জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২তম আবর্তনে (ব্যাচ) র্যাগের আয়োজন নিয়ে চলছে তুমুল তর্কবিতর্ক। ক্যাম্পাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিতর্কে যোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের নৃত্যানুষ্ঠানে অশালীনতার অভিযোগ তুলছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একাংশ। তাদের অভিযোগ, এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাংস্কৃতিক মান’ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
তবে এর বিরোধিতা করে আরেকটি অংশ বলছে, বিতর্ক ছড়ানো হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। একটি সাধারণ নাচকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মানসিক সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম আবর্তনে র্যাগের অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনুষ্ঠানে একটি হিন্দি গানের সঙ্গে দুই শিক্ষার্থীর নাচের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মূল পরিবেশনাটি একটি হিন্দি গানের সঙ্গে হলেও পরে সেটি একটি বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত করেও প্রচার হচ্ছে।
ট্যাঙ্গো নাচের ভঙ্গিমায় এই নৃত্যায়োজনে নারী শিক্ষার্থীর পোশাক ও ধারণ করা ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ভিডিওতে দেখা যায়, যুগল নাচে নারী শিক্ষার্থীর পরনে ছিল ফ্রক ও স্কিন কালার টাইটস।
এ ধরনের আয়োজনে চরম ক্ষুব্ধ ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ মল্লিক। ২৬তম আবর্তনের শিক্ষার্থী মারুফ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ক্যাম্পাসে রুচিশীলতার চরম অধঃপতন ঘটছে। এটা শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার জন্যই প্রযোজ্য। যে ভাষায় এখন শিক্ষার্থীরা কথা বলে, আনন্দ প্রকাশ করে বা শিক্ষকদের যেসব কীর্তির কথা শুনি তা স্পষ্টতই মানসিক বিকারগ্রস্ততার প্রমাণ।’
মারুফ মল্লিক বলেন, ‘অনলাইনে সরাসরি র্যাগ উৎসব দেখলাম। মান দেখে আমি খুবই আহত হইছি। আমরাও র্যাগ করছি। আমাদের সময় নানা ধরনের সংকট ছিল। কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি মান বজায় রাখতে।’
‘গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উপলক্ষে যা দেখছি তা খুবই হতাশাজনক। একটা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে জাবিয়ানদের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। অশ্লীলতা, মানহীন কথোপকখন কখনই আনন্দ প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না।’
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ৪০তম আবর্তনের শিক্ষার্থী মাজেদ সীমান্ত লিখেছেন, ‘র্যাগের প্রোগ্রামে অনেকগুলো সিঙ্গেল, কাপল, দলীয় নাচ হয়েছে। ভিডিওতে দেখলাম, বেশ সুন্দর হয়েছে। যে নাচটা নিয়ে কথা উঠেছে সব জায়গায় সেখানে নিশ্চয় সমস্যা হয়েছে বলেই কথা উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে সেটাই স্বাভাবিক। ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে যেটা অপসংস্কৃতি/অশ্লীল সেটা আপনাদের ১০ জনের কাছে শ্লীল হইলেই হয়ে যাবে কি?’
৪৪তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আখলাক হোসেন লিখেছেন, ‘৭টা বছর ক্যাম্পাসে আছি, ১০ তারিখ রাতের মতো নোংরা আর সস্তা কন্টেন্টের প্রোগ্রাম দেখি নাই। ৪২ ব্যাচের বড় ভাই আপুরা সেরা, আমার দেখা অন্যতম সেরা ব্যাচ। কিন্তু যেই স্ট্যান্ডার্ডের প্রোগ্রাম তারা ডেলিভার করলেন, তা পরবর্তী প্রোগ্রামগুলোর জন্য হুমকিই বলবো। সেক্সুয়াল কন্টেন্ট আর্ট হতেই পারে। কিন্তু সেটা যদি সেভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তবেই এ রকম একটা মঞ্চে মঞ্চস্থ হতে পারে। আপনারা যা করলেন ভাই, তা আর্ট ও হয় নাই, সেক্স ও হয় নাই। মানে কোনো দিক দিয়ে এটা মজারও ছিলো না আবার **** সুরসুরিও দেয় নাই।’
তবে ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের আয়োজনকে সমর্থন করেও ফেসবুকে ঝড় তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাজু নুরুল লিখেছেন, ‘ধরেন, জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ্চে ওখানকার ছেলেমেয়েরা না, নাচছে ভারতের নোরা ফাতেহী। আবার এইটা বইলেন না যে, নোরা ফাতেহীকে চিনেন না! টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা। আজ সেই একই মুক্তমঞ্চে কি তিল ধারনের জায়গা থাকতো? বুকে হাত দিয়া বলেন তো? সিনিয়র থেকে জুনিয়র - পারলে কিডনি বেচে হলেও মুক্তমঞ্চের সিট বুকিং দিতে ঝাপাইয়া পড়তো না?
