অনেকে বলে থাকেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলবন্দি হয়ে ফরিদপুরে ছিলেন। ফলে, এই আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল না। যারা এহেন কথা বলে থাকেন, তাদের বক্তব্যে তথ্য ও যুক্তি নেই। কারণ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু কিছু মুহূর্তের ব্যাপার নয়। এর ছিল প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা। এই প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা বিচার করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান স্থপতি বলতে হয়।
বাঙালির আত্মশক্তির উত্থান দেখা গিয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রকাশ্যে আন্দোলন করে শহিদ হওয়ার পূর্বদৃষ্টান্ত আর নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে অন্তরীণ নিশ্চয়। একুশের ঘটনা স্মরণ করে জেলখানাতে বসে তিনি লিখেছেন:
“মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।’ (রহমান, ২০১২ : ২০৪) ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এভাবেই একুশের রক্তদান এবং এই রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জেলে বসে (১৯৬৬) সেই আন্দোলনের পরিণাম নিয়ে রাজনৈতিক গ্রন্থরচনা, কম সাহসের কথা নয়। এই সাহস বঙ্গবন্ধু নিজে লালন করতেন এবং তা বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে তিনি পেরেছিলেন।
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এক দিনের নয়। ছাত্ররাজনীতিতে যখন তিনি ছিলেন, আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতিতে যখন তিনি যুক্ত, স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন তিনি- সব সময়ই ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি উন্নত ভাবনা ভেবেছেন এবং তা কার্যকরের ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এই ভাবনার ধারাবাহিকতা আছে।
১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয় নিশ্চয়। কিন্তু এতেই তুষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৬ সালের ৮ জুন, বুধবার জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শহিদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে প্রার্থনা করেন এবং অন্তরের মণিকোঠায় নেন সুদৃঢ় সংগ্রামের শপথ। ‘কারাগারের রোজনামচায়’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি [বঙ্গবন্ধু] আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।” (রহমান, ২০১৭ : ৭৩-৭৪) এই প্রতিজ্ঞা বঙ্গবন্ধু শেষপর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন এবং সে কারণেই বাঙালি পেয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় যুবলীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং সেখানে ভাষা-বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক লিখেছেন-
“সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫) কী ছিল সেই প্রস্তাবে? গাজীউল হক বঙ্গবন্ধুর সে বচন উল্লেখ করে লিখেছেন:
“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫)
এই দাবি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু সরকারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“ফেব্রুয়ারি ৮ হবে, ১৯৪৮ সাল। করচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য [তখন ‘জাতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল ছিল; তিনি সেই দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।] বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।” (রহমান, ২০১২ : ৯১)
আদতে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংসদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও তার পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৌহিত্রী আরমা দত্ত লিখেছেন-
“একদিন দাদু [ধীরেন্দ্রনাথ] আর দিলীপ কাকুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের জীবনে সে এক অমাবস্যার কাল। [...] পরবর্তীকালে ময়নামতি সেনানিবাসের তৎকালীন বেসামরিক কর্মচারী রমণীমোহন শীলসহ অন্যদের স্মৃতিচারণা থেকে জেনেছি, কী নির্মম নির্যাতন চলেছে তখন দাদুর ওপর। দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু দিলীপ দত্তের লাশ আমরা পাইনি।” (ইসলাম, ২০১৩ : ৬১৩) এভাবেই পাকিস্তানিরা তাদের শত্রুকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনও তার একটি।
মূলত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছড়িয়ে পড়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি এবং সে-সূত্রেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে। তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় এই পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিতকুমার গুহ প্রমুখ। সভায় পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আলোচনা করে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনের স্বার্থেই গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাস বা হোস্টেলগুলোর সংসদ ইত্যাদি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ওই দিন পূর্ববাংলায় সফল হরতাল পালিত হয় আর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে এভাবেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ঘটে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল প্রথম হরতল। হরতালে বিক্ষোভ দেখানোর সময় সচিবালয়ের প্রথম প্রবেশদ্বার বা গেইটে পিকেটিংয়ে অংশ নেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ, দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারে অন্যরা। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সূচনা করতে গিয়ে পুলিশ ও শাসক দলের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে বহু আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা আহত এবং অনেক ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন চরমে ওঠে। ফলে ১৫ মার্চও হরতাল পালিত হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বিবেচনা করে ওই দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের নির্বাচিত প্রতিনিধি কমরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর চুক্তি! একটি অভাবিত ঘটনা। সেটিও সম্ভবপর হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানসহ বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে ছাত্রসমাজের বজ্রকঠোর মনোভাবের জন্য। এই চুক্তির আটটি শর্ত ছিল।
প্রধান কয়েকটি হলো: গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তিদান; হামলার তদন্ত ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিপ্রদান; বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদাদানের জন্য ব্যবস্থাপক সভায় প্রস্তাবের ব্যবস্থা; কলেজগুলোতে বাংলায় পঠনপাঠনের সুযোগ সৃষ্টি; আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ না নেয়া; সংবাদপত্রসমূহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার; ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার; ‘আন্দোলনকারীরা বিদেশের অনুচর’ সরকারের এই বক্তব্য প্রত্যাহার। উল্লেখ্য, এই চুক্তিপত্র যখন তৈরি হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা জেলে। সে কারণে চুক্তিপত্রের খসড়া জেলখানাতে নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনের অনুমোদন করিয়ে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে এতোটাই প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন যে, জেলে থাকলেও তাকে না দেখিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ছাত্রনেতৃবৃন্দ একমত হতেন না। এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন যে, ১১ মার্চ তাদের জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে তাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দি ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং জেল থেকে মুক্তি পাবার পর দিনই বঙ্গবন্ধু এই বিক্ষোভে শামিল হন। শুধু শামিল নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমাবেশে তাকে সভাপতিত্ব করতে হয়। এই সভাপতিত্বের ব্যাপারটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কোনো সভাতে সভাপতিত্বও করেননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সে সময় বঙ্গবন্ধুর ওপরই নেতৃত্ব প্রদান করে। তাই ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি আন্দোলনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনাও ঘোষণা দেন। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে গমন এবং সেখানে দাবিনামা উত্থাপন করে আবার ফিরে আসা- এই ছিল বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বঙ্গবন্ধুও কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন ঢাকা থেকে সারা দেশে তখনই ছড়িয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনকে হিন্দু, কমিউনিস্ট ও ভারতের আন্দোলন বলে প্রপাগান্ডা চালায়। তারা বলে, ভারত থেকে হিন্দু ও কমিউনিস্টরা পাকিস্তানে এসে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এই আন্দোলন করছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পাকিস্তানিদের কূটচাল। বাংলা কেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব ভাবনা ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। তার বক্তব্য:
‘‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পাশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচ ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।’’ (রহমান, ২০১২ : ৯৮)
তারপরও বঙ্গবন্ধু বাংলার একক মর্যাদা দাবি করেননি, করেছেন উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদা।
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ পূর্বদিনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাতেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করেন। তবে এই অভূতপূর্ব ধর্মঘট পালনের জন্য নেতৃবৃন্দের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতার কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলা বাঙালির আত্মার আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সারা দেশ কেঁপে ওঠে; রাস্তা, দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোস্টারে ছেয়ে যায়। তাতে লেখা থাকে: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। এই দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যায় এবং এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেসব ছাত্রনেতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাগ্রে। তার ভূমিকা ও সাহস ছিল স্মরণে রাখার মতো।
১৯ মার্চ মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ ঢাকা ঘোড়দৌড় মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) এক ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুসহ চার-পাঁচশ ছাত্র সেই সমাবেশে একত্রে বসেছিলেন। ছাত্ররা ধ্বনি ও হাত তুলে জিন্নাহর এই প্রত্যয়ের বিপক্ষে জানিয়ে দেয়: ‘মানি না’। এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সময় জিন্নাহর বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা। ২১ মার্চের প্রতিবাদ থেকেই ২৪ মার্চের প্রতিবাদের সাহস সঞ্চয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ভিত তৈরিতে এভাবেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করার পর ছাত্রসমাজের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে খানিকটা দ্বিধার জন্ম যে হয়েছিল, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। কেননা, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানেই জিন্নাহর গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি ছিল। জিন্নাহর মুখ দিয়ে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বক্তব্য এলে অনেক বাঙালি ছাত্রনেতা পর্যন্ত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে জিন্নাহর অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ বক্তব্যও রাখেন। কিন্তু এখানেই আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে দ্ব্যর্থহীনভাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, নেতা অন্যায় করলেও ন্যায়ের স্বার্থে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লেখেন: “আজও আমার একটা কথা মনে অছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন, হজরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।”
সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।” (রহমান, ২০১২ : ১০০)
ছাত্রসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর এই দ্ব্যর্থহীন অবস্থানের কারণে ছাত্রসমাজের দ্বিধাও কেটে যায় এবং সরকারের অবস্থান সমর্থনকারী ছাত্রসংগঠনের অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু সঠিক পথনির্দেশ করতে পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে আন্দোলনে রূপলাভ করে। আসলে বলা চলে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথমপর্যায় শেষ হয়।
এ সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালির রাজনৈতিক দল গঠনে তৎপর হন। আসলে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে’র ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। বঙ্গবন্ধু এই ব্যাপারটি ভালো করে ছাত্রসমাজে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন। তাই ছাত্রদের মধ্যে সমর্থন হারিয়ে ফেলে এই ছাত্রসংগঠনটি। দেশ ও ছাত্রদের স্বার্থে সঠিক পথে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৪৮ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমানসহ চৌদ্দজন ছাত্রনেতা একটি প্রচারপত্র বিলি করেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় সরকারবিরোধী প্রথম সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। রাষ্ট্রভাষা সংগঠনে এই ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে বিনাবিচারে আটকে রাখে। এদিকে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হত্যা-পাল্টা হত্যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন পূর্ব বাংলার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। অথচ, তিনিই ১৯৪৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ছাত্রদের সঙ্গে যে আট দফা চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা প্রদান করা হবে বলে অঙ্গীকার ছিল। যারা লেখেন, এ সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে তার উপস্থিতি নেই। যারা এগুলো লেখেন, তারা প্রকৃত ইতিহাস হয় জানেন না অথবা জেনে গোপন করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরও স্থপতি। এই আন্দোলন কীভাবে, কারা আরম্ভ করবে, জেলে বসে তার নিজের করণীয় কী হবে এসব তিনি আগেই ভেবেছেন এবং অনুসারীদের দিয়ে সে অনুসারে কাজ করিয়েছেন। ভাষাসৈনিক গাজিউল হক এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই লিখেছেন-
