বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইউরোপে বাংলাদেশকে তুলে ধরছে মেহেদীর ন্যাচারক্রাফট

  •    
  • ২ মে, ২০২২ ০৮:৪২

মেহেদী বলেন, ‘কী নিয়ে কাজ করা যায়, এমন ভাবতে ভাবতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা সেই অ্যাসাইনমেন্টের কথা মাথায় আসে। এরপর চাকরির পাশাপাশি পণ্যগুলোর ব্যাপারে খুঁটিনাটি সব জানার চেষ্টা করলাম। মোটামুটি ধারণা পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে নিজে কারখানা তৈরি করে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি শুরু করি।’

পোশাক কারখানায় ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামবেন বলে পরিবারের সদস্যরা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। বন্ধুরা কাটত টিপ্পনী। তবে থেমে থাকেননি তিনি। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখন তিনি একজন সফল রপ্তানিকারক। সচ্ছল জীবনযাপনের পাশাপাশি করেছেন তিন হাজারেরও বেশি মানুষের জীবিকার সংস্থান।

তার নাম মেহেদী হাসান। পড়াশোনা করেছেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ক্লাসে অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে হোগলাপাতা, পাট, বেত, বাঁশ, শন, খেজুরপাতাসহ নানা উপকরণ নিয়ে পণ্য বাজারজাতকরণের সুবিধা সম্পর্কে লেখেন। যোগ দেন পোশাক কারখানায়।

এক বছর চাকরি করার পর আর ভালো লাগছিল না। চাকরি ছেড়ে নিজের করা অ্যাসাইনমেন্টকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চ্যালেঞ্জে নেমে সফল হয়েছেন। তার কারখানার পণ্যের ক্রেতা এখন ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা।

মেহেদীর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ন্যাচারক্রাফট বাংলাদেশ’।

গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রম লেভেল ক্রসিংয়ের ৫০ গজ পশ্চিমে মেহেদী হাসানের প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। ২০১৭ সালের শেষ দিকে ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ বা পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির কারখানাটি খোলেন তিনি। মাত্র তিনজন নিয়ে শুরু। এখন সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে তিন হাজারের বেশি মানুষের।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঁচামাল হিসেবে সংগ্রহ করা হয় পচনশীল হোগলাপাতা, পাট, বেত, বাঁশ, শন, খেজুরপাতাসহ নানা উপাদান। পরে সেসব উপাদান প্রক্রিয়াজাতকরণের পর তা দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি, ফুলের টব, পাপোশ, ম্যাট, বাটি, ব্যাগসহ ঘর সাজানোর ১৫ থেকে ২০ ধরনের পণ্য। এসব পণ্য আবার রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের মোট ৩২টি দেশে। সব মিলিয়ে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার পণ্য পাঠাচ্ছেন তিনি।

ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট থেকে শুরু

প্রতিষ্ঠানটি তৈরির পেছনে রয়েছে মেহেদী হাসানের চমৎকার একটি গল্প। ২০১১ সালে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। পরিবারের ইচ্ছা ছিল তিনি পড়বেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এ কারণে জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে ভর্তি হন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে।

মেহেদী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার উন্মুক্ত অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়। সেদিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় অন্য বন্ধুরা অ্যাসাইনমেন্টের সব পছন্দের বিষয় বেছে নেয়। তাৎক্ষণিক জুতসই কোনো বিষয় মাথায় আসছিল না। ইন্টারনেট ঘেঁটে হোগলাপাতার ঝুড়ি, খেজুরপাতার পাটি, শণ বা বাঁশ-বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর অ্যাসাইনমেন্ট লিখে ফেলেন তিনি। শিক্ষকদের কাছে বেশ পছন্দ হয়েছিল সেই অ্যাসাইনমেন্ট।

২০১৬ সালে পড়াশোনা শেষ হলে একটি পোশাক কারখানায় চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে চাকরি ছেড়ে নিজেই খুলে বসেন ‘ন্যাচারক্রাফট বাংলাদেশ’।

কারখানাটিতে গিয়ে প্রায় ৩০০ শ্রমিকের কর্মব্যস্ততা দেখা গেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। কেউ মেশিনে সেলাইয়ের কাজ করছেন, কেউ পণ্য তৈরির কাঁচামাল রোদে শুকাচ্ছেন। কেউবা পণ্য মোড়কজাতের কাজে করছেন। পাশাপাশি চলছিল শ্রমিকদের গল্প, আড্ডা।

নিজের গড়ে তোলা স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের শুরুর গল্প নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলাম। তবে চাকরিতে মন বসছিল না। বারবারই মনে হচ্ছিল, নিজের মেধা ও শ্রমের চেয়ে পারিশ্রমিক কম পাচ্ছি। কী নিয়ে কাজ করা যায়, এমন ভাবতে ভাবতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা সেই অ্যাসাইনমেন্টের কথা মাথায় আসে।

‘এরপর চাকরির পাশাপাশি পণ্যগুলোর ব্যাপারে খুঁটিনাটি সব জানার চেষ্টা করলাম। মোটামুটি ধারণা পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে নিজে কারখানা তৈরি করে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি শুরু করি।

‘শুরুতে মাত্র তিনজন কর্মী ছিল। এখন গাজীপুরের ধীরাশ্রম এলাকায় মূল কারখানা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় আছে আরও সাতটি সাব-স্টেশন। সব স্টেশন মিলিয়ে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩২০০।’

মেহেদী জানান, তার কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি, ফুলের টব, পাপোশ, ম্যাট, বাটি, ব্যাগসহ তৈরি হয় ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ। যশোর, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় কাঁচামাল।

তিনি বলেন, ‘উৎপাদিত পণ্যগুলোর ক্রয়াদেশ আসে বিদেশ থেকে। এসব পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ৩২টি দেশে।’

শুরুতে পাশে পাননি পরিবার, বন্ধুদের

উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানান চড়াই-উতরাইয়ের ঘটনাও জানান মেহেদী।

তিনি বলেন, ‘পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাইনি। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেয়ায় পরিবারের সদস্যরা কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। অন্যদিকে কারখানা শুরু করতে ঋণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হই। কিন্তু কেউ কোনো ঋণ দেয়নি। কেউ আসলে বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু বর্তমানে আমি সফল। আমাকে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না।’

নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মেহেদি বলেন, শুধু বাংলাদেশ না, পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো ‘হ্যান্ডিক্রাফট কম্পোজিট ফ্যাক্টরি’ আছে বলে আমার জানা নাই। আমি চাই এটি আমার হাত ধরে আসুক।’

কারখানায় নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে জানিয়ে মেহেদী বলেন, ‘ন্যাচারক্রাফট বাংলাদেশের শ্রমিকদের ৯০ শতাংশই নারী। আমরা বিশ্বাস করি নারীদের যদি অর্থনীতিতে সক্রিয় করতে পারি তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে। অর্থনীতিতে নারীরা অবদান রাখতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।’

তিনি জানান, নতুন কেউ কাজ শুরুর আগে তাকে দেয়া হয় তিন মাসের প্রশিক্ষণ। কোন পণ্য কীভাবে তৈরি করতে হবে, কখন তৈরি করতে হবে, প্রশিক্ষণে এসব শেখানো হয়। প্রশিক্ষণের এই সময়ও বেতন পান শ্রমিকরা।

এ বিভাগের আরো খবর