এক পা দিয়ে লিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন যশোরের অদম্য মেধাবী তামান্না আক্তার। এমন সাফল্যে তাকে ফোন করে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
এবার তামান্না গুচ্ছভুক্ত ২২ সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরীক্ষায় তামান্না ৪৮ দশমিক ২৫ নম্বর পেয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলেও ব্যবহার করেননি প্রতিবন্ধী কোটা।
তার এমন সিদ্ধান্তে প্রশংসায় ভাসছেন তামান্না আক্তার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবি আপলোড দিয়ে অনেকেই বলছেন, এটি সমাজের সমতার সুন্দর নিদর্শন।
তামান্না আক্তারের ইচ্ছা, তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ভর্তি হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামান্না যদি প্রতিবন্ধী কোটায় পরীক্ষা দিতেন, তাহলে এই নম্বরেই তিনি যবিপ্রবিতে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেতেন। এই নম্বর নিয়ে তিনি ভর্তি হতে পারবেন কি না এখনও বলা যাচ্ছে না।
তবে আশা হারাচ্ছেন না অদম্য এই তরুণী তামান্না। দু-এক দিনের মধ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চয়েজ দেবেন, নির্বাচন করবেন যবিপ্রবির মাইক্রোবায়োলজি বিষয়টিকেই।
গত ৩০ জুলাই গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দেন। ‘ক’ ইউনিটে এবার পাসের হার ৫৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
তামান্নার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুর গ্রামে। তার বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার ছোট পৌদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তাদের তিন ছেলেমেয়ে। তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণির ছাত্র।
অদম্য এই তরুণী শুধু একটি পা দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সবকটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। তার এই সাফল্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা খোঁজখবর নেন। একই সঙ্গে তারা দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন। তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থাও করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।
মেধাতালিকায় প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হওয়ায় আনন্দিত তামান্না। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তামান্না বলেন, ‘২২ সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছি। আমি ৪৮ দশমিক ২৫ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় আছি। দুই-এক দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবজেক্ট চয়েজ দেব।’
তিনি বলেন, ‘আমি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে পড়তে চাই। আমি এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হতে চাই।’
তামান্না আরও বলেন, ‘এর আগে সাধারণ কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। অনেক বান্ধবী-শিক্ষক বলেছেন, প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে। কিন্তু আমি নিজের যোগ্যতা আর সবার দোয়ায় এই পর্যন্ত এসেছি। নিজের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাব বলে প্রত্যাশা করি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’
তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, তামান্নার স্বপ্ন গবেষণাধর্মী কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি নেয়ার। স্বপ্ন পূরণে কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও হয়নি কোটায় পরীক্ষা না দেয়ায়।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেছিলেন তামান্না প্রতিবন্ধী কোটা ব্যবহার করলে যেকোনো বিষয়ে চান্স হয়ে যেত। এবার সে যবিপ্রবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় আছে।’
রওশন আলী বলেন, ‘যবিপ্রবিতে চান্স হলে সেটা তামান্না আর আমাদের পরিবারের জন্য ভালো। কেননা সে পরিবার ছাড়া থাকতে পারবে না। সেই বিবেচনায় যবিপ্রবিতে ভর্তি হলে তার জন্য সুবিধা হবে।’
এ ছাড়া তার স্বল্প বেতনের চাকরি ও টিউশনিতে তামান্নাকে পরিবারের বাইরে রেখে পড়াশোনা করানো তার পক্ষে কঠিন বলেও জানান তিনি।
যবিপ্রবির সহকারী পরিচালক (গণসংযোগ) আব্দুর রশিদ অর্ণব বলেন, ‘তামান্নার প্রতিবন্ধী কোটায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগ নেয়নি। নিজের মেধার জোরে সে পড়াশোনা করতে চায়। তার এই অদম্য ছুটে চলা অবশ্যই প্রশংসিত।’
যশোরের শিক্ষাবিদ ড. মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ও সরকারি চাকরিতে কোটা এখন প্রচলিত ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এটি ব্যবহার করে অনেক অযোগ্য লোক যোগ্য স্থানে যাচ্ছে। তার মধ্যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জন্মগতভাবেই দুই হাত ও এক পা-বিহীন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন তামান্না আক্তার। সে ইচ্ছা করলে প্রতিবন্ধী কোটা ব্যবহার করতে পারত। মেধার জোর দিয়ে সে অনেক দূর যেতে চায়। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক প্রশসিংত।’