“১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (আজিজ, ১৯৯২ : ১৭)
আবদুল গাফফার চৌধুরীও ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।” (আজিজ, ১৯৯২ : ২১)
এই চিরকুটে ছিল আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। এ ব্যাপারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু নিজে সব প্রকাশ করে গেছেন। আসলে, ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় এবং আরম্ভকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন-ঘোষণার পর জেল-হাসপাতালে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন: যে ঢাকায় বসে খাজা নাজিমুদ্দিন ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টো বললেন। জেল-হাসপাতালে সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে, তারাসহ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের আরও নেতা নিয়ে রাত একটায় জেল-হাসপাতালের গোপনীয় স্থানে সভা করেন। এই সভা করাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, আই.বি’র লোকজন, পুলিশের সদস্য, গোয়েন্দা কর্মচারী আর সাধারণ ডাক্তার-নার্স- এতো সংস্থা ও লোকের চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতের এই সভাটি আহ্বান করা একজন বন্দির জন্য স্বাভাবিককর্ম ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং সে রাতের অনানুষ্ঠানিক সভায় যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল সেই পরিকল্পনা অনুসারেই পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ সূচিত হয়েছে। এই সভা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছে। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরো দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি [বঙ্গবন্ধু] আরও বললাম, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব।” (রহমান, ২০১২ : ১৯৬-৯৭)
বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনা অনুসারে তার সুপরিচিত কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক মনোনীত করে ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুধু ছাত্ররা করে আসছিল তাতে সর্বমহল যুক্ত হয়, এতে রাজনীতিবিদগণ আসার সুযোগ পান। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় পূর্ববাংলা আইনসভার অধিবেশন আহ্বানের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এই আন্দোলনের ডাকের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পায় অনেক গুণে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা অনুসারে জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন যে, তাকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। হয় তাকে মুক্তি দেয়া হবে, তা না হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশনের মাধ্যমে দেহত্যাগ করে জেলমুক্ত হবেন। এই গোপন সভার সংবাদ নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং সে কারণেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আসার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি হোটেলে আবার গোপন রাজনৈতিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
‘‘আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করব। বললাম, সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। [...] তারা আমাকে বলল, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” (রহমান, ২০১২ : ২০০)
এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত ও বিভিন্ন স্থানে বিস্তারে বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকার পরও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ফরিদপুর জেলে এসে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ পূর্বসিদ্ধান্ত অনুসারে অনশন আরম্ভ করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অনশনরত অবস্থায় জেলে বসেই কর্তব্যরত পুলিশদের কাছে সংবাদ পান ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা শহিদ হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে ফরিদপুরে মিছিল হয়েছে ইত্যাদি। এই সংবাদ শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে ছাত্রহত্যার ব্যাপারটি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর।” (রহমান, ২০১২ : ২০৩)
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকলেও তার মন ছিল আন্দোলনে, তার চিন্তা ছিল আন্দোলনকারীদের ঘিরে। অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ঘরে ফেরার আর উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে-
“গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি [বঙ্গবন্ধু] ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।” (রহমান, ২০১২ : ২০৪)
অনশনে বঙ্গবন্ধুর শরীরের এমন অবনতি হয়েছিল যে, ডাক্তারেরা পর্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলেন। অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে বের হন।
ভাষা আন্দোলনের প্রবল স্রোত পাঁচ বছরের শিশু শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাই জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিন পর বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জের বাড়িতে পৌঁছেন, শিশু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর গলা আদরে জাপটে ধরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর রাজবন্দিদের মুক্তি চেয়ে স্লোগান দেন। সেই স্মৃতি বঙ্গবন্ধু ভুলতে পারেননি। তিনি লিখেছেন-
‘‘পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।” (রহমান, ২০১২ : ২০৭)
এ থেকে বোঝা যায়, ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কতোটা তীব্র হয়েছিল এবং শেখ হাসিনার মধ্যে শৈশব থেকেই রাজনীতি কতটুকু আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। পরে দেখা যাবে শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এবং আরও পরে জাতীয় রাজনীতিতে। তাই একথা বলাই চলে, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি, আর শেখ হাসিনার রাজনীতিতে প্রবেশের সূচনাদ্বার হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই আন্দোলন শেখ হাসিনার মনে দাগ কেটেছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছেন, গ্রামের মানুষেরাও ঢাকা শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র শহিদ হওয়ার কথা জানে এবং তারা পাকিস্তানি শাসকদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। জনগণের এই বিক্ষুব্ধতাকে তাদের শোষণমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে পরে যুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহতি পরে বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আদায় ও তা প্রকাশ-প্রচার করা। ইতিপূর্বে সোহরাওয়ার্দীর নামে মুসলিম লীগ সরকার পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে যে, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দী দীর্ঘদিন করাচিতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাই করাচিতে যান এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে- এই বার্তাটি যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি সোহরাওয়ার্দীকে অন্ধভাবে সমর্থন করতো তাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর করাচি সফরের কারণে সোহরাওয়ার্দীর মত সর্বাংশে বাংলা ও উর্দুর দিকে আসে এবং বাঙালির সংগ্রাম অনুকূল বাতাস পায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থে আছে-
“আমি [বঙ্গবন্ধু] আর একটা অনুরোধ করলাম, তাঁকে [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বিরুদ্ধে। তিনি [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বললেন, ‘নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস।’ তিনি লিখে দিলেন।” (রহমান, ২০১২ : ২১৬)
এই বক্তব্যটি পরে পূর্ববাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী সেসময় মিথ্যে প্রচার করেছিল যে, বাঙালিরা শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে আন্দোলন করছে। করাচিতেই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মারফত বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে সত্য তুলে ধরেন। এটি যে শাসকদের মিথ্যে প্রচারণা সে কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লেখেন-
“খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বলা হয়েছে, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা।” (রহমান, ২০১২ : ২১৭)
বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সঠিক গতিপ্রাপ্ত হয় ও সাধারণ বাঙালি বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পায়।
১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীন দেশে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের ৩০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে গিয়েছিলেন পাঁচ জন। কিন্তু একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলায় বক্তৃতা করার সাহস দেখান। এতে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ে এবং এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। কারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গিয়ে বাংলার অস্তিত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, কম কথা নয়! ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-
“পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।”
কেন কর্তব্য? এর উত্তর আছে বঙ্গবন্ধুর অন্য বইয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, স্বদেশের ভাষা নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই গর্ববোধ করে; ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে গর্বের কিছু নেই বলে তিনি লিখেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও লিখেছেন, বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা যেহেতু বিশ্বের মানুষ জানে, সেহেতু বাংলাতেই বক্তৃতা দেওয়া উচিত। বাংলায় বক্তৃতা দেওয়াটা তার পূর্বপরিকল্পিত বলেই এ ব্যাপারে তিনি আতাউর রহমান খান, তফাজ্জাল হোসেন ও খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে কী বলবেন তা আলাপ করে নিয়েছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান, ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ (রহমান, ২০২০ : ৪৩)
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লক্ষ করেছেন চীন দেশের অনেকে ইংরেজি ভাষা জানার পরও ইংরেজি বলে না। এমনকি নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বভাষায় বঙ্গবন্ধু ও তাদের দলকে অভ্যর্থনা করেন। দোভাষী যখন ভুলভাবে এর উপস্থাপন করেন তখন উপাচার্য ইংরেজিতে দোভাষীর ভুল শুধরে দেন। উপাচার্যের এই স্বভাষা প্রীতির ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। আদতে চীনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করে পাকিস্তানের শাসকদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলায় এই ভাষণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রবাহকে তীব্র করেছে নিশ্চয়। এই ভাষাপ্রীতির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী পালনের সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকাতেই থাকেন, নেতৃত্ব দেন মিছিলে, করেন বক্তৃতা। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে প্রভাতফেরি বের করা হয়; কালো পতাকা বহন করা হয়; ঢাকা শহর প্রদক্ষিণও করা হয়। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর্মানিটোলা মাঠে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। এভাবেই ২১-এর চেতনার ধারাবাহিকতায় আন্দোলনে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি জেল থেকেই স্মরণ করেছেন বায়ান্নের বীর শহিদদের এবং ‘কারাগারের রোজনামচায়’ লিখেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে ছিলেন-
“আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।” (রহমান, ২০১৭ : ২০৬)
বন্দিত্ব-আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদির পথ ধরে একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের প্রেরণা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারতো বলে মনে করেন ভাষাসংগ্রামী গাজিউল হক। তিনি লিখেছেন-
“১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও নেতৃত্বদানের পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব যদি কারাগারের বাইরে থাকতেন, তা হলে সেদিন (২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হতো না বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৪)
অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাদের মধ্যে যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু জেলে না থাকলে তার সঠিক নেতৃত্বে এই বিরোধ সৃষ্টির অবকাশ হতো না বলেই গাজিউল হক মনে করেন। তবে, এম আর আখতার মুকুলের এই কথাই শেষ অবধি সত্য-
“১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এর পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলো বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ আন্দোলন। প্রায় একই সময়ে দ্রুত গড়ে উঠলো স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা ও স্বাধিকরের আন্দোলন এবং চরম পর্যায়ে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সবই একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সংগঠিত জাতীয়তাবাদীদের হাতে।” (মুকুল, ২০০০ : ৪৫)