‘তাইলে কি দাঁড়াইলো ব্যাপারটা? নোরা ফাতেহী ভারত থেকে আইসা কয়েক কোটি টাকা সম্মানি নিয়ে, মোটামুটি প্রেসিডেন্ট লেভেলের নিরাপত্তা বেস্টনিতে থাইকা, প্রায় কিছু না পরে মুক্তমঞ্চে নাচতে পারবে, ওইটা আন্তর্জাতিক মানের হাই ক্লাস শিল্প, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের রর্যাগে, ৪২ ব্যাচের ছাত্রী তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে স্কিন কালারের লেগিংস আর স্লিভলেস ফ্রক পইরা নাচতে পারবে না? সেই নাচ দেইখা আপনার নিচের দিকে ধুকুরপুকুর শুরু হয়ে যাবে? দেশের সংস্কৃতি রসাতলে চলে গেল বলে হায় হায় রব উঠে গেল? কামডা কি ঠিক হইলো বাবাজি?’
তিনি আরও লেখেন, ‘অথচ একই মঞ্চে কম পোশাক পরে একটা ছেলে যখন নাচছে, একটা ছেলে ঠিক না, অনেকগুলো ছেলে যখন নাচলো, ওদের মাসলড শরীরের উপরের দিকে প্রায় সামান্য পোশাক, ওইটা নিয়া আপনার কোনও আপত্তি নাই৷ তার মানে কি এইটা যে, সেক্স ব্যাপারটা শুধু ছেলেদের ডিপার্টমেন্ট? মেয়েরা সেক্সুয়ালি আপিলড হয় না? আর আপনি কিনা দাবি করছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন কিংবা পড়েছেন? স্যরি, নিতে পারলাম না ভাই। কারণ আপনার দাবিখানার সাথে মামুনুল হকদের দাবির যে সঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছি আমি? ঠিক এইটাই ওনাদের দাবি না? বহুদিন ধইরা?’
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৩০তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ফারদীন ফেরদৌস লিখেছেন, ‘না দেখে বলতে পারছিলাম না। এখন দেখলাম। কোনো সমস্যা দেখছি না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২ এর শিক্ষা সমাপনী উৎসব (র্যাগ) উপলক্ষে মুক্তমঞ্চে নাচ হয়েছে। নাচের মতোই নাচ হয়েছে। অবশ্যই নাচটি সমকালীন ও আনন্দকর হয়েছে। সংকীর্ণমনাদের কাছে কোনো নাচই ভালো ঠেকবে না।
‘কিন্তু তারা সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওই ড্যান্সটা দেখতেও থাকবে। ইউটিউব/ফেসবুকে সোরগোলও তুলবে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘৪২ এর ব্যাপারে আমাদের বাতুলতা খাটে না এইজন্য যে, ওরা ওদের জন্য শিল্পের পসরা সাজিয়েছিল। অন্যদের জন্য নয়। শিল্পের স্বরূপ লক্ষণ হলো আনন্দ। শিল্পবস্তু (কনটেন্ট) যাই হোক না কেন তা থেকে রস আহরণ করাই হল রসিকের কাজ-রসিকজনার বৃত্তি। আমরা যারা মুক্তমঞ্চের ড্যান্স থেকে অশান্তি কুড়াচ্ছি তারা রসিক তো নই-ই, শিল্পকর্মের রসোপলব্ধিতে সহৃদয় সামাজিক মানুষও নই।’
গণিত বিভাগের ৩৪তম আবর্তনের শিক্ষার্থী কৌশিক আজাদ প্রণয় লিখেছেন, ‘আশি বা নব্বই দশকের বাংলা মুভিকেও আমরা সুস্থ বিনোদন বলি। যদি একজন নায়ক ও নায়িকার নাচের দৃশ্যকে সহজভাবে নিতে পারি আর নন্দন সংস্কৃতির আধুনিকতা মানতে পারি, তাহলে এ রকম নন্দন শিল্পের প্রকাশকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতিবাচক ভাবে দেখার মানে কী?
