৌদি পক্ষ জানায়, শ্রম আইন সংস্কার করা হচ্ছে, যাতে উভয় পক্ষের অধিকার সংরক্ষিত হয়। এ ছাড়া কর্মীরা যাতে বাংলাদেশ থেকে রওনা হওয়ার আগে তাদের নিয়োগ চুক্তি নিশ্চিতভাবে পায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়।
এ ছাড়াও ঢাকায় সৌদি দূতাবাসে পেশাদার সার্টিফিকেট সত্যায়ন সংক্রান্ত সমস্যা উত্থাপন করা হয়। কালচারাল অ্যাটাচের অনুপস্থিতির কারণে এই প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে, তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকার সৌদি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায়। এৎই সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে বলে নিশ্চিত করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
সৌদি কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ শ্রমিক সমস্যা এবং নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম দূর করতে শিগগিরই একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি যৌথ টিম গঠনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়।
বৈঠকে গৃহকর্মী প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে বাংলাদেশ প্রশিক্ষণের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করে গুণগত মান উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ড. নজরুল সৌদি আরবের মেগা প্রকল্পগুলোতে আরও দক্ষ কর্মী নিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেন এবং সৌদি ভাইস মিনিস্টারকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ড. নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদের সঙ্গে পৃথক এক বৈঠকে বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের মধ্যে নিরাপত্তা ও অভিবাসন সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ সৌদি আরবে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করায় সৌদি সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে।
বৈঠকে অনিয়মিত অভিবাসন রোধ এবং বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া উন্নত করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
উপদেষ্টা অনিয়মিত অভিবাসীদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে সৌদি সরকারের সহায়তা চেয়ে অনুরোধ জানান। সৌদি ভাইস মিনিস্টার বিষয়টি পর্যালোচনার আশ্বাস দেন।
আরও পড়ুন:প্রতি বছর হাজারো বাংলাদেশি উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে অভিবাসন করেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময়ই কঠিন।
প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি এবং প্রশিক্ষণের অভাব বাংলাদেশি শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে টিকে থাকার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বপ্ন ও বাস্তবতা
নোয়াখালীর ৩০ বছর বয়সী যুবক রফিক সৌদি আরবে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে গিয়েছিলেন পরিবারের জন্য ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন। প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার অভাবে অন্যান্য দেশের সহকর্মীদের তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে হতো তাকে।
রফিক বলেন, ‘একই কাজ করলেও আমার সহকর্মীরা আমার প্রায় দ্বিগুণ বেতন পেত। আমি অধিকাংশ মেশিন পরিচালনার নিয়ম জানতাম না, যা আমার কাজের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা তৈরি করেছিল।’
বরিশালের ২৮ বছর বয়সী নারী সালমা মালয়েশিয়ায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যে বাড়িতে কাজ করতাম, সেখানে তারা আধুনিক গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রত্যাশা করত। কিন্তু আমি আগে কখনও এসব ব্যবহার করিনি।’
সালমা জানান, প্রায়ই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে হতো তাকে। যেখানে ফিলিপাইনের গৃহকর্মীরা উচ্চ বেতন পেত, সেখানে সালমা অনেক কম বেতনে কাজ করতেন।
ঢাকার বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী রনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি দোকানে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লক্ষ করেন, তার সহকর্মীরা তার তুলনায় অনেক দক্ষ।
রনি বলেন, ‘আমার পাকিস্তান ও ভারতের সহকর্মীরা দ্রুত কাজ শেষ করে ফেলত। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ, বিক্রয়, নগদ লেনদেন এবং দোকান ব্যবস্থাপনায় অনেক দক্ষ ছিল, যেখানে আমাকে সব কাজ হাতে-কলমে করতে হতো।’
দক্ষতার ঘাটতির প্রভাব
বিদেশে অবস্থানরত হাজারো বাংলাদেশি কর্মীর বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলে উল্লিখিত গল্পগুলো। প্রতি বছর অসংখ্য বাংলাদেশি অভিবাসী দক্ষতার অভাবে চাকরি হারান, ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান জনশক্তি রপ্তানিকারক হলেও দক্ষতার ঘাটতি একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। অনেক বাংলাদেশি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না নিয়েই যাত্রা করেন বিদেশে।
দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশি অভিবাসীরা অধিক পারিশ্রমিক পেতে পারেন, যা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০২৪ সালের বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন ও ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীরা গড়ে প্রতি মাসে ২০৩.৩৩ ডলার আয় করেন, যেখানে ফিলিপাইনের কর্মীরা ৫৬৪.১ ডলার, ভারতীয় কর্মীরা ৩৯৫.৭১ ডলার, পাকিস্তানি কর্মীরা ২৭৫.৭৪ ডলার এবং চীনা কর্মীরা ৫৩২.৭১ ডলার আয় করেন।
এ ছাড়াও ৬০ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী স্বল্প দক্ষতার কাজ করে থাকেন, যা অন্যান্য দেশের দক্ষ কর্মীদের তুলনায় তাদের আয় কমিয়ে দেয়।
দক্ষতা উন্নয়নের পথ
বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল অভিবাসন প্ল্যাটফর্ম ‘আমি প্রবাসী’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এরই মধ্যে সাড়ে তিন লাখের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে শুধু ২০২৪ সালেই ১ লাখের বেশি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
‘আমি প্রবাসী’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক ই. হক বলেন, ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম চালিকা শক্তি হলো অভিবাসন খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু নভেম্বর মাসেই আমরা ২.১৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছি, যা বার্ষিক ১৩.৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