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুর্তাজা আলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯)
বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান মনে করেন, এই বক্তব্যের মধ্যে ‘স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একটা ডাক’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯) আছে। সত্যি, মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই (৭ মার্চ) বঙ্গবন্ধু ঘোড়দৌড় মাঠে তার ঐতিহাসিক ভাষণে সেই ডাকটি দিয়েছিলেন। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবন্ধু একুশের কথা স্মরণ করিয়ে জনগণকে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে বলেছেন এবং সাহসী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহীদমিনার পাদদেশে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের মোকাবেলায় বাঙালি যাতে কাপুরুষের মতো পিছু না হটে। কারণ, শহিদের আত্মারা ভিক্ষা চাইছে বাঙালিরা সাহসী হোক। ভাষা আন্দোলনের সময় যেসব ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন তারা তখন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, অতীতে ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও ষড়যন্ত্র হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন,“সামনে আমাদের [বাঙালির] কঠিন দিন। আমি [বঙ্গবন্ধু] আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। আমি জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারবো। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হোন। বাঙালি যেন আর অপমানিত-লাঞ্ছিত না হয়। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।” (সালাহউদ্দিন, ২০১১ : ১১৮) এভাবেই একুশের চেতনার আলোকে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে লড়াইয়ে আহ্বান করেছেন এবং পরবর্তী সময় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর তার দৃঢ় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, ১৯৭১ সালে।
বাংলা ভাষার জন্য মমতা ও আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। তিনি ১৯৪৮ সালেই বুঝেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান দেখাবে না। তাই, তিনি সে সময় থেকেই আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাঙালি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পৌঁছে এবং অবশেষে তারা লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মূলত তিনটি বাংলা ভাষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে; দ্বিতীয়টি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়; তৃতীয়টি ১৯৭৪ সালের ২৫শ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে। এর আগে চায়নার শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি দেশের কর্ণধার ছিলেন না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বীরের মতো মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এবার তার স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। লন্ডন ও দিল্লি হয়ে তার ঢাকায় পৌঁছার কথা। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গার্ড-অব-অনার প্রদান করা হয়। তিনি সেখানে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি-শুভেচ্ছা বক্তব্যও প্রদান করেন। তার সম্মানে দিল্লিতে আয়োজন হয় একটি জনসভার।
স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ এটি। শীতের দিনে মূলত হিন্দিভাষী দিল্লিবাসীর সম্মুখে এই ভাষণ দেবার আগে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।
করাচি থেকে লন্ডন হয়ে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অবশেষে দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি তার সেই প্রত্যাবর্তন দিবসটি স্মরণীয় করতে উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরিকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের উপস্থিত করিয়ে বিশ্ববাসীকে চমক দেন ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তার নেতাকে এভাবেই সম্মান জানায় ভারত। একটি খোলা মঞ্চ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার ভাষণ শেষ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর দেহকে আটক করেছিল কিন্তু তার আত্মাকে তারা আটক করতে পারেনি। সেই আত্মাই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধুর পালা, তার অভিব্যক্তি তিনি প্রকাশ করবেন। মাইকের সামনে দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়ান। দিল্লির জনসভায় উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। সেদিনটি ইন্দিরা গান্ধীর ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুর। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মঞ্চে আছেন কিন্তু জনতার মনোযোগ তিনি ছাড়া অন্য কারো প্রতি, সম্ভবত ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা এই একবারই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করেন: ‘প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, প্রেজেন্ট...’, এরপরেই জনতার মধ্য থেকে প্রবল দাবি ওঠে: ‘বাংলা... বাংলা...’। থেমে যান বঙ্গবন্ধু। পাশে দাঁড়ানো ইন্দিরা গান্ধী ও অন্য নেতারা বলেন, তিনি যেন বাংলাতেই বক্তৃতা করেন। মুচকি হেসে, ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আরম্ভ করেন বাংলায় তার বক্তৃতা-
“আমার ভাই ও বোনোরা”। বাংলাদেশে পা রাখার আগেই বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ভাষণ বাংলায়! এটিও ইতিহাস। ভাষণে সম্বোধনের পর তিনি সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন-
আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগত অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, দুদিন আগেও তিনি পশ্চিম পকিস্তানের অন্ধকার সেলে কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি ভাষণে বলেন, তার মুক্তির জন্য, তাকে রক্ষার জন্য শ্রীমতী গান্ধী পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে চেষ্টা করেননি। ব্যক্তিগতভাবে ও দেশের মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার, ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভারতের মানুষও সবাই সচ্ছল নয়, কিন্তু তারপরও এক কোটি শরণার্থীকে তারা আহার ও বাসস্থান দিয়েছে- একথা উল্লেখ করেও বঙ্গবন্ধু ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের সচেতন মানুষের সাহায্য ও সমর্থন কামনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য। আদর্শ, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল বলে সেই ভাষণে জানান। এভাবে স্বাধীন দেশে পদার্পণের পূর্বকালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলকাঠামো কী হবে, বিশ্বের কাছে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম থেকেই যে অপজিজ্ঞাসা শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তা পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন, তাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আদর্শের এত মিল কেন? এর উত্তর তিনি দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেন; বলেন, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তিতে তাদের আদর্শ অভিন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পরে যে নানা তিক্ত প্রশ্ন বিভিন্নজন তোলে, তার সূচনা যে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই সে উল্লেখ আছে। ভাগ্যিস কেউ বলে না, ভারতের আকাশ, বাতাস, বৃক্ষলতার সঙ্গে বাংলাদেশের এত মিল কেন!
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছিল ১৯৭২-এর জানুয়ারির ১০ তারিখেই বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একটু দেখা দিয়ে তবে ঢাকায় যান। কিন্তু তা হয়নি। ভারতের যে রাজ্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাছে থেকে এত ঘনিষ্ঠভাবে সাহায্য করেছে, সেই রাজ্যের মানুষের দাবিপূরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু তার প্রথম আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফর করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। যে কলকাতার রাস্তার ধুলোতে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পদসঞ্চালন ঘটেছে অগণিতবার, যে কলকাতার কলেজে তিনি পাঠ নিয়েছেন, হোস্টেলে থেকেছেন, তার সেই স্মৃতিময় কলকাতায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসেন প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় ব্রিগেড মাঠে দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে তার দ্বিতীয় বাংলা ভাষণটি রাখেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণের প্রথমেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জনগণের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের একটি রাজ্যের নামও ভুল করে তিনি বাদ দেননি। এক নিঃশ্বাসে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের নাম। তাদের জনগণ ও রাজ্য সরকারকেও ধন্যবাদ জানান।
বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা চিত্তে আরও বলেন, “আপনাদের এই দান কোনো দিন আমরা শোধ করতে পারব না। স্বাধীনতা পেয়েছি, বড়ো রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এত রক্ত কোনো জাতি, কোনো দেশে কোনো দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা ৪০ খানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারফিউ আইন জারি করে আমার জ্ঞানী-গুণী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার এক কোটি লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।” (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইটের ভিডিও থেকে) এরপর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে কত সম্পদ ক্ষয় হয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সংগ্রাম করে বাঙালি স্বাধীন হয়। তিনি এই ভাষণে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। তারপর বলেন, পাকিস্তানিরা দেশের উন্নয়নে সময় না দিয়ে, দেশে দারিদ্র্য দূর না করে প্রতিহিংসা ছড়িয়েছে। তারা কাশ্মির নিয়ে, নেতাদের নিয়ে আর হিন্দুদের নিয়ে মিথ্যে কথা বলে জনগণকে বাস্তব থেকে দূরে রেখেছে। ভাষার অধিকার না দেয়া, অন্য অধিকার না দেয়ার কথাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিরা পরাজয়বরণ করে পালানোর আগে খাদ্যগুদাম থেকে শুরু করে কী কী ধ্বংস করে চলে গেছে, সে কথাও বলেন তিনি। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বভাবের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাঙালির স্বভাব যেমন কোমল, তেমনি কঠিনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে প্রমাণ তারা রেখেছে। এই ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, মুক্তিযুদ্ধকালে তারা যথাযথ কাজ করেনি। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মানুষ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকার সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকরা এ সময় সাহায্য করলেও আমেরিকার সরকার সমর্থন করেনি। তাই তিনি স্পষ্ট বলেন-
“আমি আমেরিকা সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাই না। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না।” বরং তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, গণতন্ত্রের কথা মুখে না বলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিন। আমেরিকা সম্পর্কে দেশের বাইরের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থানটি ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। একদিকে তিনি রাশিয়াকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, অন্যদিকে আমেরিকাকে দিচ্ছেন না এবং তা স্পষ্ট করে আবার উল্লেখও করছেন। তার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বক্তব্যের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আবার তিনি পাকিস্তানিদের উদ্দেশেও বলেছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর তার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার যে বিদেশের মাটিতে বলছে, বাংলাদেশ এখনও তাদের অংশ- এর প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি তিনি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রভাবে পাকিস্তান আমলে তার গড়া আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি দিল্লির ভাষণের মতো এখানেও বলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র হবে তার সরকারের মূলস্তম্ভ। পরে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে এগুলোই বাংলাদেশের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কাব্যপঙক্তি তিনি আবৃত্তি করেছেন এবং এর শেষদিকে বঙ্গবন্ধু বেশ আবগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নিজের ভাষায় বক্তৃতার কারণে এই আবেগপ্রকাশ আরও গভীরভাবে প্রকাশ করা গেছে বলে মনে করা যায়।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক কূটচক্রান্তে খানিকটা বিলম্বই হয়ে যায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি। বিশেষ করে ভেটোদানের শক্তিসম্মত দুটো পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা ও চায়না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান করায় জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হয়। তবু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জয় হয় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পায় এবং বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্দিষ্ট দিনে নিউইয়র্কসময় বিকেল ৪টায় তাকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে এগিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব চিরচেনা চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে অপরূপভাবে। এমন একজন সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আগে বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। দীর্ঘদেহী, চৌকস, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন সেদিনের বিশ্বনেতারা। এরপর তার ভরাটগলায় বাংলা উচ্চারণ! ১৯১৩ সালে এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উঁচু আসনে তুলে ধরেছিলেন, তার একষট্টি বছর পরে আর এক বাঙালি বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে উঁচু আসনে তুলে ধরেন।