‘৪২তম ব্যাচের র্যাগ উদযাপনে একটা নাচের দৃশ্য দেখলাম। যতদূর দেখলাম ছেলে মেয়ে দুজন তো খারাপ কোরিওগ্রাফি করেনি। আমি জানি না বাকি প্রোগ্রামের কী অবস্থা। যদি কোনো কথা বার্তা বা অন্য কিছুতে অশ্লীলতা থাকে তা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে নাচের মূদ্রা বা পোশাককে এভাবে নেতিবাচকভাবে খুঁটিয়ে না দেখে ওদের নির্মাণশৈলীকে বাহবা দেয়া উচিত। আমাদের এই দুই চোখই কিন্তু একই গানে সেলুলয়েড স্ক্রিনে- স্যাটেলাইটে এইরকম কোরিওগ্রাফিকে নান্দনিকভাবেই গ্রহণ করে।’
যার ধারণ করা ভিডিও নিয়ে এত আলোচনা
মুক্তমঞ্চের নৃত্যানুষ্ঠানের আলোচিত ভিডিওটি ছড়িয়েছে একটি ফেসবুক লাইভ থেকে। লাইভটি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ।
জাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ৪২-এর অনেক বন্ধুরা চাকরি, দেশের বাইরে থাকার কারণে প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতে পারেনি। তারা পুরো প্রোগ্রাম লাইভ করার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিল। তাই আমি করেছি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘একটি ভূঁইফোঁড় নিউজপোর্টাল উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার প্রোফাইল থেকে বিনা অনুমতিতে ভিডিওটির একটি অংশ কেটে নিয়ে সস্তা বি গ্রেডের বাংলা গান যুক্ত করে দেয়। সেই ভিডিওটি পরে ভাইরাল হয়।’
৪২তম আবর্তনের র্যাগ উৎসবের আহ্বায়ক ইসমাইল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সাংস্কৃতিক কমিটি ক্যাম্পাস ছাড়াও ক্যাম্পাসের বাইরের এবং দেশের বাইরের দর্শকদের কথা চিন্তা করে এমন আয়োজন করেছিল। আমাদের দর্শকরা মুক্তমঞ্চে পুরোটা সময়ই আগ্রহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
‘আমাদের প্রোগ্রামের নাচের একটি অংশ এডিট করে বিনা অনুমতিতে প্রচার করা হয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনিগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছি। তারা আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে।’
আলোচনার কেন্দ্রে থাকা শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ
যে নাচটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল বিতর্ক চলছে তাতে অংশ নেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী নিগার সুলতানা তৃষা ও চারুকলা বিভাগের আসিফ আল নূর রাতুল।
‘পেয়্যার কি ইয়ে কাহানি সুনো’ গানের সঙ্গে নাচে অংশ নেন তারা। এরপর ফেসবুকে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমালোচনা এবং অন্য গানের সঙ্গে ভিডিও ভাইরাল করার ঘটনায় তৃষা বেশ ক্ষুব্ধ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রোগ্রাম নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তবে যারা ভিডিওটি ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
বিষয়টি নিয়ে ৪২ আবর্তনের ‘র্যাগ রাজা’ সিফাত আল রাব্বানি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নাচটি পরিবেশনের সময় এবং নাচ শেষ হওয়ার পর মুক্তমঞ্চের দর্শকরা কোনো ধরনের বাজে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এরপর ভিডিওটি যারা প্রকাশ করেছেন তারা ভিডিওটিতে কারসাজি করেছেন, এমনকি গানও পরিবর্তন করেছেন। এটি ক্যাম্পাস নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি বাজে ভাইব তৈরি করেছে।’