নিজের ঘরের কথা পরের কাজে লাগতে পারে ভেবে লিখছি। আমি তখন লেখাপড়া করতে গেছি সুইডেনের মালমো শহরে। সপরিবারে সেখানেই বসবাস, আমাদের পুত্র প্রান্ত আনন্দময়কে ভর্তি করা হলো মালমো শহরের এক স্কুলে।
প্রান্ত খুব কম কথা বলতো। নিজে থেকে প্রায় কিছুই বলতো না। প্রশ্ন করলে জবাব দিতো, কিন্তু দেরিতে।
ভিন্ন দেশের বিভিন্ন বাচ্চার সঙ্গে ভিন্ন ভাষায় জীবনের প্রথম পড়ালেখা শুরু। ছেলেটা ঠিক কেমন যেন বেশি বেশি শান্ত। আমরা ওকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। প্রথম প্যারেন্ট মিটিংয়ে টিচারদের বললাম, ‘আমাদের ছেলেটার একটা পারসোনালিটি প্রবলেম আছে। ও খুবই কম কথা বলে, মোটেই আলাপি না।’
শিক্ষকরা শুনলেন, গুরুত্ব দিলেন কি না, বুঝলাম না।
এরপরের প্যারেন্ট মিটিংগুলোতে সাধারণত আমার স্ত্রী যেতেন। একবার স্কুল থেকে অনুরোধ এলো যেন প্রান্তর বাবা আসে। গেলাম। প্রধান শিক্ষকের ঘরে ডাক পড়লো।
কী বলবেন এই নিয়ে চিন্তা হচ্ছিলো। প্রধান শিক্ষক পরপর দুটি ছবি দেখিয়ে বললেন, “একবার প্রান্তর ক্লাসের সবাইকে ‘নিজেকে আঁকো’ টাস্ক দেয়া হলো। ২৩ জনের মধ্যে একমাত্র প্রান্তই জুতার ফিতে এঁকেছে। তার মানে ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ডিটেইল্ড, এক্সক্লুসিভ।
আরেকবার প্রত্যেক ছাত্রকে সমান সংখ্যক বিভিন্ন রঙের কলম দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘যা খুশি আঁকো’। একমাত্র প্রান্তই সবগুলো রঙ ব্যবহার করেছে। বাকিরা আশপাশের পরিচিত নানান বস্তু এঁকেছে, কিন্তু একমাত্র প্রান্তই যা এঁকেছে তা কিছুই না, অথচ তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়, দেখতে ভালো লাগে।”
এরপর তিনি বললেন, ‘মিস্টার হোসেন, আপনি বলেছিলেন প্রান্তর একটা পারসোনালিটি প্রবলেম আছে। আমরা এই তিন মাস ওকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আসলে কম কথা বলা বা আলাপি না হওয়াটা ওর পারসোনালিটি প্রবলেম নয়। এটাই ওর পারসোনালিটি। ও হয়ত জীবনে কম কথা বলবে, কম দৌড়াদৌড়ি করবে, কিন্তু ওর ভাবনা প্রকাশে অন্য কোনো উপায় বের করবে এবং যা হবে মোর ডিটেইলড, মোর বিউটিফুল; অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো।’
দুই বছর পর সবাই ফিরে এলাম। প্রান্তকে রাজধানীর একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি তে ভর্তি করা হলো।
কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখি ছেলে স্কুলে যেতে চায় না। প্রতিদিন স্কুলের সময় এলেই অস্থিরতা বেড়ে যায়। পেটে ব্যথা, বমি, জ্বর। আঁচ করতে পারলাম সমস্যা।
একদিন স্কুলের খাতাগুলো খুলে দেখি অজস্র লাল কালির দাগ। সুইডেন ওকে নিজের মতো করে চিন্তা করা এবং সেইভাবে লেখা শিখিয়েছিল। ও সেটাই এখানে করে সব বিষয়ে জিরো পাচ্ছে!