১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। সেই পথও এভাবেই তৈরি হয় নিশ্চয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার দেহভঙ্গিমায় সকলকে সম্মান জানান এবং জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির পার্লামেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করায় সবার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ত লক্ষ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে এই অধিবেশনে যোগদান বিশেষ সফলতারই দ্যোতক। এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শুধু ১৯৭১-এর বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি। বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির- এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাঙালি ‘জাতি’র কথা। তিনি জানেন, বাঙালি জাতির বাস শুধু নবগঠিত দেশ বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বহির্বিশ্বেও। এটি জেনেই তিনি বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত জীবনযাপনের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালির দীর্ঘসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করেছে, তারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাস করবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৭)
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বিশ্বমুদ্রাস্ফীতি, কৃষিযন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব-অর্থনীতির বিপর্যয়কালের কথাও স্মরণ করে বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। তিনি বাংলাদেশে নানা বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির কথাও উল্লেখ করেন তার ভাষণে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। তারপর একাধিকবার বন্যা ও খরাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়তে হয় দেশটিকে। এই বিপর্যয়ে সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘের প্রতি। তবে তিনি এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বহু অনুন্নত দেশের অবস্থাও। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের গরিব দেশগুলোর নেতার মতো বলেন, উন্নত বিশ্ব যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে তাহলে বিশ্বে এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, যার দৃষ্টান্ত মানব-ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি পুঁজির পাহাড়গড়া কিছু মানুষের কথাও উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে কিছু মানুষ পুঁজির দাপটে বিত্তবৈভবের যে ভোগবাদী অবস্থান নিয়েছে, তারও উদাহরণ বিরল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে কিন্তু তার জীবনদর্শনও প্রতিফলিত হয়। তিনি শোষিতের নেতা এবং শোষকশ্রেণির কারণেই যে সমাজে সব সংকটের সূচনা- এই কথা তিনি তার বিশ্ববক্তব্যে এভাবেই উল্লেখ করেন। আদতে বঙ্গবন্ধু তার এই বক্তৃতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্টভাষায় বলেছেন-
“একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাতে হয়েছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। আজকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বেছে নেবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে। এই পথ বেছে নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুলে এগিয়ে যাবো অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাবো যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলবে এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৯)
বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে তার নিজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন যে, বাংলাদেশ প্রথম হতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। কেবল শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে সক্ষম করে তুলবে বলে মত দেন তিনি। মানবিক ঐক্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে তিনি বক্তৃতায় দৃঢ়ভাবে বলেন; আর এর প্রতি তিনি সমর্থন ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় বক্তৃতার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে তার কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করার রীতি চালু করেন।
বাংলাদেশের বাইরে বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই বাংলা বক্তৃতাগুলো জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে সগর্বে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বাংলায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা তিনটি ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে আছে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের মত মোড়লদের বিরোধিতার পরও পদ্মা সেতু তৈরি, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রেরেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে পারমানবিক শক্তিধর দেশের তালিকায়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু মেগা প্রকল্পই নয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে পারমাণবিক দেশের মর্যাদায় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে।
চালু হয়েছে দেশের আরেকটি মেগা প্রকল্প শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। যা বিশ্বের বুকে আরেকটি গর্বের স্থাপনা। আর এসব সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্ঠায়। তবে তিনি জাতিকে আরেকটি স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আর তা হলো অচিরেই চাঁদে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উন্নয়নে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বর্তমান বিশ্বে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও সর্বোচ্চ মানসম্মত বিমানবন্দর সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি।
বিমানবন্দরটির ২০২৩ সালের রেটিং স্কোর ৯০ দশমিক ১২। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর। রেটিং স্কোর ৮৭ দশমিক ৬২। মানের শীর্ষে আরও রয়েছে যুক্তরাজ্যের হিথ্রো, সুইজারল্যান্ডের জুরিখসহ বিভিন্ন দেশের আরও অনেক বিমানবন্দর।
এগুলোয় রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। পাশাপাশি যাত্রীদের যাতে কোনো রকম ভোগান্তি না হয়, তাও নিশ্চিত করা হয়েছে । একজন যাত্রী সহজেই বিমানবন্দরের সব ধাপ অতিক্রম করে উড়োজাহাজে আরোহণ করতে পারেন। একইভাবে বিমান থেকে নেমে আরামদায়ক প্রস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে।
সদ্য চালু হওয়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও হতে যাচ্ছে ঠিক তেমনই। চাঙ্গি বিমানবন্দরের মতো সব মান নিশ্চিত করেই তৈরি করা হচ্ছে শাহজালাল বিমানন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এটির নকশাও করেছেন চাঙ্গি বিমানবন্দরের স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরের নকশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রোহানির প্রণীত নকশার থার্ড টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে বিশ্বের প্রথম সারির বিমানবন্দরের তালিকায় উঠে আসবে বাংলাদেশের নাম।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই টার্মিনাল ভবনটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। ভবনটির ভেতরের সৌন্দর্যও নান্দনিক। দিনের বেলায় সূর্যের আলোর পরিপূর্ণ ব্যবহার করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ভবনটিতে। প্রতিদিন ৩৩ হাজার যাত্রী টার্মিনালটি ব্যবহার করতে পারবেন। যা বছরে প্রায় বছরে ১ কোটি ২০ লাখ। বহুতল কার পার্কিংয়ে গাড়ি রাখা যাবে ১ হাজার ২৩০টি। বিদ্যমান টার্মিনাল ১ ও ২-এ বর্তমানে বছরে ৮০ লাখ যাত্রীসেবার ব্যবস্থা রয়েছে।
টার্মিনাল ১ ও ২-এ বর্তমানে ৮০০টি গাড়ি পার্ক করা যায়। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের তৃতীয় টার্মিনালে (ভবন ছাড়া) একসঙ্গে ৩৭টি বিমান পার্ক করে রাখার জায়গা (অ্যাপ্রোন) রয়েছে। বোর্ডিং ব্রিজ আছে ২৬টি।
এ ছাড়াও এখানে ২ লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটারের একটি আধুনিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন থাকবে। স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন, বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন বিমানবন্দরে প্রবেশ করে যাত্রীরা সাধারণত চেক-ইন কাউন্টারে গিয়ে তার টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস নেন এবং ব্যাগেজ বুকিং দেন। তবে এ টার্মিনাল ভবনে থাকবে ১০টি সেলফ চেক-ইন মেশিন (কিয়স্ক)
এগুলোতে নিজের পাসপোর্ট এবং টিকিটের তথ্য প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বোর্ডিং পাস ও আসন নম্বর। এর পর নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী তাঁর লাগেজ রাখবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাগেজগুলো এয়ারক্রাফটের নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে।
তবে নির্ধারিত ৩০ কেজির বেশি ওজনের লাগেজ এবং সাধারণ যাত্রীদের চেক-ইন ও লাগেজ বুকিংয়ের জন্য থাকবে আরও ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার। টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেট থাকবে। এসব ই-গেট দিয়ে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি না হয়ে সরাসরি নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। তবে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও থাকবে।
সেখানে ইমিগ্রেশন করবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। বিদেশি যাত্রীদের জন্য থাকবে ৫টি ই-গেট। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার। ই-গেট সবাই ব্যবহার করতে পারবেন না। ই-পাসপোর্টধারীরাই শুধু এ গেটের মাধ্যমে পার হতে পারবেন। ই-পাসপোর্টধারীরা ই-গেটের কাছে গিয়ে ই-পাসপোর্ট রাখার সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে যাবে। নির্দিষ্ট নিয়মে গেটের নিচে দাঁড়ানোর পর স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে।
এর পর সব ঠিক থাকলে ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যেই যাত্রী ইমিগ্রেশন শেষ করতে পারবেন। কেউ ভুল করলে ই-গেটে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। তখন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা যাত্রীকে সঠিকভাবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারে সহযোগিতা করবেন।
এক কথায়, সম্পূর্ণ অটোমেটেড সুবিধা থাকবে এই টার্মিনালে। স্ট্রেইট এস্কেলেটর তৃতীয় টার্মিনালে থাকবে ৩৫টি এস্কেলেটর, যা বাংলাদেশে প্রথম। যারা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরের দীর্ঘ পথ হাঁটতে অক্ষম, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে বেশি যাত্রীসমাগমের জায়গায় এ ধরনের এস্কেলেটর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ব্যাগেজ বেল্ট যাত্রীদের ব্যাগের জন্য তিনটি আলাদা স্টোরেজ এলাকা করা হয়েছে। রেগুলার ব্যাগেজ স্টোরেজ, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এবং অড সাইজ (অতিরিক্ত ওজন) ব্যাগেজ স্টোরেজ। যাত্রীদের স্বাভাবিক ওজনের ব্যাগেজের জন্য চাঙ্গি ও ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মতো অত্যাধুনিক এবং একই রকমের ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট থাকবে।
অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে আরও চারটি পৃথক বেল্ট। এ ছাড়া ব্যাগেজ এলাকাসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ব্যাগেজগুলোর জন্য থাকবে আলাদা লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ব্যাগেজ এরিয়া। শিশুদের খেলার জায়গা টার্মিনালের প্রতিটি ওয়াশরুমের সামনে থাকবে একটি বেবিকেয়ার লাউঞ্জ। এ লাউঞ্জের ভেতর মায়েদের জন্য থাকবে ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম।
এ ছাড়া বাচ্চাদের স্পিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন খেলার এলাকাও থাকবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য থাকবে সার্বক্ষণিক দক্ষ চিকিৎসকসহ হেলথ ইন্সপেকশন সুবিধা, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, করোনাসহ নানা রোগ পরীক্ষার কেন্দ্র ও আইসোলেশন সেন্টার। মুভি লাউঞ্জ, ফুডকোর্ট বিমানের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় যাতে একঘেয়েমি না লাগে সে জন্য থাকবে মুভি লাউঞ্জ, এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডে-রুম।
এ ছাড়াও ঘোরাফেরা ও কেনাকাটার জন্য থাকবে ১৪টি স্পটে ডিউটি ফ্রি শপ। টার্মিনালের বাইরে ও ভেতরে থাকবে ফুডকোর্ট, ফুড গ্যালারি, ওয়াই-ফাই এবং মোবাইল চার্জিং সুবিধা। নারী ও পুরুষের জন্য থাকবে পৃথক নামাজের ব্যবস্থা। যাত্রীদের স্বাগত বা বিদায় জানাতে যাওয়া দর্শনার্থীদের জন্য মিটার্স অ্যান্ড গ্রিটার্স প্লাজাও থাকবে টার্মিনালে।
আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নতুন এই টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকবে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানার মেশিন, ১১টি বডি স্ক্যানার। টার্মিনালে প্রবেশ করা একজন যাত্রীকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তল্লাশি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রীকে বডি স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দু’হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। এর ফলে যাত্রী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সময় বাঁচবে। স্ক্য্যানিংও হবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ।
