আমাদের সিনিয়র ব্যাচের একজন ছিলেন যিনি একাডেমিতে থাকার সময় স্বনামধন্য কে-লাইন (K-Line) কোম্পানির স্কলারশিপ পরীক্ষা দিতে রাজি হননি। একাডেমির ইতিহাসে এমন নজির আছে কিনা আমার জানা নেই।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে আমাদের সময়ে ডেক আর ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঁচ জন করে মোট ১০ জনকে স্কলারশিপ দেয়া হতো। দুই ডিপার্টমেন্টের প্রথম ১৫ জন করে মোট ৩০ জনকে চূড়ান্ত ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হতো। সিলেকশনের দিন সকালে কোম্পানির প্রতিনিধিরা ৩০ জনকে ব্রিফিং দেয়ার পর কারো কোনো প্রশ্ন আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন।
বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ‘কলেজ প্রিফেক্ট’ সেই জহির রায়হান স্যার তখন জিজ্ঞেস করেন, কে-লাইন কোম্পানির কন্টেইনার ছাড়াও অয়েল/কেমিক্যাল, গ্যাস ট্যাংকার আছে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে এসব ট্যাংকার ফ্লিটে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা।
প্রতিনিধিরা উত্তর দেন, একাডেমি থেকে বাছাই করা হচ্ছে কেবল কন্টেইনার জাহাজের জন্য, ট্যাংকার ফ্লিটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তখন স্যার জানিয়ে দেন, উনি ইন্টারভিউ দেবেন না, কারণ উনার ইচ্ছা ট্যাংকারে চাকরি করার।
এটা শুনে একাডেমির কমান্ড্যান্ট স্যার থেকে সবাই অবাক! স্যারের রেজাল্ট ভালো থাকায় স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি ছিল। অনেকেই তাকে বলেছিলেন, এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি, কে-লাইনের মতো কোম্পানিতে জয়েন করা মেরিনারদের কাছে স্বপ্নের মতো।
তবে এরপরেও তিনি ট্যাংকারে জয়েন করার ইচ্ছায় অবিচল থাকেন এবং কোনো স্কলারশিপ না নিয়েই একাডেমি থেকে বের হন। স্যার অবশ্য একাডেমিতে ‘চিফ রেগুলেটিং ক্যাডেট’ ছিলেন এবং তাদের ব্যাচের ‘বেস্ট ক্যাডেট’ নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার পান পাসিং আউটের সময়। উনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে চূড়ান্ত মেধাতালিকায় চতুর্থ হয়েছিলেন।
স্যার কে-লাইন পরীক্ষায় অংশ নেননি শুনে তাদের ব্যাচের প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিল, জহির নিশ্চিত ‘জ্যাকপার্টি’। তা না হলে একাডেমির যে স্কলারশিপের জন্য ক্যাডেটরা স্বপ্ন দেখেন. সেটা তিনি কীভাবে নিজ হাতে দূরে ঠেলে দিলেন! তবে সত্যিকার অর্থে স্যার ছিলেন স্বপ্নবান মানুষ, কোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি নিজের স্বপ্নকে হাতছাড়া করতে চাননি।
পাসিং আউটের ছয় মাস পর স্যার কোনো ট্যাংকারে সুযোগ না পেয়ে বাংলাদেশি কোম্পানি ট্রান্সওশান শিপম্যানেজমেন্টের একটা বাল্ক ক্যারিয়ারে ইঞ্জিন ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
তখন একাডেমিক স্কলারশিপ প্রত্যাখ্যান করার জন্য তার আফসোস হয়েছিল কিনা জানি না। যা হোক, মিশর এঙ্করেজে থাকার সময়ে তিনি একদিন একটি গ্যাস ট্যাংকার দেখতে পেয়ে সঙ্গে থাকা ফিটার সাহেবের কাছে জানতে চান ওটা কিসের জাহাজ।
ফিটার সাহেব জানান, ওটা একটি গ্যাস ট্যাংকার আর সেখানে সব ইউরোপীয়ানরা চাকরি করেন। বাংলাদেশি অফিসাররা এ ধরনের জাহাজে নেই বললেই চলে। এটা শুনে স্যারের স্বপ্ন আরও তীব্র হয় এবং তিনি গ্যাস ট্যাংকারে জয়েন করতে লক্ষ্য স্থির করেন।
জহির রায়হান স্যার ‘বেসিক গ্যাস ট্যাংকার’ কোর্স করার জন্য কাউকে না পেয়ে একা পাঁচ জনের খরচ বহন করেছিলেন। ইন্সটিটিউট এরপর জানায়, গ্যাসের কোর্স করানোর জন্য কোনো ইন্সট্রাক্টর নেই, স্যার কাউকে ম্যানেজ করতে পারলে তাহলেই সম্ভব।
সৌভাগ্যক্রমে স্যারের পরিচিত একজন গ্যাস ট্যাংকার এক্সপেরিয়েন্সড সিনিয়র মেরিনার ছিলেন এবং স্যার অনেক অনুরোধ করে উনাকে ক্লাস নিতে রাজি করিয়েছিলেন। এরপর সিওসিতে গ্যাস ট্যাংকার এন্ডোর্সমেন্ট নিতে গিয়ে দেখেন গ্যাস ট্যাংকার এন্ডোর্সমেন্টের সিলই নাই ডিজিতে। এর কারণ, গ্যাস ট্যাংকারে বাংলাদেশিরা সেভাবে সেইল করেন না।
এরপর স্যারের অনুরোধে সপ্তাহখানেক পর নতুন সিল বানিয়ে ডিজি শিপিং থেকে এন্ডোর্স করা হয়। মানে, গ্যাস ট্যাংকারে জয়েন করার জন্য প্রতিটি পদে পদে স্যারকে নিজ উদ্যোগে সব করতে হয়েছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জন্যই তিনি এতসব বাধা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