ওর কাছ থেকে স্কুলে আরও সব নিষ্ঠুরতা আর কর্কশ ব্যবহারের খবর পেলাম। পকেটে একদিন একটা ছোট্ট খেলনা পেয়ে, ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা পড়তে না পারার কারণে (বাইরের আলোর রিফ্লেকশনের কারণে ও যেখানে বসেছিল সেখান থেকে বোর্ডের লেখা পড়া যাচ্ছিল না) কীভাবে ওকে অপদস্ত করেছে, সব জানলাম।
আমি ওকে বললাম, ‘নো ওরি বেটা, স্কুলে যেতে হবে না।’
স্কুল বন্ধ করে দিলাম।
কিন্তু ওর ম্রিয়মানতা যেন আরও বাড়লো, সঙ্গে যুক্ত হলো তোতলামি। ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, ও এক ধরনের সাইকোসোম্যাটিক ডিসঅর্ডারে ভুগছে।
প্রায় চার বছর ও বাড়িতেই থাকলো। পড়ায় কোনো চাপ দিই না। মাঝে মাঝে পাড়ার স্কুলে নিয়ে যেতাম। হেড স্যারকে বলেছিলাম, ‘আপনাকে সব ফিস দেবো, কিন্তু আমার ছেলেকে কোন প্রশ্ন করবেন না, কোনো পরীক্ষা নেবেন না। কেবল মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে আসবো, ইচ্ছা হলে একটু বসবে, না হলে বসবে না।’ বাসার কাছে মতিঝিল বয়েজ স্কুলের মাঠে তাকে বিকেলে মাঝে মাঝে খেলতে নিয়ে যেতাম। এর মাঝে ভর্তি পরীক্ষা হয়, ছেলেরা ইউনিফর্ম পরে স্কুল শেষে বাসায় যায়, প্রান্ত দেখে।
একবার ক্লাস সিক্সের ভর্তি পরীক্ষায় তাকে ‘এমনি এমনিই’ অংশ নিতে বলি। বলি, ‘দিয়ে দেখো, চান্স পেতেই হবে এমন তো না।’
সে পরীক্ষা দেয় এবং চান্স পেয়ে যায়। আমরা বলি, ‘দেখো, স্কুলে যেতে চাইলে যাও, না যেতে চাইলে যেও না।’ প্রান্ত দুলকি চালে স্কুল শুরু করলো। স্কুলে যায়-আসে, মাঝে মাঝে যায় না, পড়ে না। সারাদিন কম্পিউটারে গেইম খেলে, আর একা একা ফাটনাটকি কী সব করে।
এভাবে একদিন এসএসসি পরীক্ষার তারিখ পড়ে, আমরা বলি, ‘দিতে চাইলে দাও, মন না চাইলে দিও না। এমন তো না যে পাশ করতেই হবে।’
সে পরীক্ষা দেয়। প্রথম সারির রেজাল্টই করে।
আমি তাকে তার চেয়ে লম্বায় বড় একটা বোয়াল মাছ কিনে উপহার দিই। স্কুলেই নাইম, রাফি, শাওন, রিফাত, নাবিদ নামে তার বেশ কিছু বন্ধু হয়। তাদেরকেও আমরা পুত্রবৎ স্নেহ করতে থাকি (এখনও করি)।
আমরা চাচ্ছিলাম সে কো এডুকেশন কলেজে পড়ুক। মেয়েদের সঙ্গে মিশুক। তাতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নিজের প্রতি খেয়াল বাড়বে, তোতলামি কাটবে।
সে বুয়েট কলেজে ভর্তি হলো। সেখানে মেয়েরাও পড়ে। আশ্বস্ত হলাম, যাক, ছেলেটা এবার কথা বলা শিখবে।
সে যে কী পড়ে, কখন পড়ে, আদৌ পড়ে কিনা- আমরা বুঝি না। কেবল খেয়াল রাখি মনটা তার আনন্দে আছে কি না। আমাদের মনে হয়, তার বেঁচে থাকাটাই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ‘সফল’ হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এইসএসসির রেজাল্টও হলো উপরের দিকে। তখনও আমরা ওর উপর কোনো প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দিই না। ছেড়ে দিই ওর উপরে, পড়ো যা মনে চায়।