এদিকে বিমানবন্দরের ভেতরে থাকবে একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশন। সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন একজন পৃথক ফায়ার স্টেশন ম্যানেজার। থাকবে আগুন নেভানো ও জরুরি উদ্ধারকাজ পরিচালনার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে। আসবে নতুন নতুন এয়ারলাইন্স টার্মিনাল ১ ও ২-এ সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার কারণে অতীতে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট গুটিয়ে নিয়েছে।
নতুন টার্মিনালে সেসব এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন টার্মিনালটি মাঝারি ও বড় সাইজের (ওয়াইড বডি জেট) এয়ারক্রাফট ব্যবহার করবে। ১ ও ২ নম্বর টার্মিনাল দুটি ছোট আকারের বিমানগুলো ব্যবহার করবে।
বাড়বে কার্গো সুবিধা বর্তমানে বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানির জন্য একটি কার্গো ভিলেজ থাকলেও থার্ড টার্মিনালের উত্তর পাশে একটি পৃথক আমদানি-রপ্তানি কার্গো ভিলেজ ভবন থাকবে। এটির আয়তন ৬৩ হাজার বর্গমিটার। এটিও হবে উন্নত বিশ্বের মতো সর্বাধুনিক সুবিধা-সংবলিত। বিমানবন্দরের বর্তমান কার্গো ভিলেজের ধারণক্ষমতা ২ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন। তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো ভিলেজের ধারণক্ষমতা হবে প্রায় দ্বিগুণ বা ৪ মিলিয়ন টন। এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের আয়তন আড়াইগুণ বৃদ্ধি পাবে। বছরে যাত্রী পরিবহন ক্যাপাসিটি আরও ১২ মিলিয়ন বাড়বে। অর্থাৎ বর্তমানে আট মিলিয়নের সঙ্গে ১২ মিলিয়ন যুক্ত হয়ে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বেড়ে ২০ মিলিয়নে দাঁড়াবে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই রপ্তানির একটি বড় অংশ হয় বিমানবন্দর দিয়ে। সমুদ্রপথের তুলনায় আকাশপথে রপ্তানি ব্যয়বহুল হলেও লিড টাইম মোকাবিলায় আকাশপথে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠাতে হয় অনেক সময়। তবে এতে ঝক্কি-ঝামেলাও পোহাতে হয় অনেক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে তাদের ভোগান্তি লাঘব হবে অনেকাংশে। থার্ড টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে রপ্তানিতে বইতে পারে সুবাতাস। বিশেষ করে প্রপার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং তদারকি সম্ভব হলে সুফল মিলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমাত্রিক ও গতিশীল নেতৃত্বে জাতির পিতার হাতে যাত্রা শুরু করা দেশের এভিয়েশন খাত উন্নীত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাড়ছে দেশের আকাশ পথের সংযোগের পরিধি। শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা অনুসারে সারাদেশে বিমান পরিবহন অবকাঠামোর যুগোপযোগী উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, কারিগরি ও জনদক্ষতা উন্নয়ন এবং নিরাপদ ও সুষ্ঠ বিমান চলাচল নিশ্চিতে কাজ অব্যাহত রয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল তারই প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের এভিয়েশন শিল্পকে স্মার্ট এভিয়েশন শিল্পে রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম এভিয়েশন হাবে পরিণত হবে।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাতে বঙ্গবন্ধুর সকল স্বপ্ন আর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়িত হচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অবকাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে যা এরইমধ্যে দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠা হয়েছে দেশজুড়ে প্রসারিত ডিজিটাল সিস্টেম, যা সেবাসমূহকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে অভিষ্ঠ লক্ষমাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার স্মার্ট বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক, যুগ্ম সম্পাদক , ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)
চলে গেলেন ডাকসাইটে আমলা, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারাল একজন সত্যভাষী ও সাহসী মানুষকে, যিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন আকবর আলি খান। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানি জান্তা তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।
এই মানুষটিকে হারিয়ে দেশের মানুষ যে শোকাহত, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের অনেক ক্ষতি হলো, সেটাও সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো সাংবাদিকদের।
সোজাসাপ্টা বললে রিপোর্টারদের ক্ষতি হলো সবচেয়ে বেশি। এই মানুষটার কাছ থেকে আর কোনো ‘সাহসী’ ও ‘নিরপেক্ষ’ বক্তব্য পাবেন না প্রিন্ট, অনলাইন, টেলিভিশনের রিপোর্টাররা। ফলাও করে সেই বক্তব্য দেশবাসীকে জানাতে পারবেন না। আর নতুন যারা সাংবাদিকতা পেশায় আসবেন, তারা একজন ভালো শিক্ষক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন।
আর তাই তো আকবর আলি খানের মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট-বড় সব সাংবাদিকের ফেসবুক ওয়ালে শোকের ছায়া নেমে আসে। সাংবাদিকদের কাছে এই মানুষটি যে কতটা প্রিয় ছিলেন তার প্রমাণও মেলে।
আকবর আলি খানের নাম শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন তিনি সচিব পদে পদোন্নতি পান। ১৯৯৩ সালে সরকারের সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অর্থসচিব হন। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হয়েছিলেন।
সে সময় আমি খুবই ছোট সাংবাদিক। সচিবালয়ে ঢোকার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পাইনি। তাই মহান এই মানুষটির সঙ্গে খুব একটা দেখাও হয়নি। ২০০১ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক (অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর) পদে যোগদান করেন। বিশ্বব্যাংকে তিনি ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। পরে সেই সময় রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নে তিনিসহ চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন।
ততদিনে আমি স্টাফ রিপোর্টার থেকে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হয়েছি; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ করি। তখনই আকবর আলি খান স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে কাছে টেনে নেন। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতেন স্যার।
দেশের বাস্তবতার নিরিখে সুন্দর সুন্দর ঝাঁঝালো, চমৎকার কথা বলতেন স্যার। দ্রুত তা লিখে অথবা মোবাইলে অফিসে পাঠাতাম। সহকর্মীরা তা আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তুলে দিতেন। অন্য রকম তৃপ্তি পেতাম। স্যারের অন্ধভক্ত হয়ে গেলাম।
নানা কারণে সাংবাদিকতা পেশায় থাকব কি থাকব না, তা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে দোটানায় থাকতাম। সব ভুলে স্যারের নিষ্ঠুর সত্য ‘হককথা’র প্রেমে পড়ে গেলাম। সাক্ষাৎকার নিতে বেশ কয়েকবার স্যারের বাসায় গিয়েছি। কতদিন যে স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি গুনে শেষ করা যাবে না। যখনই কোনো জটিল বিষয় বুঝতে সমস্যা হয়েছে, স্যারের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছি।
শুধু আমি নই, সব সাংবাদিককেই সহায়তা করতেন; সবার ফোন ধরতেন। কে বড় পত্রিকার সাংবাদিক, কে ছোট পত্রিকার, বাছবিচার করতেন না।
এরই মধ্যে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো। দুই নেত্রীকে জেলে পাঠানো হলো। সর্বত্র ভয়-আতঙ্ক; থমথমে অবস্থা। সবাই চুপ…! শুধু একজন ছাড়া।
তিনি আকবর আলি খান। ২০০৭ থেকে ২০০৮। দুই বছর সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি; প্রায় প্রতিদিনই করেছেন।
এই মানুষটিকেই হারাল বাংলাদেশ। এমন ‘হককথা’র মানুষ দেশে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। আর আসবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
তাই তো আকবর আলি স্যারের মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর আকবর আলি খানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানাই। তার সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশের সুধী সমাজকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিল। বিদায় আকবর ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চার বছরের সিনিয়র ইতিহাস বিভাগের প্রবাদতুল্য মেধাবী ছাত্র। একাধারে দক্ষ নীতিবান সরকারি কর্মকর্তা, ইতিহাস ও অর্থনীতির গবেষক, রাজনীতির নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, সুলেখক, শিক্ষক, নাগরিক সংগঠক ও সমাজচিন্তক।’
ওপারে ভালো থাকবেন স্যার। যে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে আপনার অনন্য অবদান, সেই দেশের মানুষ আপনাকে মনে রাখবে চিরকাল।
আরও পড়ুন:পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় জুনে, এক বছরের জন্য, যা বছরের পয়লা জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ কার্যকর থাকে। মূলত সরকারের নির্দিষ্ট সময়ের (জুলাই ১ থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন ) দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু চিত্র প্রতিফিলত হয় বাজেটের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বাজেট শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবছর জুনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল আকারে পেশ করেন। এবারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে গতকাল।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাত সফলভাবে মোকাবিলা করে চলমান উন্নয়ন বজায় রাখা ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’। অর্থাৎ এবারের বাজেটে মহামারি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১.৫ শতাংশ যার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪.৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬.৬ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে অনুযায়ী এবারে বাজেটে মোট প্রাক্কলিত আয়ের পরিমাণ বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)তে এ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ইউক্রেন-রাশিয়ার কারণে বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণসহ উৎপাদন সরবরাহ ঠিক রাখা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বাজেট হচ্ছে দেশের ৫১তম বাজেট। স্বাধীনতা পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার দেশের প্রথম বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন জাতীয় নেতা ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম বাজেট যা ছিল বিদেশি অনুদান ও ঋণনির্ভর যেটাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘উন্নয়ন এবং পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট’। আর এবার ঘোষিত বাজেট হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের প্রায় ৮৬০ গুণ যার শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ও স্বাধীনতার ৫১তম বাজেটের মধ্যে টাকার অঙ্ক ও সময়ের অনেক ব্যবধান থাকলেও দুটি বাজেটের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন অর্থাৎ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি এটাই কামনা উচিত।
একটি দেশের বাজেট ঘোষণার পর সেটি নিয়ে যেভাবে আলোচনা ও সমালোচনা হয়, বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ততটা সহজ নয়। কেননা প্রতিটি দেশের জন্য প্রণীত বাজেটের কাঠামো ও আইনি ভিত্তিও বহুমাত্রিক। প্রতিবছর সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন সেই ‘বাজেট’ শব্দের উৎপত্তি নিয়েই রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কেননা ‘বাজেট’ ইংরেজি শব্দ। সাবেক অর্থসচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তার রচিত ‘বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন- মধ্যযুগের ইংরেজি ‘বুজেট’ (Bougette) থেকে বাজেট শব্দের উৎপত্তি। বুজেট শব্দের অর্থ মানিব্যাগ বা টাকার থলি। বাংলায় থলির সমার্থক বোচকা-পোটলা। তবে, বুজেট এর পরিভাষা এখনও রচিত হয়নি।
বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে উল্লেখ রয়েছে বাংলায় বাজেট শব্দটি ১৯০২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাজেটের উৎপত্তি হয়েছে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ বছর আগে। ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত রবার্ট ওয়ালপুল যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারা বছরই কর কমানো বা কর বাতিলের দাবি পেতেন।
এসব তিনি একটি ‘বুজেটে’ বা মানিব্যাগে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষদিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হতো, তখন তিনি কাগজগুলোর ভিত্তিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাঁড় করাতেন। মানে বাজেট প্রণয়ন করতেন। সেই থেকে ‘টাকার থলি বা বাজেট’ হয়ে গেছে সরকারের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের প্রতিশব্দ। সুতারং ইতিহাস বলে, বাজেট-ব্যবস্থার উৎপত্তি মানিব্যাগ থেকে। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনীতি অনেক বড় হয়। ফলে বাজেট-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাড়তে থাকে। এত বেশি দাবি আসে যে, এসব প্রস্তাব শুধু একটি মানিব্যাগে সংকুলান সম্ভব হয় না। ফলে মানিব্যাগের জায়গায় আসে ব্রিফকেস। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সংসদের বাজেট অধিবেশনে ব্রিফকেস নিয়ে যান এবং ব্রিফকেসের ভেতর থাকে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার কপি।
বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।
মহান জাতীয় সংসদে প্রতিবছর জুনে অর্থমন্ত্রী বিল আকারে যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার আইনি ভিত্তি হচ্ছে মূলত বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের ৮৭ (১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- “প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি (এই ভাগে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ বা Annual Financial Statement নামে অভিহিত)।” অর্থাৎ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বাজেট শব্দটি উল্লেখ নেই আছে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’। মূলত এই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিই ‘বাজেট’ নামে অভিহিত। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আওতায় ৮১ থেকে ৯৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনার ভিত্তি বর্ণিত আছে। তাছাড়া সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “অর্থ-বৎসর” অর্থাৎ জুলাই মাসের প্রথম দিবসে অর্থ বৎসরের আরম্ভ।
বাংলাদেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার রীতি বর্ণিত আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি’তে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ষোড়শ অধ্যায়ে “আর্থিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত কার্যপদ্ধতি” শিরোনামে বাজেট, মঞ্জুরি-দাবি, নির্দিষ্টকরণ বিল, সম্পূরক ও অতিরিক্ত মঞ্জুরি এবং ঋণের ওপর ভোট, ছাঁটাই প্রস্তাব, প্রস্তাবের ওপর আলোচনা, আলোচনার জন্য স্পিকার বরাদ্দকৃত সময় ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১১১(১) বিধিতে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে ‘বাজেট’ নামে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১১১(২) বিধিতে বলা হয়েছে, “এই ব্যাপারে সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করিবেন।”
১৯৭২ সাল থেকে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হলেও ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। যার ফলে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হতো মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণীত বিধির মাধ্যমে। ২০০৯ সালে সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে বাংলাদেশে প্রণীত হয় ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়: ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’; সচিবালয় নির্দেশমালা-২০১৪; রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬; জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলস ইত্যাদির বিধি-বিধান মোতাবেক। সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপতির সুপারিশ’ নিয়ে ‘সংসদে উত্থাপন করা’ হয় অর্থ বিভাগ হতে প্রণীত প্রস্তাবিত বাজেট। অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট বিল আকারে উপস্থাপনের পর উত্থাপিত বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়, সংসদে তর্ক হয় ও বিতর্ক হয়।
সংসদে উত্থাপিত অর্থবিল সংসদ সদস্যদের অনুমোদনের পর এটি আইনে পরিণত হয় এবং তা পরবর্তী অর্থবছরের জন্য কার্যকর হয়। বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের অংশ থাকে মূলত তিনটি: যার প্রথম ভাগে থাকে আয়ের হিসাব। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের সরকারের সম্ভাব্য আয়ের হিসাব থাকে। সরকারের সম্ভাব্য আয়ের উৎস আবার তিনটি। যথা- জনগণ প্রদেয় কর (এনবিআর ও অন্যান্য সংস্থার আদায়কৃত কর); কর বহির্ভূত আয় (ফি, লভ্যাংশ, অর্থদণ্ড, জরিমানা ইত্যাদি) এবং বৈদেশিক অনুদান।
বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের দ্বিতীয় ভাগে থাকে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব। বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয় চারটি ভিন্ন খাতে বিভক্ত করা হয়: পরিচালন ব্যয়; খাদ্য হিসাবে ক্রয়; ঋণ ও অগ্রিমবাবদ পরিশোধ এবং উন্নয়ন ব্যয়। বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দরকার আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব। ড. আকবর আলি খান তার ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ উল্লেখ করেছেন ‘‘আমরা যেমন দেখি, ‘যদি সঠিক আয়ের হিসাবে বাজেটের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে’।
বাজেটের তৃতীয় ভাগে থাকে সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে বাজেটকে বলা হয় ‘ঘাটতি বাজেট’। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সব বাজেটই ছিল ‘ঘাটতি বাজেট’। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো কেননা এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে এবং অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এবারে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি যা ছিল জিডিপির ৬.২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট মেনে নেয়া হয়। বাজেট-ঘাটতি দুভাবে পূরণ করা হয়। যেমন, বৈদেশিক উৎস; এটি মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদ হার কম এবং পরিশোধ করতে অনেক সময় পাওয়া যায়। তবে শর্ত থাকে বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস সরকার দুভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ‘ঘাটতি বাজেট’ নেতিবাচক শোনালেও এটা বরং উন্নয়ন সহায়ক।
আইএমএফের তথ্যমতে, কাতার, লুক্সেমবার্গ, উজবেকিস্তান ইত্যাদি পেট্রো-ডলারে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘ঘাটতি বাজেট’ দেয়া হয়।
দেশে দেশে বাজেট উপস্থাপনের নানা ঐতিহ্য রয়েছে। সব দেশেই অর্থমন্ত্রীদের ব্রিফকেস সঙ্গে নিয়ে সংসদে বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ দেখা যায়। তবে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন তার প্রথম বাজেটটি ঘোষণার সময় ব্রিফকেসের পরিবর্তে লালসালুতে মোড়া বাজেট ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে সংসদে ঢুকেছিলেন। দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহ্যের লাল শাড়ির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ওই বছরের বাজেট ডকুমেন্ট সাজিয়েছিলেন তিনি। কানাডায় ১৯৫০ সাল থেকে সে দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের আগের দিন নতুন জুতা কেনেন। সেই নতুন জুতা পায়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে যান, বাজেট পেশ করেন।
কানাডার ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এ বছর জুতা কিনেছেন মোড়ের দোকান থেকে। করোনা আক্রান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার প্রতীক হিসেবে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বাজেটের প্রতীক হলো ‘ব্রিফকেস’। আর এই ব্রিফকেসটি কেনা হয় অর্থ বিভাগের সেবা শাখার মাধ্যমে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৭.০৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৮৬০ কোটি টাকা বা ২৯.৬২ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ৮৬ হাজার ৭৯৮ কোটি; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৭৯ হাজার ২৬ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২২.৫৯ শতাংশ।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয়বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭.৮৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ-বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৮৫ শতাংশ; নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১.০৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ এবং বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করা হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু যা দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশের বেশি অবদান রাখবে মর্মে অর্থনীতিবিদেরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতারং আমরা আশাবাদী যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার ধারা অব্যাহতসহ আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করার পদক্ষেপের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব প্রস্তাবিত বাজেটের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যেমে।
লেখক: উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রজেক্ট, ঢাকা
আরও পড়ুন:সিলেটের বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সুরমা, কুশিয়ারা, ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি কমতে শুরু করায় ধীরে ধীরে বন্যার পানিও কমছে। আকস্মিক বন্যায় জেলার প্রায় পনেরোটি উপজেলা প্লাবিত হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দশ থেকে বারো লাখ মানুষ ছিল পানিবন্দি।
বন্যায় পানিবন্দি মানুষের অস্থায়ী দুর্ভোগ পোহাতে হয় দুই সময়। যখন বন্যায় পানিবন্দি থাকতে হয়, তখন এক ধরনের দুর্ভোগ। পানিবন্দি অবস্থায় অনেকের ঘরের ভিতর পানি ঢুকে পড়েছিল। হাঁটুপানি, কোমরপানি, গলা সমান পানি। কোনো কোনো জায়গায় ঘরবাড়ি ডুবে যায় পুরোপুরি। মানুষ অস্থায়ী মাচা বানিয়ে কিংবা বাড়ির ছাদে কোনো রকমে দুঃসহ সময় কাটিয়েছেন। ওদিকে তখন আবার বৃষ্টিও হয় কয়েকদিন। দুর্ভোগের ওপর আরও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বন্যার্তরা। তার ওপর ছিল ছিঁচকে চোর-ছিনতাইকারীর উপদ্রব।
সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ সেই অসহায় অবস্থা পেরিয়ে এসেছেন। এতদিনে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। কিছু জায়গায় পুরোপুরি নেমেও গিয়েছে।
বন্যার পানি নামার পর শুরু হয় দুর্ভোগের দ্বিতীয়পর্যায়। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। সঙ্গে আছে খাবার সংকট, ঘরবাড়ি মেরামত সংকট, সেনিটেশন সংকট। যে কারণে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরেও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ঘরে থাকা খাবারের মজুদ অনেক আগেই অনেকের ফুরিয়ে গিয়েছে। এ সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং তা সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা জরুরি। তারচেয়েও জরুরি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা।
যদিও চারধারে কেবল পানি আর পানি। বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘দ্য রাইম অব দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতার মতো- ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়ার অ্যান্ড নট আ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক।
বন্যার্তদের চারপাশে কেবল পানি আর পানি। কিন্তু এক ফোঁটাও পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানি নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে যেকোনো সময়।
বন্যার পর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু ভেঙে পড়ার আগেই যদি হাল ধরা না যায়, তবে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এমনকি বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
সিলেটের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সুপেয় পানির উৎস্য প্রধানত দুটো। গভীর নলকূপ এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা খাবার পানি। কিন্তু এই বন্যায় প্রায় ১২ হাজার নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জকিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সাড়ে ছয় হাজার মিটার পানি সরবরাহের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ৭৮ হাজার শৌচাগারও ক্ষতিগ্রস্ত। সিলেটের জনস্বাস্ব্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মতে, সবমিলিয়ে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।
বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছে সিলেটের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। মোবাইল ওটায়ার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। জেলার কানাইঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় এ কাজ চলছে। ট্রিটমেন্ট প্লান্টে ঘণ্টায় ৬০০ লিটার পানি পরিশোধন করে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পানি বিতরণ করা হচ্ছে।
এর বাইরে জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় ছয় লাখ ৬৩ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও দশ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এক হাজার ৪০০টি পানির জার ও ৯০০ বালতিও বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করেছে বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
এদিকে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বন্যার পানি থেকে জেগে ওঠা নলকূপ জীবাণুমুক্ত করার জন্য একটি পরামর্শ দিয়েছে। আটটি ধাপের এ পরামর্শ হচ্ছে- ধাপ ১: ১২ থেকে ১৫ লিটার পানি একটি বালতিতে নিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ভালোভাবে মেশাতে হবে।
ধাপ ২: একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মিশ্রণ ছেঁকে নিতে হবে। অথবা মিশ্রণটি স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ধাপ ৩: নলকূপের পাম্পের হাতল ও প্লাঞ্জার রড পাম্প থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
ধাপ ৪: মিশ্রণের অর্ধেক পানি পাম্পের ভিতর ঢালতে হবে।
ধাপ ৫: হাতল ও প্লাঞ্জার রড ভালোভাবে পরিষ্কার করে ময়লা ও কাদা সরিয়ে ফেলতে হবে।
ধাপ ৬: হাতল ও প্লাঞ্জার রড আবার স্থাপন করতে হবে। এবং ঘোলা পানি দূর না হওয়া পর্যন্ত পাম্প করে যেতে হবে।
ধাপ ৭: পাম্প করে পর্যাপ্ত পানি পাওয়ার পর অবশিষ্ট মিশ্রণ পাম্পের ভিতর ঢালতে হবে এবং ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরিনের গন্ধ থাকা পর্যন্ত পাম্প করতে হবে।
ধাপ ৮: নলকূপের আশেপাশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
কথা হলো, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সব মানুষের পক্ষে কি এসব ধাপ অনুসরণ করে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব? বিভিন্ন কারণে এটা সবসময় সম্ভব হয় না। আর সে কারণেই শুধু ধাপের উল্লেখ করে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সব এলাকায় পানি বিশুদ্ধ করার জন্য এসব উপকরণ সহজলভ্য না-ও হতে পারে।
দেশের যেকোনো সংকটময় সময়ে নানা মতের মানুষ এগিয়ে আসেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বন্যার্ত সিলেটবাসীর পাশে দাঁড়ানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি না। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও এগিয়ে আসতে পারে। পানি বিশুদ্ধকরণে এসব ধাপ অনুসরণ করে একে একে নলকূপগুলো থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার উপায় তো নিশ্চিত করতে পারে। তাতেও বন্যার্ত সিলেটবাসী উপকৃত হবে। অন্তত খাবার পানির সংকট তো কাটবে!