জহির রায়হান স্যার সিওসি পাওয়ার পর গুগলে শুধু এলপিজি/এলএনজি কোম্পানি খুঁজে খুঁজে ই-মেইল পাঠাতেন। তবে আশানুরূপ কোনো রিপ্লাই আসছিল না। এরপর আবার বাধ্য হয়ে তিনি একটি বাল্ক ক্যারিয়ারে যোগ দেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, পরে অনবোর্ড ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রমোশন পান।
জহির স্যারের কাজে মুগ্ধ হয়ে কোম্পানির সুপারিন্টেন্ডেন্ট তার পরিচিত অন্য একটি ট্যাংকার কোম্পানির সুপারিন্টেন্ডেন্টকে একটি সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করেন। এরপর স্যার তার পরম কাঙ্ক্ষিত ট্যাংকারে জয়েন করার সুযোগ পান। সেখানে থাকার সময়েও উনি গ্যাস ট্যাংকারের টার্গেটে লেগে থাকেন এবং অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একজন অত্যন্ত আন্তরিক সিনিয়রের প্রচেষ্টায় অবশেষে কাতার গ্যাস কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেয়ার সুযোগ পান।
এসএসসিতে বরিশাল বোর্ডে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করা অত্যন্ত মেধাবী জহির স্যার ইন্টারভিউতে খুবই ভালো করেন এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি ফ্লিট কোম্পানি NAKILAT-এর জাহাজে যোগ দেন।
নাকিলাতে এর আগে কোনো বাংলাদেশি অফিসার ছিলেন না, তাই স্যার জয়েন করার এক মাস পরেই কোম্পানি থেকে তার পারফরম্যান্স জানতে চাওয়া হয় চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। জহির স্যারের মতো রত্ন চিনতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার ভুল করেননি। স্যারের পারফরম্যান্স এতটাই ভালো ছিল যে, ইন্ডিয়ান চিফ ইঞ্জিনিয়ার তাকে ‘এক্সেপশনালি ট্যালেন্টেড’ হিসেবে রিপোর্ট করেন।
জহির স্যার বাংলাদেশি অফিসারদের জন্য কাতার গ্যাসে একজন পাইওনিয়ার। তার একস্ট্রা অর্ডিনারি পারফরম্যান্সের জন্যই নাকিলাতে বাংলাদেশি মেরিনারদের জন্য দরজা উন্মুক্ত হয়।
কিছুদিন আগে আমার এক ক্লোজ ব্যাচমেট কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, মেরিন লাইনে চেষ্টা করলে আর লেগে থাকলে সবই হয়। জহির স্যারের স্বপ্নপূরণের ঘটনাটি সেই কথারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
এ লেখাটি মূলত জহির স্যারের প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে লিখেছি। উনি যে লড়াই করেছেন সেজন্য এই ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।
জহির স্যারের মতো আরও অসংখ্য বাংলাদেশি মেরিনার আছেন, যারা এমন বহু নামি-দামি কোম্পানির দরজা খুলেছেন আমাদের জুনিয়রদের জন্য, আপনাদের প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা।
আপনাদের মতো মেরিনারদের সুনামের জন্যই আমরা জুনিয়ররা এখনও অনেক জায়গায় সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারছি।
এই লেখাটির আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, জুনিয়রদের স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করা। জহির স্যারের মতো তোমরাও নিজের স্বপ্ন আর ইচ্ছায় অবিচল থেকো। এর মানে এই নয়, সবাইকেই অয়েল/গ্যাস ট্যাংকারে জয়েন করতে হবে। কারও স্বপ্ন থাকতে পারে বিদেশি কোম্পানি, কারওবা ক্যারিয়ার, কারও কেমিক্যাল ট্যাংকার, কারও হয়তো কন্টেইনার।
যার যে স্বপ্নই আছে তা পুষে রাখো, পূরণ করতে অবিরাম চেষ্টা চালাতে থাকো, ইনশাআল্লাহ পজিটিভ কিছুই হবে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই ভালো কোম্পানি বা একাডেমিক স্কলারশিপ না পাওয়া মানেই সব শেষ- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
মেরিন একাডেমিতে থাকার সময়ে সিনিয়ররা জিজ্ঞেস করতেন, ‘জুনিয়র্স! হু উইল প্রভাইড ইওর জব?’ আমরা তখন গলা ফাটিয়ে জবাব দিতাম, ‘অনারেবল সিনিয়র স্যার!
তখন মনে মনে ‘বুলশিট’ ভেবে হাসলেও এখন বুঝতে পারছি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আসলেই আমাদের পাওয়া বেশিরভাগ জব অনারেবল সিনিয়র স্যারদেরই দেয়া।
আমাদের মতো জুনিয়রদের জন্য নতুন নতুন পথ তৈরি করা প্রতিটি বাংলাদেশি মেরিনারের প্রতি হাজার সালাম আর অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা।
লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)