‘যদি আমরা দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াতে পারি, তাহলে এই আয় সহজেই দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে। আমরা শুরু থেকেই এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি এবং অভিবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছি।’
প্রশিক্ষণের প্রভাব
‘আমি প্রবাসী’র বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ড্রাইভিং, কম্পিউটার অপারেশন এবং গৃহপরিচারিকার কাজ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশিক্ষণ কোর্স। ২০২৪ সালে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৭ হাজার ৭৯৯ জন। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৬ হাজার ৭৩২ জন এবং গৃহকর্মীর কাজ শিখেছেন ৯ হাজার ৩২৩ জন।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে সফল হওয়ার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং অভিবাসীদের নিজেদের সহযোগিতায় এ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সম্ভব।
দক্ষতার ঘাটতি পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আরও সম্মানজনক স্থান অর্জন করতে পারে এবং রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
আরও পড়ুন:যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত অবৈধ অভিবাসনবিরোধী আইনে অনুমোদন দিয়েছে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস।
সন্দেহভাজন বিদেশি অপরাধীদের বিচারপূর্ব কারাবাসের মেয়াদ বাড়ানোর একটি বিলও অনুমোদন করেছে কংগ্রেস।
আইনসভা কংগ্রেসের অনুমোদন লাভের পর সিনেটে ৬৫-৪৫ ভোটে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী আইনটি সহজেই পাস হয়।
ওয়াশিংটন থেকে এএফপি বৃহস্পতিবার এ খবর জানায়।
এদিকে দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানায়, কংগ্রেসের অনুমোদন লাভের পর অবৈধ অভিবাসীবিরোধী ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চার বাংলাদেশিসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত কারও কাছেই বৈধ কাগজপত্র ছিল না। এদের মধ্যে একজন এথেন্সের ও অন্যজন ভেনেজুয়েলার নাগরিক। তারা দুজনই খুনের মামলার আসামি।
প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন এক এক্স বার্তায় বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসীদের অবশ্যই আটক করা হবে এবং তাদের কখনও আমাদের দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
মাইক জনসন বলেন, ‘আমেরিকানরা নিরাপত্তা দাবি করে এবং নিরাপত্তা দাবির অধিকারও তাদের রয়েছে।’
নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন বরোর ফুলটন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার বাংলাদেশিকে।
অভিবাসী ধরপাকড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে স্কুল-গির্জা-হাসপাতালেও।
সংবেদনশীল এসব স্থানে অভিবাসী আটক কার্যক্রমের ওপর থেকে এক দশকের বেশি সময়ের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে ট্রাম্প প্রশাসন। এতে সেসব স্থানে ধরপাকড়ে আর কোনো বাধা নেই। এ সিদ্ধান্তে আতঙ্কিত অভিবাসীরা।
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কালবিলম্ব করেননি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
শপথ নিয়েই শক্ত হাতে অবৈধ অভিবাসী দমন শুরু করেছেন তিনি।
ধরপাকড় শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নানা অঙ্গরাজ্যে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এর মধ্যে চার বাংলাদেশিও রয়েছেন ।
নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন বরোর ফুলটন এলাকা থেকে ওই চার বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্ট (আইস)।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পরিচয়পত্র দেখাতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাদের গ্রেপ্তার করে সাদা পোশাকের পুলিশ। এ ঘটনার পর বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার সড়ক ও রেস্তোরাঁয় লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। চরম আতঙ্কে রয়েছেন বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা।
এদিকে এখন থেকে স্কুল, গির্জা এমনকি হাসপাতালগুলোতেও অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
আইস এবং কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন সংস্থাগুলোর ওপর গেল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এসব স্থানে অভিযান পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটির পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা বাতিল করাসহ জারি করা হয় নতুন নির্দেশনা।
এতে বলা হয়, স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে যাতে কেউ লুকিয়ে না থাকতে পারে, তাই এ নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়।
অপর নির্দেশনায় বলা হয়, বৈধ কাগজপত্র না থাকা কেউ গ্রেপ্তার হলে সেই ব্যক্তি যদি যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছরের বেশি সময় ধরে তার অবস্থান করার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাকে দ্রুতই দেশ থেকে বের করে দিতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়ার ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করেছেন আইনজীবীরা।
সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড সোশ্যাল পলিসি এক বিবৃতিতে জানায়, এ পদক্ষেপের কারণে অভিবাসীদের পরিবার ও তাদের সন্তানের পাশাপাশি আমেরিকান শিশুরাও মারাত্মক মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে।
এরই মধ্যে মেক্সিকো সীমান্তে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। নিশ্চিত করা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এ আদেশের আওতায় অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার একটি প্রকল্পও বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীরা।
আরও পড়ুন:যুদ্ধবিধস্ত লেবানন থেকে দেশে ফিরেছেন আরও ৪৭ বাংলাদেশি।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুক্রবার রাত সোয়া ৯টার দিকে পৌঁছান তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
ফেরত আসা এসব নাগরিককে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইওএম কর্মকর্তারা।
আইওএমের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা পকেটমানি, কিছু খাদ্যসামগ্রী ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
বিমানবন্দরে ফিরে আসা বাংলাদেশিদের খোঁজ নেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এখন পর্যন্ত একজন বাংলাদেশি বোমা হামলায় নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
এ পর্যন্ত ১৯ ফ্লাইটে ১ হাজার ২৪৬ বাংলাদেশিকে লেবানন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা হয়।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য