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, কলাম লেখক।
আরও পড়ুন:দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে বিদ্বেষ-বিরূপতা কমবে বলে কেউ কেউ আশা করছিলেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক এটা যদি আওয়ামী লীগ চায়, তাহলে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ওপর হামলা-মামলা কম হওয়াটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে ঘটছে তার বিপরীত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়ার কথা বলেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ছাত্রদলকে যেভাবে হামলার মুখে রেখেছে ছাত্রলীগ তাতে মনে হচ্ছে সরকার বিএনপির প্রতি নমনীয় অবস্থানে আসেনি! এর কারণ কী?
কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি নেতারা সরকার পতনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগও তাদের খুব ছাড় দেবে না। আর বিএনপি নেতারা উস্কানিমূলক কথা কম বললে পরীক্ষামূলকভাবে দলটিকে ছোট ছোট সভা-সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিতে চায়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে কোনো পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা বা কর্মসূচিকে সহজভাবে নেবে না ক্ষমতাসীন দল।
বিএনপি ও ছাত্রদলের ওপর সাম্প্রতিক হামলার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এবং উন্নয়নবিরোধী যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সুতরাং বিএনপি শান্তিপূর্ণ থাকলে আওয়ামী লীগ অশান্তি সৃষ্টি করতে যাবে কেন?
অপরদিকে, ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছেন, ইদানীং ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাঙচুর থেকে শুরু করে অছাত্র-বহিরাগতদের নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার অপকৌশল নিয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্রদলকে প্রতিহত করেছে। এখন থেকে সহিংসতার উদ্দেশ্যে ছাত্রদল যখনই ক্যাম্পাসে আসবে, তখনই তাদের প্রতিহত করা হবে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি ও ছাত্রদলকে চলতে হবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এঁকে দেয়া ‘শান্তিসীমানার’ মধ্যে। এটা কি সম্ভব? বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এ দলের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতার কারণে ক্ষমতার বাইরেও আছে বহু বছর ধরে। বিএনপির এখন অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা। তারা এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় দুটো। হয় নির্বাচনে জিততে হবে অথবা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি জিততে পারবে বলে মনে করে না।
তাদের ধারণা মানুষ ভোট দিলেও তাদের হারিয়ে দেয়া হবে কারসাজি করে। তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হঠানোর চেষ্টা কি বিএনপির সামনে? কিন্তু বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চাঙা করতে পারছে না। এই অবস্থায় কী করবে বিএনপি? কেউ কেউ মনে করেন, দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তাতে বিএনপির উচিত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য কিছু সময়ের জন্য হলেও সরকারের নিয়ন্ত্রিত পথেই হাঁটা। বড় বড় হুংকার না দিয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে সংগঠিত করা, তাদের আস্থায় আনা। কিন্তু বিএনপি সেটা সন্মানজনক বলে মনে করছে না। তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নীতিতে নয়, সংঘাতের নীতিতেই আগাতে চায়।
এক সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদল ও বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা ও বাধা এসেছে। লক্ষণীয় এটাই যে, এসব কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্যবস্তু করে বা খালেদা জিয়াকে নিয়ে তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের প্রতিবাদে। আবার একই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠন কিছু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পেরেছে, উগ্র বক্তব্য পরিহার করায়।
আওয়ামী লীগ যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব খর্ব হতে দিতে চায় না। আবার সম্প্রতি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়েছে। তারাও কিছুটা নিজেদের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিরও মেয়াদ শেষ, সম্মেলন আসন্ন। তাদের মধ্যেও নেতৃত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে তৎক্ষণাৎ কড়া জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
হঠাৎ বিএনপি উত্তেজিত হয়ে উঠলো কেন, তার কারণ অনুসন্ধানে এটা সামনে আসে যে, ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অতীতে দেয়া বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে একপর্যায়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে।
সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসাচ্ছে, এগুলো তার কাছে ছিল জোড়াতালি দেয়া। বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে কিছু দোসরেরাও…তাদেরকে এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেয়া উচিত।’
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিএনপিকে উত্তেজিত করেছে। এটাকে তারা খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি হিসেবে দেখে এর প্রতিবাদ করতে থাকে। ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রদল প্রতিবাদ সমাবেশ করে খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে। সেখানে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় টিএসসিতে ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
ছাত্রদল তাদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই দিন সকালে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি যাওয়ার পথে শহীদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়। এই হামলার প্রতিবাদে ছাত্রদল গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়। সেদিন তারা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে আবারও ছাত্রলীগ হামলা করে। একপর্যায়ে ছাত্রদলের একাংশ সুপ্রিম কোর্ট ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লে সেখানেও তাদের পেটানো হয়।
একই দিন ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি’র প্রতিবাদে খুলনা মহানগর ও পটুয়াখালী জেলা বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা হয়। পটুয়াখালীতে হামলা করে ছাত্রলীগ আর খুলনায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এরপর বরিশালে পুলিশি বাধায় ছাত্রদলের মিছিল পণ্ড হলেও ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যুবদল সমাবেশ করেছে। তাদের কোনো বাধা দেয়া হয়নি।
নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। এই লক্ষ্যে রাজপথের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরিতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু করেছে। এই সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনায় মাঠে তৎপরতা বেড়েছে তাদের।
বিএনপি মনে করছে, যেভাবেই হোক দীর্ঘদিন পরে তাদের চলমান আন্দোলনে গতি এসেছে, জনসমর্থনও বেড়েছে। আন্দোলনের এই গতিকে তারা ধরে রাখবে। এখান থেকেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য: সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপরদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন দামসহ নানা কারণে দেশের মানুষও অতিষ্ঠ। এই প্রেক্ষাপটে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বর্তমানে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা হয়েছে। মামলা-হামলা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন দমানো যাবে না বলে তাদের বিশ্বাস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং এটা চলবে। সমমনা দলগুলো বিএনপির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন ইতোমধ্যে সমমনা দলগুলো ছাত্রদলের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিএনপি বড় দল হিসেবে চেষ্টা করছে, আন্দোলন যে গতি পেয়েছে, সেটাকে অব্যাহত রাখতে। ধরপাকড়, মামলা-মোকদ্দমায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নেতাকর্মীরা এ নিয়ে আর কিছু মনে করে না।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘এত দিন সরকার নানাভাবে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। খালেদা জিয়াকে কটূক্তি করার প্রতিবাদে ছাত্রদল মিছিল করেছে। এরপর যে ঘটনা সরকার ঘটিয়েছে, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, কোনো পূর্ব প্রস্তুতির প্রশ্নই ওঠে না। সরকারের ভীতির জায়গা থেকে এই ঘটনা ঘটেছে।’
বিএনপির নেতা চলমান সংঘাতকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনে করছেন। সারা দেশের মানুষ এখন নানা কারণে নিষ্পেষিত, দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেই অস্থিরতার জায়গা থেকে যেকোনো সময় মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে। আন্দোলন চলমান রয়েছে এবং সেখানে প্রধান দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা থাকবেই।
‘মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে’ বলে বিএনপি নেতাদের যে আশা তার বাস্তব লক্ষণ এখন পর্যন্ত কোথাও দেখা যায়নি। আর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও কোনো নতুন চিন্তার কথা শোনা যায় না। তাই এখন শুধু দেখার পালা, কে কীভাবে সামনে আগায়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আরও পড়ুন:১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, সেটাই বার বার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। সেই ’৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই ঘাতকের নিশানায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। নানা সময়ে নানাস্থানে তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কখনও সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কখনও বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং তাদের অনুসারীদের মদদে কখনওবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধনে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। প্রতিটি ষড়যন্ত্রের পর রাজনৈতিক যোগসূত্র মিলে যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি দলগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে। কোনো কোনো হত্যাচেষ্টায় আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘শত্রুর শত্রু, সে আমার মিত্র’ এই আদর্শে ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নানা সময়ে এই পর্যন্ত ২১ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড-বোমা ও গুলির হামলা হয়েছে।
হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রকাশ্যে দুবার, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারবার, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারবার, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে চারবার, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার ও আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক সময়ে চারবার হত্যাচেষ্টার কথা জানা যায়। খোদ, ঢাকাতেই শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয় কয়েকবার। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরেও তাকে একাধিকবার হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে। ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এখনও তাড়া করে ফিরছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। প্রতিটি হামলায় হত্যাকারীদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বার বার বুলেট-বোমা তাড়া করে বেড়ায় তাকে? কেন বার বার হত্যাকারীদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা? এসব হামলার ঘটনায় ৬৬ দলীয় নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। পঙ্গুত্ববরণ করেছে শত শত নেতা-কর্মী।