অন্য বিষয়ে চান্স পেলেও সে ভর্তি হলো জাবির আইবিএতে। এই প্রথম তার মধ্যে লেখাপড়ায় উৎসাহ দেখলাম। প্রথম বছরে খুব ভালো করতে থাকলো। ক্যাম্পাসে গান বাজনাও করে, ফটোগ্রাফি করে। অনেক অনেক বছর পর আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তবে একদিন আইবিএর একজন টিচার ফোন করলেন আমাকে। তার মূল কথা হলো, “আপনার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চৌকশ ছেলে, কিন্তু তার রেজাল্ট খুব খারাপ হচ্ছে। বারবার সতর্ক করেও উন্নতি হচ্ছে না। এমন রেজাল্টের কাউকে আইবিএতে রাখা সম্ভব নয়। এই সেমিস্টারে ‘উন্নতি’ না হলে তাকে পরের ইয়ারে উঠতে দেয়া হবে না।”
আবার সেই শিশুকালের আতংক পেয়ে বসলো মনে। ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, আইবিএতে পড়ে আর সে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। এই পড়াটার মধ্যে কেবল উপার্জন আর পুঁজির কায়দা ছাড়া পৃথিবীর জন্যে কোনো উপকার নেই। তাই সে আইবিএতে পড়বে না, বিদেশে পরিবেশ নিয়ে পড়বে।
তথাস্তু। শিশুকালের দুই ক্লাস বাদে সে বাংলা মিডিয়ামেই পড়েছে।
আইইএলটিএসের কোর্সও করেনি, তবে স্কোর করলো আট। বুঝলাম গেইম খেলা আর মুভি দেখা কাজে লেগেছে। ইংরেজি শেখানোর জন্যে বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে অনেক টাকা দিয়ে পড়ানোর দরকার হয়নি দেখে স্বস্তি পেলাম।
প্রান্ত কিন্তু কানাডায় যেতে যেতেও গেল না। শেষে আমেরিকায় গিয়ে জিও সায়েন্স পড়া শুরু করল।
এখন সে তার পড়ালেখা আর কাজে খুব আনন্দ পাচ্ছে। মিলিয়ন বছরের পুরনো একটা ফসিল যখন যখন খুঁজে পায়, তখন তার চোখে যে আনন্দ দেখি, তাতে অন্তর কান্নায় ভিজে যায় আমার।
আজ আর তার তোতলামি, ক্লাসরুম ফোবিয়া, হীনম্মন্যতা নেই। যে বাচ্চাটাকে রাজধানীর এক নামজাদা স্কুল প্রায় খুন করে ফেলেছিল, সে এখন ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের জিও ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের ট্রেজারার।
আইরনি অফ দ্য ফেইট ইজ- যে আইবিএর প্রতি সে একদা ‘আগ্রহ’ হারিয়েছিল, সেইখানেরই এক ছাত্রীর সঙ্গে সে একটা সফল প্রেমও করে ফেলেছে!
সন্তানকে ‘সফল’ হয়ে পিতামাতাকে গর্বিত করতে হবে- এই ধারণা সন্তানের মনে একটা চাপ তৈরি করে। আমরা গোড়া থেকেই বিশ্বাস করেছি, ‘গর্বিত যদি হতেই হয়, নিজেদের কাজের জন্যে হতে হবে।’
‘পিতামাতাকে গর্বিত করার চাপ’ সন্তানের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। সন্তান হলেও আমাদের সবার জীবন আলাদা, আনন্দের অনুভব আলাদা। তাই তাকে বলেছি, ‘live your life, as long as you keep on smiling, I am happy.’
লেখক: জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তরের হিউম্যান রাইটস অফিসার।