প্রথমবার হামলা হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। এই হামলায় ২৮ নেতাকর্মী প্রাণ হারান। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার জীবন বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করে ৯ নেতাকর্মী আত্মাহুতি দেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি নীলনকশা আর জঙ্গিবাদ উত্থানের ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন; নিহত হন আওয়ামী মহিলা লীগের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। মহান সৃষ্টিকর্তার পরম কৃপায় এই হত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো ব্যর্থ হয়।
২০০১ সালের ৩০ মে তেমনি একটি দিন। সেদিন খুলনার রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ঘাতকচক্র সেখানে একটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। পরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হরকাতুল জিহাদ। অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদীতে দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল ৩০ মের অনুষ্ঠান। গোয়েন্দা তৎপরতায় ঘাতকের সেই মিশনও সফল হয়নি। ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নেয়। গ্রেপ্তারকৃতদের ভাষ্যে- কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ।
একই সময় গ্রেপ্তার হওয়া অপর জঙ্গি কুতুবউদ্দিন ওরফে বাবুর বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার কেষ্টপুরে। ২১ আগস্ট হামলা মামলার সে দুই নম্বর আসামি এবং হুজির আঞ্চলিক নেতা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়েরের ঘনিষ্ঠজন। উল্লেখ্য, এর আগে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। একই বছর সিলেটেও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী। সাজাপ্রাপ্ত হুজির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি হান্নান স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কোটালিপাড়া, খুলনা ও সিলেটে হামলা।
খুলনার রূপসা সেতুর ঘটনার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক, বুট ও বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারদের ভাষ্য ও এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনাকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ও অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার পরিকল্পনা জঙ্গিদের হলেও তাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় ছিল সরকারবিরোধী স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু নেতাকর্মী।
বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে কেউ কেউ স্বীকার করেছে, তারা শেখ হাসিনাকে ইসলামের শত্রু মনে করে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামের অনেক ক্ষতি করেছে, তাই হুজির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।
এরকম বাস্তবতায় তথা ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র ও জঙ্গিবাদ আশঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের নাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি-সন্ত্রাস-জটিলতার মধ্যেও পাল্টে যাচ্ছে দেশের চিত্র। কোনো চক্রান্ত্রই থামাতে পারছে না শেখ হাসিনার উন্নয়নরথ। তার হাত ধরে নির্মিত হচ্ছে আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজ- ইজ অ্যা মিরাকল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়- ‘উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। কোনো কোনো সূচকে ভারত থেকেও এগিয়ে।’
সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা জাতিকে ঐতিহাসিক দায়মুক্তি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন করে জাতির কলঙ্কমোচন করেছেন। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব, চারলেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রাজধানীর চারপাশে স্যুয়ারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা-জ্বালানি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন।
সহজ করে বললে, বঙ্গবন্ধু ভৌগোলিক মুক্তি দিয়ে গেলেও এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি শেখ হাসিনার হাত ধরেই হচ্ছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে, হচ্ছে শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন বলেই। কোনো ষড়যন্ত্রই দমাতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও ওঁৎপেতে আছে প্রতিশোধের। পঁচাত্তরের ঘাতকবাহিনী, যারা হত্যা করেছে পিতা-মাতা-ভাইসহ স্বজনদের, তারা চায় শেখ হাসিনার বিনাশ। তাকে নির্মূল করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানি ধারায় দেশ ফিরিয়ে নিতে চায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দেশটাকে তারা পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সেখান থেকে আজকের রূপে এনেছে স্বাধীনতার স্বপ্নবাহী পথে। সেই পথ অনেক চড়াই-উৎরাই। সেসব পথ মাড়িয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন।
আদর্শিক বিরোধের কারণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নির্মূল চেষ্টার এমন পাশবিক ঘটনা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। শেখ হাসিনা বারবার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা এক বহ্নিশিখা। তিনি মানবতার জননী। বাঙালির আশার বাতিঘর। তিনি তার জীবনকে বাংলার মেহনতি দুঃখী মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব মানবতার দিকে দুর্বার গতিতে। গণমানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির মূল দর্শন।
১৯৮১ সালের শুরুতে দলের দায়িত্ব নিয়ে দলকে তিনি শুধু চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ই আনেননি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে যেমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এখন তিনি। তার হাতে বাঙালি রাষ্ট্র ও বাঙালির সংস্কৃতি নিরাপদ।
জঙ্গিবাদকে নির্মূল ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আর এ কারণেই তার নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে ঘাতকচক্র। কিন্তু জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত তিনি অপ্রতিরোধ্য অদম্য বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন। কোনো ভয়-ভীতি তাকে কাবু করতে পারে না। জাতিকে তিনি অভয়মাঝে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। জয় হোক অভয়ের।
লেখক: সাংবাদিক
আরও পড়ুন:এক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম- নিজের ঘরের সামনে বরফ জমে থাকলেও কোনো খবর থাকে না, অথচ অন্যের ঘরের সামনের কাদা পরিষ্কার নিয়ে যত মাথাব্যথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর বর্তমানে যে অবস্থা তা দেখে আমার সেই বিখ্যাত লেখকের উক্তিটিই মনে পড়ে গেল। সম্প্রতি টেক্সাসের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বন্দুকধারী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৯ শিশুসহ মোট ২১ জনকে হত্যা করেছে। এরকম হৃদয়বিদারক ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড আফ্রিকার কিছু গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছাড়া বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই।
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসেবে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছে তা এ ঘটনায় প্রকাশ পেল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম গণগোলাগুলি (ম্যাস শুটিং) বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এরকম ঘটনা এখানে মাঝেমধ্যেই, বলা যায় নিয়মিত বিরতি দিয়ে ঘটে। এই স্কুল শুটিংয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক রাজ্যের বাফেলো শহরের একটি শপিং মলে গণগোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানেও দশজন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হন। শুধু তাই নয়, এরকম ভয়াবহ গণ গোলাগুলি ছাড়াও এই সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং বেশ কয়েকজন মারাও গেছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলে এরকম গণগোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল এবং সেখানেও বিশ ছাত্র নিহত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে এরকম বন্দুক নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখানে এমন কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেদিন বন্দুকধারীর গুলিতে কেউ নিহত বা আহত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যেভাবে প্রতিদিন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং বন্দুকধারীর গুলিতে মানুষ মারা যায় তেমনটা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটে কি না আমার জানা নেই।
এসব ভয়াবহ বিশেষকরে ম্যাস শুটিং ঘটনার নেপথ্যের সঠিক কারণ কখনই সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘাতকদের গুলি করে মেরে ফেলে, যাকে আমাদের দেশের ভাষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এই টেক্সাসের স্কুল শুটিং যে বালক ঘটিয়েছে তাকেও পুলিশ আটক না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গুলি করে মেরে ফেলেছে। নভাস্কশিয়ার সেই হত্যাকারী ১৭ বছরের বালককেও পুলিশ আটক না করে গুলি করে মেরে ফেলে। হত্যাকারীকে আটক না করে এভাবে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটে। এছাড়া উপায়ও নেই। কারণ পুলিশ ভালো করেই জানে যে তাদের আটক করে জেলে ভরলে তারা জামিনে বেরিয়ে এসে একই কাণ্ড ঘটাবে।
সবচেয়ে বড় কথা এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো সমালোচনা বা আন্দোলন সংগ্রামও নেই। এক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে কী ভয়ানক আন্দোলন শুরু হয়েছিল কারণ তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আসন্ন ছিল এবং এর পিছনে কিছু ভোটের হিসাবনিকাশ ছিল। এখন ১৯ জন শিশু সন্তানকে এভাবে প্রাণ হারানোর পরেও কোনো আন্দোলন নেই। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা মন্ত্রী বা কোন জনপ্রতিনিধির পদত্যাগের দাবিও নেই। এমনকি এসব লোমহর্ষক গণগোলগুলির পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা নীতিনির্ধারকদের এতটুকু সৎসাহস হয়নি যে এই মুহূর্তে ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য বন্দুক ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। আমাদের দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোর আলোচকরা কী বলবেন জানি না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণগোলাগুলিসহ প্রতিদিনই শুটিংয়ের ঘটনা ঘটছে এবং এসব গোলাগুলির ঘটনায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এসব ঘটনা বন্ধ করতে পারছে না এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে পারছে না তাই তাদের এখন অন্য কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনোরকম মন্তব্য করা শোভা পায় না। যে অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাবের কয়েক সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেই অবস্থা এখন তার দেশে অতি বেশি মাত্রায় বিরাজমান। তাই তাদের উচিত এই নিষেধাজ্ঞা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া। তাদের বোঝা উচিত এবং বুঝতেও পারছে যে, মানবাধিকার শুধু যারা মানুষ এবং মানবিক তাদের জন্য।
সমস্যা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কখনই তার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে না। এই অবস্থা আমরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দেখেছি এবং পঞ্চাশ বছর পরে এসে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও দেখছি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আমাদের পক্ষে থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং নীতিনির্ধারক আমাদের বিপক্ষে গণহত্যা সংঘটনকারী পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি বন্দুক নিয়ন্ত্রণ (গান কন্ট্রোল) করা অর্থাৎ খেলনা পিস্তলের মতো এভাবে খোলাবাজারে কেনাবেচা এবং সাধারণ মানুষের হাতে বন্দুক রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। মোটকথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ব্যাতিরেকে কোনো সাধারণ নাগরিক বন্দুক কিনতে বা রাখতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশে কেন সাধারণ নাগরিকের ব্যাক্তিগতভাবে বন্দুক রাখার সুযোগ থাকবে?
লেখক: ব্যাংকার-কলাম লেখক। টরনটো, কানাডা-প্রবাসী
আরও পড়ুন:
মন্তব্য